এক ছিল বাগান আর সেই বাগানে ছিল একটা পুচকে ফুলগাছ। ফুলের গাছ বললুম বটে তবে সে গাছে আজও একটা ফুল ধরেনি। গাছ বেচারার তাই ভারি মন খারাপ। রোজ সকালে পূব আকাশে লাল রঙ ধরলেই গাছ শুধোয়,
-“আলোদিদি! আমার ডালে কবে ফুল ধরবে বলতে পারো?”
আলোদিদি গাছের পাতায় চুমো দিয়ে চুপিচুপি চলে যায় মাটির ওপর বিছনো সবজে ঘাসের গালচেয়।
গাছ ফোঁস করে দম ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর করবেটাই বা কি? হেঁটে চলে যাওয়ার তো আর পথ নেই। না পথ তো আছে বটেই, পাতায় ঢাকা একফালি পথ ধরে বনের কোথায় যাবে যাও না, কেউ বাধা দেবেনাকো। মুশকিল হলো গাছ তো আর চলে ফিরে বেড়াতে পারে না। তাদের আঁকুনিবাঁকুনি শিকড়গুলো যে মাটির গভীরে চলে যায় জলের খোঁজ করতে। জল ছাড়া কি আর বাঁচা যায়? তোমরা যেমন বাড়িতে গেলাসে জল ধরে ঢকঢকিয়ে খেতে পারে গাছ তো আর অমন করে খেতে পারে না। তাই গাছেরা তাদের শিকড়গুলো দিয়েই পাইপের মতো করে চোঁ চোঁ করে জল খায়, ঠিক যেমন তোমরা কাচের বোতলে পাইপ দিয়ে সরবত খাও তেমনটি। সেই আঁকুনিবাঁকুনি শিকড়গুলোই তো এক জায়গায় ধরে রাখে গাছগুলোকে।
যাই হোক, চলে ফিরে বেড়ানো নিয়ে গাছের বিশেষ মন খারাপ নেইকো। গাছকে তো আর বাজারে চাল ডাল আলু পটল কিনতে যেতে হয় না! এই তো মাটি থেকে জল পেল, আলোদিদি আলো দিল আর বাতাস ভায়া দুবেলাই এসে এত এত বাতাস দিয়ে যায়। এই তিনটি পেলেই গাছ তার পাতার হেঁশেলে ঝপাঝপ খাবার বানিয়ে গপাগপ খেয়ে ফেলে। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করলে তবে না গাছে ফুল ধরবে, ফল আসবে!
এদিকে আমাদের পুচকে ফুলগাছ সবকিছুই নিয়ম মেনে করে তবুও গাছে ফুল আসে না। গাছের মন খারাপ সারে না তাই। বাতাসভায়া আলতো করে শীতল হাত বুলিয়ে দিয়ে যায় গাছের মাথায়। গাছের গা জুড়ায় তবে মনের দুঃখু তো মনেই থাকে। কবে রঙিন ফুল ধরবে ডালে, ডালে। লাল, গোলাপি, হলুদ, কমলা, নীল, বেগনে, রঙবেরঙের।
দিন যায়, রাত যায়, গাছ তো আশা ছেড়েই দিয়েছে ফুল ধরার এমন সময় হঠাৎই একদিন গাছের বড় বড় সবজে পাতায় লাল হলুদ ছোপ ছোপ দেখা দিল। পুচকে গাছ তো ঘাবড়ে একশা! এ কী আজব কথা! সবুজ পাতায় এমনধারা ছোপ কেন? একবার বুড়ো বটগাছের মুখে শুনেছিল বটে যে দূর শীতের দেশে যেখানে বছরে তিনমাস সব বরফে ঢেকে যায় সেখানে নাকি শীত পড়ার আগেই সব গাছের পাতা হলুদ, কমলা তারপর লাল আর সবশেষে শুকিয়ে বাদামী হয়ে নাকি ডাল থেকে খসে পড়ে মাটিতে। তারপর ফাঁকা ডালে বরফ মেখে গাছ দাঁড়িয়ে থাকে যতদিন না ফের গরমের মরশুম আসছে। গরম পড়লে বরফ গললে নতুন সবুজ পাতা গজিয়ে আবার ভরে ওঠে গাছ।
তবে এমনটা তো আমাদের পুচকে ফুলগাছ যে বনের পাড়ায় বাস করে সেখানে হয় না। এখানে সারা বছরই বলতে গেলে গরম, আর মাঝেমাঝেই আকাশে কালো মেঘ জমে জল ঝরে। তাই বড় ছোট সব গাছের ডাল সবসময়ই সবুজ পাতায় ভরা থাকে। ফুলের সময় ফুল ধরে, ফলের সময় ফল ধরে। শুধু আমাদের পুচকে ফুলগাছের কপালেই এমনটি ঘটল। ফুল তো ধরলই না তার বদলে পাতায় আবার এমনতরো দাগছোপ। কোনও অসুখবিসুখ করল না তো ফুলগাছের? ভয়ে থরথর কাঁপে! তবে সেরকম কিছু অসুবিধে তো বোধ করছে না। বরং পাতাগুলো রঙচঙে হয়ে আলোদিদির ছোঁয়ায় বেশ ঝলমল করছে। বাতাসভাইয়ের দোলায় বেশ মাথা নাড়িয়ে খুশি খুশি নাচতে লেগেছে।
এ তো আজব কথা! পাশের নিমগাছকে শুধোয় পুচকে ফুলগাছ। নিমগাছ ডাল নেড়ে বলে,
-“কিজানি বাপু! সেই কোন ছোটো থেকে এত বয়স অবদি এই বনে রইলুম তোমার মতো এমনধারা গাছ এই বনে দেখিনি। ও তোমার কিছু অসুখই করেছে। এমনিতেই তুমি এত পুচকে গাছ, না আছে মোটা গুঁড়ি না বড়সড় শরীর। এ তো মোটেই সুবিধের কথা নয়!”
নিমগাছের মুখের কথা বেজায় তেতো। মিঠে করে কিছুই বলতে পারে না। কোথায় পুচকে গাছকে একটু সাহস দেবে তা না!
ওদের আলোচনা শুনে
ওপাশের বাবলা গাছ কান বাড়ায়, নাক গলায়। সে তো আবার আরেক কাঠি বাড়া। নিমগাছের যেমন তেঁতো কথা কওয়ার রোগ, বাবলার তেমনি খোঁচা মেরে কথা কওয়ার ধাত। সে বললে,
-“আর তুমি বেশি দিন বাঁচবে না পুচকে গাছ। ফুলগাছ না কচু! তুমি হলে গিয়ে আগাছা। তুমি থাকার চেয়ে বরং না থাকাই ভালো। আগাছা আবার কোনদিন কার কাজে এসেছে শুনি?”
নিমগাছ আর বাবলাগাছের কথা শুনে তো পুচকে গাছ ঝরঝরিয়ে কাঁদতে শুরু করল। এত সব আওয়াজে বটগাছ ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে ঝুরি নেড়ে বললে,
-“কী হলোটা কী শুনি? ওই এক পুচকে গাছটাকে তোরা ধেড়ে গাছগুলো অমন করে অকথা কুকথা বলছিস যে বড়? বলি এই বনে কি বড়দের কোনও মান নেই? আমি আশুথ আম জাম আমাদের সামনে তোরা এমন বাজে কাজ করছিস, সাহস তো কম নয়!”
বটের কথায় একটু ভরসা পায় পুচকে গাছ। বট নরম সুরে তাকে বলে,
-“তোমার কোনও ভাবনা নেই পুচকে গাছ। তোমার অসুখও হয়নি বিসুখও হয়নি। এই বনে আগে তোমার মতো গাছ হয়নি কিনা তাই সকলে তোমায় চেনে না। কোনও পাখি হয়ত দূর কোনও দেশ থেকে তোমায় এখানে এনে ফেলেছে। তোমার পাতা যতদিন ছোটো ছোটো ছিল, কচি সবুজ ছিল। এবার যত বড় হবে পাতা তত লাল হলুদ বুটিদার হবে। তুমি কোনও আগাছা নও, তুমি হলে পাতাবাহার বুঝলে?
আর আগাছা হলেই বা খারাপটা কী? সব গাছই কোনও না কোনও কাজে লাগে।”
বনের সব গাছই মন দিয়ে বুড়ো বটের কথা শুনল এমনকি নিম আর বাবলাও। আর কেউ ভুল করেও পাতাবাহারকে রাগালো না একটুও। ফুল না ফুটুক এমন বুটিদার পাতা আর কোন গাছের আছে বলো দেখি এই বনে? এদিকে পুচকে পাতাবাহার তো বেজায় খুশি। গুণগুণিয়ে নামতা পড়ে আর এক দুই তিন চার করে গুণে রাখে কোন পাতায় ক’টা লাল বুটি, হলুদ বুটি হলো।