

আজ দু তিনদিন পর আকাশের ধোঁয়াশা কেটে রোদ উঠেছে। ঠিক রোদ ঝলমল করছে তা নয়, তবু সুখবিন্দর আজ দোকান খুলেছে।
এখন এই এক ঝামেলা হয়েছে। শীতটা পড়ার মুখে কেবল আকাশ ঢেকে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোর চাদরে। কেউ বলে দেওয়ালির চটরপটর আতসবাজির কারণে এই ধোঁয়াশা। আবার কেউ বলে ভিন রাজ্যের গ্রামের কিষানরা শস্য কেটে নিয়ে শুকনো গোড়া নাকি পুড়িয়ে দেয়। সেখান থেকেই শহরে উড়ে আসে এই ধোঁয়া ধোঁয়া ছাই; সেই কারনেই এই দূষিতবাষ্পের বেড়াজালে নাভিশ্বাস ওঠে শহরবাসীর।
ধুলোর পরতের মধ্যে দিয়ে সকালের সূর্যের নরম আলো পৃথিবীতে ঢুকতে পারে না।
কিংবা হয়তো পৃথিবীতে ঢুকতে পারে কেবল এই শহরটারই এই হাল। এই শহরটারই চারদিকে শীতের শুরুতে মাকড়শার ঝুলের মত বিষণ্ণতার চাদর ঝুলে থাকে।
তবে শহরটা কেবলই ম্রিয়মান তা বলাটাও ভুল, এই শহরের অন্যদিকে আবার কত আলোর ঝলমলানি।
শহরের সেইদিকটা আলোকময়, চঞ্চল, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর।
তবে কি শুধু এই মহল্লাতেই শীতের শুরুতে এমন আবছা মনখারাপ ভিড়? কে জানে? ভাবতে বসলে সুখবিন্দরের বৃত্ত কেবল ছোট হয়েই আসে। এই যে পৃথিবী থেকে শহর ঘুরে এইমাত্র সে মহল্লায় এসে পড়ল।
লোকে বলে, এই শহরটা নাকি সাত রাজার রাজধানী। সত্যিই তো দুনিয়াভর লোক আসে এখানকার সেইসব রাজকাহিনীর খণ্ডহর দেখতে।
গোটা শহর জুড়ে নানান যুগের মহল, কেল্লা, প্রাচীর, পরিখার কংকাল। এই শীতে হিমেল যেন এক যুগের পড়ো হাভেলির মধ্যে দিয়ে ভেঙ্গেচুরে ঘুরে এসে অন্য যুগের ধংসস্তূপের মধ্যে মিলিয়ে যায়। মাঝে কেবল পড়ে থাকে বাতাসী হাহাকার।
নিজেদের মহল্লাটাকেও তো মাঝেমাঝে একটা খণ্ডহরই মনে হয় সুখবিন্দরের। যেন কোন একটা মরে যাওয়া সভ্যতার ঘরে, ঘরে বারান্দায় চাতালে রাস্তায় আবছায়া সিলুয়েটের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে আধা জ্যান্ত মানুষের দল।
"আঙ্কেল কুছ পুছনা থা।" দুটো ছেলেমেয়ে, একটা অচেনা কোন এনজিওর নাম বলে।
এও এক ঝামেলা বইকি। আগে আগে সরকারি বাবুরা আসত। লিখে নিয়ে যেত নাম ঠিকানা, হাল হকিকতের হদ্দমুদ্দ। এখন আসে এরা।
এই 'কিছু জানতে চাওয়া' এনজিওর এইসব ছেলেমেয়েদের কী কাজে দেবে জানেনা সুখবিন্দর। সেইসব পুরনো কথা এদের কাছে হয়তো এখন গল্পের বিষয়। কেউ কেউ আবার সিনেমা টিনেমাও নাকি বানাতে চায় শুনেছে ও।
ছেলেটি সুখবিন্দরের মতামতের অপেক্ষা না রেখেই তার জিজ্ঞাসা শুরু করেছে।
"ম্যাসাকার কে টাইম আপ ইসি কলোনি মে রহতে থে?"
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নাড়ায় সুখবিন্দর। দু একটা হুঁ, হাঁ ছুঁড়েও দেয়।
ছেলেটি পরের প্রশ্নে চলে গেছে, "আপকে ঘরমে ঔর কোন কোন লোগ হ্যায়?"
কিরানা দোকানের সামান গুছোতে গুছোতে হঠাৎ থমকে যায় সুখবিন্দর। সেই পুরনো ভয়ঙ্কর ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার থেকেও তো এই প্রশ্নের কাছে সে আরো বিব্রত, আরো দীর্ণ।
সত্যিই এই প্রশ্নের উত্তর কি সে জানে? কে থাকে তার ঘরে? কার সঙ্গেই বা কাটছে তার জীবন?
“এক পাও রাজমা তৌলনা সুখী” ভাঙা ভাঙা গলার স্বরে চমক ভাঙে সুখবিন্দরের।
দোকানের চাতালে এসে দাঁড়িয়েছে বৃদ্ধ গুরশরণ।
ছেলেটি ঝটিতি সুখবিন্দরকে ছেড়ে গুরুশরনের দিকে ফিরেছে। ওরা এবার গুরুশরণকে নিয়ে পড়েছে। সুখবিন্দর দেখেছে এইধরণের প্রশ্নকারীরা বৃদ্ধদের বেশি পছন্দ করে। বৃদ্ধরা হয়তো ওদের চাহিদামত বেশি কিছু গল্পের যোগান দিতে পারে।
সুখবিন্দর সামান্য ওজনের রাজমা মাপতে থাকে। এখানে কেনাবেচা এরকমই। দুশো, আড়াইশো গ্রামের সস্তা সওদা। সাদা কাগজে একটু চা পাতা, দুটো বাসন মাজার সাবানের জেলিপাতা। শরীর গরম রাখতে কখনো কেউ নিয়ে যায় কফিগুঁড়োর পাতলা মোড়ক।
এলাকার লোকের সঙ্গতি দুর্বল। একলপ্তে মাস ভর চলার মত চাল, আটা, ডাল, চিনি কিনে রাখবে এমন লোক কম। বেশিরভাগই হাঁড়ি চড়িয়ে চাল কিনতে আসে। গুরুশরণও সেরকমই লোক।
ছেলেমেয়ে দুটো গুরুশরণের সঙ্গে কথা বলছে। গুরুশরণ চাচা ওদের বলছেন, নিজের কথা, ছেলের কথা, নাতির কথাও। গুরুশরণ চাচার ও অবশ্য একেবারে কেউ নেই তা নয়। এই সেদিন অব্দি তার এক নাতি ছিল।
ছিল মানে খাতায় কলমে আছে। এখনো নেই হয়ে যাবার সরকারি শিলমোহর লাগেনি তার অন্তর্ধানের গায়ে। কিন্তু একবার সস্তা নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে আর ফেরেনি সে।
হয়তো মরে গেছে, নাহয় হয়তো আরও বেশি করে মরে যাবার জন্য হারিয়ে গেছে আরও কোন নেশার গভীর আবর্তে।
অবশ্য থেকেও যে সে গুরুশরনের কিছু উপকার করত তাও নয়, কেবলই বিব্রত হওয়ার সেই স্নেহবন্ধন থেকে দাদু গুরুশরণকে মুক্তি দিয়েছে সে।
গুরুশরণচাচার ছেলেও মুক্তি দিয়ে গিয়েছিল অবশ্য। তিনদিন ধরে দেহের তিন পরত আগুনে ঝলসে হাসপাতাল থেকে আর ফিরে আসেনি। বৌটা আগেই মরেছিল,গরিবের কোন ঘোড়া রোগে। বহুবার বলা কোন আখ্যান গুনগুন সুরে গুরুশরণ বলে চলেছে ওদের।
গুরুশরণের সঙ্গে কথা বলে ওরা চলে গেল রাস্তা পেরিয়ে। হয়তো অন্য আরও কাউকে প্রশ্ন করতে।
মুখে বলিরেখার হিজিবিজি এঁকে গুরুশরণ রাজমা নিতে নিতে বললেন, “মোতিয়াবিন্দ অপরেশন কি ক্যাম্প লাগি হ্যায় সুখী, একদিন চল না হামারে সাথ।”
সুখবিন্দর দেখে গুরুশরণের চোখে যেন দীর্ঘদিনের কোন কষ্টের গমক ছানির মোতিবিন্দু হয়ে জমাট বেঁধে আছে। ছানি রোগের কারণে, নাকি ঐ কষ্টের জন্যই কি গুরুশরণ চাচা চোখে আবছা দেখেন?
হয়তো অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট দেখতে পেতেননা, এখন মোতিয়াবিন্দের অসুখটা ধরা পড়েছে।
সুখবিন্দর মাথা নেড়ে সায় দেয়। মুখে বলে, “কব যানা পড়েগা একবার বোল দিজিয়ে গা। চলেঙ্গে হম”
রাজমা নিয়ে গুরুশরণ চলে যাচ্ছেন।
অশীতিপর বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে সুখবিন্দরের মনে হল ও সঙ্গে যাবে শুনে গুরুশরণের অবয়বে একটু হলেও স্বস্তির ভাব এসেছে।
সারা জীবন যে যতই দৌড় করুক না কেন এই স্থবির বুঢ়াকালে মানুষের একটু সঙ্গ লাগে, পরিবারের প্রয়োজন হয়। রোগে, দৈনন্দিন প্রয়োজনে, একাকীত্বে এমনকি এই সামান্য শীতের কামড় থেকে বাঁচতেও যে উষ্ণতা প্রয়োজন হয়, সেই উষ্ণতা আগুন থেকে পাওয়া যায় না।
সেই উষ্ণতার খোঁজেই মানুষ জোট বাঁধে, সংসার করে, বংশ বাড়ায়।
এই মহল্লায় সেই উষ্ণতার বড় অভাব।
সেই মানুষে মানুষে ঘিরে থাকা সম্পর্কের ওমের বড় অভাব। এখানে পরিবারগুলোতে যত্র তত্র ছিঁড়ে যাওয়া সোয়েটারের মত গর্ত। শীত তাই এখানে যেন আত্মাকেও কাঁপিয়ে দেয়।
এই যে গুরুশরণের নাতিটা অনাথ ছিল, তাই বলে কি একা গুরুশরণের নাতিই অনাথ ছিল? তা নয়। উপযুক্ত ছেলে মরলে বৃদ্ধ বাপও তো অনাথ হয়।
এরকম অনাথ বেসাহারা ছেলে, আর অশক্ত অসহায় বাপ, মা এই মহল্লার ঘরে ঘরে।
“সুখী, বেটা উপর আ যা রোটি বন গ্যই” উপর থেকে রাজবির কৌর ডাক দেন।
সুখবিন্দর দোকান থেকেই ঐ ডাক শুনতে পান।
রাজবীর ডাকতে শুরু করলে সহজে থামবেন না। আবার ডাকলেই যে আবার রাজবীর সত্যিই রোটি সব্জি বানিয়েছেন তারও নিশ্চয়তা নেই।
খালি থালা বাটি, চকচকে হাঁড়ি পাতিল সামনে রেখেও তিনি ডাকতে পারেন, “সুখী আ যা; রোটি বন গয়ই; আ যা জলদি আ যা”।
সুখবিন্দরকে শেষে যেতেই হয়। এই বয়সে যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব।
সুখবিন্দর না গেলে রাজবীরের এই ডাকাডাকি ক্রমশ বাড়ে। শেষটায় ডাকাডাকিটা আর্ত চিৎকার হয়ে এই অবসন্ন মহল্লাটার বেদনা যেন আরও বাড়িয়ে তোলে।
তাই রাজবীর ডাকলেই সুখবিন্দরকে যেতে হয়। সবাই তো আর গুরুশরণ চাচার নাতির মত হতে পারেনা। সুখবিন্দরও পারেনি।
রাজবীরের ডাকে সাড়া দিতেই হয় সুখবিন্দরকে।
রাজবীরের চিন্তা-চেতনে সত্যি-মিথ্যেয়, বাস্তবে-কল্পনায়, অতীতে-বর্তমানে একটা গোলমেলে গিঁট পড়ে গেছে।
মনের ডাক্তার দেখালে, চিকিৎসা করালে হয়তো সারতো। কিন্তু সুখবিন্দরের এই কিরানা দোকানের সামান্য আয়ে সেই মনোরোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ তোলা দায়।
মনের রোগের চিকিৎসা টিকিৎসা কেউ করালে এসব মহল্লায় তাকেই পাগল বলবে। এখানে চোখের ছানি, পেটের পাথর কি অ্যাপেনডিক্সের মত মাঝারি রোগের জন্য লোকে ডাক্তার দেখায়। সামান্য রোগভোগকে এরা পাত্তা দেয় না। ঘরোয়া টোটকা করে। রোগটা যতক্ষণ না যন্ত্রণার অজগর হয়ে ছোবল মারে ততক্ষণ এরা ডাক্তারমুখো হয় না। তারপর মাঝামাঝি রোগভোগে কিছুটা ওষুধ টশুধ খায়, ছোটখাটো কাটাছেঁড়া, অপরেশন করে। তারপর রোগটার বাড়াবাড়ি হলে আবার সব ছেড়ে দেয়। ভগবান ভরসায় ঘরোয়া টোটকা করে।
সেইদিক থেকে দেখতে গেলে রাজবীরের রোগটা সেরকম ভয়ানক কিছু নয়।
অন্তত এখানের মানুষের কাছে তো নয়ই।
এই কথায়, চিন্তায়, ব্যবহারের গিঁট নিয়েই এখানে বেঁচে মরে থাকে মানুষ।
দু একজন খরিদ্দার আসছে, যাচ্ছে।
দুটো চেয়ার সামনের চাতালটায় বের করে রাখল সে।
খরিদ্দাররা এসে এখানে বসবে এরকম নয়। তাদের সবসময় তাড়া থাকে। এখানে এসে বসবেন , গুরুবক্স, বলভিন্দর, বিষাণজিতরা। এঁরা কেউই সুখবিন্দরের ইয়ার দোস্ত নন, দোকানের খরিদ্দারও নন।
এঁরা এই দোকানটির সামনে একটু জিরিয়ে নেন। টুকরো টুকরা কথা বলেন।কারো হাঁটুর ব্যথা, কারো নাতির জ্বর, কারোকে আবার যেতে হবে বোনের বাড়ি ।
কিন্তু শীতপয়লায় এঁদের কথার ভঙ্গি কেমন যেন পাল্টে যায়। প্রত্যেকের মধ্যেই একটা ত্রস্ত হাবভাব, যেন গভীর কোন কাজের নীল নক্সা তৈরি করছেন তাঁরা। হাতে থাকে কয়েকটি প্রাচীন ফাইল।
কোন শীতে গুরুবক্স হয়তো বলবেন, "ইনসাফ এবার মিলবেই।"
বলভিন্দর বলবেন, "আখেরি দম তক হম উম্মিদ রাখেঙ্গে"
বিষাণজিত বলবেন, "আরে বরবাদ তো হম হো হি গ্যয়ে, লেকিন লড়না নেহি ছোড়েঙ্গে"
তারপর কদিন সেই প্রাচীন ফাইলগুলি আর খবরের কাগজের কাটিংগুলো নিয়ে ওঁরা আবার নিজেদের মধ্যে ডুবে যাবেন।
সুখবিন্দর হয়তো তখন আধাকিলো ভাঙা বাসমতির চাল বা এককিলো চিনি মাপতে মাপতে কান পেতে থাকে ঐসব আলোচনায়।
পরের শীতে, যখন সকলের বয়স একবছর বেড়ে যাবে, তখন আবার হয়তো বলভিন্দর বলবেন, "ইনসাফ এবার মিলবেই।"
গুরুবক্স বলবেন, "আখেরি দম তক হম উম্মিদ রাখেঙ্গে"
বিষাণজিত বলবেন, "আরে বরবাদ তো হম হো হি গ্যয়ে, লেকিন লড়না নেহি ছোড়েঙ্গে"
ধরমপাল ধরা বলবেন, এয়সি হি সর্দি দি। ঠান্ড যাদা নেহি থি, লেকিন ওহ্ তো এয়সে আগ জ্বালা দিয়ে কি সব গেরস্থি উজাড় গ্যয়ে"
আবারও তাঁরা পোতার বুখার বা ঘুঁটনে কি দর্দ এর কথা ভুলে গিয়ে নীচু প্রাচীন স্বরে আলোচনার নীলনকসায় ডুবে যাবেন।
সুখবিন্দর এরকমই দেখছে শীতের পর শীত, বছরের পর বছর।
এই আলোচনা দীর্ঘদিন আগের এক শীতের অভিশপ্ত আখ্যানকে ঘিরে সুবিচারের শান্তিপ্রলেপ খোঁজার পরিক্রমণ।
বৃদ্ধদের এই প্রতি শীতের গোলবৈঠক একই জায়গায় এসে শেষ হয়।
ওঁরা ইনসাফ খুঁজতে থাকেন। আর সুখবিন্দরের দোকানের মাসকলাইয়ের বস্তায় একটু একটু করে কমতে থাকে সবজে কলাই।
এই শীতের শুরুতেই তাই এই চেয়ারগুলো পেতে রাখার খুব দরকার।
রাজবীর ওপর থেকে ডাকতেই থাকেন; নীচে দোকানে চাল ডাল মাপতে মাপতে সুখবিন্দরের মনে হয় আগের শীতগুলো এরকম ম্লান ছিল না।
তার দোকানের সামনের এই চাতালেই বাচ্চারা খেলত। লেবুর আচার রোদে দিত রাজবীর।
বছর কয়েক আগে তেমনি এক শীতের সকালে নিজের কর্মক্ষেত্রে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলেন এই দেশের এক প্রভাবশালী নেতা।
সেদিন হঠাৎ শীতে একটু বেশীই কি গা শিরশির করে উঠেছিল তাঁর? একবার মনে হয়েছিল সামনে না এগিয়ে যে দিক থেকে এসেছিলেন আর এক বার সেদিকে ফিরে যাবেন? কিছু কি ফেলে যাচ্ছিলেন তিনি সে দিন? কোন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস? কোন স্মৃতি? বা নিদেনপক্ষে কোন বেদনা?
নাহ, রোজকার মতই সোজা হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু তাঁর থেকেও সোজা গতিতে ছুটে এসেছিল কয়েকটি গুলি, আগুনে মৃত্যুদূত । দুজন বন্দুকবাজের হাতে খুন হয়ে গেছিলেন সেই জনপ্রিয় মানুষটি।
দেশের অন্যসকলের মতোই এই মহল্লার রাজবীর, হারলীন, গুরমিতরা রসুই এর পরাঠা, আচার বানানো ছেড়ে দিয়ে রেডিওর সামনে জড়ো হয়েছিলেন। পুরুষরাও কেউ কেউ কাজে বেরোতে গিয়েও ঘটনার অভিঘাতে স্তম্ভিত হয়ে বসে পড়েছিলেন ঘরের চৌপাইতে।
টিভি তো তখন আর ঘরে ঘরে ছিলনা। একেকটা ঘরের টিভির সামনে জড়ো হয়েছিল বহু মানুষ। গোটা শহর জুড়েই উত্তেজনা আর শোকের চাপা হাঁপটান।
তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচার হতে ওঁরা চোখে চুনরি চাপা দিয়েছিলেন কেউ কেউ।
সুখবিন্দরের স্মৃতি আজকাল মাঝেমাঝেই প্রতারণা করে। একটা দমচাপা আকুতি ছাড়া আর কিছুই যেন মনে নেই ওর। পরে পরে শুনেছে ও এই আহাজারি।
গুরমিত চাচি বলেছিলেন, “ মাতন হম ভি মানায়ে থে; ঘর কে বেটা জো থা ওহ।”
কিন্তু সেই মাতন যে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে গোটা মহল্লায়, শহর থেকে শহরে, দেশের আনাচে কানাচে ওরা ভাবতেও পারেননি।
সেই মাতন, যা সুখবিন্দরদের গোটা কৌমের গায়ে দেগে দিয়েছিল এমন জ্বলন্ত উল্কিছাপ, যে প্রতিটা শীত এই মহল্লায় ঢোকার আগে এখনো থমকে দাঁড়ায়।
ঐ নেতার হত্যার পিছনে ছিল গূঢ় রাজনৈতিক চক্রান্ত। সেই ষড়যন্ত্রের শেষ ঘুঁটি ঐ বন্দুকবাজ দুটির জাত পরিচয় সুখবিন্দরদের সঙ্গে এক হয়ে গেছিল।
কিন্তু সত্যিই কি খেটে খাওয়া আমমানুষের অত উপরতলার শতরঞ্জের খেলায় কোন দায়ভাগ থাকে? শুখি রোটি, ফাটা কাপড়া আর একটু ছাদ জোটাতেই তাদের হাঁসফাঁস।
এরপরই ঝাঁকে ঝাঁকে কারা সব এসেছিল গোটা কৌমের ওপর বদলা নিতে।
শীতের রাতে দাঙ্গার আগুন জ্বলেছিল। আর সেই আগুনে পোকামাকড়ের মত পুড়ে মরেছিল মহল্লার মানুষগুলো।
যদিও বয়স্ক মানুষ গুলো এখনো আইনি ইনসাফ খুঁজে বেড়ান, তবুও সেই থেকে এই কলোনিতে সারা বছরই ভিজেভিজে কষ্টজড়ানো শীত। এই মহল্লায় কখনো কালচে রক্তমাখা তুলোর মত হালকা শীত, কখনো আবার চিটচিটে আলকাতরার গড়ানে ঠাণ্ডা আবার কখনো একটুকরো জ্বলন্ত কয়লার মতো লালমুখো কালো বেদরদি সর্দি।
সুখবিন্দরও পালিয়েছিল সেই দাঙ্গার রাতে, এলাকার অন্য পুরুষদের সঙ্গে। ঘরে ছিল রাজবীর আর ওদের আট বছরের ছেলে সুখদেব। সেইরাত্রে মারণযজ্ঞের পর সে ফিরেও এসেছিল। ডামাডোলে কিভাবে যে কেবল তার প্রাণটা বেঁচে গেছিল কে জানে!
কিন্তু রাজবীর ওকে চিনতে পারেনি।
সেইরাতে ওরা রাজবীরের কোল থেকে ওদের ছেলেটাকে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল দেওয়ালে। ছোট্ট মাথাটা ফট করে ফেটে গিয়ে হয়তো মহরৎ হয়েছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞের।
কত মানুষ যে মারা গিয়েছিল আগুনে, গুলিতে, বোমায়।
তারপরের ঘটনা আর ধারাবাহিক ভাবে মনে রাখতে পারেনি রাজবীর। সন্তানের মৃত্যুর কথা কখনো বলেওনি কিছু। চিনতেও কি পেরেছিল সুখবিন্দরকে?
পরদিন ভোরে, রক্তকাদা মাখা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘোলাটে চোখে রাজবীর বলেছিল, “বেটা তু আ গ্যয়া?”
তারপর থেকে দেওয়ালের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়েছিল। সেইদিন, দিনের পর দিন।
সুখবিন্দরকে অবশ্য কোনদিন খোঁজেনি ও।
আত্মীয়স্বজন পড়সিরা বলেছিল বটে আর একটি সন্তানের কথা। তাহলে হয়তো রাজবীরের এই থম ধরে থাকা ভাবটা কাটবে। একটি সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেকটির দুঃখ ভুলবে।
কিন্তু রাজবীরের দুঃখের গোলকধাঁধায় তো আটকে আছে সুখবিন্দরও ।
রাজবীর কি সন্তানহীনা? না কি বিধবা? রাতে চমক ভেঙ্গে উঠে যে রাজবীর সুখবিন্দরকে জড়িয়ে ধরে সে তো আসলে সুখদেবকে খোঁজে।
খালি হাঁড়ি, পাতিল ছড়িয়ে আসলে সে মৃত সুখদেবকে খেতে দেয়। সারাদিন সুখদেবকেই ডাকে ইনিয়ে বিনিয়ে।
সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে অস্বীকার করতে চায় নিজের চোখে দেখা সন্তানের মৃত্যু।
সেই মায়ের মাতৃস্নেহ মাখা শরীরটিতে দাম্পত্য কামের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারেনি সুখবিন্দর। কে জানে সেই কামবিবশ মুহূর্তে, রাজবীরের ঘোলাটে দুটো চোখের তারায় সুখবিন্দরের জায়গায় সুখদেবের মুখটাই ভেসে উঠবে কি না?
ভেবেই আশিরনখ শীতল ভয়ে কেঁপে উঠেছে সুখবিন্দর। তখন ঐ চোখের তারার ছায়া পেরিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের কোথায় লুকোবে সে?
আর সন্তান আসেনি সুখবিন্দরের।
কেউ জানে না, এতগুলো বছর সুখবিন্দর একই ঘরে নিজেরই বিধবার সঙ্গে, নিজেরই সন্তানের খোলসে ঢুকে বেঁচে আছে।
রাজবীরের গলার স্বর ক্রমশ বিলাপে বদলে যাচ্ছে। থেকে থেকেই ডেকে উঠছে, “সুখী, ও সুখী, ও ও সুখীইইই……
সুখবিন্দর আর নীচে থাকতে পারে না।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে। ছেঁড়া কম্বল ঢেকে এলোমেলো বসে থাকা রাজবীরকে দেখে সুখবিন্দরের মনে হল, এবার এনজিওর ছেলেগুলোকে আর এড়িয়ে যাবে না। ওরা আসলে বলবে, ওর সঙ্গে যে থাকে সে একজন ‘শীতবিধবা’।
স্মৃতির ভুল্ভুলাইয়ায় হারিয়ে যাওয়া একজন ‘শীতবিধবা’।
দীমু | 223.19.***.*** | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৪৮519053
প্রতিভা | 2401:4900:104b:fb03:0:54:7c78:***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:১৪519068
kk | 2601:14a:500:e780:3946:17e4:36b1:***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:২৯519075
Manjulika Ray | 2405:201:4014:7071:7846:6ccc:da0:***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ২০:২৬519084
মিতা ঘোষ | 203.17.***.*** | ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:৫৯519101
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী | 2409:40e1:22:8aa:cca5:21ff:fe44:***:*** | ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ১২:০৫519110
স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:২৭519141
বিমান মৈত্র | 103.***.*** | ১১ মে ২০২৩ ২১:২৫519684