আমার এক বন্ধু শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। আমাদের কাছে তখন শাবিপ্রবি মানেই জাফর ইকবাল। আমরা যারা জীবনে সিলেটেই যাই নাই তাদের কাছে সিলেটে না শুধু ও বিশাল কিছু। কারণ ও শুধু সিলেটেই থাকে না, ও শাবিপ্রবিতে পড়ে, সকাল বিকাল জাফর ইকবালের সাথে দেখা হয়! কত সৌভাগ্যবান ভেবে খুশি হই। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখি ওই ছেলের হাবভাব সুবিধার না। কথাবার্তা কয় কেমন জানি করে। এবং একদিন মুখ খুলে বলেই ফেলল ওর সমস্যা জাফর ইকবালে! ও জাফর ইকবালকে পছন্দ করে না। একজন পছন্দ না করতেই পারে। কিন্তু ঠিক কী কারণে? জাফর ইকবাল ঠিক কী করেছে? কোন ক্ষতিটা করছে? নানা কথা কয় আসল কথা কয় না। একদিন ভালমত ধরতে বলল ওরা কোন একটা ভাস্কর্য বানাইছে ম্যালা কষ্ট করে, ওইটা উদ্বোধনের দিন জাফর ইকবাল হাজির! সব কৃতিত্ব না কি সে নিয়ে নিছে! খুব অন্যায় হয়েছে!
এই জন্য আজ পর্যন্ত ও গালিগালাজ করে যাবে? এইটা বিশ্বাসযোগ্য কথা? আমি তখনই বিশ্বাস করি নাই, এখন তো করিই না। আজ পর্যন্ত কোন বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপাত্ত দেখাইতে পারে নাই যে জাফর ইকবাল ঠিক এই অন্যায়টা করছে, এইখানে টাকা মারছে, এইখানে কথার বরখেলাপ করেছে। কিন্তু পছন্দ করে না। আমার বন্ধু রনি তখন বেঁচে, আমাকে একদিন ধমক দিল, বলল তুমি ওর সাথে জাফর ইকবাল নিয়ে তর্ক কর কেন? এইটা তো সহজ সরল সমীকরণ যে ও শিবির করে বা ওই মানসিকতার! রনি না বলার আগ পর্যন্ত আমি আসলেই বুঝি নাই। ভালো ছেলে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ করে, আমাদের শোনায় ও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ করে, আরও কত কথা। রনি তখন রাজশাহী পড়ে, ও শিবিরদের রগে রগে চিনে। তাই ও সহজেই বুঝে গেছে এই ছেলে শিবির মানসিকতার। আমি এরপরে সাবধান হয়ে যাই। আর কোনদিন ওর সাথে এইটা নিয়া তর্ক করি নাই। ও মাঝে মধ্যে ইনবক্সে জাফর ইকবাল সক্রান্ত নানা জিনিস দেওয়ার চেষ্টা করত। কী সেগুলা? জাফর ইকবাল কোন পার্টিতে নাচতেছে এই ছবি বা ভিডিও, উনার মেয়ে কোন পার্টিতে ড্রিংক করছে তার ছবি বা ভিডিও! এই হল জাফর ইকবালের অপরাধ!
শেরপুরে ফিরে আসার পরে শেরপুর জিমে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হল। ওই ছেলে শাবিপ্রবিতে পড়েছে। যথারীতি জাফির ইকবালকে দেখতে পারে না। তখন আমিও দিন দুনিয়া চিনি। কথাবার্তায় বুঝলাম শিবিরের ছেলে। যেহেতু নিজের শহর আর জিম হচ্ছে আমার স্টেডিয়ামে, যা আমার বাড়িঘরের মতো ছিল এক সময় তাই একদিন কথার ফাঁকে ধরলাম, কেন পছন্দ না। কোন কারণ নাই, ভালো লাগে না ভাই! এর তো কোন জবাব নাই! তবে এই ছেলে সৎ ছিল। বলছে ভাই পছন্দ না কিন্তু এইটাও ঠিক উনার মতো শিক্ষক আমি কোনদিন দেখি নাই। বলল ভাই যত সমালোচনা দেখবেন অন্য নানা জিনিস নিয়ে। কেউ কোনদিন জাফর ইকবাল সম্পর্কে উনার পড়ান বা উনার শিক্ষকতার কোন গাফেলতি নিয়ে একটা শব্দও বলতে পারবে না। বলে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কত জ্ঞানী গুণী মানুষ আছে, শিক্ষক আছে। দেখবেন এরা ক্লাস নিতে গিয়ে ব্যারাছ্যারা লাগায় দেয়। সময় মতো পরীক্ষা নিতে পারে না। কোর্স শেষ করতে পারে না। আজ পর্যন্ত জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে এমন একবারও হয় নাই! উনি যখন শিক্ষকতা করেছে তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল, আওয়ামীলীগও ছিল ক্ষমতায়। সকাল বিকাল তারে মারতে যায় কেউ না কেউ। দুই দলের লোকজনই তাঁকে পছন্দ করে না। তখন সমানে হরতাল হত দেশে। অথচ উনি ঠিকই কোর্স সময়মত শেষ করেছেন, প্রতিবার। জাফর ইকবাল ঘড়ি ধরে ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত। ঠিক সময়মত তিনি ক্লাসে ঢুকে যেতেন!
শিক্ষক হিসেবে তার কোন ব্যর্থতা নাই। ছোটখাটো থাকতে পারে, মানুষ যেহেতু! কিন্তু মোটা দাগে কোন দাগ নাই। সমস্যা কই? সমস্যা হচ্ছে এই লোকটার অকৃত্রিম দেশপ্রেম! উনি বলেন এই দেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান দিয়ে, স্বীকার করে রাজনীতি করতে হবে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় সমালোচনা করেন শিবিরের রাজনীতির। জামাতের টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত, এর এক সাংবাদিক গেছে উনার সাক্ষাতকার নিতে। তিনি ওই ছেলে সোজা বলে দিলেন তিনি জামাতের কোন চ্যানেলকে সাক্ষাতকার দিবেন না। তিনি পত্রিকায় কলাম লিখলেন তোমরা যারা শিবির কর নামে। শিবির আজ পর্যন্ত ওই লেখার কথা ভুলতে পারে না! তিনি ছাত্রলীগকে সমালোচনা করে লিখেছেন বহুবার। কিন্তু কেন জানি সেগুলা সামনে আসে না মানুষের। মানুষ ধরেই নেয় এই লোক আওয়ামীলীগের। অথচ ছাত্রলীগ জয় বাংলা বলেই শাবিবপ্রবির এক আন্দোলনে শিক্ষকদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে, জাফর ইকবালের ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে!
লোকটা মানুষ। ভুল ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি যা না তা বলে তার সমালোচনা করে যাচ্ছে মানুষ। আমার নিজের কাছে মনে হয় জঙ্গিদের কোপ খাওয়ার পরে তিনি একটু দমে গেছেন। দুইজন পুলিশ কনস্টেবল সব সময় সাথে থাকে তার। তিনি আগের মতো কঠিন কথা বলতে পারেন না। আর এই সুযোগে আওয়ামীলীগ সরকার তার এবং দেশের সর্বনাশটা চূড়ান্ত ভাবে করেছে। লোকটাকে সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে গেছে। আমার সাস্ট জীবন বইয়ে জাফর ইকবাল লিখেছেন, আমি জানি না মন্ত্রী পর্যায়ে কেউ কথা দিয়ে কথা রাখলে একজনের কী করা উচিত! কার কাছে যাব? কাকে বলব আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিলেটে পাঠানো হল ছাত্রদের অনশন ভাঙ্গানর জন্য সেই প্রতিশ্রুতির কী হল? প্রথম প্রথম তিনি ফোন দিতেন খোঁজ নেওয়ার জন্য। যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি ব্যবহৃত হয়েছেন, সরকার কথা দিয়ে কথা রাখবেন না, তখন তিনি চুপ হয়ে গেছেন। বইয়ে লিখে গেছেন কষ্টের কথা। অথচ মানুষ শুধু তাকেই গালি দিয়ে গেছে, তাকে যারা ব্যবহার করে গেছে তাদেরকে বলার সাহস কেউ করে নাই।
সর্বশেষ সর্বনাশ হল তিনি কোটা আন্দোলনের তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার স্লোগান শুনে যখন তিনি বলেন তিনি আর কখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান না। এই নব্য রাজাকারদের মুখ দেখার কোন ইচ্ছা নাই তার, এইটা যখন বললেন। তখনকার বাতাস অন্য রকম। জামাত শিবিরের প্রোপাগান্ডা তখন তুঙ্গে। ওরা যা বলছে তাই বিশ্বাস করছে মানুষ। মুহূর্তে জাফর ইকবালের শুভাকাঙ্ক্ষী যারা ছিল তারাও মুখ ফিরিয়ে নিলো। সুস্থ চিন্তা ধারার কতজনকে আমি বুঝানোর চেষ্টা করছি যে লোকটাকে বুঝতে হবে একটু আলাদা ভাবে। সাধারণ পাল্লায় জাফির ইকবালকে মাপতে গেলে কোনদিনই হিসাব মিলবে না। তখন আমার কথা সবাই বাঁকা চোখে দেখেছে। আল্লার কী কাম! এখন সেই সকল মানুষ সকাল বিকাল চিল্লাচ্ছে যে জাফর ইকবালই ঠিক ছিল বলে!
এইটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এইটা না হলে দেশের যে পরিস্থিতি, এতে উনি কথা বলতেন এগুলা নিয়ে। আর এখন কথা বললেই সর্বনাশ! এবার আর রক্ষা হত না। কারণ এখন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়ও নিবে না নোবেলম্যানের সরকার। বেঘোরে মারা পড়তেন তিনি। তিনি চুপ আছেন, ভালো আছেন! গতকাল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে জামাতের লোকজন! এই স্বাধীন বাংলাদেশে! কেন? তিনি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছেন বিজয় দিবসের পোস্টারে আবু সাইদের ছবি কেন? তিনি যা করছেন করেছেন, ওইটার সাথে বিজয় দিবসের সম্পর্ক কী? মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক কী? এই কথাগুলো মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছেন। এই অপরাধ! জুতার মালা পরিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে! ইউনুস সরকারের প্রেস সচিব বলেছেন তার নামে নয়টা মামলা আছে তবে এই কাজটা ভালো হয়নি! মামলার কথা বলে জুতার মালা পড়ানকে জায়েজ করার চেষ্টা!
এই যখন অবস্থা তখন জাফর ইকবাল চুপ করেছেন এইটাই ভালো না? উনার কোন হেনস্তা তো আমাদের সহ্য হত না! আমারা তো কিছু করতে না পেরে জায়গায় বসে মরে যেতাম, তাই না? তাই চুপ আছেন, এইটাই ভালো।
বাংলাদেশ চির ঋণী হয়ে থাকবে ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলা, মুক্তিযুদ্ধকে বাচ্চাদের মনের কোনে রোপণ করে দেওয়ার কাজ তিনি সাফল্যের সাথে করে গেছেন। দেশে গণিত অলিম্পিয়াড চালু করার মূল কারিগর তিনি। তিনি আরও কত যে এমন কাজ করে গেচ্ছেন তার আসলে এখন হিসাব করে বের করা উচিত। আমি আমার কথা বলতে পারি। দেশ জাতি মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু এই সব নিয়ে কোনদিন খুব বেশি কিছু ভাবি নাই। ক্লাস এইটে জেলার সরকারি গ্রন্থাগারের সদস্য হই। একদিন হাতে আসে জাফর ইকবালের কলাম সমগ্র। আমার দৃষ্টিভঙ্গি সেদিন থেকে পরিবর্তন হয়ে গেল। এর আগ পর্যন্ত উনার কিশোর উপন্যাস, সাইন্স ফিকশনে বুঁদ হয়ে ছিলাম। কিন্তু কলাম গুলো আমাকে যেন চোখ খুলে দেয়। সেই শুরু, আজ পর্যন্ত তাঁর প্রতি মুগ্ধতা কাটেনি আমার।
আমার যে বন্ধু জাফর ইকবালকে অহেতুক সমালোচনা করত ও আমাকে জাফর ডাকে! এইটা যে আমাকে সম্মান দেয় এইটা হালায় বুঝে না। ও ভাবে আমি এতে রাগ পাব! আচ্ছা, ও কী কই? ও এখন আমেরিকায়। একবার দেশে আসলে জিজ্ঞাস করেছিলাম পড়াশোনা শেষে কী ইচ্ছা, দেশে আসবি? ওর উত্তর শুনে বমি চলে আসছিল আমার। অথচ এই ছেলে জাফর ইকবালের অহেতুক সমালোচনা করে, যে জাফর ইকবাল ওর বহু আগে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের একটা গরিব দেশের তারচেয়ে একটা গরিব একটা গরিব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চলে আসছেন! দুনিয়া এক আজব জায়গা আসলেই।
শেষ করি জাফর ইকবালকে নিয়ে লেখা বিখ্যাত একটা কবিতা দিয়ে। মৃদুল আহমেদ নামের এই ভদ্রলোকের এই কবিতা আমি বহুবার বহু জায়গায় শেয়ার করেছি। এখানে আজকে আবার দিচ্ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে এইটা জাফর ইকবাল সক্রান্ত যে কোন সমস্যার উত্তর!
"সমস্যা কই" / মৃদুল আহমেদ
কও তো মিয়া সমস্যা কই? সিনায় ব্যথা ? ঠ্যাঙ্গে গোদ ?
কোষ্ঠ কঠিন ? জিব্বাতে ঘা ? রাইতে হঠাৎ পাকছে পোদ ?
বুক ধড়ফড় ? বিশাল পাথর ? ...জমছে মূত্রথলিতে ?
এইচআইভি ? হোটেল ছিলা মগবাজারের গলিতে ?
সমস্যা নাই ? আইছো কেন ? সময় অনেক সস্তা, না ?
চেহারাখান দেখতে আহো ? রূপ কি আমার মস্তানা ?
খাড়ায়া থাকো, আইবা পরে আবার তোমায় ডাক দিলে --
আপনে আহেন ! কোথায় জখম ? বুকে ? খতরনাক দিলে ?
জখম তো নাই ! প্যাডের পীড়া ? বিছনা ভিজে ঘুমাইলে ?
গোপন অসুখ ? হয় না খাড়া পরের বউরে চুমাইলে ?
কোমর টাটায় ? সর্দি নাকে ? চিপায় চাপায় খাইজ্যানি ?
মাথার ব্যারাম ? নিজের লগে নিজেই করেন কাইজ্যা নি ?
সমস্যা নাই ? তাইলে মিয়া চেয়ারডারে চ্যাটকায়া
সকাল থিকা বইসা ক্যানো আমার দিকে ভ্যাটকায়া ?
সবাই আহেন ! সবাই আহেন ! সমস্যা কী ? কইন না ভাই !
মেয়র কাকা ? মার্ক্সবিবাদি ? জাতের উকিল মইন্যা ভাই ?
কারোই দেখি সমস্যা নাই !
জামাত-শিবির ? সমস্যা নাই !
লীগের ঘেঁটু ? সমস্যা নাই !
ন্যাপের জেঠু ? সমস্যা নাই !
মেয়র কাকার ? সমস্যা নাই !
নিউজপেপার ? সমস্যা নাই !
চেয়ারম্যানের ? সমস্যা নাই !
বৃক্ষপ্রেমী ? সমস্যা নাই ?
তাইলে তোগোর সমস্যা কই ? চেইতা গিয়া জিজ্ঞালে ...
সবটিয়ে কয় ... "সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে !"
শুভ জন্মদিন ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আপনে না থাকলে হয়ত অন্ধ হয়েই বড় হতাম আর অন্ধ থেকেই একদিন মরে যেতাম। শুভ জন্মদিন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।