ছবি - ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
মেলা ভাঙিয়া আসিলে এই পড়ন্ত বিকেলে এক জীর্ণ গণিকালয়ের সুমুখে সে নিজেকে আবিষ্কার করিল। তাহার একদা রঙ্গীন দেওয়াল, বর্তমানে বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, সে দেখে, তারই পার্শ্বে এক মধ্যবয়স্ক শুঁড়ি খানিক ইতস্ততের সহিত তাহাকে বাদামী চোখের ওই চটুল যুবতীটির প্রতি আকারে ইঙ্গিতে দিকনির্দেশ করিতেছে। আশাপূর্বক ভাবেই এরপর সে ধীর পায়ে ওইদিকে যাইবে, ভেজানো দরজা ঈষৎ ফাঁক করিয়া উঁকি দিবে খানিকক্ষণ। মেয়েটির ঘরে সাজানো কুলুঙ্গি, একটি ম্লান পটচিত্র ঝুলিতেছিল– অনাবশ্যক এই দৃশ্যটুকু তাহার কেন জানি মনে থাকিবে বহুকাল। হয়ত তাকে সে ভালবাসিয়াছিল কিংবা মেয়েটি তাহাকে আদৌ ভালবাসে নাই, এই জটিল হিসেবে তার বাকি রাতখানি অতিবাহিত হইবে। প্রৌঢ় শৌণ্ডিক ওই, আজও দ্বিপ্রহরে তাহার সহিত সুব্যবহার করিতেছে, পয়সা অবধি নেয় নাই, বরং সে শহর যাইতে চায় জানিয়া, দেখো তাহাকে লইয়া আসিয়াছে বাসস্টপ পর্যন্ত। আগে কখনো শহর অবধি যায় নাই, তুমি একটু দেখিও… প্রৌঢ় বাসচালককে বলে, তাহার গণ্ডদেশ দ্রুত মুছিয়া লয়; নেহাত জ্বরে নিয়ে নিলে, বাঁচিলে আমার ছেলেটিও কি ওর বয়সী হইত না? সে নিঃশব্দে হাত নাড়ে। বাসের বিপরীতে মানুষের ক্রমশ বিন্দুতে পর্যবসিত হওয়া দেখিতে দেখিতে গত রাতের নিরক্ষর মেয়েটিকে কখনো চিঠি লিখিলে কেমন হয় একথা সে খানিক ভাবে। তাহার ঘুম পায়। আরও অনেক অনেক রাতে বাসচালকের ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙ্গিবে, এসে গেছে, নেমে যাও এইখানে। আধো চোখে সে দেখে গ্যাসবাতির আলো, সুউচ্চ কোন এক মিনার, বাড়িঘরের দুপাশে নির্জন পথঘাট। এই তবে কলকেতা শহর… অনতিদূরে ওই চিকচিক করিতেছে যেন রহস্যময় জলরাশি, উহা তো গঙ্গা নদী সে জানে, কিছু দূরেই সমুদ্রে গিয়া মিশিয়াছে, ওই সমুদ্র যাহার অপর পারে সেই আশ্চর্য ভিনদেশ, সেইখানে রমণীদের কটা চুল ও নীল চোখ- সে পড়িয়াছে ছেলেবেলায়। যাইবে না কি, ঈশ্বর করুন নিশ্চয় সে অতদূর যাইবে একদিন, উত্তেজনায় সঞ্চিত যা কিছু, দুইশত বত্রিশ টাকা তাহার রহিয়াছে, হাতে চাপিয়া সজোরে সে এখন হাঁটে। আলেয়ার মতন গ্যাসবাতির আলোর ওই ক্রমবর্ধমান দপদপানি সে টের পায় মাথার ভিতর। স্বপ্নের মধ্যে দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে এইবার মনে হয়, যেন তাহার জ্বর আসিতেছে খুব…