রহমান ৩০ বছর ধরে কামারহাটিতে থাকে। আজ থেকে ২৩ বছর আগে রহমানের আব্বা,আফজল, সুস্থ মানুষ, হজ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। রহমানের মা সাকিরা আগে খুব কাঁদত। তারপর আল্লার কাছে দোয়া করত, জলজ্যান্ত লোকটাকে ফিরিয়ে দাও। তারপর শুধু চিৎকার করত। একদিন চুপ করে গেল। সারাদিন ধরে ঘরে বসে থাকত। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিনবার পানি খেতো, একবার ভাত। তার চোখে পানি নেই.. সব শুকিয়ে গেছে। রহমান বাসায় ফিরে এলে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত। লোকে বলে রহমানকে দেখতে তার হারিয়ে যাওয়া আব্বা আফজলের মতো। সেই রকম চোখ মুখ ভুরু।
রহমান গাড়ি চালায়। গাড়ি মানে মালিকের ট্যাক্সি। ৮-১০ ঘণ্টা ডিউটি। সপ্তাহে একদিন ছুটি।
সেদিন ছিল শুক্রবার। রহমান গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ তার বাসায় কান্নার রোল উঠল। ওর ফুফাতো বোন রুকসানা রহমানকে ফোন লাগালো কিন্তু ফোন লাগল না। তিনবারের চেষ্টায় যখন পাওয়া গেল রহমান তখন গাড়ি চালাচ্ছে বাইপাসের দিকে।প্যাসেঞ্জার নিয়ে ও তখন রুবি হাসপাতালে যাচ্ছে। কোনো কথা স্পষ্ট করে শোনা যাচ্ছে না। কান্নার আওয়াজ ছাড়া। হয়তো ফোনের দোষ। বা নেটওয়ার্ক খারাপ। ট্যাক্সি তে সিরিয়াস রুগী ছিল।রুগীর দাদা চেঁচিয়ে উঠল: গাড়ি চালাতে চালাতে ফের কথা বলছ। এখনই অ্য। ক্সিডেন্ট হবে। ফোন টা রাখো।
ফোন বন্ধ করে রুগী কে রুবিতে নামিয়ে রহমান ফোন করল ওর বৌদি সাবিরা কে। সাবিরা ধরা গলায় বলল : এখনই চলে এস। আমরা মাকে নিয়ে কামারহাটির সাগর হাসপাতালে যাচ্ছি। রহমানের বুক ফেটে যাচ্ছে।
পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে, জ্যাম ভেঙে, উল্টোডাঙা, শ্যামবাজার, সিঁথি, ডানলপের সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে রহমান যখন হাসপাতালে পৌঁছল সব শেষ। মা নেই।
রহমানের কান্না পেলনা। দীর্ঘ দিনের জমে থাকা রাগ ফুটে বেরুল না তার আচরণে। বৌদি সাবিরা কে ডেকে বলল,একটু চা বানিয়ে দেবে?
পরের দিন ভোরবেলায় রহমান গাড়ি আর চাবি মালিকের কাছে ফেরত দিতে গেল। ও আর গাড়ি চালাবে না। মালিক রাজি নয়।বুঝিয়েও কাজ হবে না জেনে মালিক ওকে জানাল যে বাকি টাকা পেতে দেরি হবে। হুট করে কাজ ছাড়লে লোক পাব কোথায়?
আমার যা লোকসান হবে কে মেটাবে?
উত্তর দেবার মুড নেই। রহমান ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছে বাসার দিকে।
এর ঠিক ৭ দিন পর ওদের টালির ঘরের জানলায় একটা পাখি উড়ে এসে বসল। সবুজ রঙের ল্যাজওলা এক টিয়া পাখি। ক্ব ক্ব করে কীসব যেন বলছে। রহমান পাখির দিকে তাকাতেই ওর বুক হিম হয়ে গেল। পাখির চোখদুটো ঘুরছে মানুষের মতো। আর বলছে: ছ্বি .. ছ্বি। পাখি কিছু খেল না। বিকেল গড়ালে রহমানের হাতে একটা পাকা লঙ্কা খেয়ে সে উড়ে গেল এঁড়েদার দিকে।
রুকসানা রহমানকে জিজ্ঞেস করল, টিয়া কী বলল রে দাদা?
রহমান উত্তর দিলো না। সব কথার উত্তর হয় না। রহমান স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে উড়ে যাবার আগে পাখি বলে গেছে,পুষবি, পাখি পুষবি।
পাখি পোষ মানানো সোজা কথা নয়।পাখির ব্যবসাও এখন আর লাভজনক নয়। হাতিবাগানে পাখি কিনে গ্যালিফ স্ট্রিটে পাখিবাজারে বিক্রি করে রহমান দেখল ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। ওসব ছেড়ে সে এখন এঁড়েদার ঘোষালদের ড্রাইভার সন্তোষের সঙ্গে ফুল ও ফলের ব্যবসায় নেমেছে।
সন্তোষ এঁড়েদার হাসপাতালের উল্টো দিকে বসে আর রহমান বসে সাগর হাসপাতালের পাশে।
পাইকারি হারে কিনে ওরা ফুল ও ফল বিক্রি করে। চলে যাচ্ছে মন্দ না। কিন্তু পাখিটার চোখ দুটো ভুলতে পারে না রহমান। তার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে শুকনো বাতাস। মায়ের কান্না। আব্বার ফেলে যাওয়া চটিজুতো। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
না পেরে রথতলার রথের মেলা থেকে একটা নতুন পাখি কিনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে রহমান। কেউ পাখি পছন্দ করেনা। পাখির জন্য একটা নতুন খাঁচাও কিনেছে। অনেক খুঁজে এই পাখি পেয়েছে রহমান। ওর জন্যই যেন অপেক্ষায় ছিল।এই পাখি তিন থেকে চার বার ডাকে। প্রত্যেক ডাক আলাদা। রহমান জানে ওর ডাকের মানে আছে।ওর হারিয়ে যাওয়া আব্বা আফজল, ওর দুঃখিনী মা সাকিরা আর রহমানকেই ডাকে এই পাখি। দুবার করে ডাকে। কিন্তু কী বলতে চায় বোঝা যায় না। বিকেল চারটের সময় কণ্ঠ দেয় আজানের সুরে।
কিন্তু ওর নিজের দাদা শাহিদ,পাড়ার কেবল অপারেটর গোবিন্দ, ঘোষালদের ড্রাইভার সন্তোষ আর ফুফাতো বোন রুকসানা এই চারজন কিছুতেই পাখি টাকে সহ্য করতে পারে না। ওদের দেখতে পেলেই পাখি মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে।
মানে সরে যা, দূর হয়ে যা।
রহমান জানে এরা কেউ লোক হিসেবে ভাল না। কিন্তু আরো কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি? মনে সন্দেহ নিয়ে রহমান ফুল বেচতে চলে যায়।
রহমান বাড়ি নেই সেই ফাঁকে ওরা কয়েকজন কখন এসে ঘুরে গেছে কে জানে রাত্তিরে পাখি কিছুই খেলনা। ডাকলনা একবার ও।
পরের দিন ও না। আর অপেক্ষা করতে না পেরে রহমান পুরসভার ভেটারনারি অফিসার ইনচার্জ ডাঃ সেনের কাছে অভিযোগ জানাল।তার সুস্থ পাখি ২ দিন ধরে খাচ্ছে না। তিন দিন ডাকেনি। অসুখ তো নয়। তবে কী? কেউ কিছু করেছে?
অফিসার সব শুনে বললেন, কে কী করবে?
হয়তো গরমে কষ্ট পাচ্ছে।চান করাও ভাল করে। পানি দাও। রহমান শুকনো মুখে ফিরে এল বাসায়। ফল বেচতে গেল না।
খবর টা চাপা থাকল না। ছড়িয়ে গেল। রহমান আদালতে যায়নি,থানায় অভিযোগ করেনি, পাড়াপড়শির কাছে চিৎকার করে জানায়নি তার দুর্ভাগ্যের খবর। তবু আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে রহমান ও তার পাখির কথা। ফেসবুকের পাতায় দেখা যাচ্ছে ছবি সহ রহমানের পাখি... যে আর ডাকেনা।
রহমান খেতে পারছে না। দাড়ি কামায় না।দুদিন ঘুম নাই তার। সে ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি, বছর ৩৫ এর যুবক।সে শাদি করেনি। পাখি ভালবাসলেও তার ডানা দোষ নেই। তার অবস্থা দেখে রুকসানা শরবৎ করে আনলে রহমান বলে, নিয়ে যা। খাবনা। বৌদি সাবিরা যত্ন করে আদা দিয়ে চা বানিয়ে আনলে এক চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখে। ভাল লাগছে না। তারও খিদে নেই, তেষ্টা মরে গেছে।
আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই, গাছের পাতা রোদে পুড়ে হলুদ হয়ে গেছে।
কোনো নতুন অসুখ না কি কেউ লুকিয়ে কিছু খাইয়ে দিয়েছে পাখিটাকে?
রহমান রোজা রাখে।
কেউ কেউ লক্ষ করেছে রহমান ও তার পাখি উপবাস ভঙ্গ করেছে ফল খেয়ে। তবে সবার মুখে কুলুপ। কেউ কিছু বলবে না।
কিন্তু পাখিটার মুখে কোনো শব্দ নেই। এটা তো মিথ্যে নয়।
যা ছিল ফিসফাস দাঁড়াল গুজবে। দেয়ালে কান পাতলে শোনা যায় লোকে বলাবলি করছে পাখি নিয়ে। পাখি ডেকেছে না ডাকেনি? রহমান কি সমাজের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে দিচ্ছে নীরবে?
একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ তিরের মতো ছুটে আসছে... কোথাও কিছু একটা ঘটে গেছে।
কাউন্সিলর ও পুরসভার চেয়ারম্যান ঘুরে গেছেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে মিসেস খান এসে পানির বোতল, ও আর এস এর প্যাকেট দিয়েছেন। বলেছেন প্রয়োজন হলে থানায় গিয়ে জি ডি লেখাও। একটা নিউজ চ্যানেল লাইভ সম্প্রচার করেছে রহমান ও তার পাখি কে নিয়ে। আপনার কাউকে সন্দেহ হয়? রহমান বলাই বাহুল্য কিছু বলেনি।
সেদিন রাতে মেঘ করেছিল। কিন্তু বৃষ্টি হয়নি।
সমস্ত গুঞ্জন শেষে একটা পোড়ো জমি। সেখানে কিছু পাতা আর পালক পড়ে আছে। চারপাশে রুদ্ধশ্বাস নীরবতা। জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো সেখানে বসে আছে রহমান তার নতুন খাঁচা ও সন্দেহজনক সুস্থ পাখিকে নিয়ে। একটু দূরে তার টালির ঘর থেকে ভেসে আসছে রান্নার সুগন্ধ।
কিছু লোক এখনও বিশ্বাস করে তারা রাত্তিরে একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়। যা মানুষের নয়। পাখিটা নাকি সত্যিই ডেকেছিল।
কেউ কেউ মনে করে এই ঘটনা একটি বিপর্যয়ের পূর্বাভাস।
ফকির ও শয়তান জানে আল্লা যখন কথা বলেন পাখিরা মন দিয়ে শোনে আর বেশিরভাগ মানুষ চোখ খুলে ঘুমিয়ে থাকে।
একটু দূরে তার টালির ঘর থেকে ভেসে আসছে রান্নার সুগন্ধ।