এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কাব্য  শুক্রবার

  • এই ভীরু মৃৎপাত্রে

    অমিতরূপ চক্রবর্তী
    কাব্য | ১৫ মার্চ ২০২৪ | ৯৭৭ বার পঠিত


  • এই ভীরু মৃৎপাত্রে

    এই ভীরু মৃৎপাত্রে তুমি যখন নতুন ধূপের মতো সতেজ, সুন্দর ফুলগুলি সাজিয়ে রাখ, চারপাশে যখন অতিকায় তাঁবুর মতো ভোররবেলা নামে, রাস্তায় মানুষের টুংটাং শব্দ দুলে ওঠে, অদ্ভুত সব নিশ্চুপ বাড়ির গর্ভে খলবল করে ওঠে অতিবাহিত জীবন, তোমার লম্বা, তন্বী হাতের শেষে যখন চোখে পড়ে দরজার মাথায় সেই কবেকার পুরোনো একটি চিত্রলিপি, তখন জমাট শূন্যতা আমার নড়ে ওঠে। চারপাশে দেখি অপরূপ ভোর। যেন একদল স্কুলপড়ুয়া কিশোরীর সমবেত উষ্ণ, অনুরাগমাখা হাসি। ঘরের মেঝেয়, দেওয়ালে তোমার দৃঢ় শরীরের ছায়া সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে ভেঙেচুরে পড়ে। সে ছায়া তখন শীতল। ফুলগুলি সাজিয়ে তুমি ধীরে হেঁটে যাও আরেক প্রান্তে, আরও কিছু এই স্বয়ম্ভুব ভোরের মৃদু, শান্ত কাজে। আমি নীল, বিহ্বল চোখে তোমার ধীরে হেঁটে যাওয়া দেখি। দেখি কীভাবে তোমার দৃঢ় শরীরের ছায়া বিছানা, আসবাব, কাঠের পুতুল পেরিয়ে তোমার সঙ্গে সঙ্গে চলে। কখনো রাস্তায় মানুষের টুংটাং শব্দ শুনি। কী এক আবেগে আমার কান্না পায়, গা শীত শীত করে ওঠে। এই ভীরু মৃৎপাত্র ভরে কী এক সাদা পদার্থ যেন, যেন ঘন দুধের মতো উথলে উঠতে চায়

    আমারও ত্বকে সেই অপরূপ ভোরবেলার আলো। কাচের জানালা দিয়ে আসে। ভোরবেলা, ভোরবেলা তখনো অসংখ্য মানুষ ঘুমিয়ে আছে, ভাবি আমি। পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। ইটের নোনায় পোকারা উড়ছে, নর্দমার শীর্ষে প্রজাপতি। এমন অস্ফুট আধো ঘুম, আধো জাগরণের ভোরে শুধু তুমি কী অদ্ভুত প্রাণবন্ত। কোষ্ঠে, পাঁজরে নির্মল। দু’পায়ে ঢলোঢলো ঘেরের পাজামা, আঁটো কামিজে সোনালি সুতোর কাজ। তোমার ভেতরে এখন কোনো ব্যথা- যন্ত্রণা নেই, অস্বস্তি নেই। এই যে এখন তুমি ভোরের দিকে চেয়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে অনন্ত, সুদূর বসে আছ, তোমাকে ঘিরে এই ছাদের নীচে কী এক স্নেহের কারণে অযুত শিশিরে বোনা কুয়াশার ঢল নামছে, আমি নীল, বিহ্বল চোখে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে আরও এক হাওয়ার মধ্যে ডুবে যাই। কত মানুষ এখনো ঘুমিয়ে আছে। ধূর্ত, নরমাংসখাদকেরও এখন শিশুর মতো মুখ। পাশে স্ত্রী, সন্তান। ঘাটে বাঁধা সব কাজের নৌকো। একটি সফেদ ফুলের গাছ থেকে কখনো ফুল, কখনো শুকনো পাতা টুপ করে খসে পড়ছে। এরা কারা? তুমি কি এদের অস্তিত্বের কথা জান? তুমি চা হাতে ভোরের দিকে তাকিয়ে রয়েছ

    নীরবে। একখণ্ড পাথরের মতো তাকিয়ে রয়েছ

    ~~~


    মর্মর মূর্তির মতো

    আমার শীর্ণ কপালে, চোখে কতরকমের আলপনা! লালচে পাতার পাশ দিয়ে কত আকর্ষ, লতা বিমূঢ় চাঁদের দিকে উঠে গেছে। এইসব আলপনা তুমি ছাড়া অন্য কারও দৃষ্টিগোচর নয়। তোমাকে সরিয়ে নিলে পৃথিবীর বাকি জনমণ্ডলী দেখবে ক্ষয়াটে কপালে বটের ঝুরির মতো সব অভিজ্ঞ শিরা। শ্যাওলার চাদরে ঢাকা চুপচাপ, প্রায় নিস্পন্দ পুকুরের মতো দুই চোখ। শুধু তুমি কোনো উত্তপ্ত সোনার মতো দিনে বহু ফুল ও অরণ্য আঁকা শাড়ি পরে আমার কাছে এসে কী বিমুগ্ধ চোখে সেইসব আলপনার শৈলী লক্ষ্য কর। কখনো দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে এক মর্মর মূর্তির মতো হয়ে থাক। তোমার কাঁধের বর্তুলে, দলছুট যে-সব চুল, তাতে দূরাহত কোনো বাতাসের আঘাত লাগে। দৃষ্টির বাইরে টানা করিডোর দিয়ে অসংখ্য পায়ের হেঁটে যাবার শব্দ হয়। এইসব অসংখ্য পায়ের মধ্যে আছে আলোর চাইতেও দ্রুতগামী পা, ভাঙা কোচগাড়ির মতো শ্লথ, বিষণ্ণ পা অথবা দুগ্ধধবল বকের মতো পা। কোথাও ক্রিয়াও ক্রিয়াও করে পাখিও ডাকে হয়তো। ডাকবে, কেননা পাখিদের জীবন আছে, জীবনধর্ম আছে। জানালার কাছে বড়ো বড়ো কীসব বাহারি পাতার গায়ে চিরকালের আনন্দবাহক রোদ। দু- একটা পতঙ্গের সূক্ষ্ম শরীর। তখনো তোমার ঠোঁট দাঁতে কামড়ে ধরা। তখনো তুমি আমার মুখের ওপর বিমুগ্ধ দৃষ্টি ফেলে মর্মর মূর্তির মতো স্থির। আমি ম্যাজিশিয়ানদের সাহায্যকারীর মতো মাথা এলিয়ে দিয়ে শুধু শূন্যে ভেসে আছি

    আহা, আমার শীর্ণ কপাল, চোখের সব আলপনা! মনে মনে কখনো এদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। এরা আছে বলেই তুমি আস। দিনের একটা উন্মীলিত পর্দা সরিয়ে আস। দেওয়ালের বাইরে তখন কত কী! মাদ্রাজে ঢুকে পড়ছে অন্য দেশের বাঘ- হাতি। শৈশব পেরিয়ে আরেক শৈশব ছুটে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। আকাশের কাছাকাছি কোনো শিখরে দু’দেশের নিশান উড়ছে। দোকানে দোকানে পণ্যসম্ভার মিউজিয়ামের মতো দেখতে দেখতে হাঁটছে মানুষ। তাদের কাঁধে ঝোলান একটি ব্যাগ অত্যন্ত গোলাপি রঙের। তাদের কারও আস্তিন গোটানো হাতে পুরোনো, খুব পুরোনো স্মৃতির গন্ধ। রামধনুর মতো আকাশে বাঁক তোলা ফ্লাইওভার বলে যে ‘মানুষের জন্য অচিরেই পৃথিবীকে মনুষ্যাতীত সুন্দর করে তোলা হবে। এই তার তোরণ।’ তুমি যখন আমার পাশে ঠোঁট দাঁতে কামড়ে মর্মর মূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাক, যখন তোমার মাংসল কাঁধের বর্তুলে কিম্বা দলছুট যে-সব চুল- তাতে দূরাহত বাতাসের আঘাত লাগে, আমি প্রায় না-শোনার- মতো কণ্ঠে তোমাকে বলি ‘কথাটা কী সুন্দর না? এই যে বলছে মানুষের জন্য পৃথিবীটাকে মনুষ্যাতীত সুন্দর করে তোলা হবে? ভাবলে আমার গায়ে শিহরণ হয়। তোমারও কি হয়?’ দৃশ্যের বাইরে করিডোরে অসংখ্য পায়ের শব্দ হয়। আলোর অধিক গতিতে যে পা ছুটে গিয়েছিল, সে আবার একইরকম গতিতে ছুটে আসছে। দুগ্ধধবল পায়ের শব্দ তখন কিছুটা আড়ষ্ট

    বহু ফুল ও অরণ্য আঁকা শাড়ি পরে তুমি আমার কাছে তখনো তেমনই দাঁতে ঠোঁট কামড়ে মর্মর মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছ


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কাব্য | ১৫ মার্চ ২০২৪ | ৯৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কবিতাগুলি | 14.139.***.*** | ২০ মার্চ ২০২৪ ০৯:২৪529607
  • খুবই ভালো লাগলো। অমিতরূপকে  ধন্যবাদ । 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন