১২
পরের দিন ফেরার তাড়া। কিন্তু সকালে দুটো সেশন ঠিকই হয়।
দিনের শুরুতে নিধি বললেন যে আপনাদের মধ্যেএকজন অন্যরকম কিছু করেছে।
সবাই চুপ। মানে? আন-এথিক্যাল কিছু? কোন মেয়ের সঙ্গে মাত্রাছাড়া ব্যভার?
হয়ত কেউ কমপ্লেইন করেছে? নিধি যে এথিক্স কমিটির চিফ!
সবার টেন্সড চেহারা দেখে নিধি হেসে ফেলেন। আশ্বস্ত করে জানান যে ওসব কিছু নয়।
--এই ডামাডোলের মধ্যে একজন সবার চোখ এড়িয়ে গেছে, নিজের সম্বন্ধে কিছুই না বলে গত সন্ধ্যেয় পাঁচপাতা লিখে আমার কাছে জমা দিয়েছে। তাতে আছে তার আত্ম-বিশ্লেষণ। কিন্তু আমি ওকে বুঝিয়েছি যে এটা গ্রুপ এক্সারসাইজ। গোটা গ্রুপ মিলে এক-একজনকে আয়না দেখাবে। নিজেকে বুঝতে হেল্প করবে।
একা একা করলে দু’রকম বায়াস কাজ করে—চালাকি করে নিজেকে মহান দেখানো অথবা সেলফ-পিটি বা আত্ম -করুণা । দুটোই ডেটা বেসড বিশ্লেষণের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই সে আজ নিজের কথা আপনাদের বলবে আর আপনারা ‘হিয়ার এন্ড নাউ’ প্রিন্সিপল অ্যাপ্লাই করে ওকে সাহায্য করবেন। ও যে আপনাদের বেসিক হিউম্যান ল্যাবের সাথী!
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে এমন সময় শ্রবণকুমার দাঁড়িয়ে পড়ে। ছ’ফুট লম্বা ছেলেটাকে কেমন অপ্রতিভ আর অসহজ দেখাচ্ছে।
--‘আসলে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সবার এত সব যন্ত্রণা আর সমস্যা –এর মধ্যে আমারটা তুচ্ছ মনে হয়েছিল। আমার সমস্যা হল আমার চেহারা নিয়ে কমপ্লেক্স।
স্কুলে ভাল ফূটবল খেলে নাম হোল, কিন্তু সবাই নাম দিল ‘ঘোড়ামুখো’। বাবাকে বললাম স্কুল বদলে দাও, বাবা রাজি হলেন না। বাড়ির কাছের বাকি স্কুলগুলো সব ইংরেজি মিডিয়াম, আর অনেক চড়া ফীস।
ইলেভেনে বায়োলজি পড়ার সময় এক বন্ধু বলল যে আমার ঘোড়ামুখো হওয়ার জন্যে আমার বাবা দায়ি, উনিও তো বেশ ঘোড়ামুখো। সেই বন্ধুর সঙ্গে হাতাহাতি হল, কথা বন্ধ হোল। কিন্তু ওই নামটা সেঁটে গেল। আর বাবার উপর খুব রাগ হোল।
কেন আমার এমন ঘরে জন্ম হোল? কে ওঁকে দিব্যি দিয়েছিল আমাকে জন্ম দিতে? আমার লাইফ হেল করে দিতে?
কলেজে ভর্তি হলাম। কো-এড। আমার কমপ্লেক্স বেড়ে গেল।
মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হত, কিন্তু সাহসে কুলোতো না। মেয়েরা আমার দিকে তাকালেই মনে হত আমাকে নিয়ে হাসছে।
একই কলেজে আমার স্কুল- জীবনের পরিচিত কয়েকজন ভর্তি হয়েছিল। তাদের অনুরোধ করেছিলাম যেন আমার পুরনো নিক-নেমটা এখানে চাউর না করে । ওরা কথা রেখেছিল। তবে দুটো বছর।
ফাইনাল ইয়ারে একটা ঘটনা ঘটল। একটি মেয়েকে ভাল লেগেছিল, কথা বলতে সাহস পেলাম না। ওকে একটা চিঠি দিলাম, ছুটির পরে বাড়ি ফেরার সময়ে।
পরের দিন রোববার। সোমবারে কলেজ গিয়ে দেখি—হল্লা হয়ে গেছে। নোটিস বোর্ডে আমার চিঠিটি আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া—তার উপর রঙিন স্কেচ পেন দিয়ে মোটা মোটা করে লেখা—ঘোড়ামুখোর লাভ লেটার।
আর কলেজ যাই নি । প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে গ্র্যাজুয়েট হলাম। এন জি ও’র চাকরি পেয়ে পাশের রাজ্যে কাজ করতে লাগলাম। বাবাকে শুধু মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিতাম।
নিধি বলেন—ঠিক আছে; কিন্তু ওগুলো দেন এন্ড দেয়ার; অতীতের বোঝা। এই নিয়ে বাকি জীবন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাঁচবে? এখানে হিয়র এন্ড নাউ থেকে কী শিখলে?
শ্রবণ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের নখ খুঁটতে থাকে।
তারপর নিধির দিকে তাকিয়ে বলে—প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। এই ক্লাসে মুখ না খুললেও রাত্তিরে রুমমেট আবদুল্লা ভাইয়ের সঙ্গে রোজ কথা বলেছি।
আমার মেয়েদের নিয়ে কমপ্লেকসের জন্যে মনে মনে বাবাকেই দায়ি করেছিলাম। আর এর ফলে মা কষ্ট পাচ্ছিলেন।
তবে এটা বুঝতে সময় লেগে গেল।
কাল মায়ের একটা চিঠি পেয়েছি। লিখেছেন—উনি বুড়ো হয়ে গেছেন। এ’বছর রিটায়ার করেছেন। বড় একা লাগছে, তুমি একমাত্র ছেলে—যদি এক সপ্তাহের জন্যে ওঁকে দেখতে আসো তো ভাল হয়।
--তা কী ঠিক করলে?
-- ফোনে অফিসে কথা বলে সাতদিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়েছি। এখান থেকে সোজা দিল্লি হয়ে ট্রেন ধরে বাবা-মাকে দেখতে যাব।
--মাকে? কেন?
-- বুঝতে পেরেছি মা নিজেও খুব একা ফিল করছেন। বাবার নাম দিয়ে লিখেছেন, কিন্তু নিজেও আমাকে দেখতে চাইছেন। আমার কাজের জায়গায় আসতে চাইছেন।
কতদিন হাত পুড়িয়ে খাচ্ছি, এবার ওঁদের দুজনকেই সঙ্গে করে নিয়ে আসব। এটাই আমার হিয়র এন্ড নাউ; আপাততঃ।
গঙ্গারাম দাসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিক্রম বলেন -- আপনি ডাক্তার কমপ্লেক্সে ভোগেন। যে যাই বলুক, সব ব্যাপারে আপনার কিছু বলা চাই। কারণ আপনি এদের মধ্যে সিনিয়র।
সমস্ত সিচুয়েশনের জন্যে আপনার কাছে আছে ওষুধের পুরিয়া।ঝোলা থেকে বের করে দিতে থাকেন। পেট্খারাপ? এটা খাও, মার্ক সল; জ্বর হয়েছে? অ্যাকোনাইট নাও; মাথাব্যথা করছে? কোন ভয় নেই? এই বেলেডোনা দুটো পুরিয়া খেয়ে দেখ, এই হল আপনার স্ট্র্যাটেজি।
আপনি ওমনিপোটেন্ট, ওমনিশিয়েন্ট!
আর আছে আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি। তাতে আছে সব রঙবেরঙের গল্প।
ওগুলো ডেইলি লাইফে কোন কাজে আসে না। হ্যাঁ, আপনার বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিন, গুরুচন্ডালি না কি বল্লেন, তাতে লিখলে লোকে দাদ দেবে, ওয়া-ওয়া করে উঠবে। কিন্তু দয়া করে ওগুলোকে সর্বরোগহর বটিকা বলে চালাবেন না। আপনার অনুভবের ওপারেও দুনিয়া আছে।
গঙ্গারাম চটে যায়।-- কাউকে সাহায্য করতে চাওয়া কি খারাপ?
--- কেন খারাপ হবে? কিন্তু আপনি আগ বাড়িয়ে অযাচিত সাহায্য করতে চান। তার দুটো দিক।
এক, আপনি জানলেন কি করে তার সাহায্যের দরকার আছে কি না?
দুই, তাকে আপনি দুর্বল ভাবলেন কি করে?
সে সাহায্য চায় নি, তাকে অশক্ত ভেবে কি আপনি অপমান করছেন না? ভেবে দেখুন।
তিন, এর পিছনে মোটিভেশন খুঁজুন, পাবেন যে আপনি চান সবাই আপনাকে মহান ভাবুক। আপনি যে সে ন'ন,-- গ্রেট গঙ্গারাম দাস; দি গঙ্গারাম দাস!
এবার আসরে নেমেছেন নিধি, -- আপনি নিজেকে কী ভাবেন?কেমন শক্তিধর আপনি?
গঙ্গারাম উবাচ-- অ্যান অর্ডিনারি ম্যান উইথ অ্যান অ্যাভারেজ ক্যাপাবিলিটি।
-- দেয়ার য়ু আর! দেন হোয়াই শুড য়ু বিহ্যাভ লাইক অ্যান একস্ট্রাঅর্ডিনারি পার্সন? বিহ্যাভ নর্মালি; ডীল উইথ আদার্স্ অ্যাজ ইয়োর পীয়ার- নট অ্যাজ ইয়োর পেশেন্ট।
ওদিক থেকে তোতলা ছেলেটি বলে-- দাদা, মাজীকে বারে মেঁ আপকী ক্যা বিচার?
-- আমি রায়পুরে ফিরেই ঘরে ঢুকে সবচে আগে মার সঙ্গে কথা বলবো।আর রোজ মার সঙ্গে আধা ঘন্টা নিয়ম করে আড্ডা দেব।
আমার মেয়েরা ফোন করে বলে,- বাবা, ঠাম্মাকে জামাকাপড়-খাওয়া-বিছানা-বই-টিভি দিলেই হল না, কথা বল।
অনেক পুরোনো গপ্পো বার-বার শোনাবে, ধৈর্য্য ধরে শুনবে। এগুলো ঠাম্মা তুমি ছাড়া আর কার সঙ্গে বলবে! তুমি যদি শোন, সঙ্গ দাও, তাহলে ঠাম্মার আয়ু হয়তো আরো কয়েক বছর বেড়ে যাবে।
সুরেশ বলে-দাদা, এখন এসব বলছেন, বাড়ি গিয়ে মনে থাকবে তো? আমি কিন্তু ফোন করে জিগ্যেস করব।
সেরেনা ও ফুলটুসি অদিতি চেপে ধরে গঙ্গারামকে-- অর্ধাঙ্গিনীর কথা বলুন। তার সঙ্গে কী ডীল করে থাকেন? ঘরে কতটা সোশ্যালিস্ট আপনি? ওনাকে জিগ্যেস করলে কী শুনতে পাব আমরা?
--- ও বলবে, কেন যে বিয়ে করল? ভাবভঙ্গী দেখলে মনে হয় এখনো রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে দিন কাটাচ্ছে। সকালে চা বানানো থেকে বাজার করা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া কোনটায় হাত লাগায় না। একটা বই নয়তো কম্পিউটারে নেট ম্যাগাজিনে কিছু লেখা। তারপর আছে আড্ডা, নাওয়া খাওয়া ভুলে যায় । আর নাটকের রিহার্সাল হলে তো কথাই নেই।
--- তখন আপনি কী বলেন?
-- আমি বলি, কোন্ কাজটা তুমি বলেছ আর আমি করি নি বা করবো না বলেছি?
উত্তরে শুনতে হয়,-বলতে হবে কেন? তুমি এ'বাড়িতে থাক না? চোখ খুলে কেন দেখবে না যে সংসারে কি দরকার?
গ্যাস ফুরিয়ে গেলে কখনো ফোন করেছ? বিজলী চলে গেলে লাইনম্যান, জলের লাইন গন্ডগোল দেখলে প্লাম্বার, কখনো কাউকে খুঁজে এনেছ?
খালি মুখে বলবে-- ভালবাসি। ওসব শুকনো কথায় চিঁড়ে ভেজে না। তুমি বরং হোস্টেলেই চলে যাও।
আচ্ছা, তোমার ক্যাজুয়াল লীভ আছে। উইক এন্ড আছে, শুয়ে শুয়ে ঠ্যাং নাড়াও আর তিনটে পত্রিকা পড়।
আমার কোন রোববার নেই? কোন ক্যাজুয়াল লীভ নেই? আজকে তুমি খাবার বানাও দেখি ।
সমাজতন্ত্র মাইকে না বলে আগে নিজের ঘরে করে দেখাও।
--- বুঝতে পেরেছি; সেই মেল শভিনিস্ট পিগ! এ যে রক্তের ভেতরে খেলা করে, একদিনে যাবে না।
তা আপনি কী করবেন?
-- রোজ সকালের চা করে দেব। রিটায়ার হয়ে গেলে একবেলা রান্নায় হাত লাগাবো। রুটি বেলতে পারি না, কিন্তু ভাত-ডাল-তরকারি-ডিমের ঝোল নাবিয়ে দেব। আর বাজারে সঙ্গে গিয়ে ব্যাগ বয়ে দেব।
-- ছ'মাস পরে অ্যাডভান্স হিউম্যান ল্যাব প্রোগ্রামে আপনি আসুন, আমরাও আসছি, তখন খবর নেব।
হটাৎ এক বেসুরো চিৎকারে এদের নীচুগলায় আন্তরিক আলাপনের তার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়।
গরিলার মত বুক চাপড়াচ্ছেন রামজীবন তিওয়ারি, হা-হা করে কেঁদে উঠছেন।
-- আমি বুঝতে পারিনি! কী ভয়ানক পাপ করেছি। ছুরি নিয়ে মারতে গেছি নিরীহ সৎমাকে।
বাবাকে বলার সাহস নেই। বলতে চাইতাম-- বাবা, বিয়ে কোর না। আমি তো আছি, আমার ওপর ভরসা কর, আমি সংসারের সব দায়িত্ব নেব, ভাইবোনদের দেখাশুনো করব।
সাহস পাইনি, মারতে গেছি ওই নির্দোষ মহিলাকে। আমি কাপুরুষ,ঈশ্বর আমাকে সাজা দেবেন, হা-হা-হা!
এরপর তিওয়ারি কাঁদতে কাঁদতে ক্লাস থেকে ছুটে বেরিয়ে দৌড়তে লাগলেন বাগানের মধ্যে দিয়ে। পাশে খাদ, অন্ততঃ পাঁচহাজার ফুট গভীর।
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মত সটান দাঁড়িয়ে পড়েছেন নিধি,-- শীগ্গির! শীগ্গির! অন্ততঃ দুজন যাও, দৌড়ও! ওকে ধরে আনো।
তারপর রসগোল্লা চোখ করে তাকিয়ে থাকা দাসবাবুকে বোঝালেন-- মনের এই অবস্থায় মানুষ কী করবে কেউ জানে না; খাদে লাফিয়ে পড়তে পারে।
তিনজন মিলে ধরে এনেছে তিওয়ারিকে; মৃগীরোগীর মত মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে। ওরা পরম মমতায় শুইয়ে দিয়েছে ওকে। ওরা তিনজন--তোতলা ছেলেটা, নেপালি ছেলেটি আর সুরেশ --ওর বুকে পিঠে আস্তে আস্তে মালিশ করছে।
আস্তে আস্তে তিওয়ারি স্বাভাবিক হয়ে আসেন।
সবাইকে অপ্রস্তুত করার জন্যে ক্ষমা চান। এদিকে খাবার ঘন্টা বেজে গেছে। ফেসিলিটেটর দুজন চলে গেছেন। এদের যে উঠতে ইচ্ছে করছে না।
আর ঘন্টা দুই। তারপর সবাই হিমালয়কে অলবিদা করে মুসৌরি এলাকার পাহাড়ের কোলে বসা এই কেমটি গাঁয়ের স্মৃতিকে মনের ক্যামেরায় বন্দি করবে বেরিয়ে পরবে দেরাদুনের জন্যে। রাতের ট্রেন ধরে সকালে হজরত নিজামুদ্দিন স্টেশন, দক্ষিণ দিল্লি। তারপর সেই শুধু দিনযাপনের শুধু প্রাণধারণের গ্লানি।
ঘুমন্ত অবস্থায় অদিতির ফটো তোলা ছেলেটি শ্রীমান শ্রবণকুমার পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে,-- মাপ করে দিও, আমি তোমার সামনে ছবিটা ডিলিট করে দিচ্ছি। ফুলটুসি অদিতি খপ করে ওর হাত ধরে, ভিজে চোখে হাসে,-- ডিলিট করতে হবে না। থাকুক তোমার কাছে, আমরা তো বন্ধু।
অদিতি আর সেরেনা হাত ধরাধরি করে আমার কাছে আসে। সেরেনার মুখে গ্র্যান্ড স্লাম জেতার হাসি।
-দাদা, আমার টোটকা কাজ দিয়েছে। আজ অদিতির শ্বশুরমশায় নিজে থেকে ফোন করে ও কেমন আছে জানতে চেয়েছেন। আর বলেছেন অদিতি বাড়ি ফিরলে প্রথম বিবাহ-বার্ষিকী ধূমধাম করে সেলিব্রেট করা হবে। ওরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে চুমো খায়।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। জানি, ছ'মাস পরে আবার দেখা হবে। কিন্তু, হিমালয়ের কোলে নয়; অন্য কোথায়, অন্য কোন খানে।
দ্বিতীয় ভাগ
অ্যাডভান্সড হিউম্যান ল্যাব
১
ফেব্রুয়ারির শেষ। শীতটা যেন যাবে যাবে করেও যাচ্ছে না। দুপুরের দিকে হাওয়ায় একটু গরম ভাব, পাখা চালাতে হয়। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই হালকা শাল বা সোয়েটার চাই। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে "গুলাবি জাড়া'' বা গোলাপি আমেজের শীত।
দুপুর থেকেই পাতাঝরা শুকনো ডালে ডেকে চলে এক বেয়াড়া কোকিল।
এবছর আমগাছে মুকুল একটু তাড়াতাড়ি এসেছে। আর কী জানি কেন, এখনো কোন ঝড়বাদল হয়নি; ছোটখাট শিলপড়া ঝড়, তাও না। কাজেই আমের ফলন ভালই হবে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো মিষ্টি গন্ধে তারই ইঙ্গিত।
এমন মরশুমে বেশ খুশি খুশি মনে সাতসকালে ইটার্সি স্টেশনে নেমেছেন বাবু গঙ্গারাম দাস, সঙ্গে দুই ছোকরা স্যাঙাৎ।
ওঁয়ারা যাবেন পঁয়তিরিশ কিলোমিটার দূরে ইটার্সি-নাগপুর হাইওয়ের পাশে এক জঙ্গলের মধ্যে PRADAN (প্রদান) নামের এক সর্বভারতীয় এন জি ও'র ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে অল ইন্ডিয়া অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অফ হিউম্যান বিহেভিয়র এর কোলকাতা চ্যাপ্টার এর সৌজন্যে এঁরা পাঠ নেবেন হিউম্যান ল্যাবে। জুনিয়র স্যাঙাতেরা যাবেন বেসিক ল্যাবে, আর দাসবাবু অ্যাডভান্স কোর্সে।
যদিও উনি জানেন যে এইসব বিহেভিয়রিয়াল সায়েন্স হল আসলে সিউডো সায়েন্স আর ওদের হিয়র অ্যান্ড নাউ ম্যাক্সিম একধরণের প্রতিক্রিয়াশীল মাম্বু-জাম্বু, এবং এসবের পেছনে আছে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত যার স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্য হল মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীচিন্তাকে খারিজ করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে তোল্লাই দেয়া; তবু গঙ্গারাম এর প্রতি কেমন একধরণের আকর্ষণ বোধ করেন।
খানিকটা যেন কৈশোরোত্তীর্ণ দাসকে পাড়ার বেয়াড়া দুঃসাহসী মেয়েটার সঙ্গে মা পই পই করে মিশতে মানা করলেও ওকে দেখলে যেমন কথা না বলে থাকতে পারতেন না, তেমনই।
এখন উনি চ্যালাদের আনা ধোসা আর কফি সাঁটিয়ে ঘড়ি দেখছেন। সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। এগারটার মধ্যে ওরিয়েন্টেশন সেশন শুরু। এখন বাজে ন'টা। একটা বোলেরো ভাড়া করে রওনা দিলে এইটুকু দূরত্ব দশটার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
স্টেশনের বাইরের গাড়ির আড্ডা থেকে পাঁচশ' টাকায় বোলেরো পাকড়ে ওরা চড়ে বসলেন। টাকাটা একটু বেশি নয় কি?
ড্রাইভার বললো -- এটাই সবাই দেয়।
--এইটুকু, মানে মাত্র পঁয়তিরিশ কিলোমিটার দূরে "প্রদান'' ট্রেনিং সেন্টার যেতে? একঘন্টার জন্যে!
-- শুনুন স্যার, জায়গাটা কে আমরা বলি পোলট্রি ফার্ম। ওই প্রদান না কি নাম যে এনজিও , ওরা ওখানে বিশাল পোলট্রি ফার্ম করে স্থানীয় লোকজনকে ওখানে নামমাত্র খরচে মুরগীপালনের ট্রেনিং দিচ্ছে।
আর একঘন্টায় পৌঁছনো? ভুলে যান। কপাল ভালো থাকলে দু'ঘন্টা, নইলে আরো বেশি।
-- কেন?
-- রাস্তা খুব খারাপ। নামেই হাইওয়ে। শহরের থেকে দশ কিমি দূরে গেলেই সিঙ্গল লেন। পাশাপাশি দুটো গাড়ি যেতে পারে না। এইসময় হরদম ট্রাকের লাইন লেগে যায়। তারপর কোন ব্রেক ডাউন হয়ে রাস্তা আটকালে তো রাম নাম সৎ হ্যায়।
গাড়ি চলতে শুরু করলো।
দাসবাবু চ্যালাদের শোনাতে থাকেন ইটার্সি নিয়ে দাড়িদাদুর ছড়া।
"যোগীনদাদার জন্ম ছিল ডেরাইস্মাইল খাঁয়ে।
পশ্চিমেতে অনেক শহর, অনেক দূরের গাঁয়ে।''
তারপরে "ইটার্সিতে'' র সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে
"দেয় কারা সব জয়ধ্বনি উর্দূতে, ফার্সিতে।''
ছোট শহর ইটার্সি, কিন্তু মস্ত বড় জংশন; খানিকটা খড়গপুর স্টেশনের মত। সারা ভারতের প্রায় সমস্ত রেলওয়ের লাইন এই স্টেশনে মিশেছে।
কিন্তু শহরের বাইরে দশ কিলোমিটার ছাড়াতেই শুরু হল সিঙ্গল রোড, ট্রাকের সারি আর ধূলো।
চারদিকে আদিম অরণ্য। সবার কথা বন্ধ, শুধু শুঁয়োপোকার মত ট্রাকের কনভয় আর তাদের গোঙানি। এখান থেকে বেতুল হয়ে রাস্তা যাবে নাগপুর। কিন্তু আমাদের তো যেতে হবে মাত্র ৩৫ কিমি দূর কেশলায়।
দাস ঘড়ি দেখে মোবাইল লাগায় তার মেন্টরকে। নাঃ, মেন্টরের মোবাইল নেট ওয়ার্কের বাইরে। এবারে ফোন দিল্লিতে, নিজের এন জি ও'র ডায়রেক্টর মহিলাকে।
-- উঁহু, ওরিয়েন্টেশন সেশন আধাঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হবে, তার বেশি নয়। দেখ, এগারোটার মধ্যে পৌঁছুতে পার কি না!
কুড়ি কিলোমিটার পেরিয়ে হটাৎ আশার আলো। রাস্তা রিপেয়ার হয়ে গেছে। খানিকটা দূর ডাবল্। কিছু মেক আপ করা যাবে।
এগারোটা প্রায় বাজে, এখনো পাঁচ কিমি বাকি। সোয়া এগারোটা নাগাদ পৌঁছনো যাবে।
গঙ্গারাম ভাবতে থাকে ওর ছ'মাস আগের বেসিক সেশনের ফেসিলিটেটর নিধি'র কথা। এবার যদিও নিধি থাকছেন আর এই ট্রেনিং ক্যাম্পের লজিস্টিক প্রবন্ধন এর দায়িত্ব উনিই নিয়েছেন, তবু নিয়ম অনুযায়ী ওর হিউম্যান ল্যাব এ ফেসিলিটেটর অন্য কাউকে হতে হবে, রিপিটেশন বা চেনাশোনা লোক চলবে না।
গত বার শেষদিনে ফেসিলিটেটররা জানতে চেয়েছিলেন ওনাদের সম্বন্ধে ‘হিয়র এন্ড নাউ’ প্রিন্সিপল প্রয়োগ করে অংশগ্রহণকারীরা কী দেখলো?
সেইসব পারস্পরিক ফিডব্যাকের আলো-আঁধারি থেকে বেরিয়ে এল জেদি, অসুখী কিন্তু জীবনের কাছে হার -না-মানা এক নারীর সিল্যুয়েট্।
বাবাকে হারিয়ে মেয়েটি , তিনবোন ও এক ভাই, আশ্রয় নিয়েছিল মামাবাড়িতে। মামারা উদার, কিন্তু উদাসীন। দিদিমা ভালোবাসেন কিন্তু অদ্ভুত পজেসিভ। আর ভীষণ কর্তৃত্বপরায়ণ।
মা মানসিক রোগী,, ম্যানিক ডিপ্রেসিভ। ফলে কখনো কখনো বেঁধে রাখতে হয়। স্নেহের ছিঁটেফোঁটা পাওয়ার সম্ভাব্য জায়গা শুধু দিদিমার কোল।
দিদিমার আছে পারিবারিক সম্পদ ও সম্পত্তির মালকিন হওয়ার অহংকার। মেয়েটির কপালে জোটে উঠতে-বসতে খোঁটা। মেয়ে-জামাইয়ের দুর্ভাগ্যের জন্যে দিদিমা দোষী সাব্যস্ত করেন নাতনীকে।
ও হাসলে দোষ-- ভদ্দরঘরের মেয়েরা এমন করে হাসে না। একটু সহবৎ শেখেনি।
কাঁদলে-- ন্যাকা! মারপিট করলে-- ঝগড়ুটে, খান্ডারনী!
ছেলেদের সঙ্গে ভাব করলে---নখরেওয়ালি, ছিনাল!
প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয় ওদের জন্যে মামাবাড়ির কত পয়সা খরচ হয়ে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে মা ভাল থাকে। আগ্রার পাগলাগারদ থেকে তাকে বাড়িতে এনে রাখা হয়। মেয়েটার মনটা হয়ে যায় শরৎকালের আকাশ। দিদিমাও যেন বদলে যান, ওনার নির্দেশে কাজের মেয়েছেলে লছমনিয়া বানায় গুলাবজামুন, মগজ কী লাড্ডু।
তারপর একদিন আকাশ ছেয়ে যায় মেঘে।
মাঝরাত্তিরে চিৎকার- চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায় মেয়েটার। দোতলার বারান্দায় আলো জ্বলছে। কারা যেন দৌড়চ্ছে। আরে , ওর মাকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে বারান্দায় থামের সঙ্গে। দিদিমা একটি বাখারি তুলে শপাং করে বসিয়ে দিলেন মায়ের পিঠে।
মায়ের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে আর্তনাদ আর অশ্রাব্য গালাগালি। কিন্তু মায়ের গলার স্বর একদম অচেনা। এমন ভারি মোটা আওয়াজ তো সিনেমায় কাউকে প্রেতাত্মা ভর করলে বেরোয়!
ইতিমধ্যে ইতওয়ারি আর মঙ্গলুর চোখ পড়েছে ওর দিকে। ওরা তাড়াতাড়ি ওকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে শেকল তুলে দেয়।
--- আমি মার কাছে যাবো। মাকে খুলে দাও।
-- বিটিয়া, অভি মৎ যাও। মা বিমার হ্যায়।
-- বেঁধে রেখেছ কেন? নানী মাকে মারছে কেন?
-- তোমার মা যে লছমনিয়াকে সব্জিকাটার ছুরি নিয়ে তাড়া করেছিল! না বাঁধলে মেরেই ফেলতো।
ওর ঘুম আসে না। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখে পাড়ার বুড়ো ডাক্তার কালোব্যাগ নিয়ে এসে একটা সুঁই বার করলেন, তাতে কি যেন ভরে নিয়ে মায়ের দিকে এগুলেন। মায়ের গালাগাল চরমে উঠলো।
এবার মায়ের হাতে ভিজে তুলো দিয়ে একটু ঘষে পট করে সেটা বিঁধিয়ে দিলেন। মা ডাক্তারবাবুকে ঘাড় বাঁকিয়ে কামড়াতে চেষ্টা করলো। পারলো না।
মায়ের গালাগালির ঝড় আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে মৃদু গোঙানিতে নেমে এল। তারপর মায়ের মাথা সামনের দিকে ঢলে পড়লো।
দরজা ঠেলতেই খুলে গেছে। মানে শেকল খুলে দেওয়া হয়েছে!
এবার ও বেরিয়ে এসে আস্তে আস্তে মায়ের দিকে এগোয়। আরে, মায়ের যে নাক ডাকছে, একটু ফুরুৎ ফুরুৎ আওয়াজ হছে।
কিন্তু ও আর এগোতে পারলো না।
নানীজি!
উনি বসেছেন মায়ের ঠিক পাশটিতে। পরম মমতায় পিঠের কাপড় তুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন যেখানে তাঁর হাতের ছড়ির আঘাত দাগড়া দাগড়া হয়ে ফুলে উঠেছে।
-মুন্নি! ও মুন্নিরে! বহোত দর্দ হুই হ্যায় ক্যা? (চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।