৪
কিন্তু কোথায় ঘন্টা বেজে ওঠে। বেশ জোরে। শ্রুতিমধুর নয়, মেশিনগানের র্যাট্-ট্যাটের মত তেতো।গাড়ি থেকে তিনজন মিলে মালপত্তর নামাতে নামাতে দেখে একটু দূরে যেন মেলা লেগেছে।
লালরঙা ইঁটের দেয়ালে খড়ের চাল দেয়া কয়েকটি গোলঘর। তার মাঝে বৃত্তাকার তিনফুট উঁচু খোলা জায়গা। পাশে পলাশ গাছের গায়ে ঠেকনো দেয়া একটি সাদা বোর্ড। জনা তিরিশেক ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী ও মাঝবয়েসীর ভিড়।গঙ্গারামের মত বুড়ো বা বুড়ি একজনও নয়। তবে মহুয়া গাছের নীচে জটলার মধ্যে চশমা চোখে ধারালো চেহারার একজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে, উনি মেরে কেটে পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই।দেশি নাভ্রাতিলোভা?
হায় গঙ্গারাম দাস ! বাবু, তোমার কপাল খারাপ। তুমি যে স্কুল জীবন হইতেই সমবয়সী বা বয়সে বড় মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হও। উহাই তোমার নিয়তি।
পুরুষকুল কিভাবে "প্যাডোফিলিয়া'' নামক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয় ইহা তোমার কাছে আজও রহস্য বটে।
মনের স্ক্যানার বন্ধ করতে হল।
একজন ইনস্ট্রাক্টর এসে জানালেন-- আমরা স্কেডিউল থেকে আধঘন্টা পিছিয়ে আছি। প্লীজ, দেরি না করে অ্যাম্ফিথিয়েটরে সমবেত হোন। মালপত্তর রিসেপশনে জমা করে দিন। লাঞ্চ ব্রেকের সময় নিধি ম্যাডামের থেকে রুম অ্যালটমেন্ট এবং নিজেদের ফাইল নিয়ে নেবেন। এখন শিগ্গির অ্যাম্ফিথিয়েটরে চলুন।
রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটর! সে আবার কোথায়?
কেন, ওই যে তিনফুট উঁচু বৃত্তাকার খোলা জায়গা। হরি, হরি! এ যে নামে তালপুকুর, তাতে ঘটি ডোবে না। হ্যাঁ, পাশের গাছে একটা ওই নামের বোর্ড লাগানো আছে বটে।
নিধি এসে সবাইকে স্বেচ্ছায় নানান ছোট গ্রুপে ভাগ করিয়ে কিছু বালসুলভ কাজকম্ম করালেন। চোখ বন্ধ করে হাঁটো; একপায়ে চল। পেছন দিকে যাও। দুজন-দুজন করে এক্জন চোখ খুলে আর একজন বন্ধ করে একে অন্যের ভরসায় হাঁটো দিকি! গঙ্গারামের মনে হল পার্কসার্কাসের সংযুক্ত পরিবারে সদ্যোজাত ছেলে আর রান্নাঘরের দায়িত্বে ব্যতিবস্ত বড়কাকিমা যেন বলছেন,--
তুমি অরে খেলা দাও, আমি একটু আসি। দেইখো, যেন পইড়্যা না যায়।
এর মধ্যে কে যেন দাসবাবুর নাম ধরে ডাকছে। আরে, এ যে আবদুল্লা আর কৈলাশ। সেবার মুসৌরির পিচ্ছিল পাহাড়ি পথে যারা ওকে হাত ধরে গন্তব্যস্থলয়ে পৌঁছে দিয়েছিল। এসেই জড়িয়ে ধরে একে অপরকে।
-প্রথম থেকেই ভাবছি আপনি আছেন কি না এবার! যখন গাড়ি থেকে স্যুটকেস নামাচ্ছিলেন তখনই দেখতে পেয়ে আওয়াজ দিলাম, আপনি যে কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন!
নিধি এগিয়ে এলেন।
-- সরি! আপনারা পুরনো লোক, নিয়মগুলো জানেন। চেনাদের মধ্যে গ্রুপ ফর্ম করলে চলবে না। প্রত্যেক বার নতুন দের নিয়ে গ্রুপ বানাতে হবে।
আর দৌড়-ঝাঁপ নয়।এবার নিজেদের মধ্যে পরিচয়। একবার নিজের নিজের একস্পেক্টেশন একে অপরকে জানান। অন্যবারে নিজের জীবনের সবচেয়ে দুঃখের বা সুখের ঘটনাটি পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীকে বলুন।
শালা! সেই ট্র্যাডিশন এবারেও চালাবে ওরা! ইয়াংকি মাম্বো-জাম্বো!
এইভাবে ওর পরিচয় হল ঝাঁকড়াচুলো বেশ মোটা অল্পবয়সী স্মৃতি ম্যাডামের সঙ্গে। কথা বলে তো ওর হয়ে গেল। এই মেয়েটি সবগুলো কোর্স করে এবারে এসেছে ট্রেনার হবার অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে। অবজার্ভার পার্টিসিপেটর! মানে এবার ভালো গ্রেড পেলে আগামীবারের থেকে আইস্যাবস বা ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়ারিয়াল সায়েন্স’ এর সার্টিফায়েড ফেসিলিটেটর হবে! ক্ষী ক্কান্ড!
দেখ, ওই বাচ্চা মেয়েটিকে দেখ। আর তুমি ষাটবছুরে বুড়ো ভাম! রয়ে গেলে আজীবন ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে। কি যে শালার জীবন হইল!
ওরিয়েন্টেশন সেশনে দেখা গেল চারটে গ্রুপে জনাচল্লিশেক ছেলেমেয়ে নিয়ে হচ্ছে বেসিক হিউম্যান ল্যাব, আর জনাছয়েক কে নিয়ে অ্যাডভান্স ল্যাব। যেহেতু অ্যাডভান্সের জন্যে এইবার কম লোক পাওয়া গেছে তাই সবাইকেই এক ব্যাচে রাখতে হচ্ছে, যদিও দু’জন আমার পূর্ব পরিচিত।
লাঞ্চ ব্রেকের সময় ঘরের ঠিকানা পাওয়া গেল। প্রায় পঞ্চাশ একর জুড়ে এই সেন্টার।
চারদিকে মানুষের তৈরি এক ঘন জঙ্গল; নানারকম গাছপালা, মাঝে খালি জায়গা জুড়ে ছোট ছোট সার্কুলার ক্লাসরুম।লাল ইঁটের দেয়াল। জানলার জায়গায় পর্দা ঢাকা খালি জায়গা। খড় ও টালির ছাদ, দেয়াল ও ছাদের মাঝে বাঁশের পাতলা টুকরো ও বেতের তৈরি নকশা। হাওয়া আসছে ভালই।
কিন্তু এত গাছপালার ফলে বেশ মশা, খানিকক্ষণ কছুয়াছাপ আগরবাতি জ্বালাতে হয়। অ্যাম্ফিথিয়েটারের পাশে রয়েছে ওপেন এয়ার এরিনা থিয়েটার। নীচে মাঝখানে গোলাকার সিমেন্ট বাঁধানো অভিনয়ের জায়গা। আর চারদিক ঘিরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সার্কুলার গ্যালারি।
সামনের দিকে খালি জায়গায় আছে একটি বাগান, ফোয়ারা ও বাঁধানো জায়গা।
কিন্তু এই শান্তিনিকেতনী পরিবেশের মধ্যে থাকার ঘরগুলো বেশ আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন। বাথরুম ও ল্যাবে গ্লেজেড টাইলস্, কমোড ইত্যাদি। দাসবাবুর ওই একটি দুর্বলতা-- কমোড।
খাবার সময়ে ছোট ছোট গ্রুপ। এর মধ্যে ডাইনিং হলে কোণের টেবিল থেকে চশমা পরা গাঁট্টাগোট্টা একজন আচমকা পা বাড়িয়ে দেয়, ল্যাং খেয়ে দাস মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিল, তার আগেই দুজোড়া হাত ওকে সামলিয়ে নেয়।
হতভম্ব দাসবাবুর মুখ দিয়ে খালি বেরোয়-- ইয়ে ক্যা বদতমীজি!
কোন সন্দেহ নেই যে ল্যাং ইচ্ছে করে মারা হয়েছে।
একজোড়া হাসিমুখ ওর দিকে এগিয়ে আসে। চশমাপরা গালে দু'দিনের দাড়ি, বলে-- ক্যা দাদা! ভুল গয়ে? ইতনী জলদি! আরে আমি রামজীবন তিওয়ারি। গতবার মুসৌরিতে আপনাদের সঙ্গে একই গ্রুপে ছিলাম। সেই যে ক্যাম্প ফায়ারের সময় "নজর লাগি রাজা তোরি বাংলো পর'' গানের সঙ্গে নেচেছিলাম।
ও হেসে ফেলে। -হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েচে, কিন্তু তা বলে ওরকম ল্যাং মারা?
-- তা আপনি সারাক্ষণ ওরকম আকাশের দিকে তাকিয়ে চললে হোঁচট খেতেই হবে। একটু জমিন পে নজর রাখকর চলা কীজিয়ে জনাব।
চারপাশে ঘিরে ধরেছে নতুন কিছু ইয়ং ছেলেমেয়ে,ওদের চেহারায় উত্তেজনা।
-- স্যার, আপনারা তো আগের বার ছিলেন। কী হয় ওই ল্যাবে? খুব কঠিন কিছু? ওই রোডিজ্ বা বিগ বস রিয়েলিটি শো' গোছের কিছু?
-- আমরা কেন বলবো? নিজেরাই জানতে পারবে।
-- বলুন না স্যার, আমরা রাজস্থান থেকে এসেছি। আবদুল্লা আর কৈলাশ স্যারের সঙ্গে।
-- ওদের জিগ্যেস কর না?
-- ওরা খালি বলছেন-- মেলডি খাও, খুদ জান যাও।
-- দাস স্যার, আপনি তো সিনিয়র, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের হেল্প করবেন। বলুন না, কী হয়?
দাসের ফক্কুড়ি স্বভাব ।
-- হ্যারি পটার দেখেছ? এটাও হগওয়ার্ট্স্ জাদু কলেজের কম নয়। এখানে বন্ধ কামরায় হয় কালাজাদু। পলিগ্রাফ টেস্ট। আরো কত কি! আমরা ক'জন সেই আগ কী দরিয়া সাঁতরে পার হয়ে এসেছি। তাই অ্যাডভান্স্ড ল্যাবে সুযোগ পেয়েছি। অন্যেরা ডুবে গেছে।
মেয়েটি কি শিউরে উঠলো?
কিন্তু কৈলাশ ও আবদুল্লার চেহারায় বিরক্তি ফুটে উঠেছে।
-- তাড়াতাড়ি থালাবাটি ধুয়ে নিয়ে সাজিয়ে রেখে অ্যাসেমব্লিতে চল। এর পর প্রথম সেশন শুরু হবে।
৫
অ্যাসেমব্লিতে জানা গেল যে বেসিক কোর্সের চারটি ব্যাচ, ওদের জন্যে গড়ে দুজন করে দশ জন ফেসিলিটেটর; পুরুষ ও মহিলা। দাস চিনতে পারে ওদের মধ্যে একজন মিসেস রেহানা বজাহত, দিল্লির বিখ্যাত হিন্দি নাট্যকার ও অভিনেতা অসগর বজাহতের স্ত্রী, পাঠানি স্যুট পরা বেশ লম্বা-চওড়া মহিলা। আচ্ছা, উনি কি অ্যাডভান্সড্ গ্রুপের একজন ফেসিলিটেটর হতে পারেন না?
যদিও দাস ভগবান মানে না, কিন্তু এমনি সময় ও অদৃশ্য ভগবানের সঙ্গে বাজি ধরে।
-- ভগবান! তুমি যদি সত্যি আছ, (জানি তুমি নেই, ফালতু চু-কিৎ-কিৎ খেলার কি মানে!) তাহলে তোমার বিভূতি দেখাও! ওই মহিলাকে আমার গ্রুপের মেন্টর করে দাও, তাহলে মেনে নেব তুমি আছ।
-নইলে?
-- নইলে রইলে, সেই দারুভূত নিরঞ্জন হয়ে। সেই যে ওমর খৈয়াম বলে গেছেনঃ
‘উপুড় করা পাত্রটা ওই আকাশ মোরা বলছি যাকে,
----------------------
ওর কাছে ভাই হাতটি পেতে থেকো না আর রাত্রিদিন,
তোমার-আমার মতই ওটা অক্ষমতায় ক্লান্তিহীন’!
তা কখনো কখনো ইচ্ছাপূরণ হয় বইকি! তখন ও ভগবানকে কাঁচকলা দেখিয়ে বলে-- এসব কাকতালীয়। ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।
এ’রকম সাকসেসের প্রোব্যাবিলিটি কত? ফেভারেবল ইভেন্টের পার্সেন্টেজ? খুব কম। ডেসিমেলে গুনতে হবে।
তবে অধিকাংশ সময়ই ও যখন প্রার্থনা করে তখন ভগবান ভদ্রলোক বাথরুম-পায়খানায় থাকেন। সেখানে তো ইন্দ্রিয়ের দ্বার বন্ধ করেই বসতে হয়। সবগুলো নয়, মানে নাক-কান-মুখ আর কি! ফলে হতাশ দাসবাবু ভগবানের অনস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে মুদি দোকান থেকে তেল আনতে যায়। অধুনা জনপ্রিয় একটি হিন্দি র্যাপ গান গুনগুন করে।
" অ্যাশ তু কর ভাই, অ্যাশ তু কর!
দেশ জায়ে তেল লেনে অ্যাশ তু কর ।''
এবারেও ব্যতিক্রম হল না। শ্রীমতী বজাহত জুনিয়র একটি গ্রুপের সংযুক্ত মেন্টরের দায়িত্ব পেলেন। দাস ছক কষছিল যে ওনার পরিচয়ের সূত্র ধরে যদি ওনার বাড়ি গিয়ে অসগর স্যারের সঙ্গে পরিচয় জমিয়ে একটা -দুটো স্ট্রীট-প্লে'র স্ক্রিপ্ট হাতানো যায়!
যাকগে মরুকগে!
অ্যাডভান্সড্ কোর্সের মাত্র একটিই ব্যাচ, ছয়জনের। তার একজন মাত্র ফেসিলিটেটর-- ফর্সা, বেঁটে, টাকমাথা ,কড়া চাউনির সুরেশ ওয়ালিয়া। উনি আবার এবারের গোটা প্রোজেক্টের ডীন বটেন! আর আছে এথিক্স কমিটি,-- তাতে নিধি মূল দায়িত্বে।
সেশন শুরু হল। ছোট গোল মত এক ইঁটের দেয়াল ঘেরা মজার ক্লাসরুম। আধেক খোলা আধেক ঢাকা। দরজা জানলার বদলে ছোট ছোট পর্দা। টালির চালের নীচে বাঁশের বুনুনি। বসার জায়গায় স্টেজের ওপর যেমন আয়তাকার টুকরো টুকরো বেদি থাকে তেমনি।
সুরেশ এসে নিজের একটি বেদিতে পাশ ফিরে আধশোয়া হয়ে রইলেন। কি অসভ্য লোক রে বাবা! এ আমাদের কি শেখাবে? ওগুলো কি অহংকারের বডি ল্যাংগোয়েজ নয়! হুঁ, শালুক চিনেছেন গোপাল ঠাকুর!
ছয়জনের দলটি অস্বস্তি কাটাতে একে অন্যের পরিচয় নিয়ে কথা শুরু করে।
কৈলাস-আবদুল্লা-রামজীবন- হরিদাস আগের ট্রেনিংয়ে বন্ধু হয়ে গেছল। ওদের একসঙ্গে ট্রেনিং হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এবারের অ্যাডভান্সড্ কোর্সে বেশি লোক আসেনি, অগত্যা!
পঞ্চম জনও যে অল্প চেনা। বুক অব্দি লম্বা দাড়ি চোখে পাওয়ারফুল চশমা জয়ন্তকে কে না চেনে ভোপালে!
এডুকেশনের লাইনে পেডাগগি নিয়ে লম্বা সময় ধরে নীরবে কাজ করে যাওয়া নীচু গলায় কথা বলা সুভদ্র ব্যক্তিত্ব।
এবার ছ'নম্বর? দিল্লিতে মহিলা অধিকার ও যৌনশোষণের বিরুদ্ধে ডকুমেন্টেশনের কাজ করা একটি নামজাদা এনজিও'র এইচ আর!
কিন্তু হরিদাস দেখছিল শুভা মুদগলকে। তেমনি মোটা কিন্তু লাবণ্যে ভরা চেহারায় স্মিত হাসি।
আমি বিনীতা ।
কথা চলছে,-- আশ কথা, পাশ কথা।
কিন্তু এমনিতো বেসিক ল্যাবেও হয়েছিল। এরা কথা বলছিল আর মেন্টররা একেবারে মাদাম তুসোর মিউজিয়মের স্ট্যাচু হয়ে ছিলেন। রা টি কাড়েন নি।
আস্তে আস্তে দিন দুই পরে ওরা বুঝে গেল যে পুরনো হিস্ট্রি চলবে না। একেবারে ঘটমান বর্তমান নিয়ে কথা বলতে হবে। র্যাশনালাইজ করা চলবে না, যুক্তির জায়গায় অনেস্টলি ভেতরের ফিলিংটা সবাইকে কমিউনিকেট করতে হবে।
তবে অ্যাডভান্সড ল্যাবে অন্য কিছু হওয়া উচিত নয় কি?
সেটা কে ঠিক করে দেবে? সুরেশ ওয়ালিয়া? সে মহাপ্রভূ তো মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আহা রে! কত কষ্ট করে কাল রাত্তিরে এখানে পৌঁছেচেন। ঘুমোক! ঘুমোক!
কিন্তু ঘন্টাখানেক কেটে গেল , কিছুই ঘটছে না যে!
কত আশা করে এসেছে , ও সাইকোঅ্যানালিসিসের কিছু উন্নত গুরুমন্ত্র শিখে যাবে, আগামী বছর এর পরের ধাপ – মানে ইনস্ট্রাক্টর হওয়ার কোর্স করবে। তারপর আর এক ধাপ। শেষে আর একবছর ইন্টার্নশিপ, এবারের স্মৃতি ম্যামের মত।
তারপর?
তখন স্বর্গের দ্বার খুলিয়া যাইবে! লোকের মনের চোরকুঠুরি খোলার চাবিকাঠি থাকবে ওর হাতের নাগালে। একজন আধুনিক প্রস্পেরো!
ও আর ভ্যাবাগঙ্গারাম থাকবে না, ও হবে আইস্যাবস এর সার্টিফায়েড্ বিহেভিয়ারিয়াল অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সের ইনস্ট্রাক্টর। বছরে কয়েক বার সুন্দর সুন্দর জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্পে সিলেক্টেড গ্রুপের সঙ্গে এসে ট্রেনিং দেবে।
কিন্তু পাঁচদিন ক্যাম্পের একদিন প্রায় শেষ, কিছু ঘটছে না কেন?
-- নাথিং ইজ হ্যাপেনিং ইয়ার!
দাসবাবু কি বেশ জোরে বললো ? নইলে ওই বেঁটে বক্কেশ্বর সুরেশ ওয়ালিয়ার ঘুম ভেঙে গেল কেন? আরে, ও যে এদিকে পাশ ফিরছে!
-- ডোন্ট বদার অ্যাবাউট হ্যাপেনিংস! মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড! ট্রাই টু বি ইন পীস উইথ য়োর ওন বিইং ।
-মানে?
-- মানে আর কি? তখন থেকে তোমাদের কথাবার্তা-গল্পগাছা শুনছি। তোমরা নাকি সিনিয়র! বেসিক হিউম্যান ল্যাব ভালো ভাবে উৎরেছ। তাহলে তো তোমাদের কথাবার্তা সব হিয়র এন্ড নাউ হত। কোথায়? অধিকাংশই তো দেয়র এন্ড দেন ।
আবার উনি পাশ ফিরে কাত হয়ে শুলেন।
এদের গলার আওয়াজ ফিসফিসানিতে নেমে এসেছিল। আচমকা যেন ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে ওয়ালিয়া বল্লেন-- ভয় পাওয়ার কি আছে? এখানে মানুষ নির্ভয় হতে শেখে।
ওরে আমার চোটের হাবিলদার রে! এসব জ্ঞানের কথা অনেক শোনা আছে।
কি করা যায়! মেয়েটি প্রস্তাব দিল-- এস, আমরা সবাই কে কোন জায়গায় বেসিক ল্যাব শেষ করেছিলাম, আর কি আশা নিয়ে এই অ্যাডভান্সড ল্যাবে এসেছি সেটা বলি।
প্রথমে আজানুলম্বিত দাড়ি জয়ন্তর পালা।
-- আমি সবাইকে জায়গা ছেড়ে দিই, দিয়ে আনন্দ পাই। কিন্তু এতে করে কখন যে আমার নিজের জায়গাটাও ছেড়ে দিই, খেয়াল থাকে না। এটা ঠিক করতে হবে।
-- আর?
-- আর কাউকে উচিৎ কথা বলতে খারাপ লাগে।
--কেন খারাপ লাগে? (এটা শুভা মুদগল ওরফে বিনীতার তরফ থেকে)।
-- না মানে কেউ যদি কষ্ট পায়!
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।
ওলে! ওলে! অন্যের কষ্টে গেছেন গলে!
কৈলাস বলে,-- আচ্ছা, আমরা আপনার এই আজানুলম্বিত দাড়ি রাখার কারণ জানতে পারি কি? বউ রাগ করে না?
আবদুল্লা বাধা দেয়,-- এটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেল না?
গঙ্গারাম আম্পায়ারের ভঙ্গিতে বলে-- তা কেন? এখানে আমরা নিজেদের পরিবারের, বন্ধুবান্ধবের, পাড়াপড়শীদের আড়ালে এক মানব পরীক্ষাগারে নিজেদের মিউচুয়ালি কাঁটাছেড়া করতেই তো এসেছি। তবে ব্যাপারটা স্বেচ্ছায় হতে হবে। জয়ন্ত চাইলে উত্তর না ও দিতে পারে।
জয়ন্ত চোখ পিটপিট করে, বারবার চশমার কাঁচ মোছে, বলে একটু জল খেয়ে নিয়ে বলবে।
বিনীতা জলের বোতল এগিয়ে দেয়।
দাসের মুখে একটা ফিচেল হাসি খেলা করছে। ওর মাথায় ঘুরছে ছোটবেলার একটি ছড়ার লাইন-- জামাইবাবু কমলালেবু একলা খেও না। জানলা দিয়ে বউ পালাবে দেখতে পাবে না!
এই বাংলা ছড়াটার লাইন এইসময় কেন মনে পড়ছে? এইজন্যে কি যে জয়ন্ত'র বউ বাঙালী ?
বুলবুলি সেন এখন ওই এনজিও'র ইডি, সবাই চেনে। আসলে এই মুখচোরা পর্দার পেছনে থেকে কাজ করতে থাকা জয়ন্তকে সবাই বলে-- ও? বুলবুলির হাজব্যান্ড?
জয়ন্ত গলা খাঁকারি দেয়। শুরু করবে। দাসবাবু জানলার কাছে ঘুরঘুর করতে থাকা বোলতার থেকে চোখ সরাতে গিয়ে দেখতে পেল ওয়ালিয়াজী উঠে বসেছেন এবং স্মিত মুখে তাকিয়ে আছেন সোজা ওর দিকে। চোখে কি একটু ব্যঙ্গের আভাস? উনি চোখ সরাচ্ছেন না। অগত্যা গঙ্গারাম দাস চোখ ফিরিয়ে জয়ন্ত'র দিকে তাকাল।
-- দিনটা বোধহয় ছিল ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। বাবরি মসজিদ দুপুরের মধ্যে ভাঙা হয়ে গেল।
সুপ্রীম কোর্ট, ভারত সরকার , বিরোধী দলগুলো সব কেমন শিখন্ডীর মত দাঁড়িয়ে রইল। আমি তখন ভোপালে থাকতে শুরু করেছি। দাঙ্গা দেখলাম, পরিচিতদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা উন্মাদ দেখলাম। নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেল। ঠিক করলাম নিজেকে কোন ধর্মের বলে পরিচয় দেব না। তাই দাড়ি রাখলাম।
দাড়িটা এমন রেখেছি যে এটা শিখদের জ্ঞানীজী -মুসলিমদের মৌলবি- বা পাদ্রীবাবা, সবার সঙ্গে মানিয়ে যায়। কেউ আমার ধর্ম জিগ্যেস করলে হাসি, উত্তর দিই না। আমার স্ত্রী সব জানেন।
সবাই খানিকক্ষণ মৌনব্রত ধারণ করল।
দাসবাবু জিগাইলেন যে জয়ন্তর কোন রাজনৈতিক আইডেনটিটি আছে কি না!
উঃ! অমর্ত্য সেন কি সহজে পেছন ছাড়বে না?
-- না, তবে আমি মার্কেট ক্যাপিটালিজম, মানে লেসেজ ফেয়রের স্ট্রং ক্রিটিক।
ওয়ালিয়া বল্লেন,-- সে না হয় হল। কিন্তু তারপর গঙ্গা ও গোমতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। আঠেরো বছর। এখন তো দেশে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে, আবার বদলায়ও নি। এই পরিস্থিতিতে তুমি ভেবে দেখতে পার যে তোমার মেসেজটি সবাইকে দিতে দাড়িই সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম কি না!
জয়ন্ত হামি ভরে,-- হ্যাঁ, ভেবে দেখব।
বিনীতা উঠে গিয়ে ওর হাত জড়িয়ে বসে থাকে। রামজীবন বলে-- দাড়ি কাটলে দেখতে পাবে যে তুমি কী ভীষণ হ্যান্ডসাম!
এই সময় চায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে, ওয়ালিয়া উঠে পড়েন।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।