এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • যে আঁধার আলোর অধিকঃ পর্ব ১২

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৬ অক্টোবর ২০২৪ | ১৯৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)


  • পরের দিন সকালে ও অনেকটা স্বাভাবিক। রাত্তিরে ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলছিল আবদুল্লা।

    রাজস্থান দিল্লি বর্ডারের একটি গ্রামের ছেলে। একটা মাঝারি গোছের এনজিওতে কাজ করে। বয়স প্রায় চল্লিশ, ছ'টি সন্তান, সবকটাই ছেলে। হাসিখুশি আবদুল্লা খুব পরিশ্রমী। রোজ রাত্তিরে ল্যাপটপে এন্ট্রি করে, নোটস্‌ নেয়। অজানা ইংরেজি শব্দ শুনলে মানে জিগ্যেস করে লিখে নেয়।
    একটি বছর কুড়ির ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো -- এই ছেলেটি রাজস্থানের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের, খুবই দুঃস্থ পরিবার। পয়সার অভাবে গ্র্যাজুয়েশন করা হয় নি। আমি এখন যে নতুন এনজিও তে জয়েন করেছি, তার ক্যাডার। আমিই তুলেছি, ওদের গাঁয়ে কাজ করতে গিয়ে। ছেলেটি ট্যালেন্টেড; তাই রিক্রুট করলাম। একবছরেই নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে একধাপ ওপরে উঠেছে। ভাল এক্সপোজার পাবে ভেবে এখানে বেসিক হিউম্যান ল্যাবে নিয়ে এসেছি।

    ও মবিলাইজেশন, টি ও টি, সেল্ফ হেল্প গ্রুপ ফর্মেশন, বেস লাইন সার্ভে আর হিন্দিতে রিপোর্ট তৈরি করা --- সবই পারে।

    নানান কথার পর আবদুল্লা বলে -- দাদা, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই। আমাকে আপনার এনজিও তে নিয়ে নিন। আপনি তো ওর বোর্ডে আছেন বল্লেন। প্লীজ, দাদা! আমি আর পারছি না।
    -- সেকি! তুমি না মাত্র একবছর হল বর্তমান সংস্থাটিতে কাজ করছ, বদলাতে চাও কেন? আর আমারটা তো অনেক দূরে, ছত্তিশগড়ে। মাসে-দুমাসে একবার বাড়ি যেতে পারবে।
    -- দাদা, সত্যি কথা বলি ? এই এনজিও অত্যন্ত করাপ্ট, পয়সার লুট চলছে। আমি পারলে কালকেই ছেড়ে দিই।

    দাস চমকে ওঠে। এমন অনেক এনজিও আছে শুনেছে বটে! তা’বলে এইরকম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা?
    খোলাখুলি চার্জ!
    -- একটু খুলে বল। আগেরটা ছাড়লে কেন? সেটাও করাপ্ট?
    -- না দাদা! আগেরটা "প্রদান'' সংস্থার স্পিন অফ , মিঃ সৈয়দ জাঈদী'র অর্গানাইজেশন। খুব কোয়ালিটি এনজিও। সাত বছর কাজ করেছি।

    -- ছাড়লে কেন?
    -- ছাড়লাম আমার রাগের জন্যে, চন্ডাল রাগ। আসলে মিঃ জাঈদী একটু কানপাতলা, ওনার কোটারির পরামর্শে চলেন, ব্যস্ত ভদ্রলোক, সব সরেজমিনে দেখতে পারেন না। ওনার চেলার চুগলি শুনে আমাকে অন্যায় ভাবে বকেছিলেন।
    আমার মাথায় রাগ চড়ে গেছল,-- অ্যাদ্দিন ইমানদারীতে কাজ করে শেষে এই পুরস্কার! তৎক্ষণাৎ রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে ওনাকে ধরিয়ে দিয়ে বল্লাম-- যখন আমার ওপর আপনার বিশ্বাস উঠে গেছে তখন আর আপনার সংস্থায় কাজ করব না। চলে এলাম বাড়ি।
    -- তারপর?

    --তারপর সাতদিনের মাথায় জাঈদী সাহেবের মেইল এল। আমার রেজিগনেশন এখনো পেন্ডিং রাখা আছে, চাইলে কালই ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমার রাগ কমে নি, সোজা মেইল করলাম-- অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু আমি থুতু চেটে খাই না।

    এখন বুঝি, মনের মধ্যে অহংকার জমে ছিল। আমি খুব ভাল কাজ জানি। যেকোন ডেভেলপমেন্টাল এনজিও'র জন্যে আমি অ্যাসেট,আমি বসে থাকব না। কিন্তু দু'মাস কেটে গেল-- কোথাও জায়গা খালি নেই। আমার ঘরে আটজন প্রাণী, বড় ছেলে দুটো হায়ার সেকন্ডারি আর ম্যাট্রিক পড়ছে। ওদের ফীস, কোচিং, জামাকাপড়, ঈদ-মহরম সবই তো আছে। জমা পুঁজি নেই।

    হাজার বিশেক মাইনে পাই। নিজের জন্যে কোন শখ-আহ্লাদ করিনে।
    হলে গিয়ে সিনেমা দেখা কবেই ছেড়ে দিয়েছি। হেডকোয়ার্টারে শস্তা সে শস্তা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি, একবেলা রেঁধে খাই। অন্য বেলা চানা বা ছাতু। জামাকাপড় নিজে ধুয়ে ইস্ত্রি করে নিই। মাসে একবার মাইনে পেয়ে টাকা দিতে বাড়ি যাই দিন তিনেক থেকে আবার চলে আসি।

    কিন্তু কোথাও কেউ ডাকছে না। তখন মিঃ ত্যাগীকে বল্লাম। আপনার তো ওর সঙ্গে পরিচয় আছে। রাজস্থানে একটি নামকরা এনজিও’র এইচ আর? ও আমাকে এখানে মধ্যপ্রদেশের নিমাড় জেলায় লাগিয়েছে।

    কিন্তু এখানে অর্গানাইজেশনের প্রোমোটার মহাচোর। দশজায়গা থেকে গ্র্যান্ট নিয়ে ইভেন্ট বেসড্‌ কাজ করে।
    কাজ যা হয়! খালি চুরি! ও চায় ওর স্টাফও চুরির ভাগ নিক আর কোন প্রশ্ন না করুক। কিন্তু আমার দিল গবাহী দেয় না। তাই দেখুন না আপনাদের ওখানে,কুড়িহাজার পেলেই চলবে। আসলে ভোগল সায়েবকে জানি, আর আপনাকেও দেখছি।
    আমি ইমানদারির রোটি খেতে চাই, আল্লাতালা জানেন। এখানে মুখবুজে করে যাচ্ছি, কিন্তু বেশিদিন পারবো না। প্লীজ দাদা! একটু দেখবেন।

    ইতিমধ্যে ওর মোবাইল বেজে ওঠে।
    ও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চগ্রামে কথা বলতে থাকে। রুমের সবাই তাকিয়ে আছে দেখে বাইরে গিয়ে কথা বলতে থাকে। কিন্তু গলার আওয়াজ চড়ছে সেটা ঘরের ভেতর থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
    খানিকক্ষণ পরে ও আবার উত্তেজিত হয়ে হ্যালো-হ্যালো বলতে বলতে ঘরে ঢোকে, তারপর মাথা নেড়ে মোবাইলটা দেয়ালে আছড়ে ফেলে। মোবাইলটি ককিয়ে উঠে টুকরো হয়ে মেজেতে পড়ে যায়। গোটা কামরা নিঃস্তব্ধ।

    কৈলাশ গিয়ে ভাঙা মোবাইলের টুকরো গুলো তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। নাঃ, ব্যাটারি আর সিমকার্ডদুটো মনে হয় অক্ষত রয়েছে। নিজের হ্যান্ডসেটে লাগিয়ে দেখে- হ্যাঁ, কাজ করছে বটেক। সন্ধ্যেয় দশ কিলোমিটার দূরের ছোট টাউনে গিয়ে একটি শস্তা হ্যান্ডসেট কিনে আনলেই আবার রাত্তিরে বউয়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে।

    কেউ কোন কথা বলে না। আবদুল্লা দেয়ালের দিকে সরে গেছে। আস্তে আস্তে ঘর খালি হয়ে যায়। দাস এগিয়ে গিয়ে আবদুল্লার কাঁধে হাত রাখে। আবদুল্লা আস্তে করে সরিয়ে দেয়। একটু পেছন ফিরে দাঁড়ায়।

    --- মোবাইল ছুঁড়ে ফেললে কেন?
    কোন জবাব নেই।
    -- এত রাগ কার ওপরে? এভাবে একটি চাকরি খুইয়েছ, ছেলেদের পড়াশুনো শেষ হয় নি। তারপর?
    -- কী করব? আমি ছেলেকে জিগ্যেস করছি, কেন কোচিংয়ে যাচ্ছে না, তো ও লাইন কেটে দিল!
    --তুমি কি করে জানলে যে ও লাইন কেটে দিয়েছে?

    -- আমি জানি, ও শালার ছেলে বহুত নচ্ছার টাইপ। আমি খেটে মরছি, ওদের জন্যে সব কিছু করছি। আপনি দেখছেন খুব সাদাসিদে ভাবে থাকি, কোন সাধ-আহ্লাদ করি নে। নিজের হাতে জামা কেচে ইস্ত্রি করে ব্যবহার করি। ওদের পড়ার খরচা দিতে, খাতাবই দিতে কোন কার্পণ্য করি নে। তবে কেন শালার ছেলে পড়বে না? জিগ্যেস করেছি তো লাইন কাটবে!
    -- ধেত্তেরি! সেই এক কথা! আরে এই গহন জঙ্গলে হরদম নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, তারপর ট্রেনিং সেন্টার থেকে শুনেছি দিনের বেলায় জ্যামার লাগিয়ে রাখে। আমারও তো বউয়ের সঙ্গে কথা কইতে দশবার লাইন কাটছে, তার মানে কি গিন্নি ইচ্ছে করে?
    -- কী যে বলেন! কোথায় বৌদি আর কোথায় ওই উনপাঁজুরে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে!

    -- তুমি তোমার ছেলেদের সাথে একটুও বন্ধু হতে পার না? খালি শাসন কর?
    কখন রামজীবন ফিরে এসেছে, হরিদাস স্বস্তি বোধ করে।

    -- দেখুন, আমি ভাবি আমার বাড়িতে আমার কথাই ফাইনাল। আমি জানি সবার ভাল কিসে হবে। আর আমার অন্য কোন স্বার্থ তো নেই। তাই যখন দেখি আমি যা যা নির্দেশ দিয়ে এসেছি সেগুলো ঠিকমত মানছে না, তখন মাথায় রক্ত চড়ে যায়।
    মানছি, মোবাইল আছড়ে ফেলা বোকামি। আমি যে বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারি না। বড় দুটো বাঁদর। কিন্তু ছোট চারটে আমার সঙ্গে খেলে, আমার গায়ের ওপর ওঠে।
    ইতিমধ্যে ঘন্টা বেজে ওঠায় ওরা ক্লাসে চলে যায়।



    আজকের ক্লাসে গিয়ে দেখা গেল জলের বোতল নেই, মসকুইটো কয়েলও নেই। ওই অ্যানাকোন্ডা মিঃ ওয়ালিয়া নিশ্চয়ই এইসব দেখে নিজের হাতে বোতলে জল ভরে আনবেন। মনে মনে আমাদের কী ভাববেন কে জানে! দাস দুটো খালি বোতল হাতে নিয়ে জল আনতে চলল। ও জানে যে ভালো লীডর হুকুম না দিয়ে বাই এগ্‌জাম্পল লীড্‌ করে।
    কিন্তু ক্লাসরুমের বাইরে দু'পা এগিয়েছে কি অ্যানাকোন্ডা!
    মাপা পায়ে ক্লাসরুমের দিকে প্রায় নিঃশব্দে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ও থতমত খেয়ে বলে ওঠে -- স্যার, জল নিয়ে আসছি।
    অ্যানাকোন্ডা কোন কথা না বলে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। কি অসভ্য লোক রে বাবা! প্রোগ্রামের ডীন হয়েছে তো মাথা কিনে নিয়েছে। জল-টল নিয়ে ফিরে এসে ও দেখতে পেল ধুন্ধুমার বেধে গেছে।

    বিনীতার মুখ রাগের চোটে লাল টকটকে, পারলে চোখের আগুনে আবদুল্লাকে ভস্ম করে ফেলে।
    -- তাহলে আপনি আমাকে বন্ধু মনে করেন না! বেশ, কারণটা কি জানতে পারি?

    আবদুল্লার চেহারায় একটা কাঠিন্য, চোয়াল যেন বেশি শক্ত। ও কোন উত্তর না দিয়ে স্বীকৃতিসূচক মাথা হেলায়।
    বিনীতার ক্রোধের পারা কয়েক ডিগ্রি চড়ে যায়। গলার পিচ তার সপ্তক ছুঁয়ে ফেলে।
    -- এখানে বাকি চারজন আপনার বন্ধু, শুধু আমি বাদ। আমার অপরাধ? আমি মেয়ে, তাই না?
    আবারও আবদুল্লার মাথা নড়ে ওঠে।
    -- শুধু মেয়ে বলে আমি আপনার বন্ধুত্বের যোগ্য নই? মেল-শভিনিস্ট- পিগ কথাটা শুধু শুনেছি, আজ প্রথম কাউকে প্রত্যক্ষ করলাম।

    "পিগ' শব্দটি কি আবদুল্লার মুসলিম সত্তায় আঘাত করল? মনে পড়ল বঙ্কিমের কোন উপন্যাসের, বোধহয় 'দুর্গেশনন্দিনী', একটি এপিসোড্‌। এক মুসলিম মাছ-ভাত খাচ্ছিল, আগন্তুক হিন্দু প্রতিবেশিকে দেখে ইয়ারকি করে বলল-- আপনাদের অবতার ভক্ষণ করিতেছি।
    চট্‌ জলদি জবাব এল—কোন অবতার? তৃতীয় অবতার নাকি?
    মুসলিম ভদ্রজনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল-- তওবা! তওবা!

    আবদুল্লার অন্তর্মনও কি শভিনিস্ট- পিগ অভিধায় ভুষিত হয়ে তওবা-তওবা করে উঠেছে?

    যেন চিন্তার প্রতিধ্বনি করে আবদুল্লা বলে উঠলো-- আমাকে যা খুশি গাল দিন গে, সে আপনার শিক্ষা ও রুচির ব্যাপার। কিন্তু কোন মেয়ে আমার বন্ধু হতে পারে না। আমার ধর্মে যে শিক্ষা পেয়েছি তাতে মেয়েরা আমাদের সমান নয়, বন্ধু হবে কি করে?

    ঘরের মধ্যে ব্যারোমিটারের পারা আরো নেমে গেল। সবাই চুপ।

    দাস বলে-- আবদুল্লা ভাই! মেয়েদের ব্যাপারে এমনি চিন্তা নিয়ে আপনি মেয়েদের সেল্ফ-হেল্প-গ্রুপ চালান কী করে? ওদের মবিলাইজ করেন কী করে?
    -- তাতে কি হয়েছে? আমি দুর্বল, পীড়িত মহিলাদের সংগঠিত করি, ওদের বন্ধু ভাবি না তো? এর মধ্যে কোন স্ববিরোধ নেই।

    বিনীতার মুখের রেখা বঙ্কিম হয়ে ওঠে।
    --ওহো, মেয়েরা আপনার দয়ার পাত্র। আপনি দুর্বল, অসহায় মেয়েদের করুণা করেন। বেশ, বেশ!
    -- আপনি হয়তো ব্যতিক্রম, কিন্তু অধিকাংশ মেয়ে এই সমাজে অবশ্যই দুর্বল, সাহায্যপ্রার্থী। আপনাদেরই মনুসংহিতায় আছে না যে নারী স্বাধীন স্বতন্ত্র নয়। অল্পবয়সে বাবার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের প্রটেক্‌শনে থাকে?

    এবার গঙ্গারাম উত্তেজিত হয়।
    -- এটাও জেনে বসে আছ, আবদুল্লা ভাই? আরো অনেক আছে। তুলসীদাস বলেছেন-
    'ঢোল, গঁওয়ার, শূদ্র, পশু, নারী,
    সকল হ্যায় তাড়ন অধিকারী'।

    অর্থাৎ, ঢোল, গোঁয়ার, শূদ্র, পশু,এবং মেয়েদের পিটিয়ে ঠিক লাইনে রাখতে হয়। এটা পড়নি?
    রবীন্দ্রনাথের "স্ত্রীর পত্র'' পড়েছ? তাতে উনি সতী অনুসূয়ার কুষ্ঠরোগগ্রস্ত স্বামীকে পিঠে করে বেশ্যালয়ে পৌঁছে দেবার বহুপ্রচারিত গল্পটিকে পুরুষদের কাপুরুষতার চরম বলেছেন।
    পড়নি? যত্তসব গারবেজ মনে রেখেছ শুধু!

    -- ওটা আপনাদের ধর্মের ব্যাপার, আপনারা ভাল বুঝবেন। আমি শুধু আমার ধর্মের অনুশাসন মানতে বাধ্য।
    কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়।
    বিনীতা উঠে পড়ে।-- আমি একটু বাইরে খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসছি।

    ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর নীরবতা। গুমোট বাড়ছে। অ্যানিমেটর ওয়ালিয়া বোধহয় পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছিলেন। রামজীবন বোতল থেকে জল খায়। জয়ন্ত জায়গা বদলে কৈলাশের পাশে গিয়ে বসে। গঙ্গারাম জানলার পর্দার গায়ে বারবার একটি বোলতার আছড়ে পড়া দেখতে থাকে। তার মধ্যে কোন প্যাটার্ন আছে কিনা ভাবতে থাকে।

    -- মানুষ আর কী ভাবে মুক্ত হবে? নিজেই নিজের হাত- পা শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। নানারকম শেকল। কোনটা ধর্মের, কোনটা ভাষার, কোনটা রাজনীতির।

    ওরে বাবা, অ্যানাকোন্ডার ঘুম ভেঙেছে। অ্যানাকোন্ডার চ্যাটালো মাথা বিবর থেকে বেরিয়ে এসেছে, হলদেটে চোখ গুলো আবদুল্লাকে একদৃষ্টে দেখছে।

    ইতিমধ্যে বাইরের খোলা হাওয়া খেয়ে বিনীতা শুভা মুদগল ফিরে এসেছে। কিন্তু এখন সবার চোখ অ্যানাকোন্ডা- অ্যানিমেটর ওয়ালিয়ার দিকে। শিকার ধরতে উদগ্র সরীসৃপ-- চেরা জিভ বেরিয়ে এসেছে।
    --কী যেন আগে বলছিলেন , আবদুল্লা? আপনার বড়ছেলে দুটো অবাধ্য, কথা শোনে না, ঠিকমত পড়াশুনো করে না? কোচিংয়ের ফি নিয়েও সেখানে যায় না?
    যাবে কি করে! আপনার ওই মাই-ওয়ে- অর-হাইওয়ে অ্যাটিচুড তো ক্ষমতার ভাষা, স্নেহশীল বাপের ভাষা নয়! ওদের বোধহয় ঘরে থাকতেই ভালো লাগে না। আপনি যখন রাগের চোটে মোবাইল ভেঙে ফেলতে পারেন তখন সামনে পেলে নিশ্চয়ই ওদের গায়ে হাত তোলেন?
    --- তা অবাধ্য ছেলেদের শাসন করতে একটু-আধটু ওরকম হয়ে যায়। কিন্তু আপনি যেরকম ভাবছেন তা নয়। বাকি চারটে বাচ্চারা আমার সংগে খেলে, পিঠে-ঘাড়ে ওঠে।

    বাঃ, আবদুল্লা অ্যানাকোন্ডার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে।

    -- এটা বেশিদিন থাকবে না। আপনার যা অ্যাটিচুড ওরাও শীগ্গির বারমুখো হবে।
    এই বলে ওয়ালিয়া আবার পাশ ফিরে শুলেন।

    যাকগে, এযাত্রা বোধহয় ওনার শিকার ফসকে গেল। দমবন্ধ ভাবটা কাটাতে দাসবাবু একটু জল খায়, বোতল যথাস্থানে রাখে। আড়চোখে ঘড়ি দেখে নিশ্চিন্ত হয় যে চায়ের ঘন্টা বাজতে বেশি দেরি নেই।

    --- মাফ কীজিয়েগা, আপনি শেষবার কবে বৌয়ের গায়ে হাত তুলেছেন বলবেন কি?
    আচমকা সরীসৃপের হামলা। অ্যানাকোন্ডা শিকারকে বুঝতেই দেয়নি। টপ করে গিলে নিয়েছে। বাকি পাঁচজন দর্শক উত্তেজনায় টানটান। ঘরের মধ্যে অক্সিজেন কমে গিয়েছে।

    এমন প্রশ্ন কাউকে করা যায় নাকি? এতো নেহাৎ ব্যক্তিগত, অপমানকর; তাও আবদুল্লাকে? ও যদি অ্যানিমেটর ওয়ালিয়ার বিরুদ্ধে এথিক্স কমিটিতে যায়? ও যদি এমন ওয়ার্কশপ বয়কট করে? ওয়ালিয়া এমন লুজ নো-বল করলেন? সেটা আবার ওয়াইড হয়ে বাউন্ডারির দিকে চলে যাচ্ছে!

    -- প্রায় পাঁচবছর আগে।
    আবদুল্লার খাদে নামা গম্ভীর স্বর শোনা যায়।

    জয়ন্ত অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে,"তারমানে বছর পাঁচ আগে আপনি বৌকে পেটাতেন? কেন?"
    --- হ্যাঁ, আমার কথা না শুনলে; আমি চাই আমার বাড়িতে যেমন বলব তেমনটি করতে হবে। ব্যতিক্রম হলে ভীষণ রাগ হত।
    -- "কেমন মারতেন? জোরে? বাচ্চাদের সামনে?'', রামজীবনের প্রশ্ন।
    -- হ্যাঁ, বাচ্চাদের সামনে। হাত দিয়েই, বেশ জোরেই হয়ে যেত। ওই যে বল্লাম, আমার বাড়িতে ডিসিপ্লিন ব্রেক আমি বরদাস্ত করি না। তাহলে বাচ্চারা কী শিখবে?

    হতভম্ব গঙ্গারাম শুধোয়,-- আর এখন?
    -- এখন আমি আর রোজকার ব্যাপারে মাথা গলাই না। ওর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। বলি- তুই যা ভাল বুঝছিস তাই হবে।
    ক্রি-রি-রিং করে বেল বেজে ওঠে।

    গঙ্গারাম বাইরে গিয়ে চা-বিস্কুট নিয়ে এদিক-ওদিক থেকে ওয়ালিয়াকে খুঁজে বের করে। ওনাকে একটু কোণার দিকে নিয়ে যায়। বড় বড় শ্বাস ফেলে জিগ্যেস করে--একটা কথা জানতে চাইছি, আপনি আবদুল্লাকে অমন প্রশ্ন কী করে করলেন? এত ব্যক্তিগত এবং অপমানজনক প্রশ্ন? ও যদি অন্য ভাবে নিত?

    ওয়ালিয়ার চোখে একটা দুষ্টু ফিচেল হাসি।
    -- হ্যাঁ, আমি অনেক ভেবে এই প্রশ্নটা করেছি। এটা একটা লোডেড কোশ্চেন বটে! রিস্ক ছিল, নিয়েছি। ক্যালকুলেটেড রিস্ক, আমাদের পেশায় নিতে হয়।
    শচীন- সৌরভ যখন স্টেপ-আপ করে ছয় মারে তখন কি রিস্ক থাকে না? স্টাম্প হওয়ার রিস্ক? বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডারের হাতে ধরা পড়ার রিস্ক? তবু নিতে হয়, ওরা নেয়, দশবারের মধ্যে সাতবার সফল হয় আর তিনবার হেলমেট হাতে করে হেঁটে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসে।

    -- তবু? কিছু একটা--?
    --হ্যাঁ, ছেলেটা অসম্ভব সৎ। দেখলে তো? ও বলতেই পারতো যে এরকম কিছু হয় নি, আমি কক্ষণো বউয়ের গায়ে হাত তুলিনি। অনেক সাহস লাগে সবার সামনে স্বীকার করতে! আর এখান থেকেই হয়তো ছেলেটা ঘুরে দাঁড়াবে।
    দাস অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবতে ভাবতে ক্লাসে ফেরে।
    ক্লাসে ঢুকে থমকে দাঁড়ায় ও। যেন বিজয়াদশমীর কোলাকুলি চলছে। রামজীবন জয়ন্তের আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে কিছু ফিসফিস করে বলে চলেছে।
    শালা! আঠা দেখ, যেন কোন গে-দম্পতি। গঙ্গারামের জিভের স্বাদ কেমন তেতো হয়ে যায়।

    কিন্তু নেপালী চেহারার ছয়ফুটিয়া কৈলাশ আবদুল্লার হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে আসে,--কোথায় গিয়েছিলেন দাদা? সেবার হিমালয়ের কোলে কেমপ্টি ভিলেজের ওয়ার্কশপে আপনার সঙ্গে কত কথা হত, এবার আপনার নাগালই পাচ্ছিনা। আজ রাত্তিরে আপনার সঙ্গে এক রাউন্ড হয়ে যাক। ওই টি-টুয়েন্টি আজ বাদ দিন। অনেক কথা বলার আছে।

    গঙ্গারামের হাড়- পাঁজরা নিয়মিত জিমে যাওয়া ছেলেটির চাপে ককিয়ে ওঠে।
    চোখের কোণ দিয়ে দেখে বিনীতার হাত ধরে রয়েছে আবদুল্লা, বলছে-- আমি চেষ্টা করব, আজ থেকেই, একটু একটু করে। তোমার সাহায্য চাই।
    শুভা মুদগলের চেহারা ঝলমলিয়ে ওঠে।
    --তুমি ঠিক পারবে, আবদুল্লা। আমি তো আছিই।
    ভ্যাবা- গঙ্গারামের কোথাও একটু খোঁচা লাগছে, হিংসে? নাকি মনের ভুল?

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ অক্টোবর ২০২৪ | ১৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:৫৯538637
  • সত্যি আগল ভাঙ্গে এভাবে? গাঁট মানুষেরও? কোর্স নেওয়ার আগে - পরে কোন মেন্টাল ওরিয়েন্টেশন জাতীয় কিছু মাপা হয়?
  • kk | 172.58.***.*** | ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ২০:০৮538639
  • কার মনের আগল কিসে ভাঙে এই জিনিষটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। খুব আন-এক্সপেক্টেড ট্রিগার থেকে মহা শক্ত মানুষেরও আগল বালির বাঁধের মত ধ্বসে যেতে দেখেছি ... একটা কথা, একটা ঘটনা, পাশে বসা অচেনা মানুষের একটা ইমোশন....আসলে হয়তো খুব চাপা, খুব অনিচ্ছুক মানুষেরও কোনো একটা অংশ তার জমাট কষ্টগুলো শেয়ার করতে চায়। কোথাও একটা সাপোর্ট, কারুর পাশে থাকা চায়। সেটা চেনার থেকে অচেনা মানুষদের কাছে পাবার সম্ভাবনা বেশি বলে আমার মনে হয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন