এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • যে আঁধার আলোর অধিকঃ পর্ব ১৪

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ২১৬ বার পঠিত
  • ১২
    আর মাত্র দেড় দিন। আজকের সেকন্ড সেশন, আর কালকের গোটা দিন। এর পর সবাই ফিরে যাবে নিজের নিজের আস্তানায়, দৈনন্দিন জীবনে, রুটি-রোজির ধান্ধায়। সেখানে গিয়ে কতজন এই ওয়ার্কশপের শিক্ষাগুলোকে আত্তীকরণ করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে?
    বলা মুশকিল। আজ দিনের শুরুতেই অ্যাডমিন থেকে কিছু হ্যান্ড আউট আর একটি বই দেয়া হয়েছে।

    একটি প্রবন্ধে সাবধান করে দেয়া আছে যে সবাই বাড়ি গিয়ে যেন তক্ষুণি নিজের বৌ-বাচ্চাকে ধরে- বেঁধে " হিয়র এন্ড নাউ " প্রিন্সিপল শেখাতে না বসে!
    এও বলা হয়েছে যে ছোটবাচ্চা নতুন নতুন দাঁত উঠলে সব কিছুকে কামড়াতে চায়। তেমনি একসপ্তাহের ওয়ার্কশপ করে সবাই ভাবে টি-গ্রুপ মেথড শিখে গেছে।

    -- সাধু সাবধান,
    ফির কহি কর অবধান।
    শহরের বাইরে হাইওয়েতে গাড়ি চলে ৮০-৯০ এর স্পীডে, কিন্তু শহরে ঢুকলেই সাইনবোর্ড চোখে পড়ে-- স্পীড ২৫ বা ৩০ এর বেশি নয়।
    তেমনি এখানে প্রাত্যহিক জীবনের বাইরে আইসোলেটেড ল্যাবরেটরি কন্ডিশনে প্রত্যেককে অবজার্ভ করা হচ্ছে। সেটা রিয়েল লাইফে সম্ভব নয়। কাজেই তাড়াহুড়ো করে ডেটা নিলে ভুল হওয়ার চান্স বেশি।
    এটা আসলে গোটা জীবন রোজ অভ্যেস করার প্রশ্ন, যেন অবচেতনে বসে যায়! যেমন রোজ ঘর ঝাঁট দিতে হয়।

    আজ শুরুটা ভাল হয় নি। সবাই কেমন রোম্যান ক্যাথলিক হয়ে পাপ-স্বীকারের মুডে আছে।
    রামজীবন তিওয়ারি বিড়বিড় করছে-- সারাজীবন এক ভুলভুলাইয়ায় কেটে গেল। মাকড়সার মত নিজেই নিজের চারদিকে জাল বুনে চলেছি। কে বলেছিল এসব করতে? তাহলে কেন?  গঙ্গারামের এসব একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।
    ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল-‘তাই অসহ্য লাগে ও আত্মরতি,
    অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে’!
    -- এটা কি?
    -- কিছু না; বাংলা কবিতা।
    -- গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের লেখা?
    ধুস্‌ শালা! দাড়িদাদু ছাড়া বাংলায় কেউ পদ্য লেখেনি নাকি?

    ও ভাবল, সুধীন দত্ত ও বিষ্ণু দে নিয়ে কিছু ডায়লাগবাজি করবে, কিন্তু কৈলাশ ইশারায় চুপ করতে বলল। ঘরের ওপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে জয়ন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল। অবাক গঙ্গারাম উঠে গিয়ে ওকে রুমাল এগিয়ে দিল, পিঠে হাত রাখল, আরে! হয়েছেটা কী?

    ভাঙা গলায় জয়ন্ত বলে--- আমি আমার সংগঠনের সব জুনিয়র মেয়েদের বলেছিলাম যে আবদুল্লা নিজের ওপর কঠিন এক্সপেরিমেন্ট করছে। ও মেয়েদের ব্যাপারে ধার্মিক ও সামাজিক প্রেজুডিস কাটিয়ে সমান ভাবে মেশার চেষ্টা করছে। কিন্তু সহজ হওয়া সহজ নয়। তোমরা ওকে একটু সাহায্য কর। কনশাসলি হেল্প কর।

    -- তাতে কী হয়েছে?
    -- আমার কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে আমি কেন আবদুল্লাকে আমার চেয়ে কমজোর দুর্বল ভাবলাম? কেন ভাবলাম যে ও নিজে এই প্রবলেম হ্যান্ডল করতে পারবে না? আমি কেন অহংকারের চোটে বন্ধুকে অসম্মান করলাম?

    বাবা! এতো সুপার-ন্যাকামি, অতি- দার্শনিকতা! বুদ্ধিজীবি জয়ন্তের কি টি-মেথডের বদহজম হল?

    বিনীতা গিয়ে জয়ন্তের হাত ধরে খানিকক্ষণ বসে রইল। এই মেলোড্রামা শেষ হল আবদুল্লা ও জয়ন্তের কোলাকুলি দিয়ে, তারপর চায়ের ঘন্টি বেজে উঠল ঠিক সিনেমা হলের ইন্টার্ভ্যালের মত।
    চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে ও দেড়েল জয়ন্তের থেকে জানার চেষ্টা করছিল যে ও কোন বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের ভক্ত কি না! কিন্তু জয়ন্তের কেমন নিরাসক্ত হাবভাব, যেন গঙ্গারামকে ও আগে থেকেই মেপে নিয়েছে। ও দুদিকে প্রবল মাথা নেড়ে বলল যে ও খালি মার্কেট ক্যাপিটালিজম ও তার অঙ্গ গ্লোবালাইজেশনের প্রবল সমালোচক।

    ও কি বেশি সাবধানী? ও কি ভয় পায়? কোন শালা পায় না!

    এঁটো কাপ রাখতে রাখতে ওর চোখে পড়ল যে মেয়েদের একটি ছোট দঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আবদুল্লা অঙ্গভঙ্গী করে কিছু বলছে আর সবাই হেসে উঠছে।

    গঙ্গারামের মাথায় কিলবিল করছে কিছু বেয়াড়া কবিতার লাইন, সম্ভবতঃ আশা দেবীর কোন হাসির গল্পের কোথাও-- ফুলশয্যার রাতে বৌয়ের নকল চুলের খোঁপা দেখে নায়কের মনের আকুলি-বিকুলিঃ
    " তোমার কালো চুলের মাঝে,
    কি যে আছে, কি যে আছে,"
    তারপরই গল্পের নায়কের মাথায় এসেছিল
    " চড়ব আমি আমড়া গাছে।"

    ও ক্লাসের দিকে এগিয়ে যায়। জয়ন্ত নিজের রাজনৈতিক পরিচয় কেন লুকোতে চাইছে? নাকি সবটাই আমার কল্পনা? মার্কেট ক্যাপিটালিজমের সমালোচক, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে যুক্ত নয়?
    হ্যাঃ, কাঁঠালের আমসত্ত্ব! ল্যাঙ্গটের বুকপকেট? কী হচ্ছে কী! এসব কি ভাবছে ও? তোমার অহংকারে বা কনফিডেন্সে আলপিন ফুটিয়েছে কেউ, তোমাকে হিন্দিতে যাকে বলে ' নাপ দিয়ে হ্যায়!'

    তবু আকাশের ময়লা কাটছে না।
    এবার কোত্থেকে মনে আসছে ছোটবেলার শোনা একটা শস্তা চুটকি।
    শেয়ালদা প্ল্যাটফর্মের পাশের ঝুপড়িতে একটি বাঙাল মেয়েকে লাইন দিচ্ছেন শহরের ধনীঘরের বখাটে ছোকরা।
    ছেলেঃ করুণা, একটু ভাব তো! আকাশে ওই রূপোর থালার মত চাঁদ, আর নীচে তুমি আর আমি!"
    বাঙাল মেয়েটিঃ " হ, হ! বুঝসি, বুঝসি, তুমি আমার লগে শুইতে চাও, তাই পটাইবারে লাগঝ-অ!"
    এটা কেন মনে এল? জয়ন্তও কি ওই চুটকির প্রতাড়িত অভিজ্ঞ মেয়েটির মতো পূর্ব অনুভব থেকেই সাবধানী হয়েছে?

    কিন্তু আমার তেতো অনুভবের আরও বাকি ছিল।
    আজকের বিকেলের সেশনে ফেসিলিটেটর ওয়ালিয়া একটু আগে এসেছেন। বসে বসে কিছু ফাইল নাড়াচাড়া করার ফাঁকে খুটুর খুটুর নোটস্‌ নিচ্ছেন। একবারও কাত হয়ে গুহায় ঢুকতে থাকা অ্যানাকোন্ডার পোজ মারেন নি। ওনার অন্যমনস্ক চোখ মাঝে মাঝে আড্ডারত ট্রেনিদের ওপর দিয়ে সার্কাসের তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসা সার্চলাইটের মত ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ফলে দাসবাবু এন্ড কোং একটু অসহজ।
    এবার উনি কাগজপত্তর গুছিয়ে নিয়ে চশমাটা ঠিক করে গলা খাঁকারি দিলেন। ক্লাসরুম জুড়ে সন্নাটা, সন্নাটা।

    ---আগামী কাল সন্ধ্যেনাগাদ আমাদের এবারের ওয়ার্ক্শপ শেষ হবে। তোমরা এই ফীডব্যাক ফর্মগুলো নিয়ে আজ রাত্তির থেকেই ফিল আপ করা শুরু করে দাও। বলা বাহুল্য, নির্ভয়ে লিখবে।
    ফেসিলিটেটর থেকে টোটাল কোর্স ডিজাইন, লজিস্টিক প্রবলেম্স-- সব ব্যাপারে খোলাখুলি লিখবে। তাতে আমাদের সুবিধে হবে। এই টি-গ্রুপ মেথডে তোমরা ভাল ভাবে পার্টিসিপেট করেছ। চেষ্টা করেছ নিজেকে মেলে ধরার, অন্যদের চোখে নিজেকে দেখার, অন্যদের দেয়া ডেটা সিরিয়াসলি নিয়ে সমীক্ষা করার।
     আমি বিশেষ ভাবে বলব আবদুল্লার কথা। গত কয়েকদিনে ও যেভাবে মেয়েদের ব্যাপারে নিজের প্রেজুডিস কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে, নিজের সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে--- আমরা অবাক হয়ে গেছি।

    হ্যাঁ, আমরা ; মানে "আইস্যাব্স্‌" এর সমস্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বার। আমরা নিজেদের মধ্যে রোজ রাতে আলোচনা করি কঠিন কেসগুলো নিয়ে। সবাই মিলে নজর রাখি "অবজেক্ট" এর ওপরে। ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে। কারণ আমরা মনে করি -- মানুষ ক্লাসরুমের ভেতরে ও বাইরে একই থাকে-- তাই। এটা গোয়েন্দাগিরি নয়।
    তোমরা " বেসিক হিউম্যান ল্যাব" কমপ্লিট করে "অ্যাডভান্স হিউম্যান ল্যাব” অ্যাটেন্ড করতে এখানে এসেছ। ফ্যামিলি ও ওয়ার্কপ্লেসের পরিচিত এনভায়রনমেন্ট ছেড়ে এই পান্ডববর্জিত জায়গায় । এখানে গোটাটাই ল্যাবরেটরি। ক্লাসরুম, রিক্রিয়েশন রুম, বাগান, ডাইনিং হল-- সব মিলে একটাই ইউনিট।

    কিন্তু একজনকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। প্রথম দু'দিন সে ঠিক ছিল। তারপর থেকেই তার অন্য চেহারা আমরা দেখতে পেলাম। সে গিরগিটি। রং বদলায়।

    সে একজন সেল্ফ- অবসেসড্‌ পুরুষ। সে বলে গ্রুপ-ফিলিং এর কথা, কিন্তু ব্যবহারে সব সময় নিজেকে প্রোজেক্ট করতে চায়। নিজের প্রতিবাদী চরিত্র নিয়ে বড়াই করে, আসলে সবসময় ক্ষমতার সঙ্গে সুনজরে থাকতে চায়। অন্যদের সাহায্য করে, আসল উদ্দেশ্য সবাইকে বশ করা, ওর স্তাবক বা চামচা বানানো। বলে সবাইকে স্পেস দেয়ার কথা, বলে "শত-পুষ্প বিকসিত হোক"। কিন্তু ওর কথার প্রতিবাদ করে দেখ, দেখবে কেমন লেজের ওপর ভর দিয়ে ফণা তুলে দাঁড়ায়!

    তাই আমার বিশ্লেষণে সে একজন স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক এবং হীনমন্যতায় ভোগা লোক। সেশনগুলোর মাঝে আমি ওকে কিছু সিগন্যাল দিয়ে্ছিলাম। ও সেগুলো না দেখার ভান করে। ও সিগন্যালগুলো বোঝেনি তা নয়। ও বোকাহাঁদা নয়, বরং ইন্টেলেকচুয়ালি শার্প। এটা ওর শক্তি, আবার এটাই ওর কাল হয়েছে।

    আবদুল্লা যে ওর ছোটবেলা থেকে ধর্মের মোড়কে সযত্নে লালিত সেক্সিস্ট পুরুষবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে পেরেছে তার কারণ ও বেসিক্যালি সরল, অকপট খোলামনের মানুষ। এটাই দরকার। আমি গর্বিত যে আমি আবদুল্লার মত মানুষের মেন্টর।

    কিন্তু আমাদের 'উনি' নিজের সঙ্গেও লুকোচুরি খেলেন, অভিনয় করতে করতে সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তাই ওনার উদ্ধার নেই। এই টি-গ্রুপ মেথড ওঁর মত মানুষের জন্যে নয়।
    ওনার নাম বাবু গঙ্গারাম দাস।

    ১৩
    ঘুমুতে পারছে না গঙ্গারাম । মার্চের শেষ, ঘরের বাইরে ক্যাম্পাসের গাছগুলোয় মৃদুমন্দ হাওয়া। ক্যাম্পাসের বাগানটা খুব বড়, প্রায় সংরক্ষিত জঙ্গলের মত। কোথাও একটা দুটো পাখি ডাকছে, ভোর হচ্ছে কি? মোবাইলের আলোয় দেখা গেল সাড়ে তিনটে। এই পশ্চিম প্রদেশে মালব উপত্যকায় মার্চের ভোর হতে হতে ছ'টা বাজবে। এখনো আড়াই ঘন্টা। ঘরের নীল আলোয় চোখে পড়ছে চারটে খাট, তাতে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে তিনজন। পাশের খাটে আবদুল্লার নাক ডাকছে ফুরুর-ফোঁৎ, ফুরুর-ফোঁৎ।

    আমি জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলাম, বাথরুম থেকে ঘুরে এ্লাম। তারপর ডায়রি নিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে আলোর নীচে বসলাম।

    অ্যানাকোন্ডাটা ভেবেছে কী? যা খুশি বল্লেই হল!  গঙ্গারাম ডিজঅনেস্ট? হিপোক্রিট? পাওয়ারের সঙ্গে সমঝোতা করতে চায়, তেল দিয়ে ইম্প্রেস করতে চায়?
    আরো কত কী বলেছে ওয়ালিয়া।
    দাস যখন মেয়েটিকে হাগ্‌ করে তখন ওর হাতের তেলো ওর পিঠের ওপর আস্তে আস্তে পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করে, অর্থাৎ নিজের অজান্তে ওর নিজেকে বড় ভাবার মানসিকতা প্রকট হয়ে যায়।
    ও যখন জয়ন্তকে কাঁদতে দেখে, তখন গায়ে পড়ে পকেট থেকে চোখ মোছার জন্যে রুমাল দেয়। অর্থাৎ নিজেকে দলের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল, সবচেয়ে মানবিক দেখাতে চায়। কি যেন বলেছিলেন উনি? হ্যাঁ, বাবু গঙ্গারাম দাস হলেন সংযুক্ত হিন্দু পরিবারের কর্তা।
    শালা নিজেকে ভাবে কি? বিহেভিয়ারিয়াল সায়েন্সের জাদুকর?

    দেখাচ্ছি, কাল প্রথম সেশনেই দেখাচ্ছি। অ্যানাকোন্ডার হিমশীতল চোখের চাউনির ম্যাজিক কাল উপে যাবে।

    --ও দাদা! উঠুন, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সারারাত কি যে বিড়বিড় করছিলেন, ঠিক করে ঘুমোন নি?
    গঙ্গারাম দাস ধড়মড় করে উঠে বসে। চায়ে চুমুক দেয়। সকালের রোদে বিছানা ভেসে যাচ্ছে। ও ঘড়ি দেখে। চটপট চানের জন্যে তৈরি হয়, দাড়ি কামায়। পেটের মতে একটা গুড়গুড় , একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। এটা দাসবাবুর পরিচিত অনুভূতি। প্রত্যেকবার স্টেজে ওঠার আগে মেকাপ নিয়ে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে ওর এমনি লাগে।
    আচ্ছা, একবার পার্টটা ঝালিয়ে নিলে কেমন হয়? যাতে কোন ভুলচুক না হয়?

    -- আচ্ছা, আবদুল্লা! তোর কি মনে হয় আমি এতটাই খারাপ?
    -- মানে?
    -- মানে ওই ওয়ালিয়া কাল যেমন বললো। আমি কি খুদগর্জ, স্বার্থী? দুসরোঁকে সর পর পাও রাখকর উপর চড়নেওয়ালে? তোর কি মনে হয়? সত্যি কথা বলবি।
    -- না দাদা! ওসব ভাববেন না। তাহলে কি আর আমি ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে আপনার রুমে শিফ্ট করতাম? চলুন, ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে গেছে। আজই শেষ দিন।
    -- দাঁড়া, আজ ওই শালা অ্যানাকোন্ডাকে ঝাড়বো। মনে হয় ও ইচ্ছে করে কাল ওইসব বলেছে, আমাকে প্রোভোক করতে চায়। তোকে একটু ডেমো দিই? দ্যাখ, চলবে কি না?

    ডেমো দেখে আবদুল্লা কেমন একরকম করে ওর দিকে তাকায়। চলুন দাদা! দেরি হয়ে যাচ্ছে।

    ১৪

    শেষ দিন।অদ্যই শেষ রজনী। রাত্রে ক্যাম্প ফায়ার। কালকে শুধু ইন্টারফে্স- ভ্যালেডিকশন, বিদায় নেয়া, ফিরে চলো আজ আপন ঘরে-- ইত্যাদি।
    সবাই সময়মত এসেছে। ওয়ালিয়া, থুড়ি অ্যানাকোন্ডা, আজ আবার আধশোয়া হয়ে শেষনাগের শয্যায়। ও কি বুঝতে পেরেছে যে দাস আজ ওকে ঝাড়বে? তাই কোমর কষে তৈরি হয়ে এসেচে?

    সবাই উশখুশ করচে, জয়ন্ত সবার ফর্মগুলো নিয়ে দেখচে যে কোন ডেটা বাদ পড়েছে কি না!
    আমার গলা শুকিয়ে গেছে। পেটের মধ্যে এক ডজন ইঁদুরের ছুটোছুটি। পর্দা ওঠার আগে মেক আপ নিয়ে উইংসের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেমন মনে হয় আর কি! আর কত দেরি করবে তুমি বাবু গঙ্গারাম?---- গুরু, হো যা শুরু! কোন স্টার্টার নেই, নিজেই নিজেকে স্টার্ট দাও।
    রেডি, অন ইয়োর মার্ক, সেট তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, এবার--গো! আরে, কি হল? গো- ইন্ডিগো-গো!
    ---" দোস্তোঁ, আমার কিছু বলার ছিল। সময় বেশি নেই, আপনাদের সবার মনোযোগ আশা করতে পারি কি? বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না। বেশ।

    গতকাল আমাদের মেন্টর ওয়ালিয়া সাহেব এই ক্লাসরুমে আমার সম্বন্ধে কিছু উক্তি, কিছু বক্তব্য রেখেছেন। সেটা ওনার প্রেরোগেটিভ। কিন্তু সেগুলি সত্যি হলে বলার কিছু ছিল না। আমি কাল সারারাত ওনার বক্তব্য, তথ্য, যুক্তি নিয়ে অনেক ভেবেছি। না, আমার মনে হয় নি উনি যা যা বলছিলেন সেগুলো নির্বিবাদ তথ্যের শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে।

    "দেখুন, যিনি আমার ভগ্নিপতি তিনি আমাকে শ্যালক সম্বোধনে আপ্যায়িত করতেই পারেন, আমি আহ্লাদে গলে যাবো। কিন্তু তিনি যদি আমার বোনকে বিয়ে না করে থাকেন তাহলে আমি কথাটাকে গালাগাল অর্থেই নেব।
    উনি এই টি-মেথডের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন যে কারো সম্বন্ধে কিছু ফিডব্যাক দিতে হলে তা ইম্প্রেসনিস্টিক না হয়ে ডেটা বেসড হতে হবে। কিন্তু উনি তাই করেছেন কি? আমি দেখাচ্ছি যে আমার সম্বন্ধে ওনার অভিযোগগুলো সব মিথ্যে, আদৌ এ কদিনের ডেটা ওনার বক্তব্যকে সাপোর্ট করে না।
    "প্রথম,
    আমি সবসময় নিজেকে ফোকাসে রাখার চেষ্টা করি। তাই সেদিন ওনাকে দেখিয়ে জলের বোতলগুলো ভরে রাখছিলাম। আশ্চর্য্য? আমি গ্রুপ-ফিলিং থেকে ওই কাজটা করলাম তাতেও দোষ? আপনারাই বিচার করুন।
    "দ্বিতীয়,
    আমি জয়ন্তকে চোখের জল ফেলতে দেখে রুমাল এগিয়ে দিলাম তাতেও উনি আমার ভন্ডামি দেখতে পেলেন! আমি মশাই রুমাল-টুমাল বেশি ব্যবহার করি না। গতবার বেসিক ল্যাবের কোর্স করার সময় মেন্টর শোলাংকিকে দেখেছিলাম একটি মেয়ের চোখ মোছার জন্যে রুমাল এগিয়ে দিতে। আমি ভেবেছি সেটাই পলিটিক্যালি করেক্ট বিহেভিয়ার। এখন আমার মেন্টর, যিনি গোটা ওয়ার্কশপের ডীন বটেন, বলছেন সেটা ভুল!
    আমি সবাইকে আমার তুলনায় দুর্বল ভাবি? যাচ্চলে!
    "তৃতীয়,
    আমার বিনীতাকে হাগ্‌ করার বডিল্যাংগোয়েজে নাকি আমার মেয়েদের প্রতি পেট্রনাইজেশন প্রকাশ পেয়েছে! আমি নাকি সেই সময় ওর পিঠে যেভাবে হাত বোলাচ্ছিলাম---! মাইরি,এমন গাঁজাখুরি অ্যানালিসিস বাপের জন্মে শুনি নি।
    হতে পারে উনি ভারতবর্ষের নামকরা বিহেভিয়ার স্পেশালিস্ট, কিন্তু আমিও নাটকের সঙ্গে যুক্ত। হ্যান্ড সিগন্যাল, ফুট সিগন্যাল-- আমরাও কিছু কিছু শিখেছি। আমাকে একটু ডেমো দিতে অনুমতি দিন।
    অ্যানাকোন্ডার চ্যাটালো মাথা থেকে দুটো কুতকুতে চোখ নির্নিমিষে আমাকে দেখতে থাকে।

    বিনীতা, তুমি গোটা ওয়ার্কশপে আমাকে অনেকবার সাহায্য করেছ, আজ শেষবারের মত একটু সাহায্য কর। উঠে দাঁড়াও।"
    বিনীতা শুভা মুদগল ভূতগ্রস্তের মত উঠে দাঁড়ায়। আমি মাপা পায়ে ওর দিকে এগিয়ে যাই, ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওর উন্নত পাঞ্জাবী পুষ্ট বুক আমার বুকে পিষ্ট হয়। কিন্তু আমি কিছুই অনুভব করি না।

    বিনীতার গলা দিয়ে কি চাপা গোঙানির আওয়াজ বেরোল? না বোধহয়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে দাসবাবুর ক্যাম্পেন, যেন দৈনন্দিন রেলযাত্রীদের মাঝে লজেন্স বেচছে কোন ক্যানভাসার।

    ---" দেখুন, আপনারা সবাই দেখুন, আমার হাত বিনীতার পিঠে সমান্তরাল রেখায় ঘোরাফেরা করছে। এর ভাষা বন্ধুত্বের, সিগন্যাল --ভরসা দেয়ার। আই গেট য়ু ফ্রেন্ড-বলার। যদি পেট্রনাইজিং হত? তাহলে এইরকম মুভমেন্ট হত, ভার্টিক্যাল, নট হরাইজন্টাল।"
    এই বলে ও আবদুল্লাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে ওর পিঠ ব্র্যাভো বলার ভঙ্গিতে থাবড়ে দেয়।
    --" কাজেই আমার বক্তব্য, ওনার শেখানো মেথড অনুযায়ী খতিয়ে দেখলে , আমি আদৌ আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতার ধামাধরা, স্কীমার নই। হয় উনি বিশ্লেষণে ভুল করেছেন, নয় অন্য কোন মোটিভের বশবর্তী হয়ে আমাকে অপমান করেছেন। আমি এথিক্স কমিটিতে যাব না। আপনারাই বিচার করুন।"

    দশ মিনিট কেউ কোন কথা বলে না।অ্যানাকোন্ডার ভাবলেশহীন মুখ।
    হটাৎ বিনীতা মুখ খুলল।
    --" দাস, আমি কিছুই বুঝছি না।খালি এটুকু বুঝেছি যে এই মুহুর্তে তোর মনের স্থায়ী ভাব বা ইমোশন হল ক্রোধ, অ্যাংগার! আর তোর ডেমো নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। এটা আদৌ সিন্সিয়ার বিশ্লেষণ নয়। বরং একটি ওয়েল-রিহার্সড স্কিট, কলেজের সোশ্যালে যেমন হয়, বা বড়জোর টিভির রিয়েলিটি শো।"
    জয়ন্ত চশমা সাফ করতে থাকে।---আপনি একটু কনফিউজড, দাদা । নিজের বেলায় হিয়ার-অ্যান্ড-নাউ মেথডকে ঠিক করে প্রয়োগ করতে পারেন নি। শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে দেখছেন। গাছ দেখছেন, জঙ্গলকে নয়।

    রামজীবন--" আমার খুব খারাপ লাগছে আপনার গতবারের মেন্টরকে টেনে আনায়। উনি তো আজকে সামনে নেই। ওটা তো দেয়ার -অ্যান্ড-দেন হল, হিয়ার -অ্যান্ড-নাউ নয়।"
    আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক ব্যাটসম্যান হেলায় উইকেট দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাচ্ছে।

    খুব ধীরে ধীরে নীচু গলায় আবদুল্লা কথা বলছে--" দাদা, আমি শকড্‌; এ কোন চেহারা দেখছি আপনার! আপনি বিনীতাকে আপনার নাটকের প্রপস্ এর মত ব্যবহার করলেন? আপনি কি গিরগিটি? এই দাদার জন্যে আমি ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়া করে নিয়ম ভেঙে রুম বদলে পাশের খাট দখল করলাম? হায় আল্লা!"

    এবার হাতে বল নিয়েছেন ওয়ালিয়া। না, টেল-এন্ডারকে কেউ দয়া করে না। সোজা বডি লাইন লক্ষ্য করে শর্ট পিচ বল উড়ে আসছে।
    ---- আমার পাল্টা জবাব দেয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু আমার অবজেক্টিভ ডিবেট জেতা নয়। মনের দরজা-জানালা-গিঁট খোলা। তাই কিছু বলছি।

    এক, আমার কলিগ শোলাংকি যদি কোন সেশনে কোন পার্টিসিপেন্টকে কাঁদতে দেখে রুমাল এগিয়ে দিয়ে থাকেন তবে তিনি ভুল করেছেন। একটু কাঁদলে কোন ক্ষতি হয় না। যদিও আমি ঠিক বিশ্বাস করি না যে ও এমন করেছে। বাবু গঙ্গারাম আউট অফ কন্টেক্স্ট অনেক কথা বলে থাকে। তবু আমি ওকে জিগ্যেস করব। কাউকে দুর্বল মনে করা উচিৎ নয়। মেয়ে বলে তো আরো নয়, তাহলে জেন্ডার বায়াসের প্রশ্ন উঠবে।
    দুই,আমাদের বাবুমহাশয় শুধু বুদ্ধিমান নয়, অত্যন্ত ধূর্ত এবং শাতির দিমাগের লোক। সে আমার শিক্ষাকে আমারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ভাল গুরুদক্ষিণা দিয়েছে। আমার অথরিটি, ইন্টিগ্রিটিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আমার বিরুদ্ধে গোটা ব্যাচকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছে। এমনকি অপ্রত্যক্ষ ভাবে এথিকস কমিটিতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।

    এত অহংকারী লোকের উদ্ধারের আশা নেই। এই ওয়ার্কশপে ও কিছুই শেখেনি, কারণ ও সহজ সরল নয়। আমারই ব্যর্থতা!

    সবাই কথা বলছে। অনেক কথা। হাসি , ঠাট্টা, ছোট ছোট চুটকি।কিন্তু আমার কানে কিছু ঢুকছে না।শব্দ , শুধু শব্দ। যার কোন অর্থ হয় না, আওয়াজ মাত্র। এর মধ্যে কেউ কাউকে চাঁটি মারার কথা বলল, কেউ জল নিয়ে এল। কেউ হেসে উঠল।

    কিন্তু আমি কেন কিছু বুঝতে পারছি না? এরা কোন ভাষায় কথা বলছে? এসবই কি ওয়ালিয়ার নির্দেশ? এরা কারা? এদের চেহারা অচেনা লাগছে কেন? মাথার মধ্যে বড্ড যন্ত্রণা, কেউ যেন চোখে লংকাবাটা দিয়েছে। জলের বোতলটা কোথায় গেল? কেউ সরিয়ে নিয়েছে?
    চোখে বেশ খানিকটা জলের ছিটে আর মাথায় জলের ঝাপটা পেয়ে দাসবাবু যখন উঠে বসল তখন ওয়ালিয়া ওকে চেপে আবার শুইয়ে দিলেন। ভিজে জামা, অস্বস্তি লাগছে, কিন্তু ওয়ালিয়া নাড়ি ধরে রয়েছেন।
    এবার বল্লেন-- ভয়ের কিছু নেই। কেউ ক্যান্টিনে গিয়ে আমার নাম বলে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এস। তোমরা এবার গল্প কর , আমি চললাম।

    ঘন্টাখানেক কেটে গেছে। সবাই ওকে ঘিরে বসে আছে। জয়ন্ত ওকে জড়িয়ে ধরে আছে।
    --- আমরা তোমার বন্ধু, আমরা চাই তুমি নিজেকে বুঝতে চেষ্টা কর। নিজের ওপর ওয়ার্ক কর। খালি ডুয়িং-ডুয়িং নয়, বিয়িং এর সাথে একাত্ম হও, নিজে জীবনে কী চাও ভাব, আর কী করছ তাও।
    -- এমন কেন হল? তোমরা সবাই যেটা বুঝতে পারছ, যেটা দেখতে পারছ, আমি কেন পারছি না? একি সেই এইচ জি ওয়েলসের গল্প? আমি দৃষ্টিহীনের দেশে এসেছি? নাকি আমারই চোখ গেছে?
    শুভা মুদগল হাসে।
    --- দাস, সবাই বইকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে বইয়ের সাচ্চা-ঝুটা খতিয়ে দেখে। আর তুমি এমন আজব প্রাণী যে জীবনকে বইয়ের ফর্মূলার সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা কর।
    নেপালী ছেলেটি প্রস্তাব করে যে আজকের সন্ধ্যায় ক্যাম্প ফায়ারে আমাদের গ্রুপের তরফ থেকে কালচারাল প্রেজেন্টেশন হবে দাদার মোনো-অ্যাক্টিং।
    সবাই হেসে ওঠে। এর পরে আরও?
    কৈলাশ বলে-- আমি কিন্তু সিরিয়াস। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
    --- কি শর্ত?
    ---- দাদা কথা দিন যে আজ রাত্তির আপনি নিজের ওপর ওয়ার্ক করবেন। তারপর কালকের প্রথম সেশনে আপনার মুখ থেকে মেঘ কেটে যাবে। যদি আমার সাহায্য চান তো আমি আপনার সঙ্গে রাত জাগতে রাজি, লাল চা করে খাওয়াতে, সিগ্রেট এনে দিতে রাজি। কী হল?
         আমার চোখে কিছু একটা পড়েছে, বড্ড জ্বালা করছে। আমি কৈলাশের হাত ধরে ফেলি।

    পরের দিন, দুপুর একটা। লাঞ্চের আগে বিদায়-সম্ভাষণ। বিশাল কমিউনিটি হলে সবগুলো গ্রুপ মিলে জনাচল্লিশেক ছেলেমেয়ে আর দশজন ফেসিলিটেটর। সবাই মাটিতে বসে। সবাইকে একটি করে চিরকুটে লিখতে হবে ও এখান থেকে কী নিয়ে যাচ্ছে, আর এখানে কী ছেড়ে যাচ্ছে। সেটা বাই টার্ন সবার সামনে পড়ে শুনিয়ে তারপর বিরাট বাক্সটাতে ফেলে দিতে হবে। ফেসিলিটেটররাও এর হাত থেকে ছাড় পাবেন না।
    ওয়ালিয়ার পালা এলে উনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন--- আমি এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি আমার টি-গ্রুপ মেথডের ওপর পুরনো আস্থা, এ অসাধ্য সাধন করতে পারে। আর ছেড়ে যাচ্ছি আমার খামখেয়ালিপনা।

     আমার পালা এল।
    বাবু গঙ্গারাম উঠে দাঁড়িয়ে দেখল ওর দিকে তাকিয়ে আছে ওয়ালিয়া, মেন্টর শোলাংকি ও আর একজন মহিলার চোখ , যার সঙ্গে ইচ্ছে থাকলেও আলাপ করা হয়ে ওঠেনি।
    --- আমি ছেড়ে যাচ্ছি আমার ঔদ্ধত্য , যার কারণ আমি সাথী মহিলার সঙ্গে অসভ্য ব্যবহার করেছিলাম। আর এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি নিজের মনের অন্ধকার দিকটাকে ভাল করে দেখার সাহস।
    এবার কোলাকুলির পালা। ওয়ালিয়া নিজেই এগিয়ে এলেন।
    -- কাল সন্ধ্যে থেকে তোমাকে দেখছি। কালচারাল প্রোগ্রামের আসরে তুমি নিজের টিমকে এগিয়ে দিয়েছ, নিজেকে নয়। আরও কাজ করতে হবে নিজের ওপর। জীবনে কী চাও? অনেক নাম? খ্যাতি? নামকরা এইচ আর ট্রেনার?
    --- না স্যার! ওসব যা হবার হবে। না হলেও কোন দুঃখ নেই। জীবন শেষ হয়ে যাবে না। আমি চাই নিজের কাছে সৎ থাকতে।
    ---- বেশ তো, লোককে ভালবাসো, কিন্তু দয়া করবে না। অযাচিত সাহায্যও নয়। এসব দুপক্ষকেই ছোট করে। আর কখনো দরকার মনে করলে আমাকে ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারো। আমি তোমাদের জন্যে আছি। সারাজীবন, এটা আমার প্রফেশনাল এথিক্স।

    একের পর এক গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনটা ইটার্সি রেল স্টেশন, কোনটি ভোপালের বেরাগড় এয়ারপোর্ট। শোনা যাচ্ছে টুকরো গানের কলি, হাসি, ঠিকানার আদান-প্রদান। আবার দেখা করার শপথ। গঙ্গারাম হাসে। ও জানে যে দুবার একই নদীতে স্নান করা যায় না।
    গাড়িতে উঠতে উঠতে বিনীতাকে ডাকে।
    -- অ্যাই, এদিকে আয়। তোর সঙ্গে আলাদা করে কথা আছে।
    সবাই হাসে।
    -- কী রে বল্?
    -- একটা কথা কাউকে বলবি না? একটু আগে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলি না, আমি কিন্তু আজ চান করিনি।
    --- দাঁত মেজেছিলি তো? তাহলেই হল। আমি না হয় দিল্লি পৌঁছে আবার চান করে নেব।
    সবাই জোরে জোরে হাততালি দেয়।
      এবার বিনীতা বলে—আমারও তোকে কিছু বলার ছিল।
    সবাই উৎসুক, জোড়া জোড়া চোখ এদিকেই।
    --আসলে না আমরা সবাই একা; একে অন্যকে সাহায্য করতে পারি, কিন্তু নিজের ক্রুশ নিজেকেই বইতে হয়।
    বাড়ি পৌঁছে কথাটা ভেবে দেখিস।

    (সমাপ্ত)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ২১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১৭539272
  • অসাধারণ লাগল পড়তে। 
     
    এই নিজেকে চেনা বড্ড কঠিন কাজ। মুখ আর মুখোশে বড্ড তফাৎ । আর চিনতে পারলে বড্ড ধর্ম সংকট উপস্থিত হয়। বদলানো তো অনেক কঠিন ও পরের ব্যাপার। 
  • রঞ্জন | 2402:e280:3d02:20a:c593:922a:1694:***:*** | ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৩৫539279
  • সঠিক উপলব্ধি l
    আর নিজের অহংকারকে তৃপ্ত করতে যেভাবে সাথী মেয়েটিকে ব্যবহার  করেছিলাম ভাবলে আজও মাথা নুয়ে পড়ে।
    ও আমাকে একটা  টেনে চড় মারলে ঠিক হত।
  • kk | 172.58.***.*** | ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:১৯539281
  • টেনে চড় মারলে আজ আপনার মাথা নুয়ে পড়তোনা। অনেক কমেই রেহাই পেয়ে যেতেন। সেটা ফেয়ার নয়। অনেক সময়েই ধিকধিক করে কয়েক দশক ধরে জ্বলতে থাকা অনুতাপ, গিল্টি ফিলিং, শেম, এগুলো খুব দরকারী ইমোশন। নিজেকে শুধরানোর জন্য। অত সহজেই ছাড়া পাবেন ভেবেছেন?
  • Ranjan Roy | ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৫:২৬539287
  • ঠিক l 
     
    দুবছর পর কোন কাজে দিল্লি গেছলাম l
    আমার গুরু এবং বন্ধু ভোগলের কাছে খবর পেয়ে ওই মেয়েটি ওর এন জি ও অফিসে ডাকলো।
    অর একজন,  যার শ্বশুর আগে বৌমার সঙ্গে কথা বলতনা, ওই অফিসেই কাজ করে।
    গেলাম। 
    সব ডেস্কে নিয়ে গেল। কোথায় কী কাজ  হয় সেসব দেখালো।
    কফি স্ন্যাকস্ খেয়ে আড্ডা দিয়ে চলে এলাম।
     
    কিন্ত কাঁটা এখনও বিঁধে আছে। থাকবে।
     
    সেই মহাগুরু অ্যানাকোণ্ডা ওয়ালিয়া স্যারের সঙ্গেও দেখা হল। কোভিডের ঠিক আগে।
     
    আমি চুপ করেছিলাম।  এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। উনিই এগিয়ে এলেন।
     আপনি কি আমার  সঙ্গে আইস্যাবস্ এর অ্যাডভান্সড্ হিউম্যান ল্যাবে ছিলেন,  দশ বছর আগে?
     
    আমি দাঁত বের করি। দুহাত বাড়িয়ে দিই। জড়িয়ে ধরি। অনেকক্ষণ দুজনে  দুজনকে আঁকড়ে ধরে থাকি।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন