২
এসব কথা নিধি অবশ্যি ক্লাসরুমে এতটা খুলে বলেন নি। শুধু বলেছিলেন যে ওনার মা ম্যানিক ডিপ্রেসনের রোগী ছিলেন। ফলে উনি তিওয়ারির স্ত্রীর ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন, ওরকম পেশেন্ট- মা'র ওপর বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব দেয়া যায় না। তাই উনি আজকের মেয়ে হয়েও তিওয়ারির দ্বিতীয় বিয়ে করা ব্যাপারটাকে ঠিক কড়া ভাবে নিতে পারছেন না। আর জীবন এত স্পষ্ট সাদা কালো নয়।
এটাও বলেছিলেন যে জীবনের এক মোড়ে উনি কারো দেখা পান, যিনি নিধির মনের কোণে লুকিয়ে থাকা বহু জিজ্ঞাসার সমাধান করে দিয়েছেন। তাঁকে গুরু মেনে নিধির মনে শান্তি এসেছে।
কথা হয়েছিল গঙ্গারামের সঙ্গে সেবার ফেরার পথে দেরাদুন রেল স্টেশনের ওয়েটিংরুমে।
কফি এবং হালকা স্ন্যাক্স্ নিয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আড্ডা জমে গিয়েছিল।
-- কী বই পড়ছেন? ও, সমার্সেট মমের অ্যাশেন্ডেনের গল্পগুলো। বেশ জমাটি, নয়? আচ্ছা, দর্শনের বই পড়ায় আগ্রহ নেই? ও, আপনি তো আবার স্বঘোষিত নাস্তিক।
--- হ্যাঁ, তবে নাস্তিক বলে দর্শনের বই পড়ব না কেন? আর দর্শন মানেই তো খালি অধ্যাত্মবাদ নয়। ওটা সামগ্রিক দর্শনশাস্ত্রের সাবসেট মাত্র।
-- উপনিষদ নিশ্চয়ই পড়েন নি? পড়লে আপনার বস্তুবাদের পুরনো ব্যাগেজ কাঁধ থেকে নেমে যাবে।
-- সরি ম্যাডাম, পড়েছি। আপনাদের হরিদ্বারের শ্রীরাম শর্মা আচার্যের অনুবাদগুলো, রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী গম্ভীরানন্দের এডিশন, সবই একটু নেড়েচেড়ে দেখেছি।কিন্তু আমার কোন উদ্ধার হয় নি।
-- হবে কি করে? এগুলো গুরুমুখী বিদ্যা, খালি ছাপার অক্ষরে পড়লেই হল? আগে প্রবোধচন্দ্রোদয় পড়ুন, বেদান্তদর্শনের অন্ততঃ প্রথম দুটো খন্ড পড়ুন। তারপর আবার উপনিষদ পড়ুন; অন্যরকম লাগবে।
-- আপনি বলছেন যখন নিশ্চয়ই পড়বো।
-- শুধু আমি বলছি বলে?
চল্লিশোর্ধ নিধির চোখে একটু হাসির ঝিলিক। গঙ্গারামও একটু হাসে। তারপর আড্ডার জোয়ারে একটু একটু করে বালির বাঁধগুলো ভাঙতে থাকে। উঠে আসে ব্যক্তিগত জীবনের নানা গল্প।
--- জানেন, ওই যে মিঃ শোলাংকি, যিনি আপনাদের সেশনে আমার সঙ্গে সিনিয়র ফেসিলিটেটর ছিলেন , উনি কিন্তু বিহেভিয়ারিয়াল সায়েন্সের এক ওয়ার্কশপে আমারও একসময়ের গুরু।
একবার গোয়াতে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। আমি ট্রেনার হওয়ার ফাইনাল ল্যাপের ওয়ার্কশপে গেছি। শোলাংকি আমাদের মেন্টর। একদিন বিকেলে আমরা ক'জন গেছি সমুদ্র নাইতে।
আমি তো শুরু থেকেই একটু বেহায়া টাইপ। আমার আস্কারায় সঙ্গী দুই মেয়েও গেছে সুইমিং কস্টিউম পড়ে। আমরা স্নান সেরে ফিরছি আর শোলাংকি স্নানে যাচ্ছেন। মাঝরাস্তায় মোলাকাত হতেই ওনার কাহিল অবস্থা! উনি মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন যেন আমাদের দেখতে পান নি।
আমিও নাছোড়বান্দা, সোজা সামনে গিয়ে বলেছি-- শুভ সন্ধ্যা, মহাশয়!
উনি কি করবেন বুঝতে না পেরে ওনার বারমুডা টেনে নামিয়ে খোলা হাঁটু ঢাকতে চেষ্টা করলেন। বারমুডা নীচে নামে না, শেষে নিজের ছোট টি-শার্ট টেনে টুনে যেন নিজেরই বুক ঢাকছেন, এমনি অবস্থা। আমরা তো হেসে আকুল।
দুজনের হাসির আওয়াজে পাশের আরামকেদারায় বসা ভদ্রলোক বিরক্ত চোখে তাকালেন।
ইতিমধ্যে গাড়ি এসে গেছে। নিধি চাকাওলা ব্যাগ টানতে টানতে বলে্ল্লন-- বাকি অসমাপ্ত গল্পগুলো পরে হবে, মেইলে বা ফোনে।
হ্যাঁ, নিধি কথা রেখেছিলেন; মা-দিদিমার গল্পটা সম্পূর্ণ করেছিলেন।
মায়ের ডিপ্রেসনের মাত্রা বাড়তে লাগলো। আগ্রার মানসিক চিকিৎসালয়েই থাকতে হচ্ছিল।
ছোট্ট নিধির সব রাগ গিয়ে পড়ল নানীর ওপর। তার বিদ্রোহ প্রকাশ পেল স্কুল পালানোয়, আবোলতাবোল পোষাক পরায়, মেথরপট্টির ছেলেদের সঙ্গে কাবাড্ডি, লেংড়ি খেলা, নদীতে ঝাঁপানো এসবের মধ্যে দিয়ে।
জানেন, ইচ্ছে করে ফেল হতাম। যাতে পাড়ার মধ্যে , কায়স্থ মহিলা সমাজের সদস্যদের মধ্যে আমাদের মামাবাড়ির বদনাম হয়, নানীর নাক কাটা যায়।
গজব হল ম্যাট্রিকের টেস্ট পরীক্ষায়। সব বিষয়ে ফেল। কিন্তু অন্য একটি প্রোফেশনাল সংস্থার আয়োজিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর।
দেখিয়ে দিলাম আমি বোকা নই, ইচ্ছে করলে এসব পরীক্ষা আমার কাছে কিছু নয়।
এবার নানীজি ভেঙে পড়লেন, বল্লেন-- গুড়িয়া! তুই যা ইচ্ছে কর, আমার মুখে চুনকালি লেপে দে! আমি আর কিছু বলবো না।
আমার ভেতরে কিছু একটা হল। আমি ভালভাবে পরের বছর হায়ার সেকন্ডারি দিলাম। আর আমার জীবনে বদল এল। সেই শুরু।
আমিও জীবনের শুরুতে পাঁড় নাস্তিক ছিলাম। সমস্ত অথরিটিকে চ্যালেঞ্জ করতাম।
আজ বুঝি আমার নাস্তিকতা তারই অঙ্গ ছিল। কোথাও আমার নানীজি আর অন্যায়কে প্রশ্রয়দাতা ভাগ্যবিধাতা এক হয়ে গেছিলেন। বিয়ে করি নি, পরিবারের দায়িত্ব সামলেছি। নানীজির শেষজীবনে মামারা মুখ ফেরালেন। আমি আমার কাছে এনে সেবাযত্ন করেছি। বোনভাইদের দাঁড় করিয়েছি।
-- আপনিও ভগবান হতে চাইতেন?
-- হয়তো তাই।
গর্তে পড়ে বোলেরো ঝাঁকুনি খেল। চটকা ভেঙে দাসবাবু দেখলেন এক্গাদা শাল-তাল-তমালের হরিয়ালীর মাঝে একটি লাল মোরাম বিছানো রাস্তা, পাশে সবজে রঙের সাইনবোর্ড।-- "প্রদান ট্রেনিং সেন্টার'', ৫০০ মিটার।
৩
মুরগীর ফার্ম কেন বলে? হরিদাস বাবু কোথাও কোন মুরগী দেখতে পেলেন না। জিগ্যেস করে জানলেন যে এখন আর এখানে মুরগী পোষা হয় না, আগে হত। ইদানীং শুধু ডেমনস্ট্রেশন সেন্টার, আর ট্রেনিং হয়। চারপাশের বিশটা গাঁয়ে দশ বছরের চেষ্টায় চেইন অফ পোলট্রি শুরু হয়ে গেছে। এখানে উৎসাহী কৃষকদের মুরগীর চিকিৎসা ছাড়াও পোলট্রি প্রোডাক্ট এর মার্কেটিং এর ঘাঁতঘোঁত শেখানো হয়।
কিন্তু এছাড়া এই জায়গাটাকে "প্রদান'' বেশ বড় রেসিডেনশিয়াল ট্রেনিং সেন্টার বানিয়েছে। একটা উইংয়ে এক্সক্লুসিভলি ওদের নিজস্ব প্রোজেক্টের ট্রেনিং দেয়া হয়। আর অন্য দুটো দোতলা উইংয়ে অন্য এন জি ও’দের রিজনেবল্ চার্জ নিয়ে ট্রেনিং এর জন্যে ব্যবহার করতে দেয়া হয়।
গঙ্গারামবাবুর হটাৎ মনে পড়লো যে পনের বছর আগে এর ডিজাইনটা আর্কিটেক্ট কবীর বাজপেয়ী করেছিল।ভোপালের ভারত ভবনের স্বর্ণিম দিনে ওখানকার হর্তাকর্তা আই এ এস কবি অশোক বাজপেয়ীর ছেলে।
বিলাসপুরে এক ওয়ার্কশপে ওর সঙ্গে পরিচয়।
-- আচ্ছা, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর সঙ্গে তোমাদের আর্কিটেকচারের সম্পর্ক বা ফারাকটা কি, একটু বুঝিয়ে বলবে?
কবীর হাসে,-- আরে এই ব্যাপারটাই লোককে বোঝাতে আমি টাইমস্ অফ ইন্ডিয়াতে আর্টিকল্ লিখি।
-- বেশ, আমার মত গাম্বাটকে বোঝাও দেখি!
--- ধরুন, আর্কিটেকচার= সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং+ অ্যাস্থেটিকস্।
--আরেকটু খোলসা কর, একটু উদাহরণ দিয়ে। আমি বেশ গাম্বাট, মনে রেখ।
-- আমরা স্বপ্ন বেচি। না, ভুল বল্লাম , আমরা মানুষের স্বপ্নকে সাকার করি, মূর্ত রূপ দিই।
--যেমন?
-- যেমন, এক বয়স্ক লোক এসেছেন। সারাজীবনের স্বল্প সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি করছেন, ছোটমত। কাকু, আপনি বাড়িটাতে কী চান? উনি বল্লেন, ভোরে উঠে বাগানে পূবের হাওয়া চাই । কিন্তু ওনার বাগান খুলছে দক্ষিণে। আর পূবের দিকে আছে সরকারি এঁদো নালা।
কী করি!
আমি লাগাই কিছু পিলার; পূবের দিকে এমন করে লাগাই যে ভোরের হাওয়া ওই পিলার গুলোতে ধাক্কা খেয়ে দক্ষিণে ধেয়ে আসবে। কিন্তু পূবে যে আবার নোংরা নালা। তাহলে তো সেই প্রভাত হাওয়া বয়ে আনবে দুর্গন্ধ!
এর সমাধান হল।
নালার পাশে কয়েকটি পিলারের কাছে ঘন করে এমন সব গন্ধফুলের গাছ লাগিয়ে দেব যে উনি ভোরে দক্ষিণের বাগানে পায়চারি করতে করতে পাবেন সুগন্ধিত পূবের হাওয়া। ওনার দক্ষিণকেই আমি পূব বানিয়ে দেব।
তারপর ধর, এক দাদু বাড়ি বানাবেন, বলছেন যে ওনার ডুপ্লেক্স চাই। বল্লাম, সঙ্গে কে কে আছেন? কেন, ছেলে-ছেলেবৌ-নাতি-নাতনি। তাহলে ডুপ্লেক্স বানাবেন না, প্লীজ। হাঁটুর জন্যে আপনি একতলায় থাকবেন, নাতি-নাতনি দোতলায়। ওরা স্কুল থেকে এসে দৌড়ে দোতলায় গিয়ে বইয়ের ব্যাগ বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ল্যাপি বা টিভি খুলবে, আপনি ওদের দেখা পাবেন সেই খাবার টেবিলে।
কবীরের উৎসাহ বেড়ে চলেছে।
-- একটা বড় কাজের বরাত পেয়েছি, কুষ্ঠরোগীদের জন্যে আশ্রম বানানোর। জানেন তো, ওরা ছুঁচ ফোটালেও ব্যথা পায় না। তাই ওদের বাড়িতে সিঁড়ি, দেয়াল কোথাও কৌণিক কিছু থাকলে চলবে না। সব সার্কুলার বা কার্ভড্ হতে হবে। নইলে খোঁচা লেগে রক্ত পড়বে, ওরা টেরটি পাবে না।
--"ব্যস্,ব্যস্, বুঝে গিয়েছি'। মানব ও ভৌতিক বিজ্ঞানের এমত মহতী সমন্বয়ে আমার মাথা নুয়ে প্রায় বুকে ঠেকে আর কি!
কথা ঘোরাই, ওই দেখ দীক্ষিত সভাগার। বিলাসপুরে ভাল সব নাটক এখানেই হয়। ছেলেটি নাটক ও স্টেজ ক্র্যাফটে বেশ উৎসাহী। কথায় কথায় নাটকের কুলীন হিন্দি ম্যাগাজিন দিল্লি থেকে বেরোনো বিখ্যাত "নটরঙ্গ'' পত্রিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ও হাসে, হোটেলে ওর ঘরে নিয়ে গিয়ে স্যুটকেস খুলে পত্রিকাটির নবীনতম সংখ্যা বের করে আমার হাতে দেয়। বলে-- এতে আমার নাম আছে, পাল্টে দেখুন কোথায়।
অবাক হয়ে দেখি-- প্রচ্ছদঃ কবীর বাজপেয়ী। আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে বলে এটা তো আমার দাদুর পত্রিকা।
আমার চোখ এবার ছানাবড়া। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার সংস্থাপক নির্দেশক ইব্রাহিম আলকাজীর সহযোগী নেমিচান্দ জৈন তোমার দাদু? আর শিশুনাট্য নিয়ে নিবেদিত প্রাণ শান্তি জৈন-- দিদিমা? বেশ।
আচ্ছা, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা'র বর্তমান ডিরেক্টর কীর্তি জৈন ম্যাডাম? যাঁর ছাদের ওপর বসে শম্ভু মিত্র মশায়ের সঙ্গে আলাপচারিতার বৃত্তচিত্র প্রায়ই দূরদর্শনে দেখানো হয়?
-- উনি আমার ছোটমাসী।
-- তা কি করে হবে? তোমার মা তো কত্থকশিল্পী দক্ষা বাজপেয়ী, আর এঁরা তো জৈন।
কবীর হাসে, আর প্রায় নান্দীকারের "তিন পয়সার পালা''র কবিতাটি শুনিয়ে দেয়।
" মোহিনীমোহন দেব, আর মোহিনীবালা দেবী,
পুরুত বসে মন্ত্র পড়ায় অং-বং-চং-কং।
আমরা বলি, হোলো কিসে?
যদুর মামা মধুর পিসে?
শুনে তারা বল্লে হেসে-- বিবাহং,বিবাহং।''
আহা , সেই কবীরের বানানো এই সেন্টার। কৌতূহল চরমে।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।