কর্মসূত্রে নিজের বেছে নেওয়া নাগরিকত্বে আমি আমেরিকান। জন্মসূত্রে ছিলাম ভারতীয়। কিন্তু মর্মসূত্রে যে ভূখন্ড, যে সত্তা দূর শৈশব থেকে আমার চেতনায় জুড়ে গিয়েছিল, তার নাম বাংলাদেশ। আমার মা, বাবা, তাদের আগের বহু প্রজন্ম ধরে তারা সেই ভুমির বাসিন্দা ছিল, সেই সত্তার অংশীদার ছিল। আমার সেই অংশীদার হওয়ার অধিকার নেই। কিন্তু মা-বাবা-ঠাকুমা আমাদের বড় করার সময়, তাদের চিন্তা-চেতনা-স্মৃতি দিয়ে আমাদের গড়ে তোলবার সময় একটু একট করে সেই দেশ নিয়ে, সেখানে যাপিত তাদের জীবন নিয়ে, তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিগুলো আমাদের মধ্যে বুনে দিয়েছে। কনিষ্ঠতম ভাই তাদের খ্যাতনামা নাটকের দলের সাথে গিয়ে প্রিয় স্মৃতি বুকে করে ঘুরে আসে সেই দেশ থেকে, মেজভাই তার সুগায়িকা স্ত্রীর গানের অনুষ্ঠান উপলক্ষে বেড়িয়ে আসে সেই স্বপ্নের দেশ থেকে, বাংলাদেশ থেকে।
আমার কখনও সেখানে যাওয়া হয়নি, আর হবে বলে ভাবিও না। এক সময় সেই দেশেরই কিছু স্বপ্ন দেখা মানুষের যত্নে-ভালোবাসায়-পরিশ্রমে গড়া অনলাইন সাহিত্য মঞ্চ সচলায়তন আমায় এই ক্যালিডোস্কোপ নিয়ে দেখার লেখা লিখতে জায়গা করে দিয়েছিল। প্রিয় সেই দেশ মাথা উঁচু করে এগিয়ে চললে আমিও এগোই, সেই দেশ বিপন্ন হলে আমার যন্ত্রণা হয়; স্বজন রক্তাক্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। আমি অত্যন্ত তুচ্ছ একটি অস্তিত্ব, বাস্তবের নিরিখে এতই বিচ্ছিন্ন, এমনকি নিজের কাছেও দাবি করতে পারি না যে সে দেশের বেদনাকে তার সামগ্রিক কার্য-কারণে বুঝে উঠতে পারি। আতঙ্কিত হই, আবার বুঝি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। লেখার সূত্রেই পরিচিত বন্ধুরা, যারা জানেন শোনেন, বোঝেন, খবর রাখেন তারা মর্মাহত, চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন। এমনও পড়ছি, শুনছি, কেউ কেউ লিখছেন, বলছেন লণ্ডভণ্ড অনেক দিনই হয়ে চলেছে, এখন আর চাপা থাকছে না, থাকবে না। হবেও বা। কত জন যে আবার এই দুর্যোগেকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে নেবে দেশের ভালোর অছিলায় কে জানে! কত মানুষের প্রাণের, অস্তিত্বের বিনিময়ে পাওয়া দেশ, কত স্বপ্ন তার প্রজন্মের পর প্রজন্মে … এই সংকট সে কাটিয়ে উঠবে, উঠবেই। কতটা মূল্যে - জানা নেই।
বাবা ভালবাসত গুছিয়ে কথা বলতে। যেভাবে যত্ন করে জামা কাপড় ইস্ত্রী করে সাজিয়ে রাখত, কথাও বলত তেমনি করে। পদ্মাপারের বাচনরীতি প্রবলভাবেই হাজির থাকত তার কথায়। বাড়িতে টেপ-রেকর্ডার ঢোকার পর নিজের অজান্তে ফিতে-বন্দী হয়ে যাওয়া ‘বাঙাল ভাষায়’ বলা নিজেরই কথা শুনে আমাদের প্রশ্ন করেছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন নুতন রেকর্ড কিনেছি কিনা আমরা। তার কথায় চলিত শব্দের পাশাপাশি সাধুভাষার শব্দরাও থাকত অনেকই। বড় হয়েছিল সাধুভাষায় লেখা বই পড়ে। হ’তে পারে সে কারণেই। বেশী কথা বলত না বাবা। কিন্তু তার সাধ্যমত আমার মাথায় বিভিন্ন সময় ভরে দিয়েছিল নানা গল্প, ইতিহাস, চিন্তা, দর্শন, জীবনের অভিজ্ঞতা। নিজের আত্ম-পরিজন-বন্ধুদের কথা খুব একটা বলত না। শৈশবে পিতৃহারা মানুষটির মনে হয়ত কোন অভিমান কাজ করত। কিংবা অন্য কোন গভীরতর কারণ ছিল কি?
পদবী ইত্যাদির কথায় জেনেছিলাম আমরা অনেক প্রজন্ম আগে ছিলাম মুখোপাধ্যায়, এপার বাংলার কোথাও, সম্ভবত বর্ধমান থেকে গিয়ে এক পূর্বপুরুষ হাজির হয়েছিলেন পদ্মাপাড়ের দেশে - ঢাকা, পানাম, সোনার গাঁ। উপাধি পেয়েছিলেন রাজচক্রবর্ত্তী, পরে কেঁটেছঁটে চক্রবর্ত্তী। শৈশবে প্রশ্ন জাগেনি মনে, আজ ভাবি, কি সে কাজ করেছিলেন সেই বহু আগের সময়ের মানুষটি যাতে তিনি রাজচক্রবর্ত্তী উপাধি পান? কবে পেয়েছিলেন, ইংরেজ আমলে? তা হলে নিশ্চয়ই তাদের খুশী করে পেয়েছিলেন, ভালো কোন কাজ কি আদৌ? সন্দেহ হয়। শুনেছি তাদের কাপড়ের বাণিজ্য ছিল। ওনারা কি তবে ওখানে গিয়ে রাজশক্তির সাহায্যে স্থানীয় মানুষদের থেকে তাদের ব্যাবসা ছিনিয়ে নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে গিয়েছিলেন? জানি না। শুধু এইটুকু জানি, বাবা এদের কথা বলতে কখনও কোন আগ্রহ দেখায়নি, আর জানি, ঠাকুর্দা এই ব্যবসায় যোগ দেননি। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পেশা নিয়ে, স্বর্ণকার হয়ে রাজস্থানের বিকানেরে গিয়ে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। টাকা-পয়সা জমলে বাড়ি এসে ঘুরে যেতেন। আর বাবা বিনা কপর্দকে ভিটেমাটি ছেড়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে গিয়েছিল, ফিরে আসে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। বিশ্বাস করত বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সে পথে হাঁটা হয়ে ওঠেনি তার, লক্ষ্মীলাভও ঘটেনি। বলাই বাহুল্য, বাণিজ্য করতে পারার মত মানুষ সে ছিল না; চড়াই-উতরাই সামলে চাকরি করেই কেটে গেছে পুরো জীবন। তবে উপরের দিকে চাকরির সুবাদে কুচবিহারের তিনটি বছরেই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে ভাল জায়গায় ছিল।
ঐ তিনটি বছরে আমি চারপাশের জগৎকে চোখ মেলে দেখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু যথেষ্ট মনোযোগের সাথে খেয়াল করে, নজর করে সেই দেখার কাজটি করা হয়নি। আর সময়ও হয়ত যথেষ্ট ছিল না। ফলে এমন পরিমাণ বা গুণমানের রসদ আমার সংগ্রহে আসেনি যা দিয়ে ঐ সময়ের বা ঐ ভূখন্ডের মানুষদের জীবন যাপন নিয়ে কোন উল্লেখ করার মত কিছু সৃষ্টি করতে পারি। তিন আয়নার ঘুর্নিকলে দেখা আমার এ স্মৃতিচারণ তাই নিজেকে ফিরে দেখার বেশি কিছু নয়।
কুচবিহারে গিয়ে অবধি আমার দীর্ঘকালীন অনুভূতি ছিল বিষণ্ণতার, অনেক বন্ধুর ভালোবাসায় ভরে থাকা শহরজীবনের কলকল্লোলে মুখরিত দিনগুলোকে হারিয়ে ফেলার। হয়ত সেই কারণেই নিজের অসম্ভব ব্যস্ততা সত্ত্বেও বাবা চেষ্টা করত যতটা পারা যায় তার সঙ্গ দিয়ে আমাদের ঘিরে রাখার। বড় হয়ে বুঝেছি, বাবাকে এই নিবিড় করে পাওয়া – কখনো আমায় লেখাপড়া শেখানোয়, কখনো গল্প বলায়, খেলায় খেলায়, প্রাত্যহিকের বা ছুটির দিনের সময় কাটানোর আলাপচারিতায়, কখনো বা তার নিজের জীবন যাপনের ধারায়, আমার গড়ে ওঠায় গভীর প্রভাব রেখে গেছিল।
বাবার বেশ বড় একটি সাইকেল ছিল। তার অনেক বছরের সহযাত্রী। বদলির চাকরির সব কটি কর্মস্থলে সে এটিকে সাথে নিয়ে ঘুরেছে। বাজারে যাওয়া হোক কি অফিসে - ঐটি তার চলাচলের নিত্য সঙ্গী। কখনো কখনো সামনের রডে বা পিছনের ক্যারিয়ারে আমরা, ভাইরাও সওয়ার হয়ে যেতাম। ওই সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসেই কুচবিহারের এয়ারপোর্টে আমার প্রথম এরোপ্লেন দেখতে যাওয়া, রানওয়ের উপর, সামনে থেকে। প্লেন দেখায় মগ্ন আমি খেয়াল করিনি লোকজনেরা কোথায় কি করছে। হঠাৎ দেখলাম বোঁ বোঁ করে প্রপেলার চালু হয়ে গেছে আর হাওয়ার দাপটে পিছু হটতে গিয়ে আমি প্রায় শূণ্যে উড়ে যাওয়ার মত করে ছিটকে পড়েছি। তবে সেদিন আরো দুর্ভোগ এসে জড়ো হয়েছিল। ফিরতি পথে হঠাৎ বিকট আওয়াজ করে সাইকেল থেমে গেল। পিছনের ক্যারিয়ারে বসা আমার ডান পায়ের গোড়ালি চাকার স্পোকের ফাঁকে ঢুকে গিয়ে স্পোকের সজ্জা এবং আমার গোড়ালি দুইই বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। হাসপাতাল হয়ে বাড়ি ফেরা, মোটা চামড়ার বুট জুতো পড়া থাকায় গোড়ালির হাড় ভাঙ্গেনি, তবে প্রবল ভাবে মচকে গিয়েছিল, ভুগতে হয়েছিল অনেক দিন।
এই সাইকেলটিকে বাবা কিছুদিন পর পর একটি একটি করে বড়-ছোট সমস্ত অংশ খুলে খুলে বারান্দায় সাজিয়ে ফেলত। তারপর চাকার কেন্দ্রে থাকা চাকতির মধ্যে সাজানো বলবিয়ারিং ব্যবস্থার থেকে ইস্পাতের নিখুঁত নিটোল গোল দানাগুলো বের করে এনে, ধুয়ে মুছে শুকিয়ে, কোনটা খারাপ হয়ে গিয়ে থাকলে সেটাকে বদলে দিয়ে, আবার তাদের ঐ চাকতির কৌটোয় খাঁজে খাঁজে বসিয়ে গ্রিজ লাগিয়ে, কৌটোর ঢাকনা আটকে, চাকতিটাকে একটার পর একটা স্পোক লাগিয়ে চাকার বড় বেড়টায় জুড়ে চাকার ধাতুর কাঠামোটাকে তার নিজের চেহারায় ফিরিয়ে আনত। একে একে পুরো সাইকেলটাই আবার যেন এক অলৌকিক দক্ষতায় তার পূর্ণতা ফিরে পেত। এক পর্যায়ে পাতলা রাবারের টিউব ভরা মোটা শক্ত রাবারের টায়ার ঐ চাকার বেড়ে জুড়ে দিয়ে রাবার টিউবে হাত-পাম্প চালিয়ে হাওয়া ভরে নেওয়া, বাবার হাতের পেশীগুলো ফুলে উঠত। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। কয়েক দশক পার করে বাবা যখন একদিন খুলে ফেলা এক কাঠের আলনাকে ফিরে জোড়া লাগাতে গিয়ে আমার হাতে যন্ত্র তুলে দিয়ে নীচু গলায় বলেছিল, আমার হাতে আর তেমন জোর পাই না, নিজের হাতের জোরের স্বীকৃতির আনন্দ চাপা মন খারাপে মিইয়ে গিয়েছিল।
উত্তরবঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা যখন দমদম ক্যান্টনমেন্টে থাকতাম, মাঝে মাঝেই একটি লোকের দেখা মিলত। সে সাইকেলের মত দেখতে একটি প্যাডেল আর চাকাওয়ালা যন্ত্র ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়াত। আমাদের বাসার সামনে এসে রাস্তার ধারে সেই যন্ত্র নামিয়ে তাতে চড়ে বসত। ইতিমধ্যে আশেপাশের বিভিন্ন বাসা থেকে মেয়ে-বৌরা, কাজের বাচ্চারা ছুরি, কাঁচি, দা, বটি নিয়ে এসে ঘিরে দাঁড়াত। তারা সব তার কাজের খরিদ্দার। হাতের অস্ত্র শান দিতে নিয়ে এসেছে। লোকটি তাদের কারো কাছ থেকে একটি কাটাকাটির যন্ত্র হাতে নেয়। তার চড়ে বসা যন্ত্রে পায়ের চাপে প্যাডেল ঘুরছে। প্যাডেল লাগানো, স্পোক-ওয়ালা বড় চাকাটাও তাই ঘুরছে। সেই সাথে ঘুরে চলেছে, ঐ বড় চাকার সাথে বেল্ট দিয়ে আটকানো একটা তুলনায় ছোট কিন্তু নিরেট চাকা, শানপাথর বলে বুঝি তাকে। লোকটি তার হাতের ছুরি কিংবা কাঁচির ফলার ধার ঐ ঘুরতে থাকা শানপাথরের গায়ে চেপে ধরে। প্রবল ঘষার ফলে আগুনের ফুলকি তারাবাজির মত ছিটকে বের হতে থাকে, পোড়ার গল্ধ ভেসে আসে। এক সময় লোকটি হাতের অস্ত্রটি তুলে নেয়, চোখের সামনে এনে দেখে, সাবধানে তার গায়ে হাত বোলায়, কখনো সেটাকে আবারো চেপে ধরে ঘূর্ণায়মান পাথরের গায়, অথবা তুলে দেয় তাদের যারা নিয়ে এসেছে তাদের হাতে। কাজের দাম নিয়ে কোমরের থলেতে রেখে দেয়। কুচবিহারের জীবনে এদের দেখা মেলেনি। শান দেওয়ার কাজ বাবা নিজেই করত। নাঃ, ঐ রকম কোন শান দেওয়ার চাকা ছিল না। সেই কাজ সারা হত লাল ইঁটের টুকরোয় ঘষে ঘষে। কোন কোন দিন আবার ঐ ইঁটের টুকরো দিয়ে ভারী লোহার ইস্তিরিটার চকচকে পিঠটাও আরো ঘষে ঘষে আয়নার মত মসৃণ করে তুলত। ঘষার কাজে আরো একটি বস্তুর ব্যবহার হত - একটি ঝামা পাথরের টুকরো। পায়ের গোড়ালি মসৃণ করার কাজে লাগত তা।
আমাদের সেই ছোটবেলায় তেল কিনে আনা হত টিনের কৌটোয়। শক্তপোক্ত কৌটো। নতুন কিনে আনা কৌটোর পাটা দিক দুটোর যেটা কৌটোর গায়ের ছবির উপরের দিকে, সেইটিতে বাঁকের কানা ঘেঁষে মোটা পেরেক ঠুকে একটা ফুটো করা হত বা একটা মোটা ছুরি ধরে সেটাকে ঠুকে একটু চিরে দেওয়া হত। আর এরপর ঐ পাটা দিকটাতেই যতটা সম্ভব দূরে কানা ঘেঁষে একটা তুলনায় ছোট ফুটো করে দেওয়া হত। কৌটো কাত করে বড় ফুটো দিয়ে তেল ঢালার সময় কৌটোয় হাওয়া ঢুকত ঐ দ্বিতীয় ফুটোটা দিয়ে। পরে একসময় এই বিদ্যে কাজে লেগেছিল ওল্টানো জলভরা পাত্র থেকে ইচ্ছে মত জল পড়তে দেওয়া বা না-দেওয়ার যাদু দেখানোর সময়। সে অবশ্য অন্য ছবির গল্প।
কৌটোগুলো তেল ফুরিয়ে খালি হয়ে যাওয়ার পর তাদের কোন কোনটাকে ফেলে না দিয়ে অন্য কাজে লাগানো হত, যেমন চৌবাচ্চা কি বালতি থেকে জল তোলবার মগ বানানো বা যন্ত্রপাতি রাখার কৌটো বানানো। ফুটোওয়ালা পাটা দিকটা কানা ঘেঁষে মোটা ছুরি ধরে ঠুকে ঠুকে কেটে কেটে গোল বেড়টা থেকে আলাদা করে ফেলা হত। এই কাটা কাটা ধারওয়ালা চাকতিটা সাবধানে না ধরলে একটুতেই হাত কেটে যেতে পারত। বাবা নিজে হাতে বাড়ির পিছন দিকে এক কোণায় আবর্জনা ফেলার জায়গায় এই চাকতিটাকে সাবধানে ফেলে দিয়ে আসত। এরপর 'পিটানি' দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে খোলা কৌটোর কাটা ধারটা কৌটোর বেড়ের ভিতরের গায়ে মিশিয়ে দিয়ে চমৎকার একটা কৌটো বানিয়ে ফেলত।
এই রকমই একটা বড় আর একটা ছোট মাপের কৌটোয় বাবা তার সমস্ত যন্ত্রপাতিগুলো রাখত। এই যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে বাবার নিয়মিত ব্যবহারের তিনটি বস্তু ছিল একেবারে তার নিজের কায়দার। প্রথমটি পেটাপেটি করার – নাঃ হাতুড়ি নয়, অনেক অতীতে যোগাড় করে আনা, বাইসাইকেলের প্যাডেলের একটি ডাণ্ডা। বাবা সেটাকে ‘পিটানি’ বলত। আমি অনেক বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত জানতাম না যে এই কাজের জন্য হাতুড়ি নামের অন্য একটি বস্তু আছে। জানার পরেও ‘পিটানি’ থেকে হাতুড়িতে অভ্যস্ত হতে সময় লেগেছিল আমার। আর দ্বিতীয়টি ছিল বাবার নিজের হাতে বানানো একটি কাগজ কাটার বা পেন্সিল চাঁছার ছুরি। আধা ইঞ্চি চওড়া আর আট ইঞ্চি মত লম্বা একটি লোহার পাত, তার গোলাকৃতি দুই প্রান্তের একদিকের সিকি ইঞ্চি মত ভিতরে একটি ফুটো আর বিপরীত প্রান্তের মাথা থেকে প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত একটা পাশকে একটু আগে বলা ইঁটের টুকরোর গায়ে ঘষে ঘষে ধারালো করে তোলা হয়েছে। এই ছুরিটার মত আরো কয়েকটি পাত ছিল বাবার সংগ্রহে, সম্ভবত কোন যন্ত্রের বাতিল টুকরো তারা, একদিন তাদের একটিকে শান দিয়ে আমার প্রথম ছুরিটি বানিয়ে নিয়েছিলাম। তৃতীয়টি আগেই উল্লেখ করা মোটা ছুরিটি। আকারে আরেকটু বড় আর অনেক মোটা। কামারশালা থেকে বানিয়ে আনা। দরকারমত শান দিয়ে দিয়ে বাবা এটাকে ভোঁতা হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখত। তুলনায় মোটা দাগের কাটাকাটির কাজে যেমন, কাঠের টুকরো কি টিনের কৌটো কেটে ফেলতে, এর ব্যবহার হত।
আমাদের স্কুল থাকত সোম থেকে শুক্রবার এগারটা থেকে সম্ভবত চারটা পর্যন্ত। আর শনিবারে একটা নাগাদ ছুটি হয়ে যেত। ফলে এই ছয় দিন রোজ সকালে আর সন্ধ্যায় বাড়িতে নিয়মিত পড়তে বসতে হত। স্কুলের পড়ার যে অংশটা বাড়ির কাজ হিসেবে দেওয়া থাকত সেটা ঐ সময়ে সেরে ফেলার চল ছিল। শনিবারের সন্ধ্যায় সেরে রাখবার কাজ রবিবারে গড়িয়ে না গেলে রবিবার স্কুলের পড়া তৈরি করার থেকে ছুটি। এক রবিবার সকালে বাবা ঘরের কোথা থেকে একটা ঘুড়ি ওড়ানোর লাটাই আর এক বান্ডিল নানা রঙের কাগজ নিয়ে চওড়া ভিতর-বারান্দায় পিঁড়ির উপর গুছিয়ে বসল। আমাদেরও ডেকে নিল। কাগজের পাশে দেড় হাত মত লম্বা বাঁশের টুকরো।
- কি বানাবে তুমি? ঘুড়ি?
- দেখতেই পাবি। যা, ওই দাওটা নিয়া আয়।
এই সব দা-কাঁচি-ছুরি-পিটানি-স্ক্রু ড্রাইভার-ছেনি-বাটালি-তুরপুন-ওলন দড়ি ইত্যাদি রাখার দুটি কৌটোর সাথে আরো কয়েকটি অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তু ছিল বাবার যন্ত্রপাতি রাখার জায়গায় – নানা মাপের কয়েকটি কাঠের টুকরো। বাবা বারান্দায় বসে একধাপ নিচের সিঁড়িটায় একটা যুৎসই উচ্চতার কাঠের টুকরো রেখে তার উপর বাঁশের টুকরোটা দাঁড় করিয়ে দা দিয়ে সেটাকে লম্বালম্বি কয়েকটা টুকরোয় চিরে ফেলল। তারপর তাদের একটার গা থেকে দা দিয়ে কয়েকটা ছিলকা বার করে নিয়ে ছুরি দিয়ে সেগুলোকে চেঁছে চেঁছে কয়েকটা মসৃণ এবং নমনীয় কাঠি বানিয়ে নিল।
এরপর রঙিন কাগজের বান্ডিল থেকে একটা কাগজকে টেনে নিয়ে সেটাকে ভাঁজ করে, ভাঁজ বরাবর ছুরি টেনে তার থেকে একটা বর্গাকার টুকরো বার করে আনল। এরপর ঐ কাঠিগুলোর একটাকে সেই কাগজের টুকরোটার উপর রেখে কাঠির গোড়া যদি এক নম্বর কোণায় রাখা হয়েছে ধরি, তবে অন্য প্রান্তকে তিন নম্বর কোণার দিক করে বসিয়ে কোণা ছাড়িয়ে দুই কি তিন ইঞ্চি দূরে ছুরি দিয়ে কাঠির গায়ে দাগ কেটে তারপর দাগ বরাবর দু’ টুকরো করে, দাগের প্রান্ত আর গোড়ার প্রান্তকে একটা সুতো দিয়ে আলগা করে বেঁধে একটা ধনুক বানিয়ে ফেলল। সুতোটা তখনো ঢিলা রেখে ধনুকটাকে এবার চৌকো কাগজের উপর বসিয়ে ঠিকমত আকারে এনে সুতোর সেই ছিলা টাইট করে বেঁধে ফেলা হল। ধনুকের দুই মাথা কাগজের এক আর তিন নম্বর কোণা ছুঁয়ে আছে। আমরা ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ছটফট করলেও শান্তভাবে বসে দেখে যাচ্ছি।
মা ইতিমধ্যে বাটিতে ময়দা জ্বাল দিয়ে আঠা বানিয়ে এনে রেখে গিয়েছে। আর দিয়ে গেছে সুতোর কাটিম।
ধনুকটাকে কোনাকুনি করে রাখা বর্গাকার কাগজের উপরের অর্ধে ররাকাহ হল। তারপর ছোট ছোট কয়েকটা কাগজের টুকরোয় আঠা মাখিয়ে তাই দিয়ে ধনুকের কাঠিটাকে কাগজের গায় সেঁটে দেওয়া হল। এবার তীরের জায়গায় আরেকটা কাঠি ধনুকের তলা দিয়ে বসিয়ে আঠাওয়ালা ছোট ছোট কাগজের টুকরো দিয়ে আটকে দেওয়া হল। এই কাঠির মাথা উপরে দুই নম্বর কোণা পর্যন্ত আর নীচে চার নম্বর কোণা ছাড়িয়ে একটু বেরিয়ে আছে। এরপর একটা খুব ছোট চৌকো কাগজ ভাঁজ করে মাছের লেজের মত ছোট তিন কোণা লেজ বানিয়ে ঘুড়ির নিচের দিকে আঠা দিয়ে আটকে দেয়া হল। লেজের ছুঁচলো দিকটা উপরমুখী আর তার উল্টোদিকটা তীরের কাঠির নীচের দিকটাকে পকেটের মত করে পেটের ভিতর নিয়ে রেখেছে। এবার এই তিনকোণা লেজের শেষে জুড়ে দেয়া হল লম্বা ফিতের মত লেজ। ঠিক যেমন ছবির বইয়ে দেখা ঘুড়ি!
এবার ঘুড়িকে ওড়ানোর কল বাঁধা। বাঁকানো কাঠিকে সোজা কাঠি যেখানে ছুঁয়েছে সেখানে কাগজে কাঠিদের দুপাশে কোণাকুণি দুটো ফুটো করে ঐ দুই ফুটোর মাঝের কাগজ আর দুই কাঠিকে একসাথে নিয়ে একটা সুতোর প্রান্ত দিয়ে বাঁধা হল। সুতোর টুকরোটার অন্য প্রান্ত বাঁধা হল ঘুড়ির নিচের প্রান্ত থেকে কিছুটা উপরে সোজা কাঠির দু পাশে, প্রায় গায়ে গায়ে, কাগজে দুটো ফুটো করে সেই ফুটো দিয়ে সুতো ঘুরিয়ে এনে। এবার সুতোটাকে ইংরেজি ভি অক্ষরের মত করে ধরে ভি-র গোড়ায় একটা ফাঁস রেখে গিট্টু পাকিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর কল বানিয়ে ফেলা হল।
কলের প্রান্ত ধরে হাওয়ায় টান দিয়ে দেখে নেওয়া হল ...
ক্রমশ...