ধরাধামে চোখ খোলার কয়েকমাসের মধ্যেই একটানা অসুস্থতায় মরতে বসেছিলাম। এদিকে কর্মক্ষেত্রে বাবার উন্নতির লেখচিত্র তখন উপরের দিকে উঠছে। ফলে আমার শৈশব রকমারী খেলনা আর উপহারে ভরে উঠেছিল। এই খেলনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনার ছিল এক যন্ত্রবিদ্যার খেলনা। কার্ডবোর্ডের একটি শক্তপোক্ত বাক্সে দুই থেকে ছয় ইঞ্চি লম্বা অনেকগুলো ধাতব পাত - ধারগুলো গোল, যাতে কেটেকুটে না যায়। আর, নানা আকৃতির ধাতব টুকরো - এল আকৃতির, এক্স আকৃতির, ত্রিভুজ, গোল ইত্যাদি, সমতল বা বাঁকানো। সবারই গায়ে যথেষ্ট সংখ্যায় ফুটো করা যাতে নাট-বল্টু দিয়ে পরস্পর জুড়ে ফেলা যায়। আর, অনেকগুলো নাট, বল্টু, ওয়াশার। সেগুলো লাগাবার জন্য রেঞ্চ, স্ক্রু-ড্রাইভার, সুতো, কাঁচি – এলাহি ব্যাপার। সাথে অনেক ছবি, যেগুলো দেখে বানিয়ে ফেলা যাবে - বেঞ্চ, দোলনা, ঢেঁকি, সেতু, গাড়ি, বাতিস্তম্ভ! যন্ত্রবিদ বাবা হয়ত চেয়েছিল ছেলেও ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠুক। সেই ইচ্ছাটি তার আর পূর্ণ হয়নি। ছেলের জীবন অন্য পথে বয়ে গিয়েছিল। ঘুরপথে, জীবনের কোন এক পর্বে অবশ্য জিন ক্লোনিং এর জন্য মলিকিউলার বায়োলজিতে অন্য রকমের একটুখানি ইঞ্জিনিয়ারিং করার সু্যোগ তার হয়েছিল, এই আর কি। এখন সেই সব বিদ্যাও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে।
সেতু বানানোর খেলনাটা উত্তেজনার ছিল ঠিকই। কিন্তু একটা খেলনা ছিল একেবারে রহস্যে মোড়া। দেখতেও খুব সুন্দর। শক্ত প্লাস্টিকের এক ছোট্ট লাল পুতুল। দুটি গোলক একটি আরেকটির উপর বসানো। উপরেরটি ছোট – সেইটি পুতুলের মাথা। বাকি শরীর যা কিছু সব ঐ নীচের গোলকটি। এই গোলকটির নীচেটা চ্যাপ্টা ফলে পুতুলটি সুন্দরভাবে মেঝেতে বসে থাকে। পুতুলটিকে যতটা খুশি কাত করে ছেড়ে দিলে সে আবার নিজেই সোজা হয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। আর তখন তার পেটের ভিতর একটা সুন্দর ঘন্টা বেজে ওঠে। তাজ্জব হয়ে যেতাম আমি। এই অদ্ভুত আচরণের রহস্য ভেদ না করে কতদিন আর থাকা যায়! ফলে, পুতুলটি পাওয়ার কয়েকমাস পরে কোন এক বিকেলে ওটার নীচের গোলকটার পেটের কাছাকাছি জোড় বরাবর ছুরি চালিয়ে উপরের খোলাকে দু টুকরো করে ভিতরের চমৎকার কৃৎকৌশলটি দেখে ফেলা গেল। চিন্তা একটা ছিল যে বাবা কিভাবে নেবে এই ভাঙ্গচুর। বাড়ি ফিরে বাবা কিছুই বকলনা। বরং নিজেও বেশ কৌতূহল নিয়ে কারিগরিটা দেখল আর চেষ্টা করল পুতুলটা জোড়া লাগানোর। কাগজ আটকানোর ময়দার কি গঁদের আঠা এখানে কাজে আসবে না। অল্প অল্প তাপে দুই টুকরোর ধার গরম করে তারপর একসাথে ঠেসে ধরে চেষ্টা করা হল। জোড়া লাগলেও, বলাই বাহুল্য, তা স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। জ্ঞানলাভের মাশুল ভালই দিতে হল।
আর একটা প্রিয় খেলনা ছিল – জলরঙের বাক্স, তাতে নানা রঙ ভরা খোপ আর দুটো তুলি দেওয়া আছে। ছবি আঁকার আলাদা খাতাও ছিল। অনেক দিন ধরে অনেক আঁকাআঁকি করার পরেও জলরঙে আঁকার বিদ্যাটি আমার আয়ত্ত্ব হয়নি। বাবা অবস্থা দেখে উৎসাহ দিল পেন্সিল দিয়ে আঁকা অভ্যাস করতে। এইচ বি পেন্সিল আর গন্ধওয়ালা রবার অর্থাৎ ইরেজার কিনে এনে দিল। পেন্সিল কাটার যন্ত্র ছিল একটা, কিন্তু সেটায় শিস ভেঙ্গে যেত চট করে। বাবা তাই তার বিশেষ ছুরিটি দিয়ে নিজেই চমৎকার করে পেন্সিল চেঁছে দিল।
নানা রকম ফুল ফল আঁকার চেষ্টা চলল কিছুদিন। একদিন একটি একতলা বাড়ি আঁকলাম, ছোট ভিতের উপর বাড়ির সামনের দেয়াল, তাতে দুই পাল্লার একটি দরজা। সে দরজার দু’পাশে দুটি জানালা। বাড়ির মাথায় টিনের চাল উপরের দিকে একটু সরু হয়ে উঠে গেছে। কিন্তু এক দেয়ালের বাড়িকে ঠিক বাড়ি বলে মনে হয় না। এ ত সেই অনেকদিন আগে নাটকের স্টেজে দেখা বাড়ির মত। আসল বাড়ি বোঝাতে গেলে অন্তত এক পাশের একটা দেয়াল না দিলে কি হয়!
যা ভাবা তাই কাজ। সামনের দেয়ালটা এঁকে তার বাঁদিকের ধার থেকে একটু কোণা করে বাঁ পাশের দেয়াল এঁকে ফেলা গেল। বেশ একটা ঘর ঘর ভাব আসছে। কিন্তু তার পরেই আটকে গেলাম। কেমন যেন ঠিক হচ্ছে না। কোথায় যে গন্ডগোল, তাও বুঝতে পারছিনা। খাটে বসে আঁকছিলাম। বাবা পাশে বসে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। এবার সে মুখ খুলল।
- ঠিকমত আঁকলি কি?
কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।
- খাড়া দাগ কয়টা?
- তিনটা।
- সব কটা সমান মাপে আঁকলি, তাই ত?
- সমান হয়নি? স্কেল দিয়ে আঁকব?
- নাঃ, স্কেল লাগবে না। কিন্তু সব কটা সমান হবে কি?
আমি চুপ করে আছি।
- তুই কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস? কোথায় দাঁড়িয়ে বাড়িটা দেখছিস? একেবারে সামনে দাঁড়ালে পাশের দেয়াল দেখতে পাবিনা। বাঁদিকের দেয়াল যখন দেখতে পাচ্ছিস, তার মানে বাড়ির বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছিস। তাই ত?
- হ্যাঁ
বাবা এবার খাতা টেনে নিয়ে দুই দেয়ালের দূরের প্রান্তের খাড়া দাগগুলো উপরে নীচে একটু করে মুছে দিল। সামনের দেয়ালের দূরের প্রান্ত-দাগ একটু বেশি মোছা হল। মাটির আর উপরের শোয়ানো দাগগুলোও এবার মুছে যেমন দরকার সেইভাবে খাড়া দাগগুলোর সাথে জুড়ে দেওয়া হল। এতক্ষণে আমি তফাৎটা বুঝে গেছি। কেমন ঠিক ঠিক দেখাচ্ছে এখন! এবার এর সাথে মিলিয়ে দরজা-জানালা, বাড়ির মাথার চাল, এসব বসিয়ে দিলেই হয়ে যাবে।
- রেল লাইন দেখেছিস কখনো?
- হ্যাঁ, মামাবাড়ি যাওয়ার সময়।
- প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে লাইন বরাবর তাকিয়ে দেখেছিস?
- মনে পড়ছেনা।
- আবার কখনো সু্যোগ পেলে তাকিয়ে দেখবি, মনে হবে লাইনদুটোর মাঝে ফাঁক সমানে কমে গেছে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেলে দেখবি একসময় লাইনদুটো গায়ে গায়ে মিশে গেছে। আসলে তাদের মাঝে সব সময় একই দূরত্ব থাকে কিন্তু আমরা দেখি অন্য রকম। ছবি আঁকার সময় কোথা থেকে, মানে কোথায় দাঁড়িয়ে জিনিষটাকে দেখে ছবিটা আঁকছ, সেইটা ইম্পর্ট্যান্ট। তেমনভাবে ধরা একটা ডিমকে দেখে আঁকলে সেইটা ডিমের মত নয়, একেবারে একটা বলের মত দেখাবে। একদম উপর থেকে সোজাসুজি দেখলে বাড়িটারে দেখাবে স্রেফ একটা চারকোণা ছাদ, আর কিছুনা। কোন কিছু, জিনিষ হোক কি প্রাণী, তারে আঁকার আগে তাকে দেখতে শিখতে হবে।
এরপর ছবি আঁকা নিয়ে গল্প হল, কিভাবে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার একটা বস্তুকে শুধু দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে এমন কিছুতে যেমন আঁকার পাতায়, ফুটিয়ে তুলতে হয় তার কলা কৌশল শেখা, পার্স্পেকটিভ, পরিপ্রেক্ষিত, দৃষ্টিকোণ বোঝা।
আমার মনে হল, মনের ভিতর একটা চোখ খুলে গেল। আঁকিয়ের নিজের অবস্থান, নিজের পারস্পেকটিভ থেকে বস্তুকে দেখতে শেখা। দ্রষ্টব্য একই থাকে, দৃষ্টিকোণ পাল্টায়, ছবি অন্যরকম হয়ে যায়।
দেখা কি রকম জানিস? দ্রোণাচার্য্য তাঁর ছাত্রদের তীর চালাতে শিখিয়েছেন। এবার পরীক্ষা নিচ্ছেন। বাগানে কিছু দূরে উঁচুতে, গাছের ডালে এক কাঠের পাখী বসিয়ে রেখেছেন। তাকে বিঁধতে হবে। এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন কি দেখছে তারা? বিভিন্ন জন বিভিন্ন উত্তর দিল, কেঊ বাগানের কথা বলল, কেউ আকাশের, কেউ চারপাশে জমা হওয়া লোকেদের। গুরু সন্তুষ্ট হন না। একের পর এক বাতিল। সবশেষে অর্জুন।
- কী দেখতে পাচ্ছ?
- পাতার ফাঁকে পাখী।
- বেশ, ভালো করে দেখো। এখন কী দেখতে পাচ্ছ?
- পাখীর মাথা।
- এখন?
- পাখীর চোখ।
- সাব্বাস। চালাও তীর।
সাঁই করে তীর ছুটল। একদম লক্ষ্যভেদ। একে বলে একাগ্র হওয়া, ফোকাস করা। ফোকাস করতে শিখতে হবে।
হুবহু এইভাবেই যে এ গল্প হয়েছিল, তেমন জোর দিয়ে সে কথা বলতে পারি না। তবে এর কাছাকাছিই কিছু, বেশ গল্পের মত করে, নাটকীয়তার সাথে। অনেক পরে ফটোগ্রাফি নিয়ে মেতে ওঠার কালে এই গল্প আবার মনে পড়েছিল – ভিন্ন প্রেক্ষিতে – ডি ও এফ – depth of field নিয়ন্ত্রণ করে ফটো তোলা। বিশেষ প্রকৌশলে ছবি তুলে এই দেখাকেই ফটোতে ধরতে চাওয়া। যা ছবিতে ধরতে চাইছি তার ফোকাস-তল খুব কমিয়ে এনে শুধু একটি বিন্দুকে ঘিরে কিংবা একটি রেখা বরাবর অল্প একটু জায়গা জুড়ে স্পষ্ট করে তার খুঁটিনাটি দেখানো, আর বাকি সব জায়গা ঝাপসা রেখে দেওয়া। এই ছবির কদর আলাদা। এই ছবি তোলার খরচও আলাদা, বিশেষ লেন্স দরকার হয়, প্রকৌশলের চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে এই ফটোগ্রাফিকে ঘিরে। মন ঠিক করো, কোথায় জড় করতে চাও তোমার দেখার একাগ্রতা, কোথায় ফোকাস করতে চাও? কেন্দ্রে, পাশে, উপরে, নীচে, পরিধিতে, কিংবা কোন খাড়া, আড়াআড়ি বা হেলানো রেখা বরাবর? … বর্তমানে, অতীতে, কবে, কোথায়, কাকে ঘিরে … অন্তরে, বাহিরে …
তা বলে সব সময় কি আর পাখীর চোখ দেখা! সমগ্রেও দেখতে লাগে। সে গল্পও হয়েছে। একদিন এক মেলার ছবি সামনে নিয়ে গল্প হল। কোন পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া, সাদা-কালো ছবি, সোজা রেখা, বাঁকা রেখা, কেনা-কাটার জিনিষ, দোকান, বিজলি বাতির তার, খুঁটি, নাগরদোলা, অজস্র মানুষ, নানা ভঙ্গিতে, কেউ দেখছে, কেউ কথা বলছে, সামনের দিকে যারা তাদের গোটা অবয়ব, যত পিছনে তত কম দেখা যাচ্ছে, শেষে শুধু মাথার সারি, সারির আদল। বাবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ধরে ধরে দেখালো, কত যত্নে, অল্প আঁচড়ে কিন্তু কি নিপুণ দক্ষতায় ছোট ছোট ডিটেইল ধরা হয়েছে, গোটা ছবি জুড়ে। এও দেখা, খুঁটিয়ে কিন্তু সমগ্রে।
অনেক পরে কর্মজীবনে, একসময়ে কয়েক বছর আগের সিনিয়র, তখন অণু জীববিদ্যায় আমার গবেষণার মেন্টর, ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ডক্টর চাউঢ্রি, আমার জন্য গৌতমদা, বলেছিল – tunnel vision হয়ে গেলে ত চলবে না বৎস, পুরোটা দেখতে হবে। তারপর হা হা করে হাসি। অকালে চলে যাওয়া প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক, বিশাল হৃদয় মানুষটির কাছে আমার ঋণ অপরিসীম।
ছবি আঁকায় দক্ষতা আসেনি। কিন্তু আঁকা নিয়ে এর পরেও বাবার সাথে গল্প হয়েছে অনেক। ছবি দেখা নিয়ে, দেখানো নিয়ে। হয়ত আরও সময় নিয়ে লিখব কিছু তার, যা মনে পড়ে, অন্য কোন পর্বে, অন্য কোন দিন।
ছবির জন্য শেখা এই দেখা - পরে আরও বিস্তৃত হয়েছে। দেখতে, বুঝতে চেষ্টা করেছি, করি, ঘটনাকে, জীবনকে - নিজের এবং অন্যদের, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, ভিন্ন ভিন্ন দর্শনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে।
কলকাতাকেন্দ্রিক দক্ষিণবঙ্গের দিনগুলির তুলনায় উত্তরবঙ্গের দিনগুলি ছিল অনেক বেশী গ্রামীণ, মফস্বলী। কিন্তু, নিউ টাউন, কুচবিহার-এর সেই জীবন প্রবাহও ছিলো রীতিমত আধুনিক ও শহুরে – গ্রাম কুচবিহার-এর তুলনায়। গ্রাম কুচবিহার-এর দেখা পেয়েছিলাম একবারই, অতি সামান্য সময়ের জন্য। গিয়েছিলাম এক পিসির বিয়েতে হাজির থাকতে। বাবার সম্পর্কিত বোন। লেখাপড়া শিখেছে। সেই সময় তাদের পরিবারে সেটা অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের খুব ভালো লেগেছিল পিসিকে। কিছুদিন সে আমাদের বাড়িতে বেড়িয়ে গিয়েছে। তাদের নিজেদের বসতটি ছিল এক নদীর ধারের গ্রামে, আমাদের শহরটি থেকে খানিকটা দূরে। কতটা দূরে সে আর এখন ধারণা করতে পারিনা। কিন্তু, ঝাপসা হয়ে আসা স্মৃতির আড়ালে এইটা আজো মনে পড়ে যে, দূরত্বটা নিছক ভৌগোলিকই ছিল না, কি কথার ধরণে, কি খাদ্যাভ্যাসে, কি পারস্পরিক আলাপচারিতায় সে দূরত্ব ছিল জীবনযাত্রারও, জীবন বোধেরও হয়ত বা! প্রবল আন্তরিক, জড়িয়ে নেওয়া, ভালো লাগে, আবার লাগেও না, কারণ সে যেন এক অন্য জগতে বেড়াতে যাওয়া যাকে আমি ভালোভাবে চিনি না, মাত্র কয়েকটা দিনের উৎসব বাড়ির হট্টমেলায় যাকে চিনে নেওয়া সম্ভবও ছিলনা।
তাহাদের সেই গ্রামের নামটি ঘর্ঘরিয়া। গ্রামটি ছিল নদীর পাড়ে, তাহাদের সেই নদীর নামটি, সেটিও ছিল ঘর্ঘরিয়া।
এ লেখা প্রথম বার লেখার সময় এই পর্যন্ত লিখে দ্বিধান্বিত হয়েছিলাম যে, স্মৃতি ঠিকমত সাথ দিচ্ছে ত? দূরভাষে মা’কে জিজ্ঞেস করে জানতে চেয়েছিলাম যে সেই বেড়াতে যাওয়া নিয়ে তার কিছু মনে পড়ে কি না। মা তখন শরীরে বেশ অশক্ত। কিন্তু স্মৃতি আর মনন তার, তখনও বিপুল ভাবে সতেজ সচলতার হকদার ছিল। জিজ্ঞাসামাত্রই স্রোতের মত প্রবাহিত হ’ল নানা পারিবারিক তথ্য। সেই স্রোতের ধাক্কা সামলে ভৌগোলিক তথ্যটি বার করতে গিয়েই গোল বেঁধে গেল। মা বললে নদীর নাম ঘর্ঘরিয়া নয়, তোর্সা। তা হলে! মা ঠিকমত মনে না করে থাকতেই পারে। কিন্তু এখন এ কুয়াশা কাটাই কি করে! শরণ নিলাম অগতির গতি গুগল-এর।
মাস খানেক কি তারও বেশী সময় ধরে ঘুরে বেড়ালাম এ লেখা থেকে ও লেখায়, মানচিত্রের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। দূর উত্তরে সেই সোনাপুর, কামসিংগ্রাম এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ঘর্ঘরিয়া নামের নদীটি দক্ষিণে তোর্সায় এসে মিলেছে। প্রথমবারের সন্ধানের সময় ধারণা হয়েছিল যে ঘর্ঘরিয়া নদীর শেষের দিকের খানিকটা জুড়ে সে নিজেও এক তোর্সা নাম নিয়েছে, শীলতোর্সা। তা হলে হয়ত এই শীলতোর্সার পাড়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু এবারে, প্রায় এক দশক বাদে আবার গুগল ম্যাপে এবং আন্তর্জালে আরও যতটা সম্ভব খোঁজাখুঁজি করা যা জানা গেল তাতে মনে হয়েছে তোর্সা নদীটিই একাধিক জায়গায় বা তার পুরো গতিপথ জুড়ে শিলতোর্সা বা শীলতোর্সা নামে পরিচিত। কিন্তু ঘর্ঘরিয়া কোথাও তার নাম পাল্টায়নি। তা হলে? প্রাপ্ত তথ্য আমার কোন কাজে লাগবে? আমি এখন কোথায় খুঁজে পাই আমার সেই শৈশবের গ্রামটিকে? জট খোলায় এবার তা হলে আমার ক্যালিডোস্কোপের সাহায্য নিই।
ছবি ১)
যাওয়ার পথটা যদিও অনেক লম্বা মনে হয়েছিল, সেটা অতিক্রম করতে ট্রেনে চড়ার দরকার হয়নি। বাসে চেপে আর পায়ে হেঁটে, তার মানে তার অবস্থান দূর উত্তরে, ঘর্ঘরিয়া নদীর উৎসস্থল অর্থাৎ আলিপুরদুয়ার অঞ্চলের দিকে নয়, দক্ষিণে, আমাদের বাড়ির দিকে কোথাও।
ছবি ২)
সেখানে গিয়ে পৌঁছানোর পর নদীতে যখন নেমেছিলাম, সেটা বেশ ছোট নদী মনে হয়েছিল। বাড়ির কাছের তোর্সা নদীর সাথে তার কোন তুলনাই চলে না। বরং, একটি খাল বললেই মানায় তাকে।
মনে রাখি - শিশুর কাছে যে দূরত্ব অনেক, বাস্তবে তার অতটা না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর যেটা শৈশবেই আকারে ছোট মনে হয়, সেটা বাস্তবে অবশ্যই ছোট।
গুগল মানচিত্রে ঘর্ঘরিয়া নদীর তীরে ঘর্ঘরিয়া নামের দুটি গ্রাম দেখা যাচ্ছে – ঘর্ঘরিয়া প্রথম খণ্ড ও ঘর্ঘরিয়া দ্বিতীয় খণ্ড। কেন এই খন্ড খন্ড অবস্থা সেটা জানতে পারিনি। ঘর্ঘরিয়া নদী যেখানে তোর্সায় মিশেছে সেটির অবস্থান দ্বিতীয় খণ্ডে। সেখানে সে নদী বেশ চওড়া এবং ঐখান থেকে উত্তরের দিকে বেশ খানিকটা পর্যন্ত একই রকম চওড়া দেখা যাচ্ছে। তারপর থেকে বাকি গোটা প্রবাহ জুড়ে নদীটি খুব সরু। ঘর্ঘরিয়া প্রথম খণ্ডর মধ্য দিয়ে এই সরু অংশটিই বয়ে চলেছে। তা হলে সম্ভবত আমরা এই প্রথম খণ্ড গ্রামটিতে গিয়েছিলাম। এমন কি হতে পারে, তখন গ্রামটি অখন্ড ছিল, আর তার একপাশে তোর্সা আর আরেক পাশে ঘর্ঘরিয়া বয়ে যেত? এর উত্তর আমার জানা নেই।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে ঘুরে যাই। প্রথমবার এই খোঁজাখুঁজির সময় দুটি নাম চোখে পড়েছিল। এখনও দেখতে পেলাম তাদের। ঘর্ঘরিয়া নদী আর ৩১ নং জাতীয় সড়কের মাঝখানের জমিতে একটি ধনুকাকৃতি দীর্ঘ জলাশয় । নাম তার – শোল মাছের বিল! আর তার পশ্চিম প্রান্তে সামান্য তফাতে একটি বিশাল প্রায় চৌকো দিঘী। তার নাম? লাল পরীর দিঘী! কোচবিহারের রাজবাড়ির দুর্গামূর্তি লাল রঙের, তার গল্প পড়েছি। কিন্তু এই দিঘীর নামের কারণ কি? কি রহস্য ধরা আছে এখানে? স্থানীয়রা কেউ কেউ জানতে পারেন। কোথাও কি কিছু লেখা আছে? আন্তর্জালে তার উল্লেখ নেই। অন্তত গুগল করে কিছুই পাওয়া গেল না। যারা জানেন তারা চলে গেলে সেই ইতিহাস উদ্ধার আরো কঠিন হয়ে যাবে, হারিয়েও যাবে হয়ত। কত যে গল্প চাপা পড়ে থাকে, হারিয়ে যায়, যাচ্ছে! সময় থাকতে লিখে না রাখলে সব স্মৃতিই মিলায় বিস্মৃতিতে!
ঘর্ঘরিয়া গ্রামের স্মৃতি আমার তিনটি। প্রথমটির কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আজ আশা করি সকলই অন্যরকম হয়েছে, কিন্তু সেই দিনগুলোতে আমাদের সেই আত্মীয় বাড়িতে কোন ভদ্রদস্তুর শৌচাগার ছিল না। বড় মহিলাদের জন্য কোন রকম একটা ঘেরা জায়গা সম্ভবত ছিল কোথাও, কিন্তু আমাদের ছোটদের জন্য নদীর ধার কি মাঠের কোণ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না। আজীবন খুঁতখুঁতে মানুষ আমি। ঐ দুটি দিন যে কি ভাবে এ বিষম দায় পার করেছিলাম সে কথা ভাবলে আজও সিঁটিয়ে যাই।
তবে, প্রথম অভিজ্ঞতার যন্ত্রণাকে লঘু করে দিয়েছিল এক মধুর অভিজ্ঞতা। সেই দ্বিতীয় স্মৃতিটি এই বুড়ো বয়সেও অ্যাডভেঞ্চার-এর অনুভূতি ফিরিয়ে আনে। প্রথম দিনের শেষে সম বয়সী যাদের সাথে দোস্তি জমে গিয়েছিল, তাদের থেকে এক বালিকা দ্বিতীয় দিনের সকালে আমায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিল, তাদের জল-জঙ্গল-মাঠ-ঘাট দেখাতে। সারা দিন ঘুরেছিলাম তার সাথে। সে আমায় দেখাল নদী, দেখাল মাঠ, বাগান, গাছ – ফলের, ফুলের! কত যে রকমের গাছ! আর কত যে রকমের ফুল! এবং, ফুলের মধু! তার কাছেই শিখলাম ফুলের গোড়াটা খুলে ফেলে কিভাবে সেখান থেকে মধু চুষে খেতে হয়। সারা সকাল ঘুরে ঘুরে মধু খেয়ে বেড়ালাম দু’জনে, আমার চেনা, অচেনা কত যে ফুলের! ভিন্নতর মধুর সন্ধান পাওয়ার আগে সেই আমার পরম মধুর প্রাপ্তি।
তৃতীয় স্মৃতিটি একটি অনুষ্ঠানের। বিয়ে উপলক্ষে কীর্তনের আয়োজন হয়েছিল। সে বর্ণনায় যাওয়ার আগে একটু ধরতাই সেরে নিই। ঠাকুমার কাছে জেনেছিলাম যে আমরা বৈষ্ণব না হলেও কৃষ্ণমন্ত্রী। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানা হয়নি। শুধু দেখেছি, অনেক অল্প বয়সে বিধবা হওয়া এবং তারপর একসময় দীক্ষা নেওয়া, সাদা থান পরা ঠাকুমা রোজ স্নানের পর তার জপের ঝুলিটি থেকে ধাতুর তৈরী, সম্ভবত পিতলের, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ইঞ্চি দেড়েক মাপের, জোড়া পায়ের ছাপ দেওয়ার একটি ছাঁচ বের করতেন; চন্দন বেটে ঐ ছাঁচ দিয়ে বাহুতে, এবং বুকে চন্দনের পদচিহ্ন আঁকতেন। কখনো কখনো আমিও সেই ছাপ বসিয়ে দিতাম। শরীরে, হৃদয়ে, পরম বিগ্রহকে, প্রার্থিতকে, কৃষ্ণকে ধারণ করা। ধর্মীয় আর কোন বড় অনুষ্ঠানে এ যাবৎ বিশেষ উৎসাহী হতে না দেখা ঠাকুমাকে দেখলাম এই কীর্তনের আসরে যেতে প্রবল আগ্রহী। তার সঙ্গী হয়ে আমিও জুটে গেলাম সেখানে।
চারদিক খোলা গোল তাঁবুর মত ম্যারাপ। মাঝখানে গোল চঁদোয়া। তার নীচে, কেন্দ্রের খুঁটিটি ঘিরে নানা ফটো, বৈষ্ণব ধর্মের নানা দিকপালদের। তাদের ঘিরে খোল-কর্তাল ইত্যাদি বাজিয়ে জোর কীর্তন গান হচ্ছে। বেশ ভীড়। ঠাকুমার হাত ধরে আমি সামনের দিকেই বসে পড়লাম। একটু পরে দেখি অবাক কান্ড, ঠাকুমার চোখ দিয়ে জলের ধারা বইছে! আমার রীতিমত ডাকাবুকো ঠাকুমাকে সে দিনের আগে কখনো আমি কাঁদতে দেখিনি। তারপর সামনে তাকিয়ে দেখি, আরো আশ্চর্য! বয়স্ক মানুষেরা ধূলায় গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করছে। সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম ব্যক্তি মানুষের চিন্তা-চেতনা-কাজ-এর উপর সম্মিলিত মানুষের আচরণের প্রভাব। বেলা হয়ে যাওয়ার কারণে যখন আসর ছেড়ে চলে এসেছিলাম ততক্ষণে গোটা আসরটি পরিণত হয়েছিলা একটি একীভূত চেতনা-আধারে। গোটা আসর একসাথে দুলছে, গাইছে, কাঁদছে, গড়াগড়ি দিচ্ছে, উঠে দাঁড়াচ্ছে, আকুতি জানাচ্ছে, আনন্দ প্রকাশ করছে। কথক মানুষটি কখন যে সেই জনতাকে উদ্বেলিত করছে আর কখন যে নিজেই উদ্বেলিত জনতার মিলিত অভিঘাতে ভেসে যাচ্ছে সেটা আর আলাদা করে ধরতে পারছিলাম না। ধরা সম্ভব-ও ছিল না, নিতান্তই ছেলেমানুষ আমার পক্ষে। আজও কি পারি!
অনেক মানুষের একীভূত চেতনার রূপ অবশ্য বারে বারেই দেখা হয়েছে। কোন কোন বারের অভিজ্ঞতা তুলনায় গাঢ় ছাপ রেখে গেছে। কোচবিহার নিউটাউনে, আমাদের বাসার এক মিনিটের দূরত্বে ছিল বড় রাস্তা, ক্যাঁচর-কোঁচর গরুর গাড়ি থেকে লজ্ঝড়ে লরি, বিশাল ট্রাক, সারি সারি ট্যাঙ্ক – সব যেত ঐ রাস্তা দিয়েই! মাঝে মাঝে ফৌজী বাহিনী দৌড়ে যেত কুচকাওয়াজ করতে করতে। সে সময় পাড়ার সব বাড়ির আমার বয়সী ছেলে মেয়েরা ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম রাস্তার ধার ধরে। এক দিন অন্যরকম কিছু আওয়াজ শুনে বড় রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার চেনা বাচ্চারা সব এর মধ্যেই এসে গিয়েছিল। যা দেখলাম তা আগে কখনো দেখি নি। অনেক মানুষ একসঙ্গে চলেছে। মাঝখানে কয়েকজনে মিলে বয়ে নিয়ে চলেছে একটা রঙ্গীন কাঠামো। মানুষ চলেছে কাঁদতে কাঁদতে, আর্তনাদ করছে তারা। একসময় বাড়ি ফিরে বললাম কি দেখে এসেছি। বাবা বাড়ি ছিল। বলল যে এ ছিল মহরমের মিছিল, তাজিয়া নিয়ে চলেছে তারা। (পরে জেনেছি যে শুদ্ধ কথাটা মুহররম। কিন্তু সেই সময় আমরা অনেকেই বলে এসেছি – মহরম।)
– মিছিল কাকে বলে?
– যা দেখলে, অনেক মানুষ একসাথে ঐ ভাবে গেলে তাকে মিছিল বলে।
– সবাই কাঁদছিল কেন? সবাই বলছিল হায় হাসান, হায় হোসেন। কেন?
– দুঃখ হচ্ছিল যে সবার। হাসানের জন্য, হোসেনের জন্য। অনেকদিন আগে বড় করুণ ঘটনা ঘটেছিল তাঁদের ঘিরে। সেই ঘটনা মনে করেই মুসলমানদের একটি অংশ ঐ মিছিল করেন। সব মুসলমানরা না, কেউ কেউ।
– মুসলমান মানে? মুসলমান কাদের বলে?
– যাঁরা ইসলাম ধর্ম পালন করেন তাদের মুসলমান বলা হয়।
এরপর বাবা বলল কারবালার প্রান্তরের কাহিনী। তৃষ্ণাকাতর শিশুর মৃত্যু ঘটানোর নৃশংসতার কথা বলার সময় চোখ মুছল। চুপ করে বসে রইল একটু। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একসময় বলল,
– এখনো সব বোঝার বয়স হয়নি তোমার, বড় হলে আস্তে আস্তে অনেক কিছু বুঝতে পারবে।
তারপর একটি বইয়ের নাম বলল। অনেকদিন বাদে এই মহাকাব্যিক বইটি পেয়েছিলাম এক সন্ধ্যায়, কারো বাড়ি বেড়াতে গিয়ে। সময় কম। অল্পই পড়ে উঠতে পারলাম। অন্যরকম লেখা। সমুদ্র তরঙ্গের মতই ঘটনাপ্রবাহ আছড়ে পড়ছে, ফিরে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে প্রবল ঘনঘটায়। এবং সে সমুদ্র চূড়ান্ত বিষাদময়। দমবন্ধ করে ফেলে একেক সময়। পরে বিভিন্ন দিনে, একাধিকবারের চেষ্টায় সমাপ্ত করতে পেরেছিলাম সে বইয়ের পাঠ। সময়ের সমুদ্র পার হয়ে সে কাহিনীর বিপুল বিস্তার এখন আর মনে করতে পারি না সে’ভাবে। শুধু সেই প্রথম সন্ধ্যার মৃদু আলোয়, মাত্রই কয়েকটি পাতা, মীর মশাররফ হোসেন-এর বিষাদ-সিন্ধু পড়ার অভিজ্ঞতা, আজো বুকের ভিতর মুচড়ে নেয়। থেকে থেকে টের পাই, দেখি, কোন না কোন বিষাদ-সিন্ধু ঘিরেই থাকে আমাদের, অন্তহীন। থেকে থেকে স্তব্ধ হয়ে ভাবি, বুঝি না, আজও বুঝিনা, কিভাবে কারবালার সে মর্মান্তিক প্রান্তর ফিরে ফিরে আসে, ফিরে ফিরে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় সমাজ-সংসার, মানুষের চলার পথ!
কুচবিহারেই প্রথম যাত্রা দেখেছিলাম। খুবই সাধারণ মাপের, পরবর্ত্তীতে যে বিপুল জনপ্রিয়তার বিরাট আয়োজনগুলি দেখেছি তার ধারে কাছেও নয়। মুগ্ধও হই নি তেমন করে। তবুও যে সে রাতের কথা মনে আছে তার কারণ, যাত্রার পরের একটি ঘন্টা। যাত্রার শেষের দিকেই আকাশে বাতাসে টের পাওয়া যাচ্ছিল ঝড়ের সংকেত। কিন্তু গল্প ছেড়ে কার আর উঠতে মন চায়! ফলে লোকেরা যখন একসাথে ঘরমুখী হ’ল, কয়েক পা যেতে না যেতেই ঝড়-জল আছড়ে পড়ল প্রবল মত্ততায়। এগোতে পারছি না। মাথার উপর ঠাস ঠাস করে আছড়ে পড়ছিল বরফের গুলি। আমরা বড়-মেজ দুই ভাই, বাবা আর ঠাকুমা – চারজনের দল। ঠাকুমার হাত ধরে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম বাবার হাত ধরা মেজ ভাইয়ের থেকে। আমরা দু’জন কোন একটা বাড়ির সামনের তিনদিক খোলা, ছাদঢাকা বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। ঝড় একটু কমার পর দু’জনে বাড়ি ফিরে দেখি মা জানলা ধরে দাঁড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে নিঃশব্দে। বাবা আর মেজ ভাই সোজা বাড়ি চলে এসেছিল। আমাদের না দেখে বাবা বেড়িয়ে পড়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। মিশমিশে কালো রাতে প্রকৃতির ঐ প্রবল তান্ডবের মধ্যে সে লোক ঘুরে বেড়িয়েছে তার ছেলে আর মা-এর খোঁজে। ঝড় পুরোপুরি থামার পরেও কোথাও আমাদের না পেয়ে ফিরে এল নিদারুণ হতাশায় বিপর্যস্ত, বিদ্ধস্ত হয়ে। বাড়িতে এসে দেখে হারানিধিরা ঘরেই হাজির, সুস্থ অবস্থায়। গম্ভীর মানুষটি তখন যে বিরাট আনন্দের ঢেউয়ে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিল তার গভীরতা আমি সে’দিন বুঝি নি। বুঝেছি অনেক প’রে, বিনা সংবাদে, সময়ের মাপহীন সময় যেদিন পার করতে হয়েছিল নিজের সন্তানের ঘরে ফেরার অপেক্ষায়, সেই দিন! অনেক আগের সেই রাতের ছবি তখন দেখতে পেয়েছিলাম আরেক আর্ত প্রাণের দৃষ্টি থেকে।
ক্রমশ...