উত্তরবঙ্গের বাসায় সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি এসেছিল প্রথম দিনেই, বাড়িতে কোন বিজলী বাতি নেই। শুধু আমাদের বাসায় নয়, পুরো পাড়াতেই নেই। ঐ এলাকাতে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। সারা দিনে এটি তথ্যমাত্র ছিল, সন্ধ্যার আলো পড়ে আসার সাথে সাথে, সেটি অনুভবে এল। ঘরে ঘরে তেলের আলো। দিনের বেলায় বাবা যত্ন করে কেটে সমান করত - সেজবাতি কি হ্যারিকেন-এর সলতের প্রান্তভাগ। সন্ধ্যায় তাদের যখন জ্বালানো হত অন্ধকার অনেকটাই দূরে সরে যেত। আলো ঘিরে পড়তে বসতাম আমরা। কিন্তু, সন্ধ্যা যখন গড়িয়ে যেত রাতের ঘেরাটোপে, একটু একটু করে খোঁচা জেগে উঠত সলতের মাথায়। শিখা সেখানে ঘোরাল হয়ে উঠত। চিমনীর গায়ে তির তির করে পড়ত কালির পরত, আর ঘরের ভিতর, সেদিকটার দেয়ালে অন্ধকার এগিয়ে আসত গুটি গুটি, ধীরে ধীরে আরও জমিয়ে। যতই কাঁচ-ঘেরা হোক, বাতাসের ছোবল থেকে রেহাই মিলত না কোন বাতির। সলতের উপরে থেকে থেকে কেঁপে ওঠা আলো আমাদের বসিয়ে রেখে দিত আলো-আঁধারের প্রান্তসীমায়। যে জগৎ-টা নানা রহস্যে ভরা, কে জানে কোন আদিম কাল থেকে মানুষের সঙ্গী হয়ে আছে, মনে হত সে যেন ওঁত পেতে বসে আছে আমাদের ঠিক পাশেই – যে কোন সময় লাফিয়ে পড়বে আমাদের সামনে।
আমাদের সে বাসায় বিজলীর আলো আসার আগেই আমরা সেখান থেকে গঙ্গা পার হয়ে ২৪ পরগণায় চলে আসি। যেখানে এলাম সেখানে বিজলী বাতির আলো। কিন্তু, সইল না। কিছুদিনের মধ্যেই, ‘লোডশেডিং’ নামের এক দানবের হাত ধরে অঙ্গরাজ্য বাংলায় নেমে এসেছিল দীর্ঘস্থায়ী অন্ধকার-যুগ। প্রযুক্তির অপ্রতুলতা, তার প্রয়োগের অসুবিধা এইসব কারণের পাশাপাশি সে আঁধার নামিয়ে আনার কৃতিত্ব ছিল আলো জ্বালানোর দায়িত্বে থাকা প্রশাসন আর রাজনীতির লোকেদেরও। তাদের লোভ আর অবিমৃষ্যকারীতার ফল ভুগেছে রাজ্য জুড়ে নিরুপায় মানুষেরা। আলোআঁধারির রহস্যময়তা নয়, সেই সময় আমাদের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল হতাশা আর অবক্ষয়-এর প্রায় অন্তহীন অন্ধকার।
আলোর অপেক্ষায় থাকা আঁধারের দিনগুলোয় সতর্কতা ছিল, ভয় ছিল, রোমাঞ্চও ছিল। আশা ছিল – আলো আসবে, আলো আসছে। কিন্তু, আলোর উল্টো পথে চলে যে আঁধারে পৌঁছে যাওয়া, আলোর সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে আঁধারের সমুদ্রে যে ক্রম-নিমজ্জন, আমাদের বোধের জগতে সে বড় ভয়াবহ, সে বড় মর্মান্তিক অভিঘাত নিয়ে এসেছিল। সেই শেষ নয় যদিও। বস্তুত জীবন দীর্ঘ হলে আমরা বারেবারেই কালের ঘড়ির দোলকের এই প্রান্ত বদলের মধ্য দিয়ে যাই। তাই আলোর দিনে যথা সাধ্য প্রস্তুতি নিই আগামীর অন্ধকারের জন্য। আর, অন্ধকারের দিনে মনে রাখতে চেষ্টা করি, সমস্ত অন্ধকার যুগ কাটিয়ে একসময় আলোর দিন আসে, পরের অন্ধকারের আগে। আর হাতে ধরা বাতি হোক কি তারার আলোয়, এমনকি নিকষ কালো অন্ধকারেও, আলোর পথযাত্রীরা এগিয়ে চলে, কেউ কেউ পড়ে যায়, তবু এগিয়ে চলা থামেনা।
উত্তরবঙ্গের দিনগুলো ছিল আমার চেতনার উন্মীলনের কাল। আমি চোখ মেলছিলাম আর আলো জ্বলে উঠছিল, এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে। আমার বাবা ভিটে মাটি ছেড়ে আসার সময় বস্তু হিসাবে দাম আছে এমন প্রায় কিছুই আনতে পারেনি। শুধুমাত্র দু’-একটা বই ছাড়া। পাতা খসে আসা এরকম-ই একটা বই ছিল – গল্প, নাটক, কবিতার। পড়া একটু কঠিন – বহু কথার অর্থ জানা নেই। তবে, পড়তে পড়তে আরও খানিকটা করে বোঝা যায়। বড় চমক লেগেছিল এ বইয়ের কবিতায়। নেশা ধরান, অদ্ভুত ধরণের কবিতা। পড়লে ছন্দ আছে অথচ পংক্তি শেষের মিল নেই। বাবা বলল, এ হচ্ছে, অমিত্রাক্ষর ছন্দ। যিনি লিখেছেন এ কবিতাগুলি বাংলা ভাষায় তাঁর স্বীকৃতি শুধুই একজন কবি-র নয়, মহাকবি-র। চলিত ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি বঞ্চিতকে বসিয়েছেন নায়কের আসনে। সেই শুরু। তারপর আরও বহুকাল ধরে ফিরে ফিরে গেছি মধুকবির কাছে। একসময় পড়েছি সেই কবিতাও – সভায় সভায় যা আবৃত্তি করে বেড়িয়েছি – “রেখো মা দাসে রে মনে … … মধুহীন কোরো না গো তব মনঃ কোকনদে।” মধুকবির আকাঙ্খা পূর্ণ হয়েছিল। অমর পদ্ম হয়েই ফুটেছিলেন তিনি। আমার সে গুণ নেই। এ পরবাসে যেদিন ঝরে যাব, কয়েকটি ভালোবেসে মনে করা প্রাণের স্মৃতির সরণিতে কিছুদিনের জন্য অবরে-সবরে মনে পড়া ছাড়া, মিলিয়ে যাব এমনিই, কোথাও কোন চিহ্ন না রেখে।
ঐ দিনগুলিতে একটি ছোট্ট ঘটনা আমার চেতনায় গভীর প্রভাব রেখেছিল। যদিও তখন সেভাবে বুঝিনি। আমাদের বাড়িতে তখন প্রশাসনের নানা মাপের, নানা দরের মানুষের আসা-যাওয়া। একদিন এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক বাবার সাথে দীর্ঘ বৈঠক শেষে বিদায় নেওয়ার আগে আমার কাছে এগিয়ে এসে খোঁজ নিলেন আমি কোন শ্রেণীতে পড়ি ইত্যাদি। সম্ভবতঃ তখন চতুর্থ শ্রেণী চলছে। দু-চার কথার গল্পের পর জানতে চাইলেন আমি সম্রাট অশোকের ছেলে মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রার কথা জানি কি না। তারা যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে সিংহলে গিয়েছিলেন সে কথা জানিয়ে আমি বললাম যে অনেকে কিন্তু বলে মহেন্দ্র আসলে অশোকের ভাই। আর সংঘমিত্রা মহেন্দ্রর স্ত্রী। উনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন এমন কথা আমি কোথায় পেলাম। আমি ইতিহাস বই খুলে দেখিয়ে দিলাম যে সেখানে ‘মতান্তরে’ বলে তাদের উভয় পরিচয়ই লিপিবদ্ধ রয়েছে। মানুষটি মন দিয়ে অনুচ্ছেদটি পড়ে মহা খুশী হলেন। এমন খুঁটিয়ে পড়া আর মনে রাখা ছেলে যে কালে কালে বিরাট কিছু হবে সে নিয়ে পূর্ণ নিশ্চয়তা জানিয়ে বিপুল উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। পরবর্ত্তী কালে আমি ইতিহাসবিদ হইনি। ঐ অন্য মতের আরও ব্যপক কোন অনুসন্ধান করিনি। বস্তুত নানা কিছুর সন্ধানে ক্রমাগত দিক বদলে আমার কোন স্মরণীয়, বরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু একটি শিশুর সামান্য কিছু জানাতে একজন বড় মানুষের উচ্ছসিত, প্রত্যয়ী প্রশংসা সেই শিশুটিকে নানা বিষণ্ণ, ভেঙ্গে পড়া সময়ে অন্ধকার নদীর বুকে অনেক নড়বড়ে সাঁকো পার করে দিয়েছে।
সম্ভবতঃ দ্বিতীয় শীতে এক দিন এক কাণ্ড ঘটল। বাবার সহকর্মীদের আমরা ডাকতাম সম্পর্কে জড়িয়ে নিয়ে। সেইরকমই শেখানো হয়েছিল। কাজের জায়গায় পদমর্যাদায় বাবা বড়, কিন্তু বাড়িতে আমাদের কাছে সেই সব কাকু আর পিসীদের অবস্থান ছিল যার যার সম্পর্ক আর আন্তরিকতার মাপকাঠিতে। কেউ কেউ নিয়মিত আসতেন আমাদের বাড়িতে গল্প-আড্ডায়। বাবা বেশী কথার লোক ছিল না। মা-র সাথেই জমিয়ে গল্প হত তাদের। আমাদের সাথেও হত। সেইরকমই একজন, চিত্রাপিসী সেই বিকেলে একটি ছোট আধহাত উচ্চতার সাদা মূর্তি নিয়ে এসে হাজির আমাদের বাড়িতে। সরস্বতী মূর্তি। তার দু-একদিন আগে মা-র সাথে গল্প-আড্ডায় মা-র একটি অপূর্ণ ইচ্ছের কথা পিসী জানতে পেরেছিল। তার ফলেই সেই বিকেলের ঐ উপহার। মা এ উপহার আশা করে নি। আনন্দ পেল, আবার সেই সাথে মহা চিন্তায়ও পড়ে গেল।
মায়ের দুশ্চিন্তা একটুও অমূলক ছিল না। বাবা বাড়ি এসেই অত্যন্ত রেগে গেল
– তুমি জানো, আমি পূজা-আর্চা করি না। তবু তুমি এই মূর্তি ঘরে তুললা?
– আমি কি নিজে এনেছি?
– যে আনছে তারে দিয়া দিবা।
– আমি কেন দিতে যাব? তোমার নিজের অফিসের লোক, তুমি দিয়া দিও। বচ্ছরকার দিনে বাড়িতে মূর্তি নিজে এল। আর তুমি তারে বিদায় করে দেবে। ছেলেপিলের ঘর, যা ভাল বোঝ কইরো, আমার কি!
বাবা যতই দোর্দন্ডপ্রতাপ হোক, মা ঠিকই মোক্ষম চালটা চেলে দিত। আর এইবারে ত ঠাকুমাও তার দিকে। ফলে সেই সন্ধ্যায় আমাদের খেলার ঘরটা সেজে উঠল অপরূপ সাজে। ট্রাঙ্ক থেকে একটি অপূর্ব চাঁদোয়া বার করে এনে মুর্তির মাথার উপর টাঙ্গানো হল। অনেকগুলি রঙিন পুরনো কাপড়ের ছয়কোনা টুকরো একটির পর একটি, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে-কোনাকুনি, পাশাপাশি সেলাই করে মায়ের নিজের বানানো সেই অনুপম শিল্পকর্মটি এখনো দেখতে পাই, অমন করেই টাঙ্গানো আছে, ঐ ঘরটিতেই। কাছের দোকান থেকে বাবা সন্ধ্যা নাগাদ নিয়ে এল নানা নানা রং-এর ঘুড়ি বানানোর কাগজ। কিন্তু আজ তাদের দিয়ে ঘুড়ি নয়, অন্য কিছু বানানো হবে। তারপর হ্যাজাকের আলো জ্বলল। আর সেই সব কাগজ কেটে তৈরী হল – শিকল, মালা, ফুল, ফুলের ঝাড়, আলপনা – কত কি। দোকান থেকে কাগজ ছাড়াও এসেছিল খাগ-এর কাঠি। তাই কেটে কলম তৈরী হল। খালি হওয়া কালির শিশিতে রাখা দুধের কালিতে ডুবিয়ে খাগের কলম দিয়ে পূজার পরের ভোরে লেখা হবে, কলাপাতায় – ব্রাহ্মীতু ভারতী ভাষা … …।
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পূজার জায়গা সাজানোর কাজ চলার সময় বাবাকে পেলাম খুব কাছে থেকে। কাগজ কাটার কারিগরি শেখাতে শেখাতে অল্প কথার মানুষ বাবা সেদিন অনেক গল্প করেছিল –
– ঈশ্বরকে ডাকতে পূজা করতে লাগে না। পূজা-আর্চা ত দেখনদারি।
– কেন?
– ঈশ্বর ত নিজের মনের মধ্যে। আমি তারে নিজের মনে ডাকি। তাকে ডাকতে গেলে অন্যান্যদের দেখিয়ে ডাকতে হবে কেন?
– তা হলে তুমি যে এখন পূজা করবার জন্য এসব করছ?
– না করলে তোমাদের মা কষ্ট পাবে। সবাই পূজা করে, তারও ইচ্ছা করে আর কি। এতদিন রাজী হই নাই। এইবার আর পারা গেল না। সংসার করলে নানা কিছুই মানতে লাগে।
– আচ্ছা বাবা?
– বলো
– ঈশ্বর-কে কি ডাকতেই হবে?
– নাঃ! লোকজন ঈশ্বর-কে ডাকে মনের মধ্যে জোর পাওয়ার জন্য, কি, মন শান্ত করার জন্য; কোনও সময় গভীর দুঃখে সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য। যে ঈশ্বর-এর সাহায্য ছাড়াই সেটা করে ফেলতে পারে তার আর ঈশ্বররে ডাকতে লাগে না।
– তুমি ডাকো?
– ডাকি। আমি সাধারণ মানুষ, নিজের মনে ডাকি। তা বলে তোমারও ডাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
– ঈশ্বরকে না ডাকা কি পাপ?
– ঐগুলা প্রচার। দুনিয়ায় ঈশ্বররে ডাকার নামে যত পাপ হইছে সেইগুলারে ঢাকা দেয়ার জন্য তারা এই প্রচারডা চালায়। আসল পূজা কি জান? জ্ঞানের পূজা। আমি আর তোমারে কতটুকু বলতে পারব। বই থেকে জানবা। বই পড়বা। সব রকম বই পড়বা।
আরও কিছু কথা হয়েছিল যা আজ আর মনে নেই। আজ শুধু এইটুকুই মনে পড়ে যে সেই রাতেই আমার সূচনা হয়েছিল জিজ্ঞাসার আলো হাতে আঁধারের যাত্রীদলের সঙ্গী হয়ে যাওয়া।
উত্তরবঙ্গের জীবনে বইয়ের যোগান বিশেষ না জুটলেও জীবনের পরবর্ত্তী পর্যায়ে সেই অভাব পূরণ হয়ে গিয়েছিল। বই জুটিয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করে দেওয়ার ব্যাপারে আমার কোনদিন কোনরকম লজ্জা বা দ্বিধার বালাই ছিলনা। যে বাড়িতে যখন যেতাম, হাতের কাছে যা বই পেতাম, টেনে নিয়ে পড়তে বসে যেতাম। বইয়ের মালিকেরাও এ কাজে অপার প্রশ্রয় দিতেন। তবে তাদের কেউ কেঊ যখন আমার এই পাঠ-প্রীতিকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে পাঠে অনিচ্ছুক বাচ্চাদের লজ্জিত করার চেষ্টা করতেন সেইটা কিছুটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠত।
বইয়ের ব্যাপারে আমার কোন বাছ-বিচার ছিল না। বস্তুত বিভিন্ন বাড়িতে বিভিন্ন বয়সে যে সমস্ত বই পড়েছি সেগুলি অন্য কোন কোন বাড়িতে সেই সময় আমার বয়সী পাঠকের জন্য নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হওয়ার মত ছিল। আমাদের বাড়িতে সব রকম বইয়ের প্রবেশ ছিল অবাধ, বাবা-মা দুজনকেই বিভিন্ন সময় বলতে শুনেছি, বই পড়ে কেঊ নষ্ট হয়না। নষ্ট হওয়া বলতে ঠিক কী বোঝায় সেই নিয়ে এক লপ্তে কোন বিশদ আলোচনা কখনও হয়নি, মোটের উপর ধারণা দেওয়া ছিল যে পরীক্ষায় ফেল করা, লোকজনের ক্ষতি করা, চুরি করা, গালি দেওয়া, সময়মত বাড়ি না ফেরা, বড়দের সাথে তাদের বিনা অনুমতিতে তর্ক করা এইগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রধান প্রধান লক্ষণ। আর নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হয় পরীক্ষায় ফেল করা দিয়ে। তাই বই পড়ার ক্ষেত্রে একটিই শর্ত ছিল, স্কুলের বাধ্যতামূলক পড়ার বইগুলি পড়ায় ঘাটতি হওয়া চলবেনা।
পরীক্ষায় ফল ভালই হত। ফলে বৎসরান্তে স্কুল থেকে কয়েকটা বই পাওয়া যেত, বয়সোপযোগী বলে বিবেচিত, একেবারে নিজের করে – বার্ষিক পরীক্ষায় আর বার্ষিক উৎসবে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সুবাদে।
এর মধ্যে একদিন বাবা একটা বই কিনে দিল। সেই সময়ের পাঠের অভিজ্ঞতায় বেশ মোটা বই – অথচ একটাই গল্প। বাবা জানাল, একে বলে উপন্যাস। অসাধারণ লেখার ধরণ। জমজমাট গল্প। ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, আজকের বলিউডি চলচ্চিত্রের আদিকালের সংস্করণ প্রায়। কিন্তু গল্পটা কেমন যেন! লেখা পড়তে পড়তে রীতিমত আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলাম। অথচ কি রকম এক, সমস্ত গুলিয়ে দেওয়া পরিণতিতে ঠেলে দেয়া হল পড়ুয়াকে। স্বাধীনতার আন্দোলনের কথা বলবে বলে মনে হয়েছিল। তার বদলে গল্প শেষ হল ইংরেজদেরকেই দেশের দায়িত্ব নিতে বলে আর মুসলমানদের সমস্ত দোষের জন্য দায়ী করে। দয়ী করার ভাষাও ভাল লাগলনা। প্রায় রাত জেগে পড়া শেষ করে ছুটির সকালে ধরলাম বাবাকে, কেন এরকম করলেন লেখক, মানে কি হল এর। বাবা বলল, লেখক ইংরেজের প্রশাসনে বড় পদে কাজ করতেন। ইংরেজ-এর হাত থেকে বাঁচতে সে লোক নাকি ঐরকম কায়দা করেছিল। আর তাতে কাজও হয়েছিল। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জেলে যাননি কি চাকরি থেকে ছাঁটাই হননি। অথচ এই বইয়ে লেখা গান গেয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনের সৈনিকেরা প্রাণ বলিদান দিয়েছে। আমার মুখ দেখে বাবা বুঝল যে উত্তরটায় আমি খুশী হইনি। স্বীকার গেল যে ওনার মত শক্তিধর লেখক কাজটা সম্ভবত অন্য ভাবেও করতে পারতেন; এইভাবে করাটা, ভাল করেননি। তবে বাবার সাথে আমিও একমত হলাম যে ঐ বইয়ের ভাষা, গল্প বলার কায়দা এগুলো আমার জন্য নূতন অভিজ্ঞতা ছিল, শেখার মত ছিল। সম্ভবত এই পাঠ থেকেই আমার, বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশের জন্য নয়, নিজের বোধের প্রেক্ষিতে ‘ক্রিটিকাল রিভিউয়ের’ অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
দিন গড়াতে গড়াতে উত্তরবঙ্গ বাসের কালে আমার শেষ দুর্গাপূজা দেখার সময় এসে গেল। খানিকটা বড় হয়েছি, উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। একা একাই অনেকটা দূর ঘুরে আসি। সপ্তমীর দুপুরে প্যান্ডেলে গিয়ে হাজির হয়েছি। কাছাকাছি কেউ নেই সেই তখন। ঢাকীরাও কোথাও একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আমি গোটা প্যান্ডেল জুড়ে ঘুরে বেড়ালাম। এক সময় চুপি চুপি বাঁশের বেড়া গলে মূর্তি যেখানে আছে সেই অংশে হাজির হলাম। ছোটদের কারও যাওয়া নিষেধ সেখানে। কি তীব্রভাবে যে বিশ্রী লাগার অনুভূতি হল! সামনে থেকে দেখতে অত সুন্দর! আর আড়ালে এই দশা – মাটি, কাঠ, খড়, রং নেই কোন, একেবারে উল্টো ছবি! বছর তিনেক আগে একবার একঝলক দেখে এতটা ধাক্কা খাইনি। এবার ভাল ভাবে জানা হল। দৃশ্যটা মনে বসে গেল।
কাছে গেলে দেবতার, খসে পড়ে আংরাখা। আলো-ঝলমল অপরূপ রূপের আড়ালে – ঢাকা থাকে মাটি কাঠ খড়! ভ্রান্তিবিলাস পার করে অপার গরিমা জলে ভেসে চলে যায় – নিঃশেষে, আঁধারে।