কুচবিহারে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি ছিল বিভিন্ন মেলায় যাওয়ার। প্রত্যেক মেলাতেই কিছু না কিছু খেলনা কেনা হত। একবার কর্কের ছিপির গুলি ছোঁড়ার একটা এয়ারগান কেনা হল। ঠিক মত ব্যবহার করতে না পারলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় হিসাবে এই ধরণের খেলনাগুলোয় আমার অগ্রাধিকার থাকত। আমার পরেই মেজভাইও প্রায় সমান সমান খেলার সু্যোগ পেত। সমস্যা হত সবচেয়ে ছোটটিকে নিয়ে। তাকে কি করে আমাদের সমান যোগ্যতার ভাবা যায়! অথচ, ঠিক সেইটিই তার দাবি। এবং, অবশেষে সমঝোতা করতেই হত। তা না হলে তিনজনেরই ক্ষতি।
এই রকমই এক মেলায় গিয়ে কিনেছিলাম তিন আয়নাভরা নলের ক্যালিডোস্কোপ। খেলনাটা একটু করে ঘোরালেই তার ভিতরের অপূর্ব নক্সাদার ছবিটা টুক করে পাল্টে যায়, ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকে। পুরানো ছবি আর ফিরত না। জীবনের ক্যালিডোস্কোপেও ফেরে না। নানা টুকরো ছবির গড়ে ওঠা নকশায় পার হয়ে আসা জীবনকে দেখে নিই, যতটা পারি, যতটা মনে পড়ে।
দমদম ক্যান্টনমেন্টের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ছিল দত্তপুকুরে মামাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া। বেশির ভাগ সময় মায়ের সাথে আমরা তিন ভাই, কখনও কখনও বাবাও থাকত সাথে। মাত্রই কয়েকটা স্টেশান, কিন্তু আমার মনে হত, চলেছি ত চলেইছি। সেই যাত্রার যে কয়েকটি ছবি মনে পড়ে, গাড়ি ফাঁকা হোক কি ভীড়, মা সবচেয়ে ছোট ভাইটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মনে হয় সীট ফাঁকা না থাকলে কেউ না কেউ উঠে গিয়ে মাকে জায়গা ছেড়ে দিতেন। আমরা বড় আর মেজ দুই ভাই দুই সারি সীটের মাঝখান দিয়ে জানালার পাশে চলে যেতাম। বসে থাকা যাত্রীরা জায়গা করে দিতেন। বিনিময়ে তাদের কেউ না কেউ কথাবার্তা শুরু করে দিতেন। আমাদের কাছে কেউ অপরিচিত ছিলেন না। ‘স্ট্রেঞ্জার’-ধারণাটির সাথে আমাদের বা আমাদের অভিভাবকদের তখনও পরিচয় ঘটেনি। বিপরীতে যেই বাগধারাগুলিকে আমি শৈশবের দূরতম বিন্দুটি পর্যন্ত দেখতে পাই, তার একটি হচ্ছে, বসুধৈব কুটুম্বকম, এই দুনিয়ার সবাই আমার আত্মীয়। সহযাত্রীদের সাথে গল্প করতে করতে, মানে তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, একটা-দুটো ছড়া শোনাতে শোনাতে দত্তপুকুর স্টেশান এসে যেত। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশানের বাইরে এসে যেমন দরকার, একটি বা দুটি রিক্সায় সওয়ার হয়ে যেতাম। স্টেশনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আমরা একটি আধা-শহর, আধা-গ্রাম জীবনের দিকে এগিয়ে যেতাম। পরবর্তীকালে পরিচিত হওয়া কল্পবিজ্ঞানের ধারণায় যেন বা একটি ছবির ভিতর দিয়ে একটু অন্য রকমের একটি জগতে ঢুকে যাওয়া। তারপর কয়েকটি দিন আনন্দের জোয়ারে কাটিয়ে আবার রিক্সা-ট্রেন, নিজের পাড়া, রোজকার জগৎ।
উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝে গেলাম এইবারে এক সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়ায় এসে হাজির হয়েছি। এবং এখান থেকে আর আগের জগতে ফিরে যাওয়ার কথা বড়োরা কেউ ভাবছে না। মন বসাতে সময় লেগেছিল। তারপর একটু একটু করে সেই নতুন জগৎ আমায় ঘিরে নিল।
আমাদের পাশের বাড়িতে একটি চমৎকার কুল গাছ ছিল। দুই বাড়ির মাঝে যে বেড়া ছিল, বাড়ির বাচ্চাদের সুকীর্তির ফলে মাঝে মাঝেই সেটার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বলে কিছু থাকত না। একদিন বেড়ার ফাঁক গলে ওপারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফলভরা কুল গাছ। গাছের সামনে মানুষ-জন। আমায় যে প্রশ্ন করা হল আমি তার অর্থ বুঝলেও নিশ্চিত হতে পারলাম না, চুপ করে থাকলাম। তারা আর আমায় বিব্রত না করে আঁজলা ভরে কুল দিয়ে দিল। আমি বাড়ি ফিরে এসে ঠাকুমার কাছে হাজির হতেই ঠাকুমা বলল
– হাতে কি আনছ, কুল?
– মনে ত হয়। কিন্তু, ওরা বলল বড়ই।
ঠাকুমা একগাল হেসে বলল,
– একঅই কথা।
বুঝতে পারলাম না ‘বড়ই’ শব্দটা ঠাকুমার আগেই জানা ছিল কি না। নাকি প্রতিবেশীদের সাথে গপ্পো-গাছা করার সময় জেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি শব্দটা শিখে গেলাম।
একদিন ঠাকুমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হলাম এক পাড়ায়। সমস্ত বাড়িগুলি মাটির উঁচু ভিতের উপর টালির চাল মাথায় ধরা মাটির দেয়ালে গড়া। আমার প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার সেই ভিতে থাক কেটে বানানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঠাকুমা গল্প জুড়ে বসল। আমার জন্য মুড়ি এল। ঠাকুমা এবং সমবেত মহিলারা আসর জমালেন পান-খয়ের-সুপারির। কিন্তু সেই সুপারি আমাদের বাড়িতে দেখা শুকনো সুপারি নয়। কাঁচা সুপারি। আর তাকে সুপারি বলেও না তারা, বলে – গুয়া। এক বিশেষ গন্ধ আছে তার। ছোটদের খেতে নেই তবে আমি চাইলে এই এত্তটুকু এক কুচি মুখে নিয়ে দেখতে পারি, রস গেলা চলবে না। আমি একবার দাঁতে কেটে আর মুখে রাখার উৎসাহ পাইনি। সেদিনের সেই আড্ডায় অংশ নেওয়া মহিলারা বাংলা ভাষাতেই গল্প করেছিলেন, কিন্তু ঠাকুমার একেবারে গা ঘেঁষে বসেও সেই সব আলাপের বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারিনি, বেশ কিছু অচেনা শব্দ ছিল আর চেনা কথারও সুর অচেনা ছিল।
আস্তে আস্তে এই রকমের অনেক শব্দের সাথে পরিচয় ঘটে গিয়েছিল যাদের অনেককেই আজ আর মনে পড়ে না। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর আমার জীবনচর্যা থেকে এরা হারিয়ে গিয়েছে। বছর দশেক আগে সেই সময়ে অনলাইন লেখকদের জমজমাট সাহিত্য আড্ডার সমাবেশ ‘সচলায়তন’-এ, জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম.-এর পোস্ট “আমাদের ভোটবর্মী ঋণ”-এ এই শব্দদের অনেককে ফিরে পেয়েছিলাম। অনেক কৃতজ্ঞতা তাঁকে। এই লেখাটির মধ্যে কোচদের থেকে আসা শব্দগুলিকে পড়ে মনে হয়েছিল পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল।
ঠাকুমাও হয়ত এই উত্তরবঙ্গের জীবনে ফিরে পেয়েছিলেন পুরনো বন্ধুকে, তাঁর আবাল্য পরিচিত ভাষাকে। বহুকাল বাদে তিনি যেন কথা বলার স্ফুর্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনিতে আমার বাবা এবং ঠাকুমা বেশী কথা বলার মানুষ ছিলেন না। কিন্তু কোচবিহার বসবাসের ঐ তিন বছরে ঠাকুমাকে তার চারপাশের মানুষদের সাথে অনেক বেশী গল্প করতে দেখেছি।
এমন হতে পারে যে সেখানে তিনি বেশ কিছু মানুষ পেয়েছিলেন যাঁদের সাথে তাঁর প্রাক-উদ্বাস্তুজীবনের মানুষদের জীবনচর্যার নানা মিল ছিল। আত্মীয়তার একটা টান অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই টানের মধ্যে ভাষার টান-ও হয়ত একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
টান এক মজার অনুভূতি। যে তিন বছর উত্তরবঙ্গে ছিলাম, যখন তখন ভাবতাম কবে আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের ভাড়াবাড়ির ঘরে ফিরব। আর উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর থেকে কি যে এক চোরাটান ছেয়ে থেকে অস্তিত্ব জুড়ে – সেই তোর্সাতীর-এর জন্য!
অরণ্যষষ্ঠীর সকালে মা, আরো প্রতিবেশী কাকি-পিসী-মাসীরা দলবেঁধে নাইতে যেত তোর্সা নদীতে। সাথে নূতন কেনা তালপাতার পাখা, নানা রকম গোটা ফল, দুর্বা। আমি আর মেজভাইও যেতাম সাথে। আমরা জলে নামতাম না। মা-মাসীরা সবাই নামত। স্মৃতিজলে নানা ছবি থেকে থেকে ভেসে যায়, খুঁটিনাটি ডুবে যায় হামেশাই। তাই নিশ্চিত করে বলবার দাবি নেই কোন। কেউ কেউ স্নান করার সময়, না কি স্নান শেষে, গোটা আম, হয়ত অন্য ফলও, ছুঁড়ে দিত তোর্সার জলে। আমাদের-ই বয়সী কিছু দামাল ছেলে যারা ঐ সময় সর্বক্ষণ জলেই রয়েছে, ঝাঁপিয়ে ডুব দিয়ে তুলে নিত সেই সব ফল। নদীর সন্তান তারা, নদীতে উৎসর্গের ফলে তাদেরই অধিকার।
স্নান সেরে ঘরে ফিরে মা এক এক করে, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের তিন ভাইয়ের মাথায়, গায়ে ভেজা পাখা দিয়ে বাতাস করে দিত। সে পাখা ধরারও রীতি ছিল। ডাঁটিতে ধরা নয়। পাখা যেন থালা, তাতে ধান, দুর্বা আর গোটা গোটা ফলেরা বসে আছে। মা এক হাতে আঙ্গুলের চাপে সেই ঢেউখেলানো থালাকে ধারণ করে আছে নীচে থেকে, আরেক হাত রেখেছে ফলেদের উপরে যাতে তারা গড়িয়ে না যায়। তারপর সেই থালা উঠছে, নামছে, উঠছে, নামছে, আর বারি-বিন্দু-সিঞ্চিত আশীর্বাদী বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের শরীরে, মননে, শুদ্ধ হয়ে উঠছে তার সন্তানেরা, পূর্ণ হয়ে উঠছে। এই ছবি কি ঠিক এই রকম-ই ছিল? কি এসে যায়! আমার মনে এ ছবি এ ভাবেই আঁকা আছে। সকল আশীর্বাদ-এ আমাদের ভুবন ভরিয়ে দিয়ে জীবন নদীর পাড় ছেড়ে মা চলে গেছে একদিন। আমার কোন ঈশ্বর নেই, কোন প্রার্থনা নেই। শুধু আকাঙ্ক্ষা আছে, মা’র হাতের ঐ ঠান্ডা বাতাস যেন আমায় ঘিরে রাখে, যতদিন আমার স্মৃতি থাকে, যতদিন চেতনা থাকে। যেন শুনতে পাই, প্রায় নিজের ভিতর, নিজের অন্তরাত্মাকে শুনিয়ে আমাদের জন্য বিড়বিড় করছে, ‘বাঁইচ্যা থাকো, বড় হও, মানুষ হও’। বেঁচে আছি, বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে আজকের যুগের মানুষের গড় আয়ুর থেকে এক দশকেরও কম দূরত্বে এসে গেছি। শুধু, কতটুকু যে মানুষ হতে পারলাম!
কুচবিহারে আমাদের জীবন আজকের প্রেক্ষিতে বিচিত্র সব, হয়ত বা প্রান্তিক হতে হতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিল। বিবিধ চর্চার সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশ, নাচুনী এবং সাদামাটা ভিখারী নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের সাধ্যমত প্রণামী/সিধে/প্রাপ্য/ভিক্ষে নিয়ে যেত। তাদের প্রত্যেকের কাছে নিশ্চয়ই মানুষ হওয়ার, মানুষ হিসাবে সফল হওয়ার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বোঝাত। তোমার ছেলে ফুলুস হবে মা। ফুলুস মানে পুলিশ। এই ছিল এক নাচুনীর কাছে মানুষের সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য আকাঙ্খার রূপ। কিছুদিন বাদ দিয়ে দিয়ে আসত সে। এসেই মাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিত। মা এসে দরজা ধরে দাঁড়াত। আমরা ভাইয়েরা মা’র পাশ ঘেঁষে। তারপর সে কয়েক পাক ঘুরে ঘুরে তার নাচ দেখাত। চেহারায়, সাজ-পোষাকে কিছু অন্যরকম ছিল সে। তার নাচও ছিল এমন কিছু রকম যা আগে কখনো দেখিনি, অবশ্য কতটুকুই বা এ দুনিয়ার দেখেছি তখন! পরেও চাক্ষুষ দেখার সুযোগ ঘটেনি। প্রথমবার এই লেখা লিখতে বসে মনে হয়েছিল প্রযুক্তির সাহায্য নিলে কেমন হয়! ইউটিউবে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় পেয়ে গেলাম সেই নাচের ধারার দেখা। রাজবংশী। সে মেয়ে কি তবে নাচত সাইটোল নাচ, আমাদের জন্য ষষ্ঠী ঠাকরুণ কি মনসা দেবীর আশীর্বাদ আবাহন করে? নাচ শেষে মার কাছ থেকে কিছু পেয়ে বারে বারে দু’হাত তুলে সে প্রার্থনা জানাত তার ঈশ্বরের কাছে মা’র সন্তানদের সাফল্য কামনা করে। কিন্তু কেন সে পুলিশকেই জানত সর্বোচ্চ ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু হিসেবে? পুলিশ কি তাদের জীবনে ছিল কোন ভয়ানক নিয়ন্তার ভূমিকায়, তাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত নিয়ামক? হয়ত সমাজ তখনো অনেক সরল ছিল, ক্ষমতার আরো আধুনিক দাবীদার-রা হাজির হয়নি তখনো, অন্তত তাদের রোজকার জীবনে তাদের ছায়া এসে পড়েনি।
এদের প্রত্যেকের নিজস্ব হাঁক-ডাক-সুর ছিল তাদের অস্তিত্বের, তাদের উপস্থিতির জানান দেওয়ার জন্য। নিয়মিত সময়ে এদের কারো কারো দেখা না পেলে মা-ঠাকুমা-পাড়ার বয়স্করা উদ্বিগ্ন হত, কিছু হল কিনা কে জানে! ফিরে এলে খোঁজ নিত, আসেনি কেন এতদিন? আমাদের ছোটদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের ছিল ডুগডুগি আর বাঁশির আওয়াজ। প্রথমটি যার কাছ থেকে শোনা যেত তার সঙ্গে থাকত গলায় বা কোমরে দড়ি বাঁধা অন্তত দুটি বাঁদর এবং অনেক সময় আরেকটি বাঁদর বা টিয়া অথবা একটি ছোট ভালুক। আর দ্বিতীয় জনের সাথে থাকত বাঁকের দুপাশে ঝোলান, ঢাকনা-বন্ধ সাত-আটটি নানা মাপের বেতের ঝুড়ি, যাদের ভিতরে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে ফণাধর ও ফণাহীন সাপেরা। অসহায় প্রাণীগুলির বন্দিত্বের বিনিময়ে আমাদের বিনোদনে যে নিষ্ঠুরতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেটা বোঝার মত বয়স তখনো আসেনি। আমরা বড় হতে হতে এই পেশাগুলি যে বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষ হয়ে ওঠার সামাজিক প্রক্রিয়ায় তার অংশভাগী হতে পেরে, ভালো লাগে। আবার ঐ পেশাগুলিতে যুক্ত মানুষেরা পাল্টে যাওয়া দিনে নিজের এবং পরিবার পরিজনদের বাঁচিয়ে রাখার কোন সুষ্ঠু উপায় পেয়েছিলেন এমন নিশ্চয়তার সন্ধান না থাকায় বিষণ্ণ বোধ করি।
তার কাজে তার জেলার উচ্চ আধিকারিক হিসাবে উত্তরবঙ্গের সেই দিনগুলোতে বাবার জীবন অনেক জটিলতার আবর্তে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা তিন ভাই তার আঁচ তেমন করে টের পাইনি। আমরা আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছিলাম সেই না-শহর-না-গ্রাম-এর সহজ জীবনে। কলার ঝাড় কি কচুর বন কি ছাইয়ের গাদা – টপকে টপকে আমরা চলে যেতাম পাড়ার এ মাথা থেকে ও মাথা, এ বাড়ি ও বাড়ির উঠান পেরিয়ে। কোন উঠানে ধানের মরাই, ধান মাড়ানোর ঢেঁকি, আচার শুকাচ্ছে কোথাও, লম্বা কাপড়ের টুকরাতে বড়ি। কোন উঠানে শসার মাচা, কারো ঘরের টালির চালে পুরুষ্টু লাউয়ের ভরা সংসার, কারো ঘরের পাশটিতে সর্ষে গাছের ফুলে হলুদের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
নিজের হাতে, নিজের বাড়িতে ফুল ফোটানো, ফল ফলানোর আবহে আমাদের বাসার উঠানেও কত কি যে হত! কোথাও নরম হলুদ রং-এর অতসী ফুল। আবার কোথাও ফুটে আছে নীল অপরাজিতা কি লাল রং-এর জবা। আর, গাঁদা ফুল-এর দিনে বারান্দার ধার ধরে ধরে উঠান জুড়ে রকমারী গাঁদাফুলের সমারোহে রং-এর বন্যা বইত! কখনো কোন এলাকায় ছোট ছোট, সর্বদা আকাশমুখী চকচকে কাঁচা লংকা, কখনো আবার কোথাও ধনে শাক, সর্ষে। লম্বা লম্বা ঢেঁড়স গাছে কচি কচি ঢেঁড়স। পেঁয়াজকলি এসেছে কোথাও। বিশেষ যত্ন নেওয়া জমিতে লাউ কি কুমড়োর বীজ থেকে গাছ বের হয়ে এসেছে। সে যে কি উত্তেজনার ঘটনা! তারপর সে গাছ যত্ন করে বড় করা। একসময় তাকে এগিয়ে দেওয়া রান্না ঘরের চালে। যাও বাছা, এবার ছড়িয়ে পড়ো মনের আনন্দে। তারপর তাতে ফল ধরে। ফল কাটা হয়, রান্না হয়। কি স্বাদ তার! এ বাড়ির লাউ ও বাড়ি যায়। ও বাড়ির কুমড়ো এ বাড়ি আসে। কোন একটা কি দুটো ফল আবার পাকানো হয় পুরোপুরি যাতে তার থেকে পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় বীজ – পরের ঋতুর জন্য। দু’বাড়ির বেড়ার গায়ে বইছে সীমের লতা, প্রতিবেশীর লাগানো, বইছে দু’পাশেই। ও পাশের ফল তাদের, এ পাশের ফল আমাদের।
প্রথম অঘ্রাণের প্রথম রবিবার সন্ধ্যায় আমাদের পাশের বাড়ির উঠানে গিয়ে জড় হয়েছি। উঠানের মাঝখানে পূজার আয়োজন, নাটাই ব্রত। মেয়েরাই আয়োজক। এ বাড়ি ও বাড়ির কাকি, পিসী, মাসীমারা আর, আমরা – কুচোকাচারা। ব্রতকথা পড়া শুরু হত একসময়। চুপ করে শুনত সবাই। কি ছিল গল্প, এখন মনে পড়ে না। সম্ভবতঃ ফসলের কি জমির দেবতার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে কোন গ্রামীণ লোককথা। ভারী মজার এক খাবার ছিল সে পূজার প্রসাদ-এ। ছোট ছোট পিঠা, চালের। নুন দেওয়া এবং নুন না দেওয়া। পরের রবিবারে আবার ব্রতকথায় হাজির। আজ অন্য ব্রত, সম্ভবতঃ সত্যনারায়ণের। গোটা অঘ্রাণ মাস জুড়ে প্রত্যেক রবিবারে পাল্টে পাল্টে নাটাই আর সত্যনারায়ণ। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর সত্যনারায়ণের দেখা মিললেও নাটাই ব্রতকথার আর দেখা মেলেনি।
আর একটি ব্রতকথাও সামনে থেকে বসে শোনা হয়েছিল সেই সময়, পরবর্তীকালে পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোথাও তার দেখা মেলেনি আমার – মনসাব্রত। আমাদের বাড়ি থেকে একটি কি দুটি বাড়ি পরের প্রতিবেশীর বাড়িতে সাপের দেবির পূজার আয়োজন হয়েছিল। দেবীমূর্তির মাথার চারপাশে একাধিক সাপের ফণার উপস্থিতি মনে ভালই ভয় ধরিয়েছিল।
আমাদের নিজেদের বাড়িতে একটিই পূজা আমার একেবারে ছোটবেলা থেকে মনে করতে পারি – লক্ষ্মীপূজা, প্রতি বৃহস্পতিবার এবং শরতের কোজাগরী পূর্ণিমায়। দ্বিতীয়টি বাবার পৌরহিত্যে হলেও প্রতি সপ্তাহের পূজাটি মা করত এবং সেটি ঐ ব্রতকথাগুলির মতই পাঁচালী পাঠ করে।
সব কটি ব্রতকথাতেই একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল, দেবতাদের যার যতই ক্ষমতা থাক, মানুষের পূজা না পেলে তাদের মর্যাদা নেই। বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন কিছু পেলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু নিয়মিত পূজা করতে না চাওয়া বা ভুলে যাওয়া মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণ বিপদে না ফেলে এবং পূজা করা লোকেদের যাকে যতটুকু দিলে চলবে সেই মত পুরস্কার না দিলে তাদের থেকে ঐ পূজা পাওয়া নিশ্চিত হয় না। বয়স বাড়তে বাড়তে জানতে পারব, ক্ষমতা ধরে রাখার এইটিই মূল পদ্ধতি, দেবতা কি মানুষ যিনিই সেই ক্ষমতা ভোগ করুন। আর এইভাবেই আমাদের, সাধারণ মানুষদের জীবন গড়িয়ে চলে, এক বিপন্নতা থেকে আরেক বিপন্নতা, সাধ্যে কুলোলে কিছু নৈবেদ্য ধরে দেওয়া, যেই দেবতা, যেই ক্ষমতাধর যেমন পূজা দাবি করেন, কিছু প্রাপ্তি, প্রাপ্তির আশা …
ক্রমশ...