কুচবিহারে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি ছিল বিভিন্ন মেলায় যাওয়ার। প্রত্যেক মেলাতেই কিছু না কিছু খেলনা কেনা হত। একবার কর্কের ছিপির গুলি ছোঁড়ার একটা এয়ারগান কেনা হল। ঠিক মত ব্যবহার করতে না পারলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় হিসাবে এই ধরণের খেলনাগুলোয় আমার অগ্রাধিকার থাকত। আমার পরেই মেজভাইও প্রায় সমান সমান খেলার সু্যোগ পেত। সমস্যা হত সবচেয়ে ছোটটিকে নিয়ে। তাকে কি করে আমাদের সমান যোগ্যতার ভাবা যায়! অথচ, ঠিক সেইটিই তার দাবি। এবং, অবশেষে সমঝোতা করতেই হত। তা না হলে তিনজনেরই ক্ষতি।
এই রকমই এক মেলায় গিয়ে কিনেছিলাম তিন আয়নাভরা নলের ক্যালিডোস্কোপ। খেলনাটা একটু করে ঘোরালেই তার ভিতরের অপূর্ব নক্সাদার ছবিটা টুক করে পাল্টে যায়, ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকে। পুরানো ছবি আর ফিরত না। জীবনের ক্যালিডোস্কোপেও ফেরে না। নানা টুকরো ছবির গড়ে ওঠা নকশায় পার হয়ে আসা জীবনকে দেখে নিই, যতটা পারি, যতটা মনে পড়ে।
দমদম ক্যান্টনমেন্টের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ছিল দত্তপুকুরে মামাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া। বেশির ভাগ সময় মায়ের সাথে আমরা তিন ভাই, কখনও কখনও বাবাও থাকত সাথে। মাত্রই কয়েকটা স্টেশান, কিন্তু আমার মনে হত, চলেছি ত চলেইছি। সেই যাত্রার যে কয়েকটি ছবি মনে পড়ে, গাড়ি ফাঁকা হোক কি ভীড়, মা সবচেয়ে ছোট ভাইটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মনে হয় সীট ফাঁকা না থাকলে কেউ না কেউ উঠে গিয়ে মাকে জায়গা ছেড়ে দিতেন। আমরা বড় আর মেজ দুই ভাই দুই সারি সীটের মাঝখান দিয়ে জানালার পাশে চলে যেতাম। বসে থাকা যাত্রীরা জায়গা করে দিতেন। বিনিময়ে তাদের কেউ না কেউ কথাবার্তা শুরু করে দিতেন। আমাদের কাছে কেউ অপরিচিত ছিলেন না। ‘স্ট্রেঞ্জার’-ধারণাটির সাথে আমাদের বা আমাদের অভিভাবকদের তখনও পরিচয় ঘটেনি। বিপরীতে যেই বাগধারাগুলিকে আমি শৈশবের দূরতম বিন্দুটি পর্যন্ত দেখতে পাই, তার একটি হচ্ছে, বসুধৈব কুটুম্বকম, এই দুনিয়ার সবাই আমার আত্মীয়। সহযাত্রীদের সাথে গল্প করতে করতে, মানে তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, একটা-দুটো ছড়া শোনাতে শোনাতে দত্তপুকুর স্টেশান এসে যেত। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশানের বাইরে এসে যেমন দরকার, একটি বা দুটি রিক্সায় সওয়ার হয়ে যেতাম। স্টেশনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আমরা একটি আধা-শহর, আধা-গ্রাম জীবনের দিকে এগিয়ে যেতাম। পরবর্তীকালে পরিচিত হওয়া কল্পবিজ্ঞানের ধারণায় যেন বা একটি ছবির ভিতর দিয়ে একটু অন্য রকমের একটি জগতে ঢুকে যাওয়া। তারপর কয়েকটি দিন আনন্দের জোয়ারে কাটিয়ে আবার রিক্সা-ট্রেন, নিজের পাড়া, রোজকার জগৎ।
উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝে গেলাম এইবারে এক সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়ায় এসে হাজির হয়েছি। এবং এখান থেকে আর আগের জগতে ফিরে যাওয়ার কথা বড়োরা কেউ ভাবছে না। মন বসাতে সময় লেগেছিল। তারপর একটু একটু করে সেই নতুন জগৎ আমায় ঘিরে নিল।
আমাদের পাশের বাড়িতে একটি চমৎকার কুল গাছ ছিল। দুই বাড়ির মাঝে যে বেড়া ছিল, বাড়ির বাচ্চাদের সুকীর্তির ফলে মাঝে মাঝেই সেটার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বলে কিছু থাকত না। একদিন বেড়ার ফাঁক গলে ওপারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফলভরা কুল গাছ। গাছের সামনে মানুষ-জন। আমায় যে প্রশ্ন করা হল আমি তার অর্থ বুঝলেও নিশ্চিত হতে পারলাম না, চুপ করে থাকলাম। তারা আর আমায় বিব্রত না করে আঁজলা ভরে কুল দিয়ে দিল। আমি বাড়ি ফিরে এসে ঠাকুমার কাছে হাজির হতেই ঠাকুমা বলল
– হাতে কি আনছ, কুল?
– মনে ত হয়। কিন্তু, ওরা বলল বড়ই।
ঠাকুমা একগাল হেসে বলল,
– একঅই কথা।
বুঝতে পারলাম না ‘বড়ই’ শব্দটা ঠাকুমার আগেই জানা ছিল কি না। নাকি প্রতিবেশীদের সাথে গপ্পো-গাছা করার সময় জেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি শব্দটা শিখে গেলাম।
একদিন ঠাকুমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হলাম এক পাড়ায়। সমস্ত বাড়িগুলি মাটির উঁচু ভিতের উপর টালির চাল মাথায় ধরা মাটির দেয়ালে গড়া। আমার প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার সেই ভিতে থাক কেটে বানানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঠাকুমা গল্প জুড়ে বসল। আমার জন্য মুড়ি এল। ঠাকুমা এবং সমবেত মহিলারা আসর জমালেন পান-খয়ের-সুপারির। কিন্তু সেই সুপারি আমাদের বাড়িতে দেখা শুকনো সুপারি নয়। কাঁচা সুপারি। আর তাকে সুপারি বলেও না তারা, বলে – গুয়া। এক বিশেষ গন্ধ আছে তার। ছোটদের খেতে নেই তবে আমি চাইলে এই এত্তটুকু এক কুচি মুখে নিয়ে দেখতে পারি, রস গেলা চলবে না। আমি একবার দাঁতে কেটে আর মুখে রাখার উৎসাহ পাইনি। সেদিনের সেই আড্ডায় অংশ নেওয়া মহিলারা বাংলা ভাষাতেই গল্প করেছিলেন, কিন্তু ঠাকুমার একেবারে গা ঘেঁষে বসেও সেই সব আলাপের বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারিনি, বেশ কিছু অচেনা শব্দ ছিল আর চেনা কথারও সুর অচেনা ছিল।
আস্তে আস্তে এই রকমের অনেক শব্দের সাথে পরিচয় ঘটে গিয়েছিল যাদের অনেককেই আজ আর মনে পড়ে না। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর আমার জীবনচর্যা থেকে এরা হারিয়ে গিয়েছে। বছর দশেক আগে সেই সময়ে অনলাইন লেখকদের জমজমাট সাহিত্য আড্ডার সমাবেশ ‘সচলায়তন’-এ, জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম.-এর পোস্ট “আমাদের ভোটবর্মী ঋণ”-এ এই শব্দদের অনেককে ফিরে পেয়েছিলাম। অনেক কৃতজ্ঞতা তাঁকে। এই লেখাটির মধ্যে কোচদের থেকে আসা শব্দগুলিকে পড়ে মনে হয়েছিল পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল।
ঠাকুমাও হয়ত এই উত্তরবঙ্গের জীবনে ফিরে পেয়েছিলেন পুরনো বন্ধুকে, তাঁর আবাল্য পরিচিত ভাষাকে। বহুকাল বাদে তিনি যেন কথা বলার স্ফুর্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনিতে আমার বাবা এবং ঠাকুমা বেশী কথা বলার মানুষ ছিলেন না। কিন্তু কোচবিহার বসবাসের ঐ তিন বছরে ঠাকুমাকে তার চারপাশের মানুষদের সাথে অনেক বেশী গল্প করতে দেখেছি।
এমন হতে পারে যে সেখানে তিনি বেশ কিছু মানুষ পেয়েছিলেন যাঁদের সাথে তাঁর প্রাক-উদ্বাস্তুজীবনের মানুষদের জীবনচর্যার নানা মিল ছিল। আত্মীয়তার একটা টান অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই টানের মধ্যে ভাষার টান-ও হয়ত একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
টান এক মজার অনুভূতি। যে তিন বছর উত্তরবঙ্গে ছিলাম, যখন তখন ভাবতাম কবে আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের ভাড়াবাড়ির ঘরে ফিরব। আর উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর থেকে কি যে এক চোরাটান ছেয়ে থেকে অস্তিত্ব জুড়ে – সেই তোর্সাতীর-এর জন্য!
অরণ্যষষ্ঠীর সকালে মা, আরো প্রতিবেশী কাকি-পিসী-মাসীরা দলবেঁধে নাইতে যেত তোর্সা নদীতে। সাথে নূতন কেনা তালপাতার পাখা, নানা রকম গোটা ফল, দুর্বা। আমি আর মেজভাইও যেতাম সাথে। আমরা জলে নামতাম না। মা-মাসীরা সবাই নামত। স্মৃতিজলে নানা ছবি থেকে থেকে ভেসে যায়, খুঁটিনাটি ডুবে যায় হামেশাই। তাই নিশ্চিত করে বলবার দাবি নেই কোন। কেউ কেউ স্নান করার সময়, না কি স্নান শেষে, গোটা আম, হয়ত অন্য ফলও, ছুঁড়ে দিত তোর্সার জলে। আমাদের-ই বয়সী কিছু দামাল ছেলে যারা ঐ সময় সর্বক্ষণ জলেই রয়েছে, ঝাঁপিয়ে ডুব দিয়ে তুলে নিত সেই সব ফল। নদীর সন্তান তারা, নদীতে উৎসর্গের ফলে তাদেরই অধিকার।
স্নান সেরে ঘরে ফিরে মা এক এক করে, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের তিন ভাইয়ের মাথায়, গায়ে ভেজা পাখা দিয়ে বাতাস করে দিত। সে পাখা ধরারও রীতি ছিল। ডাঁটিতে ধরা নয়। পাখা যেন থালা, তাতে ধান, দুর্বা আর গোটা গোটা ফলেরা বসে আছে। মা এক হাতে আঙ্গুলের চাপে সেই ঢেউখেলানো থালাকে ধারণ করে আছে নীচে থেকে, আরেক হাত রেখেছে ফলেদের উপরে যাতে তারা গড়িয়ে না যায়। তারপর সেই থালা উঠছে, নামছে, উঠছে, নামছে, আর বারি-বিন্দু-সিঞ্চিত আশীর্বাদী বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের শরীরে, মননে, শুদ্ধ হয়ে উঠছে তার সন্তানেরা, পূর্ণ হয়ে উঠছে। এই ছবি কি ঠিক এই রকম-ই ছিল? কি এসে যায়! আমার মনে এ ছবি এ ভাবেই আঁকা আছে। সকল আশীর্বাদ-এ আমাদের ভুবন ভরিয়ে দিয়ে জীবন নদীর পাড় ছেড়ে মা চলে গেছে একদিন। আমার কোন ঈশ্বর নেই, কোন প্রার্থনা নেই। শুধু আকাঙ্ক্ষা আছে, মা’র হাতের ঐ ঠান্ডা বাতাস যেন আমায় ঘিরে রাখে, যতদিন আমার স্মৃতি থাকে, যতদিন চেতনা থাকে। যেন শুনতে পাই, প্রায় নিজের ভিতর, নিজের অন্তরাত্মাকে শুনিয়ে আমাদের জন্য বিড়বিড় করছে, ‘বাঁইচ্যা থাকো, বড় হও, মানুষ হও’। বেঁচে আছি, বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে আজকের যুগের মানুষের গড় আয়ুর থেকে এক দশকেরও কম দূরত্বে এসে গেছি। শুধু, কতটুকু যে মানুষ হতে পারলাম!
কুচবিহারে আমাদের জীবন আজকের প্রেক্ষিতে বিচিত্র সব, ...
ক্রমশ...