কৃবু খবরের কেন্দ্রে আসতেই আবার সেই চিরাচরিত প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে। কতজন লোকে এর ফলে চাকরি হারাতে পারে ? এবিষয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন সবার চাকরি চলে যাবে , তো কেউ বলছেন আরো চাকরি তৈরী হবে। কিন্তু মূল প্রশ্নটা এখনো চোখে পড়েনি। সেই প্রশ্ন খুবই সোজা। আপনি যদি কিছু বেচতে চান , সেটা টাকা দিয়ে কেনার জন্য ক্রেতা থাকতে হবে। পাঁচ টাকার জিনিস দশটাকায় বিক্রি করলে ক্রেতা পেতে অসুবিধা হবার কথা নয় , কিন্তু সেই জিনিস একশো টাকায় বিক্রি করলে কতজন ক্রেতা পাওয়া যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাহলে যদি এত চাকরি চলে যায় , টাকা খরচ করে চারদিকের এত জিনিস কিনবে কে?
আসলে আধুনিক সভ্যতার 'প্রগতি' বলে যা দাবি করা হয় , সবই মূলত টাকা দিয়ে কেনা অপ্রয়োজনীয় জিনিস। বহু জিনিসই নিত্য প্রয়োজনীয় না। যন্ত্রসভ্যতা মানুষকে অনেক ফাঁকা সময় দিয়েছে। সেই সময় উদ্ভাবনী জিনিস বা চিন্তা ভাবনা করার বদলে কর্পোরেশন ব্যবহার করছে বিজ্ঞাপনের কাজে। ইন্টারনেট এখন শুধুই একটা খোলা বাজার যেখানে সবাই কোনো না কোনো জিনিস বেচছে বা কিনছে। গত দশবছরে সামাজিক মাধ্যমগুলি হয়েছে যাপন দেখানোর জায়গা। মানুষকে চাই শুধু একটি স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার জন্য , যেখানে সেইসব সংস্থার মালিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলগোরিদম নিজে থেকেই পনেরো সেকেন্ড বাদে বাদে বিজ্ঞাপন দেখাবে। মানুষটিকে শুধু দরকার এইটুকু বার্তা দেবার জন্য যে তুমি তাড়াতাড়ি স্ক্রোল করে নিজের পছন্দ আমাদের জানিয়ে দাও যাতে আমরা আরো অপ্রয়োজনীয় জিনিস তোমাকে বেচতে থাকি। সে ছমাসের দ্রুতগামী ফ্যাশন হোক বা কনজিউমার ইলেকট্রনিকস বা এফএমসিজি। এতে যে বিক্রেতাদের খুব সুবিধা হয়েছে তা নয় , এখন ইন্টারনেটের মুখ বিজ্ঞাপনে এমনভাবে ঢেকে গেছে যে একশো টাকার পণ্যের জন্য তিনশো টাকা বিপণনে খরচ হয়।
আসল পুঁজিবাদের ধারণা বর্তমানে মৃত। বাজারে 'লেট ক্যাপিটালিজম' বলে একটি শব্দবন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে যা আসলে পুঁজিবাদের অতৃপ্ত আত্মা। এই তত্ত্বের মূল কথা টাকার বর্তমানে কোনও মূল্য নেই। কারণ ধনকুবেরদের সম্পত্তির পরিমাণ বাজারের ওঠানামার সঙ্গে নির্ধারিত হয়। সমস্ত দেশের সরকার বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে এবং অকাতরে টাকা ছাপাচ্ছে। নব্বইয়ের দশক থেকেই শুরু হয়েছে যে লেট ক্যাপিটালিজম তার মূল লক্ষ্য আর্থিক ভোগবাদের হাতবদল বাড়ানো। কোনোকিছুর উদ্ভাবন বা প্রগতি না। আশির দশকের শেষ থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি এক বিরাট বুদ্বুদ , যেখানে ইতিমধ্যেই ২০০০ সালের ডট কম , ২০০৮ সালে আর্থিক বিপর্যয় এবং ২০২০ সালে কোভিডে ক্রমাগত ফেটেছে অথচ একই সঙ্গে আরও বড় আরেকটি বুদ্বুদ গড়ে উঠছে। বর্তমান বুদ্বুদের নাম কৃবু।
কৃবুর উত্থানের পর কাজের জায়গায় দুটি মূল পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা যায়। কলেজ থেকে বেরিয়ে অল্পবয়সীরা যে চাকরি পেত , সেগুলির ৮০ শতাংশ আর থাকবে না বলে আশংকা। আর চাকরি রাখার জন্য লোকে কম বেতনেও কাজ চালাতে বাধ্য হবে। মাঝবয়সীদের চাকরি চলে গেলে তারা আর ই এম আই দিতে পারবে না। কিন্তু নবীনতর প্রজন্ম ‘সাবস্ক্রাইব’ অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তাদের কোনোকিছুরই মালিকানা নেই। গান , সিনেমা থেকে ফ্ল্যাটের আসবাব , গাড়ি থেকে মোবাইল সবই ভাড়ায়। উন্নত দেশগুলিতে এখন এরকম অনেকে আঠেরো বয়সের পরেও বাবা মার সঙ্গে থাকছে, যা ওসব দেশে অকল্পনীয়।
সূত্র : আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০২৩ সালের রিপোর্ট , কৃবুর সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলিতে এই সংখ্যা বাড়বে ?
"ক্যারিয়ার" নামের ধারণাটিও শেষ হয়ে এসেছে। এতদিন ছিল , ধরুন আপনি অংকে স্নাতকোত্তর করলেন তারপর একটি বীমা কোম্পানিতে ছমাস কাজের প্রশিক্ষণ হল , আন্ডাররাইটার হিসেবে যোগ দিলেন , তারপর ধাপে ধাপে প্রমোশন পেয়ে একসময় চল্লিশ বছর বাদে বীমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে , সেই বীমা কোম্পানির আন্ডাররাইটার ডিরেক্টর হয়ে অবসর নিলেন। সেই সম্ভাবনা এখন খুবই কম। বীমা বিশেষজ্ঞ হবে কৃবু , তাকে চালানোর জন্য আপনাকে উমা পাশ বা বড়জোর স্নাতক হলেই চলবে। উচ্চতর ডিগ্রী বা গবেষণাপত্র বা বহুদিন কাজের অভিজ্ঞতা আপনার থাকতেই পারে কিন্তু এতদিন তার জোরে যে আপনি ছয় অংকের বেতন দাবি করতে পারতেন তা আর পারবেন না।
কিন্তু মধ্যবিত্তদের প্রতি , বা যারা পড়াশুনো করে গাড়িঘোড়া চড়তে চায় তাদের প্রতি ওপরতলার এমন অসূয়ার কারণ কি ? মেগা প্রযুক্তির কোম্পানিগুলি স্বৈরতান্ত্রিক। এদের প্রতিষ্ঠাতারা মূলত সবাই স্বেচ্ছায় কলেজ ড্রপআউট। ফলে তাদের মূল লক্ষ্য অত্যন্ত স্পেশালাইজড যারা প্রচুর বেতন দাবি করে সেই কাজগুলিকে স্বয়ংক্রিয় করার চেষ্টা। ইগোর প্রশ্ন।
এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অসাম্য নিয়েও কথা বলা যায়। বিশ্ব অসাম্য ল্যাবের রিপোর্ট অনুযায়ী [১] সমাজকে আয় এবং সম্পত্তির ভিত্তিতে যদি তিনভাগে ভাগ করা যায় - ১০/৪০/৫০ এই অনুপাতে , তাহলে নিচের গ্রাফটা দেখতে পারেন -
প্রথমবার দেখে অসম্ভব মনে হলেও আয়কর দেবার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার পর সরকারী কর্মচারী [বক্সওয়ালা] দের কল্যাণে ৪০% মধ্যবিত্তের আয় উচ্চবিত্ত ১০%র থেকে বেশি ছিল। মধ্যবিত্তের স্বর্ণযুগে এই শ্রেণীর আয় সবথেকে বেশি ছিল জরুরি অবস্থার সময় , সম্ভবত লাইসেন্স রাজ ইত্যাদির কল্যাণে। নব্বইয়ের দশকে খোলাবাজার এবং 'শাইনিং ইন্ডিয়া'র কল্যাণে দেখা যাচ্ছে এই শ্রেণীর আয় কমতে শুরু করে। যদিও মাথায় রাখতে হবে এই সময় সরকারি চাকরি কমে বেসরকারি চাকরি ভারতে ক্রমশ বাড়তে শুরু করে, কিন্তু তথ্যানুযায়ী উচ্চবিত্তের আয় যে পরিমাণ বেড়েছে, সে অনুযায়ী মধ্যবিত্তের আয় বাড়েনি।
আয়করের হিসেব ছাড়াও সম্পত্তির দিকে তাকানো যেতে পারে। স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়েও দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ১৯৮২ পর্যন্ত সমান সমান থাকলেও ১৯৯১ উদারীকরণের পর উচ্চবিত্তের হাতে সম্পদ বাড়তে বাড়তে এখন ~৬০%
অথচ ভারতে অনেক বেশি মানুষের নিজস্ব বাড়ি আছে। ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী নিচের ছবিটা দেখা যেতে পারে -

দেখা যাচ্ছে বিহার ইত্যাদি কৃষিভিত্তিক জায়গায় প্রায় প্রত্যেকেরই বাড়ি আছে। তুলনায় মেগাশহরকেন্দ্রিক এবং শিল্পভিত্তিক রাজ্যগুলিতে নিজস্ব বাসস্থানের সংখ্যা কম , কারণ অনেকেই ভাড়ায় থাকেন। একইভাবে , রাজ্যপিছু নারীদের হাতে কতটা জমি আছে সেটাও দেখা যেতে পারে। সেখানে পবর অবস্থান ভাল না, মাত্র ~৩ শতাংশ।
উন্নত দেশগুলিতে এই নিজস্ব বাড়ি থাকার পরিসংখ্যান ভাল না। তার অন্য এক কারণ আছে। উন্নত দেশগুলিতে আছে অভিবাসী ভিত্তিক এক অর্থনীতি। যেখানে বাকিরা পড়তে , কাজ করতে আসবে। এসে সেই দেশে যারা বাড়ির মালিক তাদের বাড়ি ভাড়া দেবে , খরচ চালাতে পড়ার পাশাপাশি কাজ করবে, অনেকসময় দুটো [হাসল]। অভিবাসীদের আয়ের সবই সাদা বা নীল কলারের কাজের ওপর নির্ভরশীল , চাকরি চলে গেলে ফেরত যেতে হবে দেশে বা বেআইনি অধিবাসী হিসেবে লুকিয়ে বেড়ানো। তাদের বাড়ি কিনতে কিনতে কুড়ি তিরিশ বছর।
বিশ্বের দেশে দেশে জনসংখ্যার ভাড়া বাড়িতে থাকার শতকরা হিসেব। শুধু অভিবাসীরা নন , এমন অনেক দেশ আছে [জাপান ইত্যাদি] যেখানকার ভূমিসন্তানেরাও সারাজীবন ভাড়াবাড়িতে কাটান, সূত্র - [
৩]
যুক্তরাষ্ট্রে যেরকম , বহু বাড়ির মালিক আসলে ব্ল্যাকরক , প্রেটিয়াম পার্টনারদের মত বিনিয়োগ সংস্থাগুলি, বিশদে জানতে গেলে এই অন্তর্তদন্ত রিপোর্ট পড়ে দেখতে পারেন [
৪]
এই রিপোর্টে একটি চমকপ্রদ তথ্য আছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ির বিদেশী ক্রেতার মধ্যে ১০ শতাংশ ভারতীয় নাগরিক। এরা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন না বা চাকরি করেন না। বাড়ি কিনে রেখেছেন। একই রকম ভাবে যেমন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের বড় সংখ্যক বাড়ির মালিক আসলে চীন বা রাশিয়ার ধনকুবেররা।
যেহেতু ভোগের টাকার জন্য চাকরি প্রয়োজন , তাই চাকরি সম্পৃক্ততা কমানোর জন্য অনেকেই ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের কথা বলেন। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে তাও প্রশ্নের মুখে পড়বে কারণ অধিকাংশ কোষাগার ভরে চাকরিরতদের আয়কর এবং তাদের ভোগের ওপর বসানো কর থেকে। এছাড়াও নারী পিছু শিশু জন্মের হার দুইয়ের নিচে নেমে যাবার ফলে বয়স্কদের সংখ্যা এবং অবসরকালীন আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা জটিল কারণ আছে। সেখানেও অভিবাসন বন্ধ হয়ে গেলে সমতা বজায় রাখা যাবে না অথচ অভিবাসনের মূল কারণই হল চাকরি পাবার সুবিধা। চাকরি না থাকলে অভিবাসন হবে না।
ভারতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার নিচের পঞ্চাশ শতাংশকে সাহায্য করার জন্য বহু প্রকল্প চালায়। দারিদ্ররেখা আসলে এক দৈনিক আয়ের সূচক , মাথাপিছু সম্পত্তির সূচক নয়। যারা দিন আনেন দিন খান, সরকার নানা প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে বাজার চালু রাখতে চাইছে। কিন্তু এ রাস্তাও সহজ নয়। শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে জীবন ধারণ এবং সম্পদশালী হওয়া সম্ভব না। এখনো শিল্পকে এক টাকায় জমি , বিপুল করছাড় এসব দেবার পিছনে মূল কারণ হিসেবে দেখাতেই হয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের অঙ্ক। এক টাকায় তৈরী অফিসে শুধুই কৃবু কাজ করলে সেসব শিল্পনীতি প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই মূল লক্ষ্য ১০-৪০-৫০ এই অনুপাত বজায় রাখা নয়। নতুন অনুপাত ২০-৮০। যেখানে ওপরের স্তরের ২০ শতাংশের জন্য নিচের স্তরের ৮০ শতাংশ কাজ করবে। এই কুড়ি শতাংশ মূল ভোক্তা , যারা বাজার সচল রাখবে। এতদিন নিচের পঞ্চাশ শতাংশ যে শিক্ষাব্যবস্থায় ওপরের ৪০ শতাংশে উঠতে পারত , সেই সুযোগ আর থাকবেনা।
অর্থাৎ নিজের স্বার্থের প্রয়োজনেই নতুন পুঁজির লক্ষ হবে কিছু লোককে চাকরি দেওয়া। তারাই চাহিদা তৈরী করে বাজারে নকল ভারসাম্য বজায় রাখবে। এই নতুন পুঁজিবাদ এক অতিকায় দানবীয় যন্ত্র , যার জ্বালানির জন্যই মানুষকে দরকার। নাহলে দেড় লাখের আইফোন বা কুড়ি হাজারের নাইকি এয়ার জর্ডান কে কিনবে ? প্যারাডক্সটি এখানেই লুকিয়ে কারণ জঞ্জাল বেচতে না পারলে কোম্পানিগুলি লাভ করবে কি করে? আর লাভ যদি না করতে পারে , লোককে চাকরি বা বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেবে কি করে ? আর চাকরি না দিতে পারলে জঞ্জাল বেচবে কি করে?
নতুন পুঁজিবাদ আসলে প্রাচীন পৃথিবীর অরোবরোস , সেই সাপ যা অনবরত ল্যাজ থেকে নিজেকেই খেয়ে চলেছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।