"ঈশ্বর আছেন কি?" — বিভিন্ন সম্প্রদায় বা ব্যক্তির থেকে এই প্রশ্নের নানারকম উত্তর পাওয়া যায়। অধিকাংশ মানুষই [১] এ ব্যাপারে নিজের সম্প্রদায়ের মতামতকে নিজের মত হিসেবে গ্রহণ করে। অতীতে—যবে থেকে ঠিকঠাক ইতিহাসের অস্তিত্ব আছে—সকলেই বহু ঈশ্বরে (দেবতায়) বিশ্বাস করতো। ইহুদিরাই প্রথম একটিমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শুরু করে। 'দশটি প্রত্যাদেশ' (Ten Commandments)-এর প্রথমটি (Thou shalt have no gods before me.) যখন প্রচলিত হয়, সে সময় ওটি মেনে চলা ইহুদিদের পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল, কারণ তাদের ধারণা ছিল—বাল, আশটোরথ, দাগন, মোলখ এবং বাকি দেবতারা খুবই দুষ্টু হলেও (কারণ তাঁরা ইহুদিদের শত্রুদের সাহায্য করেন), তাঁরা আগমার্কা আসল দেবতাই বটেন। দেবতাদের 'দুষ্টু' ভাবা থেকে 'নেই' ভাবনায় যেতে যে পদক্ষেপটা নিতে হয়, তা খুবই কঠিন। রাজা চতুর্থ অ্যান্টিওকাস-এর সময়ে ইহুদিদের হেলেনিজ়মে ধর্মান্তরিত [২] করার খুব জোরদার একটা চেষ্টা করা হয়। অ্যান্টিওকাস আদেশ দেন, যে, ইহুদিদের শুয়োরের মাংস খেতে হবে, খৎনা (circumcision) করা বন্ধ করতে হবে আর চান করতে হবে [৩]।
জেরুজ়ালেমের অধিকাংশ ইহুদি এই আদেশের কাছে নতিস্বীকার করে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল প্রবল; অবশেষে ম্যাকাবি-দের নেতৃত্বে ইহুদিরা নিজেদের অদ্ভুত সব নীতি ও প্রথা-পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। একেশ্বরবাদ, যা কিনা এই অ্যান্টিওকাসীয় নিপীড়নের প্রথমদিকে এক অতি ক্ষুদ্র দেশের একটিমাত্র অংশের ধর্মবিশ্বাস ছিল, একসময় খ্রিস্টান ও পরে ইসলাম ধর্মের অংশবিশেষে পরিণত হয় এবং—ভারতবর্ষের পশ্চিমে—গোটা বিশ্বজুড়েই প্রধান বিশ্বাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত থেকে শুরু করে পূর্বদিকে একেশ্বরবাদ বিশেষ সাফল্য পায়নি: হিন্দু ধর্মে অনেক দেবতা, বৌদ্ধ ধর্মের আদিম চেহারায় একটিও দেবতা ছিল না, আর একাদশ শতক থেকে কনফুসিয়ানিজ়মেও ঈশ্বর অনুপস্থিত। তবু, কোনো ধর্মমতের অন্তর্নিহিত সত্য যদি তার জাগতিক সাফল্য থেকেই নির্ণয় করতে হয়, তবে একেশ্বরবাদের পক্ষে পাল্লা বেশ ভারি, কারণ – তার সৈন্যবাহিনী সর্ববৃহৎ, নৌবহরও তাই, ঐশ্বর্য অঢেল। আমাদের এই বর্তমান যুগে এই 'সাফল্যে'র যুক্তিটি যদিও অনেকটাই দুর্বল হয়ে এসেছে। অ-খ্রিস্টান জাপানের আতঙ্ক পরাজিত হয়েছে—সত্য। তবে খ্রিস্টান জগত তার বদলে মুখোমুখি হয়েছে নাস্তিক মস্কো-বাহিনীর, আর পরমাণু বোমা যে শুধু আস্তিক-জগতের পক্ষ নিয়ে এ তর্কের অবসান করবে, এমন আশাও ক্ষীণ। [৪]
তবে, এইভাবে—রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক চশমা দিয়ে—ধর্মমতগুলোকে দেখা এবার বন্ধ করা দরকার।
সেই প্রাচীন গ্রিকদের সময় থেকেই—সময়ের সঙ্গে আরো বেশি সংখ্যায়—চিন্তাশীল মানুষেরা এই আঙ্গিকে ধর্মের সত্যতার বিচার বর্জন করে আসছেন। কিছু মানুষ, সেই সময় থেকেই, বিনা বাক্যব্যয়ে নিজের প্রতিবেশীদের ধর্মমতকে আপন করে না নিয়ে, ভাবার চেষ্টা করেছেন—যুক্তি আর দর্শন এ ব্যাপারে কী বলে? আয়োনিয়া[৫]-র বাণিজ্যনগরীগুলোয়—যে শহরগুলি গ্রিক দর্শনের আঁতুড়ঘর—খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেও মুক্ত-চিন্তকরা বাস করতেন। আধুনিক মুক্তমনাদের তুলনায় তাঁদের কাজটা অনেক সহজ ছিল, কারণ—অলিম্পাস পর্বতের দেবতারা কবিদের অঢেল কল্পনার/অনুপ্রেরণার উৎস হলেও, নিরালম্ব দার্শনিক যুক্তির [৬] সামনে তেনাদের পক্ষে সমর্থন তৈরি করা খুবই কঠিন। অলিম্পিয়ান দেবতারা দু-রকমের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন – লোকায়তভাবে অর্ফিজ়মের (এই ধর্মমতটির কাছে খ্রিস্টান ধর্ম অনেকটাই ঋণী) [৭], আর দার্শনিকভাবে প্লেটোর থেকে; গ্রিকরা তাঁর থেকে দার্শনিক একেশ্বরবাদ পেয়েছিল—যার থেকে ইহুদিদের রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী একেশ্বরবাদের স্বরূপ অনেকটাই আলাদা। গ্রিক দুনিয়া যখন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হয়, তারা নতুন মতবাদটির সঙ্গে প্লেটো-র অধিবিদ্যা [৮] মিলিয়ে ধর্মতত্ত্বের (theology) জন্ম দেয়। সন্ত অগাস্টিনের সময় থেকে আজ অবধি, সমস্ত ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিকের বিশ্বাস—কেবল নিরালম্ব যুক্তির সাহায্যেই এক-ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব। তাঁদের যুক্তিগুলিকে সংকলিত করে আধুনিকতম চেহারাটি দেন সন্ত থমাস অ্যাকুইনাস, ত্রয়োদশ শতকে।
সপ্তদশ শতকে, আধুনিক দর্শনের জন্মের সময়ে, দেকার্তে ও লিবনিজ় এই পুরোনো যুক্তিগুলিকে মাজাঘষা করে চকচকে করে তোলেন। প্রধানত তাঁদের কাজের ফলেই, বৌদ্ধিক জগতে ভক্তি/বিশ্বাসের তখনও কিছু সম্মান ছিল। কিন্তু লক [৯]—নিজে নিশ্চিতভাবে খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও—এই পুরোনো যুক্তিগুলির তাত্ত্বিক ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছিলেন; ফলত, তাঁর বহু অনুগামী—অধিকাংশই ফরাসী—নাস্তিক হয়ে যান। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে এই সমস্ত দার্শনিক যুক্তিগুলি ও তাদের খুঁটিনাটি আমি আপনাদের সামনে আনার চেষ্টা করবো না। আমার মতে, এদের মধ্যে মাত্র একটিই এখনো দার্শনিকদের কাছে কল্কে পায়—মহাজাগতিক যুক্তি/প্রথম কারণ-যুক্তি। এই যুক্তি-মতে – সব ঘটনারই যেহেতু কোনো একটা কারণ আছে, অতএব কোনো একটি মহাজাগতিক 'প্রথম কারণ'বশতই নিশ্চয়ই এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল। যুক্তিটির গোড়ায় গলদ—ঠিক যেমন সেই হাতি আর কচ্ছপের গল্পে ছিল। লোকে বলে (আমি জানিনে তার কতটা সত্যি), এক হিন্দু ঋষি নাকি ভাবতেন, যে পৃথিবীটা একটা হাতির পিঠে রাখা। 'হাতিটা তবে কীসের ওপর দাঁড়িয়ে?' জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, সেটা এক কচ্ছপের পিঠের ওপর দাঁড়ানো। কচ্ছপটা কোথায় দাঁড়ানো জিজ্ঞেস করায় তাঁর উত্তর, 'প্রসঙ্গ বদলাও তো হে, হাঁপিয়ে গেলাম উত্তর দিতে দিতে!' এই গপ্পোটা থেকে মহাজাগতিক যুক্তির অপূর্ণতার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও, পদার্থবিদ্যার যে সব অত্যাধুনিক বইয়ে বলা হয়, যে, ভৌত প্রক্তিয়াগুলিকে সময়ের সঙ্গে পিছনদিকে অনুসরণ করলে দেখা যাবে সেগুলির এক অকস্মাৎ-শুরুয়াৎ হয়েছে—তারাই এ থেকে মহাজাগতিক যুক্তি লাগিয়ে এর পিছনে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ খুঁজে পায়। এর ফলে ব্যাপারস্যাপার কী করে আরো বোধগম্য হল—সেই প্রশ্নটা তারা সন্তর্পণে এড়িয়ে যায়।
কোনো এক সর্বোচ্চ-ধী-র অস্তিত্বের সপক্ষে এই পুরোনো পণ্ডিতি যুক্তিগুলো বর্তমানের অধিকাংশ প্রোটেস্টান্ট ধর্মতাত্ত্বিক পরিত্যাগ করেছেন। তার বদলে যে নব-যুক্তিগুলির অবতারণা করা হয়েছে, আমার চোখে সেগুলি কোনোভাবেই উন্নততর নয়। পুরোনো তক্কোগুলি—খাঁটি ও গভীর চিন্তার ফসল আর তাদের পিছনের যুক্তিগুলো পোক্ত হলে তাদের সিদ্ধান্তগুলিও শক্তপোক্ত হত। আধুনিকতাবাদীদের যুক্তিগুলি অস্বচ্ছ, অথচ সেগুলিকে স্বচ্ছ, নিখুঁত করার কোনো চেষ্টাই আধুনিকদের তরফে দেখা যায় না। বুদ্ধির কাছে আপিলের বদলে, তাঁরা আপিল করেন হৃদয়ের দরবারে। তাঁদের বিরোধীদের তাঁরা 'অযৌক্তিক' বলেন না—বলেন নৈতিকভাবে রিক্ত, গভীর অনুভূতিশূন্য। তবুও, চলুন, আধুনিক যুক্তিগুলির বিশ্লেষণ করে দেখি—তারা আদৌ কিছু প্রমাণ করতে পারে কিনা।
এঁদের একটা খুব প্রিয় যুক্তি আসে বিবর্তন থেকে। দুনিয়া একসময় প্রাণশূন্য ছিল; প্রথম উদ্গত প্রাণ ছিল অতি সাধারণ গঠনের—সবুজ পিচ্ছিল শ্যাওলা-পাঁক আর অন্যান্য আবর্জনা দিয়ে তৈরি। বিবর্তনের ধারায় একসময় তা উন্নীত হল প্রাণী ও উদ্ভিদে এবং সবশেষে—মানুষে। অতএব ধর্মতাত্ত্বিকরা আমাদের আশ্বস্ত করছেন—যে নাটকের অন্তে মানুষ নামের এই চমৎকার জীবটি নায়ক সাব্যস্ত হয়েছে, ওই যুগান্তরব্যাপী ঘোলাটে, পিচ্ছিল শ্যাওলা আসলে তার ভূমিকা বই আর কিছু নয়। আমার মনে হয়, এই ধর্মতাত্ত্বিকরা তাঁদের পরিচিত বৃত্তে মেলামেশার ক্ষেত্রে ভাগ্যবান। ওঁরা মনে হয় হিটলার বা 'বেলসেনের পিশাচ'[১০]-কে তাদের সঠিক গুরুত্ব দিয়ে হিসেবে ধরেননি। যদি এক সর্বশক্তিমান—হাতে আক্ষরিক অর্থেই 'অনন্ত কাল' সময় নিয়ে, লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে এইসব মানুষ তৈরি করার পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তেনার নৈতিক ও নান্দনিক রুচি—অস্বাভাবিক। যাই হোক, ধর্মবিশারদদের মনে কোনো সন্দেহ নেই, যে পরবর্তী বিবর্তনের ফলে আরো বেশি বেশি করে তাঁদের মতো মানুষ জন্মাবে আর ভবিষ্যত-হিটলারদের সংখ্যা ক্রমাগত কমবে। বেশ, আশায় বুক বাঁধি। তবে মনে রাখবেন, এর ছলনে ভুলে, আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতার জমি ত্যাগ করে এমন এক আশাবাদের আশ্রয় নিচ্ছি, যাকে ইতিহাস কোনোমতে সমর্থন করে না।
এই 'বিবর্তনবাদী' আশাবাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য আপত্তিও আছে। জাগতিক ইতিহাসের ধারার ওপর ভর করে দাঁড়ানো এই আশাবাদ নেহাতই ক্ষণস্থায়ী, তার পরিধিও সীমিত; কারণ—সব যুক্তিই নির্দেশ করে—আমাদের এই গ্রহে অনন্তকাল ধরে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না। অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে প্রাণের অস্তিত্ব অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু, যদি থাকেও, তার সম্পর্কে আমরা কিচ্ছুটি জানি না এবং এমন ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই, যে, সেই প্রাণের সঙ্গে হিটলারের মিল কম আর আমাদের ন্যায়পরায়ণ ধর্মতাত্ত্বিকদের মিল বেশি হবে। মহাবিশ্বের এক অতি সঙ্কীর্ণ, নগণ্য মোড় আমাদের এই পৃথিবী; এমনকি সৌরজগতেরই এক ছোট্ট টুকরোমাত্র। সৌরজগত আবার আকাশগঙ্গার (আমাদের ছায়াপথ) এক ক্ষুদ্র অংশ—যা কিনা নিজে, বহু কোটি ছায়াপথের (আধুনিক দূরবীনদের সাহায্যে যাদের খুঁজে পাওয়া গেছে) এক সাধারণ সদস্য। মহাজগতের এই পুঁচকে, তুচ্ছ পাড়ায়, দুই দীর্ঘ প্রাণহীন সময়কালের মধ্যে এক সীমিত বিরতি চলছে। সেই বিরতিরও এক সামান্য অংশে এখানে আছে—মানুষ। মহাবিশ্বের উদ্দেশ্যই যদি মানবজাতির উদ্ভব হয়ে থাকে, তবে তার জন্যে এটা একটা বিচ্ছিরিরকম লম্বা, অপ্রয়োজনীয় ভূমিকা নয়? যেন এক নীরস বৃদ্ধের মুখে শোনা তার জীবনের এক অশেষ, ঝিমোনো, সাধারণ অভিজ্ঞতার গল্প শোনা, যার শেষে সামান্য কিছু একটা হয়। এমন একখান তুলনা টানার ফলে ধর্মতাত্ত্বিকদের ভক্তির প্রতি খুব একটা সুবিচার করা হয় না বলেই মনে হয়।
আমাদের গ্রহটির প্রতি অন্যায্য পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করার এই ভুল—সর্বকালের ধর্মতাত্ত্বিকরাই করে এসেছেন। কোপার্নিকাসের আগের পৃথিবীতে এই—গোটা মহাকাশ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে—ভাবনা নিতান্তই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু কোপার্নিকাসের সময় থেকে, বিশেষ করে মহাবিশ্বের সুদূর অঞ্চলগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার সাম্প্রতিক চেষ্টার পর—পৃথিবীর প্রতি এই অহৈতুকী ভক্তি নেহাতই সংকীর্ণ ধার্মিক বোধের ফলাফল। যদি মহাবিশ্বের কোনো নির্মাতা থাকতো, আমাদের এই প্রান্তবাসী ক্ষুদ্র জনপদটির জন্যে তাঁর প্রাণ আলাদা করে কাঁদছে—এমন ভাবা সত্যিই অযৌক্তিক। আর, যদি সত্যিই আমাদের বিশেষ কোনো গুরুত্ব না থেকে থাকে, তবে আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে তাঁরটি খুব সম্ভবত আলাদা—কারণ মহাবিশ্বের অধিকাংশ অংশেই প্রাণের উদ্ভব অসম্ভব।
ঈশ্বরে বিশ্বাস করার একটি নৈতিক যুক্তিও আছে—প্রচার করেছিলেন উইলিয়াম জেমস। এই মত অনুসারে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা উচিত, কারণ—সারাদিন যেন মোরা ভালো হয়ে চলি। এই যুক্তির বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান আপত্তি—এ দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হয় না, বড় জোর প্রমাণ হয়: ঈশ্বর যে আছেন, সেটা সাধারণ মানুষকে বোঝানো রাজনীতিক আর শিক্ষকদের কর্তব্য। এমন করা উচিত কিনা – তা ধর্মতত্ত্বের প্রশ্ন নয়, রাজনীতির প্রশ্ন। এই যুক্তিটি সেই শ্রেণীর তক্কো, যারা বলে: শিশুদের শেখানো উচিত—জাতীয় পতাকাকে সম্মান করতে হয়। ঈশ্বরে বিশ্বাস— উপকারী: শুধুমাত্র এই যুক্তি কোনো সত্যিকারের ধার্মিক মনোবৃত্তির ব্যক্তির পক্ষে যথেষ্ট নয়, কারণ তিনি তো জানতে চাইবেন—ঈশ্বর সত্যিই আছেন কিনা! ঈশ্বর আছেন কিনা, আর ঈশ্বরে বিশ্বাস স্বাস্থ্যকর কিনা – এই দুটি প্রশ্নকে এক করে দেখা নেহাত আহাম্মকি। নার্সারি ক্লাসে সান্তা ক্লজ়ে বিশ্বাস হয়তো কার্যকর, কিন্তু সেই কারণই যদি যথেষ্ট হত, তবে বড়রাও সান্তায় বিশ্বাস করতো।
আমাদের রাজনীতি নিয়ে মাথাব্যথা নেই, অতএব এইটুকুতেই আমরা এই নৈতিক যুক্তিটি খণ্ডিত হয়ে গেছে বলে ধরে নিতে পারতাম, কিন্তু এ নিয়ে আরও একটু আলোচনা হলে আখেরে ক্ষতি নেই। প্রথমত, ঈশ্বরে বিশ্বাস করার আদৌ কোনো শুভ নৈতিক প্রভাব আছে কিনা—তা নিয়ে আমি সন্দিহান। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলির অনেকেই অবিশ্বাসী ছিলেন। জন স্টুয়ার্ট মিল একটি উদাহরণ। সেই সঙ্গেই, ইতিহাসের ঘৃণ্যতম চরিত্রগুলির অনেকেই বিশ্বাসী ছিল—এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। অষ্টম হেনরি একটা ভাল উদাহরণ হতে পারে।
সে যাই হোক—আসল কথা হল, রাষ্ট্র যখন কোনো মতামতকে, তার সত্যতার নয়, বরং তার উপযোগিতার ভিত্তিতে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে, তখন তার ফলাফল সর্বদা ভয়ঙ্কর। যে মুহূর্তে এমন করা হয়, সেই মুহূর্ত থেকে এর বিরুদ্ধাচারী সব মতামতকে রুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়, আর তরুণদের মধ্যে যাতে "বিপজ্জনক চিন্তাভাবনা"-র প্রসার না ঘটে, তাই তাদের চিন্তা করার ওপরই প্রহরা চাপানোর দরকার পড়ে। ঠিক এইরকম অসদাচরণ যখন সোভিয়েত রাশিয়ায় 'ধর্মের বিরুদ্ধে' করা হয়, তখন ধর্মতাত্ত্বিকরা দিব্যি তার খারাপ চরিত্র অনুধাবন করতে পারেন, কিন্তু সমস্যা হল, তাঁরা যে মতামতগুলিকে শুভ মনে করেন—তার পক্ষ নিয়ে এমনটা করা হলে, রাষ্ট্রের তরফে সেই আচরণও কদাচারই থাকে। চিন্তার স্বাধীনতা আর তথ্যপ্রমাণকে গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যেস – যেকোনো সাপ-ব্যাঙ ধর্মীয় অনুশাসনের তুলনায় এই দুটির নৈতিক গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এইভাবেই—কোনো ধর্মতত্ত্বের অন্তর্লীন সত্যতার বদলে তার ব্যবহারিক গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে তাকে মেনে নেওয়া—এই যুক্তির সমূহ খণ্ডন করা সম্ভব।
অনেকের কাছে, এই যুক্তিরই আরো সরল, সাদাসিধে একখান সংস্করণের বেশ আবেদন আছে। তাঁরা আমাদের বলেন—ধর্মমতের সান্ত্বনা-স্পর্শ না পেলে তাঁরা অসহনীয় কষ্টের মধ্যে থাকতেন। তা যদি সত্যিও হয়—তাহলেও, এ এক ভীরুর যুক্তি। এক নিতান্ত ভিতু মানুষই কেবল যেচে মূর্খের স্বর্গে বাস করতে চায়। নিজের স্ত্রীকে ব্যভিচারিণী বলে সন্দেহ করা কোনো পুরুষ যখন নিশ্চিত প্রমাণের থেকেও চোখ ফিরিয়ে থাকে—তাকে তো কই আমরা ভালো চোখে দেখি না? প্রমাণকে অগ্রাহ্য করা—কেন একক্ষেত্রে সমালোচনার, অন্যক্ষেত্রে সমীহের বিষয় হবে—এ আমার মাথায় ঢোকে না। এই যুক্তিটুকু ছাড়া, ব্যক্তিগত সুখ-শান্তির উপর ধর্মমতের প্রভাবের সব গল্পই অতিরঞ্জিত। সুখী বা অসুখী হওয়া অনেকগুলি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। অধিকাংশ মানুষের প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য আর পর্যাপ্ত আহারের জোগান। তারই সঙ্গে প্রয়োজন—তার সম্পর্কে প্রতিবেশী সমাজের চোখে সম্মান, আর প্রিয়জনের ভালোবাসা। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্বাস্থ্যও প্রয়োজন। ধর্মমত-নির্বিশেষে, অধিকাংশ ব্যক্তি সুখে থাকেন—এই ক-টি শর্ত পূরণ হলেই। এদের অবর্তমানে, তাঁরাই, ধর্মমত-নিরপেক্ষভাবেই—অসুখী। নিজের পরিচিত বৃত্তের কথা ভাবলে, গড়পড়তা বিশ্বাসী ব্যক্তি যে গড়পড়তা অবিশ্বাসীর থেকে বেশি সুখী—কই, এমন তো আমি দেখতে পাই না!
যখন নিজের বিশ্বাসের দিকে চোখ ফেরাই—মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কোনো উদ্দেশ্য উদ্ধার করা তো বটেই, এমন কোনো উদ্দেশ্যের আশা করাও আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। যাঁরা কল্পনা করেন – কোনো এক স্রষ্টার পছন্দসই কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এই মহাজাগতিক বিবর্তন ঘটছে—তাঁরা সাধারণত বুঝতে পারেন না, যে একটি বিশেষ যুক্তির প্রতি তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পড়েন; সেটি হল—হয় সেই স্রষ্টা সর্বশক্তিমান নন, নয়তো, চাইলেই, এই ঝামেলার মধ্য দিয়ে না গিয়ে, তাঁর পক্ষে সেই অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। আমি নিজে তো দেখতে পাই না—এমন কোনো পরিপূর্ণতার দিকে মহাবিশ্ব এগিয়ে চলেছে। পদার্থবিদদের মতে, শক্তি যত সমসত্ত্বভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ততই তার উপযোগিতা কমবে [১১]। একসময়, যা কিছু আমাদের আকর্ষণীয় বা আরামদায়ক মনে হয়, যেমন প্রাণ, বা আলো — উবে যাবে — অন্তত এমনটা বলেই তাঁরা আমাদের আশ্বস্ত করেন। এই মহাবিশ্ব যেন এক নাট্যশালা, যার মঞ্চে একবারই আলো জ্বলে ওঠে, অভিনয়ের শেষে একবারই পর্দা পড়ে আর তারপর থেকে তা অসাড়, নিস্তব্ধ পড়ে থাকে—জীর্ণতার, ধ্বংসের অপেক্ষায়। আমি একবারও জোর দিয়ে বলছি না—এমনটাই হবে। তাহলে,যতটা জানি না, ততটা জানার ভান করা হবে। আমি বলছি, বর্তমানে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এমনটাই সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে। মহাবিশ্ব উদ্দেশ্যহীন—এমনটাও আমি গলার জোরে প্রমাণ করার চেষ্টা করবো না, শুধু বলবো—এমন কোনো উদ্দেশ্যের সপক্ষে প্রমাণের চিহ্নমাত্র নেই।
আমি আরো বলবো—যদি তেমন কোনো উদ্দেশ্য থেকে থাকে, আর সেই উদ্দেশ্য যদি কোনো সর্বশক্তিমান স্রষ্টার হয়েও থাকে, তবে সে, পরম করুণাময়, দয়াময় হওয়া তো দূরস্থান (যেমনটা আমাদের বলা হয়ে থাকে)—আসলে অননুকরণীয় নৃশংসতার ক্ষমতা ধরে। একটি খুন করা লোককে আমরা খারাপ লোক বলি। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, যদি থেকে থাকে, তবে সে সবাইকে খুন করে। ইচ্ছাকৃতভাবে একজনকেও দুরারোগ্য ক্যান্সার-ব্যধিগ্রস্ত করে তোলাকে আমরা ইতরের কাজ বলে মনে করি। স্রষ্টা, যদি সে থেকে থাকে, প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে এই ব্যধি প্রদান করে। নিজের সন্তানদের সুপথে মানুষ করার ক্ষমতা ও জ্ঞান থাকাসত্ত্বেও তাদের বিপথে চালিত করে যে ব্যক্তি—তাকে আমরা ঘৃণার চোখে দেখি। কিন্তু ঈশ্বর, যদি সে থাকে, তবে নিজের অধিকাংশ সন্তানের ক্ষেত্রেই সেই সিদ্ধান্ত নেয়। এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর—যার সমালোচনামাত্রই অপবিত্র—এই পুরো ধারণাটিই যেন প্রাচ্যের কোনো স্বৈরতন্ত্র থেকে উঠে এসেছে [১২], যেখানে রাজন্যের খামখেয়ালী অত্যাচার সত্ত্বেও তাঁরা প্রজাদের নয়নের মণি। এই অচল রাজতন্ত্রের উপযোগী মানসিকতাই যেন আজও গোঁড়া ধর্মতত্ত্বের মধ্যে বেঁচে আছে।
এক আধুনিক আস্তিকতাও আছে বৈকি, যেখানে ভাবা হয়—ঈশ্বর ঠিক সর্বশক্তিমান নন, তবে, অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও, নিজের সেরাটা দিচ্ছেন এই কাজে। এমন ধারণা খ্রিস্টানদের মধ্যে নতুন হলেও, চিন্তার ইতিহাসে মোটেই নতুন নয়। আদতে প্রথম এর খোঁজ পাওয়া যায় প্লেটো-র কাছে। এই চিন্তাটিকে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। যা বলা যায়, তা হল, এর সপক্ষে ভাবার মতো কোনো জোরালো কারণ নেই।
অনেক গোঁড়া আস্তিক এমনভাবে কথা বলেন, যেন তাঁদের অন্ধবিশ্বাসকে ঠিক প্রমাণ করার দায় তাঁদের নয়—ভুল প্রমাণ করার দায় অবিশ্বাসীদের। বলা বাহুল্য, এ ভাবনা ভুল। আমি যদি এখন দাবি করি— পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যে কোথাও একটি চিনেমাটির চায়ের কেটলি উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, আর এ-ও পরিষ্কার করে বলে দিই, যে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দূরবীন দিয়েও সেই ক্ষুদ্র কেটলিটা দেখতে পাওয়া সম্ভব না—তবে কেউই আমায় ভুল প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু আমি যদি তার সঙ্গে এ-ও যোগ করি—যেহেতু আমায় ভুল প্রমাণ করা সম্ভব না, তাই আমায় সন্দেহ করা যুক্তির তরফে ঘোর অসঙ্গত আচরণ—তবে আমি কি নেহাতই অবান্তর বকছি না? অথচ দেখুন, তেমন কোনো কেটলির অস্তিত্বের কথা যদি প্রাচীন কোনো শাস্ত্র বা পুঁথিতে লেখা থাকে, প্রতি রোববার এই কথাটিকে পবিত্র সত্য বলে আওড়ানো হয়, আর স্কুলের ছেলেমেয়েদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়, তাহলে কেটলির অস্তিত্বে অবিশ্বাসকে ছিটের লক্ষণ বলে দেগে দেওয়া হত, যাতে কিনা সন্দেহকারীকে—এই আলোকপ্রাপ্ত সময়ে, কোনো মনোরোগবিশেষজ্ঞের কাছে, বা পুরোনো দিন হলে, ইনক্যুইজ়িটরের কাছে— নিয়মিত হাজিরা দিতে হত। যা রটে, তার কিছু বটে—এমনটা ভাবা প্রায় স্বতঃসিদ্ধের আকার নিয়েছে, অথচ, ইতিহাসের কোনো পড়ুয়াই এতে বিশ্বাস রাখেন বলে আমার মনে হয় না। বন্য মানুষের সমস্ত বিশ্বাসই, কার্যত, অবাস্তব। প্রাচীন সভ্যতাগুলির হয়তো, মেরেকেটে এক শতাংশ বিশ্বাসের মর্মে তাও কিছু সত্য ছিল, আজকালকার দিনে...
কিন্তু রোসো! এইবারে আমায় কিঞ্চিৎ সাবধানে কথা বলতে হবে। সোভিয়েত রাশিয়ায় যে বহু উদ্ভট বিশ্বাস চালু—সে কথা আমরা সকলেই জানি। আমরা প্রোটেস্টান্ট হলে, ক্যাথলিকদের মধ্যে প্রচলিত উদ্ভট আচারের কথা আমাদের জানা। আমরা ক্যাথলিক হলে, প্রোটেস্টান্টদের অদ্ভুতুড়ে বিশ্বাসের কথাও আমরা জানি। আমরা রক্ষণশীল দলের হলে, লেবার পার্টির মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারের গল্প শুনে আমরা অবাক হই। সমাজতন্ত্রী হলে, রক্ষণশীলদের অতি সহজে সবকিছু বিশ্বাস করে নেওয়ার ক্ষমতা দেখে আমাদের গা জ্বলে যায়। প্রিয় পাঠক, আমি জানি না—তোমার নিজের বিশ্বাস কী; তবে তা যা-ই হোক, এ কথা তোমায় মেনে নিতেই হবে, যে, মানবসমাজের নব্বই শতাংশের, শতকরা নব্বইভাগ বিশ্বাসই, সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। অবশ্যই, যে সব অযৌক্তিক ধ্যানধারণার কথা হচ্ছে—তাতে তুমি মোটেই বিশ্বাস করো না। অতএব, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ—কেবলমাত্র কোনো কোনো বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে বলেই, কোনো বিশ্বাসকে (সব ধর্মবিশ্বাসই কোনো না কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত) সন্দেহ না করার কোনো কারণ আমি দেখতে পাইনে।
অতএব, আমার সিদ্ধান্ত হল—কোনো গতানুগতিক ধর্মতত্ত্বে বিশ্বাস করারই কোনো কারণ নেই, আর তার চেয়েও বড় কথা—সেগুলি সত্য হোক—এমন আশা করাও অর্থহীন। যতক্ষণ না প্রাকৃতিক শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে হয়, ততক্ষণ মানুষ তার নিজের মর্জির মালিক, নিজের নৌকার কাপ্তেন। দায়িত্ব যেমন তার নিজের, সমস্ত সুযোগও—তারই।
----- বার্ট্রান্ড রাসেল
"Is There a God?" (1952),
The Collected Papers of Bertrand Russell,
Volume 11: Last Philosophical Testament, 1943-68,
ed. John G. Slater and Peter Köllner
(London: Routledge, 1997), pp. 543-48.
ফুটনোট কণ্টকিত এই অ্যামেচার অনুবাদের চেষ্টাটি বুঝতে অসুবিধে হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন, আর উপরের লিঙ্কে গিয়ে আসল ইঞ্জিরিটা পড়ে ফেলুন প্লিজ়। বলাবাহুল্য, লেখাটি রাসেলবুড়োর হলেও, ছ্যাবলা ফুটনোটগুলি আমার।
[১] ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে, উইকি-মতে, দুনিয়ার জনসংখ্যার ৮৪.৪% নিজেকে কোনো না কোনো ধর্মের অংশ মনে করেন। এঁদের প্রায় সকলেই যে অ-ধর্মান্তরিত, এই হিসেবটা মনে রাখলেই লেখায় ব্যবহৃত "অধিকাংশ" শব্দটির গুরুত্ব পরিষ্কার হবে।
[২] আলেক্সান্ডারের যুদ্ধযাত্রার সঙ্গে গ্রিক শিল্প-সংস্কৃতি আর ধর্মের এক সমসত্ত্ব সংস্করণ ছড়িয়ে পড়েছিল উপনিবেশগুলোয়। একেই হেলেনিজ়ম বলে।
[৩] পুরোনো যুগের ইহুদি পুরুষদের প্রতি শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে জলে ডুব দিয়ে চান করার রীতি প্রচলিত ছিল, এর নাম মিকভা। আজও আছে, তবে এখন আর তার মানে এই নয়, যে অন্যদিন চান করা যাবে না।
আমাদের গুরু-গাঁয়ের যোগী, ইহুদি-বিশেষজ্ঞ ('ইহুদি-রসিকতা'-খ্যাত) হীরেন সিংহরায়কে জিজ্ঞেস করায় এই উত্তরটি পেয়েছি:
"জলের সঙ্গে ইহুদিদের একটি বৈমাত্রেয় সম্পর্ক আছে। স্নান না করার জন্য তাদের অসম্ভব খ্যাতি আছে। তাই মিকভার ব্যাঙ্গার্থ – 'দাও বেটাকে চুবিয়ে'! তবে এখন মিকভা আবশ্যিক নয়।"
এই প্রসঙ্গে 'ইহুদি-রসিকতা'-র একটি টুকরো না তুলে পারছি না—হীরেনবাবুই দেখালেন:
"কার্লসবাদ (কার্লোভি ভারি, আজকের চেক)–
সেখানে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে খনিজ জল। জলের দ্বারা স্বাস্থ্য—সানুস পের আকুয়াম। (SPA-স্পা!) ইলান গেছে জল চিকিৎসার টিকিট কাটতে।
কাউন্টারের মহিলা: একটা কেন, একসঙ্গে যদি বারোটা টিকিট কাটেন, সস্তা হবে। এগারোটার দামে বারোটা পাবেন।
ইলান (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে): আমি কি আর বারো বছর বাঁচবো?"
[৪] ১৯৫২ সালের বক্তৃতার প্রতিলিপি। বুঝতেই পারছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর ঠান্ডা-লড়াইয়ের পূর্ববর্তী দুনিয়ার অবস্থা ঠিক কী ছিল...
[৫] এশিয়া মাইনরের পশ্চিম সমুদ্রপাড়ে, বর্তমান তুর্কির ইজ়মির-এর দক্ষিণে।
[৬] unaided reason: বহির্জগতের সাহায্য ছাড়াই যে পর্যালোচনা সম্ভব; বাইরে হয় বৃষ্টি হচ্ছে, নয় হচ্ছে না – এই দুটিই মাত্র বিকল্প। এইটে হল নিরালম্ব যুক্তি। বৃষ্টি হচ্ছে দেখে নেওয়ার পর আপনার সিদ্ধান্তটি আর 'নিরালম্ব' থাকে না।
[৭] অর্ফিউস-এর নাম থেকে। "রহস্যাবৃত ধর্মমত"গুলির অন্যতম।
[৮] Metaphysics: দর্শনের সেই ঘোলাটে চশমা-পরা অংশ, যা সবকিছুর মূলে গিয়ে তার প্রকৃত মানে বোঝার চেষ্টা করে। এসবের চর্চা করতে গিয়ে একদলের মাথায় সামান্য ছিট দেখা দিলে, তেনাদের Philosophical Skeptic বলে (মশকরা কচ্ছি, রাগবেন না)
[৯] John Locke: চিকিৎসক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, বিশ্রুত জ্ঞানতাত্ত্বিক। বলা হয়, প্রথম অভিজ্ঞতাবাদী (empericist)।
[১০] Beast of Belsen: জোসেফ ক্রেমার। প্রথমে আউশভিৎসের গ্যাস চেম্বারের, পরে বের্গেন-বেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দায়িত্বে। প্রায় ৬০ হাজার প্রাণ-নিধনের জন্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। একটা সহজ হিসেব—সেই সময় গোটা আলাস্কার জনসংখ্যা এর সমান ছিল।
[১১] Heat death: মহাবিশ্বের এনট্রপি বেড়ে চলেছে, বেশি শক্তির অঞ্চল থেকে কম শক্তির অঞ্চলে শক্তির প্রবাহ হচ্ছে। কিছু না কিছু ঘটছে। এনট্রপি যখন সর্বাধিক, শক্তির বণ্টন যখন সমসত্ত্ব—শক্তির প্রবাহ বন্ধ, আর কিছু ঘটাও বন্ধ—অনন্ত একঘেয়েমি পড়ে থাকে।
[১২] Oriental Despotism: অ্যারিস্টটলের সময় থেকে চলে আসা, প্রথমে গ্রিক, পরে ইউরোপীয় ধারণা—এশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক রাজ্যব্যবস্থা সম্পর্কে।