আমার একটি লেখায় একটি বইয়ের প্রথম প্রকাশিত সাল লিখেছিলাম ১৯৮২, সঠিক তথ্য ১৯৬৯. ইন্দ্রানী ১৯৮২ টা নিশ্চিত ভুলে জেনেও মন্তব্য করেছিলেন - কিছু মনে করবেন না। একটি তথ্য ভুল মনে হচ্ছে। সূর্য কাঁদলে সোনা ১৯৬৯ এ প্রকাশিত। আমি লিখেছিলাম - এতে মনে করার কিছু নেই। মনযোগী পাঠিকা হিসেবে আপনি একটা তথ্যগত ভুল দেখিয়েছেন। আমি সেটা সংশোধন করে দিচ্ছি। তাহলে আমি যে বইটা কিনেছিলাম সেটা ছিল ১৯৮২ মূদ্রণ। ধন্যবাদ।
আমার দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল বাঙালি কবে থেকে এমন অসংবেদনশীল হয়ে গেল? পরে ইন্দ্রানী লিখলেন -
“ভুল তো হয়ই মানুষের। এরকম করে কেন বলছেন? ভুল একটা হয়েছে। শুধরে নিলেই হবে।” উৎপল কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি। আমি মনে মনে সেদিন ওর বাকসংযমকে কুর্নিশ করেছিলাম। আমি কোথাও একবার লিখেছিলাম -
Dignity, Grace, Good Manners, Sensitivity এহেন মানবিক গুণগুলি বাজারে কিনতে পাওয়া যায়না - these are not saleable commodities - এগুলি অর্জন করতে হয়। ‘দু নৌকায় পা’ প্রথম পর্বে কিছু পাঠকের উপহাসসূচক মন্তব্য প্রসঙ্গে রঞ্জনদা লিখেছিলেন - ‘এব্যাপারে দময়ন্তীর আমাকে দেয়া পরামর্শটি প্রণিধানযোগ্য। 'রঞ্জনদা, লেখা পাবলিক ফোরামে পেশ করার পর সেটা আর আপনার সম্পত্তি নয়,
বরং আপনার। যে কমেন্ট ট্রোলিং মনে হচ্ছে তার জবাব দিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের লেখা লিখে যান"। এবারেও সাত মিনিটের মধ্যে চতুর্ভুজ স্যাটাক করে ধরলেন - ".
.. ফোরামে পেশ করার পর সেটা আর আপনার সম্পত্তি নয়, বরং আপনার।" কঠিন বাইক্য :(
রঞ্জনদা দেড়ঘন্টা পর জানালেন - “ঠিক। ওটা হবে - "বরং পাঠক সাধারণের"। ধন্যবাদ চতুর্ভুজ! তবে রঞ্জনদার একটু অসংলগ্নভাবে লেখা দময়ন্তীর বক্তব্য, চতুর্ভূজ পয়েন্ট আউট করার আগেই, আমি কিন্তু, AI নয়, আমার সামান্য NI দিয়েই সঠিক বুঝেছি। ওটা নতুন কোনো কথাও নয়, আগেও শুনেছি, বিশেষ করে বিমূর্ত কবিতার ক্ষেত্রে - সেটি যতক্ষণ কবির খাতায় থাকে, ততক্ষণই তার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব - প্রকাশ হয়ে গেলে - বারোয়ারি। তখন তা নিয়ে পাঠক এমন কিছু ভাবতে পারে যা কবি নিজেও ভাবে নি।
এসব দেখে সত্যজিতের ‘
পুরস্কার’ গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর ভার্সনই সংক্ষেপে উল্লেখ করি - “অন্যমনস্ক এক চিত্রশিল্পী। শিল্পের ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত পছন্দ, সে রিয়্যালিজম বা বাস্তবতার অনুরাগী। প্রকৃতিকে ভেঙেচুরে বিকৃত করে দেখানোই তো আধুনিক শিল্পের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তার সৌন্দর্যবোধ তাতে পীড়িত হয়। শিল্পে যা স্যারিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ বলে চলছে, তা তার ভীতি উদ্রেক করে। তা ছাড়া, রেখা আর আকৃতি নিয়ে ওই যেসব পাগলামির খেলা, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'অ্যাবস্ট্রাকশন' বা বিমূর্ত শিল্প, ওটা তার মনে আদৌ কোনও সাড়া জাগায় না। এইরকম একটা ছবি দেখে মনে হয়েছিল, কাঁচা হাতে কেউ নিআনডারথাল বা পুরোপলীয় যুগের এমন এক আদি মানবীর ছবি এঁকেছে, যার সম্ভবত গোদ হয়ে পা ফুলে গেছে, গলাটা জিরাফের মতো লম্বা। অথচ সেই ছবির নাম 'আদর্শ নারী'। ভাবা যায়? তার মনে হয়েছিল, এর চেয়ে অদ্ভুত রসিকতা আর কিছুই হতে পারে না।”
শিল্পী অনেক খেঁটে আঁকলেন প্রতিযোগিতার জন্য একটি রিয়্যালিস্টিক ছবি - দ্য সমন্যাবুলিস্ট বা স্বপনচারিণী। বিষয় লেডি ম্যাকবেথ ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন। কিন্তু অন্যমনস্কতার জন্য ডাকে পাঠিয়ে দিলেন ছবিটির বদলে সেই কাগজখানা, ছবিতে যে-যে রঙ ব্যবহার করবে, তার মিশেল ঠিক করবার আগে যার উপরে সে তার তুলি দিয়ে হরেক রঙের ছোপ লাগিয়েছিল। কিন্তু সেবার ঐ কাগজটিই সেরা বিমূর্ত চিত্রের প্রথম পুরস্কার পেল - শিরোনাম - দ্য সমন্যাবুলিস্ট।
আমার লেখার বিষয় এবং লেখ্যশেলী হালকা চালের। সিনেমায় সিরিয়াস ঘটনাপ্রবাহের মাঝে কেষ্ট মুখার্জী বা অনুপ কুমারের কমিক রিলিফ গোছের। গুরুতে অনেক প্রকৃত জ্ঞানী, অভিজ্ঞ, দক্ষ লেখক আছেন। তাদের লেখা পড়ে ঋদ্ধ হই। যেমন হীরেনদার লেখা, শিবাংশুবাবুর “কালী এক অনার্য ওডিসি” বা রঞ্জনদার “অদ্বৈত বেদান্ত বা মায়াবাদঃ শংকরাচার্যের যুক্তিগ্রাহ্যতা” ইত্যাদি। অমন বিষয়ে লেখার মতো পড়াশোনার ব্যপ্তি বা ভাবনার গভীরতা আমার নেই। তবু কিছু ভাবনা, অভিজ্ঞতা অচেনা পাঠকজনের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছা হয়। পরিচিতির দায় নেই বলে উন্মুক্ত মন্তব্য পাওয়া যায়। তাছাড়া আমার মতো কিছু খেলো লেখক না থাকলে তো এই ফোরামের নামকরণের সার্থকতাই থাকে না।
পাঁচ বছর ধরে গু৯তে অন্যের লেখা পড়ার জন্য ঢুঁ মারলেও হপা তে লিখতে শুরু করি ২৭.৯.২৩ থেকে। তার একমাসের মধ্যে ২৬.১০ গুরুচণ্ডা৯ থেকে মেল পেলাম - শারদ সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাবেন? আমার কাছে এটা একটা স্বীকৃতি স্বরূপ। তাই লিখলাম – এতো আনন্দের কথা। একটা লেখা পাঠাচ্ছি। পছন্দ হলে রাখবেন। না হলে, জানালে, অন্য লেখা পাঠাবো। পাঠালাম “
পলায়নবাদীর সঞ্জীবনী বটিকা।” আলোচনা-বিবিধ শ্রেণীতে ১৬.১১ তে সেটা বেরোতেই এক পাঠক পত্রপাঠ লিখলেন - “
রসিকতার প্রয়াস খেলো মনে হলো”। অর্থাৎ ঐ লেখায় ওটাই ওনার মূল প্রতিপাদ্য বলে মনে হয়েছে। অথচ ২৬.১১ মোহাম্মদ কাজী মামুন লিখলেন - দারুণ লেগেছে পড়তে। আমি লিখলাম, লেখাটির ওপর একজন ১ এবং দুজন ৫ রেটিং দিয়েছেন। এসব থেকেই TASTE DIFFERS প্রবচনটির যথার্থতা অনুভূত হয়।
গুরুতে এ গপ্পোটা দুটো পর্বে আলাদাভাবে পোষ্টানো ছিল একটা এক্সপেরিমেন্ট কারণ আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম প্রথম পর্বটি পড়ে কেউই দ্বিতীয় পর্বটি অনুমান করতে পারবে না। আগে জনা দশেক বন্ধুমহলে যখন এটা পাঠিয়েছিলাম - কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। গুরুতে একমাত্র দীমু প্রথম পর্ব পড়ে আশাংকা করেছিলেন দ্বিতীয় পর্বে রসভঙ্গ হবে। তবে সেটা তিনি প্রথম পর্বে জানাননি।
এই প্রসঙ্গে মুষ্টিমেয় কজন বন্ধু মহলে আমি কিছুদিন যে Digital Game খেলেছি তার উল্লেখ করি। খেলাটির নাম দিয়েছিলাম -
LBO বা Look Beyond Obvious. অন্য কেউ কোথাও এই খেলা খেলে থাকলেও তা আমার অজানা। খেলার প্রকরণ এবং নামকরণ আমারই উদ্ভাবিত। একটা ছবি পাঠিয়ে জানতে চাইতাম, আপাতভাবে এতে যা দেখা যাচ্ছে - ছবিটি দেখে
‘তা ছাড়া আর কী মনে হচ্ছে জানাও’। ছবিগুলো আমার তোলা বাস্তব দৃশ্য। শরৎ সংখ্যায় লেখাগুলোর ওপরে পাইয়ের দেওয়া ছবিগুলোর মতো বিমূর্ত আঙ্গিকের নয় - সোজা সাপটা ছবি।
একদা আনন্দমেলায় তপন দাশ অদ্ভুত এ্যাঙ্গেল থেকে বা ম্যাক্রো ভিউতে কোনো বস্তুর ছোট্ট অংশ দেখিয়ে প্রশ্ন করতেন - বলো তো এটা কী? বা ইদানিং হোয়াতে আসে - Only genious observer can find it in less than 10 sec - এই বলে অসংখ্য লাল টালির ঘরের ছবির মাঝে কোথাও একটা লুক্কায়িত বিড়ালের মুখ খুঁজে বার করতে বলে। দুটি ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা close ended মানে নির্দিষ্ট একটা কিছু বলতে হয়। LBO Game তা নয়। এটি open ended - এতে কোনো নির্দিষ্ট বা ভুল ঠিক জবাব নেই। একটি ছিল খবরে কাগজে প্রকাশিত একটি আর্টিকলে এক বলিউড নায়িকার ছবি। আর্টিকলের শিরোনাম ও নায়িকার মুখটি বাদ দিয়েছিলাম, যাতে কেউ চিনতে না পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রে, ঐ ছবিটির ক্ষেত্রে আমার নিজের LBO ভাবনা (যা অনেক সময় বিশদে হয়ে যেতো) লিখে একটা PW Protected Word ফাইল হিসেবে আগেই পাঠিয়ে দিতাম যাতে কেউ না ভাবে আমার ভাবনা অন্যের ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত।
অতঃপর সবার ভাবনা পেয়ে, compilation করে, একটা Word ফাইলে কপি পেষ্ট করে সেটা অংশগ্রহণকারীদের পাঠাতাম। তাতে তাদের কোডনেম দিতাম যাতে কেউ কাউকে চিনতে না পারে। ছবিটা তোলার সময় কোনো একটা LBO স্ফূলিঙ্গ মাথায় এসেছিল বলেই সেটা পাঠানো। এবার দেখার কথা - একটি ছবি নানা পার্সপেক্টিভ থেকে দেখে দর্শকদের কতো বিভিন্ন রকমের extrapolated resonance বা প্রলম্বিত অনুরণন হতে পারে - সেটাই ছিল এই খেলার বৈশিষ্ট্য এবং মজা। কেউ কেউ যা আপাতদৃষ্ট সেটাই ব্যাখ্যা করতো। তখন আবার বলতে হোতো - এর বাইরে কিছু মনে হচ্ছে কিনা জানাতে। তেমন দুটো LBO ছবি উদাহরণ হিসেবে রাখছি।
‘দু নৌকায় পা’ লেখা পড়ে যদি দীমু প্রথম পর্বেই জানিয়ে দিতেন দ্বিতীয় পর্বে কী জাতীয় রসভঙ্গতা তিনি আশাংকা করছেন এবং তা যদি মিলে যেতো - তাহলে তাকে আভূমি কুর্নিশ করতুম। শরৎ সংখ্যায় কেকের তিন পর্বের ‘‘
ব্ল্যাক আউট ডাইনিং” লেখায় স্টার্টার থেকে ডেজার্ট অবধি যেমন ধারাবাহিকতা ছিল তা যে ‘দু নৌকায় পা’ লেখায় দ্বিতীয় পর্বে থাকবেনা বরং অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন হবে তা আমি জানতাম। দেখার ছিল, যাদের প্রথম পর্ব পড়ে ভালো লেগেছিল, দ্বিতীয় পর্বে ছন্দপতন কীভাবে নেন। তাই প্রথম পর্বের কিছু মন্তব্যের ওপর প্রতিমন্তব্য করলেও দ্বিতীয় পর্বের মন্তব্যের ওপর আমি এতোদিন চুপ করে ছিলাম।
যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের কেউই দ্বিতীয় পর্বের ছন্দপতনটি মেনে নিতে পারেন নি।
কেবল ফরিদা প্রথম পর্বে বলেছেন - দ্বিতীয় পর্বে যাই থাকুক, সেটা যদি নাও আসে, তাহলেও প্রথম পর্বটি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। কথা হচ্ছে, সমাজে এবং ব্যক্তিজীবনে কী ধারাবাহিকতায় ছেদ, প্রত্যাশার অপমৃত্যু, অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন এসব ঘটে না? বহু প্রত্যাশিত ‘অচ্ছে দিন’ এসেছে কিনা বুঝি না। জীবনে বিভিন্ন সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বা প্রয়োজনে দু (বা তিন, বা চার) নৌকায় সজ্ঞানে পা দিয়ে কী লোকে চলে না? উৎপল দত্ত কিছু বাণিজ্যিক বলিউড ছবিতে স্টিরিওটাইপ ভাঁড়ামি বা ভিলেনের রোল করেছেন স্রেফ পয়সার জন্য যাতে থিয়েটার দলটি চালাতে পারেন। হয়তো মামাবাবুর সৃজনশীল সৃষ্টির তাগিদ ছিল কিন্তু বাণিজ্যিক সিরিয়াল বানাতে গিয়ে সেই ইচ্ছার অপমৃত্যু হয়েছে। তাই তিনি সলিলকে সাবধান করে দেন - দু নৌকায় পা রেখে চলা সহজ নয়।
জীবনে প্রিয় বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক প্রথাগত পরিণতি না পেলেও দুটো অধ্যায় তো আলাদাভাবে রাখা যেতেই পারে। যেমন আমি রাখতে পেরেছি - আঙুরফল টক জাতীয় ভাবনা ছাড়াই। সৌন্দর্যে ও স্বভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয়া প্রথম প্রিয় বান্ধবী - আট বছর মেলামেশার পর আমারই আলাপ করিয়ে দেওয়া এক বন্ধুকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেল। তখন ভেতরটা কিছুদিনের জন্য ফাঁকা হয়ে গেছিলো। তবে মেনে নিয়েছি। কারণ আমি তাকে ধরে রাখতে চাইনি। আর কখনো খোঁজও করিনি। ওর বিয়ের ছাব্বিশ বছর পর সে ডিজিট্যালি খোঁজ পেয়ে যোগাযোগ করতে আবার সহজভাবে নিয়েছি।
তবে সুলভ হওয়া সত্ত্বেও কখনো হোয়া ভিডিও চ্যাট করিনি। এর মাঝে সে অনেকবার ভারতে এলেও দেখা করার তাগিদ অনুভব করিনি। মনে হয়েছে যেসব মধুময় দিন চলে গেছে তা স্মৃতির বাক্সে থাকাই ভালো - now no point trying to walk down the memory lanes. অডিও চ্যাট হয়েছে মাত্র কয়েকবার। দশবছর ধরে মূলতঃ মাঝেমধ্যে ভার্চুয়াল টেক্সট চ্যাট হয়েছে। আমার লেখা পাঠাই। ওর পড়তে ভালো লাগে। ব্যস এটুকুই। কোনো উন্মাদনা, হাহাকার, তিক্ততা নেই। সাবলীলভাবে হালকা রসিকতা করি।
বর্তমানে বৌমণি ও আমাদের একমাত্র পুত্রসন্তানের সাথে আমার পারিবারিক জীবন খুব আনন্দময়। কোনো অতৃপ্তির কাঁটা নেই তাতে। সেই বান্ধবী বৌমণির দুর সম্পর্কের আত্মীয়া। বিয়ের আগে পূর্বরাগ পর্বে বান্ধবীর কথা বৌমণিকে বলেছিলাম। আমাদের বিয়ের তেইশ বছর পর সেই বান্ধবী ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করতে, তাও বৌমণিকে জানিয়ে বলেছিলাম, তোমার সাথে বিয়ের পর আমার জীবন কেটেছে আনন্দে কিন্তু ও আমার অতীতের এক সুন্দর অধ্যায় যখন তুমি ছিলেনা আমার জীবনে। তোমার জীবনে এমন আন্তরিক প্রাকবৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না। তবু আশা করি তুমি বুঝবে এই দুটি অধ্যায় আমি আলাদাভাবে রাখতে পারি কোনো আপাতবিরোধীতা ছাড়াই। বুদ্ধিমতী বৌমণি বোঝে বিবাহিত জীবনেও কখনো স্পেসের প্রয়োজন হয়। বান্ধবীকে নিয়ে তার সাথে আর কোনো আলোচনা হয় নি।
সুনীলের ‘স্বপ্ন লজ্জাহীন’ লেখায়, দুই প্রিয় বন্ধু সুনীল ও হেমন্ত দুজনেই মনীষাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু দুজনেই ওরা একে অপরকে মনীষাকে বিয়ে করতে বলছে। তার একটা কারণ, সুনীলের ধারণায়, বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রী অচিরেই আটপৌরে হয়ে যায় কিন্তু না পাওয়া প্রেমিক বা প্রেমিকার অভিঘাত স্মৃতিতে থেকে যায় আজীবন।
তো বলার কথা এই যে, দু নৌকায় পা লেখার দ্বিতীয় পর্বের ছন্দপতন - কারণ ব্যাখ্যা করে জানানো সত্ত্বেও কেন সহজভাবে নেওয়া গেল না? প্রেম - বিবাহ - অতঃপর সুখী দাম্পত্য জীবন কাটানো বা অসুখী দাম্পত্য জীবন বয়ে বেড়ানো নতুবা বিবাহবিচ্ছেদ। মানবজীবনের এই প্রচলিত ছকটির ধারাবাহিকতা বা ছন্দপতন সর্বজনবিদিত। সেই ছন্দপতনও part of the game হিসেবে মানুষ মেনে নিতে পারে। তাই লিজ টেলর আটবার বিবাহ করেছেন। রিচার্ড বার্টনের সাথে হয়েছে পূনর্বিবাহ এবং পুনর্বিচ্ছেদও। রিচার্ডের সাথে দ্বিতীয় বিচ্ছেদের পরেও লিজের হয়েছে আরো দুবার বিবাহ এবং বিচ্ছেদ। On a lighter note - লিজ আমার “দু নৌকায় পা” পড়লে হয়তো দ্বিতীয় পর্বের ছন্দপতন সহজভাবে নিতেন - কারণ তিনি তাতেই অভ্যস্থ ছিলেন যে।
তবে দ্বিতীয় পর্বে যাদের রসভঙ্গতা হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে আর একটি কারণ থাকতে পারে। প্রথম পর্ব পড়ে মনে দানা বেঁধে ওঠা ম্যাজিক রিয়ালিজম, স্যূররিয়ালিয়াস্টিক আমেজ দ্বিতীয় পর্ব পড়ে ছানা কেটে যেতে তাদের হয়তো মনে হয়েছে লেখক তাদের অনুভূতি নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। প্রথম পর্বটি আদৌ ওসব কিছু না, মামাবাবুর ফরমায়েশ অনুযায়ী সলিলের লেখা একটি Nonsensical prose অথচ আমরা কত কী ভেবে নিলাম, ধুস!
Sapiosexual না হলে অধিকাংশ পুরুষ নারীর মৌখিক সৌন্দর্য, সুঠাম শরীর, সুডৌল বক্ষসম্পদে আকৃষ্ট হয়। ধরা যাক অফিসে তেমনিই এক বছর পঁচিশের সুন্দরী, খাজুরাহো ভাস্কর্যের মতো সুতনুকা স্বপ্নার সাথে আলাপ হোলো শৌভিকের। পরিচয় গড়ালো অন্তরঙ্গতায়। বর্তমানে পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রাকবৈবাহিক শারীরিক সম্পর্কে শুচিবায়ুগ্ৰস্থতা নেই। এক ছুটির সন্ধ্যায় ডিনার অন্তে শৌভিক গেল স্বপ্নার ফ্ল্যাটে রাত কাটাতে। শয্যায় অত্যন্ত আগ্ৰহে স্বপ্নার ঊর্ধাঙ্গের পোশাক উন্মোচিত করেই যেন বৈদ্যুতিক শক খেল শৌভিক। একি! স্বপ্নার সুঠাম শরীরে পোশাকের অন্তরালে যে বক্ষসম্পদ কল্পনা করে সে এতোদিন মুগ্ধ হয়েছে তা তো সদ্যকিশোরীসম! স্বপ্না সেই দীনতা লুকোতে ব্যবহার করতো হেভিলি প্যাডেড ব্রা। আর তাতেই শৌভিক চকমা খেয়েছে। এখন হোলো স্বপ্নভঙ্গ। অথচ তাতে কী পোশাকে আবৃতা স্বপ্নাকে দেখে শৌভিকের আগে যা মনে হোতো বা এখন কেবলমাত্র বক্ষসম্পদের দীনতাটুকুর জন্যই কী স্বপ্নার সমগ্ৰ সত্তাটি মূল্যহীন হয়ে যায়?
আমার ভাবনায় দ্বিতীয় পর্বটিই এই লেখার ক্ষেত্রে conclusive chapter তাই তারপর সেটাকে আর টেনে বাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কেউ যদি রিলে রেসের মতো এর পর তৃতীয় পর্ব লিখে তার ধারণায় লেখাটির একটি কাঙ্ক্ষিত রূপ দিতে চান - আমার আপত্তি তো নেইই বরং সাগ্ৰহে দেখবো - কী দাঁড়ায়। সেটাও ঐ LBO Game জাতীয় একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হবে।
বাস্তবেও তেমন হয়েছে। ১৯৭০ সালের জুলাইয়ে লেখা শুরু করে সেপ্টেম্বরে অনন্তলোকে যাত্রার আগে শরদিন্দু তাঁর ব্যোমকেশ কাহিনী “
বিশুপাল বধ” - শেষ করতে পারেননি। আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত শরদিন্দু সমগ্ৰতে ওটি অসমাপ্ত শেষ ব্যোমকেশ কাহিনী হিসেবেই ছিল। নারায়ন সান্যাল ওটি শেষ করেন।
বিভাগ, উপবিভাগ নিয়ে ভাটে আলোচনার সময় r2h একবার গুরুর প্ল্যাটফর্মটিকে লেখক পাঠক সমবায় গোছের মন্তব্য করেছিলেন। টইপত্তর বিভাগে লেখাগুলোও তেমনি। কেউ একজন কোনো বিষয়ে একবারে না লিখে কমেন্ট সেকশনে টুকরো টুকরো করে ধারাবাহিকভাবে লেখেন। লেখার মধ্যেই - বাঃ, বেশ, চলুক, পড়ছি, তাপ্পর গোছের সংক্ষিপ্ত পাঠ মন্তব্যের সাথে বিশদে মন্তব্যও আসে। তার ভিত্তিতে লেখক লেখার কিছু কোর্স করেকশনও করতে পারেন।
যেমন এবারের শরৎ সংখ্যায় ”
হাওয়া মোরগের জীবন” রচনার লেখক দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় ঐ লেখার ওপর কিছু পাঠ মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে ‘বার্তা’ চরিত্রটি নিয়ে আর একটু খেলিয়ে লেখার সম্ভাবনা দেখেছেন। সে ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।
পরিশেষে সব মন্তব্যকারীকে পুনরায় ধন্যবাদ জানাই। কারণ তাদের মন্তব্য আমার সীমিত জ্ঞান ও বোধবুদ্ধির পরিসরেও নানা ভাবনার তরঙ্গ তোলে। তা বিচক্ষণ দৃষ্টিতে গ্ৰহণীয় না হলেও যা ভাবছি তা সুসংহতভাবে লেখ্যমাধ্যমে প্রকাশ করতে পারা আমার কাছে মগজের ব্যায়াম সদৃশ। তার ফলে লেখ্য প্রকাশভঙ্গিতে বার্ধক্যজনিত মানসিক অসংলগ্নতা যতদিন সম্ভব এড়িয়ে থাকা যায়।