এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কিছুক্ষণ ১০ প্যারিস 

    হীরেন সিংহরায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ আগস্ট ২০২৪ | ৪৭২ বার পঠিত
  • প্যারিস








    এর নাম শঁজেলিজে ?

    ল্যুভরের পিরামিড , ছোটো  আর্চ পেরিয়ে তুইলারির বাগান দিয়ে হেঁটে দাঁড়িয়েছি প্লাস দে কনকর্ডের ফোয়ারার সামনে। বাঁয়ে আসেমবলি নাসিওনাল , দূরে আইফেল টাওয়ারের চুড়ো , ডানদিকে মাদলেন।  সন্ধ্যে নেমে আসে । হঠাৎ  এক সঙ্গে কে যেন অনেকগুলো  বাতি জ্বালিয়ে দিলেন - আমার সামনে আশ্চর্য আলোর বন্যায় ভেসে গেলো  এক অন্তহীন রাজপথ,  শঁজেলিজে, অনেক দূরে  চলে গেছে এক বিশাল সুরম্য তোরণ অবধি -আর্ক দু ত্রিউম্ফ , এতোয়াল-  বিজয় তোরণ , তারকা । সেই পথের দিকে চেয়ে সেদিন এক স্তম্ভিত বিস্ময়ে বিদেশির ভিড়ে নিজেকে বাংলায় যা বলেছিলাম তার কপিরাইট শ্রী মণি শঙ্কর মুখোপাধ্যায় বাঙালির কাছ থেকে সত্তর বছর আগেই বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে  কত অজানারে  শুরু করলেন - এর নাম হাই কোর্ট ?






    সবে ফ্রাঙ্কফুর্ট এসেছি । একদিন স্থানীয় কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো , ইস্টার পরবে তিন দিন দু রাত্তিরের  জন্য বাসে প্যারিস চলুন , দক্ষিণা ১৭৯ মার্ক (  ভারতীয় আটশ টাকা , ১৯৭৯ সাল )।  আমার মতন কপর্দকশূন্য টুরিস্টের কাছে এ বিশাল প্রলোভন । হ্যাংলাকে কেউ বললে প্যারিস যাবি? সে বললে,  টিকিট কই ?

    সাত ঘণ্টার বাস যাত্রা ,  ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পশ্চিম মুখো অটোবান ধরে রাইন পেরিয়ে মেতস ;  কবে সম্রাট শারলামেন ছোট  ছেলেকে বলেছিলেন  তুমি রাইনের এ পারে রাজত্ব করো তোমার দাদা নিক অন্য পার । সেই থেকে এই নদী জার্মানি ও ফ্রান্সের সীমান্ত।  প্যারিসের কাছে এসে বাস থামলে নয়সি ল্য গ্রাঁর ফুটপাথে কফি খাওয়া । একসময় চোখে পড়ে আইফেল টাওয়ার!  আমার প্রথম প্যারিস পরিক্রমা। আলোকের ঝর্না ধারায় ধোয়ানো প্যারিস;  মমারত্রর শ্বেত গিরজের সামনে দাঁডিয়ে দেখি প্যারিস, যতদূর চোখ যায় ,  পাকদণ্ডী  বেয়ে নেমে এলে প্লাস পিগাল , মুলা  রুজ , অনেক ঘুরে মাদলেন, প্লাস ভেন্দম ,  নতর দামের জোড়া টাওয়ার , সেইনের বাঁ পাশ ধরে ,  রিভ গশ , হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা  কাতির লাতাঁ , নেপোলিয়নের  সমাধি অবধি হাঁটা ।  মনে হয়েছে  কোনো  অচেনা শহরে বেড়াতে  আসি নি, আসলে এটা একটা  ফিল্মের সেট; আমি তার মাঝে দু টাকার এক্সট্রার  রোল পেয়ে ঢুকে পড়েছি  ।  নায়ক নায়িকা এখুনি এসে পড়বেন , ডিরেক্টর বলবেন , লাইট,  ক্যামেরা , অ্যাকশন।






    তারপর পঁয়তাল্লিশ বছর কেটে গেল । কখনো এসেছি টুরিস্টের বেশে  ট্রেনে,  বাসে। একদিন উত্তীর্ণ হয়েছি বিজনেস ট্রাভেলারের পর্যায়ে , বিলেতের ট্যাক্স বাঁচাতে অফিসের কাজে লন্ডন থেকে প্যারিস , ক্যালে হতে এ ছাব্বিশ মোটরওয়ে ধরে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে গেছি সাত মাথার মোড়ে, আর্ক দি ত্রিউম্ফ। ব্যবসায়ের দিন ফুরোলে এসেছি গ্রাম থেকে নিছক সপ্তাহান্তে, আগস্ট মাসের জনশূন্য প্যারিসে বিনে পয়সায়  গাড়ি পার্ক করেছি প্লাস ভেন্দমে ।







    বাসতিয়ের লিফট বিহীন পাঁচ তলায় ভাগ করে নেওয়া বাথরুমের হোটেল কামরা থেকে একদিন এসে পৌঁছেছি  প্লাস দে লা কনকর্ড হতে দু পা ফেলে  রু কাস্তিলিওনের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের আপ গ্রেডেড স্যুইটে –রিভোলিতে ছেলে মেয়ের সঙ্গে দেখেছি তুর দে ফ্রন্সের সাইকেল বাহিনীর শেষ চক্কর। কাঁধে ছোট্ট ইন্দ্রনীলকে নিয়ে হেঁটেছি ল্যুভরের আনাচে কানাচে,  সেইন নদীতে সন্ধ্যের নৌকা সফর -বাতো মুশ । রু সাঁ দমিনিকে আউস পারতিকুলেরে নাটিকসিস ব্যাংক, রু সাঁ অনরে বঁক নাসিওনাল দে পারি, রু দে ইতালিয়াঁয় লিওনে । সফল লোন সই সাবুদের পার্টি চলেছে হোটেল ক্রিওঁতে – পায়ের তলায়  কনকর্ড । অফিসের কাজে দেড় ঘণ্টায় উবি সাঁ লউ থেকে এসে কনকর্ডের ভূগর্ভস্থ  গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করে কাজ  সেরে , সন্ধ্যেয় রু রিভোলির দোকানে কেক কিনে বাড়ি পৌঁছেই মায়ার হাতে তা তুলে দিয়েছি । রোদিকার সঙ্গে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ – সকাল বেলা ইনটার কনটিনেনটাল থেকে বেরিয়ে সে ধরেছে ভারসাইয়ের মেট্রো, আমি গেছি আমার কাজে, লা দিফঁস।






    তবু  আমার চিরকালের প্যারিসের ছবি সেই প্রথম সন্ধ্যা - আকাশ বাতাস জুড়ে আলোয় প্লাবিত শঁজেলিজে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই।  

    বরানগরে আমার স্কুলের অনুজ প্রতিম সোমনাথ সেন সেদিন লিখল, হীরেনদা এতো ঘুরেছেন কিন্তু আপনি কি মনে করেন না প্যারিস পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাজধানী শহর ?

    মানতেই হয় সোমনাথ।






    প্রাগ বুদাপেস্ত রোম ভিয়েনা – সুনীল আকাশের তলে সকলই মোহন , সকলই  শোভন । মনে থাকে প্রাগের চার্লস ব্রিজ ছাড়িয়ে মলদাউ নদীর ওপরে সেতুর সারি,  বুদার পাহাড় থেকে দেখা দানিউব , আলোকিত পেস্তের চেন ব্রিজ;  ফোরো রোমানায় স্মরণ করেছি মার্ক অ্যানটনির ভাষণ - আই হ্যাভ কাম টু বেরি সিজার নট টু প্রেজ হিম; ভিয়েনার শোনব্রুন বেলভেদেরে । কিন্তু প্যারিস অনন্য, তার কোনায় কোনায়  পাড়ায় পাড়ায় , প্রতি পদক্ষেপে এক  ঘরোয়া মাধুর্য , এখানে যেন আমার নিত্যি আসা যাওয়া।  এই তো রুটির দোকান,  বাগেত কিনে বাড়ি ঢুকবো ।  তাকে  ভাল না বেসে উপায় নেই।  আমি মনে করি  ফরাসির নয় ,সারা দুনিয়ার  আমাদের সবার শহর প্যারিস । সাধে কি চিরশত্রু ইংরেজ বলে , প্যারিস ইজ এ বিউটিফুল সিটি।  আনফরচুনেটলি ইট ইজ ফুল অফ দি ফ্রেঞ্চ !

    বিচ্ছেদ আসন্ন জেনে কাসাব্লাঙ্কা ছবির অন্তিম  দৃশ্যে রোরুদ্যমানা  ইনগ্রিড বেরগমান বলেন , আমাদের কি হবে ? হোয়াট অ্যাবাউট আস ? হামফ্রি বোগারট তাঁর চোখে চোখ রেখে বলেন, উই উইল অলওয়েজ হ্যাভ প্যারিস।  

    এহ বাহ্য






    গত সপ্তাহে প্যারিস গিয়ে সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্ত হয়েছি ।এতদিনের চেনা শহর কখন কি করে  বদলে গেলো ? প্লাস দে লা কনকর্ডে মিশরের ওবেলিস্কটা আছে কিন্তু তার চার পাশে কীসের মেলা বসেছে ? চতুর্দিকে নীল সাদা  গ্যালারি, তেরপলের ফাঁক দিয়ে কোনমতে শঁজেলিজের শেষ প্রান্তে আর্ক দু ত্রিউম্ফ দেখা যায় , রাস্তা ঘাটের কোন চিহ্ন  নেই ! এই গত এপ্রিল মাসে  এখানে গাড়ি চালালাম , সে রাস্তা গেলো কোথায় ? গ্যালারিতে বসলে দূরে আসেম্বলি নাসিওনালের মাথাটা দেখা যায় কোন মতে,  আর হ্যাঁ আইফেল টাওয়ারটা সেখানেই আছে অন্তত । কনকর্ড থেকে তুইলারির  বাগান  পেরিয়ে ল্যুভর যাওয়া যায় না,  সেখানকার আকাশে উঠে বসে আছে সাদা রঙের এক  বেলুন । এবারের অলিম্পিকে গ্রিস থেকে আনা প্রমেথেউসের আগুন সেখানেই রক্ষিত ।






    প্যারিস অলিম্পিক হয়তো সবার থেকে আলাদা ।

    দেবী দুর্গা কখনো নৌকায় আসেন বটে কিন্তু  জলপথে প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগমন অলিম্পিকের ইতিহাসে কখনো দেখা যায় নি !






    অলিম্পাস পাহাড় থেকে রিলে প্রথায়  আগুন নিয়ে আসার যে রীতি ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে হিটলার  প্রচলন করেন সেটি আজও অব্যাহত । সেই  শিখা হতে অ্যাথলেটিক স্টেডিয়ামে প্রজ্বলিত হয় এক আগুনের বেদি , যার সামনে শপথ নেন সমবেত প্রতিযোগী ।  এবার তার  স্থান হল   ল্যুভরের সামনে তুইলারির  গোলাকৃতি জলাশয়ের উপরে উড়ন্ত এক বেলুনে - একটি বিপুল ব্যতিক্রম !

    প্রথম অলিম্পিক দেখেছি  লন্ডনে ২০১২ সালে,  তারপর রিওতে ।  চল্লিশটার বেশি ডিসিপ্লিন , তার মঞ্চ নানান স্টেডিয়াম-যার কিছু বানানো হয় এই উপলক্ষ্যে,  যেমন লন্ডন স্টেডিয়াম (  এখন ওয়েস্ট হ্যাম ফুটবল ক্লাবের আপন আড্ডা ) এবং স্ট্র্যাটফোরড পার্কে,  যেটা জুড়ে নানাবিধ ক্রীড়ার আয়োজন হয় ।  গ্রিনিচে এবং বিশ বছরের পুরনো ও টু নামক একটি শ্বেত হস্তির মঞ্চে বাস্কেটবল অনুষ্ঠিত হয়। বাকিংহাম প্যালেসের অদূরে হর্স গার্ডের মাঠে ভলিবল ।  রিওতে হকি কায়াকিং সাইক্লিং ক্যানোইং ইত্যাদির জন্য আটটি নতুন স্টেডিয়াম অথবা স্থায়ী গ্যালারি বসানো হয়।  কোপাকাবানায়  বিচ ভলিবলের আসর বসে , সেটি অত্যন্ত মানানসই জায়গা নিঃসন্দেহে !  আমরা তার কাছাকাছি  একটি ফ্ল্যাটে ছিলাম, খেলা চলে অনেক রাত্তির অবধি । ব্রাসিল একটা পয়েন্ট জেতে  আর জনতার উত্তাল চিৎকারে সকলের নিদ্রাভঙ্গ হয় ।

    দেশের বা শহরের কোন আইকনিক অঞ্চলে অলিম্পিক ইভেন্ট আয়োজনের  উদাহরণ আছে - যেমন ২০০০ সালের আথেন্স অলিম্পিকে আদি অলিম্পাস পাহাড়ে হয়েছে শট পুটের প্রতিযোগিতা , মারাথন শহর থেকে ম্যারাথন দৌড়ের বাঁশি বাজানো হয়েছিল। । সিডনির অপেরা হাউসে ট্রায়াথলন ।
















    একটা গোটা শহরকে অলিম্পিক উৎসবের সাজে সাজিয়ে দিয়েছে  প্যারিস ২০২৪!   ঘরের ও  বাইরের কোন  ফারাক রাখে নি।  রাস্তা বন্ধ করে যেমন পূজো বা পাড়ার জলসা হয়  কলকাতায় , ঠিক তেমনি  সমস্ত চেনা জানা চত্বর , বাড়িঘর প্রাসাদের পথ ঘাট আটকে দিয়ে  প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ছয়লাপ হয়েছে প্যারিস শহর । প্লাস দে লা কনকর্ড পরিবর্তিত হয়েছে পার্ক উরবানে  - সেখানে চলছে  স্কেট বোর্ডিং , বি এম এক্স বাইক  দৌড় , সংক্ষিপ্ত ৩ x ৩ বাসকেটবল !




    সাধারণ দিনের শঁজেলিজে





    শঁজেলিজে, মে, ২০২৪


     গ্রাঁ প্যালেতে বসেছে ফেন্সিঙ্গের স্টেজ,  নেপোলিয়নের  সমাধি আঁভালিদের ( Invalides ) চারপাশ কাপড়ে  ঘেরা,  সেখানে ধনুর্বাণ ক্রীড়া হবে, পাতা হয়েছে ঘন নীল রঙের কার্পেট যার ওপর দিয়ে দৌড়ে আসবেন ম্যারাথন যোদ্ধা ,  ত্রকাদেরো ছাড়িয়ে  আইফেল টাওয়ারের অন্য দিকে চলছে জুডো , বিচ ভলিবল, কিছু কুস্তি । স্তাদ দে ফ্রন্সের চেহারা বদলায় নি; আঠারো বছর আগে সেখানে আর্সেনাল বনাম বার্সেলোনার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল দেখতে গিয়েছি,  এখনো তার চেহারা সে রকম। জনতা  সঁ দেনি -পোরত দে পারিতে ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছেন  রাগবি সেভেন কিংবা অ্যাথলেটিকস দেখতে । রোলাঁ গারোস   স্টেডিয়াম  অন্তত বাইরে থেকে তাই আছে কিন্তু  ভেতরে গিয়ে দেখি সুজান ল্যাংলেন কোর্টে জকোভিচ আলকারাজের লড়াই চলছে ; পাশেই ফিলিপ শারতিয়ে কোর্ট ।  যেখানে এককালে বর্গ ম্যাকেনরো ফেদারার নাদাল লাল মাটিতে ধুলো উড়িয়েছেন,  সেখানে বসেছে কুস্তির আখড়া ! লা দিফঁস , গ্রান্দারশ , সেখানে ছিল সিটি ব্যাঙ্কের অফিস, কুর ভালমিতে সসিতে জেনেরাল , সে কতো চেনা ;  তার সামনে সাঁতার চলছে পুলে।  সেখানে  অবশ্য বসানো  হয়েছে কিছু বাড়তি গ্যালারি -সর্বত্র নীল রঙের ছড়াছড়ি !

    মায়া বর্নিত সুসমাচার 

    মায়া জানালে  আজ ঘুম নেই , রাত বারোটা থেকে  সার্ফিং দেখবে !






    তার  পছন্দের ক্রীড়াগুলি অতীব  বিচিত্র – সে নিয়মিত পোলো , স্কিইং এবং মাঝে সাঝে বোরনমাউথে সার্ফিং করে থাকে- যে সব ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার পিতা মাতার চোদ্দ পুরুষের  কেউ কখনো ভুলেও পদার্পণ করে নি । জানতে চাইলাম সেটা কোথায়  হবে? আর এতো গভীর রাতেই বা কেন?  উত্তর পেলাম, ডিসকভারি টি ভিতে দেখাবে, অকুস্থল তাহিতির তেয়াহুপো বিচ , সেটা ফ্রান্সের কোন দেপারতমঁ নয়, একটি স্বায়ত্ত শাসিত এলাকা।  কিন্তু সেটাও  ফ্রান্স। অধিকন্তু  ফ্রান্সের রাত বারোটা তাহিতির সকাল এগারোটা।




    হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল



    সবাই ফরাসি সার্ফিং স্টার কাউলি ভাসতকে দেখতে ব্যস্ত।  হোটেলের লবিতে গলায় মালা পরা একটি তরুণের  কাট আউট আসতে যেতে  অবশ্য চোখে পড়ত । এমন  খ্যাতনামা এক ফরাসি যুবকের সঙ্গে এতদিন পরিচয় হয় নি ভেবে  লজ্জিত হলাম। 

    অলিম্পিকের প্রথম সপ্তাহে কয়েকদিন লিল শহরে ছিলাম , উবি সাঁ লউ  থেকে সওয়া ঘণ্টার পথ । সে শহরে উত্তেজনা ক্ষীণ , ভিড় কম,  টিকেট মেলে সহজে ।  পিয়ের মরোয় স্টেডিয়ামে  আট বছর আগে ইউরো ২০১৬র সময়ে বেলজিয়াম বনাম ওয়েলসের ফুটবল ম্যাচ দেখেছিলাম। এবার ভেতরে গিয়ে দেখি ঘাস অদৃশ্য , বিশাল বাস্কেটবলের চত্বর সেখানে।

    ভগ্নদূতের মতন মায়া নিয়মিত নানান সংবাদ পরিবেশন করে –

    উদ্বোধনী উৎসবে অলিম্পিক পতাকা উলটো করে টাঙ্গানো হয়েছে।  দক্ষিণ কোরিয়ান টিমকে উত্তর কোরিয়ান বলে ঘোষণা করা হয় সেই নৌ মিছিলে।

    ইউ এস এ বনাম সাউথ সুদানের বাস্কেটবল ম্যাচে সুদানের জাতীয়  সঙ্গীত বাজানো হয়।

    টেবিল টেনিসের একটি পদক অনুষ্ঠানে চিন দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে , প্রথমবার।

    বর্শা ছোঁড়ার বিজয়ীর পোডিয়ামে  দাঁড়িয়েছেন পাকিস্তান , ভারত ও গ্রানাডার অ্যাথলিট।  ইতিহাসে এই প্রথম কোন ইউরোপীয় বা আমেরিকান বা সাদা মানুষ সে পোডিয়ামে স্থান পান নি।




    পতাকা হাতে ভারতীয় সমর্থক


    সেইনের জল এমনই দূষিত যে ট্রায়াথলনে এক জন বেলজিয়ান সাঁতারু ইকোলাই রোগে আক্রান্ত হলে বাকি  টিম জলে নামতে অস্বীকার করে । তাদের দেখাদেখি সুইজারল্যানড তাদের টিমও তুলে নেয় ।






    বিশ্ববিদ্যালয় শহর নামে লিলের পরিচিতি  ( শারল দ্য গলের জন্মস্থানও বটে )- গরমের ছুটিতে ছাত্র ছাত্রীরা  বাড়ি গেছে ,  অতএব সেই খালি হস্টেলের ঘর গুলিকে ফরাসি অলিম্পিক কমিটি অ্যাথলিটদের বাসস্থানের জন্যে নির্দিষ্ট করেছেন।  বেজায় গরম ( লিলে প্রতি দিন ৩২ ডিগ্রি পেয়েছি) ; এয়ার কনডিশনিং ব্যাপারটা ফ্রান্স বা ইংল্যান্ড কেন গোটা ইউরোপেই বিশেষ প্রচলিত নয়।  ঘুমোতে না পেরে অনেকে বাইরে ঘাসের ওপরে বসে রাত কাটিয়েছেন।




    লিলের সন্ধ্যে


    প্যারিসে এক ইতালিয়ান স্বর্ণ পদক বিজেতা তাঁর  বিছানার চাদর  পার্কে পেতে শুচ্ছেন- সে ছবি চাউর হল ।   

    সিফান হাসান নেদারল্যান্ডের হয়ে ইতিহাসে প্রথম মহিলা অ্যাথলিট হিসেবে অলিম্পিকে পাঁচ হাজার দশ হাজার মিটার ও ম্যারাথন দৌড়  জিতেছেন । তিনি জন্মসূত্রে ইথিওপিয়ান, রানি শিবার দেশের মানুষ। কেনিয়ার সালপেটার  এবং মেরিনগর এবারে মহিলাদের ম্যারাথনে দৌড়েছেন যথাক্রমে ইজরায়েল ও রোমানিয়ার হয়ে। 

    মনে রেখে  দেবো 

     
    প্যারিসের বিতিকিচ্ছিরি গরম ভুলে যাবো ।  ভুলে যাবো কোন খেলা চাক্ষুষ দেখেছি , কে কটা মেডেল পেলেন ।






    চির চেনা প্যারিসের অন্য রূপ মনে রেখে দেবো । ভোরের আলোয়  আইফেল টাওয়ারের সাময়িক স্টেডিয়াম ঘিরে ৩৫ কিলো মিটার পথ চলার প্রতিযোগিতা – রেলিঙের পাশে  সারা পৃথিবীর মানুষের মুখ!  এতো রকমের এতো রঙের যে পতাকা আছে !  মায়ের কোলে বসে স্প্যানিশ পতাকা হাতে শিশু , জানলা দিয়ে বিশাল ফরাসি পতাকা দোলাচ্ছেন এক মহিলা, সবার শেষে যে স্লোভাক চলা  শেষ করলেন তাঁকে সম্বর্ধনা জানালেন হাজার মানুষ ।




    মায়ের কোলে বসে স্প্যানিশ পতাকা হাতে শিশু


    ফরাসি জাতীয় সংগীত



    স্টেডিয়ামের ভেতরে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সমবেত জনতা গাইছেন-  লা মারসেইস,  অকস্মাৎ অজস্র আইরিশ কণ্ঠে বাজে ওরান না ভিঅন – সৈনিকের গান , ও কানাডা , আইনিগকাইট উনড  রেখট উনড  ফ্রাইহাইট, অ্যাডভানস অস্ট্রেলিয়া ফেয়ার ! হার বা জিত যাই হোক না কেন , আপন পতাকা গায়ে জড়িয়ে চলে নানান দেশের মানুষের মিছিল।  






    পথে শুনি সারা ইউরোপের , বাকি পৃথিবীর চেনা অচেনা ভাষা ।  মাটির তলার প্যারিস আছে তার পুরনো চেহারায় তবে সেখানে অন্য উন্মাদনা - মেট্রোর কামরায় কেউ  পতাকা উঁচু করে গান ধরেছেন । সেইনের ধার ধরে হাঁটি  মুজে দরসে থেকে পঁ আলেক্সান্দ্র সেখানে আবার নীল কার্পেট,  আঁভালিদের শিখর,  গ্রাঁ প্যালের কাচের চুড়ো । নদীর ধারে সুখী জনতার সমাবেশ, আচমকা গজিয়ে ওঠা অগুনতি কাফের চেয়ারে বসে, গা এলিয়ে টেলিভিশনে দেখছেন অলিম্পিকের খেলা ধুলো । যাবতীয় পথে গাড়ি চলা নিষিদ্ধ । আগস্ট মাসের  এই উদার আলোয় দিগন্ত বিস্তৃত অপরূপ প্যারিস । মেট্রো স্টেশনে স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকার ভিড়  ; তাদের  ইংরেজি সীমিত কিন্তু সাহায্যের আগ্রহ অসীম ।
     
















    মধ্য রাতে কোনো  স্টেডিয়াম থেকে বেরুচ্ছি, যেখানে সেখানে পুলিশ পথ আটকে দিয়ে বলে এ স্টেশন এখন বন্ধ ,  পরের স্টেশনে যান এই রাস্তা ধরে । সে অন্তত  দু কিলো মিটার,  কেউ প্রতিবাদ করে  না।  

    সারাদিনের উষ্ণতার শেষে মন্দ মধুর বাতাস উঠেছে। আহা কি সুন্দর এই সন্ধ্যে , অজস্র মানুষের,  হাজার পতাকার রঙ্গিন মিছিলের সঙ্গে  পা মিলিয়ে চলি ।  চারিদিকে শান্ত বাতি মৃদু কলরব ।






    আজ না হয়  জুতো হাতে হেঁটে যাবো বাড়ি ।

    এই প্যারিস আজ আমাদের ।  




    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ আগস্ট ২০২৪ | ৪৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৮:১১536807
  • ক্যা বাত! মন ভরে গেল।
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ২৫ আগস্ট ২০২৪ ০০:৩৫536820
  • বাঃ, খুব ভালো লাগল। দুই প্যারিসের চমৎকার মেলবন্ধন। প্যারিসের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
  • শিবাংশু | ২৫ আগস্ট ২০২৪ ১২:৫৩536834
  • আপনার এই লেখাগুলি পড়লে  এই শ্যেরটি মনে পড়ে যায়, 

    जिस दिन से चला हूँ मिरी मंज़िल पे नज़र है,
    आँखों ने कभी मील का पत्थर नहीं देखा...

    (बशीर बद्र) 

    ক্যা খুব, 
  • হীরেন সিংহরায় | ২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৭:০৩536838
  • ঠিক শিবাংশু! মাইল ফলক কে গোনে ! কোথায় যাচ্ছি কে জানে ! দি পারটি ছবির শেষ দৃশ্যে পিটার সেলারসকে একজন জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছেন!সেলারস বলেন
    I don't know and I don't care!
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন