আমার হিরো
সিনেমা জগতে আমাদের সবার একজন হিরো থাকেন ।আমাদের বয়েস বেড়ে যায় , তাঁদের বাড়ে না, অন্তত আমাদের মনের গভীরে। সেখানে তিনি চির তরুণ ।
আমার হিরো দেব আনন্দ।
দেব আনন্দের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঝরিয়া ( সে আমলে বিহার,আজকের ঝাড়খণ্ড ) শহরের ভিহার টকিজ সিনেমায় ; তৎকালীন বিহার প্রদেশের একমাত্র শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চিত্রগৃহ। ছবির নাম সি আই ডি। একা সিনেমা দেখার স্বাধীনতা পেতে অনেক দেরি কিন্তু হোলি হ্যায় এই আওয়াজ তুলে পাড়ার বড়োদের সঙ্গে কিছু বালকের দলে আমিও ভিড়ে গেছি; টিকিটের লাইন হলের পেছন দিকে একটা লম্বা খাঁচায় , সেখানে গরমে ঘামে জামা ভিজে যায় । সে যাবত বাবা মায়ের সঙ্গে একটি মাত্র হিন্দি সিনেমা দেখে জেনেছি রাজ কাপুর নামক ভদ্রলোক জাপানি জুতো এবং ইংরিজি প্যান্ট পরেন – ছবির নাম শ্রী ৪২০। এবার রুপোলী পরদায় আমার সামনে আবির্ভূত হলেন দেব আনন্দ - ‘আঁখো হি আঁখো মে ইশারা হো গয়া ‘ সে ইশারা তিনি অভিনেত্রী শাকিলাকে করছিলেন কিন্তু সেই সঙ্গে আমার মন জয় করে নিলেন। জনি ওয়াকারের ওপরে চিত্রায়িত ‘ ইয়ে হ্যায় বমবই মেরি জান ‘ গানের সঙ্গে সঙ্গে বোম্বের বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখা হয়ে গেলো ।
বাবা ঝরিয়া শহরের অদূরবর্তী সেন্ট্রাল তিসরা নামের এক কয়লা খনির ম্যানেজার ছিলেন – বাংলোটি ছড়ানো, প্রশস্ত ঘর , উঁচু সিলিং - বিজলি বাতি ছিল না , বাগান ছিল। পাকা রাস্তা দু মাইল দূরে । দেয়াল ঘেরা ছোট্ট পাড়া । তার নাম ফড়িয়া - সে নামের সূত্র কখনও জানা হয়ে ওঠেনি। আমাদের পাশাপাশি থাকতেন গোদাম বাবু , খাজাঞ্চি বাবুরা । সভ্যতাকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়ে সেন্ট্রাল তিসরা পৌঁছুতে গেলে চরণ বাবুর গাড়ি সমেত বিবিধ যান বাহনের সহায়তা নিতে হতো।মায়ের কাছে এই তিসরা কোলিয়ারির অন্য নাম ধাপধাড়া গোবিন্দপুর। লোদনা নামক একটি ছোটো জনপদে নিকটবর্তী স্কুল - মাইল দুয়েক হেঁটে যাওয়া । হয়তো সে কারণেই আবদার করেছিলাম বাড়িতে থেকে বাবার কাছে পড়ব । সারাদিন কাজের শেষে বিদ্যাদানের এই ঝামেলা থেকে ছুটি পাওয়ার অভিলাষে হয়তো তিনি চাকরি বদল করে আমাদের শহর ঝরিয়াতে নিয়ে গেলেন - ঘরে প্রথম ইলেকট্রিকের আলো দেখলাম , প্রথম স্কুলের মুখ দেখলাম । ঝরিয়া বঙ্গ বিদ্যালয়: প্রধান শিক্ষক প্রয়াত বন বিহারি সরকার ।
আমলাপাড়ায় থাকি । এই দু বছর আগে সেই বাড়ি দেখে এলাম কিছুই বদলায় নি । আশ্চর্যের বিষয় সে বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা ডাক্তার সুভাস দত্ত আমায় চিনলেন সে আমলে তাঁদের ভাড়াটে ছিলাম।
স্কুলে যাবার পথে বাঁ পাশে পড়ে রাজবাঁধ নামের এক বিরাট দিঘি , পরের মোড়ে বসন্ত ফারমাসি (এখনও আছে), বাটার দোকান, উলটো দিকে ধানবাদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ইশকুলের সামনে আলুকাবলিওলা (আমরা বলতাম আলু কচ্চ ) হজমি গুলি বিক্রেতা । আহা কি সুন্দর সে সব দিন ।
স্কুলের সামনের দেওয়ালের নিচের দিকটায় সিনেমার ইস্তেহার সাঁটা, মাঝারি সাইজের। তার মধ্যে থাকত সিনেমার নাম , নায়ক নায়িকার অস্পষ্ট ছবি এবং তিনটে ছটা নটার সময় সূচি ! একেবারে নিচে বোল্ড অক্ষরে ভিহার টকিজ । শহরে আরেকটি সিনেমা হল , দেশবন্ধু -এখনও তেমনি আছে। সেখানে বাঙলা হিন্দি দুই রকম ছবি দেখানো হতো।
বাড়িতে ব্যাটারি চালিত রেডিওতে কলকাতা ক এবং খ পাওয়া যায় – ক্রিকেটের, ফুটবলের ধারা বিবরণী শুনি। পিয়ারসন সূরিটা সিডনি ফ্রিস্কিনের ইংরেজি বুঝি না তবে স্কোর জানা দরকার – কারণ সে আমলে বাড়িতে যে যুগান্তর কাগজ আসতো তার পোশাকি নাম মফঃস্বল সংস্করণ – দু দিনের পুরনো। কমলদা (ভট্টাচার্য ) অজয় বসু ইডেন গার্ডেনের সঙ্গে পরিচয় করালেন! পুষ্পেন সরকার মোহনবাগানের সঙ্গে । সেই ভালবাসা আমার রক্তে, নিশ্বাসে প্রশ্বাসে -থাকবে যতক্ষণ শ্বাস আছে।
রেডিও সিলোন শুনতাম শর্ট ওয়েভ পঁচিশ মিটার ব্যান্ডে । ভারতীয় বেতার সরকারি – সেখানে বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, কিন্তু কলম্বোতে নয়। সন্ধ্যে ঠিক ছটায় প্রসন্ন লঙ্কা নামক তামিল প্রোগ্রাম শেষ – হিন্দি অনুষ্ঠান শুরু । সেখানে বাজত হিন্দি ছবির গান - সায়গল থেকে রফি হেমন্ত লতা ।
অপেক্ষা করতাম বুধবারের- সন্ধে আটটা থেকে নটা অবধি চলত বিনাকা গীতমালা - আজকের ভাষায় হিট প্যারেড , যেখানে পরপর বাজে ষোলটি গান। গানের জনপ্রিয়তাকে মিটারের মতো সংখ্যা দিয়ে মাপা হয়েছে –গান গুলি মার্কস পেতো। সপ্তাহের এক নম্বর গানের সম্মানে বিউগল বাজত আর তার সঙ্গে বিনাকা গীতমালার সিগনেচার টিউন- স্প্যানিশ জিপসি ডান্স , যেটা অনেক পরে জেনেছি । দেশে গানের রেকর্ড বিক্রি এবং শ্রোতাদের ভোট অনুসারে স্থির হয়েছে সেই ষোলটি সিঁড়ির মাপ। হিন্দিতে পায়দান । কোনদিন কোন গান প্রথম স্থান পাবে তাই নিয়ে আমাদের মধ্যে সে কি উত্তেজনা! আমিন সায়ানির অসাধারণ কণ্ঠ কোনদিন ভুলব না । আমার শোনা বেতার জগতের সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী আমিন সায়ানি, তিনি অনন্য - স্বয়ং ঈশ্বরও দ্বিতীয়টি সৃষ্টি করতে পারবেন না।
ভর সন্ধ্যেয় লেখা পড়া মুলতুবি রেখে লারে লাপ্পা গান শোনার ব্যাপারে বাবার সাতিশয় আপত্তি ছিল। মা বলতেন আহা হফতায় একদিন তো!
আমার স্মৃতিতে দেব আনন্দ জড়িয়ে আছেন তাঁর ছবির অজস্রে গানেও । ও পি নাইয়ার , শচিন দেব বর্মণ , শঙ্কর জয়কিশন সঙ্গীত জগত কাঁপিয়ে দিচ্ছেন - বিনাকা গীতমালায় বাজে - লেকে পেহলা পেহলা প্যার , মানা জনাব নে পুকারা নহি সে , ইয়াদ কিয়া দিল নে কাহাঁ হো তুম ‘। সে বছর সি আই ডি ছবির ‘ ইয়ে হ্যায় বম্বই মেরি জান’ বিনাকা গীতমালার বর্ষশ্রেষ্ঠ গান । তার বছর দুই বাদে বাদে দেশবন্ধু সিনেমাতে দেখেছি সোলভাঁ সাল- মাউথ অর্গানের সঙ্গে ট্রেনের কামরায় দেব আনন্দের ওপরে ফিল্মায়িত সেই অমর গান ‘ হ্যায় অপনা দিল তো আওয়ারা’। ১৯৫৮ সালের বার্ষিক বিনাকা গীতমালার অনুষ্ঠানে সে গান এক নম্বরে –স্কোর ৪৮০ - গীতমালা শুরু (১৯৫২) হবার পর থেকে সেটাই একেবারে টপ মার্কস।
কালাপানির ‘ হম বেখুদি মে তুমকো পুকারে চলে গয়ে‘ রেডিওতে বাজছে – মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন “ হ্যাঁরে , এটা তো শচিন দেবের একটা গানের সুর - ঘুম ভুলেছি নিঝুম । হিন্দিতে কেউ চুরি করেছে বুঝি? তোদের স্কুলে যেমন টোকাটুকি হয় বলে শুনি।“
মাকে বলতে হলো , অন্য কেউ নয়, শচিন দেব ( আমাদের কাছে ওই নাম চালু ছিল) নিজের বাংলা গানের সুরে হিন্দি গান করেছেন!’। ‘অমরদীপ’ এবং ‘ কালা বাজার’ সিনেমার পরে মাথার চুল ফাঁপিয়ে আঁচড়ানো কি ভীষণ চালু হলো – ‘দেখ হমে আওয়াজ না দেনা’ ও ‘ খোইয়া খোইয়া চাঁদ’ লোকের মুখে মুখে ফেরে।
একদিন শোনা গেল দেব আনন্দ ফিল্মের দলবল নিয়ে কয়লাখনি অঞ্চলের কাতরাসে এসেছেন একটি ছবির শুটিঙে – তার নাম শরাবি । ঝরিয়া থেকে কাতরাস বিশ কিলো মিটার , বাসে এক ঘণ্টা কিন্তু যাবো কার সঙ্গে ? দেব দরশনের অনুমতি পাওয়া গেলো না । প্রিয় বন্ধু পরম ভট্টারক লাহিড়ীর বাবা প্রয়াত প্রমোদ লাহিড়ী অন্তত সিনেমার খাতিরে তাকে বাড়ি থেকে পালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন, সে ভাগ্য করি নি।
তারপর কলকাতা – বরানগর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরে বিদ্যা অর্জনের প্রয়াসের প্রারম্ভ দেব আনন্দ ছেয়ে আছেন – পূর্ণশ্রীতে দুবার দেখেছি জব প্যার কিসিসে হোতা হ্যায় , হম দোনো ; মৃণালিনীতে বাত এক রাত কি । ক্লাস নাইনে পড়ি নতুন ছবি এসেছে - একদিন টিফিনের পরে অরুণ আর আমি স্পোর্টস রুমের ছাদে লাফ দিয়ে নেমে পেছনের গেট টপকে কামারহাটির মুক্তি সিনেমায় তেরে ঘরকে সামনের ম্যাটিনি শো দেখতে গেছি । কুতুব মিনারের ওপরে দাঁড়িয়ে দেব আনন্দ নূতনকে বলছেন, আমরা অনেক ওপরে উঠেছি কিন্তু দুটো মাত্র জিনিস আমাকে আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে । নূতন বললেন সেটা কি ? উত্তর: খুদা আউর প্যার ! কুতুবের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেব আনন্দ নূতনকে শোনাচ্ছেন ‘দিল কা ভওঁর করে পুকার , প্যার কা রাগ সুনো রে ‘। পরের দিন শুনলাম টিফিনের পর ক্লাস নাইনে ছাত্র সংখ্যা কম হয়ে গেছে দেখে হেড সার প্রয়াত দীনেশ মজুমদার নাকি হাজিরা খাতা আনবার জন্য আসনারায়ণকে ডাক পাঠিয়েছিলেন , তবে আমাদের সৌভাগ্য বশত সে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল ।
চাকরি শুরু- অবিস্মরণীয় জলপাইগুড়ি , স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া । ব্যাঙ্কের বাইরে আমতলায় মোহনদার চায়ের দোকানের আড্ডায় দেব আনন্দ প্রসঙ্গ উঠলে পর সুজিত বললে ‘ আরে আমি তো তারে দেখসি‘।
কোথায় কোথায় ?
সুজিত বললে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে । ওই যে জব প্যার কিসিসে হোতা হ্যায় সিনেমার শুটিং চলছিল তখন । তিনি কি চমৎকার মজার মানুষ, সবার সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বলেন - চা খাইয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বতাও মেরি উমর ক্যা হ্যায় ?’
একদিন দেশ ছেড়েছি। দেব আনন্দ সঙ্গে থেকে গেছেন । বহু বছর আগে তাঁকে চাক্ষুষ দেখার যে সুযোগটি এসেছিল সেটি কি আর কখনও আসবে ?
পঞ্চাশ বছর পরে বিড়ালের ভাগ্যে শিকা ছিঁড়িল।
নিক ( নিকোলাস ) ফিলপট ডারহামের ইংরেজ যুবক । সে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি হিসেবে যোগ দেয় । তার শিক্ষানবিশির একটা পর্ব কাটে আমার দফতরে। সকল সামার ইন্টার্ন এবং ট্রেনীদের সঙ্গে সুযোগ পেলেই গল্প করতাম – কিছু জ্ঞান বিতরণ করা আর এই আজকের যুবা পিড়ি কি ভাবছে সেই জ্ঞান আহরণ করা ! মজার কথা জানলাম নিকের কাছে - তার বাবার পেশা হলো বিভিন্ন ইভেন্টের লাঞ্চ বা ডিনারের ডিজাইন করা – ক্রিয়েটিভ থিঙ্কিং ! নিক একটা এক্সট্রিম উদাহরণ দিলো- ডিনার শুরু হবে সিগার দিয়ে, তার পরে কফি, মিষ্টি, প্রধান পদ , শেষে সুপ- মানে খাবার ক্রমটাকে উলটে দেওয়া! তারপর মাঝে সাঝে ফোন করতো - একদিন শুনলাম প্রথম পাকা পোস্টিং নিয়ে সে আমাদের লাগোস অফিসে গেছে , নাইজেরিয়াতে ।
হঠাৎ তার ফোন । নিক লন্ডনে ফিরে এসেছে, বিদেশি মুদ্রা বিনিময় বিভাগে কাজ করে দোতলায় । কুশল সংবাদ বিনিময়ের পরে নিক প্রশ্ন করলো আমি হিন্দি সিনেমা দেখি কিনা । আমি জানালাম দীর্ঘকাল তোমাদের মত ফিরিঙ্গির দেশে কাটালেও কিছু অভ্যাস থেকে গেছে।
‘মিস্টার দেব আনন্দ বলে একজন অভিনেতার নাম শুনেছেন? ‘
বলে কি ? এ দেশের একটি ইংরেজি পরিহাস আমার শোনা । প্রশ্ন : বিয়ার নেবে ? উত্তর : এটা কি কথা হলো? পোপ কি ক্যাথলিক? ( ইজ পোপ ক্যাথলিক ?)।
যেমন আমাদের হ্যাংলাকে জিজ্ঞেস করা হল , খাবি? হ্যাংলা বললে হাত ধোব কোথায়?
‘দেব আনন্দ লন্ডনে এসেছেন । আমার বন্ধু কেনি মুর তাঁর ইভেন্ট ম্যানেজার । পরশু সন্ধের কোন অনুষ্ঠান স্থির হয় নি ।সেটা খালি রাখা যায় না । একটা ব্যবস্থা করতে হবে । আপনি কি তাঁকে সেই সন্ধ্যেয় হোস্ট করতে পারেন? আমি থাকব না তবে বলে রাখি, দেব আনন্দের ছেলে সুনীল এবং অক্সফোর্ডের দুটি মেয়ে থাকবে । তারা আমেরিকান ট্রিপের আয়োজন করছে , সব মিলিয়ে ধরুন পাঁচ, ছ জন ।
অবশ্যই করবো । পোপ কি ক্যাথলিক ?
আমি কোন কোম্পানি চালাই না তবে বহুদিন আগে ক্রিস রকেট নামের এক বাণিজ্য সহযোগীর প্ররোচনায় আমি ইনস্টিটিউট অফ ডিরেক্টরসের খাতায় নাম লেখাই । এ কেলাব যে স্বয়মাগতদের পাত্তা দেয় না সে প্রসঙ্গ তুললে ক্রিস বলেছিলেন , তোমার আমন্ত্রণের ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি কিন্তু মনে রেখো মেম্বারশিপ ফি তোমার ব্যাঙ্ক দেবে না – এটি ব্যক্তিগত সদস্য চুক্তি । এটিকে সযত্নে রক্ষা করে চলেছি আজও।
প্রসঙ্গত যারা আরাউনড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ পড়েছেন তাঁরা জানেন ফিলিয়াস ফগ রিফরম ক্লাবের সদস্য ছিলেন – সেখানেই তিনি আশি দিনে ভু প্রদক্ষিণের বাজি ধরেন। সেই ক্লাব ইনস্টিটিউট অফ ডিরেক্টরসের পাঁচটি বাড়ির পড়েই, ১০৪ প্যাল মাল ।
দেব আনন্দ সপুত্র লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে উঠেছেন। কেনি মুর বললে অনুষ্ঠানটি সে অঞ্চলে করাই ভালো।
রিজেনট স্ট্রিটের কোনায় , ট্রাফালগার স্কোয়ারের অনতিদূরে ১১৬ নম্বর প্যাল মালের ইন্সটিটিউট অফ ডিরেক্টরসে আমার প্রিয় তারকা দেব আনন্দ উদিত হয়ে শ্যাম্পেন বারটি আলোকিত করে দিলেন। বয়েস মাত্র ৮৫ ! তাঁর পাশে আমাকে বৃদ্ধ মনে হয় । সঙ্গে স্কটিশ যুবক কেনি মুর, ছেলে সুনীল আনন্দ এবং দুটি তরুণী ।
দেব সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে প্রথম কি কথা বলেছি আজও মনে নেই – সত্যি বলতে সেই সন্ধের তাবৎ ঘটনাবলি আমার স্মৃতিতে একটা ঝাপসা ছবি । নিজের গায়ে চিমটি কাটতে ইচ্ছে করেছে । আমি দেব আনন্দের সামনে বসে আছি? ঠিক দেখছি ? হিরো ওয়ারশিপ কথাটা শোনা ছিল – এইবার বুঝিলাম সেটি কি কঠিন বস্তু!
দেব আনন্দ শুধু খ্যাতনামা অভিনেতা নন তিনি একটি যুগের প্রতিভূ । এতো বড়ো মাপের মানুষ কেমন স্বচ্ছন্দে আমাদের সঙ্গে মিলে মিশে আড্ডা দিলেন ! পানের ব্যাপারে নিজে অত্যন্ত সংযমী - সারা সন্ধ্যে একটি ওয়াইন গ্লাসকে শূন্য হতে দিলেন না । কিন্তু আমাদের অসৎপথে চালাতে উদ্যোগী হয়ে পড়লেন – আভি জওয়ান হো, অব নহি তো কব পিওগে?
সেই কণ্ঠ, সেই সুর- মেরা নাম জনি নহি হ্যায়!
প্রশ্নের লাইন মনের ভেতরে। কত কথা জিজ্ঞেস করতে চাই ! কাতরাসে শরাবি ছবির শুটিঙের গল্প এবং সেখানে যেতে না পারার দুখভরি কহানি পেশ করলাম । জায়গার নাম তাঁর মনে নেই কিন্তু কয়লা খনিতে শুটিঙের এবং জীবনে একবার মাত্র তিনি একটা গোটা ছবিতে মদ্যাসক্ত মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বলে শরাবি ছবিটি তাঁর প্রিয় । মনে করিয়ে দিলাম তিনি আমাদের পোশাকের কায়দা শিখিয়েছেন - গলায় রুমাল বাঁধা , শার্টের কলার ওলটানোর স্টাইল কিন্তু রূপ কি রানি চোরোঁ কা রাজা ছবিতে তিনি একবারও ড্রেস বদলান নি !
অচ্ছা ! ইয়াদ হ্যায় ?
দুটো ওয়াইনের পরে দুঃসাহস বাড়ে । বললাম শোনা যায় আপনি একদিন জুহু বিচ ফ্রন্টে গাড়িতে যাচ্ছিলেন । আপনার সঙ্গী একটা বিশাল হোরডিঙ দেখিয়ে বলেন, , দেব সাব , এই নায়ককে দেখে রাখুন এ হলো সুপার স্টার – রাজেশ খান্না ‘। আপনি সেদিকে না তাকিয়ে জবাব দিয়েছিলেন ‘ আজ থেকে পঁচিশ বছর বাদে আমাকে জানিও তো তখনও সে স্টার কিনা ‘। সেই অসাধারণ মিষ্টি হেসে দেব সাব বললেন, ‘ ইয়েস বাট নট এক্স্যাক্টলি ইন দোজ ওয়ার্ডস , ইয়াং ম্যান ‘।
দেব পুত্র সুনীল আনন্দ আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন আপনি গাইডের ইংরেজি ভার্সন দেখেছেন?
অনিতা কেনি মুর দেব আনন্দ
দেখি নি ।
ইংরেজি গাইড কোথাও কোনো হলে রিলিজ হয়েছিল বলে শুনি নি । সুনীল তাঁর ব্যাগ থেকে একটা ভিডিও ক্যামেরা খুলে খানিকটা দেখালেন – আর কে নারায়ণের গল্প , নোবেল বিজয়িনী পার্ল বাকের চিত্রনাট্য, টেড ডানিয়েলেউস্কির পরিচালনা( অনেক পরে ইউ টিউবে দেখেছি, দারুণ প্রোডাকশন, আজকের যে কোন ইংরেজি ছবির সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে )। সুনীলকে বললাম, আমার সবচেয়ে স্মরণীয় সিকুয়েন্স কোনটা জানেন ? সেই যে এক আমেরিকান রিপোর্টার দেব আনন্দকে প্রশ্ন করছেন, স্বামীজি , হ্যাভ ইউ এভার বিন ইন লাভ ? আর ঠিক সেই মুহূর্তে রোজি মারকো গাইডের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন?
দেব আনন্দ স্মিত মুখে বললেন আই হোপ নো ওয়ান ইজ গোয়িং টু আসক মি অ্যাবাউট মাই পারসোনাল লাভ লাইফ দিস ইভেনিং !
সুরাইয়ার প্রেম প্রসঙ্গ তোলার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন, একটি বাক্যে !
ফাইল ছবি: গীতাবালি , সুরাইয়া ( একমাত্র প্রেম!) নিম্মির সঙ্গে দেব আনন্দ
কথায় কথায় কোথায় যে চলে যাই । ক্রমশ আমার ধৃষ্টতা বাড়তে থাকে । এক সময়ে বললাম , একটা সংলাপ আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই ! একবার !
চোখ তুলে দেব সাব বললেন, ফ্রম মেমারি ?
‘ডায়ালগ আমি বলে দেবো। তবে আপনার মুখে শুনতে চাই!
‘কোশিশ করেঙ্গে ‘
‘গাইড ছবিতে সেই যে আপনি খড় ভর্তি ট্রাকের পেছনে বসে রোজি মারকো বেশি ওয়াহিদা রেহমানকে বললেন, কল তক আপ লগতি থি চালিস সাল কি আউরত …’
আমার বাক্য শেষ হলো না - সেই চির চেনা সুরে মাথাটি হেলিয়ে বললেন
‘মেরে সমঝ মে ইয়ে নহি আয়া - কল তক আপ লগতি থি চালিস সাল কি আউরত, জো জিন্দগি কি হর খুশি, হর উমংগ রসতে মে কহিঁ খো আই হ্যায় “।
টেবিলে রাখা আমার বাঁ হাতটি ধরে, আমার স্তম্ভিত মুখের দিকে চেয়ে দেব সাহেব বললেন, ‘রাইট ? “
অবিস্মরণীয় মুহূর্ত
গাইড বেরুনোর তেতাল্লিশ বছর বাদে লন্ডনে ইন্সটিটিউট অফ ডিরেক্টরসের শ্যাম্পেন বারে বসে পঁচাশি বছরের দেব আনন্দ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন আমার ছেলেবেলায় , দমদমের মৃণালিনী সিনেমায়- এই তো আমার স্কুলের প্রদীপ্ত , অরুনের পাশে বসে গাইড দেখছি । বাবা চলে গেছেন আগের বছরে। স্কুলের পালা শেষ করে এবারে কলেজ । তারপরে কপালে কি লেখা আছে কে জানে, জীবনে সবই তো বদলিয়ে যায় ।
দেব আনন্দ থেকে যান ।
ছ মাস আগে তাঁর আত্মজীবনী রোমান্সিং উইথ লাইফ প্রকাশিত হয়েছে । সুনীলের কাছে চাইলেন বইয়ের কপি । সই করে সেটি আমার হাতে তুলে দেওয়ার সময় খুব নিচু স্বরে দেব আনন্দ বললেন ,
‘নেভার লেট ইয়োর ইমোশনস রুইন ইয়োর লাইফ’ ।
পুনশ্চধরমদেব পিশোরিমল আনন্দ: জন্ম শকরগড় (অধুনা পাকিস্তান) পাঞ্জাব ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৩
১১২টি ছবি
প্রথম ছবি হাম এক হ্যাঁয় ( ১৯৪৬ )
শেষ ছবি চার্জশীট ( অক্টোবর ২০১১)
নিজস্ব প্রোডাকশন ব্যানার নব কেতনের হয়ে দেব আনন্দ তিরিশের বেশি ছবি প্রযোজনা করেন ; তার মধ্যে হম দোনো , জুয়েল থিফ এবং হরে রামা হরে কৃষ্ণা থেকে যাবে সবার স্মৃতিতে ।এখন সুনীল আনন্দ নব কেতনের কর্ণধার।
মৃত্যু ওয়াশিংটন হোটেল, মেফেয়ার , লন্ডন, শনিবার ৩ ডিসেম্বর ২০১১
শেষকৃত্য পাটনি ভেল, দক্ষিণ লন্ডন , শনিবার ১০ ডিসেম্বর ২০১১
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।