হীরেনদার কিছুক্ষণ সিরিজ আমার প্রিয়। এটা পড়ে আমার পরবর্তী সিক্যুয়েল "অবাক রামধনু" লেখার একটি অংশ এই লেখার অনুরণন হিসেবে তুলে দিচ্ছি:
"পিতাশ্রী মেসের বোর্ডার হিসেবে মোটামুটি সতেরো থেকে পঁচিশ - এই সময়কালটি জীবনের একটি সুবর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে গড়ে ওঠা অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব জীবনের অমূল্য সম্পদ। তেমন বন্ধুত্ব হয় মুষ্টিমেয় কয়েক জনের সাথেই। তেমন বন্ধুত্বে সেভাবে উপলব্ধি হয় না কোনো শর্ত, চাহিদা, আদানপ্রদাণের টানাপোড়েন। পীড়িত করে না সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, উপার্জন ইত্যাদি নিয়ে তুলনামূলক হীনমন্যতাবোধ। প্রতিষ্ঠার ঝলমলে আলখাল্লা সত্তায় চাপতেও ঢের দেরী। নিছক একে অন্যের সাহচর্য উপভোগ করতে চাওয়ার আনন্দ - সেই কালে সেটাই তখন অন্তরঙ্গ সম্পর্কের আঠা। সেই সমীকরণ কিছু ক্ষেত্রে ক্রমশ বিবর্তিত হতে শুরু করে জীবিকার সোপান বেয়ে কে, কোথায়, কত তাড়াতাড়ি উঠে যায় তার ভিত্তিতে। কখনো তা ভবিষ্যতে বদলে যায় অসমীকরণে বা চলে যায় কোমায়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পরেও যাদের জীবনে তেমন কিছু অতীত বন্ধুত্বের টান রয়ে যায় - তারা ভাগ্যবান। তেমন বন্ধুত্বও মহার্ঘ্য।
পঁচিশ থেকে তিরিশ - একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড। কর্মব্যস্ততা, দায়িত্ব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমশ থাবা বসায় দায়হীন কালের বন্ধুত্বে। তারপর আর ঠিক বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়, তা হয়তো হয়না। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে মনে নানা মানবিক আবেগের অভিঘাত কমে যায়। পলি পড়ে সরলতায়। অনেক কিছু চোখে পড়ে যা আগে পড়তো না। সংশয়ী, সাবধানী হয়ে যায় মন। অজান্তেই মনে আসে নানা অগ্ৰপশ্চাৎ ভাবনা, হিসেব, বিবেচনাবোধ। এমন মন নিয়ে আর স্বচ্ছতোয়া বন্ধুত্ব হয় না। অতঃপর সচরাচর যা হয় তা নিছক পরিচিতি, সামুদায়িক জীবনযাত্রার শর্ত বা কোনো বাস্তব প্রয়োজনীয়তায় সম্পর্কস্থাপন (networking) ও তা বজায় রাখার জন্য অনুশীলিত প্রচেষ্টা। মুষ্টিমেয় পছন্দের মানুষের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করে একঘেয়েমি কাটাতে ইচ্ছা হয়। অধিকাংশ সম্পর্কে অন্তঃসারশূন্যতা উপলব্ধি করে অন্তর্মুখী মানুষ (introvert) প্রৌঢ়ত্বে, বার্ধক্যে অধিকাংশ সময় একলা কাটাতেও পছন্দ করে।"
হীরেনদার লেখা পড়ে মনে হয়েছে, তিনি ভাগ্যবান, জীবনে অনেক আকর্ষণীয় মানুষের সাহচর্যে তিনি সমৃদ্ধ হয়েছেন। নিজস্ব স্বভাববৈশিষ্ট্যর গুণে তেমন সব সম্পর্কের উষ্ণতা বহুদিন বজায় রাখতে পেরেছেন। অনেকেই পারে না। আগুনের 'পরে জমে ওঠা ছাইয়ের মতো সময়ের সাথে বন্ধুত্বের উষ্ণতা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে, বাড়ে শীতলতা।
হীরেনদার সব লেখাতেই ছড়িয়ে থাকে টুকরো টাকরা এক্সপ্রেশনের মনিমাণিক্য, এখানেও পেলাম কয়েকটি, যেমন :
"হাঁদু একদিন বললে ‘ চল দিকি আমার সঙ্গে, গ্যালিফ স্ট্রিট যাবো‘ । কেন, কি কারণে জানতে চাইলাম না। অনুরোধ আর আদেশের মাঝমাঝি একটা হয়তো অনির্দিষ্ট কিছু আছে – হাঁদুর কণ্ঠে তেমনি একটা সুর।"