৷৷ ১ ৷৷
-সেদিন আন্দাজ সকাল দশটা। একটি প্রৌঢ় হন্তদন্ত হয়ে কলেজে যাচ্ছেন। ইস্ত্রি করা ট্রাউজার, কোট, টাই। এক কাঁধে ঝুলছে ন্যাপস্যাক ...
-ফেঁদে বসলেন তো এক গাঁজাখুরি গপ্পো?
-কেন?
-প্রৌঢ় লোক আবার কলেজে যায় না কী?
-যায় না?
-যায়, তবে পড়তে নয়, পড়াতে।
-কিন্তু আমি তো বলিনি লোকটা কলেজে কেন যাচ্ছে, পড়তে না পড়াতে।
-সেটা না বললেও বোঝা যায়।
-কীভাবে?
-ঐ যে, বললেন, হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছে।
-তাতে কী বোঝা গেল?
-তাতেই বোঝা যায় কেউ পড়তে যাচ্ছে। পড়াতে যাওয়ার তাড়া সচরাচর কারুর থাকে না।
-তাই বুঝি? আর যারা পড়তে যায় তাদের বুঝি খুব তাড়া থাকে? জ্ঞানপিপাসা বলছেন?
-না, তাও নয়।
-তাহলে?
-সেটাও নিছক নিয়মের বশবর্তী হয়ে। সবাই যায় তাই যায়। ঘন্টা পড়ে গেলে ক্লাসে ঢুকতে পাবে না, তাই তাড়াহুড়ো করে। বেশিরভাগই পড়তে যায় পেটের ধান্দায়, জ্ঞানার্জনের জন্য নয়।
-ঠিক আছে। ধরে নিন প্রৌঢ় লোকটা পড়তেই যাচ্ছে। তারপর হোলো কী ...
-না ঠিক নেই।
-কেন?
-ঐ যে বললাম, মাঝবয়সী লোক পড়তে যায় না। আপনার গপ্পোটাই গাঁজাখুরি।
-তবে কারা যায়?
-যাদের পড়তে যাওয়ার বয়স। এখন তো তিন বছরের শিশুকেও প্লেওয়ে স্কুলে পাঠায়। বা ধরুন বালক, কিশোর, তরুণ। এমনকি সদ্য যৌবনউত্তীর্ণ মানুষও হয়তো যায়। ঝাঁকের কইয়ের মতো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ার ওটাই বয়স। কিন্তু প্রৌঢ় লোক একা অথবা পন্ডিতপরিবেষ্টিত হয়ে সাক্ষাৎকার দেয়, সেমিনারে গিয়ে জ্ঞান বিতরণ করে। জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে গবেষণাগারে অন্বেষণ করে, গ্ৰন্থাগারে অধ্যয়ন বা বাড়িতে নিমগ্ন হয়ে পঠনও করতে পারে।
-বয়স্করা তবে পড়তে যায় না বলছেন?
-যাবে না কেন, যায়, যেমন ধরুন বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে। সময়কালে যা করা উচিত ছিল সুযোগ পেয়েও তা না করে বা কোনো কারণে তা করতে না পেরে পরে সেই ভুল উপলব্ধি করে অবেলায় সান্ধ্যক্লাসে শিখতে আসে এবিসিডি বা যোগ, বিয়োগ। পড়াতে আসে আদর্শবাদী তরুণ তরুণী বা প্রতিষ্ঠিত মানুষ যাদের কোনো কারণে ব্যক্তিগত সাফল্য ধাওয়া করার বদলে সমাজসেবার পোকায় কেটেছে।
-ঠিক আছে, হতে পারে, না, না, হয়েই থাকে, আপনি যখন বলছেন, তবে এ লোকটি সত্যিই কলেজে পড়তে যাচ্ছে।
-এতো নিশ্চিত হয়ে কীভাবে বলছেন আপনি?
-আমি যে তাকে চিনি?
-তাই নাকি? কী নাম তার?
-তিনিবাবু।
-এ্যাঁ! তিনিবাবু! এটা আবার কারুর নাম হয় নাকি? আমি, আপনি, উনি, তিনি এসব তো সর্বসাধারণের যে কেউ হতে পারে, অর্থাৎ সর্বনাম। পরিবর্তনশীলও বটে। যেমন ধরুন, আপনি আমার কাছে আপনি কিন্তু আপনি আপনার কাছে আমি। আমরা তো সেই অর্থে সবাই একই সময়ে আমি, আপনি, উনি, তিনি হয়ে বিরাজ করি।
-আচ্ছা পরের বার দেখা হলে জিজ্ঞাসা করবো ওনার আসল নাম কী, ঠিক আছে তো হোলো কী, উনি হন্তদন্ত হয়ে…
-না, ঠিক নেই।
-আবার কী হোলো?
-একটা মাঝবয়সী লোক কর্পোরেট অফিসের বাবুর মতো কোট প্যান্ট টাই পরে এক কাঁধে ন্যাপস্যাক ঝুলিয়ে কলেজে যায় না। ওসব টিনএজারদের স্টাইল। সকাল সকাল কী খেয়েছেন বলুন তো?
-যা খাই রোজ - টোষ্ট, পোহা, রুটি তরকারি, আলু পরোটা, চাউমিন - ধরে নিন তারই কোনো একটা। সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তিনিবাবুর বোধহয় সেদিন সকাল থেকেই দিনটা বেগড়বাঁই করছিল।
-কেন?
-কলেজ যাওয়ার আগে উনি না চিবিয়েই খেয়ে ফেলেছিলেন সরষের তেল দিয়ে পান্তাভাত, আলুভাজা ও পিঁয়াজ সহযোগে। মানে গিলে গিলেই খেয়ে ফেলেছিলেন আর কী।
-এ্যাঁ। এ আবার সম্ভব নাকি?
-খেয়ে উঠে পেষ্ট ছাড়াই দাঁত মেজে ফেলেছিলেন।
-ম্যাঁ গো! তিনিবাবু সকালে পান্তাভাত খান? প্রাতরাশের পর মাজন ছাড়া দাঁত মাজেন? তাহলে তো এমন লোকের পক্ষে মধ্যবয়সে কোটপ্যান্ট পড়ে হন্তদন্ত হয়ে কলেজ যাওয়া অসম্ভব নয়।
-কিন্তু শেষ অবধি যাওয়া হোলো না।
-কেন? বেশ তো যাচ্ছিলেন আপনার গল্পের তিনিবাবু, হন্তদন্ত হয়ে।
-এটা গল্প নয়, ঘটনা।
-আচ্ছা, না হয় ঘটনাই হোলো। তা যাওয়া হোলো না কেন?
-জুতো পরতে ভুলে গেছিলেন।
-সে কী! জুতো ছাড়াই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন? আচ্ছা কিম্ভূত লোক তো মশাই আপনার তিনিবাবু।
-আমার তিনিবাবু আবার কী? আমি শুধু ওনাকে চিনি, এই যা। হতে পারে উনি একটু বিচিত্র প্রকৃতির। তেমন একটু আধটু তো আমরা অনেকেই, তাই না? নিজেরাই শুধু বুঝতে পারি না, এই যা। অন্যেরা কিন্তু বোঝে, তবে ভদ্রতার খাতিরে বলে না। যাইহোক, যা বলছিলাম, সেদিন বাড়ি থেকে অনেকটা এসেও উনি বুঝতেই পারেননি যে ওনার খালি পা। ওনার মনে হচ্ছিল উনি যেন ঘরের মেঝেতেই হাঁটছেন। যেই দুর থেকে কলেজের বিশাল ভবনের চূড়াটা দেখতে পেলেন, উনি নীচে তাকিয়ে দেখলেন ওনার খালি পা। কলেজ তখনও বেশ খানিকটা দুরে...
-আর অমনি আপনার তিনিবাবু খালি পায়ে হাঁটছেন বুঝে পায়ে ব্যাথা টের পেলেন, তাই তো?
-মোটেও তা নয়। পায়ে জুতো না থাকলেও উনি পায়ে কোনো ব্যাথার অনুভূতি টের পাননি। উনি তো ভাবছিলেন খালি পায়েই চলে যাবেন ক্লাসে।
-তা গেলেন না কেন? আপনার কিম্ভূতবাবু।
-মিষ্টির দোকানীটা বারণ করলো যে।
-মিষ্টির দোকানী?
-হ্যাঁ। তিনিবাবু যেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলেন যে পায়ে জুতো নেই সেখানেই ছিল একটা মামূলী মিষ্টির দোকান। শো কেসে সাজানো থাকে অল্প কিছু মিষ্টি। বিক্রি বিশেষ হয় না। তবু ও যত্ন করে রোজ সাজায়। মিষ্টিগুলো দেখতে চটকদার। তবে সাতবাসকে।
-মিষ্টির বিক্রি নেই তবু সে নিয়ম করে শোকেসে রোজ সাজায় কেন?
-ঐ যেমন আপনি বললেন, অনেকে নিয়ম করে কলেজে যায় ডিগ্ৰি নিতে, নিয়ে যে কী হবে জানে না, তবু যায়, অভ্যাসে, সবাইকে দেখে, সেরকম।
-তো মিষ্টির দোকানীর চলে কীভাবে?
-বাতাসা বিক্রি করে।
-বাতাসা! এখন আর কেউ খায় বাতাসা?
-তা জানি না। তবে পুজো আচ্চায়, মন্দিরে, গাঁয়ে হরির লুটে এখনও চলে। তাই ওর মিষ্টির থেকে বাতাসাই বেশী বিক্রি হয়, ভালো লাভও হয়, নিজেই বানায় যে।
-নিজে বানায়? আপনি দেখেছেন?
-দেখেছি বৈকি। বেশ লাগে দেখতে। একটা চ্যাপটা মাটির হাঁড়ির গলায় লোহার আঁকশি পড়ানো। কানার নীচে একটা ফুটো। কয়লার উনুনে হাঁড়িতে ফোটে সোডা মেশানো গুড়ের রস। খাপড়ার চালের ঝুলপড়া দোকানের ভেতর উনুনের পাশে মেঝেতে পাতে একটা শেতলপাটি। আঁকশি বাঁধা হাঁড়িটা বাঁহাতে নিয়ে ডানহাতে একটা কাঠের হাতায় ফুটন্ত রস বিশেষ কায়দায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফোস্কার মতো শেতলপাটিতে ফেলে। তাড়াতাড়ি করতে হয়। কয়েক সারি ফেলার পর ফুটন্ত হলদেটে রস ঠান্ডা হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আসে। তখন হাঁড়িটা আবার উনুনে বসিয়ে দেয়।
-বাঃ, খুব সরল পদ্ধতি তো?
-হ্যাঁ, শুনতে সরল বটে তবে করা অতো সোজা নয়। বাতাসাগুলো দেখলে মনে হবে হাঁড়ি থেকে পড়েই পাটিতে কামড়ে বসে গেল বুঝি। কিন্তু তা নয়। গরম বাতাসা একটু ঠান্ডা হয়ে জমতেই দোকানী পাটিটা দুপাশে দু হাতে তুলে ধরে। সমান পাটি গোল হয়ে যায়। দু একবার এদিক ওদিক করে। বাতাসাগুলো কেউ কেউ গায়ে গায়ে লেগে থাকে তবে বেশিরভাগই ছাড়াছাড়া হয়ে জমিয়ে বসেছিল পাটিতে। ওভাবে পাটি দোলাতেই খররর করে ছেড়ে গিয়ে একসাথে এসে জড়ো হয় পাটির মাঝে। ও তখন পাশে রাখা টিনে পাটিটা কাত করে ফররর করে ঢেলে দেয়। হয়ে গেল বাতাসা তৈরী।
-বাঃ, বেশ মজার ব্যাপার তো? তা মিষ্টির দোকানী তিনিবাবুকে বারণ করলো কেন?
-ও নিজে থেকে কিছু বলেনি। ও তো বাইরে বেঞ্চিতে বসে দই মুড়ি খাচ্ছিল। তিনিবাবুই ভ্যালভ্যাল করে দোকানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যাঃ জুতো পরতে ভুলে গেছি, এভাবেই চলে যাই ক্লাসে?
-বাতাসাওলাকে জিজ্ঞেস করলেন উনি? ও হয়তো কোনোদিনই স্কুলেই যায় নি। কলেজের কেতার ব্যাপারে ও কী জানে?
-ঠিক বলেছেন। তবে এমনটা তো হয়েই থাকে। যে প্রশ্ন যাকে করার নয় বরং নিজেকেই করা উচিত তাও তো আমরা কখনো অন্যকে করে বসি। করি না?
-হুমম, তা হয় বটে। তা দোকানী কী বললো?
-ও বললো, না বাবু, খালি পায়ে লাঙল কাঁধে জমিতে বা জাল পিঠে নদীতে যাওয়া চলে, তবে পায়ে কিছু না পরে পড়তে যাবেন না।
-আশ্চর্য! এমন কথা বাতাসা বানানো এক মামূলী দোকানী দই মেখে মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলে দিল?
-অন্যকে দেখেই হয়তো। অনেক কলেজ পড়ুয়াই তো যায় ওখান দিয়ে।
-হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও চোখকান খোলা মানুষ অন্যকে দেখে অনেক কিছু বোঝে। তো তিনিবাবু কী করলেন?
-তিনিবাবু রোজ দশ কিমি ট্রেনে এসে প্রায় দু কিমি হেঁটে কলেজ যান। তখনও কলেজ প্রায় দেড়কিমি দুরে। পকেটে বেশী পয়সাও নেই। তাই উনি ভাবলেন উল্টোদিকে ফুটপাতের দোকান থেকে আজকের জন্য একটা হাওয়াই চটি কিনে নেবেন। কিন্তু সেদিকে এগোতেই দোকানী বলে, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
-সত্যি ভারি অদ্ভুত আপনার তিনিবাবু। পকেটে পয়সা কম, ট্রেনে, হেঁটে কলেজে আসেন অথচ পরে আছেন ধোপদূরস্ত কোট-প্যান্ট-টাই। তো তিনিবাবুর হাওয়াই চটি কেনার প্ল্যান শুনে দোকানী কী বললো?
-সে বলে, না, না, অমন নীলচে কোটপ্যান্টের সাথে লাল হাওয়াই চটি মোটেও মানায় না। ওর কাছে তো সবই লাল চটি। তাছাড়া পদত্রাণ তো কেবল পায়ের প্রয়োজনে নয়, পোষাকের সাথেও তো মানানসই হওয়া চাই।
-পদত্রাণ!
-মানে পাদুকা বা জুতো, যা পদযুগলকে রাস্তার বিপদ থেকে ত্রাণ বা রক্ষা করে।
-বাব্বাঃ, জুতোর এমন শুদ্ধ প্রতিশব্দ জানলো কী করে আপনার গল্পের বাতাসা ময়রা এতো আমিও জানতাম না।
-হয়তো শুনেছে কারুর কাছে। সবাই কী সবকিছু লেখাপড়া করে জানে? তবে আবারও বলছি, বারবার গল্প গল্প করবেন না, এটা ঘটনা।
-ও হ্যাঁ, তাও তো বটে, এটা তো আবার ঘটনা, তো তারপর কী হোলো আপনার ঘটনার?
-তিনিবাবু হতাশ ভঙ্গিতে বলেন, তাহলে আর আজ আমার কলেজ যাওয়া হোলো না। বাড়িই চলে যাই। জুতো কেনার তো পয়সা নেই। তাই শুনে দোকানী বলে, তা কেন? ঐ দেখুন আমার দোকানের কোনের তাকে কয়েক জোড়া পদত্রাণ রাখা আছে। দেখুন কোনো একটা আপনার হয় কিনা।
-যে মিষ্টির দোকানীর মিষ্টি বিক্রি হয়না, বাতাসা বানিয়ে পেট চলে সে দোকানে কয়েক জোড়া জুতো রেখে দিয়েছে আপনার তিনিবাবুর মতো কিম্ভূত লোক মনের ভুলে কখনো খালি পায়ে কলেজে চলে আসবে বলে? এমন উদ্ভট গল্প, যা আপনি বলছেন ঘটনা, আমায় বিশ্বাস করতে বলেন?
-সে আপনার মর্জি। তবে আপনার পক্ষে যা বিশ্বাসযোগ্য তাই কেবল ঘটনা আর অবিশ্বাস্য লাগলেই গল্প, এমনটা তো নাও হতে পারে। তো শুনুন না যা বলছিলাম। জুতোর তাকে ছিল কয়েক জোড়া জুতো। ছেলেদেরই বেশী। মেয়েদের মাত্র দু জোড়া। তিনিবাবুর পায়ে এক জোড়া হোলো। হান্টারের মতো, পুরু সোল, উঁচু কানা, অনেক ফিতে বাঁধার ফুটো। কিন্তু রঙটা সাদা। মোজা নেই। দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে তাড়াহুড়ো করে তিনিবাবু ডান পাটা এক পাটিতে ঢুকিয়ে ওপর থেকে নীচে ফিতে বেঁধে বাঁ পাটা অন্য পাটিতে ঢোকাতে যাচ্ছেন, এমন সময় দোকানী বলে, একটু দাঁড়ান।
-আবার কী হোলো?
-তিনিবাবুও সেই একই প্রশ্ন করেন। দোকানী বলে, কতদিন খোলা পড়ে আছে তাকে, আপনি না দেখেই পা ঢুকিয়ে দিলেন? ভেতরে আরশোলা, মাকড়সা থাকতে পারে। উল্টো করে ঝেড়ে নিন। তিনিবাবু বাঁ জুতোটা উল্টো করে ঝাড়লেন।
-কিছু ছিল নাকি?
-হ্যাঁ, ঠপাস করে একটা কাঁকড়াবিছে মাটিতে পড়ে হেলেদুলে চলে গেল।
-কী সর্বনাশ!
-তবে তিনিবাবু চমকালেন না। চোখ কুঁচকে খানিক কী যেন ভাবলেন। দোকানী বলে, কী হোলো? তিনিবাবু বলেন, ডান পায়ের কড়ে আঙ্গুলের পাশেও কী যেন একটা নরম নরম ঠেকছে। দোকানী বলে, খুলে ঝেড়ে আবার পড়ুন। ওটার জুড়িও হতে পারে। হয়তো লীলাখেলার পর পাশেরটায় ঢুকেছে ডিম পাড়তে।
-হতেই পারে। তারপর? ওরে বাবা, শুনেই তো আমার গা শিরশির করছে।
-আপনি তো বলেইছেন তিনিবাবু লোকটা কিম্ভূত প্রকৃতির। তাই উনি বলেন, না, না, কাঁকড়াবিছে হলে খরখরে হোতো। এতক্ষণে হয়তো কামড়েও দিতো। এটা হয়তো টিকটিকি হবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে কলেজের। এখন যাই, ফার্স্ট পিরিয়ডের পর খুলে দেখবো।
-সত্যি অদ্ভুত মানুষ তো তিনিবাবু! তো দোকানী কিছু বললো না?
-শুধু বললোই না, রীতিমতো জোর করলো। সে বলে, তা হয় না, খুলে ঝেড়ে আবার পড়ুন। আমার দেওয়া পদত্রাণ পরে আপনার কিছু হলে আমার আফশোষের সীমা থাকবে না। দেরী হবে না। ঐ সামনের মোড় থেকে বাস পেয়ে যাবেন। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাবেন কলেজে। আবার ফিতে খুলে ডান পায়ের জুতোটা ঝাড়তে এবার টপাক করে মাটিতে পড়লো ছোট্ট একটা সবজেটে সোনাব্যাঙ। মুখটা ছুঁচলো। কালো চোখ। খুব মিষ্টি দেখতে। মাটিতে পড়ে তার আর লাফানোর ক্ষমতা নেই। পায়ের চাপে দমবন্ধ হয়ে কাহিল অবস্থা। ওটাকে জুতোর মধ্যে পায়ে চেপে তিনিবাবু এক পিরিয়ড ক্লাস করলে ওর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি অবধারিত ছিল।
-একটা জুতোয় কাঁকড়াবিছে অন্যটায় ব্যাঙ? আপনার গল্পে, থুরি, ঘটনায় দেখছি অত্যন্ত বিচিত্র সব ঘটনার ঘনঘটা! তারপর কী হোলো?
-তিনিবাবু জুতো পরে দৌড়ে গিয়ে মোড় থেকে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন।
-যাক শেষ অবধি তাহলে তিনিবাবুর কলেজ যাওয়া হোলো।
-নাঃ, তাও হোলোনা, কলেজ মিস হয়ে গেলো।
-এ্যাঁ, কীভাবে? এই তো বললেন বাসে কলেজ মোটে পাঁচ মিনিটের পথ। তাহলে?
-তিনিবাবু একটা ভুল বাসে উঠে পড়েছিলেন। বললাম না, সেদিন ওনার দিনটাই গড়বড় যাচ্ছিল। সে বাসে কোনো রুট নম্বর নেই। সামনে গন্তব্য লেখা বোর্ডটাও ফ্যাটফেটে সাদা। ও বাস সন্ধ্যার আগে কোথাও দাঁড়ায়ও না। যে রাস্তায় যায় তাতে কখনো জ্যামও হয় না। তাই চলতেই থাকে। কখনো রাস্তা বেশ মসৃন। তখন বাসের গতি বেড়ে যায়। গতির নিজস্ব উন্মাদনা আছে, জানেন তো? জানলা দিয়ে তখন ফুরফুরে বাতাস আসে। কোথায় যাচ্ছে না জেনেও তখন যাত্রীরা বেশ উৎফুল্ল বোধ করে। মাঝে মাঝে ও রাস্তায় বেশ খানাখন্দ আছে। তখন বাস সেখান দিয়ে প্রচন্ড নেচেকুঁদে আস্তে আস্তে যায়। গায়ে গতরে ব্যাথা হয়ে যায়। তবু বেশিরভাগ যাত্রীই বসে থাকে। ভাবে আবার মসৃন রাস্তা আসবে। শুধু কিছু অধৈর্য্য যাত্রী সেই নাচনকোঁদন সহ্য করতে না পেরে খোদলানো রাস্তায় ধীরগতিতে চলা বাস থেকে লাফিয়ে নেমে পড়তে যায়। তবে রাস্তার পাশেই গভীর খাদ। টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে খাদে। ওখান থেকে তোলার কেউ নেই।
-যেমন আপনার তিনিবাবু তেমনি অদ্ভুত বাস তো মশাই? ওতে কন্ডাক্টর নেই?
-আছে।
-চলন্ত বাস থেকে কেউ নামতে গেলে সে বারণ করে না?
-না। বাসে সে থাকে বটে তবে তার কোনো ভূমিকা নেই। তিনিবাবুর মতো তারও কোনো নাম নেই।
-নাম নেই মানে?
-নামের কী দরকার। তাকে সবাই ডাকে ভাই বলে। ও ভাই শুনছো, কোথায় যাচ্ছে এ বাস? সে চুপ। ও ভাই এখন কোথায় এলো? সে চুপ। ও ভাই একটু দাঁড়াবে? সে চুপ। সে ভাড়াও চায় না। কেউ উঠলে কিছু জানতে চায় না। চলন্ত বাস থেকে কেউ লাফিয়ে নামতে গেলেও বাধা দেয় না। সে কেবল চুপ করে বসে থাকে তার নির্ধারিত আসনে।
-আশ্চর্য ব্যাপার তো! তাহলে তার বাসে থাকার দরকারটাই বা কী?
-সেটাও ঐ - আপনি যা বললেন - নিছক নিয়ম। চলন্ত বাসে একজন চালক ও একজন সঞ্চালক থাকতে হয়, তাই। তবে কোথায় যাচ্ছে, কোথায় এলো এসব প্রশ্ন না করে অন্য কিছু জানতে চাইলে সে জবাব দেয়।
-যেমন?
-যেমন ধরুন তিনিবাবু চলন্ত বাসে উঠে দেখেন পিছন থেকে তীব্র হর্ণ দিচ্ছে একটা প্রাইভেট কার। তারপর তিনিবাবুর সাথে কন্ডাক্টরের যা কথাবার্তা হোলো তা এই প্রকার:
-ও ভাই, ঐ গাড়িটা অতো হর্ণ দিচ্ছে কেন?
-ওর তাড়া আছে।
-কিসের তাড়া?
-বাসটাকে ওভারটেক করার।
-ওভারটেক করে কোথায় যাবে?
-যেখানে এই বাসটা যাচ্ছে, রাস্তা তো একটাই।
-অমন প্রাইভেট কার কী কেবল বাসকেই ওভারটেক করে?
-না অন্য কোনো প্রাইভেট কার বাসের থেকে জোরে গেলেও তাকেও কেউ কেউ ওভারটেক করতে চায়।
-কেন?
-সে আরো দ্রুত যেতে চায়।
-এ বাসটা কোথায় যাচ্ছে?
-জানি না।
-কোথায় যাচ্ছে না জেনেই বাস চলছে?
-হ্যাঁ। রাস্তা তো একটাই।
-কতদূর যাবে?
-যেখানে সন্ধ্যা হবে সেখানেই যাত্রা শেষ।
-সেখানেই কি বাসের সবাই নেমে যাবে?
-হ্যাঁ।
-আমাকেও কি ওখানেই নামতে হবে?
-হ্যাঁ।
-ওখানেই কি রাস্তা শেষ?
-তা জানি না। তারপর ওদিকে কোনোদিন যায়নি বাস। রাস্তা আছে কী নেই তা অন্ধকারে বোঝাও যায় না। তবে যারা বাস থেকে নামে তাদের কাউকে টর্চ হাতে ওদিকে যেতে দেখেছি। বাকিরা কী করে, কোথায় যায়, জানিনা।
-বাস কি ওখানেই রাতে থেকে যাবে?
-না, ফিরে আসবে।
-কোথায়?
-সকালে যেখান থেকে ছেড়েছিল সেখানে।
-সেটা কোথায়?
-জানি না।
-আমি কি তাহলে এই বাসেই আবার ফিরে আসতে পারি?
-না, এই বাসে কাউকে ফেরৎ নিয়ে আসার নিয়ম নেই।
-তাহলে আমি কী করবো?
-জানি না।
-রাতে ওখানেই থেকে সকালে ফিরে আসতে পারি?
-পারেন, তবে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
-মানে?
-সকালে কোন বাস ছাড়ে জানি না, রোজ ছাড়ে কিনা, কখন ছাড়ে তাও জানি না।
-তাহলে? আজ না হয় আমার কলেজে মিস হয়ে গেলো, কাল কী হবে?
-জানি না।
চুপ করে যান তিনিবাবু। তাঁর প্রশ্ন শেষ হয়ে যায়। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে ...
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।