ইংরেজিতে Lynching বললে যা বোঝায় বাংলায় এক কথায় তার প্রতিশব্দ নেই। নেই কারণ আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে কালো মানুষদের পিটিয়ে মারার যে উৎসব প্রচলিত হয়েছিল ১৮৩০ সাল থেকে শুরু করে কিঞ্চিদধিক প্রায় একশত বছর ধরে, তার একমাত্র কারণ হিসেবে বর্ণবিদ্বেষকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ভারতে যূথবদ্ধভাবে মানুষ মারার কারণ ভারতের ভাষা, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের মতই বহুবিধ। ভারতে স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশবিভাজনের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দিয়ে এই উপমহাদেশের মানুষ এই ধরণের লিঞ্চিংয়ে হাত পাকায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উপাদান ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। এরপর উল্লেখযোগ্য ১৯৬৯ সালের ৪০ দিন ব্যাপী আমেদাবাদ দাঙ্গা (মৃত সরকারী মতে ৬৬০, বেসরকারীমতে ২০০০)। ১৯৮৪ সালের ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু পরবর্তী এক পক্ষকাল ব্যাপী দিল্লীর শিখ গণহত্যা, ১৯৮৮ সালের দুই মাস ব্যাপী মীরাট দাঙ্গা, ১৯৮৯ সালের একমাস ব্যাপী ভাগলপুর দাঙ্গা, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা, ২০২০ সালের দিল্লী দাঙ্গা। এই দাঙ্গাগুলিতে যে লিঞ্চিংয়ের ঘটনাগুলি ঘটে তার মূল কারণ ধর্মীয় গোষ্ঠীগত পরিচয়ভিত্তিক বিভেদ।
কিন্তু ভারতের মত দেশে আরো হাজারটা কারণে লিঞ্চিং ঘটে থাকে। ২০১৪ সালের ২১ শে জুলাই দক্ষিণ দিল্লীর কোটলা মুবারকপুরে ২৯ বছরের মণিপুরী যুবক আখা সালৌনিকে পিটিয়ে মারা হয় সামান্য কথা কাটাকাটির জন্য। মারে পাঁচ ছয় জন স্থানীয় যুবক। ২০০৬ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর মহারাষ্টের খৈরলাঞ্জিতে ওবিসি সম্প্রদায়ের কিছু লোক জমি সংক্রান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে একটি দলিত পরিবারের চারজনকে টেনে বের করে, বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরায়, মেয়েটিকে ধর্ষণ করে এবং সবশেষে পিটিয়ে মারে সবাইকে। ২০১৪ সালের ২রা জুন ২৮ বছরের যুবক মহসীন শেখ, পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী মহারাষ্ট্রে শিবাজী এবং বাল ঠাকরেকে ফেসবুকে কুৎসা করার অভিযোগে রাত্রি নটার সময় মসজিদ থেকে প্রার্থনা করে ফেরার সময় জনতার হাতে লিঞ্চড হয়। এই লিঞ্চিংগুলোর মুখ্য কারণ তাই কোথাও ধর্মীয় বিভেদ, কোথাও উগ্র প্রাদেশিকতা, কোথাও নৃতাত্ত্বিক বিভিন্নতা, কোথাও জাতপাতের ঘৃণা। ২০১৩ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি আসামের রুক্মিণীগাঁও নামক জায়গায় একটি দোকানে চুরির চেষ্টার অপরাধে একটি চোদ্দ বছরের ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলে জনতা। শেষ ঘটনাটি যেখানে ঘটে সেটি মূলত মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত এলাকা। সাম্প্রতিককালে মণিপুরে মেইতেই আর কুকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে গণধর্ষণ এবং লিঞ্চিংয়ের অজস্র ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে। তার আগে গত কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গোরক্ষক বাহিনীর তাণ্ডবে গোমাংস বহন করার অভিযোগে বেশ কয়েকটি লিঞ্চিংয়ের শিকার হয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।
আমাদের রাজ্যে সম্প্রতি শিশুচুরির গুজবে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিস এসে কোনোরকমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে না বাঁচালে এগুলি সবই লিঞ্চিংয়ের নজির হয়ে উঠত। মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, ভবঘুরে, মহিলা-ছাড় পাচ্ছেন না কেউ। যদিও সারা বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ছেলেধরা, গরুচোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই থাকে। এগুলি সাধারণত খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় ছোট্ট খবর হিসেবে থাকে। পুলিসও নাম-কা-ওয়াস্তে একটা তদন্ত করে কেসগুলি মিটিয়ে দেয়। এই ঘটনাগুলি গ্রামের মানুষ প্রায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘটিয়ে থাকেন। এর পেছনে যে কারণগুলি তারা দেখান তা হচ্ছে (১) পুলিসি অকর্মণ্যতা, (২) দীর্ঘসূত্রী বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা আর (৩) গ্রাম বা অঞ্চলের সুরক্ষা।
লিঞ্চিয়েংর মধ্য দিয়ে একধরণের ‘বিচারপ্রদান’ করার ন্যায্যতা, বৈধতা এবং ক্ষমতাপ্রয়োগের স্বাধীনতা ভোগ করতে চায় সমাজ। তাই লিঞ্চিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তেমন হয় না বা হলেও বিরুদ্ধতার কন্ঠস্বর থাকে ক্ষীণ। আদিবাসী সমাজে ডাইনি নাম দিয়ে অসহায় প্রৌঢ়া মহিলাকে লিঞ্চিংয়ের যে ঘটনাগুলো আমরা মাঝে মাঝে শুনতে পাই সেখানে কুসংস্কারের পাশাপাশি এই সামাজিক ক্ষমতাপ্রয়োগ এবং গ্রামসমাজের স্বায়ত্তশাসনের মনোভাবও তাই প্রবল থাকে।
লিঞ্চিংয়ের প্রেরণা হিসেবে গুজবের ভূমিকা এই উপমহাদেশে একটু বেশি। যখন সামাজিক মাধ্যম ছিল না তখনও গুজব লিঞ্চিংয়ের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। শোনা যায় ১৯৮২ সালে বিজন সেতুর ওপর ১৭ জন আনন্দমার্গী সাধুদের হত্যার পেছনে ছেলেধরা সংক্রান্ত গুজব রটানোর একটা ভূমিকা ছিল। ১৯৯০ সালে বানতলায় অনিতা দেওয়ান এবং ড্রাইভার অবনী নাইয়ার মৃত্যু এবং আরো দুজন মহিলা অফিসারের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার পেছনেও এরকম একটা গুজবের ভূমিকা শোনা গেছিল। গত তিন দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে শহর এলাকায় পরপর লিঞ্চিংয়ের খবর আসছে। ২৮শে জুন কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলে একটি ছাত্রাবাসে মোবাইল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে মারা হয় ইরশাদ আলম নামে ৩৭ বছরের এক গরীব যুবককে। যাঁরা মারলেন তাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের এস সি বা এস টি ছাত্র যাদের বাড়ি মফস্বল বা গ্রাম বাংলায়। দু একজন, বিশেষত যার মোবাইল চুরি গেছে বলে অভিযোগ, তাঁরা স্নাতকোত্তর পাশ করে গেছেন। এই ঘটনা অনেকের স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনছে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার এন আর এস মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে ঐ মোবাইল চুরির অভিযোগে কোরপান শাহ নামে জরির কারিগরের গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা। অভিযোগ হবু ডাক্তাররাই তাকে পিটিয়ে মেরেছিলেন। গত ২৯ শে জুন কলকাতার সল্ট লেকে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে পিটিয়ে মারা হয় একজনকে। ৩০ শে জুন হুগলীর পাণ্ডুয়ায় কথা কাটাকাটির জেরে এক যুবককে পিটিয়ে মারা হয়। তাই সামাজিক হিংস্রতার প্রকাশ লিঞ্চিংয়ের ট্র্যাডিশন সমানেই চলছে।
লিঞ্চিংয়ে মানুষ কেন অংশ নেয়? মনস্তাত্ত্বিকরা বলবেন মানুষের ভেতরের আক্রামক প্রবৃত্তি এবং আদিম হিংস্রতা যাকে শিক্ষা,সভ্যতা এবং বিবর্তন চেপে রেখেছে মাত্র তা অনুকূল পরিবেশ পেলে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় শাস্তি না পাওয়ার সম্ভাবনা জনিত বাঁধনছাড়া মনোবৃত্তি (impunity)। এর ওপর যূথবদ্ধ আক্রামকতাকে যখন ধর্ম, জাতি, বর্ণগত বিভেদের নানা বদ্ধমূল ধারণা অনুপ্রেরণা যোগায় তখন তো সোনায় সোহাগা। একই সঙ্গে লিঞ্চিংয়ে থাকে পৌরুষের বিকৃত আস্ফালন, থাকে পিতৃতান্ত্রিক শাস্তিপ্রদানের অহংকার।
তার মানে মনস্তাত্ত্বিক কারণের সঙ্গে সামাজিক কারণের যোগসাজসেই লিঞ্চিংয়ের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ। এর বিসর্জন কবে হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। মানুষের অবদমিত হননেচ্ছা যতদিন থাকবে ততদিন লিঞ্চিং ফিরে ফিরে আসবে। তবে একদিকে আইন শৃঙ্খলার সঠিক প্রয়োগ আর তার চেয়েও বেশি করে সমাজতাত্ত্বিক কারণগুলির বিশ্লেষণ এবং অপনোদন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এই জঘন্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো যেতে পারে।