গ্যাব্রিয়েল পতনোন্মুখ দেবদূত নাকি ঈশ্বরের দিব্য মহিমায় স্নাত উড়ালসক্ষম ত্রাতা? আমি গ্যাব্রিয়েল বরিচের কথা বলছি, যিনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে চিলের সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট এবং অনেকটা বামপন্থী, নব্য বামপন্থী, স্বাধীন বামপন্থী। বরিচ নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের বামপন্থী এবং কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে যে ব্রড ফ্রন্ট গড়া হয় এবং পরে আরও পার্টির সম্মেলনে যে ফ্রন্টের নাম হয় আপ্রুএবো ডিগনিডাড (মর্যাদার অধিকার), চিলের কম্যুনিস্ট পার্টি তার গুরুত্বপূর্ণ শরিক। তার ওপর চূড়ান্ত পর্যায়ে বরিচের একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে যিনি ছিলেন, সেই হোসে আন্তোনিও কাস্ট একেবারে মার্কামারা নব্য-ফ্যাসিস্ট। তাঁর বাবা ছিলেন হিটলারের নাজি পার্টির সদস্য, যুদ্ধের পর রেড ক্রসের কাগজ জালিয়াতি করে চিলেতে পালিয়ে এসেছিলেন। আন্তোনিওর দাদা প্রয়াত মিগুয়েল কাস্ট ছিলেন স্বৈরতান্ত্রিক জেনারেল অগাস্তো পিনোশের ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের অন্যতম, যাঁরা শিকাগো বয়েজ ইকোনমিস্ট নামে পরিচিত ছিলেন। আন্তনিও সদম্ভে পিনোশের উত্তরাধিকারকে মহিমান্বিত করেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতির জয়গান করেন, অভিবাসী, গর্ভপাত এবং সম-লৈঙ্গিক সম্পর্কের বিরোধিতা করেন। আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতা করেন, কারণ তা নাকি দেশের ঐক্যের পরিপন্থী। চিলি বলিভিয়া সীমান্তে পরিখা খনন করে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশ আটকাতে চান। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জাইর বোলসোনারোর সঙ্গে দারুণ মিল যে আছে সেকথা বোঝাই যায়। তাই গ্যাব্রিয়েলকে চিলের ৫৬ শতাংশ ভোটদাতা নির্বাচিত করেছে দেবদূতের ভূমিকায়। কিন্তু প্রশ্ন আছে যে সেই ভূমিকায় গ্যাব্রিয়েল কতটা স্থিত হতে পারবেন? চিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্ট ফাঙ্কের কথায়, বরিচ আসলে লাতিন আমেরিকার সেই রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধি যাঁরা যতটা বিপ্লবী মনে হয় আসলে ততটা নন।
আমরা গ্যাব্রিয়েলকে চিনেছি ২০১১-১৩ সালের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে। সেই আন্দোলন শিক্ষার খরচ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে শুরু হলেও, অন্যান্য সামাজিক সমস্যা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তার জোরালো কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। গ্যাব্রিয়েল তখন চিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সম্পাদক। তারপর ২০১৩ সালে নির্দল হিসেবে এবং ২০১৭ সালে ব্রড ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি সংসদে ডেপুটি নির্বাচিত হন। ছাত্র আন্দোলনের সময় অবশ্য আরো বেশি প্রচারের আলোয় ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির জনপ্রিয় ছাত্র নেত্রী ক্যামিলা ভ্যালেহো। এতটাই, যে ভ্যালেহো গার্ডিয়ান পত্রিকার পাঠকদের মধ্যে একটি অনলাইন নির্বাচনে ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন। গ্যাব্রিয়েলের তাই প্রথাগত কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, বিভিন্ন প্রশ্নে মতপার্থক্য সত্ত্বেও। গ্যাব্রিয়েল জেতার পর বলেছেন, ‘চিলেকে যদি নয়া উদারবাদের আঁতুড়ঘর ধরা যায়, তাহলে এখন সেটাই তার গোরস্থান হবে।’ আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে হবে তাঁর লড়াই। তাঁর প্রতিশ্রুতি ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, কাজের সময় সাপ্তাহিক ৪৪ ঘন্টা থেকে ৪০ ঘন্টায় কমানো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে মানুষের খরচ কমানো, সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়ানো, বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াই, আদিবাসী, সমকামী এবং ট্র্যান্সজেন্ডার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এরই সঙ্গে টাকার জোগানদারির জন্য ধনীদের ওপর কর বাড়ানো, মাইনিং রয়্যালটি বাড়ানো, ‘সবুজ কর’ বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। আদর্শগতভাবে নয়া-বামদের যে মতবাদিক বৈশিষ্ট্য, যেমন নারীবাদ এবং পরিবেশ– সেসবই তাঁর বিবেচনায় আছে। বেসরকারি পেনশন ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটিয়ে এক নতুন ও সার্বিক পেনশন ব্যবস্থার প্রচলন করতে চান তিনি। তা এই গ্যাব্রিয়েল যে বেশ বাম, তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি একটা বিরাট কোয়ালিশনের নেতা। উপরন্তু বিরোধীরাও সেনেটে যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই তাঁর প্রস্তাবগুলি রূপায়ণ করতে গেলে তাঁকে যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে হবে। তাঁর ওপর আরেকটি গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে। পিনোশের প্রবর্তিত অগণতান্ত্রিক সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে সেনেটকে।
বরিচ চিলের কম্যুনিস্ট পার্টির বিভিন্ন অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন। ভেনেজুয়েলা, কিউবা এবং নিকারাগুয়ার বাম বা কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের তিনি সমালোচনা করেছেন গণতন্ত্রের প্রশ্নে, যেখানে চিলের কম্যুনিস্ট পার্টি তাদের সোচ্চার সমর্থক (বরিচ জেতার পর কিন্তু সবার আগে সেই দেশগুলি থেকেই অভিনন্দন বার্তা এসেছে)। চিলির বর্তমান সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য যে সর্বদলীয় সহমত তৈরি হয়, বরিচের তার প্রতি সমর্থনও কম্যুনিস্ট পার্টির না-পসন্দ। বরিচ অবশ্য নিজেকে সমাজ-গণতন্ত্রী বলে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন। আপ্রুএবো ডিগনিডাদ ফ্রন্টের তরফ থেকে কাকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করা হবে - তাই নিয়ে নির্বাচন হয় গত ১৮ই জুলাই ২০২১। সেই নির্বাচনে বরিচ প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে পরাজিত করেন কম্যুনিস্ট পার্টির মনোনীত প্রার্থী ড্যানিয়েল হাদুয়েকে। এই হাদুয়ে কিন্তু প্রার্থী হিসেবে ছিলেন জবরদস্ত। ৫৪ বছরের হাদুয়ে ২০১২ সাল থেকে রেকোলেতা শহরের মেয়র থাকাকালীন ‘জনগণের ফার্মেসি’ চালু করেন, যা পরে চিলের ১৫০ টি মিউনিসিপালিটি গ্রহণ করে। তিনটি ওষুধ কোম্পানির একাধিপত্য ভেঙে এর ফলে ওষুধের দাম ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যায়। এছাড়াও ‘জনগণের পুস্তক বিপণি’, ‘জনগণের চশমা ভাণ্ডার’, ‘জনগণের রিয়েল এস্টেট’ এবং ‘মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ ইত্যাদি গড়ে তুলেছেন তিনি। হাদুয়ে নিজেও ঘোষিত নারীবাদী এবং গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করার পক্ষে। কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী’ ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত ব্যর্থ বলেন তিনি। তাই গ্যাব্রিয়েল এবং চিলির কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে দূরত্ব যতটা আছে, নৈকট্য তার চেয়ে বেশি আছে বলেই মনে হয়। বরং লক্ষণীয় এটাই, যে একুশ শতকের বামপন্থা, অন্তত লাতিন আমেরিকায়, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বোধ এবং মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়ে, বিংশ শতাব্দীর মডেলগুলির ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বহুমুখী সাধনায় নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে। সাম্প্রতিক অতীতে হন্ডুরাস ও পেরুতেও সেই পথে সাফল্যের নজির তৈরি হয়েছে। ব্রাজিলও একই প্রক্রিয়ার ভেতর আছে। বিভিন্ন ধারাগুলির নৈকট্য বোধের মধ্যে তাদের স্বকীয়তা এবং সৃজনশীলতাকে বজায় রাখার প্রচেষ্টাকে রেজিমেন্টেড রাজনীতি দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখে কিছুটা নমনীয় ঠেকলেও সাধারণ নিপীড়িত মানুষ কিন্তু এই ধারাটিকেই গ্রহণ করছেন বিকল্প হিসেবে। অন্যদিকে একুশ শতকের পুঁজিবাদ বরং বিকল্পহীনতায় ভুগছে মনে হয়। কম্যুনিজমের ভূত ঠেকানোর জন্য তার যেমন উদারপন্থী, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিকল্পগুলি কার্যকর ছিল তা এখন যেন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আন্তোনিও কাস্টের মত নব্য ফ্যাসিস্টদের তাই প্রধান বিকল্প হিসেবে দেশে দেশে দেখা যাচ্ছে, আর্থিক উদারনীতির ধ্বজাধারী হিসেবে। এমনকি বুর্জোয়া শাসনে যে সামাজিক ন্যায়ের কথা অন্তত লিপ সার্ভিস হিসেবে বলা হত, গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মধ্য দিয়ে কতিপয় ইওরোপীয় দেশে তার কিছু সদর্থক প্রয়োগও আমরা দেখেছিলাম, তারও আন্তর্জাতিক কোনো প্রয়োগমালা তৈরি হতে দেখা গেল না। স্তালিনের কথা একটু পালটে নিয়ে আমাদের কি তবে বলতে হবে, বুর্জোয়া শ্রেণি গণতান্ত্রিক সমাজবাদের পতাকাকে ধুলায় ফেলে দিয়েছে, নিপীড়িত মানুষের দায়িত্ব হল তাকে আবার সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করা? গ্যাব্রিয়েল বরিচ দেবদূত কিনা জানি না, কিন্তু আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে প্রাসাদ অভ্যুত্থানে যে সালভাদোর আয়েন্দেকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, তাঁর পুনরুত্থানের ঋত্বিক তো বটেই। হ্যাঁ, চিলি বামদিকে মোড় নিচ্ছে।