মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী। তার অন্তঃস্থল, মনোজগৎ, শারীরবৃত্তীয় নির্মাণ, যৌনতা – সবকিছুর বৈচিত্র অপরিসীম। যদিও এ’ সবকিছুকেই একটা চেনা ছকে বুঝে নিতে চাই আমরা। আর সবক্ষেত্রেই যা হয়, সংখ্যাগুরুর যা প্রবণতা – তাকেই মান্যতা দেয় সমাজ, ধর্ম, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি। যৌনতাও তার ব্যতিক্রম নয়। যেহেতু আমরা অধিকাংশ মানুষই বিষমকামী (heterosexual), তাই সেটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে বাকি সব যৌন প্রবণতাকে অস্বাভাবিক, প্রকৃতিবিরোধী, সমাজবিরোধী, অনৈতিক, অবক্ষয়ী – ইত্যাকার নানা বিশেষণে ভূষিত করতে আমাদের বাধে না। এর একটা বড় কারণ এই, যে আমাদের চালু আখ্যানগুলি একমাত্র বিষমকামী যৌনতাকে স্বাভাবিক ধরেই নির্মিত হয়েছে। ফলত, এর ব্যতিক্রমকে স্বীকার করে নিলে, তাকে মান্যতা দিলে, সেই ডিসকোর্সগুলি অমোঘতার দাবি হারায়, তাদের ভিত্তি আক্রান্ত হয়। ডিসকোর্স মানে এখানে আধিপত্যের ডিসকোর্স।
অন্য যৌনতার এক বড় শরিক হল সমলৈঙ্গিক যৌনতা। এর মধ্যে দু’জন মেয়ের মধ্যে আকর্ষণের বিষয়টি নিয়ে ফিকশনধর্মী শিল্পের সঙ্গে আমার পরিচয় সামান্য। কমলকুমার মজুমদারের ‘মল্লিকাবাহার’ বা ইসমত চুগতাইয়ের ‘লেপ’ গল্পগুলি তাদের নির্মাণকৌশলে বুদ্ধিবৃত্তিগত আকর্ষণ তৈরি করে এবং বিষয়ের সাহসিকতাকেও তারিফ জানাতে হয়। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে মীরা নায়ারের ‘ফায়ার’ বা কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার’ দেখে হতাশই হয়েছিলাম। অবশ্য ফ্রান্সের মুক্ত যৌনতার পরিবেশে অন্য যৌনতার উদযাপনটাই হয়তো শেষোক্ত ছবিটির উদ্দেশ্য ছিল, এমনটাও হতে পারে। কিন্তু যেখানে অন্য যৌনতার অস্তিত্ব এখনও অবদমনের মুখোমুখি, সেখানে তার অস্তিত্বের সংকট কতটা মর্মস্পর্শী হতে পারে – সেটা বোঝার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হল একটি বাংলা তথ্যচিত্র দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন পর্যন্ত। যদিও ‘এবং বেওয়ারিশ’ নামে স্যাফো প্রযোজিত এবং দেবলীনা মজুমদার পরিচালিত তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে ২০১৩ সালে, আমি এটা দেখার সুযোগ পেলাম এতদিনে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘মুবি’তে। যেহেতু মুবি অনেক ছবির এক্সক্লুসিভ রাইট নেয় না, তাই প্রযোজকদের অনুরোধ করব, সম্ভব হলে ছবিটি ইউটিউবের মত সর্বজনীন প্ল্যাটফর্মে দিতে। এই ছবির বহুল প্রচার দরকার।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। প্রাক ভোটের পরিবর্তনপন্থী হাওয়ায় সরগরম নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া। সেইখানে দু’টি মেয়ে একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে আত্মহত্যা করল বিষ খেয়ে। বিষ খেয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণার কোনো চিহ্ন অবশ্য দু’টি মেয়ের মুখে ছিল না। মেয়েদু’টির নাম সুচেতা (১৮) আর স্বপ্না (২২)। সুচেতা স্বপ্নার ছাত্রী ছিল। পরস্পরকে দারুণ ভালোবাসত। এই অস্বাভাবিক ভালোবাসার অবসান ঘটাতেই বোধহয় স্বপ্নাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সে বিয়ে সুখের হয়নি। অবশেষে দু’জন আত্মহত্যা করে আর রেখে যায় একটি দীর্ঘ অন্তিম চিঠি। সে চিঠিতে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। শুধু অন্তিম ইচ্ছা ব্যক্ত করে যায় তারা – যেন তাদের একসঙ্গে সৎকার করা হয়। না, তাদের এই ইচ্ছাটুকুও পূর্ণ করেনি তাদের পরিবার তথা সমাজ। তাদের দেহ নিতেও তারা অস্বীকার করে। মর্গে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে তারা। অথচ শেষ চিঠিতেও পরিবারের প্রতি, বাবা-মার প্রতি তাদের ভালোবাসা আর উৎকন্ঠা ঝরে পড়ে। কেন এমন হয়? এই চিঠিটিকে কেন্দ্রে রেখে সিনেমায় আরো চারজন মানুষের যাপনের অসহায় আর্তিকে তুলে ধরা হয়, যাদের একমাত্র অপরাধ তাদের যৌন পছন্দ কোনো চেনা ছকে বাঁধা নয়।
এমনিতে এটি হেলাফেলা করে বানানো কোনো দলিলচিত্র নয়, অত্যন্ত সুনির্মিত। চারজন চরিত্রর প্রথম মেয়েটি বলে, সে যখন বাড়িতে তার এই যৌন প্রবণতার কথা জানায়, বাড়িতে তার নামে করে দেওয়া সাইবার কাফে এবং কম্প্যুটারগুলির মালিকানা চেঞ্জ করে দেওয়া হয়। কান্না চাপতে চাপতে মেয়েটির জিজ্ঞাসা, আচ্ছা, আমি কি শুধু এই কারণে একটা খারাপ মানুষ হয়ে গেলাম, প্রতারক হয়ে গেলাম, যে বাবা মাকে ঠকাব, তাদের দেখব না? তার যৌন পছন্দকে সঠিক পথে আনার জন্য তার দাদাদের তরফ থেকে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়, সেগুলো তো ভয়াবহ। দ্বিতীয় যে চরিত্র আসে – স্বরূপ – সে বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা। সে কিন্তু ট্রান্সসেক্সুয়াল। তার শরীরটা পুরুষের, মনটা মেয়েদের। তাকে সম্ভবত কিছুটা জোর করেই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন সে বন্দি এক অসহায় যাপনের ভেতর। সে মেয়ে হয়ে উঠতে চায়। তৃতীয় একটি চরিত্র হিসেবে যে মেয়েটি আসে, সে তার যৌনতাকে কোনো খোপেই সংজ্ঞায়িত করতে চায় না – বাইসেক্সুয়াল, লেসবিয়ান, প্যানসেক্সুয়াল, এমনকি কুইয়র – কোনো খোপেই নয়। এটা জেনেও তাকে ভালোবাসবে – এমন মানুষ আর জোটে না। চতুর্থ যে চরিত্র আসেন, মধ্যবয়স্কা, তিনি সম্পন্ন পরিবারের। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে স্বামী এবং সন্তান থাকা সত্ত্বেও তিনি আবিষ্কার করলেন, যে তিনি একজন মেয়ের প্রেমে পড়েছেন এবং তাকে ছাড়া তিনি বাঁচবেন না। এতে যে নিজের স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা বা নির্ভরতা কমে গেল তা নয়। কিন্তু তাঁর মায়ের কাছে এবং নিজের স্বামীর কাছে কনফেস করার পর তাঁকেও আত্মহত্যা করার কথা ভাবতে হয়েছে, অন্তত একবার। বাকি চরিত্রগুলিও এই জায়গাটায় স্বপ্না, সুচেতার সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। এরা প্রত্যেকেই আত্মহননের কথা ভেবেছে, শুধু সামাজিক চাপের কারণে। ওই চিঠিটা চারটি চরিত্র পাঠ করে, পাঠ করতে করতে কাঁদে। খোপে ঢুকতে না চাওয়া মেয়েটি শেষ দৃশ্যে খোলা রিক্সায় চেপে প্রকাশ্য রাস্তায় হাউহাউ করে কেঁদে চলে। এই কান্নাটিকে রেখে দিতে চান পরিচালক – যা আমাদের সামাজিক বিবেকবোধকে প্রশ্ন করে।
আসলে আমরা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের যৌন পছন্দটাকেই স্বাভাবিক বলে মান্যতা দিই। বাকি সবকিছুকেই অস্বাভাবিক, প্রকৃতিবিরোধী, অসামাজিক, অনৈতিক বলে দাগিয়ে দিতে অভ্যস্ত। কোনো মানুষের ভালোবাসা – তার যৌন চাহিদাসহ – শুধুমাত্র বিষমকামী হবে, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সার্থকতা পাবে এবং সন্তান উৎপাদন ছাড়া যৌনতার অন্য কোনো অর্থ থাকবে না – এ সমস্ত কিছুই তো শেষপর্যন্ত সামাজিক আধিপত্যবাদকে বাঁচিয়ে রাখে। এ কথা বোঝার জন্য যে মনুষ্যত্ববোধের প্রয়োজন, তা আমাদের কিছুটা হলেও শেখাতে পারে এই ছবি।