বিজয় তেণ্ডুলকর, মহেশ এলকুঁচওয়ার অথবা সতীশ আলেকারের মত নাট্যকারের নাট্যকৃতি দেখা বা পড়ার সুযোগ থাকায় মারাঠি নাটক সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে। মারাঠি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গায়ক বা গায়িকাদের বিরাট ঐতিহ্য সম্পর্কেও আমরা সশ্রদ্ধ অনুরাগ পোষণ করি। কিন্তু মারাঠি চলচ্চিত্র বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নেই। তার একটা কারণ বোধহয় এই যে আমাদের দেশে আঞ্চলিক ভাষার চলচ্চিত্রের প্রসার এখন ভীষণ অবহেলিত। তার মধ্যে আবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সর্বোৎকৃষ্ট ছবির শিরোপার ৭১ শতাংশ হিন্দি, বাংলা এবং মালয়ালম ছবির দখলে এসেছে গত ৬৯ বছরের ইতিহাসে। সত্যজিৎ রায় সমেত দশ জন পরিচালক তাঁদের প্রথম ছবিতেই এই সম্মান পেয়েছেন। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন মারাঠি পরিচালক চৈতন্য তামহানের নাম ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কোর্ট’ ছবিটির জন্য।
মহারাষ্ট্রে দলিত আন্দোলনের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। এই ছবির অন্যতম চরিত্র নারায়ণ কাম্বলে এক প্রায় বৃদ্ধ প্রতিবাদী লোকগানের শিল্পী যিনি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়ান আর শহরের বিভিন্ন দলিত অধ্যুষিত অঞ্চলে জাত ভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গান করেন। তাঁকে একটা এরকম অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে পুলিস ধরে নিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে বাসুদেব পাওয়ার নামে এক সাফাই কর্মীর মৃত্যু হয়। পুলিসের মতে এটা আত্মহত্যা এবং সেই আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন নারায়ণ কাম্বলে। বাসুদেবের বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় একটি অনুষ্ঠানে নাকি নারায়ণ কাম্বলে একটি গান গেয়েছিলেন যেখানে সাফাই কর্মীদের এই দূষিত জীবনের বদলে মৃত্যুবরণ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। কাম্বলের হয়ে কোর্টে সওয়াল করে বিনোদ ভোরা নামে এক তরুণ আইনজীবী, যে মানবাধিকার নিয়েও চর্চা করে। পুলিস ভাড়াটে সাক্ষী দিয়ে বলানোর চেষ্টা করে যে বাসুদেব নাকি কাম্বলের গান গেয়ে আত্মহত্যা করার জন্যই ম্যানহোলে ঢুকেছিল। পুলিস কাম্বলেকে একটা চিঠির ভিত্তিতে জেলবন্দি অশ্বিন ভাগাত নামে এক রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করে। সরকারপক্ষের মহিলা আইনজীবী নূতন কাম্বলের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ বই রাখার অভিযোগ আনে যদিও বিপিন বোঝাতে চায় ঐ বইগুলি নিষিদ্ধ থাকার কোনো যুক্তি নেই । ইতিমধ্যে পাওয়ারের স্ত্রী কোর্টে দাঁড়িয়ে জানায় তার স্বামী কোনো নিরাপত্তা সুরক্ষা ছাড়াই ম্যানহোলে ঢুকত, প্রতিদিনই মদ খেত এবং কাম্বলের নাম বা তার গানের কথা কখনও সে বলে নি। বাসুদেবের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টেও আত্মহত্যার কোনো প্রমাণ মেলে না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এক লক্ষ টাকার বণ্ডের বিনিময়ে কাম্বলে জামিন পায়। জামিনের টাকা বিপিনই আপাতত দিয়ে দেয়। মুক্তি পাওয়ার অল্পদিন পড়েই আবার কাম্বলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবার অভিযোগ, লোকশিল্পীদের নিয়ে কর্মশালা চালানোর আড়ালে কাম্বলে দেশদ্রোহী শিবির চালিয়েছেন। কাম্বলে এবং বিপিন এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু এবার ইউ এ পি এ দেওয়া হয়। কাম্বলের গুরুতর স্বাস্থ্যের অবনতির আশঙ্কা সত্ত্বেও বিচারক কাম্বলেকে পুলিস হেফাজতে পাঠিয়ে বিপিন কে হাইকোর্টে আবেদন করতে বলেন।
কোর্টরুম ড্রামা বলতে আমরা যা বুঝে এসেছি এই ছবি তার থেকে আলাদা। উচ্চকিত যুক্তি, নাটকীয় উত্থানপতন– সেসব এখানে কিছুই ঘটে না। সবাই যেন নিজস্ব ভূমিকা পালন করে যায় বাড়তি কোনো তাগিদ ছাড়াই। কিছুটা ব্যতিক্রম অবশ্যই বিপিন ভোরা, তার আদর্শবাদের তাগিদেই। কিন্তু সেও এই সিস্টেমের সামনে এক ক্লান্ত যোদ্ধা যেন। উদার, উচ্চ মধ্যবিত্ত বিপিনের শ্রেণী অবস্থানটিকেও চৈতন্য স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেন। সে চোস্ত ইংরেজি বলে, সেমিনারে বক্তব্য রাখে, নিজের গাড়ি চালায়, পাবে বন্ধু ও বান্ধবীদের সঙ্গে রিল্যাক্স করতে যায়। এই ছবির এইটাই বৈশিষ্ট্য যে প্রতিটি চরিত্রকে তাদের নিজস্ব প্রেক্ষিতে ধরা হয়। যেমন সরকারি আইনজীবী সরযূ। কাজের সময়টুকুর বাইরে সে আমাদের চেনা মধ্যবিত্ত মহিলাদের একজন। লোকাল ট্রেনে মহিলা কামরায় বাড়ি ফেরার সময় সহ-যাত্রিণীর সঙ্গে শাড়ি এবং রান্নার রেসিপি নিয়ে গল্প করে, প্লে স্কুল থেকে বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফেরে, রান্না করে, পরিবেশন করে, সপরিবারে রেস্তোরাঁয় খেতে যায়, বরের সঙ্গে নাটক দেখতে যায়। আসলে এগুলো এত খুঁটিয়ে দেখানোর কারণ মনে হয় এটাই যে রাষ্ট্রের হয়ে যিনি সওয়াল করেন, প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের অমানবিক উদ্যোগের সহায়ক ভূমিকা পালন করেন তিনিও অন্য কেউ নন, আমাদের মধ্যবিত্ত যাপনের থেকে উঠে আসা স্বাভাবিক প্রতিচ্ছবি, সেটাই দেখানো। বিচারককেও সেভাবেই দেখানো হয় এই ছবিতে। স্লিভলেস টপ পরে আসা এক মধ্যবয়সী মহিলার শুনানি তিনি বাতিল করে দেন শুধু পোশাক সংক্রান্ত আপত্তি তুলে। ছবির শেষভাগে ঐ বিচারককে দেখা যায় আবাসনের এক পিকনিকে অংশগ্রহণ করতে। সেখানে মধ্যবিত্ত সুলভ বিষয় নিয়ে (যেমন আই টি সেক্টরের মাইনে) আলোচনার পর বিচারককে দেখা যায় রিসর্টের বাইরে এক বেঞ্চে বসে ঘুমাতে। পিকনিকের দলের কয়েকটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে তা দেখতে পেয়ে দুষ্টুমি করে বিচারকের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। বিচারক রাগের চোটে হাতের কাছে যে বাচ্চাটিকে পান তাকেই থাপ্পড় মারেন। সে কাঁদতে থাকে, বাকিরা পালিয়ে যায়। গোটা ফ্রেমে লং শটে বিচারককে দেখা যায়, একা, সম্ভবত আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন বেঞ্চে। সাউণ্ডট্র্যাকে বাচ্চাটির কান্নার আওয়াজ জেগে থাকে। যেন আমাদের স্কুলে পড়া সেই “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”- তারই দৃশ্যরূপ। শুধু জেগে থাকে কর্তৃত্ব (নাকি আসলে ঘুমিয়ে থাকে, এই ঘুমিয়ে থাকাটাই ব্যবস্থাকে সহায়তা করে)। চৈতন্য তামহানে ছবিটি ঘিরে আমাদের বিদ্রোহী চেতনাকে উজ্জীবিত করার কোনো সস্তা উপকরণ সরবরাহ করেন না। কিন্তু যাতে গোটা ব্যবস্থার যান্ত্রিকতা, অসহনীয়তা আমাদের স্বাভাবিক চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে অস্বস্তিকর কাঁটার মত বিঁধে থাকে সেই ব্যবস্থা করেন। কোর্ট ছবিটি আমাদের প্রাত্যহিকতার মধ্যে, উদাসীনতার মধ্যে রাষ্ট্র তার দমন-পীড়নকে কিভাবে এক রুটিন স্বাভাবিকতার অংশ করে তোলে সেটাই দেখায়। ছবিটি আপাতত দেখা যাচ্ছে নেটফ্লিক্সে।
চৈতন্য তামহানের দ্বিতীয় ছবি ‘দ্য ডিসাইপল’(২০২০) মুক্তি পেয়েছে নেটফ্লিক্সে। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের সুমহান পরম্পরা রয়েছে মহারাষ্ট্রে। সেখানে গুরু শিষ্যের সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সঙ্গীতের সাধনায় নিজেকে উজাড় করে দিতে হয় গুরুর কাছে। নিষ্ঠা, অনুশীলন আর আত্মনিবেদনে তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয় নিজেকে। এ সমস্ত কিছু আমাদের অনেকটা জানা। এরকমই এক শিষ্য শারদ নেরুলকর এখানে মুখ্য চরিত্র। শারদ তার গুরুজী বিনায়ক প্রধানের প্রতি, তার অনুসৃত রাজস্থানের আলোয়ার ঘরানার প্রতি একনিষ্ঠ। এই ধরণের অনেক ছবিতেই আমরা দেখি এই পরিশ্রম ও একনিষ্ঠতার ফল মেলে সাফল্যে। কিন্তু চৈতন্যের ছবির ব্যতিক্রম এখানেই যে অর্জন বা সিদ্ধিলাভের ক্ষেত্রে শারদ যেন সবসময় কিছুটা পিছিয়ে থাকে, তার গুরুর মত শিল্পী হয়ে ওঠা (বাণিজ্যিক সাফল্যের প্রশ্নে নয়, সে অর্থে তার গুরুও সফল ছিলেন না) তার আর হয় না। অথচ এইরকম একটা ব্রতে নিজেকে নিয়োজিত করার অর্থ হল নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেওয়া। সত্যিই তাই করে শারদ। সে অন্য কোনো চাকরি করে না,কিছু গান শেখায় (সেখানেও সে আপোষহীন), দিনরাত নিজেকে অনুশীলনে ডুবিয়ে রাখে, বিয়ের প্রস্তাব সরিয়ে রাখে বয়স বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও। এককথায় নিজের গোটা জীবনটাকেই বাজি রাখে শারদ। শারদ এবং তার গুরুর ভূমিকায় চৈতন্য দুই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গায়ককে দিয়েই অভিনয় করিয়েছেন। এঁরা হলেন যথাক্রমে আদিত্য মোদক এবং অরুণ দ্রাবিড়। এর সঙ্গে আছে একটি কাল্পনিক চরিত্র বিদুষী সিন্ধুবাই যাতভ বা মাঈয়ের কণ্ঠস্বর যার কথাগুলি শারদের সঙ্গীত সাধনার পাথেয়। সেখানে ভোরের নির্জন রাস্তায় বাইকে করে যাওয়ার সময় শারদের মাথায় মাঈয়ের কথাগুলি ঘুরতে থাকে যা সঙ্গীতের সাধনাকে আধ্যাত্মিক সাধনার সাথে মিলিয়ে দেয়। হ্যাঁ, শারদ বিচ্যুত হয় না নিজের পথ থেকে। তবু অভীষ্টলাভ তার হয় না। এই বেদনার চিত্ররূপ দেওয়ার কথা কেউ তো ভাবেন নি। শুধু সফলদের নিয়ে কথা হয়। অসফলদের সাধনার কথাও তো বলা দরকার ছিল। এটা শুধু সঙ্গীত নয়। জীবনের আরো অনেক ক্ষেত্রে, সমস্ত আন্তরিকতা, পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের পরও সাফল্য অনেকেরই (বস্তুগত সাফল্যর কথা বলা হচ্ছে না) করায়ত্ত হয় না। তবু এই জার্নিটা থাকে। সেটার জন্যই হয়ত বেঁচে থাকা। দ্য ডিসাইপল এই ভাবেই বহুমাত্রিক দ্যোতনা তৈরি করতে পারে। চৈতন্য তামহানে ভারতীয় চলচ্চিত্রে থাকতে এসেছেন বলেই মনে হচ্ছে।