তানপুরা বিষয়টি বঙ্গজীবনে ইদানিং বিশেষ বেচারা। সেই যে নব্বইয়ের নব্য নিব্বা-নিব্বিরা, সমষ্টিগতভাবেই গিটারের ঝ্যাং-ঝ্যাং শব্দের প্রেমে পড়ে গেল, তার পর থেকেই তানপুরা একটু দুয়োরানি গোছের সময় কাটায় আর কি! ফ্ল্যাটবাড়ির কোণ অথবা চিলেকোঠার ভুলে যাওয়া ধুলো-ময়লায় থম মেরে থাকাই যখন তার ভবিতব্য হয়ে উঠেছে, তখনই আচমকা বাঙালি জানল, পুরনো তানপুরার বাজারদর কত হতে পারে!
হলফ করে বলা যায়, হৈচৈ-এর সাম্প্রতিক সিরিজের প্রথম সিজনটি স্ট্রিমিং হতেই বাঙালি ফিরে গিয়েছে তার পুরনো তানপুরাদের কাছে। তাদের কান মলে, একখান হাগ দিয়ে, বাঙালি যখন ভাবুক-বৈরাগী, সাঁঝবেলাতে গানের টিউশানি-প্রেমে মগ্ন, তখনই একখান এলইডি তানপুরা এসে সব ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা করে দিলে!
বাঙালির আর কিছু থাকুক না থাকুক, একটা জিনিস কোনওদিনই থাকে না — বাজেট। সে আদার ব্যাপার হোক বা জাহাজের, নেকুপুষুমি ছাড়া যদি আর কিছু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালিকে কচুকাটা করে থাকে, তবে তা হল হাভাতেপনা! কথায় বলে, জানিনা, পারিনা, নেইকো ঘরে, এই তিনজনারে দেবতা হারে! বাজেট নাইয়ের ফিকিরে কতশত বাংলা ছবি যে সহ্যের সীমায় ঢুকে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
যদিও লগ্নিতে হৈচৈ একটি অ-বাঙালি সংস্থা, কিন্তু ধারক ও বাহকেরা বাঙালি। তানসেনের তানপুরা-র পরিচালক, চিত্রনাট্যকারও তাই। সম্ভবত সেই কারণেই সিরিজের সর্বশেষ এপিসোডে বাজেটের বাজনার তাল কেটেছে! কিন্তু বাজেটই একমাত্র কারণ নয়, আসল অসুখ আরও গভীরে।
মাস কয়েক আগে যখন প্রথম সিজনটির স্ট্রিমিং শুরু হয়, প্রায় একই সময়ে আমাজন প্রাইমে আসে বন্দিশ ব্যান্ডিটস। এই উকুলেলে প্রজন্মের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীত অনেকটাই সিন্দুকে তালা দেওয়া সাবেকি গয়না। বিশুদ্ধ উপস্থাপন সীমিত, রাগাশ্রয়ী বা রাগপ্রধান গানও। এই দুটি সিরিজই দর্শককে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহ ফিরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টির কোনও তুলনা চলে না। বন্দিশ ব্যান্ডিটস দর্শককে শুধু গান বা গল্প বলেনি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবনদর্শনের অনুভবকে ছুঁয়ে গিয়েছে। গায়ে কাঁটা দেওয়া কিছু বন্দিশ উপহার দিয়েছে যার অনুরণন রয়ে যাবে বহুদিন ধরে। তানসেনের তানপুরা-তে গল্পের জগঝম্পের দাপটে ও সঙ্গীত পরিচালনার মুন্সিয়ানার অভাবে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সেই অনুরণনটাই হারিয়ে গেল।
আইডিয়াটি ছিল চমৎকার। কিন্তু যা ভাবা যায়, তা দেখাতেও আনতে গেলে যে উৎকর্ষতা প্রয়োজন তা কেন জানি বিমনা হয়ে কোথাও উড়ে চলে গিয়েছে। রাগপ্রধান ও রাগাশ্রয়ী গানগুলি শুনলে খুব মনে পড়ে যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই অ-শিক্ষকদের, যাঁদের সাংগীতিক মধ্যমেধা বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকে রাগ সঙ্গীতের প্রতি সহজাত আগ্রহগুলিকে যত্নে নষ্ট করেছে। বিগত দুই প্রজন্মের এই ‘গানের মাস্টার-নাচের মাস্টার’ দৃষ্টিভঙ্গির এবং উলটো পক্ষের সেই অশ্রদ্ধার কাছে মাথা নোয়ানোর ফলাফল — জাতিগতভাবেই বাঙালির রাগ সঙ্গীতের উৎকর্ষতা তলানিতে এসে ঠেকা।
সেই সব অ্যাভারেজের অনেকটা উপরে যাঁরা রয়েছেন, সম্ভবত তাঁরা হৈচৈ-এর বাজেটের বাইরে। প্রসঙ্গত, বন্দিশ ব্যান্ডিটস-এ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে গরজ গরজ আজ মেঘ গানটি শুনলে ভরা শীতেও বর্ষার শিহরণ জাগে।
তা যাই হোক, এই সিরিজে, গল্পের যে চলনটি লেখক ভেবেছিলেন, তার ঠিকঠাক পরিপূরক হয়ে উঠতে পারেনি সঙ্গীত পরিচালনা। আরও সমৃদ্ধ উচ্চমার্গের সঙ্গীতের আশা ছিল। অথচ একটু চোখ বুজে মনে করলেই, আপনার মনে বেজে উঠবে বন্দিশ ব্যান্ডিটস-এর সজন বিন আয়ে না মোহে নিন্দিয়া। অনবদ্য একটি ফিউশন, যেখানে দুটি আঙ্গিকই নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, কিন্তু একে অপরকে এতটুক নষ্ট করে না।
পাশাপাশি, তেঁতুলপাতায় নজন করতে গিয়ে, চিত্রনাট্যকার যাকে বলে রাগ সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর সারাজীবনের জ্ঞান ঠুসে দিয়েছেন। থ্রিলার এখানে বড় বেশি কটকট করে ওঠে, তানপুরার মৃদু ঝঙ্কার ঢাকা পড়ে যায়। তবে এই গানের সূত্র দিয়ে রহস্যের জট খোলার ব্যাপারটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। যদিও তার সপ্তকের কম্পনাঙ্কে কাচ ভেঙে পড়া এবং গুপ্ত বার্তার সন্ধান, তিন দশক আগেই ‘তার সপ্তক’ গল্পে লিখেছিলেন এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়। বাকি জারিজুরিটা চিত্রনাট্যকারের এবং তা বেশ অভিনব তো বটেই।
আরও একটি বিষয় অত্যন্ত প্রশংসনীয়, যা গল্পকে একটি অন্য মাত্রা দিয়েছে, তা হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তবায়েফ অর্থাৎ বারবণিতাদের অবদান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম, অন্তরালে থেকে এঁরা প্রাণে ধরে আগলে রেখেছেন এই সঙ্গীতকে। এঁরাই বরং খুব কমই মধ্যমেধায় হারিয়ে গিয়েছেন। কারণ পঙ্কিল জীবনে এই সঙ্গীতই তাঁদের কাছে শুচিতা ও শুদ্ধতার অনুভব হয়ে এসেছে, জীবনকে পরিপূর্ণ করেছে। সংলাপের মাধ্যমে এই বিষয়টিতে আরও একটু আলোকপাত করলে ভাল হত।
আরও ভাল হতে পারত যৎসামান্য অ্যাকশনের দৃশ্যগুলি। কেন যে চরিত্ররা পরস্পরকে ঠিক করে মারতে পারে না কে জানে! তা বাদে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই ভাল কাজ করেছেন। দুটি সিজনে গল্পের বিভাজনটি চমৎকার। দ্বিতীয় সিজনে গল্পের বিন্যাসও বেশ তরতরে। আবার ‘দেখ-পটকা-কেমন-মিলিয়ে-দিলাম’ ব্যাপারও বিস্তর। আসলে এত বড় সিরিজ লেখা তো কম পরিশ্রমের নয়। ক্রিয়েটিভ লিবার্টির দোহাই দিয়ে তাই মাঝে মাঝে অমন একটু-আধটু হয়।
সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল ফাংশান করতে গিয়ে, পাশের লোকের সুফি গান শুনে হঠাৎ মাথায় বুদ্ধির বাল্ব জ্বলে ওঠা। কিন্তু গানগুলি যদি অল্প- স্বল্প স্কিপ করে সিরিজটি দেখা যায় তবে বিঞ্জওয়ার্দি বটে! আরে বাবা আর যাই হোক না কেন, ট্রেজার হান্ট তো! এই গোপন ধনের প্রতি বিশ্বসুদ্ধ মানুষেরই বেশ ইয়ে আছে, বাঙালিই বা কেন বাদ যায়।
কিন্তু এত আস্ফালন করে, এত শুকতলা খইয়ে, ট্রেজারের যা রূপ চাক্ষুষ করা গেল, তাকে শুধু চোনা বলা যায় না, বলতে হয় রামচোনা! ৩৩ বছর কেটে গেল, তবু বাঙালির ভিএফএক্স সেন্স আলিফ লায়লা-র চকমকি চামেলি থেকে বেরতে পারল না। আমাজন অভিযানের শেষে সোনালি গ্লিটারের প্রলেপ লাগানো সোনার শহর দেখে যাঁরা চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি, তাঁরা উথালি পাথালি হবেন সিজন ফিনালে-তে, তানসেনের তানপুরাটি দেখে।
অ্যান্টিক সম্পর্কে যাঁদের কোনও তালজ্ঞান নেই, তাঁরাই তানসেনের তানপুরা-র অমন একটি নয়নজ্বালানো রূপ কল্পনা করতে পারেন। ট্রেজার হান্ট সিরিজের চূড়ান্ত রিনরিনে মুহূর্তে, দর্শক যখন মুখ চালানো বন্ধ করেছে, মিয়াঁ তানসেনের কথা ভাবতে ভাবতে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গিয়েছে—তখনই খুলে যায় বাক্স, কার্টুনে দেখা সেই ট্রেজার বক্স, যেখান থেকে আলো ঠিকরে বেরয়— হলদে-সবুজ-ওরাংওটাং আলোখচিত তানপুরা দেখে চোখ ঝলসে যায়।
আসলে দোষ কারও নয় গো মা। দোষ এই পাপী মনের যেখানে নান্দনিকতার একটা বোধ তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন গগন-অবন-রবি বর্মা। যে নান্দনিকতা কী সহজাতভাবে পর্দায় ধরে ফেলেন মীরা নায়ার! সত্যি বলছি, মোটের ওপর উপভোগ্য এই সিরিজের শেষে যখন ওই বিচিত্র তানপুরা পর্দায় ভেসে ওঠে তখন একটা সৎ কষ্ট হয়। সম্পদ মানেই মণিমাণিক্য আর জেনেরিক ভার্সন টুনিলাইট? বাংলায় প্রোডাকশন ডিজাইন ও আর্ট ডিরেকশনে যে অ্যাভারেজপনা রয়েছে, তা থেকে যদি বেরিয়ে না আসা যায়, তবে বাংলা ওটিটির মান উন্নয়ন হবে না! বাজেট একটি অজুহাত মাত্র, দৃশ্যপট ভাবনার দৈন্যই এক এবং একমাত্র কারণ।
যে বাঙালি আর তুতু-ভুতু পড়ে না, শিশু সাহিত্য বলতে বোঝে উৎকট ভূতের ছবি আঁকা প্রচ্ছদ, যে বাঙালির ঘর সাজানোতে মাটির কোনও গন্ধ অবশিষ্ট নেই, আছে শুধু সবুজ দেয়ালে বেগুনি পর্দা, সেই বাঙালি দর্শকের জন্য অবশ্য রংবেরঙের এলইডি তানপুরাই অ্যান্টিক—একেবারে আক্ষরিক অর্থে!
আপনার কলমে এমন আরও রিভিউ আসুক। আমার বিশেষ পছন্দ বন্দিশ ব্যান্ডিটস। গান, ফিউশন, অভিনয়।
কিন্তু চেনা পরিচিতদের গালাগালির সামনে অসহায় ।
লেখাটা একটা সিরিজের সমালোচনা না একটা প্রপের সমালোচনা - হলেও বা সেই প্রপ নামভূমিকায় - বোঝা গেলনা।
আর ইয়ে, তুতু-ভূতু পড়া বাঙালি হবার অবশ্যশর্ত কেন, তাও বোঝা গেলনা।
তবে খাবলে-খুবলে সিরিজের যেটুকু দেখেছি, বুঝেছি না দেখলে কোন ক্ষতি হতনা।
ভালো লিখেছেন
খুব ভালো লাগলো
"তানসেনের তানপুরা" আইডিয়াটিই হাস্যকর। লেখায় তিন নোক্তা।
নাম ভূমিকায় গুরুচণ্ডা৯ কথিত সবুজ জমিনে "করোনাকালীন সময়ে" পড়ে থ' হয়েছি।
খানিক ধাতস্থ হয়ে লেখাটি পড়ে ভাল লেগেছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, লেখার স্টাইলও ভাল, এরকম আরো লেখা চাই।
পুনশ্চঃ লেখায় উদ্ধৃত দুটি গানের লিংকের একটিও এপস ভার্সনে কার্যকর নয়! কেমনে কী?
:D :D
খাজাস্য খাজা বন্দিশ ব্যান্ডিট-এর চেয়েও খারাপ! বাপ্ রে!
আর লেখায় ২ বার 'উৎকর্ষতা' দেখে একটু কষ্ট পেলাম।
বন্দিশ ব্যান্ডিটস ভালো লেগেছে
লেখাটি বেশ লাগলো, শুধু 'উৎকর্ষতা' বাদ দিয়ে!