যে কোনও মাধ্যমের একটা রাজনীতি থাকে। তার প্রত্যেক পদক্ষেপ হয় মাপা, সুপরিকল্পিত। পেশাদার একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অবধারিত ভাবেই সুনির্দিষ্ট কিছু কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি নির্ভর। যৌন সুড়সুড়ির সিউডো দর্শন, অগভীর স্যাটায়ারের ওপর ভর করে যে প্ল্যাটফর্মটি তাদের ভিত শক্ত করেছিল, প্রেমকে তারা যে একেবারেই একটি বস্তাপচা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে, সে আর আশ্চর্য কী! হইচই-এর সাম্প্রতিক রিলিজ, ‘’টুরু লাভ’’ সত্যিকারের প্রেম অথবা ট্রু লাভ-এর যে ব্যাখ্যা দেয়, তা হাস্যকর তো বটেই, পাশাপাশি পরিবেশনার মানের দিক থেকে এ সিরিজ একটি অপুষ্ট বনসাই।
বনসাই যাঁরা বেচেন তাঁরাও বোঝেন আর যাঁরা কেনেন, তাঁরাও বোঝেন যে এটি প্রাকৃতিক নয়। বামন আর বনসাই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন তল ও মাত্রা। বামনত্ব তার স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, তার নিজস্ব একটি আর্ক আছে। অন্যদিকে, বনসাই একটি আরোপিত দৃষ্টিনান্দনিকতা তৈরি করে যা প্রকৃতির ভাবনায় ছিল না কখনও। বনসাই মানেই সেখানে রয়েছে হিউম্যান ইন্টারভেনশন-- একটি পরিকল্পনা কাজ করেছে, বিশেষ পরিচর্যাও। তাই প্রাকৃতিক নিয়মে, ঋতুচক্রে, শুকিয়ে যাওয়া গাছকে অসুন্দর মনে হয় না। কিন্তু সুসজ্জিত ঘরে একটি অপুষ্ট বনসাইকে প্রতিষ্ঠা করলে, তা চোখে লাগে বইকি! কাঠখড় পুড়ছে যেখানে, সেখানে নির্মাণ যথাযথ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
হইচই-এর এই সিরিজটি হল মিনি সিরিজ অর্থাৎ অন্যান্য সিরিজের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম দৈর্ঘ্যের। তা নিয়ে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মিনি বলেই চরিত্র ও ঘটনাগুলি রণপায়ে হেঁটে যাবে এবং দর্শক হাঁফাতে হাঁফাতে পিছনে ছুটবে, তা কি কাম্য? ৫ এপিসোডে গল্পটি শেষ হয়, কিন্তু দানা বাঁধে না। পুরোটাই বিজ্ঞাপনী তারাবাজি। আহা, ইন-ফিলিম ভালো। কড়ি না ঠেকালে জীবনে প্রেম টিকিয়ে রাখাও যে মুশকিল, সিরিজের চিত্রনাট্যকার নিজেই তা বেশ ‘পষ্ট’ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই গল্পে। কিন্তু তা বলে এত নির্লজ্জভাবে ইন-ফিলিম?
প্রেম সপ্তাহ নিয়ে আপনি যতটা না ভাবিত, বিজ্ঞাপনদাতারা তার শতগুণ হবেন, সেটাই কাঙ্ক্ষিত এবং বাঞ্ছিত। রথের মেলায় পূজাবার্ষিকী প্রকাশের মতোই, পরবর্তী বছরের প্রেম সপ্তাহের পোঁ শোনা যায় নাকি শারদোৎসবের ছুটি খতম হলেই। তবে কেন এত হেলা হে নাথ? বাঙ্গালার (ঙ টাইপ না করাটা এক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত) সর্ববৃহৎ ওটিটি মাধ্যমের ভ্যালেন্টাইন ধামাকায় কেন এত চেয়ে-থাকা সবজি সমাহার?
সেনকো গোল্ডের ভ্যালেনটাইন অফার, সোনার আংটিতে ছাড় ইত্যাদি যখন গন্তব্য, তখন সিরিজের প্রথম এপিসোডেই একটি মুখ্য চরিত্র বলে বসে— বিয়ে করতে হলে, একটা ডায়মন্ড রিং কিনে, এক পায়ে বসে, প্রেমিকাকে বলতে হয় আই লাভ ইউ। এই উথাল-পাথাল বিজ্ঞাপনী ভারে সংলাপের ঢেউ-কুচকুচ যখন একদিকে ঝুলে গিয়েছে, তখন তাকে ঠেকনা দিতে এল পরবর্তী লাইন—আর সেই রিংটা নিজের টাকায় কেনা হতে হয়।
আসলে ‘টুরু লাভ’ যতটা না সেনকো গোল্ডের বিজ্ঞাপন, তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মনির্ভরতার ক্যাম্পেন। আইটি সেল কেন যে এখনও এর মাহাত্ম্য অনুধাবন করল না, তা আর এক আশ্চর্যের বিষয়। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও প্রলেতারিয়েত সম্পর্কে এই শ্রেণির ধারণা নিয়ে যে নিম্নমানের হাস্যকৌতুক তৈরি করা হয় এই সিরিজে, তা থেকে মেকারদের রাজনৈতিক অন্তঃসারশূন্যতা অত্যন্ত প্রকট।
আর মেকিংয়ের কথা না তোলাই ভাল। পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরীর এযাবৎ নিকৃষ্টতম কাজ। এই সিরিজটি হইচই-এর ফ্রি কনটেন্ট। সাবস্ক্রিপশন ছাড়াই দেখা যায়। সম্ভবত এটা বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিউ জেনারেট করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা বলে মুফতের মালের কোনও মান থাকবে না? এখানে মান একমাত্র ধরে রেখেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, বিশেষ করে রাজনন্দিনী, ঋষভ, ঊষসী, পিঙ্কি এবং সুমিত। বাংলা থিয়েটারের নব্য প্রজন্মের অন্যতম দক্ষ অভিনেতা রাজু বেরা একেবারেই অব্যবহৃত। আসলে মেইনস্ট্রিম মাধ্যমগুলির এটাই সমস্যা। এরা শুধুই গ্লস বোঝে, ম্যাট নয়।
এই সিরিজ নিয়ে তার চেয়েও বড় আপত্তি প্রেমের সংজ্ঞা গুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা নিয়ে। আসলে যত সময় এগোচ্ছে, মেকি গতিময়তায় হারিয়ে যাচ্ছে ভাবনার গভীরতা। যে প্রজন্ম প্রেম বলতে বুঝত অপুর সংসার, সেই প্রজন্ম ঠিকঠাক উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেনি বোধহয়।
অথচ তা-ই বা বলি কী করে? উত্তরা-ও তো ছিল অথবা সাম্প্রতিক অতীতে এসেছে লেবার অফ লাভ। যে কোনও সময়কালে, যে কোনও প্রেক্ষাপটে সত্যিকারের প্রেম বা ট্রু লাভ সবসময় লারজার দ্যান লাইফ। নাহলে সেটা প্রেমই নয়, সম্পর্কের সমঝোতা মাত্র। ওয়েব সিরিজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে, প্রেম যদি এভাবে, এত ঠুনকো হয়ে ধরা দেয়, তবে তা দুশ্চিন্তার।
টুরু লাভ আদতে কোনও প্রেমের গল্পই নয়, একটি মোড়ক দেওয়া বিচ্যুতি মাত্র।
ওফ্ফ্ফ্ফ্ফ্ফ
জাআআস পারা যায় না!
টুরু লাব ইজ লার্জার দ্যান লাইফ - এক্কেবারে খাঁটি কথা। সেজন্যই তো কবি গেয়েছেন - প্রেম জেগেছে আমার মনে বলছি আমি তাই, তোমায় আমি ভালোবাসি তোমায় আমি চাই। উরি উরি বাবা উরি বাবাগো!
ভালই লিখেছেন তো।আরো লিখুন
পুরাই ন্যাকাবোকা পোলাপান ছবি, ইন্টারনেট ডেটার অপচয়!
আরও লিখুন