এ লেখা যখন লিখছি, তখন চোখের সামনে তাঁকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে এক শান্ত শোভাযাত্রা – রবীন্দ্রসদন থেকে ক্যাওড়াতলা শ্মশানের দিকে। কেউ আমাকে কিচ্ছু লিখতে বলেনি। কাউকে জানাবার দায়ও নেই কোনও। তবু আমি লিখছি, সব কাজ ফেলে তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাব বলেই। এই সময়টুকুই তাঁর প্রতি, আমার একান্ত অর্ঘ্য। যথার্থই এক ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’।
বিবিধ ভারতী শোনা বা বাংলা সিনেমা দেখা – এ দুটোর মধ্যে কোনটির চলই আমাদের বাড়িতে ছিল না। মানে খড়দায় থাকাকালীন কিশোরী-বেলা অবধি। আমার চিত্র শিল্পী বাবা মেতে থাকতেন ছবি আঁকা, শখের ছাদ বাগান, পাড়ার নাটক আর আড্ডায়। আর মায়ের পেশাদারি শিক্ষয়িত্রী জীবনের বেশির ভাগটাই কেটে যেত , ইশকুল গড়া ছাড়াও নানা সামাজিক কাজে। বড় সুন্দর এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল আমাদর পরিবারকে ঘিরে। আশপাশের বাড়িতে ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’ বা সিনেমার হিরো হিরোইনদের নিয়ে চর্চার আঁচ আমাদের মনে তেমন ছাপ ফেলেনি বাবা এবং মা দুজনেই ছিলেন হলিউড ভক্ত। বাবা এবং মা দুজনেই ছিলেন হলিউড ভক্ত। আমাদের দু’বোনকে শ্যামবাজারে ছোট পিসিমার বাড়ি জমা রেখে, খড়দা থেকে নিয়মিত টকি - শো হাউস ছাড়াও এলিট, নিউ এম্পায়ার , মেট্রো , গ্লোব আর লাইট হাউস। এর মধ্যে মনে পড়ে যে , গঙ্গা ছবিটি তাঁরা দেখেছিলেন , কারণ পরিচালক রাজেন তরফদার ছিলেন বাবার সহপাঠী। আর্ট কলেজের পড়া শেষ করে প্রথম জীবনে বাবা চলে যান এখনকার মুম্বাইতে , ফিল্মিস্তান বা বোম্বে টকিজে সিনেমার আর্ট ডিরেকশনের কাজ পেয়ে। সঠিক তথ্য যাচাইয়ের মানুষ গুলি কেউই আর বেঁচে নেই। তবে শোনা কথা এই যে , বছর খানেকের মধ্যে সে কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে এলেও তাঁর কলকাতার আড্ডায় প্রায়ই আলোচনায় এসেছে সাদাত হোসেন মান্টো, লুধিয়ান সাংভি, অশোক কুমার, হিমাংশু রায় – এই রকম সব নাম। মান্টো এবং অশোক কুমার ছিলেন বাবার সমবয়সী – জন্ম ১৯১৩ সাল। তো বলার কথা এই যে, ছায়াছবির সংসারে নিবিড় কাটিয়েও ওদিকে তাঁর টান তেমন ছিল না।
বাবার মৃত্যুর পর খড়দার পাট চুকিয়ে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে থাকা শুরু করে আর বাগবাজারের ইশকুলে ভর্তি হয়ে , সেই প্রথম দেখলাম সারি সারি সিনেমা হল – ঠিক যেন ছোট পর পর দাঁড়িয়ে থাকা ফুল দিদু, মেজ-কাকা কাকা, বড় জেঠুদের বাড়িগুলি। খড়দার কুলীন পাড়ার বদলে যেন সিনেমা পাড়া। আর দেখলাম বাংলা সিনেমা আর বোর্ডের নাটকের ছয় লাফ। স্টার বিশ্বরূপা রংমহলের মতোই রাধা, শ্রী, উত্তরা, দর্পণা আর রূপবাণী। তো আমাদের বাসা থেকে ছোট পিসিমার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি হাঁটা পথ। তাঁর বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বহু মানুষের আনাগোনা। সেই সূত্রেই দাদা দিদিদের বন্ধু মানেই আমাদেরও গগনদা, বাসুদেবদা, অশোকদা, সমীরদা, পূবালীদি, বুলবুলদি, রত্নাদি।
থাঙ্কোমণি কুট্টির সঙ্গে প্রথম আলোর সিডি প্রকাশের অনুষ্ঠানে
রেডিওতেই কোনও একটা অনুষ্ঠান করাবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন আমার মা। তিনি তখন বাগবাজার মাল্টিপারপাস ইশকুলের বড়দি। তাঁকে সহযোগ দিতে সঙ্গে ছিলেন, অশোকদা - মানে অশোক পালিত। রেকর্ডিংয়ের দিন একটা গাড়িতে অনেকে মিলে চলেছি আকাশবাণী ভবনের দিকে। হঠাৎ দেখি সিগনালে পেয়ে ঠিক পাশেই থেমেছে লাল টুকটুকে একটা গাড়ি। স্টিয়ারিংয়ে বসা মানুষটির সঙ্গে এ গাড়ি থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলছেন অশোকদা। আর সেই রূপবান মানুষটির পাশে বসে আছেন ঝকঝকে এক মহিলা। পিছনের সিটে একটি ছোট ছেলে এবং একটি পুঁচকি মেয়ে। অশোকদা ওই মানুষটিকে ‘পুলু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। সিগনাল সবুজ হতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দুটো গাড়িই ছেড়ে গেল। আমার কানে ভোঁ ভোঁ করতে লাগল এক অসচরাচর কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ আর মনের মধ্যে এক রূপময় মুখ, যেখান থেকে চোখ যেন আর ফেরানো যায় না। মায়ের কানে গুন গুন করতেই মা বললেন – ‘উনি সিনেমায় অভিনয় করেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – অশোকদার বন্ধু’।
ইশকুলে তখন সপ্তম শ্রেণি। সহপাঠী বন্ধু শ্রাবন্তীকে পরদিন ইশকুলে গিয়েই, ওই দিনের গপ্পো বলাতে, ও বলল যে উনি ওদের বাড়িতে আসেন, ওর বাবার কবিতা নিতে; বলল – ‘এক্ষণ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক তো তাই’। শ্রাবন্তীর বাবা শঙ্খ ঘোষ। বাড়ি ফিরে সেদিন মায়ের ঘরে বসে বই ঘাঁটতে গিয়ে এক্ষণের কয়েকটা সংখ্যা হাতে পেয়ে বুঝলাম, যে শুধু সম্পাদক নন, উনি একজন কবিও। উত্তর কলকাতার গড়পড়তা অধিকাংশ বাড়িতেই তখন উত্তম - সুচিত্রা বা উত্তম - সাবিত্রীর ছয়লাপ। আর, তার পরের সারিতে সন্ধ্যা রায় ও বিশ্বজিৎ জুটি। হাতি বাগানের সিনেমা হলেও তাই। কিন্তু সৌমিত্র কোথায়? তবু মা আর ছোট পিসিমার উদ্যোগে বেশ কিছু বাংলা সিনেমা দেখা হল, যেখানে সৌমিত্র নায়ক। একে কলকাতা , তার ওপর বড় পর্দায় প্রথমেই ‘পরিণীতা’ – ফলে, ‘শেখরদা’ তো মাথা চিবিয়ে খেল। এর পিছু পিছু মাল্যদান দেখে মনে হল, মরেই তো সব সুখ। মাথা পুরো ভোঁ ভোঁ। এভাবেই ‘অশনি সংকেত’, ‘সংসার সীমান্তে’ – এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই ‘বসন্ত বিলাপ’ এবং ‘ছুটির ফাঁদে’। ওরে বাবা, সে কী উতরোল! ইতিমধ্যে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘অসময়’, ‘আপনজন’ এবং সেই সঙ্গে এক ঝাঁক নতুন নায়কও। ধৃতিমান, রঞ্জিত মল্লিক, স্বরূপ দত্ত, দীপঙ্কর দে আর শমিত ভঞ্জ। ‘যদি জানতেম’ আর ‘স্ত্রী’ দেখার পর তো ফেরার সব রাস্তাই বন্ধ। শুধু অপেক্ষা পরের ছবির। আর ‘এক্ষণ’ এলেই খোঁজ তাঁর লেখা কবিতা আছে? সুনীল – শক্তি - সৌমিত্র পার করে তবে বাকি জনদের লেখা। এই তিনজনই জুড়ে এলেন আমাদের সংস্কৃতি চর্চায়, একেবারে স্বাধীন নির্বাচনে।
ইশকুল কলেজের সন্ধিক্ষণে রাজেশ, অমিতাভ, সঞ্জীব কুমার, জয়া, নাসের, শাবানা, স্মিতার ঢেউ সামলেও ‘সৌমিত্র’ বিলাস রয়েই গেল চেতনার অভ্যাসে। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসে তৈরি হল আর এক নতুন সংসার – কফি হাউস। সেই সূত্রে সিনে ক্লাব, সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মাধবী আর গ্রুপ থিয়েটার। অজিতেশ, রুদ্র, কেয়া পার করে - অশোক বিভাস মেঘনাদ। এবার পেলাম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বোর্ড নাটক। বৃহস্পতি শনি রবি – তিনদিন নিয়মিত, মাসের পর মাস। প্রথম নাটক ‘নাম জীবন’ তাঁর স্ত্রী দীপা বৌদির করা নাট্যরূপ। সেই শুরু - সৌমিত্রমুগ্ধতার আরও এক পর্ব এবং একই সঙ্গে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা। ‘রাজকুমার’ ,‘নীলকণ্ঠ’, ‘কুরবানি’, ‘টিকটিকি’। ক্রমে পরিণত সৌমিত্র – ‘ক্ষিদ্দা’। কফি হাউসের আঁতলামি পর্ব সমাপ্ত হল, ছোট বেলায় হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া তাঁর সব ছবি গুলি একে একে দেখে - বিশেষত ‘অভিযান’, ‘চারুলতা’, ‘দেবী’, ‘সমাপ্তি’ আর ‘অপুর সংসার’। আর প্রেম অটুট হল, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে। না হয়ে যায়! সে যে সুনীল – সৌমিত্র জুটি।
সত্যজিতের হিরো থেকে বাংলা সিনেমার পুরোদস্তুর নায়ক হয়ে উঠলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন আমরাও বড় হচ্ছি টগবগিয়ে। রমরমিয়ে দূরদর্শনও এসে যাওয়াতে পুরনো সিনেমাও প্রায় সব; ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘প্রথম কদম ফুল’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘মন্ত্রমুগ্ধ’ , ‘অপরিচিত’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ইত্যাদি। ইতিমধ্যে হুট করে চলে গেলেন উত্তম কুমার। আর ‘শাখা প্রশাখা’ , ‘হুইল চেয়ার’, ‘আতঙ্ক’ দেখতে দেখতেই একে একে চলে গেলেন সত্যজিৎ ও তপন সিংহও। নতুন পরিচালকদের সঙ্গেও একই রকম মসৃণ হয়ে উঠতে লাগলেন সৌমিত্র। এমনকি না চলা আনাড়ি সিনেমাতেও তাঁর অবস্থানও কিন্তু হতে লাগল অনড়। সময়ের বদলে সহজ হল তাঁর আবৃত্তি শোনা। কৈশোরে, একটি লঙ প্লেয়িংয়ে তাঁর আবৃত্তি সব সময় শুনতাম – ‘বনলতা সেন’। ধূসর গোধূলির সে কী রোমান্টিক আবহ! এর পর তো রাশি রাশি সি ডি। আর তারপর ইউ টিউবে – ‘চাই কী, নাই কি’ আয়োজন। অসংখ্য শিল্পীর গানে যুগলবন্দিতে ধরা তাঁর আবৃত্তি, সাক্ষাৎকার। আর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর এতো এতো লেখাও, বিশেষত সংবাদ প্রতিদিনে তাঁর সাপ্তাহিক কলাম - ‘কফি হাউস’।
তো এই রকম এক স্বপ্নের মানুষের সঙ্গেও নৈকট্য হয়; এবং তা ঘটল আমার জীবনে, পরিণত বয়সে, চল্লিশ পার করে। বারুইপুরের কাছে, অন্তরা সাইকিয়াট্রিক সেন্টারের – এস্থেটিক থেরাপি ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত থাকার কাজে। এখানকার রোগীদের জন্য আমি এক ধরণের শুশ্রূষা পদ্ধতি শুরু করি, রবীন্দ্রনাথের গান ও নাচের মাধ্যমে। ক্রমে তা একটি নিয়মিত বিভাগ হয়ে দাঁড়ায় – নান্দনিক শুশ্রূষা বা Aesthetic Therapy Unit হিসেবে। ২০০৭ বা ২০০৮ – এই রকম সময়ে এ বিষয়েই আনন্দবাজার পত্রিকাতে আমার একটি উত্তর সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। সেটি পড়ে এফ এম রেডিওর একটি চ্যানেল থেকে আমন্ত্রণ আসে ‘তোমার আকাশ - তোমার বাতাস’ শিরোনামে দু’ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানে নান্দনিক শুশ্রূষা ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু বলার জন্য। অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন শোভন তরফদার আর সঞ্চালনায় স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের কিছু গান এবং তাঁর সঙ্গে আমার আলাপচারিতা। ওঁকে বাড়ি থেকে তুলে, সেই গাড়িতেই পার্ক স্ট্রিটের একটি স্টুডিওতে আসা। শুরু হল এক নতুন শিক্ষা পর্ব।
পথের আলোর অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা, জ্ঞান মঞ্চ, ২০০৯
গাড়ি নিয়ে ওঁর বাড়ি পৌঁছতে ঠিক পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছিল। সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়েই ছিলেন। কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে গাড়িতে উঠলেন। যেতে যেতেই সহজ আলাপ। তাতে কী! আমি তো বিস্ময় আর মুগ্ধতায় কুঁকড়ে গেছি। স্টুডিও পৌঁছে মাইক্রোফোনের সামনে বসে একেবারে অন্য মানুষ। শোভনের কাছে বিষয় বক্তব্য শুনে নিয়ে, পূর্ণ দৃষ্টিতে আমাকে এবার ভাল করে মাপলেন। শুরু করার আগেই আত্তি করে দেখিয়ে দিলেন, অনায়াসে মাইক্রোফোন ব্যবহারের পদ্ধতি – যা এ জীবনে আর ভুলব না। কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল কে জানে! লাইভ অনুষ্ঠান – দু ঘণ্টা, শুধু কথা বলে? না - সেদিন আমি ফোন নম্বর, অটোগ্রাফ বা এক সঙ্গে একটা ফটো কিছুই নয়। অথচ তখনই পরিচিত শ্রোতাদের মেসেজ ঢুকতে শুরু করেছে – ‘ তুই কি এখনও ওঁর সঙ্গেই রে?’
*************************
আবার দেখা হল, ‘হোমাপাখি’ র অভিনয় শেষে গ্রিন রুমে। শিশুর মতো উদগ্রীব প্রশ্ন – ‘কেমন লাগল’? বুঝতে পারলাম যে চিনতে পেরেছেন। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম- ‘অন্তরার বার্ষিক অনুষ্ঠানে কি আপনাকে পেতে পারি’? ফোন নম্বর দিয়ে বললেন – ‘খবর দিয়ে বাড়িতে এসো, কথা বলবো’। লোহার গেটের বাইরে থেকেই গাছেদের অভ্যর্থনা, বিশেষত - পান্থপাদপ। রেলিং দরজা পার করে অন্দরে পা রাখতেই, বাঁধানো পথের পাশে শুধু ঘাস নয়, বেগুনি ফুল ফোটা ঘন সবুজ পাতারও গালচে। আর নানা লতার সঙ্গে আইভি মোড়া এক সুপর্ণ দেওয়াল। দীপা বৌদির সাজানো এক্সটেরিয়ার এবং ইন্টিরিয়র তো বটেই। সে যে কী সুন্দর আর অভিনব না দেখলে বোঝানো যাবে না। আর তার সঙ্গে এক কাপ দার্জিলিং নিয়ে, বৌদিও এসে বসলেন। আমাকে আর বেশি অভিভূত হবার সময় না দিয়ে দুম করে কথা শুরু করে দিলেন সৌমিত্র দা। বললেন – ‘বেশ তো - মঞ্চে থাকব কিছুক্ষণ, কিন্তু কী ভাবে থাকব তা তোমাকেই ভাবতে হবে। আমি বাপু ভাববার সময় দিতে পারব না’। আমিও ঝপ করেই বললাম – ‘যদি হোমাপাখি করেন, মানে অংশ বিশেষ!’ আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে রাজী। এই হল নৈকট্যের শুভ সূচনা। অন্তরার কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সুধীজনেরা তো কেউ বিশ্বাসই করছেন না যে, কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই উনি মঞ্চে থাকতে রাজি হয়েছেন, এবং দিন ক্ষণ কিছুই না জেনে। মানে ওঁর ভাবখানা এমন যে, পারিশ্রমিক আবার কী! অন্তরার সাম্মানিক সচিব, সেই বুদ্ধিমান পি এম জন ( আঙ্কল) তবু দশ হাজার টাকার অনুমোদন অন্তরার বাজেটে আগাম দিয়ে রাখলেন, সম্মান মূল্য হিসেবে। সামরিক তৎপরতায় উঠে পড়ে লেগে জ্ঞান মঞ্চে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের অনুষ্ঠান সাজিয়ে। এই প্রথম অন্তরার আবাসিকদের নিয়ে কলকাতার মঞ্চে, অজানা দর্শকদের সামনে পেশাদারি মেকআপ ও কস্ট্যুমে নাচ - গান। ঘড়ি ধরে এসে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে সহ অভিনেত্রী কন্যা পৌলোমী। দুর্ভাগ্য তাড়িত এবং অবসাদ গ্রস্ত মানুষগুলির নাচ গানের পর, ওঁরা দুজনে অভিনয় করলেন হোমাপাখির একটি অংশ। বিশেষত অসুস্থ মানুষগুলি ও তাঁদের অভিভাবকদের মনে - সে যে কী সংযোগ তৈরি হল, বলবার নয়। অভিনয় শেষে ওঁদের হাতে ফুল দিলেন আঙ্কল পি. এম. জন - অন্তরার তরফ থেকে। তোড়ার নিচে গোঁজা, টাকার খামটি বার করে সঙ্গে সঙ্গে আঙ্কলকে ফিরিয়ে দিলেন, মঞ্চে দাঁড়িয়েই। অন্য কেউ না দেখলেও পাশে দাঁড়ান আমি তার সাক্ষী। আর দেখলাম, ওঁর নির্বিকার অভিব্যক্তির পাশে, আঙ্কলের হতবাক হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। গাড়িতে তুলে দেবার সময়, ওঁকে প্রণাম করতে গিয়ে, তীব্র সুখে ঝর ঝর করে সে কী কান্না আমার! এরপর তো প্রতি বছর, আমাদের ‘পথের আলো’ অনুষ্ঠানে ওঁর উপস্থিতি এক ধারাবাহিক অভ্যাসই হয়ে দাঁড়াল। কখনও উনি কবিতা পড়েছেন, ওরা নেচেছে, কখনও আবার উনি কথা বলেছেন আর শ্রোতারা শুনেছে। কোনও পারিশ্রমিক নেবেন না, অথচ তাঁর নাম আমন্ত্রণ পত্রে থাকায় অন্তরা পেতে লাগল শ্রোতাদের আর্থিক সহায়তা। এক বিচিত্র সংযোগে হয়ে উঠলেন - ‘অন্তরা বন্ধু’। স্মরণীয় হয়ে আছে অন্তরার তৃতীয় বা চতুর্থ বারের ‘পথের আলো’ অনুষ্ঠানেই জ্ঞান মঞ্চে তাঁর পাঠে, আমার লেখা – ‘ফুলরাণী’। সেবার সভয়ে তাঁকে বলি – ‘মানসিক রোগাক্রান্ত এক ফুলরাণীকে নিয়ে একটা লেখা আছে পড়বেন’? জিজ্ঞাসা করলেন –‘কার লেখা’? মাথা নিচু করে বললাম – ‘আমার’। বললেন- ‘দিয়ে যেও, পড়ে দেখে বলবো; তবে এনলার্জড ফটোকপি চাই। সাধারণ মাপে পড়তে সময় লাগে; আমার সময় কোথায় বল’! এর আগে রেডিওর সেই অনুষ্ঠানে আমার কিছু কবিতা শুনেছিলেন, সেটুকুই যা ভরসা! পরদিন কথামতো ‘ফুলরাণী’র এনলার্জড জেরক্স দিতে গেলে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘তোমার পড়তে কত সময় লাগছে’? বললাম- ‘দশ মিনিট’। কয়েকদিন বাদে ফোন করে জানালেন- ‘ওটাই পড়ব’। আমার দম যেন বন্ধ হয়েই রইল। আমন্ত্রণ পত্র ছাপাবার আগে আরও একবার ফোন করে সম্মতি নিতেই বললেন –‘ওই রকম ফটোকপি আরও দু’সেট বাড়িতে রেখে যেও’।
২০০৮ সালে পথের আলোর এক অনুষ্ঠানে বর্তমানে প্রয়াত পি এম জনের সঙ্গে
আমাদের ছেলেমেয়েদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই দেখি, উইংসের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন –‘কটা বেল পড়বে’? অনভ্যস্ত আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে, নিজেই যন্ত্রীদের বললেন- ‘তিনটের বদলে দুটো বেল দিয়ে পর্দা সরিও’। এবার আমাকে কাছে ডেকে বিনীত স্বরে বললেন –‘তোমার একটা অনুমতি চাই; এই ‘ফুলরাণা’ পড়ে আমি একটা কবিতা লিখেছি, সেটাও কি শেষে পড়তে পারি’! না মানে আপত্তি থাকলে শুধু ‘ফুলরাণী’ই পড়ব’। নিজেকে সামলে সংযত স্বরে বললাম – ‘আপত্তি নেই’। প্রথম বেল, দ্বিতীয় বেল – পর্দা উঠল। মঞ্চের মাঝখানে আলো হয়ে বসে আছেন। সামনের টেবিলে রিডিং লাইটের নীচে সেই এনলার্জড ফটোকপি – ফুলরাণী’। উইঙ্গসের পাশে আমি বসে আছি –নিথর , দম বন্ধ হয়ে। এ অভিজ্ঞতা তো এই জীবনে এই একবারই হবে! আমার পড়ায় সেই কুড়ি মিনিটের পাঠ, ওঁর তিরিশ মিনিট ছাড়াল । পাঠ শেষে কিছুক্ষণ থেমে , এবার বললেন – এই লেখা কেমন করে তাঁকে ওই কবিতা লেখাল। আর, সেই আবৃত্তিতে আমি স্তম্ভিত!
‘চিরত্ব পেল, ধ্রুব হল’ - ( ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮)
তুমি মেনে নিতে পারবে
তোমার নিঃসঙ্গতা - সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচতে পারবে তো?
তাহলে নিরবধি কাল অপেক্ষা করে থাকবে
তোমার অঞ্জলি থেকে
ফুলরাণী কুসুমের অর্ঘ্যটিকে নেবে বলে
তুমি যে গতিহারা পুষ্পের শরীরকে
সম্ভ্রম দিলে
অনিকেত দুঃখকে
স্বীয় বলে বরণ করলে
সে চিরত্ব পেল, ধ্রুব হল
তার কথা অক্ষরের অভ্রান্ত জালে
তুমি বন্দী করেছ বলে
নিজস্ব নির্জনতায়
তুমি তবু নির্বাসিত হয়ে রইলে
নিরবধি কালের অঞ্জলি
তোমার জন্যে জাগর রয়েছে।।
এতো বড় আশীর্বাদ পেলে জীবন তো সাধনা তুল্য হয়ে যায়। প্রাপ্তির এক সম্মানজনক সেতু তৈরি হল, পরস্পরে। সমবেত হাত তালি ছাপিয়ে পর্দা পড়তেই, উইংস থেকে বেরিয়ে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্থির তাকিয়ে রইলেন; সে দৃষ্টিতে করুণার আলো আর ভালবাসা। মুগ্ধতা পার করা এক নির্জন পথ – যেখান থেকে আর কোথাও ফেরা যায় না। চারিদিকে আলো জ্বলে উঠতেই এক মুহূর্তেই তিনি সেই দূরের মানুষ - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নিজে থেকেই বললেন- ‘বাড়ি থেকে কবিতাটি নিয়ে যেও’। আমি ওঁর ওই হাতে লেখা কাগজটিও চেয়ে নিলাম। শুরু হল এক দ্বিতীয় পর্বের যোগাযোগ; তাঁর বাড়িতে তাঁকে দেখা।
***********************
দুরন্ত শিশুর মতো। বড়জোর, না বড়ো হওয়া যেন এক উচ্ছ্বসিত কিশোর। সন্ধে আটটাতে সময় দেওয়া ছিল। সিক্যুরিটি পেরতেই ড্রয়িং রুম। এক কোনায় হলুদ আলোর নীচে সোফায় বসে আছেন, এক উজ্জ্বলতর আলো হয়ে। আদ্যোপান্ত ভিন্ন এক মানুষ। বৌদি এসেই সংযোগ খুঁজে পেলেন, আমার সেই কিশোরী বেলার সূত্র – ছোট পিসি, দিদিভাই, অশোক দা আর সতী দি। সঙ্গে বৌদির বানানো সেই সুস্বাদু চা। সৌমিত্র দা জিজ্ঞাসা করলেন –‘সময় দেবে একটু – মানে খুব যদি তাড়া না থাকে’, একটা স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাবো'। সম্মতি পেয়ে, পাঠ-চশমাটি নিয়ে গুছিয়ে বসলেন। পাশে মাপ করা ওয়াইন গ্লাস। পড়া শুরু হল – ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। ঘোর না লাগাটাই অস্বাভাবিক। যেখানে যে পোশাকেই থাকুন না কেন, উনি আলোর নীচে বসা মানেই যেন ‘ক্যামেরা – একশন – রোল’। পড়া শেষ করেই অধীর প্রশ্ন – ‘কী – কেমন’! পাকামি করে কিছু বলেছিলাম কিনা তা আর স্মরণে নেই। তবে সমস্ত শরীরে পরিতৃপ্তি ছড়িয়ে, ওয়াইনে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে, স্ক্রিপ্ট ও খালি গ্লাসটি নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। ঘড়িতে দেখলাম দশটা বেজে গেছে – মানে দু’ঘণ্টা পার। প্রায় তখনি বেরিয়ে এলেন যেন দ্বিতীয় শট দিতে। নিজের প্যাডে লেখা, মুক্ত ঝরা অক্ষরে সেই কবিতাখানি আর সঙ্গে একটি খাম। আসন্ন অনুষ্ঠানের টিকিট; রবীন্দ্র সদনে – ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শ বছর জন্মবার্ষিকীতে পথের আলোর অনুষ্ঠানে
সেই প্রথম নাটক ‘নাম জীবন’ থেকে শুরু করে, আমি ওঁর সব কটি নাটক দেখেছি। ফলে সে ব্যাপারে হোম ওয়ার্কের ত্রুটি নেই। পরে তো কত পাঠের অনুষ্ঠানও! এমনকি অনামা গায়ক গায়কদের সঙ্গে পাঠের সিডিও। যাতায়াতের ক্রমঘনিষ্ঠতায় একদিন তাই অনুরোধ করি, অন্তরার শিল্পীদলের গানের সঙ্গে ওঁর পাঠ সিডিবদ্ধ করাতে যদি অনুমতি দেন, বিশেষত ‘ফুলরাণী’র পাঠ সমেত একেবারে ডবল সি ডি! এই অদ্ভুত প্রস্তাব শুনেও, সেই ভাবলেশহীন প্রসন্নতা। বললেন – ‘স্ক্রিপ্ট দাও, পছন্দ হলে করব’। লাগাতার, বার কয়েক কসরতের পর পছন্দ হল। মনে আছে সে কথা – ‘গানের ব্যাখ্যা নয়; তোমার এই কাজ, উপলব্ধি , এমনকি ওদের লেখার সঙ্গে তোমার লেখা সব গুছিয়ে নিয়ে বসো; আর ভাবো যে আমি পড়ছি। আমার গলাটা যদি অলক্ষ্যে শুনতে পাও তো জানবে যে, তোমার স্ক্রিপ্ট দাঁড়িয়ে গেছে’। সে এক পরিশ্রমের আরাম। অন্তরার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে বলা ওঁর বক্তব্যগুলোও ভাগ্যিস সব আমি টুকে রেখেছিলাম! অন্তরার অনুমোদন মিলল, বাজেট পাশ হল, স্থির হল রেকর্ডিংয়ের দিন এবং তাঁর পছন্দের স্টুডিয়োটিও। এবার পারিশ্রমিকের শর্ত। কত কথাই তো শুনেছি; একটা ফুঁও নাকি বিনা পয়সায় ছাড়েন না, পাঠ তো দূর স্থান! তো সে কথা পাড়তেই বললেন – ‘কিচ্ছু না, কিচ্ছুটি নেব না’। বললাম – ‘তা হয় নাকি, সামান্য হলেও সম্মান দক্ষিণার অনুমোদন তো আমি পেয়েছি’। বললেন- ‘হয় যেমন না, তেমন হয়ও। আমাকে ভাঙিয়ে যারা খ্যাতি বা উপার্জন চায়, সেখানে আমিও উপার্জন করি। কিন্তু এ কাজ একেবারে আলাদা। পয়সা কড়ির চাপের মধ্যেই আমি যে ওই সময়টুকু বের করতে পেরেছি – এটাই আমার পারিশ্রমিক’। কথা না বাড়িয়ে, হেসে বললাম – ‘স্ক্রিপ্টটা বড় ফন্টে জেরক্স, তাই তো’?
রেকর্ডিংয়ের দুদিন আগে সৌমিত্রদাকে ফোনে না পেয়ে বউদি কে ফোন করাতে উনি বললেন – ‘ও কোথায়? বোলপুরের শুটিং থেকেই তো ফেরে নি; শুনলাম জ্বরও এসেছে’। গুম হয়ে বসে থেকে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কী ই বা উপায়! কিন্তু কী আশ্চর্য! ঠিক আগের দিন সকালেই ফোন –‘বুঝলে, জ্বরটা ছেড়েছে, কিন্তু গলা একেবারে গেছে’। জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বললেন – ‘সকালে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিও’। পরদিন সকাল হতে না হতেই সাতটা নাগাদ ফোন –‘নটায় নিতে এসো, তোমার কাজটা সেরে বারোটায় শুটিংয়ে যাব’। ওঁর বাড়ির কাছেই স্টুডিও। রেকর্ডিংয়ে বসলেন , আর পুরোটা শেষ করে উঠলেন। ঠিক সাড়ে দশটা। সঙ্গে শুধু দু’কাপ কালো কফি। এতটাই আত্মবিশ্বাস যে একবার শুনতেও চাইলেন না। এও এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞটা। সি ডি রিলিজের অনুষ্ঠানে যখন সেটি বাজানো হল, সাধারণ শ্রোতার মতোই শুনলেন, মাথা নিচু করে। দু’চার কথা বলার সময় বলে গেলেন খুব দামি এক ভাবনা – ‘মানুষ নানা ভাবে প্রতিবন্ধী, আবার প্রতিবন্ধকতাতেই তার সৃষ্টিশীল জীবন’।
‘পথের আলো’ অনুষ্ঠানের বাইরে এবার সুযোগ হল সত্যিকারের এক বড় মঞ্চে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর। অন্তরার ডাক এলো, রবীন্দ্রনাথের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে, রবীন্দ্রসদন থেকে। সৌমিত্রদাকে সভয়ে জানাতেই এক কথায় রাজী এবং আগের মতোই বিনা পারিশ্রমিকে। বললেন – ‘কিন্তু স্ক্রিপ্ট হবে ছোট্ট, বড় জোর চল্লিশ মিনিট আর একবারে কম্প্যাক্ট। স্ক্রিপ্ট পছন্দ হতে আবদার করে বললাম – ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে – এই গানটার আগে – ও গো নির্জনে বকুল শাখায়......... কবিতার সঙ্গে আমার নাচে একটু পাঠ রাখব’? হেসে বললেন – ‘তা হবে, কিন্তু রিহার্সাল দিতে পারব না’।
রবীন্দ্রসদনে হাজার চেয়ার কিন্তু লোক প্রায় বারোশো। বাড়তি লোক মাটিতে বসে বা দু’পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। সময়ের একটু আগে এসে জিজ্ঞেস করলেন – ‘আমাকে কোথায় বসাচ্ছো’? মঞ্চের একপাশে সূত্রধরের আসনটি দেখে, চেয়ারে বসে আলো এবং মাইক্রোফোন ঠিকঠাক করে নিয়ে তবে, কফি খেতে গ্রিনরুমে এলেন। সকলের সঙ্গে ফটো সেশন হল। এবার আমাদের পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে উজ্জ্বল মেঘ রঙের একটা নতুন পাঞ্জাবি ওঁর দিকে এগিয়ে দিতেই, ছোট্ট ছেলের মতো খুশি। মঞ্চ জুড়ে সাজগোজ করা শিল্পী দল আর তাঁর সঙ্গে নীল পাঞ্জাবি পরে, আলোর নিচে বসা বর্ষার সাজে সৌমিত্রদা, যেন বৃষ্টি ধোয়া আকুল আকাশ। পর্দা উঠতেই তাঁকে দেখে করতালির উৎসব। কোনও মহড়া ছাড়া কি মসৃণ সে উপস্থাপনা! আর, তাঁর ওই দু’ পঙক্তি পাঠের সঙ্গে নাচে আমার মুদ্রা, ঘুঙুর, সবুজ শাড়ি, গয়না, খোঁপার মালা – সব যেন বকুল ঝরা আবেশটুকু। তাঁর পাঠ আমায় লয় দিল, দিল লাবণ্য। কত যে অসামান্য তিনি, ওই ওইটুকু সংযোগেই বুঝতে পেরেছিলাম। এতো সুন্দর করে আমাদের ধারণ করে ছিলেন তিনি যে, ওই এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানেই যেন গোটা জীবনের নির্মাণ ও বিনির্মাণ ঘটলো আমাদের; এবং কোনও মহড়া ছাড়াই।
***************************
বউদিকে নিয়ে বার কয়েক এসেছেন আমার বাড়ির ঘরোয়া আমন্ত্রণে। পাড়ার আখতার আমার ছাদের এক কোণে উনুন বসিয়ে রুটি চিকেন কাবাব আর মাটন ভুনা বানাচ্ছে দেখে সহজভাবেই বলেছেন কাবাব – কষা না দিয়ে মশলা ছাড়া মাছের ঝোল ভাত রেঁধে খাওয়াতে পারব কিনা! কুড়ি মিনিটের নোটিশে যা রাঁধতে পারলাম তাই সোনা মুখ করে খেয়েছেন দু’জনে। নাতির একবছরের জন্মদিনে অসংখ্য নবীন তারকাদের মধ্যেও সব আলো ওঁরই মুখে। মেয়ের বন্ধু থেকে আশি ছুঁই ছুঁই আমার মামী মাসির দল – সকলেই সমান মুগ্ধ। আর তেমনই উদাসীন দীপা বৌদি। পরম আনন্দে, তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার মাসি আর মামীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে কত কী আড্ডা দিয়ে গেলেন। সময় বদলে যায়, অদল বদল ঘটে যায় জীবন যাপনের শর্তে, কিন্তু সৌমিত্রদা যেন সেই স্থির বৃক্ষ যার ছায়াতে সবসময় সূর্যোদয়ের আশ্বাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন - একে একে চলে গেলেন তাঁর প্রায় সব সমসাময়িক বন্ধুরা। সেই সব স্মরণ সভায় দর্শকাসনে বসে আমরা দেখলাম এবং শুনলাম - উনি এসে কবিতা পড়লেন, দু’কথা বললেন, বিষাদের লেশমাত্র না ছড়িয়ে। ওঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী বা ওঁর লেখা গদ্যসমগ্রের উদ্বোধন – তাতেও তো সেই একই রকম প্রসন্নতা। নাসিরুদ্দিন মুখোমুখি – সে অনুষ্ঠানেও আত্মবিশ্বাসে স্থির এক মানুষ। আর এই শেষ পর্বে, অবিস্মরণীয় অভিনয়ে নিজেকে উজাড় করে দিলেন – ‘বরুণ বাবুর বন্ধু’ সাম্প্রতিক এই সিনেমাটিতে।
কাজের মধ্যেই চলে গেলেন তিনি। এই বোধহয় একবার, কোনও রকম প্রস্তুতি ছাড়াই এবং থার্ড বেল বাজার আগেই।
এ শূন্যতার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে, গলফ গ্রিনের ওই বাড়িটার। সময় লাগবে আমাদেরও। যেমন মনে থাকে না যে ‘পারিজাত’ বাড়ির ন’তলার আস্তানায় - সুনীলদা, বা ‘ভালবাসা’ বাড়িতে নবনীতাদি - এঁরা যে কেউই আর নেই। মনের পথটাই যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
দূর থেকে দেখা নায়ক আর কাছ থেকে দেখা এক অবিসংবাদী নট এবং খুঁটিয়ে দেখা এক প্রাণময় সত্তা – এ নিয়েই তো আমার দেখা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আমার অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্য - প্রণাম জানাই তাঁকে।।
স্মৃতিচারণ হিসেবে ভালো লাগল।
লুধিয়ান সাংভি - এটা সাহির লুধিয়ানভি তো?