এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  সমোস্কিতি

  • নোবেল পুরস্কারের জুজু

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, ভাষান্তর: সোমনাথ গুহ
    সমোস্কিতি | ০৯ অক্টোবর ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: রমিত 



    প্রত্যেক বছর এই সময়ে শ্রেষ্ঠ লেখকদের একটা জুজু তাড়া করেঃ সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের জুজু। একবার একটি সাক্ষাৎকারে সম্ভাব্য বিজয়ী মহান ও অধ্যবসায়ী লেখক খোর্খে লুইস বোর্খেস, ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই সময়ে যে নানা অনুমান করা হয় তা তাঁকে দু মাস ধরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে রাখে। এটা অবশ্যম্ভাবী কারণ স্প্যানিশ ভাষায় বোর্খেস হচ্ছেন উৎকৃষ্টতম শিল্পমনস্ক লেখক এবং শুধুমাত্র অনুগ্রহ-পূর্বক হলেও তাঁর নাম সম্ভাব্য তালিকায় থাকবে না এটা তাঁরা ভাবতেও পারেন না। দূর্ভাগ্যজনক হচ্ছে চূড়ান্ত ফলাফল প্রার্থীর মেধার ওপর নির্ভর করে না, এমনকি সেটা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের ওপরেও না, সেটা নির্ভর করে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্যদের প্রহেলিকাময় পছন্দের ওপরে।

    আমি কোনও নির্ভুল পূর্বাভাস মনে করতে পারছি না। সাধারণত দেখা যায় বিজয়ীরাই সব চেয়ে বেশি বিস্মিত বোধ করেন। ১৯৬৯এ আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটকে যখন পুরস্কার প্রাপ্তির কথা জানান হয় তিনি ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠেন, “হায়, ঈশ্বর, এ কি সর্বনাশ হল!” ১৯৭১এ পাবলো নেরুদা সুইডিশ অ্যাকাডেমির গোপন সূত্র মারফত খবরটা প্রচারিত হওয়ার তিন দিন আগে সেটা জেনে গেছিলেন। পরের দিন রাতে তিনি প্যারিসে বন্ধুদের নৈশাহারে আমন্ত্রণ করলেন, যেখানে তিনি তখন চিলের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আমরা বুঝেই উঠতে পারলাম না যে আয়োজনটা কিসের জন্য যতক্ষণ না সান্ধ্য পত্রিকায় খবরটা দেখলাম। “ছাপার অক্ষরে না দেখলে আমি কোনও কিছু বিশ্বাস করি না,”, অপরাজেয় হাসির ধুম তুলে তিনি পরে আমাদের ঘটনাটা জানান। কয়েক দিন বাদে বুলভার মঁপারনাসের একটি কোলাহলপূর্ণ রেস্তোঁরাতে আমরা যখন মধ্যাহ্নভোজন করছিলাম তখন তাঁর মনে পড়লো আটচল্লিশ ঘন্টা বাদে স্টকহোলমের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তাঁর যে বক্তব্য পেশ করার কথা সেটি তিনি তখনও লিখে উঠতে পারেননি। তিনি মেনুর একটি পাতা উল্টে, একবারও থমকে না গিয়ে, চারিদিকের কলরবকে উপেক্ষা করে, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, তাঁর প্রথাগত, অমোঘ সবুজ কালি যা দিয়ে তিনি কবিতা লেখেন, একেবারে ওখানেই তাঁর চমকপ্রদ দরবারি ভাষণ লিখে ফেললেন।

    লেখক ও সমালোচকদের চালু কথা হল যে সুইডিশ বিদ্বজ্জনেরা মে মাসের মধ্যে, যখন বরফ গলতে শুরু করে, একটা ঐক্যমতে পৌঁছে যান এবং গ্রীষ্মের উষ্ণতায় তাঁরা চুড়ান্ত প্রতিযোগীদের কাজ পর্যালোচনা করেন। অক্টোবর মাসে দক্ষিণের সূর্যালোকে তেতেপুড়ে শরীরে বাদামী আভা বহন করে তাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আবার এটাও শোনা যায় যে ১৯৭৬ এর মে মাসে খোর্খে লুইস বোর্খেস মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু নভেম্বরের চূড়ান্ত নির্বাচনে তাঁর নাম খারিজ হয়ে যায়। আসলে সেই বছরের বিজয়ী ছিলেন অতুলনীয় এবং বিষণ্ণ সল বেলো যাঁকে অন্তিম মুহূর্তে মনোনীত করা হয়েছিল যদিও সেই বছর অন্যান্য বিষয়েও জয়ীরা সবাই উত্তর আমেরিকার ছিলেন।

    সত্যটা হচ্ছে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে, পুরস্কার ঘোষণার মাত্র এক মাস আগে, বোর্খেস এমন কিছু করেছিলেন যার সঙ্গে সাহিত্যের মুনশিয়ানার কোনও যোগ নেইঃ তিনি আনুষ্ঠানিক পরিবেশে আউগুস্তো পিনোচেত-এর সাথে দেখা করেছিলেন। “মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার সাক্ষাৎ সমীপে হাজির হওয়া এক অযাচিত সম্মান,” দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি বলে ফেলেন। এরপর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করা সত্ত্বেও তিনি বলে যান, “আর্জেন্টিনা, চিলে এবং উরুগুয়েতে স্বাধীনতা এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করা হচ্ছে।” “এটা হচ্ছে একটা মহাদেশে যেখানে নৈরাজ্য ছেয়ে গেছে এবং কম্যুনিজম তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে,” তিনি যন্ত্রের মতো বলে যান। এটা ভাবা যেতে পারে যে একটু মজা করে পিনোচেত-কে কড়কে দেওয়ার জন্য এরকম মৌখিক নির্যাতন করা হয়েছিল। কিন্তু সুইডদের কাছে বুয়েনস এয়ারসের কৌতুকবোধ বোধগম্য ছিল না। তারপর থেকে সম্ভাব্য তালিকা থেকে বোর্খেসের নাম উধাও হয়ে যায়। অন্যায্য প্রায়শ্চিত্ত পর্বের শেষে সেটা এখন আবার হাওয়ায় ভাসছে। তিনি যদি তাঁর এই বাৎসরিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পান, আমরা যারা তাঁর অতৃপ্ত পাঠক এবং একই সাথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের কাছে এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু হবে না।

    তাঁর সবচেয়ে বিপজ্জনক দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন ইংরাজি ভাষার দুই ঔপন্যাসিক। প্রথম জন যাঁর নাম বিগত বছরগুলোতে খুব একটা শোনা যায়নি, তিনি এখন নিউজউইক পত্রিকার চমকপ্রদ প্রচারের বিষয় হয়ে উঠেছেন যারা সঠিক ভাবেই তাঁকে তাদের ১৮ই অগস্টের প্রচ্ছদে ইংরাজি উপন্যাসের মহান কারিগর হিসাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর লম্বাচওড়া পুরো নাম, বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নাইপল, তাঁর বয়স সাতচল্লিশ, তাঁর জন্ম আমাদের ঘরের কাছেই, এই ত্রিনিদাদে, তাঁর পিতা ভারতীয়, মা ক্যারিবিয়ান এবং অত্যন্ত নাকউঁচু সমালোচকরাও মনে করেন তিনি বর্তমানে ইংরাজি ভাষায় মহত্তম লেখক। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন গ্রাহাম গ্রিন, বোর্খেসের চেয়ে চার বছরের ছোট, যাঁর ওই স্থবির সম্মান পাওয়ার ঠিক ততোটাই যোগ্যতা আছে এবং যাঁর ক্ষেত্রেও একই ভাবে সেটি পেতে বহু বছর বিলম্ব হয়ে গেছে।

    লন্ডনে ১৯৭২-এর শরৎকালে নাইপল সম্ভবত ক্যারিবিয়ান লেখক হওয়া সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন না। এক বন্ধুত্বপূর্ণ সভায় আমি তাঁকে সেটা মনে করিয়ে দেওয়ায় তিনি একটু বিভ্রান্ত বোধ করলেন, সামান্য চিন্তা করলেন এবং তাঁর রাশভারী মুখ এক নির্মল হাসিতে আলোকিত হয়ে উঠল। “সঠিক দাবী,” তিনি বললেন। অপর দিকে গ্রাহাম গ্রিন যাঁর জন্ম বারখামস্টেডে, তাঁর কিন্তু চোখের পাতাও পড়লো না যখন এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি যে একজন লাতিন আমেরিকান ঔপন্যাসিক সেটা সম্পর্কে তিনি সচেতন কি না। “নিশ্চয়ই,” তিনি সপাটে উত্তর দিলেন “এবং সেটা সম্পর্কে আমি অত্যন্ত আনন্দিত কারণ বর্তমানে সেরা উপন্যাসরচয়িতারা সব ওখানকারই, যেমন খোর্খে লুইস বোর্খেস।” কয়েক বছর আগে গ্রাহাম গ্রিনের সাথে নানা কথার সময়, বিপুল এবং মৌলিক কাজ সত্ত্বেও তাঁর নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায় আমি নিজের বিভ্রান্তি এবং বিতৃষ্ণা প্রকাশ করলাম।

    “ওরা কোনদিনও আমাকে ওটা দেবে না,” তিনি গম্ভীর ভাবে আমায় বললেন, “কারণ আমাকে ওরা গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসাবে মনে করে না।” সুইডিশ অ্যাকাডেমি যা আকাদেমি ফ্রঁসেজ-এর অনুরূপ হওয়ার দাবী নিয়ে ১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা শুধুমাত্র সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার দায়িত্বে আছে। (অন্যান্য চারটি পুরস্কার হলঃ পদার্থ ও রসায়ন বিদ্যা যা রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস দিয়ে থাকে; শারীর ও চিকিৎসা বিদ্যা যা করোলিনস্কা ইন্সটিটিউট এর নোবেল অ্যাসেম্বলি দিয়ে থাকে এবং শান্তি পুরস্কার যা নরওয়ের সংসদের নোবেল কমিটি দিয়ে থাকে।) তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে কালে কালে এটি বিশ্বের পবিত্রতম ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠবে। আঠেরো জন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এর আজীবন সদস্য যাঁদের অ্যাকাডেমি সুইডিশ বিদ্যাতনিকদের উৎকৃষ্টতমদের মধ্যে থেকে মনোনয়ন করেছেন। এঁদের মধ্যে দুজন দার্শনিক, দুজন ঐতিহাসিক, তিন জন নর্ডিক ভাষায় বিশেষজ্ঞ এবং মাত্র একজন মহিলা। কিন্তু সেটা পিতৃতান্ত্রিকতার একমাত্র চিহ্ন নয়; আশি বছরের ইতিহাসে ঊনসত্তর জন পুরুষের বিপরীতে মাত্র ছজন মহিলা পুরস্কৃত হয়েছেন। এই বছর সিদ্ধান্ত বিজোড় সংখ্যার ভিত্তিতে হবে কারণ অধ্যাপক লিন্ড্রোথ স্টেন, অন্যতম বিশিষ্ট অ্যাকাডেমি সদস্য মাত্র পনেরো দিন আগে, তেসরা সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন।

    কী ভাবে তাঁরা অগ্রসর হন, কী ভাবে সম্মত হন, বাস্তবে কোন সমঝোতাগুলির মধ্যে দিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, সমস্তটাই এই সময়ের নিপুণ ভাবে আবৃত রহস্যগুলির মধ্যে একটা। তাঁরা যে মানদণ্ডর নিরিখে বিচার করেন তা অনিশ্চিত, স্ববিরোধী, এমনকি পূর্বাভাসের থেকেও দায়মুক্ত; এবং তাঁদের সিদ্ধান্ত গূঢ়, পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ এবং চূড়ান্ত। তাঁরা যদি এত রাশভারী না হতেন তাহলে হয়তো অনুমান করা যেত যে তাঁরা সম্ভাব্য ফলাফল বিপথে চালনা করার তামাশায় উত্তেজিত। তাঁদের সাথে যতটা মৃত্যুর সাদৃশ্য তা আর কারো সাথে নেই।
    আরেকটা খুব সযত্নে রক্ষিত রহস্য হচ্ছে যে পুঁজি এত পর্যাপ্ত লভ্যাংশ সৃষ্টি করে তা কোথায় বিনিয়োগ করা আছে। আলফ্রেড নোবেল (ও কারের থেকে এ কারের ওপর জোরটা বেশি) ৯.২ মিলিয়ান ডলার পুঁজি নিয়ে ১৮৯৫ সালে এই পুরস্কার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, প্রতি বছর ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে যা থেকে প্রাপ্য সুদ পাঁচ জন পুরস্কার বিজয়ীর মধ্যে ভাগ করে দিতে হয়। প্রতি বছরে সুদের হার অনুযায়ী এই অংকটা ওঠানামা করে। ১৯০১এ প্রথম বার যখন পুরস্কার দেওয়া হয় তখন প্রত্যেক বিজয়ী ৩০,১৬০ ক্রোনার পেয়েছিলেন। ১৯৭৯ যখন সুদের হার সবচেয়ে লাভজনক ছিল তখন প্রত্যেকে পেয়েছিলেন ১,৬০,০০০ ক্রোনার।

    জনশ্রুতি হচ্ছে এই পুঁজি দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনিতে বিনিয়োগ করা আছে, যার অর্থ কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের রক্তের বিনিময়ে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। সুইডিশ অ্যাকাডেমি কোনদিনও প্রকাশ্য স্পষ্টীকরণ দেননি কিংবা কোনও অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাননি। তাঁরা এই যুক্তি দিতে পারেন যে টাকা লেনদেনের সাথে অ্যাকাডেমির কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা ব্যাঙ্ক অফ সুইডেন দেখাশোনা করে। আর এটা সম্পর্কে তো সবাই অবহিত যে হৃদয় বলে ব্যাঙ্কের কিছু নেই।

    তৃতীয় রহস্য হচ্ছে সুইডিশ অ্যাকাডেমির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেক সময় এমন কাউকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যে মানুষের ধারণা হয়েছে এঁরা সব ভাববাদী লিব্যারাল। ১৯৩৮এ সবচেয়ে অতিকায় ও সম্মাননীয় ভুলটি ঘটে যখন হিটলার নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে জার্মানদের নিষেধ করেন এই হাস্যকর কারণে যে এর প্ররোচক ইহুদি ছিলেন। জার্মান বিজ্ঞানী রিচার্ড কুন ওই বছর রসায়ন বিদ্যায় পুরস্কার জেতা সত্ত্বেও সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। বিশ্বাস বা বিচক্ষণতা, যে কারণেই হোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনও পুরস্কার দেওয়া হয়নি। কিন্তু ইয়োরোপ যুদ্ধের বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়ানোর পরেই সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁদের একমাত্র অনুশোচনামূলক ভুলটি করে যখন তাঁরা স্যর উইনস্টন চার্চিল-কে সাহিত্যের পুরস্কার দেন শুধুমাত্র এই কারণে যে তিনি সেই সময়ের সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ ছিলেন এবং তাঁকে শান্তি পুরস্কার তো বটেই, আর কোনও পুরস্কার দেওয়ার কোনও উপায় ছিল না।
    সোভিয়েত ইউনিয়ানের সাথে হয়তো অ্যাকাডেমির সবচেয়ে জটিল সম্পর্ক ছিল। ১৯৫৮য় যখন অত্যন্ত যোগ্য বরিস পাস্তারনাককে পুরস্কার দেওয়া হয়, দেশে ফেরার অনুমতি না পাওয়ার ভয়ে তিনি সেটা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এই পুরস্কারটিকে প্ররোচনা হিসাবে মনে করেছিলেন। অপর দিকে ১৯৬৫ সালে যখন মিখাইল শলোকভ, যিনি ছিলেন সোভিয়েত লেখকদের প্রিয়তমদের মধ্যে প্রিয়তম, পুরস্কার পান তাঁর দেশের মন্ত্রীসান্ত্রীরা প্রবল উৎসাহের সাথে তা উদযাপিত করেছিলেন। আবার পাঁচ বছর বাদে যখন মার্কামারা বিক্ষুব্ধ আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিন-কে পুরস্কার দেওয়া হল সোভিয়েত সরকার এতটাই ক্ষেপে গেল যে নোবেল পুরস্কারকে সাম্রাজ্যবাদের একটা হাতিয়ার বলে দেগে দিল। নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভিত্তিতে আমি বলতে পারি যে পাবলো নেরুদা যত শুভেচ্ছা-বার্তা পেয়েছিলেন উষ্ণতমগুলি এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ান থেকে, এবং এর প্রেরকদের মধ্যে কিছু উচ্চতম কর্তাব্যক্তিও ছিলেন। এক সোভিয়েত বন্ধু হেসে বলেছিলেন, “আমাদের জন্য নোবেল পুরস্কারটা ভালো যখন সেটা আমাদের পছন্দের লেখককে দেওয়া হয়, এবং খারাপ যখন তার উল্টোটা হয়।” এই ব্যাখ্যাটা ততোটা সরল নয় যতটা আপাত ভাবে মনে হয়। আমাদের মনের গভীরে আমরা সবাই একই চিন্তা পোষণ করি।

    সুইডিশ অ্যাকাডেমির একমাত্র সদস্য যিনি স্প্যানিশ পড়তে জানেন এবং খুব ভালোই জানেন, তিনি হলেন কবি আর্তুর লুন্ডভিস্ট। তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাদের লেখকদের কাজ জানেন, তাঁদের প্রার্থী করার প্রস্তাব দেন এবং তাঁদের জন্য গোপনে বচসা করেন। তাঁর কাছে বিরক্তিকর হলেও এটা তাঁকে এক সুদূর, রহস্যজনক অবতারে রূপান্তরিত করেছে যাঁর ওপর আমাদের সাহিত্যের সবাইকার নিয়তি অনেকটাই নির্ভর করছে। বাস্তব জীবনে তিনি একজন উদ্যমী প্রবীণ মানুষ যাঁর কিছুটা লাতিন কৌতুক বোধ আছে এবং তিনি এত অনাড়ম্বর একটি বাড়িতে বসবাস করেন যে তাঁর ওপর কারো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এটা ভাবাই অসম্ভব হয়ে যায়।

    কয়েক বছর আগে তাঁর বাড়িতে ঠাণ্ডা মাংস ও উষ্ণ বিয়ার সহ পুরোদস্তুর এক সুইডিশ নৈশাহারের পর লুন্ডভিস্ট তাঁর পাঠাগারে আমাদের কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। অবাক কাণ্ড, স্প্যানিশ ভাষায় এত বই, শ্রেষ্ঠ আর নিকৃষ্ট সব মিলেমিশে একাকার, প্রায় প্রতিটাই প্রত্যাশী লেখকদের সই করা, জীবিত, মুমুর্ষু অথবা মৃত। কিছু বইয়ের নিবেদন পড়ার জন্য আমি কবির অনুমতি চাইতে তিনি করুণা ও প্রশ্রয়ের হাসিতে সেটা মঞ্জুর করলেন। বেশির ভাগই এত দরদী ছিল এবং এত সরাসরি ও মনকাড়া যে আমার যখন সময় এলো কিছু লেখার আমি ভাবলাম শুধুমাত্র একটা সই করা অসমীচীন হয়ে যাবে। দূর ছাই, কারো ক্ষেত্রে তো সেটা অস্বস্তিকর হয়ে যেতে পারে।

    অক্টোবর ৮, ১৯৮০, এল পাইস, মাদ্রিদ

    (দ্য স্ক্যান্ডাল অফ দ্য সেঞ্চুরি এন্ড আদার রাইটিংস নামক সংকলন থেকে অনূদিত)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • সমোস্কিতি | ০৯ অক্টোবর ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন