১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি কি আমরা যাকে সিনেমা বলে চিনি তাই? নাকি এটি একটি সিনে-প্রবন্ধ বলাটাই যথার্থ হবে? তাহলে এটি কি একটি তথ্যচিত্র? না, এটি ফিকশন এবং তথ্যচিত্রের সংমিশ্রণ? ভালো ন্যারেটিভ সিনেমা দেখে আমরা যেমন আবেগে আপ্লুত হই, চরিত্রগুলির বিকাশ ও প্রকাশভঙ্গী মনে প্রভাব ফেলে আমাদের, এখানে সেসব কিছুই তো হয়না। তার ওপর প্লট বলেও কিছু নেই। এরপরও এটা সিনেমা? হ্যাঁ, এটাই সিনেমার ফ্লুইডিটি যে সে সবকিছু হয়ে উঠতে পারে। এটিকে তাই সিনেমাটিক আলাপন (Discourse) বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। এটাই ফরাসী পরিচালক জাঁ লুক গোদারের স্বাক্ষর শৈলী হয়ে উঠবে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ - এই সময়কালের মধ্যে জাঁ লুক পূর্ণাঙ্গ ছবি করেছেন পনেরোটি। এই ছবিটির শুটিং যখন তিনি করছেন তার মাত্র নয় দিন আগে শুটিং শেষ করেছেন ‘মেড ইন ইউ এস এ’ ছবির। এর মধ্যে তিনি বিভিন্ন জনপ্রিয় ঘরানা নিয়ে কাজ করেছেন। গ্যাংস্টার, মিউজিকাল, সায়েন্স ফিকশন এসব ঘরানার অবিনির্মাণ করে তিনি ছবি করেছেন - বলা যেতে পারে এই ঘরানাগুলি সম্পর্কে তাঁর শৈল্পিক প্রতিক্রিয়া তিনি সিনেমার মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। সেই ছবিগুলি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার অনেক অতিকথার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে জাঁ লুক গোদারের পার্থক্য যে তিনি এতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। তাঁর নিজের সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ককে, ইমেজের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ককে, জীবনের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ককে বরাবর প্রশ্ন করে গিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতি এই সিনেমা। গোদার নিজেই বলেছেন "এটা ফিল্ম নয়। ফিল্ম করার এক প্রচেষ্টা এবং সেইভাবেই এটা উপস্থাপিত।" এটা কি কোনো গিমিক? তা নয়, আসলে গোদারের মতে শুধু ফিকশন শিল্পীকে বঞ্চিত স্পেস এবং তাঁর কণ্ঠস্বর দেয় না। এখানেই ফিকশনের অসম্পূর্ণতা। গোটা ছবির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে গোদারের অনুচ্চ, ফিসফিসে কণ্ঠস্বরের বক্তব্য। সেটা কিন্তু ন্যারেটিভের কোনো ধারাভাষ্য নয়, যেভাবে আমরা দেখে থাকি। এটা হচ্ছে শিল্পকর্মের মধ্যে শিল্পীর সেঁধিয়ে থাকাকে প্রকাশ করা। এটা বাদ দিলে এ ছবি অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় , বড়জোর নীরস সমাজতত্ত্ব সমন্বিত এক প্রতিবেদন মনে হতে পারে। গোদার আসলে দর্শককে তাঁর চিন্তন প্রক্রিয়ার অংশ করে নিতে চান, সেই চিন্তন যা তাঁকে এই ছবিটির সঙ্গে সম্পর্কিত করছে।
ছবির নামকরণে যে ‘হার’ শব্দটি আছে তা কি কোনো বিশেষ মহিলার সম্পর্কে বলা হয়েছে? এই ছবির যে বিজ্ঞাপনী পোস্টার গোদার নিজেই তৈরি করেন তাতে এই ‘হার’ বা ‘তার’ বলতে বলা হয়েছে নব্য-পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা, বেশ্যাবৃত্তি, পারী অঞ্চল, ৭০ শতাংশ ফরাসির না থাকা বাথরুম, বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্সগুলির ভয়াবহ নিয়মকানুন, ভালোবাসার শারীরিক দিক, আজকের জীবন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আধুনিক কল গার্ল, আধুনিক সৌন্দর্যের মৃত্যু, চিন্তার সংবহন, স্ট্রাকচারের গেস্টাপো রূপ।
ছবির প্রাথমিক উৎস পারীর শহরতলী এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে ‘লে নুভেল অবজার্ভেতর’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ। কিন্তু গোদার সেটা নিয়ে কোনো তথ্যচিত্র বানান নি। ফিকশন তাঁর দরকার - বিশেষ থেকে নির্বিশেষে গতায়তের জন্য। এই ছবির বিষয় জুলিয়েট জ্যানসন (মারিনা ভ্লাদি) নামে ফরাসী এক গৃহবধূর এক দিনের জীবনযাপন। পারী শহর, অসংখ্য বস্তুপুঞ্জ, ক্রেন, বুল ডোজার, ভেঙ্গে ফেলা বাড়ি, নিয়ন সাইন, শিশুদের কলরব, কান্না, অন্তর্বাসের ডিজাইন, গ্যাজেট - আসলে আধুনিক জীবনের অসংখ্য চিহ্ন যা আমাদের অস্তিত্বের সীমাকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে তার ভাষার দ্বারা (জুলিয়েটের জবানে ‘প্রিজন হাউজ অব ল্যাংগুয়েজ’) - তার সঙ্গে জুলিয়েটের ব্যক্তিগত জীবনকে জুড়ে দেন গোদার। বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে গোদার এর আগেও দুর্দান্ত ছবি করেছেন - ভিভরে সা ভি। কিন্তু সেখানে সমাজতত্ত্ব এভাবে ছিল না, গোদারের উপস্থিতিও এত প্রত্যক্ষ ছিল না। এখানে কিন্তু পুঁজিবাদের অধীনে আমাদের সামগ্রিক যাপনের বাধ্যতাকে প্রশ্ন করা হয়। এই অনিচ্ছুক যাপনের সঙ্গে বেশ্যাবৃত্তির মূলগত নৈতিক তফাত কিছু আছে কি? পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটিতে আংশিক সময়ের অপেশাদার যৌনকর্মীদের কথা প্রধানত বলা হয়েছিল যাঁরা পারী শহরের চারপাশে গড়ে ওঠা বিরাট বিরাট আবাসনগুলিতে থাকেন। চড়া ভাড়া , জল, বিদ্যুৎ আর আসবাবপত্রের খরচ মেটাতে (আবাসন কর্তৃপক্ষ পুরোনো আসবাব অনুমোদন করেন না) তাঁদের অনেককে বাধ্য হয়েই এই পথ বেছে নিতে হয়। নয়ত পরিবারের দানাপানি জুটবে না। গোদার এবং তাঁর তৎকালীন বান্ধবী তথা এই ছবির প্রধান অভিনেত্রী মারিনা ভ্লাদির চোখে এই সংক্রান্ত একটি চিঠিও চোখে পড়ে যার অজ্ঞাতনামা লেখিকা দাবী করেন তিনি প্রায় চল্লিশ বৎসর বয়সের একজন সিঙ্গল মাদার, শিক্ষিত, যে কাজ করেন তাতে মাইনে বেশি নয়, একটি দামী ক্যাফে থেকে কাস্টমার তুলতে শুরু করেন, সেই টাকাতে মাসে দুবার হেয়ারড্রেসারের কাছে যাওয়া, ভালো পোশাক পরা এবং ফ্ল্যাট কেনার জন্য টাকা জমাতে চান। এই চাহিদাগুলি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সেই ব্যবস্থাটা অস্বাভাবিক যেখানে এই চাহিদাগুলি মেটানোর জন্য এরকম একটা চয়েস বেছে নিতে হয়। গোদার সেই ব্যবস্থাটার ভেতরের আন্তর্সম্পর্কগুলোকে মেলে ধরেন আমাদের সামনে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজেকেও সম্পর্কিত করে চলেন সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে। গোদারের প্রোজেক্ট কোনো প্রথাগত চরিত্র নির্মাণ নয়, সেই নিয়মগুলিকে আবিষ্কার করা যেগুলি ব্যক্তির সামাজিক জীবনকে নির্মাণ করে, সেই ‘সামাজিক’ যা চাপা দিয়ে দেয় ‘জীবন’কে। দার্শনিক মার্লো পঁতি যাকে বলেন ব্যক্তির একক অস্তিত্বের স্থানাঙ্ক নির্ণয়, এই ক্ষেত্রে তা জুলিয়েটের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চান গোদার। জুলিয়েটের এই বিমূর্তকরণের ফলে ন্যারেটিভে যে শূন্যস্থান তৈরি হয় গোদার তা পূর্ণ করেন নিজের কণ্ঠস্বর জনিত উপস্থিতি দিয়ে। এই উপস্থিতির পর গোদারের ছবি তৈরির পদ্ধতিই আরো পালটে যাবে। স্থায়ী ভাবে জায়গা করে নেবে শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্কের বিষয়টি। আর ফিকশনের জায়গায় আলাপনই হয়ে উঠবে শিল্পী হিসেবে তাঁর স্বাক্ষর।
এই ছবি করার সময় মারিনা ভ্লাদির সঙ্গে গোদারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পোড় খাওয়া অভিনেত্রী হওয়া সত্ত্বেও মারিনা গোদারের পরিচালন শৈলীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না। শুটিংয়ের সময় মারিনার কানে একটা ছোট্ট স্পীকার বসানো থাকত। আগে থেকে তাকে কোনো সংলাপ দেওয়া থাকত না। অনেক সময় সেই মুহূর্তে গোদার তাঁকে একটি সংলাপ বলে রিপিট করতে বলতেন। মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন করতেন যার তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে হত। আবার সেই উত্তরের পর মুহূর্তে হয়ত কোনো সংলাপ গোদার বলতে বলতেন। ছবিটি দেখলেও বোঝা যায় মারিনা যখন ফ্রেমে নেই তখন গোদার অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ছবি তুলেছেন যার অধিকাংশই হল বস্তুপুঞ্জ। মারিনা অভিনীত অংশগুলিই তুলনায় প্রাণহীন। এই ছবির তাই শ্রেষ্ঠ দৃশ্য কোনো মানুষ নয় - একটি ফেনা ওঠা এসপ্রেসো কফির কাপ। ওই সিকোয়েন্সে কফির ফেনার ঘূর্ণায়মান ছবির সঙ্গে গোদারের কণ্ঠস্বরে মহাবিশ্বের রেফারেন্স অপূর্ব অভিঘাত তৈরি করে । শেষ দৃশ্যে সবুজ ঘাসের ওপর ছড়িয়ে রাখা কনজিউমার প্রোডাক্টগুলিও যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। এই ছবিতে বস্তুপুঞ্জ তাই সজীব মানুষের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গোদার ততদিনে মারিনাকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত, আনা কারিনার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ তার আগেই ঘটে গেছে। এই বিষয়গুলিকে গোদার বিশ্লেষণ করতে চান তার ধারাভাষ্যে:
"যেহেতু জীবনের প্রতিটি ঘটনাই আমাকে পাল্টাচ্ছে, যেহেতু আমি সংযোগস্থাপনে বিরামহীনভাবে ব্যর্থ , বুঝতে ব্যর্থ, ব্যর্থ ভালবাসতে বা ভালোবাসা পেতে,যেহেতু প্রতিটি ব্যর্থতাই আমাকে একাকীত্বকে সহ্য করতে শেখায়, যেহেতু ... যেহেতু্... যেহেতু... যে অবজেক্টিভিটি আমাকে বিচূর্ণ করে তার থেকে আমি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারি না, পারি না যে সাবজেক্টিভিটি আমাকে নির্বাসিত করে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে, যেহেতু আমার পক্ষে সম্ভব নয় নিজেকে সত্তার ( being) পর্যায়ে উন্নীত করা, সম্ভব নয় নাস্তির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া তাই আমাকে শুনতে হবে।" এই শোনা মানে কান দিয়ে শোনা নয়, শুধু, সামগ্রিক সত্তাকে উন্মুখ করে শোনা - একথা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এই ছবিতেই গোদারের সেই বিখ্যাত ‘ রিটার্নিং টু দ্য জিরো’ বা শূন্যে ফেরার ঘোষণা। একবার শুনে নেওয়া যাক সেই বিঘোষণা:
“আমি আমার ট্রানজিস্টর রেডিওতে বিজ্ঞাপন শুনি। এসোর (বহুজাতিক তেল কোম্পানি, E-SS-O এভাবে বানানটি লেখা হয় ছবিতে) দৌলতে আমি স্বপ্নের রাজপথে গাড়ি ছোটাই আর ভুলে যাই বাকি সব কিছু। আমি ভুলে যাই হিরোশিমা, আমি ভুলে যাই আউশউইদশ, আমি ভুলি বুদাপেস্ট, আমি ভুলি ভিয়েতনাম,আমি ভুলি নূন্যতম মজুরি, আমি ভুলি আবাসন সমস্যা, আমি ভুলি ভারতের দুর্ভিক্ষের কথা। আমি ভুলে গেছি সব। শুধু এটুকু মনে আছে আছে যে, আমি যেহেতু শূন্যে ফিরছি সেখান থেকেই শুরু করতে হবে নতুন করে।" :
এর অব্যবহিত পরে লা শিনোয়াজ এবং উইকএণ্ড নামে আরো দুটি মাস্টারপিস বানানোর পর গোদার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মেইনস্ট্রীম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম এবং সিনেমার ক্ষেত্রে প্রচলিত সিনেমার আঙ্গিক - দু'জায়গাতেই আর পাওয়ার কিছু ছিল না তাঁর। রাজনীতিকে শিরোধার্য করে বাঁচতে চেয়েছিলেন পরবর্তী পাঁচ বছর (১৯৬৮-১৯৭২)। শিল্পী হিসেবে তাঁর কাজ ছিল রাজনৈতিক ছবির ভাষা আবিষ্কার করা। এরপর ছিল ভিডিও মাধ্যম, টেলিভিশন এবং ইমেজ ও সাউন্ড নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার বছরগুলি। এরপর যখন তিনি ফিরলেন, তাঁর আলাপন ধর্মী সিনেমার চরিত্র পাল্টাল না। সিনেমার প্রচলিত যে ধাঁচ, যেখানে ইমেজ এবং সাউন্ডের নিখুঁত যুগলবন্দীর আড়ালে নির্মাতা বাস্তবতার উপস্থাপনের দাবি করেন, যেখানে নির্মাতা নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, দর্শকও যেন নির্মাতার অনুপস্থিতিতে বাস্তবতার সরাসরি স্বাদগ্রহণ করছেন বলে ভাবেন - এটাকে গোদার কোনোদিনই গ্রহণ করতে পারেন নি। যে বিকল্প নির্মাণের পথে তিনি হাঁটতে চেয়েছেন সারা জীবন ধরে তা কিন্তু এই ছবি থেকে থেকেই তার প্রস্থান ভূমি চিনে নিতে পেরেছিল স্পষ্টভাবে। অন্তত এই ছবি সম্পর্কে যে দু-তিনটি কথা আমি জানি তাতে এরকমই মনে হয়েছে।
ছবিটি বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ‘Mubi’ নামক ওয়েবসাইটে।
তথ্যসূত্র: :