এস হরিশের নাম আমি আগে শুনিনি, যেহেতু ভারতের আঞ্চলিক সাহিত্যের অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম না জেনেই বা লেখা না পড়েই আমাদের বাঙালি পাঠকজীবন দিব্যি কেটে যায়। তার জন্য জাতিগত উন্নাসিকতা বা কূপমণ্ডুকতা শুধু দায়ী তা নয়, ভালো অনুবাদের অপ্রতুলতাও দায়ী। একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জালিকুট্টি সিনেমাটা দেখার পর ছবিটির কাহিনিকার হরিশের নামটি জানতে পারি। মূল গল্পটির নাম ‘দ্য মাওয়িস্ট’ জানবার পর কৌতূহল বাড়ে। তখনই জানতে পারি হরিশের এই উপন্যাসটির কথা, যেটি মাত্রুভূমি সাপ্তাহিকে ধারাবাহিকভাবে বেরোনোর মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় হিন্দুত্ববাদী এবং জাতভিত্তিক সংগঠনগুলির চাপে কারণ এখানে নাকি ‘হিন্দু মহিলা এবং মন্দিরের পুরোহিতদের অপমান করা হয়েছে’। পরে সম্পূর্ণ উপন্যাসটি ডি সি বুকস থেকে বেরোয় এবং হারপার কলিন্স থেকে এই উপন্যাসের একটি অসাধারণ ইংরেজি অনুবাদ করেন জয়শ্রী কালাথিল, যেটি ইংরেজিতে লেখা বা অনূদিত সাহিত্যের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ আর্থিক মূল্যের জে সি বি পুরস্কার লাভ করে। আমি এই ইংরেজি অনুবাদটিই পড়েছি এবং যথার্থই মুগ্ধ হয়েছি।
এই উপন্যাসের স্থান কুট্টানাদ, যা কেরালার তিনটি জেলাকে নিয়ে গঠিত এক বদ্বীপ অঞ্চল। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা থেকে উদ্ভূত পাঁচটি নদী এই অঞ্চলকে ঘিরে আছে, আর তাদের শত শত শাখানদী বেরিয়ে ভারতের বৃহত্তম হ্রদ ভেম্বানাদ কায়ালকে তৈরি করেছে যা কোচি বন্দরের কাছে আরব সাগরের সাথে মিলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চল নিচু। তবু মানুষ এখানে বসতি বেঁধেছে, ধান চাষ করেছে, জল ও জীবনের সহাবস্থানে রচিত হয়েছে বিচিত্র যাপনচিত্র। উপন্যাসের কালসীমা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। সেই সময় কেরালার তিনটি ভাগ। উত্তরে মালাবার, মধ্যে কোচি আর দক্ষিণে ত্রাভাঙ্কোর। এরমধ্যে মালাবার সরাসরি ব্রিটিশ শাসিত হলেও কোচি এবং ত্রাভাঙ্কোর ছিল দেশীয় করদ রাজ্য। এই উপন্যাসের সময়কালে ইংরেজি শিক্ষা, মিশনারি কার্যকলাপ এবং সামাজিক সংস্কারমূলক কার্যক্রম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পটভূমি রচনা করছে। তার সঙ্গে ছিল (এখনও আছে) জাতভিত্তিক শুদ্ধতা ও পবিত্রতার ধারণা ও অনুশীলন এবং পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ।
এই কাহিনীর মূল চরিত্র ভাভাচান এরকমই এক নিচু জাত পুলায়ান সম্প্রদায়ভুক্ত যারা মূলত কৃষিকর্মী ছিল এবং যাদের অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত উচ্চবর্ণের জমির মালিকরা সম্পত্তির মত বিনিময় করত। এদের মধ্যে অনেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। জাতপাতবিরোধী নেতা এবং সমাজসংস্কারক আয়ানকালি এই পুলায়ন জাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন যার উল্লেখ উপন্যাসে আছে। এই উপন্যাসে বহু চরিত্র আছে যারা বিভিন্ন জাতের প্রতিনিধি। সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ, যাদের হাতে ছিল জমির মালিকানা এবং তামিলনাড়ু থেকে আগত আইয়ার ব্রাহ্মণ, যাদের হাতে প্রশাসন এবং রাজস্ব আদায়ের উচ্চপদগুলি ছিল। নায়ার জাতি এবং তাদের উপজাতিসমূহ, যেমন পিল্লাই, মেনন এবং কুরুপ্পুদের অনেক চরিত্রও উপন্যাসে আছে। অনেক চরিত্র আছে চোভান (এজাভা) নামে আরেকটি নিচু জাতের, কৃষি কাজ ছাড়াও নারকেল গাছ থেকে তাড়ি তৈরি যাদের প্রধান কাজ। শ্রী নারায়ণ গুরু বা গুরুস্বামী এই সম্প্রদায়েরই এক সমাজসংস্কারক ঐতিহাসিক চরিত্র, এই উপন্যাসে যাঁর দেখা মেলে (প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি কেরলের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও এজাভা সম্প্রদায়ের। এছাড়াও পেশাগত ভিত্তিতে স্থিরীকৃত অসংখ্য জাতের মানুষ উপন্যাসে ভিড় করে আছেন, এমনকি খ্রিস্টানরাও বাদ যান নি।
হরিশ কি তাহলে কেরলের আঞ্চলিক জাতপাত বা সংঘর্ষের ইতিহাস লিখেছেন? না, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল আখ্যান রচনা যাতে ওই অঞ্চলের মানুষ এবং প্রতিবেশের বাস্তবতাকে মূর্ত করে তোলা যায়। সেই আখ্যানকে শিল্পসম্মত করে তোলার জন্য তার দুটি প্রধান উপজীব্য, প্রথমত আখ্যান কৌশল (narrative strategy) আর দ্বিতীয়ত ভাষা। হরিশ যে আখ্যান লেখেন সেখানে মূল চরিত্র ভাভাচান একটি গ্রামীণ ভ্রাম্যমান নাটকের দলে গোঁফ সম্বলিত এক পুলিসের সংলাপহীন চরিত্রে অভিনয় করার পর গোঁফ কামানো ছেড়ে দেয়। কালক্রমে সে নিজে, বা প্রকৃত প্রস্তাবে তার গোঁফ, এক মিথের জন্ম দেয় গোটা কুট্টানাদ অঞ্চলে। দেশের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়া ভ্রাম্যমাণ এই চরিত্রকে ঘিরে ভয়, বিস্ময়, আখ্যান, গান – কতকিছু যে জন্ম নেয়। পাশাপাশি অজস্র চরিত্র এবং তাদের আখ্যান এসে মিশে যায়, মূল আখ্যানের সঙ্গে তারা কখনও মিলে যায়, কখনও দূরত্ব রচনা করে, কখনও তৈরি করে প্রতি-আখ্যান। ভাভাচানের পরবর্তী জীবনের সন্ধানের বিষয় হয়ে ওঠে সীতা নামক এক মহিলা (যার গায়ের সুগন্ধ তাকে আকৃষ্ট করেছিল) আর মালয় যাবার রাস্তার খোঁজ। এই দুটির খোঁজে তার পরিভ্রমণ চলতে থাকে। আবার লেখক তার ছেলেকে এই আখ্যানটি সমকালে দাঁড়িয়ে বলে যান। ভাভাচান বাস্তবতা থেকে মিথের অংশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ভাভাচান, তার অতিপ্রাকৃতিক গোঁফ (যেখানে পাখিরা বিশ্রাম করে, তার দৈর্ঘে খালের যাত্রাপথ ঢেকে যায়) এবং তার অলৌকিক শক্তিমত্তা নিয়ে মাঠের কৃষকদের গান একটি অধ্যায়ে আছে। সেই গানগুলিতে যা যা বলা আছে ভাভাচান তার আখ্যানকে সেইসব পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চায়। বস্তুত, পাঠকের কাছেও পৌঁছে যায় এই বার্তা যে ভাভাচান বাস্তব নয় শুধু, অতিবাস্তব। সেই অতিবাস্তবতা ইতিহাসের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চায়। হরিশ আখ্যানের শক্তিকে পরীক্ষা করতে চান। তাই শুধু মানুষ নয়, গোটা জনপদের প্রতিবেশকেই আখ্যানে মূর্ত করে তোলেন তার জলরাশি, নারকেলগাছ, ধানক্ষেত, জলজ লতাগুল্ম, শোল মাছ, পেঁচা, উদবিড়াল, কচ্ছপ, সাপ, কুমীর সবকিছু নিয়ে। এরা কেউ কেউ আখ্যানে অংশ নেয়, প্রয়োজনে কথা বলে, আখ্যানকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। একটি অধ্যায়ের নাম যেমন ‘ দ্য লাস্ট ক্রোকোডাইল’ সেখানে জনপদের শেষ কুমীরটি চরিত্র হয়ে ওঠে, এমনকি আমরা যেন তার আখ্যানচরিত্রের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ি। তার সঙ্গে আখ্যান জুড়েই নিহিত থাকে রামায়ণের পরোক্ষ উল্লেখ। তবে সবই নিহিত পাতালছায়ার মত সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে। আখ্যানের সূতোটিকে সেই নিয়ন্ত্রিত দক্ষতায় ছাড়তে এবং গোটাতে হরিশ পারেন যাতে কল্পনার ঘুড়িটা দমকা হাওয়ায় ভেসে না যায় আবার চিরাচরিত বাস্তবতার বাদাবনে গোঁত্তা খেয়ে না পড়ে।
এই আখ্যানের বয়নে হরিশকে যা সাহায্য করে তা তাঁর ভাষা, যা এই উপন্যাসের জাদু বাস্তবতার ধাঁচের সঙ্গে মানানসই। লাতিন আমেরিকার লেখকদের জাদু বাস্তবতার ভাষার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁদের ব্যাপারটা চেনা চেনা ঠেকতে পারে। একটা জনপদ, যার ভৌগোলিকতার মধ্যেই আছে বাস্তবোত্তর উপাদান, যেখানে ক্ষুধা ও জীবনসংগ্রামের অসহনীয় উপাদান বাস্তবতার মাত্রাকে অতিক্রম করে যায়, যেখানে মানুষ তার অতিলৌকিক বিশ্বাস, জনস্মৃতি, লৌকিক আখ্যান, জীবজগৎ এমনকি ভূতপ্রেত সমেত একটা নির্মিত বাস্তবতার অংশ হয়ে বেঁচে থাকে, সেখানে এই ভাষাকে নির্মাণ না করা পর্যন্ত লেখক ওই বাস্তবতাকে ছুঁতে পারেন না। এটা খুব কঠিন কাজ। বাস্তবতার অন্তর্ভাগকে দেখতে না পেলে একাজে সিদ্ধিলাভ করা মুশকিল। তা না হলে কল্পনার ঘোড়াকে লাগামহীন ছুটিয়ে দিয়েই সাধারণ লেখকও ম্যাজিক রিয়ালিজমের জাদুকর আখ্যা পেতে পারতেন। এই ইংরেজি অনুবাদের প্রথমে লেখকের কথায় কুট্টানাদ অঞ্চলের ইতিহাসকে তুলে আনা হয়েছে যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার আলোচনার প্রাথমিক তথ্যগুলো সেখান থেকেই নেওয়া। এর পর আছে অনুবাদক জয়শ্রী কালাথিলের একটি নোট, যেটা পড়লে বোঝা যায় এই লেখার আত্মাকে বোঝার জন্য এবং তাকে সার্থকভাবে অনুবাদ করার জন্য জয়শ্রী কী পরিমাণ মেধা এবং শ্রমকে নিয়োজিত করেছেন। উপন্যাসটি শেষ করার পর একটাই আপশোস হয় আমাদের বাংলাতেও যদি এইরকম একজন জয়শ্রী কালাথিল থাকতেন। অবশ্য তার আগে হরিশের মত শক্তিশালী, পরিশ্রমী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী (সাহিত্যের উচ্চতাকে ছোঁয়ার প্রশ্নে) লেখকও থাকা দরকার।
অজানা সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য লেখককে সাধুবাদ। বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরী হল।
অন্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্য আমরা সত্যি খুব কম পড়ি। এটা পড়ার ইচ্ছা আছে।