কেনিয়া
What it will cost, no words can express
What is its object, no brain can suppose
Where it will start from no one can guess
Where it is going to, nobody knows
It clearly is naught but a lunatic line
মোমবাসা, কেনিয়া নভেম্বর ২০১৩
পেল্লায় তাঁবুর ভেতরে সারি সারি চেয়ার টেবিল পাতা, সামনের মাঠে ব্যান্ডবাদ্যি বাজছে। প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াট্টার ইউনিফরমধারি সুরক্ষাবাহিনী বন্দুক বাগিয়ে ঘোরাঘুরি করছে–সাদা পোশাকের রক্ষী বাহিনীও নিশ্চয় আশে পাশে আছে। আমার মতো উটকো লোককে এখানে ঢুকতে দিয়েছে তাতেই ধন্য হয়ে নভেম্বরের গরমে বসে ঘামছি।
বন্দর শহর মোমবাসা (ভারত দর্শনের পথে ভাসকো ডা গামা এখানে প্রচুর লুটপাট করে গেছেন) থেকে নাইরোবি, তারপর লেক ভিক্টোরিয়ার গা ঘেঁষে কিসুমুতে সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণ সুদানের জিবা, উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা, রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি চলে যাবে এই ব্রড গেজ লাইন। আজ সেই লাইন তৈরির মাটিতে পয়লা কোদাল চালাবেন হিজ এক্সেলেন্সি উহুরু কেনিয়াট্টা; গ্রাউনড ব্রেকিং সেরিমনি।
ইংরেজ পূর্ব আফ্রিকায় প্রথমে উগান্ডায় ঘাঁটি গেড়েছিল; চমৎকার সবুজ দেশ, হ্রদে ভরা: চার্চিল বলেছিলেন এ এক রূপকথার দেশ। হাজার মাইল দূরের সমুদ্র বন্দর মোমবাসা থেকে কাম্পালা অবধি রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৯৬ সালে; এই রেল প্রকল্পে অর্থ লগ্নির বিতর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হেনরি লাবুশেরে ওপরে উদ্ধৃত তির্যক মন্তব্যটি করেছিলেন! ততদিনে ব্রিটিশ রাজ ভারতে বিশ হাজার মাইল রেললাইন পেতে ফেলেছে তাতে লাভ হয়েছে প্রচুর কিন্তু আফ্রিকায় সেটা কতটা সঙ্গত হবে এনিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেদিন লন্ডনের ওয়েস্টমিনসটারে বসে একে পাগলের লাইন মনে হলেও ভবিষ্যতে পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ডের লগ্নির আয় দ্বিগুণ হবে এই আশায় ব্রিটিশ সরকার প্ল্যান মঞ্জুর করেছিলেন। কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই রেলপথ থেমে যায় লেক ভিক্টোরিয়ার কূলে, কিসুমুতে কিন্তু রেল লাইন বরাবর জনপদগুলি জুড়ে গিয়ে দেখা দিলো একটি নতুন দেশ, কেনিয়া! রেল নির্মাণ কর্তৃপক্ষ মাঝ পথে কর্ম বিরতির জন্য একটি ক্যাম্প বানিয়েছিলেন, কালে সেটি এক জনপদে পরিণত হল, আজ সেটি পূর্ব আফ্রিকার বৃহত্তম শহর, নাইরোবি(মাসাই শব্দ- শীতল জল, কুল ওয়াটার)! তখনকার পূর্ব আফ্রিকার ব্রিটিশ কমিশনার চার্লস এলিওট বলেছিলেন, “কোনো দেশে রেলওয়ে বানানো আশ্চর্য কিছু নয় কিন্তু কোন রেলওয়ে থেকে একটা দেশ বনে গেল সেটা নিঃসন্দেহে আশ্চর্যের কথা”। মোমবাসা জুড়ল পাঁচশ মাইল দূরের কিসুমুর সঙ্গে- কেনিয়ার জন্ম হলো।
প্রসঙ্গত বলি ট্রেনলাইন দিয়ে দেশ জোড়ার গল্পটা শুনতে মজার লাগে কিন্তু বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। ইংরেজ যে দেশটাকে কেনিয়া নাম দিল সেথা বাস করে মূলত কিকুয়ু এবং কালেনজিন ও লুও ট্রাইব। তারা এক দেশে এক পতাকার তলায় থাকতে চাইবে কিনা সে প্রশ্ন কেউ করেন নি। আমার পরিচিত জন আছেন এই তিন জাতিতেই, আমি এক আন্ডার কারেন্ট দেখেছি। কিন্তু সেটা ইংরেজের ভাবনা ছিল না, ওরা সবাই তো কালো মানুষ।
প্রাচীন লাইনটির দিনশেষের ঘণ্টি বাজবে, ট্রেন এতদিন চলতো ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে, প্রায় আঠারো ঘণ্টার পথ! এখন ছ ঘণ্টায় পৌঁছুনো যাবে। সকাল থেকে নানান উৎসব, মাসাইদের গান, বর্শা নিয়ে খেলা। প্রেসিডেন্ট সুন্দর ভাষণ দিলেন, “আজ এক ঐতিহাসিক দিন ব্রিটিশ কলোনিয়াল সরকার যে পরিকাঠামো বানিয়েছিল তার খোলনলচে বদলানো প্রয়োজন। ছোটো গেজের রেললাইন উন্নীত হবে স্ট্যান্ডার্ড গেজে, প্রথম পর্যায়ে মোমবাসা থেকে নাইরোবি, দ্বিতীয় পর্যায়ে নাইরোবি থেকে মালাবা, কিসুমু -তারপর দক্ষিণ সুদানের জিবা আমরা সেখানেই থামব না, আমি আশা করি পাঁচ বছর বাদে মোমবাসা থেকে ট্রেন চলে যাবে কাম্পালা হয়ে কিগালি (রুয়ান্ডা)। চিনের সঙ্গে এই সৌহার্দ্যমূলক সহযোগিতা শুধু কেনিয়া নয়, উত্তর পূর্ব আফ্রিকায় পরিবহন ব্যবস্থায় আনবে বিপ্লব, মাল বহনের খরচা কমবে ষাট শতাংশ ।”
প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াট্টার আরেকটি মন্তব্য মনে আছে তিনি বললেন কেনিয়া কেবল ধার বাড়িয়ে বিপদ ডেকে আনছে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দিয়ে জানালেন ষাটের দশক থেকে পরের পঁচিশ বছর কোরিয়া ধারে ডুবে যায়, সেটি হয়ে পড়ে দুনিয়ার চতুর্থ দেনদার দেশ। এই অপবাদে তারা বিভ্রান্ত হয় নি– কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, এটা ধার নয়, আমরা অপরের অর্থে নিজেদের উন্নয়ন করছি, ফেরত দেব সুদে আসলে! অচিরে দক্ষিণ কোরিয়া পূর্ব এশিয়ার টাইগার বিবেচিত হয়।
রেল নির্মাণের ঠিকেদারি পেয়েছে কারা আর এই বিশাল কাজের টাকা জোগাবে কে? উত্তর কেনিয়াট্টার ভাষণেই নিহিত, সব আসছে চিন থেকে, টাকা, যন্ত্রপাতি, লোকবল, রেলওয়ে ওয়াগন, সমস্ত রোলিং স্টক। নাইরোবি অফিসের সহকর্মী ক্রিস পাশ থেকে বললে, “আমরা সুযোগ পেলাম কই, সবটাই তো চিনের!” সে কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। প্রোজেক্টের মেন কন্ট্রাক্ট পেয়েছে চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশন (CRBC), খরচা ৩.৬ বিলিয়ন ডলার, তার নব্বুই শতাংশ ধার দেবে চায়না এক্সিম ব্যাঙ্ক, বাকিটা কেনিয়াকে কষ্টে সৃষ্টে যোগাড় করতে হবে। জমি অধিগ্রহনের আইনি কারবাই এবং তার খরচা পুরোপুরি কেনিয়া সরকারের দায়িত্ব।
টাকা ধার দিয়ে ব্যাঙ্ক আয় করে কিন্তু কঠিন সত্য এই, যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বা সিটি ব্যাঙ্ক এই দশ বিশ বছরের প্রোজেক্ট ফাইনান্সে টাকা ঢালবে এমন আশা করা বাতুলতা মাত্র। এটি সেই সব প্রতিষ্ঠানের কাজ যাদের পকেট অত্যন্ত গভীর, রেভেনিউ টার্গেট নেই, প্ল্যানিং দিগন্ত অন্তহীন, আমাদের মতন বার্ষিক বাজেট পূরণ করে বোনাস আদায়ের ভাবনা নেই; যেমন আই এম এফ অথবা দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক দীর্ঘ মেয়াদি ঋণদান যেমন চিন দিচ্ছে কেনিয়াকে (যেমন আমেদাবাদ-মুম্বাই বুলেট ট্রেনের জন্য ভারত পেয়েছে পঞ্চাশ বছরের জাপানি ঋণ)। একে ঠিক রাজা হর্ষবর্ধনের মহা দানযজ্ঞ বলা যায় না, কারণ এগুলির সঙ্গে সুদের কুপন জোড়া আছে, সে সুদ যতই নগণ্য হোক না কেন। দুনিয়ার কোনো বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক এই সুদে কাউকে এক পয়সা ধার দেবে না। আমার নিজের মত এই যে বড়ো লোন দিতে আমরা পারি না কিন্তু ধনীর দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা কাঙালিনীর মতো এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডের কিছু উচ্ছিষ্ট আমাদের ভাগ্যেও জোটে, যার নাম অ্যান্সিলিয়ারি বিজনেস! মনে আছে চার দশক আগে মালদ্বীপের এয়ারপোর্ট প্রোজেক্ট– স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সেখানে কোনো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয় নি। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিস থেকে আমরা অনেক লেটার অফ ক্রেডিট খুলেছি জার্মান সাপ্লায়ারদের সমর্থনে– তারা সরবরাহ করেছে মালদ্বীপ বিমান বন্দরে ব্যবহৃত ম্যানহোল কভার! এয়ারপোর্টে হাতে সময় থাকলে একবার চেয়ে দেখবেন, নাম গুলো জার্মান কিন্তু তারা সাপ্লাই করে আমাদের লেটার অফ ক্রেডিটের বলে!
আই এম এফ বা চিন-জাপান ধার না দিলে দেশের পরিকাঠামো প্রস্তুতের বিশাল খরচা মেটানোর আর কোনা পন্থা আছে কি? আছে। তার এক নাম পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP), যেখানে সরকার এক কদম এগিয়ে গেলে ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্যোগ সঙ্গ দেয়। কেনিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে সে বিষয়ে পরে আসবো।
আপাতত, মোম্বাসার আড্ডা।
ক্রিসকে মালদ্বীপ এয়ারপোর্টের উদাহরণ দিয়ে বললাম রেললাইন খুললে আমাদের অনেক আনুষঙ্গিক বিজনেস জুটবে তবে সেক্ষেত্রে দেনদার কেনিয়া সরকার নয়, রেল পরিবহনের সাপ্লায়ার! কম ধার অধিক আয়! তোমার হয়তো পছন্দ হবে না তবু বলি– নাৎসি আমলে মিউনিক সালতসবুরগ অটোবান খুলে গেলে ব্যাভেরিয়ার গোয়ালা অস্ট্রিয়ায় দুধ বিক্রি করার সুযোগ পেয়েছিল, রেফ্রিজারেশন তখনও আসে নি। সে খুব একটা খুশি হলো না, তার মাথায় ঘুরছে কি ভাবে সে এ বছরের বাজেট পুরো করবে।
মণ্ডপে উপস্থিত ব্যাংকারদের কণ্ঠে চাপা অসন্তোষের সুর শোনা গেল- এই প্রোজেক্টের কোনো টেন্ডার ডাকা হয় নি, সবটাই চুপিচুপি। হঠাৎ জানা গেলো China Bridge and Road Corporation(CBRC) রেল লাইন বসানো, ব্রিজ-স্টেশন বানানোর কাজ পেয়েছে। এ ঘোর অন্যায়, ইউরোপ জাপান আমেরিকার কোন কোম্পানি চান্স পেলো না, কমপিটিটিভ বিডিং নামের একটি প্রথা সভ্য সমাজে প্রচলিত আছে, তার কি হলো? আমরা নিজের বাড়ির গ্যাস বা পাইপের লাইন বসাতে অন্তত দুটো কোটেশন নিয়ে থাকি না? পার্লামেন্টে কোন বিতর্ক হল না, বন্ধ ঘরে চিনেদের সঙ্গে চুক্তিতে সই করলেন। মানতে হবে, উহুরু কেনিয়াট্টা সদ্য প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, দ্রুত নাম কামানোর প্রলোভন অনেক। খুব স্বল্প সুদে ধার দেবে চিনের ব্যাঙ্ক, যাত্রী ও মালবাহী রেল ওয়াগন আসবে চিন থেকে। তৎক্ষণাৎ কারচুপি স্বজন পোষণ দুর্নীতির গন্ধ পেলেন সবাই। এই স্বাভাবিক এমনি তো হয়েই থাকে। আমার মনে অন্য প্রশ্ন- চুরি চামারি বিশ্বজনীন ব্যাধি কিন্তু রেল লাইনটা বসবে তো? ট্রেন চলবে একদিন?
সিসিলিয়ান মেয়রের গল্প আছে- স্কুলের বন্ধু তার বাড়ি বেড়াতে এসে বিশাল অট্টালিকা দেখে জিজ্ঞেস করলে, সত্যি কথা বলতো, সামান্য মেয়রের আয় থেকে এমন বাড়ি বানালি কি করে? মেয়র একটা জনালা খুলে দিয়ে বললে, সামনের নদীর ওপরে ব্রিজটা দেখছিস, ওটা বানানোর বরাদ্দ টাকায়। বন্ধু অবাক হয়ে বললে, নদী দেখছি, ব্রিজ তো দেখছি না? মেয়র বললে, ঠিক তাই। আমার বাড়িটা দেখছিস।
কেনিয়া আসা যাওয়ার পর্ব শেষ হল ২০১৬ সালে। লুসাকায় আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের বাৎসরিক মিলন মেলায় শুনে এলাম এস জি আরের কাজ দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে আর সেই সঙ্গে রিউমার মিল, গুজবের কারখানা! শেষ অবধি অবিশ্বাসী নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে চার বছরের মধ্যে চারশ মাইলের লাইন পেতে চিন থেকে রোলিং স্টক এনে মাদারাকা (শক্তি/ ক্ষমতা) এক্সপ্রেস ট্রেন চলল ২০১৭ সালে। ছ ঘণ্টায় দিব্যি আরামে মোম্বাসা থেকে নাইরোবি। ঝাঁ চকচকে ট্রেনের কামরা, আটটি নতুন স্টেশন, রাতের ট্রেন নন স্টপ চলে। নাকের খবর পরে নেওয়া যাবে, আপাতত অন্তত নরুনটা তো পাওয়া গেল।
পরিকল্পনা মাফিক ভিক্টোরিয়া লেক পরিক্রমা করে এই স্ট্যান্ডার্ড গেজ দক্ষিণ সুদানের জুবা হয়ে কাম্পালা, কিগালি পৌঁছুনোর কথা। ইতিহাসের পরিহাস একশ বছর আগের সেই উগান্ডা রেলওয়ের মতো সেই ব্লু প্রিন্ট দেয়ালেই ঝুলে রইল। মাদারাকা এক্সপ্রেস গিয়ে থামে দুকা মোজা নামের এক ছোট্ট শহরে, নিরালা মাঠের মাঝে। ভিক্টোরিয়া লেকের তীরে কিসুমু অবধি পৌঁছুতে পারে নি একশ বছর আগে যেটি ছিল এন্ড স্টেশন, সেটিও অধরা রয়ে রয়ে গেল। খবরের কাগজে, সামাজিক মাধ্যমে দুর্নীতির, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরনের নমুনা দেখা গেল। প্রতিবাদী সাংবাদিক বা সরকারি কর্মচারিদের ঘুষ দেওয়ার গুজব শোনা যায়। কিছু লোক জমি হারিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ পান নি। পরিবেশরক্ষক মণ্ডলী সোচ্চার হলেন - নাইরোবি পৃথিবীর একমাত্র বড়ো শহর যার গা লাগোয়া আছে নিজস্ব ন্যাশনাল পার্ক। জিরাফ দেখতে মাসাই মারা যাওয়ার প্রয়োজন নেই, নাইরোবিতে অফিসের কাজের শেষে আপনি পনেরো মিনিটের মধ্যেই বাঘ সিংঘি খাটাসের সঙ্গে মোলাকাত করতে পারেন।
এই নতুন এস জি আর চলে গেছে সেই বনানীর মাঝ দিয়ে, সিংহ জিরাফকে দিবারাত্র হতচকিত করে।
খবর পাই, সমস্যা দেখা দিয়েছে সেই ধার শোধের ব্যাপারে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক থেকে কেনিয়া সরকারের জন্য আমরা তিন বছরের মেয়াদে তিনশো মিলিয়ন ডলারের একটি সিন্ডিকেটেড ঋণের আয়োজন করেছিলাম; সেই প্রথম কোন আফ্রিকান সরকারকে ইউরোলোনের বাজারে দেখা যায়, যে কোনো সরকার টাকা তোলে বণ্ড ইসু করে। আমাদের যোগাড় করা ডলারের সুদের হার বেশি, আমাদের নিজেদের ঘর সংসার চালাতে হয়। চিনের এক্সিম ব্যাঙ্কের অগাধ টাকা, তারা বাজারের অর্ধেক সুদে ধার দিয়ে থাকে। তবু সেই ঋণের বোঝা এবং সুদ-ডেট সার্ভিস- কেনিয়াকে একদিন শোধ করতে হবে। সেটি ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৩ থেকে ২০২০ অবধি কেনিয়ার জি ডি পি বেড়েছে কিন্তু তেমনি বেড়েছে তার ঋণের বোঝা। বিশ বছর আগে বিদেশি ঋণ ছিল জাতীয় আয়ের ২১ শতাংশ, এখন সেটি ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাজেট ঘাটতি এবং আমদানি ও রপ্তানির ব্যবধান বাড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার স্টাইলে অপরের ধনে ব্যবসা বাড়িয়ে, মুনাফা করে পরের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কেনিয়ায় দেখা গেল না।
উহুরু কেনিয়াট্টার দুই টার্ম শেষ হলে ভোটে জিতে সেই পদে আসীন হলেন পুরনো ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো। তাঁর নির্বাচনী ম্যানিফেসটো ছিল উন্নয়নপন্থী ও দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার বিরোধী। মোম্বাসা-নাইরোবি লাইন বা এস জি আরের প্রসঙ্গ বারবার তুলেছেন তাঁর ক্যাম্পেনে, জনতাকে আশ্বাস দিয়েছেন চিনেদের সঙ্গে সই করা সেই স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ নির্মাণ ও অর্থায়নের অরিজিনাল কন্ট্রাক্ট সর্ব সমক্ষে উন্মোচিত করবেন। তিনি স্টেট হাউসে বসলেন, তারপর প্রায় দু বছর কেটে গেল, সে কন্ট্রাক্ট গোপনেই রইল। প্রকাশ্যে অন্তত দেখা গেল লচুক্তিমত সেই রেলের যাত্রা সম্পূর্ণ হয় নি, থেমে গেছে মাঠের মাঝে। এ নিয়ে আর আলোচনা না বাড়িয়ে তিনি বললেন আমাদের উন্নয়নের কাজ অনেক বাকি- সস্তায় বিজলি সাপ্লাই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দেশের প্রবেশ তোরণ, এয়ারপোর্ট জোমো কেনিয়াট্টা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের (JKIA) সংস্কার; সেটি একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেছে (আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বিশ বছরে তার বিশেষ উন্নতি দেখি নি)।
রাষ্ট্রের উন্নয়নের খরচা যোগাড় হয় একাধিক পন্থায়; রাজস্ব থেকে, শুদ্ধ দেশি প্রজেক্ট, যেমন হুভার ড্যাম, দামোদর ভ্যালি, টোল রোড, বর্ষে বর্ষে শোধ হয় ব্যবহারকারীদের প্রদত্ত অর্থে; অথবা সরকার ধার করেন দেশের লগ্নিকারকের কাছ থেকে, আগামী রাজস্বের আয় থেকে শোধ দেবেন এই প্রতিশ্রুতিতে - তখন অঙ্ক মেলানোর প্রশ্ন ওঠে (আঙ্গেলা মেরকেল বলেছিলেন আমি গৃহবধূর (Hausfrau) মতো চিন্তা করি, আমার আয় কত সেই বুঝে ব্যয় করি- ব্যালান্সড বাজেট); আরেক উপায় বিভিন্ন দেশের সরকার, উন্নয়ন সংস্থা যেমন আমেরিকান এক্সিম, কানাডিয়ান ই ডি সি- সেখানে সুদের হার কম, মেয়াদ দীর্ঘ মানে একটা লম্বা দড়ি মেলে, শোধ করার তাড়া থাকে না। অন্তত যে সরকার ধার নিলেন সে সরকারের কর্মকালে তো নয়ই তবে দেশের গলায় সেই ঋণ ঝুলে থাকে অনন্তকাল, সেটা অন্য কারো সমস্যা; তবে এখানে একটা লেজুড় থাকে, ঋণদাতা এই সব সরকার অবশ্যই চান যে তাঁদের নিজেদের দেশের কোন সংস্থা লাভবান হোক, অবশ্যই টেন্ডার বিজয়ী হয়ে।
আর কোনো পথ?
আছে। ছোটো বা লম্বা মেয়াদে ধার না নিয়ে সরকার বিজলি সরবরাহ, বিমান বন্দর প্রকল্পের প্ল্যানিং, পরিচালনা ও অর্থায়নের সম্পূর্ণ ভার সমর্পণ করতে পারে একটি বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে, আজ নগদ কল উধার নয়! সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে কোন বাণিজ্যিক সংস্থা একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারে যার মুখ চলতি নাম প্রাইভেটলি ইনিশিয়েটেড প্রপোজাল (PIP)। এই ধরুন শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এলেন, বললেন আমরা আপনাদের ইলেকট্রিক পাওয়ার জেনারেশন, ট্রান্সমিশন, সবটাই উন্নত করে দেবো প্রোডাকশন বাড়িয়ে দেবো, তবে আমাদের শর্তে আর এ নিয়ে কোন টেন্ডার ডাকা চলবে না। আপনাদের আজ কোনো খরচ নেই। নিজেদের খরচা মিটিয়ে, কিছু মুনাফা করে তিরিশ বছর বাদে প্রকল্পের মালিকানা ফিরিয়ে দেবো সরকারের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে; প্রকল্পের মোট মূল্য, স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম, বিজলির ইউনিট প্রতি দাম, এয়ারপোর্ট ব্যবহারের খরচাপাতি, এমনকি গাড়ি পার্কিং ফি, ঠিক কোন দরে ফেরানো হবে মালিকানা, এমনি হাজার সওয়াল। দেশ একটা প্রোজেক্ট পেলো, তার আপাতত কোনো খরচা নেই কিন্তু স্বচ্ছতা?
দেয়ার ইজ নো ফ্রি লাঞ্চ কথাটা বহুকাল ধরে শুনে আসছি।
প্রেসিডেন্ট রুটো জানালেন তিনি এক সুযোগ্য বিজনেস পার্টনারকে বিজলি, স্বাস্থ্য ও এয়ারপোর্টের উন্নয়নের ভার দেবেন, কেনিয়ার রাজস্বের ভাঁড়ারে কোনো টান পড়বে না, বিজলি মিলবে সস্তে মে, রুগী পাবে যথাযথ চিকিৎসা, এয়ারপোর্টে নেমে নির্মল আনন্দ হবে। তিরিশ বছর বাদে এ সবেরই মালিকানা ফিরে পাবে কেনিয়া।
কেনিয়াকে ত্রাণ করতে কোন মহাপুরুষ মর্ত্যভূমে অবতীর্ণ হবেন?
প্লট ঘনীভূত।
ক্রমশ:
পুঃ
গ্রাউন্ড ব্রেকিং সেরিমনির পরে ক্রিস বললে প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াট্টার সঙ্গে হাত মেলাবে? তা কি সম্ভব? প্রহরী ও প্রেস পরিবৃত তিনি! সে বললে আমার গাড়িতে ওঠো। তারপর অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সে প্রেসিডেন্টের ক্যাভালকেডের পিছু ধাওয়া করে মোম্বাসা এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি এলাকার ভেতরে নিয়ে যায়। হাত মেলানোর সুযোগ পেলাম। আমাকে উহুরু জিজ্ঞেস করলেন আপনি কতদূর থেকে এসেছেন, জবাবে জানালাম, ভারত থেকে তবে ইংল্যান্ডে বাস করি, ছোটবেলায় কেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী শুনেছি আপনার বাবা আমার হিরো ছিলেন! ততক্ষণে উহুরু পাশের মানুষটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমার গল্প এখানেই শেষ নয়! পরের দিন সন্ধ্যেবেলা নাইরোবি থেকে লন্ডনের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে বিজনেস ক্লাসে আমার প্রিয় সিট 1A তে সবে আরাম করে বসেছি এমন সময় এয়ার হোসটেস আমার কাছে একটি অনুরোধ জানালেন – আমি যদি আমার এই সিটটি আরেকজনের জন্যে ছেড়ে দিয়ে পিছনের রো 2A তে আসন গ্রহণ করি, বিমান কর্তৃপক্ষ সাতিশয় সন্তুষ্ট হবেন। নিতান্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে জানতে চাইলাম কার জন্য আমি এই মহান ত্যাগ করব? এয়ার হোসটেস নিচু স্বরে বললেন মাদাম মারগারেট কেনিয়াট্টা! তখন আমাকে ঠেকায় কে? হলিউডি স্টাইলে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, অবশ্যই তাঁর জন্য এ আসন ছেড়ে দেব। মাদাম কেনিয়াট্টা আসন গ্রহণ করলে তাঁর কাছে গিয়ে সবিনয়ে জানালাম আগের দিন হিজ এক্সেলেসির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তিনি মৃদু হাসলেন।
এ ঘটনার বিশদ বিবরণ আমার আফ্রিকা বইতে আছে। তবে যারা সেটি পড়েন নি তাঁদের সুবিধার্থে পুনরাবৃত্তির লোভ সামলানো গেলো না!