আসমান সে আয়া ফরিশ্তা
২০২২ সালের কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ আট বছর আগের উপরাষ্ট্রপতি রাইলা ওডিঙ্গা এবং উহুরু কেনিয়াট্টারর উপরাষ্ট্রপতি উইলিয়াম রুটো। রুটো তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে মোম্বাসা-নাইরোবি স্ট্যান্ডার্ডগেজ রেলওয়ে প্রকল্পের প্রভূত সমালোচনা করে জানান নির্বাচনে জিতলে তিনি সেই প্রোজেক্টের গোপন তথ্যাবলি সর্ব সমক্ষে উপস্থিত করবেন। তিনি ভোটে জিতলেন, উহুরু কেনিয়াট্টার পরে পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হলেন কিন্তু এস জি আরের টেন্ডার ও ফাইনান্সিংয়ের রহস্য উন্মোচিত হল না। বরং তাঁর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি বললেন, ধৈর্য ধরুন, আমার শাসনকালে কেনিয়ার পরিকাঠামোকে আমূল বদলে দিয়ে যাবো।
পয়লা নম্বরে আসে নাইরোবির জোমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
১৯৭৮ সালে সম্পূর্ণ করা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিমান বন্দরের হাল খারাপ অত্যন্ত খারাপ; একদিকে কেনিয়া দাবি করে সে দেশ এবং নাইরোবি শহর হল পূর্ব আফ্রিকার গেটওয়ে, অন্যদিকে সেই গেট দিয়ে ঢোকা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার কিছু সমাজসেবামূলক কাজকর্মের সূত্র সম্পর্কে পরিচিত মেরি এঞ্জেরি নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া ও কমিউনিকেশন পাঠরত। সে আমাকে কেনিয়ান সাংবাদিক ল্যারি (লরেন্স) মাদোওর কথা বলে যাকে আমি ফলো করি। ল্যারি এখন সি এন এনের উজ্জ্বল তারকা নাইরোবি এয়ারপোর্টের দুরবস্থার বিষয়ে তার একটি অগ্নিগর্ভ লেখা পড়েছি এ বছর!
দ্বিতীয় জরুরি বিষয়, অধিক বিজলি উৎপাদন এবং তার সুলভ ট্রান্সমিশন।
তিন নম্বরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা; কেনিয়ার আশু প্রয়োজন একটি ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল সিস্টেম
২০১৩ সালে স্ট্যান্ডার্ডগেজ রেলওয়ে লাইন পাতা, ট্রেন চালানো এবং টাকার ব্যবস্থা সবটাই এসেছে চিন থেকে। চিনের একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কেনিয়ায় জনমত গড়ে উঠেছে। সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়– লুসাকায় প্লেন থেকে নামলে দেখবেন দুটি এয়ারপোর্ট, একটি আপনার আমার জন্য, অন্যটি চিনের। গল্প আর না বাড়িয়ে এটা উল্লেখ করতে পারি দক্ষিণ আফ্রিকায় বারোটি পুলিস চৌকি আছে যেখানে কেবলমাত্র চিনা অপরাধীদের পাঠানো হয়। প্যারালেল গভর্নমেন্ট।
প্রেসিডেন্ট রুটো জানালেন কেনিয়ার উন্নয়ন প্রকল্প অত্যন্ত জরুরি তবে এবার সহায়তার জন্য তাকাবেন পশ্চিম পানে, পুব দিকে নয়।
বিমানবন্দর প্রকল্প - আদানির প্রস্তাব
মার্চ ২০২৪
জোমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের পূর্ণ মালিকানা পেলে আদানি এভিয়েশন তার সম্পূর্ণ আপগ্রেডিং করবেন– মাত্র চার বছরের মধ্যে বার্ষিক আয় হবে দ্বিগুণ (বর্তমানের ১৬০ মিলিয়ন ডলার থেকে ২৯০ মিলিয়ন)। তিরিশ বছর পূর্ণ হলে, ২০৫৪ সালে, আদানি এ বিমানবন্দরের ভার কেনিয়ান সরকার তথা কেনিয়া এয়ারপোর্ট অথরিটির হাতে যখন তুলে দেবেন ততদিনে তার বার্ষিক আয় গিয়ে পৌঁছুবে ১.২ বিলিয়ন ডলারে।
প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য কেনিয়া সরকারকে বাজেটে কোনো অর্থ বরাদ্দ করতে হবে না। ফলত করদাতাদের ওপরে কোন অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর সম্ভাবনা শূন্য।
আদানির শর্ত
বিমানবন্দর পুনর্নির্মাণ প্রকল্প অধিগ্রহণের যে সকল শর্ত তিরিশ বছর যাবত জারি থাকবে তার তালিকা নিম্নরূপ-
বিমানবন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বাণিজ্যিক বিষয় সরকারের কোন হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে আদানি গোষ্ঠী দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হবে, যেমন সকল প্রকার পরিষেবার লাইসেন্সিং চার্জ, গাড়ি পার্কিং ফি, ট্যাক্সি ভাড়া, চা কফি পানীয় জল সহ খাবার দাবার, বিজলি ও জল ব্যবহারের মূল্য।
এয়ারপোর্ট প্রোজেক্ট, তার পরিচালনা এবং তৎসংশ্লিষ্ট আয়ের ওপরে পরবর্তী তিরিশ বছরে কেনিয়ান সরকার বিশেষ কর-মুক্তি দেবেন।
সমস্ত আয়ের হিসাব হবে আমেরিকান ডলারে। কেনিয়ান শিলিংয়ে প্রাপ্ত আয়কে ডলারে পরিবর্তিত করার অনুমোদন ও গ্যারান্টি দিতে বাধ্য থাকবেন সরকার। গাড়ির পার্কিং ফি শিলিংয়ে জমা হলেও কেনিয়ান সরকার সেটি শেষ অবধি ডলারে আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন।
এয়ারপোর্টের সকল কর্মচারীর নিয়োগ এবং চলতি চুক্তিপত্র সংশোধন করবার অধিকার আদানি গোষ্ঠীর হাতে থাকবে।
বর্তমান বিমানবন্দরের কাছাকাছি (সঠিকভাবে নির্দেশিত নয়, তবে অন্তত তিরিশ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে) কেনিয়ান সরকার কোনো প্রকারের পরিকাঠামো নির্মাণ করতে পারবেন না। করলে সেটিকে আদানি গোষ্ঠী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অভিপ্রায় বিবেচনা করবেন। তাঁরা জানিয়েছেন ভারতীয় এয়ারপোর্ট প্রকল্পে তাঁরা এই শর্ত আরোপ করেছেন এবং ভারত সরকার সেটি মেনে নিয়েছেন।
২০৫৪ সালে এয়ারপোর্ট মালিকানা হস্তান্তরের পরেও আদানি গোষ্ঠীর হাতে ১৮% মালিকানা থেকে যাবে, ইন পারপেচুইটি অথবা অনন্তকাল।
বংশীবাদকের উপাখ্যান
এ বছরের জুলাই মাসে নেলসন আমেনিয়া নামক এক কেনিয়ান তাঁর ব্লগে জানিয়েছেন আদানিগোষ্ঠীর আনসলিসিটেড (তথাকথিত প্রাইভেট ইনশিয়েটেড প্রোজেক্ট) প্রস্তাবটি যেদিন সকালবেলা কেনিয়া এয়ারপোর্ট অথরিটির টেবিলে রাখা হয়েছিল সেদিনই বিকেলবেলা সেটি গৃহীত হয়। এই প্রোজেক্টের খরচা বা শর্তাবলী নিয়ে কোনো দ্বিতীয় অভিমত নেওয়া হয় নি, টেন্ডার তো অনেক দূরের কথা এই ডিলে আদানির লাভ ৯০% কেনিয়ার ১০%। তিনি যতদূর জানেন কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই আদানি ভারতে এয়ারপোর্ট ম্যানেজ করার কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে সাংবাদিক-স্বাধীনতার মাপকাঠিতে কেনিয়ার স্থান ভারতের অনেকটা ওপরে (১০২-১৫৯)।
একুশে নভেম্বর পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট রুটো আদানি-চুক্তি বাতিল করার পর তাঁর সাক্ষ্যে কেনিয়ান অর্থমন্ত্রী এমবাদি বলেন এক দিনে এই প্রকল্পটি সরকার মঞ্জুর করেছিলেন জেনে তিনিও যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন।
আমেনিয়া কেন তাঁর বাঁশিটি বাজালেন? তার উত্তরে আমেনিয়া জানান এর কারণ বহুবিধ- নাইরোবি বিমানবন্দর প্রকল্পে আদানির প্রস্তাব শোনার পর তিনি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার দর নিয়ন্ত্রণ (স্টক ম্যানিপুলেশন) এবং হিসেবের কারচুপির (অ্যাকাউনটিং ফ্রড) বৃত্তান্ত পাঠ করেন, তারপরে তিনি অস্ট্রেলিয়ান পরিবেশসংরক্ষণ লবির একটি ইস্তেহারে সেখানকার পরিবেশবিনষ্টিকরণ, মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও আইন বিরোধী কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণ পান। তখন তাঁর মনে হয়েছে জনস্বার্থে আদানির প্রস্তাব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত যতই তিনি এই প্রস্তাবের গভীরে গেছেন, মনে হয়েছে এটি অত্যন্ত একপেশে। আমেনিয়া এও বলেন তিনি বাঁশি না বাজালে কেনিয়ান সরকার অথবা কেনিয়ান এয়ারপোর্ট অথরিটি আদানির তিরিশ বছরের প্রোজেক্টটি সর্ব সমক্ষে আনতেন না। একান্ত গোপনে যে চুক্তি সই হয়েছিল সেটি গোপনেই থেকে যেতো। পরে কমার্শিয়াল কন্ট্রাক্ট সই হতো, যেখানে এয়ারপোর্ট পার্কিং থেকে চেক-ইন ডেস্কের কর্মীদের মাইনে, এক বোতল পানীয় জলের মূল্য নির্ধারিত হতো। এয়ারপোর্টের উন্নয়নের কাজ শুরু হতে দেখে মানুষজন মনে করতেন এটি সরকার বানাচ্ছেন, আদানি নামক এক কনট্রাক্টর দিন মজুরির ভিত্তিতে রাজ মিস্ত্রির কাজ করেন।
দু বিলিয়ন ডলারে কেনিয়ার ক্রাউন জুয়েল বিক্রি করাটা সমীচীন কিনা সেটা কি ভেবে দেখা উচিত ছিল না? এই ডিলের ব্যাপারে কত টাকা এ হাত ও হাত হয়েছে? রুয়ান্ডার কিগালি, উগান্ডার কামপালা, সুদানের জুবাসকল, প্রতিবেশী দেশের রাজধানীর গেটওয়ে, পূর্ব আফ্রিকার সবচেয়ে কর্মব্যস্ত এই নাইরোবি বিমান বন্দর
কেনিয়ার ক্রাউন জুয়েল; দু বিলিয়ন ডলারে লিজের নামে এটি বাস্তবিক বেচে দেওয়াটা কি সমীচিন হবে?
খবরটি নিয়ে কানাঘুষো হলে পরে কেনিয়ান এয়ারপোর্ট অথরিটি বলেন যে তাঁরা এই প্রস্তাবের টেকনিকাল, আইনি ও আর্থিক দিক গুলি খুঁটিয়ে দেখবেন (ডকুমেন্টে সই করার পরে!)।
আমেনিয়া বর্তমানে ফ্রান্সে পড়াশোনা করেন এবং নাইরোবিতে একটি কার্বন ক্রেডিট ফার্ম চালান। আদানি প্রস্তাবের বিষয়ে তাঁর অভিযোগগুলি সরকারের গোচরে আসা মাত্র কেনিয়ান ডিরেক্টরেট অফ ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন(আমাদের ই ডি) আমেনিয়ার ফার্মের বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবসায়ের চার্জ আনেন। আমেনিয়ার
এই কার্বন ক্রেডিট ব্যবসায়ের সঙ্গে ক্রিপ্টো কারেন্সির কোন সম্পর্ক নেই সেটা বুঝতে তাঁদের মাস দুয়েক লেগে যায়। আমেনিয়া আরও বলেন বর্তমানে তিনি ফ্রান্সে আছেন বলেই বাঁশি বাজাতে পেরেছেন। কেনিয়াতে এই কাণ্ডটি করলে তাঁর জীবন বিপন্ন হবার বিপুল সম্ভাবনা, হয় পুলিশ তাঁর দরজায় কড়া নাড়বে বা দরোজা ভাঙবে, রাস্তায় হঠাৎ কোন ট্রাক বেপথু হয়ে তাঁকে চাপা দেবে অথবা সরকারের কোনো না কোনো সংস্থা তার শ কয়েক ইন্সপেক্টর পাঠাবেন। ফ্রান্সে গিয়েও নিস্তার নেই– কেনিয়ান সরকারের আইনি দপ্তর কিছু ফরাসি আইনজ্ঞের সাহায্য নিয়ে আমেনিয়ার মুখ বন্ধ (গ্যাগ অর্ডার) করার চেষ্টা চালু রেখেছেন। আত্মরক্ষার্থে আমেনিয়া এখন ফরাসি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছেন।
বিজলি উৎপাদন ও বিতরণ– আদানির প্রস্তাব
নাইরোবি বা মোম্বাসায় লোডশেডিং হয় না, তবে গাতুম্বিতে মেরি এঞ্জেরির গ্রামে গিয়ে দেখলাম বিদ্যুৎ সেখানে পৌঁছায়নি। সে একেবারে আমার বাল্যকালের পদুমা গ্রামের মতন, তবে সে সময়ে আমাদের বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল নগণ্য। এখন মেরির মা বাসে চড়ে নিকটবর্তী শহরে গিয়ে তাঁর ফোন চার্জ করান এবং অত্যন্ত কার্পণ্যের সঙ্গে সেটির ব্যবহার করেন। বাস রাস্তা থেকে গ্রামে যাবার পথ কর্দমাক্ত – জুতো হাতে হেঁটে গেছি!
উইলিয়াম রুটোর সরকার এর সত্বর প্রতিবিধান খুঁজলেন এবং মেঘ না চাইতেই পেলেন জল।
মর্ত্যভূমে অবতীর্ণ হলেন আদানি এনার্জি সলিউশন
তাঁরা প্রস্তাব দিলেন ৩৭১ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন এবং পূর্ব এবং পশ্চিম কেনিয়াতে পাঁচটি সাবস্টেশন তাঁরা বানিয়ে দেবেন– মোট খরচ ১২৭ বিলিয়ন কেনিয়ান শিলিং, আজ উধার কল নগদ তিরিশ বছর বাদে। ইতিমধ্যে বিদ্যুতের দাম, সংশ্লিষ্ট সকল বাণিজ্যিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার একমাত্র আদানি গ্রুপের, কোনো পাল্টা প্রস্তাব বিবেচনা অথবা টেন্ডার ডাকা চলবে না।
সেটি তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হলো।
নাইরোবির সেনেটর এডউইন সিফুনা প্রশ্ন তুলেছিলেন (আগস্ট ২০২৪) – এই প্রস্তাবের কোন মাপজোক হয়েছে কি? এটি কি বাজারের একমাত্র প্রস্তাব? তার কাগজপত্র লোক সমক্ষে উপস্থাপিত করতে বাধা কোথায়? সিফুনা সহ আরও অনেকের প্রশ্ন সরাসরি ইউ টিউবে দেখতে পাবেন।
জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা (ইউনিভারসাল হেলথ কেয়ার সিস্টেম)-মিলিত প্রস্তাব
২৪শে জানুয়ারি ২০২৪ বিকেল তিনটেয় নাইরোবির আফিয়া হাউসে একটি প্রার্থনা অনুষ্ঠানের পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কেনিয়ার টেলিকম জায়ান্ট, সাফারিকম, একটি সম্পূর্ণ ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল সার্ভিসের ঘোষণা করলেন: মোট ব্যয় আটচল্লিশ বিলিয়ন কেনিয়ান শিলিং, দশ বছরের প্ল্যান। মিটিঙের অব্যবহিত পরে সাফারিকম তাঁদের প্রস্তাবটির সমীক্ষা করে পুরো খরচাটা কমিয়ে আনলেন- যেমন ওষুধ ব্যবহারের নিরীক্ষার খরচ নেমে এলো ১৩ বিলিয়ন থেকে ৩১২ মিলিয়ন শিলিং, হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ৯ বিলিয়ন থেকে ৩ বিলিয়ন ইত্যাদি। সাধারণত প্রোজেক্ট রিভিউয়ের পরে ব্যয় বর্ধিত হতে দেখা যায় কিন্তু সাফারিকমের এই একক প্রপোজালে সেটি গেল কমে।
কদিন বাদে একটি বিচিত্র ঘটনা ঘটল–সাফারিকম জানালেন আমরা ব্যাপারটা একটু খুঁটিয়ে দেখে নতুন প্রস্তাব দেবো। এবার এটি একেবারে অন্য চেহারা নিলো –
সাফারিকমের কর্তারা মাথা চুলকে জানালেন প্রকল্পটি বিশাল, তাঁদের পক্ষে একা এর সাধন শক্ত। ড্রইং বোর্ডে আবার বসে বিচার বিমর্ষ করে তাঁরা দেখছেন কাজটা সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে সবল সহযোগীকে সঙ্গে আনা দরকার এবং খরচাটা প্রায় ডবল হবে, আটচল্লিশ বিলিয়ন নয় ১০৫ বিলিয়ন শিলিং (একটি নমুনা। সিকিউরিটি ও সাপোর্ট সিস্টেমের খরচা বাড়লো ৭০০ মিলিয়ন শিলিং থেকে পাঁচ বিলিয়ন শিলিং)।
এই বাড়তি খরচা মেটানো যাবে কি ভাবে? উত্তর সহজ– প্রত্যেক খরচার আইটেমের ওপরে পাঁচ পারসেনট সার্ভিস চার্জ যোগ করে (যেটা কেনিয়ান নাগরিকরা কখনো দিয়ে আসেন নি)। তাঁরা ও তাঁদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানদুটি একত্র বসে হিসেব করে দেখেছেন এই চার্জ ধরলে মাত্র দশ বছরে ১০৫ বিলিয়ন উঠে আসবে।
২৪শে জানুয়ারির পরিষেবার আইটেমগুলি অপরিবর্তিত রেখে সদ্য গঠিত কনসার্টিয়াম নতুন প্রস্তাবটি পেশ করল- কনসরটিয়ামের অন্য দুই সদস পো: আবুধাবির সংস্থা আপেইরো (৫৯.৫৫%) এবং আরেকটি কেনিয়ান কোম্পানি কনভারগেনজ(১৭.৮৯%) সাফারিকমের হাতে রইল ২২.৫৬%।
শুরু হয়েছিল সাফারিকমের ১০০% মালিকানা দিয়ে।
এই প্রস্তাবটি পাওয়া মাত্র কেনিয়ান স্বাস্থ্য দফতর মঞ্জুর করলেন একই দিনে।
পু: আপেইরোর বড়ো ভাগের শেয়ারের মালিক আবুধাবির সিরিউস ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং যেটি আবার ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানির সহায়ক (সাবসিডিয়ারি) সংস্থা। ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানি
-আই এইচ সি- তার হর্তাকর্তা বিধাতার নাম শেখ তাহনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। তিনি তাঁর দেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং অন্তত একশ বিলিয়ন ডলারের দুটি সভারেন ওয়েলথ ফান্ডের অধীশ্বর। শেখ সাহেব প্রকাশ্যে জানিয়েছেন তিনি ও তাঁর সংস্থাগুলি অত্যন্ত সচেতন ভাবে আদানি গ্রুপে নিয়মিত অর্থ বিনিয়োগ করে থাকেন। এই মার্চ মাসে তিনি আরও দু বিলিয়ন ডলার আদানি গ্রিন এনার্জিতে লগ্নি করেছেন।
ডান ডিল?
মার্চ মাসে অতি গোপনে এয়ারপোর্ট আপগ্রেডিং বিষয়ে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল কেনিয়ান প্রেস ক্রমশ তার সারাংশ উদ্ধার ও প্রকাশ করতে থাকে। নেলসন আমেনিয়া বাঁশিটি বাজালেন তাঁর ফ্রান্সের আবাসন হতে। নাইরোবি বিমানবন্দরের কর্মীরা এই পাবলিক প্রাইভেট প্রপোজালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন, সেপ্টেম্বর থেকে সেটি উঠলো তুঙ্গে। সরকার আপন পক্ষ সমর্থনে জানালেন আদানি ভারতে বহু এয়ারপোর্ট পরিচালনার ভার পেয়েছেন, সেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে নি। আদানি এভিয়েশন একটি সুযোগ্য সংস্থা এ নিয়ে হঠাৎ এতো গোলযোগ কেন?
ভবি ভোলবার নয়। সেপ্টেম্বর থেকে ধর্মঘট শুরু হল নাইরোবি এয়ারপোর্টে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো ও ট্রান্সমিশন লাইন বসানোর খরচা নিয়েও প্রতিবাদের ঝড় উঠলো- এখানে কোন টেন্ডার ডাকা হয় নি কেন?
এটা কি সত্যিকারের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, না প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ? পাবে বসে আড্ডা দিচ্ছেন এমন সময়ে কেউ এসে বললেন সার, আপনি যে বাড়িটা ভাড়া দিয়ে থাকেন তার সম্পূর্ণ সংস্কার করে দেবো। আমার খরচা এই এতো। আর আগামী তিরিশ বছরের ভাড়া, তার বার্ষিক বৃদ্ধি সব কিছুই আমার পকেটে যাবে, তিরিশ বছর বাদে ফেরত পাবেন কিন্তু আমার আংশিক মানে এই ১৮% মালিকানা থেকে যাবে চিরতরে।
বিশে নভেম্বর অবধি কেনিয়ান সরকার তাঁদের সিদ্ধান্তে অটল– টেন্ডার ডাকা না হয়ে থাকুক, কেনিয়া এয়ারপোর্ট অথরিটি আদানি প্রস্তাবের প্রভূত ছানবিন করে কোনো ত্রুটি বা ফাঁক খুঁজে পান নি, সরকারের অর্থ দফতর একে আশীর্বাদ জানিয়েছেন কারণ কেনিয়ান করদাতাদের ওপরে কোনও ভার পড়বে না, তাঁরা মুফতে একটি আধুনিক এয়ারপোর্ট পেয়ে যাবেন। অন্যদিকে ঘরে ঘরে বিজলি বাতি জ্বলে উঠবে, তার জন্যেও কোন বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন হবে না।
লাভ শুভ, শুভ লাভ।
পার্লামেন্টে তুমুল বিতর্ক, দাবি উঠল স্বচ্ছতার, খোলা টেন্ডার ছাড়া কোনো কাজের বরাত দেওয়া যাবে না, এই মর্মে আইন পাশ হোক দুনিয়াতে আরও অনেক কোম্পানি আছে এক আদানিতে শীত যায় না।
সারা দেশে প্রতিবাদের তুফান; নাইরোবি এয়ারপোর্ট থেকে ছড়িয়ে গেল কিসুমু, মোম্বাসা , মালিন্দি, লামু, ঠিকা মেরু, গাতুম্বি।
অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় কেনিয়ান প্রেস ও টেলিভিশন কতোখানি মুক্ত তার প্রমাণ পাওয়া গেল দিনের পর দিন। পার্লামেন্টের তর্কাতর্কি অবাধে দেখা যায় যে কোন সামাজিক মাধ্যমে, স্পিকার সেখানে কারো নাম বা বক্তব্য ডিলিট করেন না।
শেষের সেদিন?
কেনিয়ান পার্লামেন্টের যুগ্ম অধিবেশন
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪
আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস আদানি গোষ্ঠীর সাতজনের নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করার পরের দিন।
স্টেট অফ দি নেশন ভাষণে কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম রুটো বললেন “আদানি সংস্থার কিছু সিনিয়র লোকের বিরুদ্ধে আনা আমেরিকান সরকারের চার্জশিটের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পরিবহন এবং বিজলি দফতরের মন্ত্রণালয়কে আদেশ দিয়েছি এই মুহূর্তে দু বিলিয়ন ডলারের বিমান বন্দর প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের কন্ট্রাক্ট অবিলম্বে বাতিল করা হোক।”
পার্লামেন্টে তুমুল করতালি, স্ট্যান্ডিং ওভেশন।
পরিশিষ্ট এক
জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবায় ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটালাইজড সিস্টেমের প্রস্তাবটি আপাতত নাকচ হয়েছে।
আদানিগোষ্ঠী জানিয়েছেন পিকচার অভি বাকি হ্যায়। কেনিয়ান সরকার একতরফা কোনো চুক্তি বাতিল করতে পারেন না, আর্থিক ক্ষতিপূরণ বাঞ্ছনীয়।
পরিশিষ্ট দুই
নেলসন আমেনিয়া আজ কেনিয়ার ন্যাশনাল হিরো।