ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা যে হচ্ছে এটা শুভ লক্ষণ। তবে সেই আলোচনার অনেকটাই পূর্বশ্রুত কথাবার্তার পুনরুক্তিপ্রবণ। সেই অবকাশে একটা কথা বলার যে, ঋত্বিক নিজের ছবি তৈরি করার জন্য নিজের এক নন্দনতত্ত্ব তৈরি করে নিয়েছিলেন। এমন নয় তাঁর সিনেমার ভাষা ও দর্শন নিয়ে কথা বলা হয় নি। কিন্তু সবটা মিলে তিনি যে একটা নিজস্ব নন্দনতত্ত্বের জনক—এই কথাটাও আলাদা করে বলা দরকার। কারণ খুব বড় শিল্পীদের এটা থাকে। সিনেমার ক্ষেত্রে আইজেনস্টাইন, ব্রেসোঁ, গোদার, তারকোভস্কি –এদের যেমন ছিল।
যে কোনো বড় শিল্পীর একটা নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব থাকে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ জিনিস তো আমরা বরাবর দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ যেমন সাহিত্যের পথে লেখেন, জাঁ পল সার্ত্র তেমনই What is literature লেখেন। শিল্পের উদ্দেশ্য, উপযোগিতা, প্রকাশভঙ্গী, দর্শন নিয়ে বড় শিল্পীরা ভাবেন আর সেটাই নন্দনতত্ত্বের জন্ম দেয়। এপিক থিয়েটার কি তাই নিয়ে না ভাবলে ব্রেখটের নাট্যভাষা তৈরি হত না। ঋত্বিক কুমার ঘটকের ক্ষেত্রেও একথা সত্য।
ঋত্বিকের জীবনবোধের মতাদর্শগত ঘোষিত ভিত্তি ছিল মার্কসবাদ। একইসঙ্গে তার ভেতরে ভীষণভাবে ক্রিয়াশীল ছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার,ভারতের প্রাচীন দার্শনিক ভিত্তি, লোকসংস্কৃতি আর সঙ্গীত। এগুলো ঋত্বিকের সিনেমায় কোনো সাজিয়ে রাখা উপকরণ ছিল না, ছিল তাঁর সামগ্রিক নন্দনবোধের অংশ।
ঋত্বিক মার্কসবাদী হয়েও কোনো যান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের দাসত্ব করেন নি। তিনি দেখেছিলেন যে মার্কসবাদী পরিভাষা দিয়ে বা শুধু শ্রেণীচেতনা দিয়ে মানুষের সব জটিলতাকে, তার অন্তর্জগতকে ধরা যায় না। আমরা জানি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখক জীবনের প্রথমার্ধে বা জগদীশ গুপ্তর সাহিত্যে কতটা প্রভাব ফেলেছিল ফ্রয়েডের মনোবিদ্যা। কিন্তু ঋত্বিক ব্যক্তি নয়, সমষ্টির মনস্তত্ত্বে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে মনস্তাত্ত্বিক কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংয়ের যৌথ নির্জ্ঞান ( Collective Unconscious ) এবং আদি প্রতিমা ( archetype ) হয়ে ওঠে ঋত্বিকের শিল্পভাষার অন্যতম উপাদান। ফলে ঋত্বিক এক নতুন নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ করে নেন যা একদিকে যান্ত্রিক মার্কসবাদী প্রয়োগকে এড়িয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে ব্যক্তির ইতিহাসকে, তার উথ্বানপতনকে জুড়ে দিতে পারে সমষ্টির ইতিহাসচেতনার সঙ্গে। নিজস্ব নন্দনতত্ত্বকে এভাবে গড়ে পিটে নেওয়ার কাজ আর কোনো ভারতীয় চলচ্চিত্রকার করেছেন বলে আমার জানা নেই।
১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মেঘে ঢাকা তারা ছবিটি বোধহয় ঋত্বিকের একমাত্র ছবি যা মুক্তির পরপরই দর্শকের আনুকূল্য পেয়েছিল। এছবির নীতাকে ঋত্বিক তার হৃদয় নিংড়ে গড়ে ছিলেন। উদবাস্তু পরিবারের একমাত্র চাকরিরতা মেয়ে নীতার উপার্জনের ওপর গোটা পরিবার নির্ভরশীল। সেই নীতা মায়ের মত মমতায় গোটা পরিবারের জন্য আত্মত্যাগ করে। তাকে ঠকায় তার প্রেমিক সনৎ, নিজের বোন গীতা। বাড়ির সবাই তাকে কমবেশি এক্সপ্লয়েট করে। কিন্তু নীতা সর্বংসহা শান্তমূর্তি। এইখান থেকেই ঋত্বিকের ছবিতে মাদার আর্কিটাইপের গুরুত্বপ্রদান শুরু।নীতার জন্ম জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। নীতার যখন প্রথম যক্ষ্মা ধরা পড়ে , সে যখন দাদা শংকরের কাছ থেকে কাশির সঙ্গে উঠে আসা রক্ত লুকাচ্ছে তার ঠিক পরেই শোনা যায় বিজয়ার গান-- আয় গো উমা , কোলে লই। আমাদের গোটা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উমার বিচ্ছেদে আমাদের ব্যথাতুর হওয়ার বেদনা আমাদের যৌথ অবচেতনে আছে। তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া দাদা শংকরের সামনে নীতা যেন মহাকাল পাহাড়ের কাছেই হারিয়ে যায় । নিজের বোন, নিজের প্রেমিকের কাছে প্রবঞ্চিত, নিজের পিতা মাতা এবং দাদার কাছে উপেক্ষিত নীতা যখন বোনের সংসারযাপনের গল্প শুনতে শুনতে পাহাড় ফাটানো আর্তনাদে তার বাঁচার আর্তিকে জানায় তখন মনে হয় এর চেয়ে ট্র্যাজিক, এর চেয়ে মহৎ সিকোয়েন্স বাংলা চলচ্চিত্রে বুঝি আর হয় নি। সত্যি বলতে কী এই বিস্ফোরণের জন্য আমরা সচরাচর প্রস্তুত থাকি না। কিন্তু সেখানেই তো ছবি শেষ হয় না। শেষ দৃশ্যে নীতার মতই একটি মেয়ে ব্যাগ কাঁধে করে হেঁটে যায় প্রথম দৃশ্যের মত। এই মেয়েটিরও পায়ের চটি ছিঁড়ে যায়। এই মেয়েটিও ক্ষণিক থমকে দাঁড়ায়। তারপর চলতে থাকে। অর্থাৎ ঋত্বিক নীতার গল্পকে, একটি পরিবারের গল্পকে, একটি মেয়ের জীবনসংগ্রামকে আরও এরকম অনেক সংগ্রামী মেয়েদের আর্কিটাইপের মধ্যে এনে মুক্তি দিলেন।
ঋত্বিকের পরের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি কোমল গান্ধারকে আবার একেবারেই গ্রহণ করেন নি দর্শক ও সমালোচকরা। আসলে কোমলগান্ধার ছিল সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ছবি । এখানে ঋত্বিক অনেকগুলি বিভাজনকে ধরেছিলেন-- নায়িকা অনসূয়ার মনের দ্বন্দ্ব, দুই বাংলার বিভাজন, আই পি টি এর বিভাজন। অনসূয়ার মধ্যে কালিদাসের শকুন্তলার অভিক্ষেপ একেবারে সচেতন সিদ্ধান্ত। তাই ভৃগু প্রতিবাদী মিছিলে হেঁটে যাওয়া মানুষদের দেখিয়ে অনসূয়াকে বলে , ধরে নাও এই কলকাতাই তোমার তপোবন আর ওই পথশিশুটি সেই তপোবনের হরিণশাবক। শিশুটি সত্যিই অনসূয়ার আঁচলের প্রান্ত টেনে ধরে। লালগোলায় বাংলাদেশ সীমান্তে বাফার জোনের বিয়োগ চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ভৃগু আর অনসূয়া। কিন্তু গোটা ছবি জুড়ে মিলনের প্রতীক হিসেবে ঋত্বিক বাজিয়ে যান বাংলার বিয়ের গান । ছবির শুরু থেকেই আমরা শুনতে পাই সেই গান—‘ আমের তলায় ঝামুরঝুমুর কলাতলায় বিয়া/ আইলেনগো সোন্দরীর জামাই মটুক মাথায় দিয়া/ মিস্ত্রী বাজাইছে পিঁড়ি চাইর কোনা তুলিয়া/ ব্রাহ্মণে চিত্রাইছে পিঁড়ি মধ্যে সোনা দিয়া/ আইজ হইবো সীতার বিয়া। “ বিভাজনের বিরুদ্ধে জেগে থাকে মিলনের সুর , বিবাহের সুর।
এর পর ঋত্বিকের যে ছবিটি মুক্তি পায় সেটি সুবর্ণরেখা। এই ছবিতেও সেই পৌরাণিক দ্যোতনা। সীতা, অভিরাম, ঈশ্বর , হরপ্রসাদ—নামগুলির মধ্যেই সেটা আছে। দেশভাগের পর আসা উদবাস্তুরা নবজীবন কলোনি গড়ে তুলছে। তাদের জীবনসংগ্রাম থেকে সরে এসে ধনী অবাঙালি বন্ধুর ব্যবসায় চাকরি নিয়ে ঈশ্বর তার বোন সীতা আর অনাথ বাগদী ঘরের অভিরামকে নিয়ে চলে যায়। ঈশ্বর নিজের জীবনের উন্নতি করে কিন্তু ক্রমে ক্রমে আধিপত্যকামী হয়ে ওঠে। সীতা আর অভিরাম বড় হয়ে ওঠার পর তাদের প্রেম অগ্রাহ্য করে , এমনকি সীতার মৃত্যুকামনা করে। সীতা অভিরামের সঙ্গে পালিয়ে যায়। দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে অভিরামের মৃত্যু হয় । এদিকে ঈশ্বর আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। ঈশ্বরের সঙ্গে হরপ্রসাদের দেখা হয়। সেও এক পরাজিত সত্তা। দুজনে মিলে বীভৎস মজার খোঁজে কলকাতায় আসে। রেসের মাঠে, পানশালায় ঘুরে বেড়ায়।ঈশ্বর -- নষ্ট আত্মা ঈশ্বর দেহসুখের খোঁজে বেশ্যাসংসর্গ করতে গিয়ে যেখানে পৌঁছায় সেটা তার বোন সীতার ঘর। সীতা বঁটি দিয়ে আত্নহত্যা করে। ঈশ্বরের পতন চূড়ান্ত হয় ।কিন্তু ঋত্বিক এই নৈরাশ্যের মধ্যে তার আখ্যান শেষ করেন নি। এখানে শেষ দৃশ্যে ঈশ্বর সীতার ছেলে অর্থাৎ তার ভাগ্নের হাত ধরে ‘নতুন বাড়ির’ সন্ধানে পথ চলা শুরু করে। এই নতুন বাড়ির কথা গোটা সিনেমা জুড়েই আছে সীতার স্বপ্নে, তার ছেলের স্বপ্নে। শেষে ঈশ্বরও সেই স্বপ্নের শরিক হয়। ঋত্বিক রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন ‘ জয় হোক মানুষের, ঐ নবজাতকের,ওই চিরজীবিতের’। এত স্পষ্ট করে না বললেও আমরা বুঝতে পারি যে এই ছবি আসলে আধ্যাত্মিক ছবি অর্থাৎ এটি মানুষের আত্মার পতন ও উথ্বানপ্রচেষ্টাকে চিহ্নিত করে। কিন্তু পতনের জন্য দায়ী করে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ যেমন দেশভাগকে, পচনশীল সমাজব্যবস্থাকে।সুবর্ণরেখা ছবিতে তাই উদবাস্তু শব্দটিকে বৃহত্তর ব্যঞ্জনার মধ্যে ধরার চেষ্টা করা হয়। একজন সাংবাদিক বলে ‘আমারা কে উদবাস্তু নই ?’ হরপ্রসাদ আমাদের নিরালম্ব, বায়ূভূত বলে বর্ণনা করে। আসলে আমাদের যে সাংস্কৃতিক শিকড়হীনতা, ঐতিহ্য থেকে, আমাদের ইতিহাস থেকে—সেটাও তো আমাদের একভাবে উদবাস্তু করে তুলেছে।
এই ছবিতে আছে মাদার গডেসের আর্কিটাইপের ধ্বংসের রূপ। পরিত্যক্ত একটি এয়ারোড্রোমে যেখানে পড়ে আছে একটি ভাঙ্গা যুদ্ধবিমান সেখানে বালিকা সীতা ঘুরে ঘুরে খেলা করে। আচমকা সেখানে আবির্ভূত হয় ভয়াল কালীমূর্তি যা দেখে সীতা ভয় পেয়ে যায় । তাকে ভয়মুক্ত করে জানানো হয় যে এই মূর্তি আসলে বহুরূপী। ঋত্বিক বলেন যে ওই বালিকাটির মত আমরা আসলে এক সামূহিক ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি তার মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধর মত প্রলয়ংকর বিপদও আছে। কিন্তু ঋত্বিক বলতে চান এই ধ্বংসই শেষ কথা নয়।এই ভয়েরও শেষ আছে। এই সিকোয়েন্সটাও ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক সম্পদ।
ঋত্বিক এরপর বছর ছয় সাতের ব্যবধানে প্রায় একই সঙ্গে যে দুটি ছবির শুটিং করেন সে দুটির একটিরও মুক্তি তিনি দেখে যেতে পারেন নি । একটি ছবি ‘ যুক্তি, তক্কো,গপ্পো’ ।আরেকটি অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশে শুট করা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ভাবলে অবাক হতে হয় সম্পূর্ণ বিপরীত মেজাজের দুটি ছবিকে প্রায় একই সময়ে ঋত্বিক কীভাবে তৈরি করলেন। যুক্তি, তক্কো,গপ্পো পুরোটাই বক্তব্যধর্মী যদিও নচিকেতা,বঙ্গবালা – এই নামকরণগুলি থেকেই সেই আর্কিটাইপের ধারণা যে এখানেও ক্রিয়াশীল তা বোঝা যায়। বঙ্গবালাকে উদ্দেশ্য করে ঋত্বিকের নিজের লিপে ‘ কেন চেয়ে আছ গো মা’ গানটিও সেই কথাই বলতে চায়। কিন্তু ঋত্বিক এখানে নিজের বিভ্রান্তিকেই চিত্রিত করেন। সেটা আমাদের কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তের দিকে পৌঁছে দেয় না। কিন্তু চারপাশের অসংগতি, বিশেষত বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তিতাস একটি নদীর নাম যখন ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম প্রদর্শিত হয় তখন আমরা ঋত্বিকের হাতে নির্মিত মহাকাব্যিক ঘরানার ছবির স্বাদ পাই। তিতাস নামে নদী,তার ওপর নির্ভরশীল মালোদের জীবনযাপন, তাদের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, প্রেম বড় মমতার সঙ্গে চিত্রিত করেন ঋত্বিক। এখানে অনাথ বালক অনন্তর কাছে তার মৃতা মা দেখা দেয় দেবী ভগবতী রূপে। সবশেষে তিতাস শুকিয়ে আসে, মালোদের জীবনছন্দ বিপর্যস্ত হয়। শুকিয়ে আসা বালির চরে যখন মরণাপন্ন এই ছবির অন্যতম এক নারীচরিত্র তখন অদূরে ক্ষেতের মধ্যে ভেঁপু বাজিয়ে আনন্দ করে এক বালক। জীবনচক্র অব্যহত থাকে।
ঋত্বিকের ছবিতে ফ্রেমের মধ্যে যতটা মানুষ থাকে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বেশি থাকে প্রকৃতি।সুবর্ণরেখা আর মেঘে ঢাকা তারার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিতে প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। ঋত্বিক যেন বলতে চান মানুষের ছোটো ছোটো ইতিহাসগুলি আসলে একটা বৃহত্তর ইতিহাসের অংশ যেখানে প্রকৃতি, মানুষের বাসস্থান, তার চলার পথ সবকিছু মিলে একটা বৃহত্তর ব্যঞ্জনা আছে। ঋত্বিকের ছবিতে আলোকসম্পাত আর ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের কাজও তাই এই লক্ষ্যে চালিত হয়। আমাদের মনে পড়বে মেঘে ঢাকা তারায় নীতা আর শংকর যখন ঘরের মধ্যে ‘ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে’ গাইছে তখন ছিটেবেড়ার ফাঁক দিয়ে এমন আলোকসম্পাত করা হয় যেন মনে হয় নীতার মাথার পেছনে তারাভরা আকাশের প্রেক্ষাপট। আবার পরমূহুর্তেই মনে হয় নীতার মাথায় যেন কাঁটার মুকুট। নীতা এবং সুবর্ণরেখায় সীতাকে বিভিন্ন নির্ধারক মুহূর্তে এমনভাবে লো অ্যাঙ্গেল শটে ধরা হয় যে মনে হয় তারা কোনো বিশেষ নারী নয়, যেন দেবীত্বের আর্কিটাইপ।
ঋত্বিক যে আর্কিটাইপ নির্মাণ করেন তা শিল্পের নিজস্ব শর্ত মেনেই নিজস্ব আবছায়ার মধ্যে অধিগম্য। ঋত্বিকের মতে কার্য কারণ সূত্র অনুসরণ করে এই আর্কিটাইপ নির্মাণ করা যায় না। অনুষঙ্গ, আবার তার অনুষঙ্গ অনুসরণ করে এই আদি প্রতিমায় পৌঁছানো যায়।সেই অনুষঙ্গগুলি ঋত্বিকের ছবিতে সূত্রের মত ছড়ানো থাকে। ঋত্বিক একে স্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করেন। ঋত্বিক সেই শিল্পী যিনি বলেন শিল্পের লক্ষ্য অবাঙমানসগোচরকে শিল্পের আয়নায় ধরা। এটা অলৌকিক কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এমন একটা বিষয় যেটা শিল্পকে প্রাত্যহিকতার থেকে ওপরে নিয়ে যায় যা উপভোক্তার মধ্যেও সেই বোধ সঞ্চারিত করে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথের গান বুঝি ঋত্বিকের এত প্রিয়। আর ঋত্বিকই হচ্ছেন সেই চলচ্চিত্রকার যিনি এই উচ্চাকাঙ্খাকে ধারণ করে সিনেমা তৈরি করতেন।
ঋত্বিক ঘটক তার নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ করেছেন যেটা খুব বড় শিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়। মানুষের দুঃখ, বেদনা, দারিদ্র, অসহায়তা, অবক্ষয় --- এসব নিয়ে তিনি প্রতি মুহূর্তে বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু উত্তরণের স্বপ্ন দেখতে আর দেখাতে ভুলে যান নি । নতুন বাড়িতে যাওয়ার স্বপ্ন তার দুচোখে ছিল। সেই স্বপ্নের অর্থ এক বিকল্প পৃথিবীর স্বপ্ন। সেটাই মানুষকে চালিত করে আলোকোজ্জ্বল পথে।তিনি সারা জীবন দাঁড়িয়েছেন বিভাজনের বিরুদ্ধে, মিলনের কথা বলেছেন। দুই বাংলার মিলন বলতে তিনি রাজনৈতিক মিলনের কথা বলেন নি। জানতেন রাজনৈতিক মিলন ঐতিহাসিক কারণেই সম্ভব নয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক মিলনের কথা ভেবেছেন। হাজার বছরের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাকে একটা র্যাডক্লিফ লাইন টেনে ভাগ করা যায় না-- এটা ঋত্বিকের বিশ্বাস ছিল। এর থেকে সত্য আর কিছু হতে পারে? মানুষের আর কোনো পরিচয়?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।