এটা ঐতিহাসিক সত্য যে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রায় সকল আবিষ্কার , তত্ত্বচিন্তা এবং তার প্রায়োগিক বিস্তার—সব মিলিয়ে যা এক চলমান বিপ্লবই বলা যেতে পারে তা ঘটেছে পশ্চিমের দেশগুলিতে, শিল্পবিপ্লবের সূতিকাগারে। ধর্মতত্ত্ব এবং তার খুঁটিনাটি প্রয়োগ নিয়ে যখন বেশ কিছু দেশ ব্যস্ত ছিল তখন উপনিবেশের বিস্তারের পাশাপাশি জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় ইওরোপ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিল। যদিও ইটালির চার্চ জিওদার্নো ব্রুনোকে হত্যা এবং গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করার মধ্য দিয়ে দুটি কুৎসিত দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল, কিন্তু সাধারণভাবে এত বেশি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইওরোপ যাচ্ছিল যে চার্চের পক্ষে সম্ভব হয় নি সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আটকে রাখা। মুসলিম দুনিয়া এই বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করে অনেক দেরিতে। উনবিংশ শতাব্দী থেকে পরবর্তী শতাব্দী পর্যন্ত বেশ কিছু সংস্কারক যেমন সৈয়দ আহমদ খান, জামাল আল দীন আল আফগানি, মুহাম্মদ আবদুহ্, মুহাম্মদ ইকবাল, সাইদ নার্সি চাইলেন মুসলিমরা যেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতে এগিয়ে যেতে পারে। তাঁরা চেয়েছিলেন ইজতিহাদ ( নতুন বিষয় সম্পর্কে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উদ্যোগ)। তবে এরা কেউই পাশ্চাত্যের জড়বাদকে স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। আল আফগানির ১৮৮১ সালে ফার্সি ভাষায় লেখা বই ‘ জড়বাদীদের খণ্ডন’ যেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে বিজ্ঞানকে জড়বাদের মোড়কে হাজির করা হচ্ছে। সৈয়দ আহমদ খান চেয়েছিলেন আধুনিকতাকে ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে। এই নিয়ে অনেক তিক্ত বিতর্ক দেখা দেয় পণ্ডিতদের মধ্যেই। এর মধ্যে তুরস্কের সাইদ নার্সি (১৮৭৭-১৯৬০) চান কুরাণের অনুশাসন, আধ্যাত্মিক জীবন এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চা –সবকিছু বজায় রেখেই মুসলিমরা চলুক। কিছু পণ্ডিত, যেমন মুহাম্মদ আবদূহ (১৮৪৯-১৯০৫) নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দিয়ে কোরাণের কিছু আয়াতের ব্যখ্যা শুরু করেন। এর নাম হল তফসির ইলমি ( বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা)।
মিশরের ধর্মবেত্তা জাওয়াহারি (১৮৭০-১৯৪০) এবং একজন চিকিৎসক মুহাম্মদ আল-ইসকান্দারানি দাবি করেন যে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আগেই কোরাণে সব বৈজ্ঞানিক অন্তর্বস্তু আছে । এর নাম ই’জাজ আলমি ( কোরাণের অলৌকিক অন্তর্বস্তু)।অনেকটা ‘বেদে সব আছে’র মত ব্যাপার। কিন্তু এই মতবাদ আরব মুসলিম জগতে প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৮০ সালে ইস্কান্দারানি ‘ কোরাণে তারাজগতের রহস্যের উদ্ঘাটন নামে বই লেখেন। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘ উদ্ভিদ,খনিজ পদার্থ এবং পশুজগতের বৈশিষ্ট্যের ঐশী রহস্য’। শুধু তাই নয় জাওয়াহারি ১৯৩১ সালে বের করেন ২৬ খণ্ডে সমাপ্য এক বিশ্বকোষ যাতে তালিকা এবং চিত্র দিয়ে এই ধরণের ব্যাখ্যা কোরাণ থেকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করা হয়। বিশ্বকোষটির নাম ‘মহান কোরাণের তফসির থেকে মণিমুক্তা’। পরবর্তী ১০০ বছরে প্রকাশিত হয়েছে এই ঘরানার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে পরমাণু, জেনেটিক্স, ,কৃষ্ণগহ্বর,আলোর গতিবেগ, পৃথিবী এবং ব্রহ্মাণ্ডের বয়স, ফোন,ফ্যাক্স,ইমেল,রেডিও,টিভি—সবকিছুর কথা কোরাণের আয়াতের ঈঙ্গিতে আছে। এই প্রবণতা আরও জোর পায় ১৯৭০ সালে ফরাসি চিকিৎসক মরিস বুকাইয়ের (১৯২০-১৯৯৮) একটি গ্রন্থ ‘ The Bible, The Quran and the Science’ প্রকাশের পর। বুকাইয়ের অনেক অনুরাগী জন্ম নেন যাঁরা খ্রীস্টীয় সৃষ্টিতত্ত্বের একটা ইসলামি সংস্করণ গড়ে তোলার পাশাপাশি কোরাণের মধ্যে একই সঙ্গে ঈশ্বর ভাষ্যের প্রমাণ এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভ্রান্ততার দাবী পেশ করেন। পাকিস্তানের সেকুলারপন্থী পদার্থবিদ পারভেজ হুডভয় ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে এমন পেপারও পড়া হয় যাতে জিনের (অশরীরী আত্মা) উপাদানকে কাজে লাগিয়ে শক্তির ( energy) উৎস খোঁজার কথা বলা হয়।একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন নিধাল গেসুম কাতারে ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলন প্রসঙ্গে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ৮৬ টি পেপার পড়েন ই’জাজ (কোরাণের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে )। সেখানে জলের ওপর কোরাণ পাঠের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হয় যাতে সেই জল খেয়ে অনেক রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এক অধ্যাপকের মতে কোরাণ পাঠের ফলে জলের মধ্যে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয় যা জলের আণবিক গঠনকে পুনর্বিন্যস্ত করে তাকে ঐশী শক্তি প্রদান করে। তুরস্কজাত বিজ্ঞানী ট্যানার এডিস বা হুডভয় বিজ্ঞানের ইসলামীকরণের সমস্ত প্রচেষ্টাকেই অর্থহীন ও বিভ্রান্তিকর মনে করেন। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের একমাত্র নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম নিজেকে একজন ধার্মিক মুসলমান মনে করলেও (পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সমাজ অবশ্য আহমদিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় তাঁকে মুসলমান বলেই মানে নি ) তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে কোরাণের সম্পর্ক স্থাপন করতে যান নি। সালাম বিজ্ঞানের যে সত্যে একজন প্রবল আস্তিক হয়ে পৌঁছেছিলেন সেই একই সত্যে তাঁর সঙ্গে একই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পাওয়া নাস্তিক শেল্ডন গ্ল্যাসো এবং স্টিভেন ওয়াইনবার্গও পৌঁছেছিলেন।
একথা অনস্বীকার্য যে আজকের ইসলামি দুনিয়ায় সঠিক বৈজ্ঞানিক মনোভাব এবং যুক্তিবাদের চর্চায় ঘাটতি আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শ্লথতা এবং কূপমণ্ডুকতার পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কায়েমী শক্তির মেলবন্ধন । অথচ অতীতে সমস্ত ধর্ম,সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান থেকে শেখার মনোভাব দেখিয়েছেন ইসলামি পণ্ডিতরা। নয়তো বহুভাষাবিদ এবং গণিতজ্ঞ আল বিরুণী ভারতে আসার পর কেনই বা পতঞ্জলির যোগসূত্র আরবি ভাষায় অনুবাদ করবেন ? শুধু ভারতীয় নয়, গ্রীক দর্শনের প্রভূত চর্চার ইতিহাস আমদের এই লেখায় পূর্বোল্লিখিত মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ইসলামি সংস্কারকরা। বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলিকে তাঁদের ধর্মীয় ধারণার সঙ্গে তাঁরা মেলাতে পারছেন সেখানে তাও এক রকম, যেখানে পারছেন না সেখানে অনেক সময় বিরোধিতার জায়গায় চলে যাচ্ছেন। বিশ্বসৃষ্টির কারণ হিসেবে বিগ ব্যাং তত্ত্বকে তাঁরা গ্রহণ করেছেন কারণ সেখানে সৃষ্টি এবং সময়ের একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে (যা অ্যারিস্টটলীয় অনাদি সৃষ্টির ধারণার বিপরীত) ফলে তাকে স্রষ্টার ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়। এখন আধুনিক বিজ্ঞানের একটা মূল প্রশ্ন হল আমাদের এই বিশ্ব এভাবে হয়ে উঠল কী করে যেখানে অনেকগুলি ধ্রুবকের মান, পারমাণবিক কণাগুলির ভর, মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান একচুল এদিক ওদিক হলেই এই সৃষ্টি বা প্রাণের প্রকাশ সম্ভব হত না । এটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এসেছে ফাইন টিউনিং থিওরি যাতে ধরে নেওয়া হয় যেন একজন স্রষ্টা সমস্ত কিছুকে নিঁখুত ছন্দে বেঁধেছেন। খ্রিস্টান সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা ( Creationist) এই তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরেন। মুসলিম সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরাও পেছিয়ে থাকবেন কেন ? একসময় তুরস্কের হারুণ ইয়াহিয়া কোরাণ ও সৃষ্টিতত্ত্বের প্রচারে সাড়া ফেলে দিয়ে কাল্ট স্ট্যাটাস লাভ করেছিলেন যদিও আর্থিক এবং যৌন অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ৮৬৫৮ বছরের কারাদণ্ড হওয়ায় তিনি এখন জেলে। বিজ্ঞান কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রকৃতিতে শুধু নিয়ম আর শৃঙ্খলা আছে এমন নয়, আপতিকতা আর নৈরাজ্যও আছে যথেষ্ট পরিমাণে।সেসবের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে , মাল্টি ভার্স থিয়োরি আর অ্যান্থ্রোপিক প্রিন্সিপলের সাহায্যে স্রষ্টা নিরপেক্ষভাবে সৃষ্টির কল্পনা করা যাচ্ছে সহজেই।যদিও এসব ব্যাপারে শেষ কথা বলা যায় না কখনই। কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্ব মানি আর আনা মানি , বিজ্ঞান আর ধর্মের উদ্দেশ্যর পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার। কারণ মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য, তার চরিতার্থতা—এসবের উত্তর খোঁজার জন্য মানুষ ধর্মের কাছে যায়। এমনকী স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে উদাসীন হয়েও সেটা যে সম্ভব বৌদ্ধ আর জৈন ধর্ম সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। মুশকিল হল সব মতামতকে খোলা মনে বিবেচনার মধ্যে আনার চেষ্টা থাকছে কিনা।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রসঙ্গ এলেই ইসলামি দুনিয়া তার বিরোধিতা করেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অনেক মুসলিম দেশে বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় না অথবা পড়ালেও সেটিকে একটি অপ্রমাণিত ,ভ্রান্ত তত্ত্ব হিসেবে পড়ানো হয়। আবার ইরানে উঁচু ক্লাসের পাঠ্যক্রমে পশু পাখিদের জগতে বিবর্তনবাদ পড়ালেও মানুষের ক্ষেত্রে তা নিশ্চুপ থাকে। ঈশ্বর সরাসরি মানুষকে তৈরি করেছেন এই ধারণার সঙ্গে বিবর্তনবাদকে মেলানো একটু কঠিন হয়ে পড়ে। সম্প্রতি সৌদি পণ্ডিত ডেভিড সলোমন জালাজেল বলছেন ,যে ঈশ্বর শুধু আদম ও তার স্ত্রীকে সরাসরি তৈরি করেছিলেন । আদমের উচ্চতা বাকি মানুষদের মত নয়, ষাট কিউবিট বা নব্বই ফিট। বাকি মানুষদের ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদ প্রযোজ্য। তবে আরো সুক্ষ্মভাবে মেলানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য , সিরিয়ার দার্শনিক পণ্ডিত মুহাম্মদ শাহরুরের ব্যখ্যা। শারজা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলজিরিয়াজাত পদার্থবিদ নিধাল গেসুম তাঁর ২০১০ সালে প্রকাশিত বইতে একটি দীর্ঘ অধ্যায়ে বিবর্তনবাদ যে সম্পূর্ণ সঠিক সেটা সহজে বুঝিয়ে দিয়েছেন। হারুণ ইয়াহিয়ার মত ক্রিয়েশনিস্টরা যে বিবর্তনবাদকে ভালো মত না জেনেই তার সমালোচনা করেন সেটা গেসুম দেখিয়ে দিয়েছেন। শাহরুরের ব্যতিক্রমী বক্তব্যের দিকেও নিধামই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এখানে নিধামের বই থেকেই সেই বক্তব্য আমরা তুলে দিলাম।
শাহরুরের মতে ইনসান (যার মানে মানুষ) এবং বাশার (মানব প্রজাতি )—এই দুটির মধ্যে অর্থের পার্থক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। কোরাণে আদমের সৃষ্টি প্রসঙ্গে যতবারই ইনসান শব্দটি এসেছে ততবারই বুদ্ধি, বোধ এবং বিমূর্ত ধারণা করার ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বোঝানো হয়েছে। উল্টোদিকে ‘বাশার’ শব্দটি শুধু মানুষের সৃষ্টি প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে বৌদ্ধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ইনসান’ হয়ে ওঠার আগের পর্যায় পর্যন্ত। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় হোমিনিড পর্যায়কে ‘বাশার’ এবং ‘হোমো ‘ পর্যায়কে ইনসান ধরে শাহরুর এগোতে চাইছেন। কোরাণের ৩৮ নং সুরার ৭১ এবং ৭২ নং আয়াতে আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে সুঠাম করে নেওয়া এবং তার মধ্যে মহান ভাবের সঞ্চারের কথা বলা হয়েছে। শাহরুর এই আয়াতে আরবি শব্দ জা’আলা ( তৈরি করা) এবং খালাকা(সৃষ্টি করা ) –এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদের দিকেও নজর রেখেছেন।শাহরুর অনেকগুলি আয়াত ব্যাখ্যা করার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আদমের আগেও মানবসদৃশ বহু প্রজাতি ছিল। আল্লাহ তাদের মধ্য থেকে আদমকে বেছে নিয়ে তার মধ্যে মহান ভাবের সঞ্চার ঘটান। এই পরবর্তী ক্রিয়ার মধ্যেই প্রাণিকুলের থেকে মানব প্রজাতির উল্লম্ফনকে চিহ্নিত করা যায়। সেই মানব প্রজাতিই ধীরে ধীরে নৈতিক, নান্দনিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অনেক জটিল ধারণার জন্ম দিয়েছে। যদি বানর প্রজাতিকে একটি বিরাট বটগাছের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে কোটি বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার একটি ঝুরি (একটি টাইপ) থেকে মানব প্রজাতির উদ্ভবকে আর অবিশ্বাস করার যুক্তি খুঁজতে হয় না।
বিবর্তনবাদ নিয়ে এত কথা বললাম যে আধুনিক ইসলামি পণ্ডিতদের মধ্যেও এই তত্ত্ব নিয়েই সবচেয়ে বিরোধিতা আছে এবং এই নিয়ে বিরোধিতার জন্য তাঁরা যে যুক্তি ব্যবহার করেন তা খ্রীস্টান ক্রিয়েশনিস্টদের থেকে ধার করা। অথচ গেসুম দেখিয়েছেন যে ডারউইনের তত্ত্ব যখন প্রথম প্রসিদ্ধি পায় তখন আরব দুনিয়ায় যে তা আলাদা করে কোনো বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল এমনটা নয়। অনেকেই তা নিয়ে ধর্মীয় প্রসঙ্গ না টেনেই আলোচনা করেছিলেন।আসলে আধুনিক ইসলামি দুনিয়ার ধর্মীয় ব্যাখ্যার অনেকখানিই নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রশক্তি এবং রাজনৈতিক ইসলাম এবং মোল্লাতন্ত্রের জোট। অথচ আধুনিক বিশ্বের বহু সমস্যা রয়েছে যেগুলির ক্ষেত্রে সরাসরি ধর্মগ্রন্থকে টেনে আনার দরকার নেই। ধর্মগ্রন্থের মূল ভাব অর্থাৎ সাম্য, ন্যায় এবং মনুষ্যত্বের বিকাশকে সামনে রেখে যুগোপযোগী অবস্থান নেওয়া যেতে পারে। গেসুম স্টেফানো বিগলিয়ার্দির সঙ্গে সম্পাদিত গ্রন্থে এরকম বেশ কটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন—যেমন সারোগেসি , অঙ্গদান, নিস্কৃতিমৃত্যু,ক্লোনিং, তৃতীয় লিঙ্গর মান্যতাদান ,কৃত্রিম মেধা ইত্যাদি। অন্যান্য বিষয়েও চিন্তা এবং যুক্তির মাধ্যমে (যার ওপর কোরাণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ) মতামত নির্ধারণ করা প্রয়োজন। একদল গোঁড়া মৌলবাদী যেমন বলেন ইসলামে জাতীয়তাবাদ নাকি হারাম। অথচ চোখের সামনে তাদের আরাধ্য দেশ সৌদি আরবও জাতীয়তাবাদী গৌরবে যুদ্ধ করে বা ইয়েমেনে মুসলিমদের ওপর বোমা ফেলে। আসলে ইসলামের উদ্ভবের সময় জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবই হয় নি একথা মনে রাখতে হবে। একথা ঠিক উগ্র জাতীয়তাবাদ খুব খারাপ হতে পারে, কিন্তু দেশপ্রেম সব সময়ই ভালো এবং যখন তা উপনিবেশ বা নয়া উপনিবেশের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে লড়াই করে তখন তা বরণীয়। আবার এই লড়াইকে ন্যায়, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ হিসেবে দেখলে তা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাযুজ্যপূর্ণ। আবার কিছু মৌলবাদী আছেন যাঁরা আধুনিক সেকুলার ও নাস্তিকদের ওপর খড়গহস্ত হয়ে থাকেন।কোরাণে কিন্তু নাস্তিকদের সঙ্গে মতভেদ থাকলেও কোনো হিংসা বা বিদ্বেষের কথা নেই। আসলে আধুনিক পৃথিবীতে সকলের সহাবস্থানেই যে চলতে হবে একথা সকলকেই মেনে নিতে হবে। এখানে আমরা সাহিত্য ও শিল্পের থেকে উদাহরণ টেনে একটা কথা বলি। পাশ্চাত্যের অনেক সাহিত্য বা সিনেমা আছে যেগুলি শৈল্পিক উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার হলেও আমরা ঠিক নিতে পারি না, সাংস্কৃতিক দূরত্বের কারণে। তাতে আমরা খারাপ হয়ে যাই না বা ঐ শিল্পকর্মটিকেও খারাপ বলে বাতিল করার ফতোয়া দিতে পারি না।আমাদের জগৎটাও সত্য আবার পাশ্চাত্যের জগতটাও তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস অনুযায়ী সত্য।
গোঁড়া ইসলামি সমাজে অনেক সেকুলার মানুষ কিছুটা হতাশা বা বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন।সবাই পাশ্চাত্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেকুলার হবেন না, সাংস্কৃতিক কারণেই তা সম্ভব নয় এটা আমাদের বুঝতে হবে। বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে, যুক্তিবাদ এবং আবেগের মধ্যে কিছুটা সমন্বয় এবং যেখানে সেই সমন্বয় সম্ভব নয় সেখানে তাদের নিজস্ব স্বাধীন ক্ষেত্র সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার। আবার আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সকলের ধর্মপালনের অধিকারকে স্বীকার করে এরকম সেকুলার ব্যবস্থাই যে তুলনামূলক বিচারে ন্যায় ও ধর্মসঙ্গত সেটা হিন্দু মুসলিম সকলকেই বুঝতে হবে। এমন নয় যে মুসলিমরা আধুনিক সেকুলার ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে পারেন না। পৃথিবীতে ৪৯ টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মধ্যে ২১ টি দেশ পুরোপুরি সেকুলার। উইকিপিডিয়ার এই ২১ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের মত মডারেট ইসলামিক দেশকেও ( সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঢোকানো আছে) ধরা হয় নি। সেকুলার দেশের মধ্যে ৯৭ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আজারবাইজানও আছে যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামির চিহ্নমাত্র নেই। এই সমস্ত বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই আমাদের যুক্তিবোধের প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ধর্ম আমাদের সে ব্যাপারে উৎসাহিত করলেও ধর্মের সমস্ত মানেবই যারা নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী তৈরি করে সেই ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষকে কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হবার সুযোগ দেবে কি ?
তথ্যসূত্রঃ
(১) কোরআন শরীফ, হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ, আল কোরআন একাডেমি লণ্ডন। এই নিবন্ধে ব্যবহৃত সমস্ত আয়াতই এই বইয়ের থেকে নেওয়া।
(২) Islam and Science: Past, Present and Future Debates, Nidhal Guessoum and Stefano Bigliardi, Cambridge University Press, 2023
(3) Islam’s Quantum Question : Reconciling Muslim Tradition and Modern Science , Publisher : I B Tauris, 2012.
(4) An Illusion of Harmony, Taner Hadis , Prometheus Books, New York, 2007.
(5) Major Themes of the Qur’an, Fazlur Rahman ,University of Chicago, year of publishing not mentioned.
(6) Can Science Dispense with Religion ? Edited by Mehdi Golshani, Institute for Humanities and Cultural Studies, Tehran, 1998.
(7) Revival and Reform Iin Islam, Fazlur Rahman, Oneworld, Oxford, 2000.
(8) Rethinking Islam, Common Questions, Uncommon Answers, Mohammad Arkoun, Routledge, 1994.