স্বাধীনতা দিবস আসন্ন। সেই উপলক্ষে প্রথাগত কিছু লেখালিখি, আলাপ-আলোচনা প্রতি বছরের রীতি। তবু মহাবিদ্রোহের বেশ কিছু বিষয় বহু যুগ পরেও অনালোকিত রয়ে যায়। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কাহিনী সবার জানা। কিন্তু চট্টগ্রাম কালেক্টরেটের কোষাগার লুট করে জেল ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করে পার্বত্য রাজ্য জয়ন্তিয়ার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং মাঝপথে অসমের করিমগঞ্জ জেলার লাতুতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ -- আজ ক'জন মনে রেখেছে? অথচ এই ঘটনার অভিঘাতে রচিত হয়েছে 'জঙ্গিয়ার গীত'। যে পল্লীগীতির পটভূমি চট্টগ্রাম থেকে সুরমা-বরাক উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ... ...
বছর কয়েক আগে এমনই এক শীতের মরসুমে পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোট থেকে ফিরে এসে উপলব্ধি করেছিলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত কেন লিখেছিলেন, "মণিহারা ফণি তুমি রয়েছ আঁধারে।" দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক দশকও হয়নি। টেলিফোন, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়ার এই তাৎক্ষণিক দুনিয়ায় বসে কল্পনা করাও কঠিন সে সময়ের পরিস্থিতি। পরিবেশ এবং হেরিটেজ-সংরক্ষণ, জনজাতির জীবিকা ও ঐতিহ্য রক্ষার মতো বিষয়গুলি জনপরিসরের চর্চায় তখন উঠে আসেনি। সংবাদমাধ্যমের এই নজরদারিও তখন ছিল না। সেই কারণেই উত্তরকাশী জেলায় চারধাম মহাসড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ ধস বা তারও আগের বছরগুলিতে উত্তরাখন্ডে ক্রমাগত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে যে আশঙ্কা ও শোরগোল তৈরি হয়েছে তার ছিঁটেফোঁটাও ছিল না যখন এই তথাকথিত উন্নয়নের দাপটেই আমাদের এই বাংলার পুরুলিয়াতেই কার্যত নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল এক প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক সব নিদর্শন। উন্নয়নের অজুহাতে আধুনিক ভারত তার পুরাতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সম্পদ যে ভাবে ধ্বংস করেছে বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত তেমন নজির নেই। পাঞ্চেত বাঁধ দেখলে তার সীমাহীন মাসুলের কাহিনীও যেন আমাদের মনে পড়ে। পাঞ্চেতের ঘটনা যে দেশের রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মোটেই লজ্জিত করেনি তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরও একটি বাঁধ নির্মাণে। দামোদরের পরে সুবর্ণরেখা। পাঞ্চেতের ৫০ বছরের মধ্যেই তৈরি হল চান্ডিল বাঁধ। সেক্ষেত্রে অধুনা ঝাড়খন্ডের পাতকুমেও আরও বহু জনপদ এবং জৈন মন্দির ঠিক একই ভাবে জলের তলায় চলে গেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, স্বাধীনতার পর থেকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, পরিবেশের বিরুদ্ধে তথাকথিত উন্নয়নযজ্ঞের এই ধ্বংসলীলা কিন্তু একই ভাবে অব্যাহত রয়েছে। ... ...
একজন ১৮৬৮ থেকে ১৯০৪। অন্যজন ১৯৮০ থেকে ২০১৬। প্রথমজন পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ প্রভুদের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। দ্বিতীয়জন স্বাধীনতার তিন দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরের পর্বের আই এ এস। দুজনেই প্রশাসনিক কাজে যুক্ত ছিলেন ৩৬ বছর ধরে। বিচক্ষণতা, দক্ষতা এবং দরদী ও অনুভূতিসম্পন্ন অন্তরের স্নিগ্ধতায় পেয়েছেন সাধারণ মানুষের উজাড় করা ভালোবাসা। কায়েমী স্বার্থের সংঘাত অগ্রাহ্য করে বিবাদ-বিসম্বাদ মেটানো থেকে শুরু করে দুর্নীতি রোধ, উন্নয়ন সহ বিবিধ কর্মকান্ডের জটিল দায়িত্বের প্রাত্যহিকতা সামলে দুজনেই সৃজনশীল সাহিত্যসেবী। দুজনেই কবিতা ও গদ্যে সমান স্বচ্ছন্দ। দুজনেই প্রকৃতিপ্রেমী বঙ্গসন্তান। প্রথমজন মাইকেল মধুসূদনের থেকে ২৩ বছরের এবং তাঁরই সমসাময়িক আর এক কবি ও হাকিম রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক ২০ বছরের কনিষ্ঠ নবীনচন্দ্র সেন। 'রৈবতক', 'কুরুক্ষেত্র', 'পলাশীর যুদ্ধ', 'রঙ্গমতী' রচনা করে যিনি জনপ্রিয় এবং ইংরেজ আমলে বাঙালি কবিদের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম গদ্যে লেখেন আত্মজীবনী, 'আমার জীবন'। প্রথমজনের সঙ্গে দ্বিতীয়জনের ব্যবধান শতাধিক বছরের। দ্বিতীয়জন একালের সুপরিচিত লেখিকা অনিতা অগ্নিহোত্রী যাঁর প্রশাসনিক জীবনে "মানুষের আঙিনায় বসে দেখা রাষ্ট্রের রূপ" প্রকাশ পেয়েছে 'রোদ বাতাসের পথ' বইটিতে। এই দুটি বই পাশাপাশি পড়লে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। স্থান-কালের ব্যবধান যাই থাকুক না কেন, দেশ পরাধীন বা স্বাধীন যাই হোক না কেন, দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু বিষয় তেমন বদলায়নি। ... ...
মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গার্সেটি এই সেদিন কলকাতা এসে ঘুরে গেলেন। আসার আগে দিল্লির বঙ্গভবনে গিয়ে তিনি মোচার চপ, মাছের ঝোল খেলেন। কলকাতায় এসে হলুদ ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন, রাস্তার পাশে ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিলেন। অলি-গলিতে হেঁটে বেড়ালেন। বিবিধ সংস্কৃতির পীঠস্থান লস এঞ্জেলেস শহর। গার্সেটি আগে ছিলেন সেখানকার মেয়র। দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের দায়িত্ব নেবার পরে বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার রান্নার বৈশিষ্ট্য, বাংলার মন বুঝতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টায় বোধ হয় একটা ফাঁক থেকে গেল। মল কালচার, দেশি-বিদেশি রেস্তোঁরা, ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আর বিলীয়মান ঘরোয়া রান্নার এই যুগে আমেরিকান সাহেব দুপুরের আহারটা কলকাতার কোন একটি পাইস হোটেলে সারলেই পারতেন। কারণ, এই পাইস হোটেলগুলিই কলকাতার আসল হেরিটেজ ইটারি। মেনুতে থাকত সদ্য ধোয়া কলাপাতার ওপরে লেবু-লঙ্কা সহ ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সুক্তো, পাঁচফোড়ন দেওয়া পাতলা মসুরির ডাল, কুমড়ো ফুলের বড়া আলু-পোস্ত এবং আলু-পেঁপে-কাঁচকলা সহ মাছের কবিরাজি ঝোল, হাঁসের ডিমের ডালনা, আলুর বড় টুকরো দিয়ে কচি পাঁঠার ঝোল এবং কাঁচা আমের চাটনি। সঙ্গে রাখা যেত মাটির খুড়িতে মিষ্টি দই, একটা নরম পাকের সন্দেশ ও রসগোল্লা। বেরিয়ে আসার সময় একটা মিঠে পাতার পান। বাঙালির ইটিং আউটের প্রায় শতবর্ষের বিবর্তনের সঙ্গে জড়িত এই রাজ্যের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, পারিবারিক আচার, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং ব্যবসার বর্তমান হাল হকিকতের একটা পরিষ্কার চালচিত্র তাহলে তিনি পেয়ে যেতেন। তিনি আরও উপলব্ধি করতেন, এই সব পাইস হোটেলে একটা সময় সাধারণ মানুষ মাত্র এক পয়সার বিনিময়ে ঠিক বাড়ির মতো রান্না খেয়ে পেট ভরাতেন। কলকাতার আসল বাঙালিয়ানার হদিস পেতে হলে এই পাইস হোটেলগুলিতেই আসতে হবে। বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির ইতিহাসে পাইস হোটেলের হেরিটেজ কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। সেখানে বসে সাবেকি রান্নার আস্বাদ গ্রহণ তারিয়ে তারিয়ে ভিনটেজ ওয়াইন উপভোগ করার মতোই অতুলনীয়। ... ...
শনিবার সকালে কলকাতার একটি ইংরেজি কাগজের ভাঁজ খুলতেই পাতাজোড়া রঙিন ঝকঝকে বিজ্ঞাপন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। উত্তরবঙ্গের অরণ্যময় ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতে উচ্চবিত্ত শহুরে নাগরিকদের ভোগবাদকে উস্কে দিতে ২০ একর জমিতে বিলাসবহুল আবাসন তৈরি হচ্ছে। দুপুরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের অনলাইন এডিশনে দেখলাম, ফরিদাবাদের বনভূমিতে বন কেটে বসত তৈরির উদ্যোগ নেওয়ায় ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এন জি টি) সেই রিয়ালটারকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। অসাধু ব্যবসায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাঁচ একর জমিতে অন্তত ৫০০ গাছ কেটে ফেলেছে। প্রতিটি গাছ কাটার জরিমানা দু' লাখ টাকা। ফরিদাবাদের ঘটনায় এন জি টি-র নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে স্মরণ করা যেতে পারে, প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে প্রকৃতি সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রচার করা হয়েছিল। সনাতন হিন্দু ধর্মে বৃক্ষ ও প্রকৃতি বন্দনার প্রশস্তির প্রকৃত লক্ষ্য হল, মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা গাছ রক্ষা করা তাঁদের আবশ্যিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন। আর সে কারণেই প্রতিটি গাছের প্রতি তাঁরা আরোপ করতেন ধর্মীয় পবিত্রতা। তাই সমাজে খুব সহজেই গাছ হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় আরাধনার বস্তু। এর দৃষ্টান্ত রয়েছে লোকাচারেও। নগরায়ণের বেপরোয়া দাপটে বোঝা যায়, প্রকৃতিকে লালন করার যে সহজাত নীতিবোধ অতীতে ছিল তা থেকে বর্তমান সমাজ পুরোপুরি বিচ্যুত। ... ...
পুজোর উৎসবের আতিশয্যে ভুলে না যাই, আজ গান্ধী জয়ন্তী। আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারাবার পরে গান্ধীজির প্রথম জন্মদিনটি পালিত হয়েছিল স্মরণে। আজ এত দশক বাদে জনচেতনার পরিসরে গান্ধী কি ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন? সরকারি-বেসরকারি সংবাদমাধ্যমে গান্ধী-চর্চা কি তেমনভাবে কোথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে? খবরের কাগজে চোখে পড়ল, কেন্দ্রীয় সরকারি তরফে গান্ধী এবং সঙ্গত কারণেই লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন মারফত শ্রদ্ধা নিবেদন। রয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠান 'প্রত্যহিকী'তে দিনটির বিশেষ তাৎপর্যের উল্লেখ, 'মৈত্রী' প্রচারতরঙ্গে 'সুচিন্তন' অনুষ্ঠানে গান্ধিবাণী এবং 'সঞ্চয়িতা' প্রচারতরঙ্গে রিলে করা হয়েছে দিল্লির হিন্দি অনুষ্ঠান। ওই পর্যন্ত। ইঙ্গিত স্পষ্ট, অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় গান্ধী আজ কার্যত ফিকে। ... ...
১৯৪৭ সালের ১৩ অক্টোবর সোমবার ছিল মহালয়া আর ২১ তারিখ মঙ্গলবার ছিল মহাসপ্তমী। দেশ যখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, সমাজে যখন পারস্পরিক অবিশ্বাস আর বিভেদের রেশ, সেই মুহূর্তে উৎসবের সুর কেমন ছিল এই কৌতূহল তো স্বাভাবিক। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও যখন নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে থেকেই মাথাচাড়া দেয় তখন আমরা দেখি, পারস্পরিক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজি নজরুল ইসলামের কলমে ফুটে উঠেছে দুর্গা-বন্দনা। নজরুল-রচিত অনেক শ্যামাসঙ্গীত সুপরিচিত। কিন্তু আগমনীর আগমনে ১৯৪২ সালে নজরুলের লেখা গান ততটা পরিচিত নয়। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্র থেকে সেই বছর সপ্তমীর দিন সকাল সওয়া সাতটায় 'আগমনী' অনুষ্ঠানে সে যুগে ভক্তিগীতির জনপ্রিয় শিল্পী মৃনালকান্তি ঘোষের কণ্ঠে সম্প্রচারিত হয়েছিল এই নজরুলগীতি। স্বাধীনতা লাভের বছরে পুজোর সূচনায় যে গানটি বাজানোর জন্যে রেডিও চয়ন করেছিল আজ সকলের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির ভাব গড়ে তুলতে মন্ডপে মন্ডপে আবার বেজে উঠুক নজরুলের সেই বিখ্যাত গান। ... ...
১৯৩৪ সালে উপন্যাসের শুরুতেই নায়কের ভূমিকায় 'বঙ্গ ব্যায়ামাগারে'র প্রতিষ্ঠাতা আলোকনাথ সেনের চরিত্র অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। "পায়ের ধূলো" নামে উপন্যাসটি লিখেছিলেন "আবার যকের ধন"-খ্যাত হেমেন্দ্র কুমার রায়। বার্মিংহামে সদ্য কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়ন অচিন্ত্য শিউলি, তাঁর দাদা অলোক বা আট বছর আগে গ্লাসগো কমনওয়েলথে আর এক সোনাজয়ী সুখেন দে-র রোমাঞ্চকর কাহিনীর সূত্রেই আজ থেকে ৮৮ বছর আগে লেখা হেমেন রায়ের এই রচনার কথা মনে পড়ে যায়। উপন্যাসের নায়ক আলোকনাথের মতো চরিত্র কিন্তু মোটেও কাল্পনিক নয়। বাংলা ও বাঙালির অবক্ষয় এখন সর্বস্তরে। তবু তারই মধ্যে কেউ কেউ নেহাত ব্যতিক্রম হিসেবে নিজের উদ্যমে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অচিন্ত্য বা সুখেনের মতো দেশের পতাকা সবার উঁচুতে তুলে ধরে প্রচারের আলোয় উঠে আসেন। আমাদের তখন স্মরণ করা দরকার, একদা বাংলার ঘরে ঘরে দেশ বিদেশ কাঁপিয়ে দেওয়া এমন পালোয়ানের কোনও অভাব ছিল না। সাহসে, বীর্য্যে, সহ্য ক্ষমতায় ও আত্মরক্ষার শক্তিতে বাঙালি যুবকদের বাহুবলে বলীয়ান করে তুলতে পাড়ায় পাড়ায় তখন 'বঙ্গ ব্যায়ামাগারে'র মতো জিমন্যাস্টিক ও কুস্তির আখড়া গড়ে উঠেছিল। বাংলা তার শরীরচর্চার সেই ধারাটি বজায় রাখতে পারলে এবং সেই সব ব্যায়ামাগার থাকলে হাওড়ার অষ্টম দাসকে আর মরচে ধরা সরঞ্জাম নিয়ে গাছতলায় অচিন্ত্যের মতো যুবকদের অনুশীলন করাতে হত না। আর কীর্তিমান সেই পালোয়ানদের যোগ্য উত্তরসূরিরা থাকলে এশিয়াড, কমনওয়েলথ বা অলিম্পিকসে সোনার মেডেলের ভিড়ে বাংলার সিন্দুক ভরে উঠত। সেকালের শৃঙ্খলা, নীতিবোধ, দেশপ্রেম আর সাহস থাকলে আজকের সমাজও এমন মূল্যবোধহীন দুর্নীতির পাঁকে ডুবে যেত না। ... ...
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ১০০ দিন ছাড়াল। যুদ্ধাবসানে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা ক্ষীণ। ইউক্রেনের সেনানী ইউরোপে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউক্রেনকে আর ফ্রান্স পাঠাতে শুরু করেছে স্বয়ংক্রিয় সিজার হাউইৎজার কামান। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনকে পশ্চিমি সামরিক সাহায্য আগুনে ঘি ঢালছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। কিন্তু যাবতীয় অশান্তি এবং বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা ছড়ানোর মুলে তো গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আচমকা রুশ আগ্রাসন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত কলকাতা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পথে নামেনি। যদি নামত তাহলে রোজকার চায়ের সঙ্গে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে, গোপালদার চায়ের দোকানের ঠেকে বা বাড়ির বৈঠকখানায় বসে নিরীহ মারি বিস্কুট চিবানো বোধহয় সহজ হত না। তখন হয়ত রুশ দূতাবাসের সামনে জনতার বিক্ষোভে স্লোগান উঠত "বয়কট মারি বিস্কুট।" সাদামাঠা মারি বিস্কুটের সঙ্গেই যে জড়িয়ে রয়েছে রুশ রাজকীয় দম্ভের ইতিহাস! ... ...
মুসলিমদের আজান এসেছে বেদুইনদের সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে। সেই ১৯৫০-৬০ এর দশকে জর্ডনের মরু অঞ্চলে বেদুইনদের রহস্যময় জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার সূত্রে এবং বেদুইনদের গান-বাজনা শোনা ও রেকর্ড করার পর সঙ্গীত- সংগ্রাহক দেবেন ভট্টাচার্যের এমনটিই মনে হয়েছিল। ঈদের আগে রমজান মাসের এক সকালে এমন এক উপলব্ধির কথা জানতে পেরে বেশ চমকিত হলাম। বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা আলি জাকেরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গের অবতারণা। জাকেরও বলেছিলেন, আজানের সুরের ভিত্তি আহির ভৈরবী। সেই সময় দেবেন ভট্টাচার্যের রেকর্ড করা বেদুইন সঙ্গীতের একটি অংশ পেলাম ইন্টারনেট আর্কাইভে। সেটি শুনলে ভ্রম হয় যেন আজানের ধ্বনি। ১৯৫৫ সালের গ্রীষ্মে বিবিসির-র এক কমিশনড প্রোগ্রামে ইউরোপ থেকে প্রায় লঝ্ঝড়ে একটি মিল্কভ্যানে এক বাঙালি যুবক যুগোস্লাভিয়া, গ্রিস, ইতালি, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডন, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে ১২ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছ' মাস বাদে ভারতে আসেন বিভিন্ন দেশের গান রেকর্ড করতে করতে। সঙ্গী ছিলেন আর্কিটেকচারের ইংরেজ ছাত্র কলিন গ্লেনি আর ফরাসি সাংবাদিক হেনরি অ্যানভিল। দেবেনের রেকর্ডিংয়ের বিচিত্র সম্ভারের কিছু নমুনা শুনলেই বোঝা যায়, জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি সারা বিশ্বের খ্যাত-অখ্যাত শহর, গ্রাম, পাহাড় বা মরুপ্রান্তরে কাটিয়েছেন। এভাবেই আন্তর্জাতিক স্তরে দেবেনের পরিচিতি গড়ে ওঠে এথনোমিউজিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে। বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ সঙ্গীতের অপূর্ব ঐতিহ্যের হদিস প্রকৃতপক্ষে দেবেনই প্রথম দুনিয়ার মানুষকে দিয়েছিলেন। তার আগে নানা দেশের লোকসঙ্গীতের সমৃদ্ধ ভান্ডারের অস্তিত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে কার্যত কোন ধারণাই ছিল না। যাঁকে নিয়ে আজও সমান ভাবে গর্ব করার কথা আমাদের দুই বাংলার মানুষেরই, ভাবতে অবাক লাগে এমন এক আশ্চর্য বাঙালিকে নিয়ে হাল আমলে কোন চর্চা নেই। ... ...