বিভিন্ন দেশের সুর রেকর্ড করার সময় দেবেন বিশেষ ভাবে খেয়াল করেছেন যাতে সেই সব গান বা সুর যেন হয় একান্ত ভাবেই সেই দেশের নিজস্ব। তাতে যেন কোন পাশ্চাত্য প্রভাব বা অনুকরণের ছায়া না থাকে। সেই কারণেই তুরস্কে গিয়ে তিনি খেদের সঙ্গে লিখেছিলেন, "এরা সব নিজেদের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞান জাহির করতেই ব্যস্ত। সব জায়গায় সেই এক মোৎজার্ট, বিঠোফেন আর ওয়াগনারের প্রতিধ্বনি। টার্কিশ ক্যাবারে ও জ্যাজও রয়েছে তার পাশাপাশি। খুব খারাপ ও অবসন্ন লাগে দেখে যে এরা নিজেদের ঐতিহ্য ও নিজস্ব সম্পদকে ভালোও বাসে না বা তা নিয়ে নিজেদের কোন গর্ব নেই।" আবার দামাস্কাসে পৌঁছে দেবেনের এক অন্যতর, গভীর উপলব্ধি। তিনি লিখছেন, "মুসলিম দরবেশের কণ্ঠের গান আর রবাব শুনে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হল, জীবন ও ধর্মের থেকে সঙ্গীতের সুর কখনই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।" আলেপ্পো, বাগদাদ, কাবুল সহ আফগানিস্তান ও ইরাকের বিভিন্ন শহর বলতেই যখন আমাদের চোখের সামনে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ধ্বংস, মৃত্যু আর হানাহানির চেহারা ভেসে ওঠে তখন দেবেনের সফরের বর্ণনা সেই সব শহরের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সিরিয়ার পথে ভায়োলিন, ইরাকের কুর্দদের ব্যালাড বা আফগানিস্তানে লোকনৃত্যের সঙ্গে পরিবেশিত সঙ্গীতের রেকর্ডিং সমগ্র বিশ্বের দরবারে মহত্বর ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তবে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, মধ্যপ্রাচ্যে কেবল পুরুষ সঙ্গীত শিল্পীদেরই দেবেন রেকর্ড করতে পেরেছেন। মহিলা শিল্পীরা প্রায়ই নজরের আড়ালে দ্রুত চলে যেতেন। এই ঘটনা থেকে তখনকার সামাজিক পরিস্থিতির কথাও বেশ বোঝা যায়।
দেবেনের রেকর্ডিংয়ের বিচিত্র সম্ভারের কিছু নমুনা শুনলেই বোঝা যায়, জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি সারা বিশ্বের খ্যাত-অখ্যাত শহর, গ্রাম, পাহাড় বা মরুপ্রান্তরে কাটিয়েছেন। পথে-ঘাটে, মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায়, বাজারে যেখানেই স্থানীয় সুর দেবেনকে আকর্ষণ করেছে, তাই তিনি বিশ্বের শ্রোতার জন্যে পরম নিষ্ঠায় তখনকার সীমিত প্রযুক্তির সাহায্যে নিজের যন্ত্রে রেকর্ড করে রেখেছেন। তাঁর ওই পরিশ্রম আর গভীর আগ্রহ ও কৌতূহলের জন্যেই আজ এতদিন পরেও আমরা ইয়েমেন কিংবা আফ্রিকার অ্যাটলাস পর্বতমালা বা তিউনিসিয়া কিংবা স্পেন থেকে এসে ইজরায়েলে জড়ো হওয়া ইহুদিদের প্রেম ও বিবাহ সঙ্গীত বা বাজার এলাকায় সেই জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উচ্ছল সুর বা মেষ পালকদের লোকসঙ্গীত কিংবা প্রিয়জনের মৃত্যুতে পারিবারিক শোকগাথার হৃদয়স্পর্শী সুর নিজের কানে শোনার দুর্লভ সুযোগ পাচ্ছি। বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ সঙ্গীতের অপূর্ব ঐতিহ্যের হদিস প্রকৃতপক্ষে দেবেনই প্রথম দুনিয়ার মানুষকে দিয়েছিলেন। তার আগে নানা দেশের লোকসঙ্গীতের সমৃদ্ধ ভান্ডারের অস্তিত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে কার্যত কোন ধারণাই ছিল না। মার্কিন ক্লাসিক রক মিউজিশিয়ান ফ্রাঙ্ক জাপ্পা বিলেতের মর্যাদাপূর্ণ মাসিকপত্র 'দ্য গিটারিস্ট'কে ১৯৯৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর গিটারের বাজনা বা গানের অধিকাংশ অনুপ্রেরণা এসেছে দেবেনের রেকর্ড করা মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় লোকসঙ্গীত শুনে। তিনি জানিয়েছিলেন, সময় পেলেই তিনি 'মিউজিক অন দ্য ডেজার্ট রোড' অ্যালবামটির সব ধরণের জনগোষ্ঠীর গান শুনতেন।
আউদ বাদ্যযন্ত্র হাতে অনামা শিল্পী বেদুইনদের রহস্যময় জগৎ ছাড়া এই সফরে দেবেনকে যা প্রবল উৎসাহ জুগিয়েছিল তা হল ইজরায়েল। সেটি তখন নবীন রাষ্ট্র যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ইহুদিদের সামনে একটাই স্বপ্ন -- সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জারি রাখা আর নিজস্ব বাসভূমির ভিত্তি দৃঢ় করা। প্রাক পরিচয় ঘুচিয়ে অতীতের জীবনচর্যা থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশে হিব্রু ভাষায় সড়গড় হয়ে ইজরায়েলি নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। সেই দেশে পৌঁছে দেবেনের তাই প্রথমেই নজর কেড়েছিল মানুষের মুখের বৈচিত্র্য আর শব্দের নানাত্ব। খর্বাকৃতি, নাশপাতি আকারের তারযন্ত্র আউদের সঙ্গে দীর্ঘ স্প্যানিশ ব্যালাড, আরবের বীণা, কেরোসিনের টিনের বাজনার তালে তালে হিব্রু ভাষায় গাওয়া ইয়েমেনি মানুষের গান, চাং, সন্তুর বা কামাঞ্চার মতো ঐতিহ্যপূর্ণ বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে বুখারার এক গায়কদলের কণ্ঠে পূর্ব ইউরোপের ইহুদি সিনাগগের মধুর ধর্মীয় সঙ্গীত অথবা মরক্কোর কোন গায়কের কণ্ঠে আরবি ভাষায় প্রেমের গান কিংবা আবার ভারতের দাক্ষিণাত্যে কোচি থেকে আসা ইহুদি জনগোষ্ঠীর কণ্ঠে আউদের তানে ধর্মীয় সঙ্গীত সবই দেবেনকে বিমোহিত করেছিল। আর সেগুলি তিনি পরম আগ্রহের সঙ্গে রেকর্ডও করেছিলেন।
দেবেনের বিবিধ রেকর্ডিংয়ের আরও এক ঝলক আর এভাবেই আন্তর্জাতিক স্তরে দেবেনের পরিচিতি গড়ে ওঠে এথনোমিউজিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে। সেই যুগে এক দল লোকসঙ্গীত শিল্পীকে তিনি সুইডেনে হাজির করেছিলেন। জীবনের সেই অধ্যায়ে তাঁকে পেশার তাগিদে লন্ডন ও স্টকহোমে থাকতে হত। ১৯৬২ সালে তিনি কিছু ডকুমেন্টারি তৈরিতেও হাত দেন। বিবিসি থার্ড প্রোগ্রাম প্রোডিউসার রবার্ট লিটন তাঁকে আলাপ করিয়ে দেন ডেভিড অ্যাটেনবরোর সঙ্গে যিনি তখন বিবিসির এক এক্সিকিউটিভ। দেবেন তাঁকে বলেন, একজন দক্ষ ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে তিনি ভারতে যাবার পরিকল্পনা করছেন। অ্যাটেনবরো তাঁকে এক হাজার পাউন্ড দেন। ভারত থেকে ফিরে আসার পর তাঁর সংগৃহীত রসদ সম্পাদনা করে বিবিসি বানায় দুটি ছবি, 'কথাকলি' আর 'স্টোরিটেলার্স ফ্রম রাজস্থান'। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হল তার যোগ্য মহিমায়। এরপরে সুইডিশ টেলিভিশনও তাঁকে দিয়ে ফিল্ম করায়। রোমানিয়া, তিব্বত, চিন, বাংলাদেশ, নেপাল সহ বহু দেশে এজন্যে তাঁকে যেতে হয়েছে। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তাঁর প্যারিসের বাড়িতে ৬০০ ঘন্টার সঙ্গীতের রেকর্ডিং মজুদ আছে। বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৬ হাজার ছবিও তিনি সংগ্রহে রেখেছিলেন।
১৯৭১ সালে একবার দেবেন সস্ত্রীক কলকাতায় আসেন। সেটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে শরণার্থীর ঢল নেমেছে। নদীয়া, উত্তরবঙ্গ সহ বেশ কিছু জায়গায় গড়ে উঠেছে বিরাট শরণার্থী শিবির। দেবেনের ইচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী সাধারণ মানুষের কিছু গান রেকর্ড করবেন। দেবেনের স্ত্রীর সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় থাকায় তাঁরা কলকাতায় এসে যোগাযোগ করলেন গৌরী আয়ুবের সঙ্গে। তিনি তখন তাঁদের আলাপ করিয়ে দেন মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে। সেই যোগাযোগের সূত্রে দেবেন নানা শরণার্থী শিবিরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে ভাব জমাতে থাকেন। আর এভাবেই জানতে পারেন শরণার্থীদের মধ্যেই রয়েছেন কত প্রতিভাসম্পন্ন গায়ক। সেই সময় তিনি রেকর্ড করেন তোরাব আলী শাহ এবং চট্টগ্রাম থেকে আসা মহম্মদ শাহ বাঙালির গান।
যাঁকে নিয়ে আজও সমান ভাবে গর্ব করার কথা আমাদের দুই বাংলার মানুষেরই, ভাবতে অবাক লাগে এমন এক আশ্চর্য বাঙালিকে নিয়ে হাল আমলে কোন চর্চা নেই। দেবেনের বিপুল সঙ্গীত সম্ভারের ঐশ্বর্যের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় ঘটানোর দায়িত্ব কি কারও নেই?
তাঁর অসামান্য কাজের কিছু তালিকা --
Partial filmography:
* Waves of Joy: Anandalahari - Director
* The Cosmic Dance of Shiva - Director
* The Chanting Lama - Director
* Silk and Strings: Taiwan - Director
* Raga - Director
* Painted Ballad of India - Director
* Krishna in Spring - Director
* Jesus and the Fisherman - Director
* Faces of the Forest: The Santals of West Bengal - Director
* Echoes from Tibet - Director
* Buddha and the Rice-Planters - Director
* Chinese Opera - Director (1983)
* Land of Smiles: Thailand - Director (1973)
* Bali: Isles of Temples - Director (1973)
* Ecstatic Circle: Turkey - Director (1972)
* Adaptable Kingdom: Music and Dance in Nepal - Director (1972)
Partial discography:
* Bedouins of the Middle East 1955-60 - ARC Music
* Sounds of West Sahara: Mauritania - ARC Music
* Maqams of Syria - ARC Music
* River Songs of Bangladesh - ARC Music
* Treasures in Sound - India UA International, 1967
* The Living Tradition Music From Turkey - Argo Records, 1968
* The Living Tradition Music From Iran - Argo, 1971
* The Living Tradition - Songs of Krishna - Argo, 1971
* The Living Tradition Music From Bangladesh - Argo, 1972
* The Living Tradition - Songs and Dances From Macedonia - Argo, 1972
* Various - Folkmusik Från Rumänien - Caprice Records 1972
* 2 Ragas - Sveriges Radio
* Musique folklorique du monde: Yougoslavie - Musidisc
* Musique folklorique du monde: Iran - Musidisc
* Various - Sacred Temple Music of Tibet - ARC Music 1998
Books:
* Songs of the Qawals of India: Islamic Lyrics of Love
* Songs of the Bards of Bengal
* Love Songs of Vidyapati
https://archive.org/.../disc1/02.02.+Ballad+-+Bedouin.mp3তথ্যসূত্র
https://archive.org/details/lp_music-from-the-middle-east_deben-bhattacharyahttps://archive.org/details/lp_music-from-turkey_deben-bhattacharyahttps://archive.org/details/lp_music-from-yugoslavia_deben-bhattacharyahttps://archive.org/details/cd_the-music-of-uzbekistan_deben-bhattacharya-fakhruddin-sadikovhttps://www.discogs.com/release/12867823-Deben-Bhattacharya-Paris-To-Calcutta-Men-And-Music-On-The-Desert-Roadhttps://www.thetravellingarchive.org/tribute/deben-bhattacharya/https://www.last.fm/music/Deben+Bhattacharya/+wikihttps://4columns.org/dayal-geeta/deben-bhattacharyahttps://theworldjukebox.wordpress.com/2011/01/20/ethnic-music-from-israel-field-recordings-by-deben-bhattacharya/