এবার পুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। মন্ডপরা পেয়েছে অনেক পুরষ্কার। কিন্তু পুজো মানে তো কেবল মন্ডপ বা প্রতিমা না। মানুষও। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? কে পাচ্ছেন শারদ সম্মানের শিরোপা? জানতে হলে পড়তে থাকুন। একমাত্র গুরুচণ্ডালিতে।
মন্ত্রী
গত কয়েক-বছর স্টাইলের মুকুটহীন সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী থাকার পর এবার শোভন ও বৈশাখীর পতন হয়েছে। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন এবার যুগ্মভাবে শারদসম্মান পেতে চলেছেন পার্থ-অর্পিতা। যাকে বলে অ্যান্টি-হিরো ও হিরোইন। পুজোর আগে থেকেই তাঁদের মুখে আলোর কোনো কমতি নেই। এই ফ্ল্যাটে টাকা গোনা হচ্ছে কুড়ি-বিশ ক্রিকেটের গতিতে, তো পরক্ষণেই গ্রেপ্তার। এই কেঁদে ফেলছেন, তো পরক্ষণেই মিডিয়া জানতে পেরে যাচ্ছে, গোপন সেক্স টয়ের কথা। একে টাকা, তায় কেচ্ছা, তদুপরি মহিলা, এবং সবার উপরে ডিলডো সত্য, তাহার উপরে নাই। হইহই করে গোনা চলছে মন্ত্রীর প্রাক্তন বান্ধবীদের সংখ্যা, ব্যাকগ্রাউন্ডে যুগপৎ "ইডি-সিবিআই দিয়ে আমাদের রোখা যাবেনা" এবং "চোর-ধরো জেল-ভরো"র কলধবনি। সব মিলিয়ে এটা নিঃসন্দেহে বৈশাখী-শোভনোত্তর যুগের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ঘটনা।
বিচারপতি
অনেকেই ভেবেছিলেন, পার্থার্পিতার উত্থানের পর এবার আর শারদ-সম্মান নিয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকতে পারেনা। কিন্তু মানুষ প্রোপোজেস আর বিচারপতি ডিসপোজেস। ঠিক এই ব্রাহ্মমুহূর্তে সমস্ত আলো শুষে নিয়ে টিভির পর্দায় উপস্থিত হলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সিনেমার ভাষায় বলতে হলে বলা যায় "এন্ট্রি নিলেন", কবীর সুমনের ভাষায় "এমন সময় উঠে দাঁড়ালেন অরুণ মিত্র"। ব্যস, দিগ্বিদিক আলো হইল। এর আগেই তিনি কড়া রায় দিয়ে আলোচনায় এসে গিয়েছিলেন, এবার টিভিতে ঠিক যেন ডান্ডা হাতে বহুযুগ আগের টিএন শেষনের পুনর্জন্ম। জনতার দরবারকে নিজের এজলাস বানিয়ে নিয়ে বিচারাধীন মামলা-টামলা নিয়েও ফটাফট মন্তব্য করছেন, কখনও নরম, কখনও গরম, আশির দশকের বেল্ট-হাতে রঞ্জিত মল্লিকের পর, এইরকম হিরো বাঙালি আর দেখেনি। বিশেষ করে পার্থার্পিতার চমকপ্রদ উত্থানের মধ্যেই সমস্ত আলো নিজের মুখে টেনে নেওয়া, বিরাট কৃতিত্বের কাজ।
মুখ্যমন্ত্রী
কিন্তু বাপেরও বাপ থাকে, ভাইয়ের আছে দিদি। পট দ্রুত বদলায়, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে ভালো আর কে জানেন। এই উৎসবের মরশুমে তিনি প্রথমে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর শারদসঙ্গীত সম্ভার। সে নিয়ে বিশেষ হট্টগোল দেখা যায়নি, সম্ভবত লাইটপোস্টে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে শুনে লোকের কান পচে গেছে বলে। পরের সুযোগ এসেছিল কার্নিভ্যালের আয়োজনে। অনেকেই বিপর্যয়ের মধ্যে কার্নিভ্যাল আয়োজনের বিরোধী ছিলেন, ফলে একটা হইচই হতেই পারত। কিন্তু বাম দিকের বিখ্যাত ইন্টারনেট বাহিনীর কাছে সবসময়েই লক্ষ্যের ছেয়ে উপলক্ষ্য বড়। তারা মুখ্যমন্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর সঙ্গে যারা দেখা করেছিলেন, তাদের পিছনে পড়ে যাওয়ায়, মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়েও তেমন উচ্চস্বর কিছু শোনা যায়নি। উৎসব শেষ হয়ে যাবার পর মুখ্যমন্ত্রী ছাড়লেন তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র। "টাটাকে তাড়িয়েছে সিপিএম"। ব্যস, সমস্ত আলো এক নিমেষে তাঁর উপর। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি উবে গেল, জগৎসংসার মায়া, এমনকি বিরোধীরাও সমস্বরে সিঙ্গুর-সিঙ্গুর-টাটা-টাটা করে উত্তেজিত হয়ে পড়তে বাধ্য হলেন, যেন ওটাই এখন জ্বলন্ত ইস্যু। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে এই ভাবে এক ঝলকে সমস্ত আলো নিজের দিকে নিয়ে আসার ক্ষমতাই মমতাকে মমতা করেছে। উৎসবেও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই।
প্রাক্তন মেয়র
তিনি প্রাক্তন মেয়র বা বর্তমান উকিল, যাই হোন, লাইমলাইটের ব্যাপারে স্লো অ্যান্ড স্টেডি। দীর্ঘদিন ধরে চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে উকিলি লড়াই লড়ছিলেন। ন্যায়যুদ্ধের গৌরবের ম্লান কিন্তু সোজা আলো অনেকদিন ধরেই তাঁর মুখে ছিল। অরুণাভ ঘোষ মাঝে-মধ্যেই একটু চিমটি দিয়েছেন, যে, বিকাশবাবুর জুনিয়ারদের ফি নাকি বিশেষ এক বিচারকের কাছে গেলেই দ্বিগুণ হয়ে যায়, কিন্তু ওইটুকু বিতর্কে মুখের উপর পড়া আলো উস্কে যায়। কমে না। ফি সহ বা ছাড়া যাই হোক, তিনি এজলাসে মামলা লড়ছিলেন, এবং ঝপাঝপ কড়া-কড়া সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে টেনে আনছিলেন। আগুনে বিবৃতিও দিচ্ছিলেন। কিন্তু আসল আলো পড়ল কদিন পরে, যখন কড়া-কড়া সিদ্ধান্ত বাড়তে বাড়তে একসময় বে-আইনী চাকরিপ্রাপকদের চাকরি যাবার রায় ঘোষণা হয়ে গেল। বিকাশবাবু সাফ জানিয়ে দিলেন, যে মামলায় চাকরি গেল, সেখানে তিনি যেমন লড়ছিলেন, একই ভাবে যাদের চাকরি যাবে, তাদের হয়েও তিনি আইনী লড়াই লড়তে প্রস্তুত। বরের-ঘরের-মাসি-কনের-ঘরের-পিসি প্রবাদটি তার জন্মলগ্ন থেকে সম্ভবত এমন অব্যর্থ প্রয়োগ কখনও চোখে দেখেনি। এর পরে মুখের উপর ঝপ করে আলো এসে না পড়লে, তাকে আলো বলাই মুশকিল। ফলত মন্ত্রীকে ছাড়িয়ে, বিচারপতিকে ছাপিয়ে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে টেক্কা দিয়ে তিনি চলে এলেন শারদসম্মানের প্রথম সারিতে।
আরেক মুখ্যমন্ত্রী
এতক্ষণ ভাবা হচ্ছিল, যে, এই সম্মান কেবলমাত্র বাংলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু কালীপুজো নাগাদ হঠাৎ করে দেখা গেল, ইউনেস্কো সম্মান বৃথা যায়নি। পুজো এখন সত্যিই সর্বভারতীয়। প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি তাঁর শাসনকালের গোড়ায় লিবারালদের নয়নমণি ছিলেন। তারপর পুজো দিয়ে হঠাৎ আস্তিক হয়ে বিশ্বসযোগ্যতা একটু খোয়ান। ৩৭০ নিয়ে অবস্থানের পর আরও একটু। তারপর মনীশ শিশোদিয়ার উপর বারংবার ইডি-হামলা হওয়ায় একটু মোদিবিরোধী সহানুভূতি ফিরে পান। দিল্লির সরকারি বিদ্যালয়গুলির মানোন্নয়নের প্রচার করে আবার জাতে ওঠেন। ঝা-চকচকে মানুষজন অনেকেই তখন আত্মহারা হয়ে আইআইটির আসনসংখ্যা ভুলে গিয়ে, দিল্লি বনাম পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করে বলছিলেন, দিল্লিতে সবাই পড়াশুনো করে আইআইটিতে যাবে, আর পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার অভাবে সবাই ঘুগনিশিল্প করবে। এইভাবে ধিক্কার এবং বাহবার মধ্যেই কেজরিওয়ালের জীবন যাচ্ছিল, হঠাৎই দেখা গেল, কালীপুজো নাগাদ তিনি বিবৃতি দিয়ে ফেললেন, যে, এবার ভারতীয় টাকায় লক্ষ্ণী এবং গণেশের ছবি ছাপাতে হবে। ব্যস। উদ্দীপনা আন্তর্জাতিক স্তরে চলে গেল। সমস্ত খবরের কাগজে কেজরিওয়াল, সব টিভিতে কেজরির মুখ, সারা দুনিয়ার মোদিবিরোধীরা তাঁকে তেড়ে গাল দিচ্ছেন, সব ঘটতে লাগল একসঙ্গে। বাংলা পক্ষের সাধারণ সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে এই দিল্লিমুখীনতার বিরুদ্ধে সকল বাঙালিকে সতর্ক থাকতে বললেন। কিন্তু বাঙালি অত শুনলে হয়েই ছিল। যা হবার তা হয়েই গেল, বাঙালিরাই পিছিয়ে পড়লেন শারদসম্মানের প্রতিযোগিতায়। একে বলে শেষ ল্যাপে এগিয়ে যাওয়া।
প্রধানমন্ত্রী
কিন্তু এত কিছু করেও শেষরক্ষা হলনা। শারদসম্মান শেষমেশ কেজরিওয়ালও পেলেন না। কারণ খুবই সোজা। পুজো কেবল চকমকে বাহারি আলো নয়। বাইরের চাকচিক্যও না। শুধু বুক ফুলিয়ে কথা বললেই হয়না, কিছু করে দেখাতে হয়। এবং তার প্রভাব সর্বব্যাপী হতে হয়। এই ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর থেকে যোগ্য কাউকে পাওয়া অসম্ভব। তিনি টিভিতে এসে এক ঝটকায় নোটবন্দী করে দিয়েছিলেন। ঝপাৎ করে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই কর্মের ধারা এবার উৎসবেও অব্যাহত। উৎসবের মধ্যেও তিনি একদিকে যেমন ফেক নিউজ রুখতে হবে বলে জগৎকে বিনোদন দিয়েছেন, কলমধারী নকশালদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন, একই সঙ্গে তাঁর সরকার এবং এজেন্সিগুলি সারা ভারতের সমস্ত রাজ্য সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই উৎসবের মধ্যেও কেন্দ্রীয় রাজ্যপাল কেরলের সব উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। দিল্লির আআপ নেতার বিরুদ্ধে ইডি তল্লাশি করেছে, কলকাতায় টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, যে, সন্ত্রাসবাদ রুখতে এনআইএ এবার সব রাজ্যে এসে ঢুকে পড়বে। শুধু মুখে নয়, কাজেও ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোকে কার্যকরীভাবে ভাঙ্চুর করার অসামান্য দক্ষতার জন্য, এবার শারদসম্মান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কাউকে দেওয়া অসম্ভব।