পর্ব ১
দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরে সাতসকালেই বেশ ভিড়। লম্বা লাইনে ধৈর্য ধরে মানুষ অপেক্ষা করছেন, হাতে পুজোর ডালি। ফুলের মালা, মিষ্টি, ধূপ। ছোটোখাটো একটি দল নাটমন্দির থেকে নেমে এসে মূল মন্দিরের দিকে এগোচ্ছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করার অনুমতি মিলেছে। একেবারে ছোট থেকে এক কিশোর, যুবক, যুবতী, সবাই আছে সে দলে। দলের বয়স্কা নেত্রী সবাইকে নিয়ে সামলেসুমলে এগোচ্ছেন।
"কই, বাবলু কোথায় গেলি, পিছনে কেন, আমার সামনে আসতে কী হয়? এই যে এইখানটা দিয়ে এগো দেখি!"
সদ্য বড় হতে চাওয়া কিশোর লজ্জায় লাল, "কী যে কর না তুমি ছোটমা, যাচ্ছি তো আমি তোমার পিছন পিছন!"
"না না, এদিকটায় আয়, ভালো করে দেখতে পাবি। মায়ের গর্ভগৃহে ঢোকার সুযোগ জীবনে কবার আসে?"
হঠাৎ পাশ থেকে দলের ক্ষুদ্রতম সদস্যটি বিদ্রোহ করে, "আমি জুতো খুলবো নাআআআ, পায়ে নোন্না লাগবে!"
দলনেত্রী তার দিকে চোখ পাকান, "এই বুদ্ধি হচ্ছে তোমার? মন্দিরে বুঝি জুতো পরে ঢোকা যায়? খোলো শিগগিরি!"
পুঁচকে তবুও কথা শোনে না, এবার বাবলুর হাত চেপে ধরেছে, "ও বড়মামা, দ্যাকো না, অ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ..."
হাসি চাপতে চাপতে কোনোরকমে তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বাবলু মন্দিরের দরজা পেরিয়ে যায়। ভিতরে সাদা কালোর দাবার ছকের নকশায় তৈরী শ্বেতপাথরের মেঝে। মাঝখানের বেদীতে কালো পাথরের দেবীমূর্তি। পায়ের তলায় শ্বেতবর্ণের শিব শুয়ে আছেন। এ সবই ছাপিয়ে গিয়ে তার দৃষ্টি টেনে নেয় দেওয়ালে টাঙানো কয়েকটি ছবি। বেথলেহেমের ছবিটা তার খুব চেনা। খড়ের গাদার বিছানায় মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু - এ ছবি বইয়ের পাতায় কতবার দেখেছে! আর পশ্চিমদিকের দেওয়ালে ও কিসের ফ্রেম? কাবা শরীফ? ইসলামের পুণ্যভূমি?
ছোটমা তার বিস্ময় লক্ষ্য করেছেন। কাঁধে আস্তে হাত রাখেন, "এই মন্দিরে যে মানুষটি সাধনা করেছেন, তিনি বলতেন, 'যত মত তত পথ।' সে কথাগুলিই মন্দিরের দেওয়ালে ছবি হয়ে রয়েছে।"
বাবলু বিহ্বল। সদ্য পরিস্ফুট চেতনায় কী যেন এক মহামিলনের আলো এসে পড়ছে। এমন কথা সে তো এই প্রথম শুনছে না! সেই যে আবাল্যের পরিচিত কত পুরাতনী শ্যামাসংগীত, এমনি করেই যেন সব মিলিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে গানে গানে।
আমার জাত গেছে মা কালী,
আমি গলায় দিছি তুলসীমালা,
গায়ে হরিনামামৃতবলী -
আমার জাত গেছে মা কালী।
সে কথা শুনেই ছোটমা বলেন,
"শ্যামা শ্যাম, শিব রাম নাম,
আমি ওই নাম বড় ভালোবাসি,
আমি ওই নাম জপি দিবানিশি,
শ্যামা শ্যাম, শিব রাম নাম।
কতজন এ গানে মিলেমিশে গেলেন বল দেখি?"
"ছোটমা," হাতের কনুইতে আলতো চাপ দেয় সে, "এ সব গান কারা লিখে গেলেন? কেমন তাঁদের জীবন, তাঁদের সাধনা, খুব জানতে ইচ্ছে করে।"
"বড় হচ্ছিস, জানতে তো নিশ্চয়ই চাইবি। মন্দির থেকে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসব আমরা। কালীকীর্তন আর তার পদকর্তাদের নিয়ে যেটুকু আমি জানি, নিশ্চয়ই শোনাব তোকে।"
দিনটা আজ সত্যিই অন্যরকম। আকাশে নীলবরণ মেঘ ছায়া ফেলছে গঙ্গার জলে। নদীর বুক থেকে ভেসে আসছে জলের গন্ধ। দূরে চলেছে দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড় মঠের খেয়া পারাপার করা নৌকাগুলি।
দলের বিদ্রোহী ক্ষুদে জুতো ফেরত পেয়ে খুশি, পা নোংরা হওয়ার ভয় আর নেই, আপাতত তার মা-বাবার সঙ্গে পঞ্চবটির বনের হনুমানদের নিয়ে মহাব্যস্ত। চিনেবাদাম কেনার তোড়জোড় চলছে।
একটু দূরে বাবলু তার ছোটমার পাশে। চুপচাপ বসে নদী দেখছে।
ছোটমাই নীরবতা ভাঙলেন।
"কালীসাধনা মূলত পূবদেশের আচার। মানে পূর্বভারত। আসামে কামাখ্যা মন্দির, ঢাকায় কালীবাড়ি, কলকাতার কালীঘাট - সবই সেই একই ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে যায়। খোদ আদ্যাস্তোত্রের শ্লোকে বাঙালির কালীসাধনার উল্লেখ পাবি।"
"’কালিকা বঙ্গদেশে চ’ - তাই না ছোটমা?" বাবলু উৎসাহী।
"হ্যাঁ, বাঙালির জীবনচর্যায় মিশে আছেন দেবী কালী। আর অবিভক্ত বঙ্গদেশ ধরলে তো গোটা পূর্বভারতই এই গোত্রে পড়ে। এই অঞ্চলে বৈদিক পূজা বা আচার কম, বরং লোকাচার বেশি। বেদাচার নয়, লোকাচার। খেয়াল করে দেখ, কালীও কিন্তু বৈদিক দেবী নন, লৌকিক দেবী। তাঁর পূজার সঙ্গে তন্ত্রসাধনার যোগ আছে। তন্ত্রের আচার কিন্তু শাস্ত্রীয় পূজাপদ্ধতি নয়।"
"মন্ত্র তন্ত্র জানি নে মা, শাস্ত্রপাঠে নেই কো রুচি,
সদানন্দে বিভোর হয়ে, মায়ে-পোয়ে সুখে আছি।"
বাবলু শিহরিত। এত গান লুকিয়ে ছিল তার মধ্যে, সে কি নিজেও জানত? আজ যেন সব দুয়ার খুলে যাচ্ছে, খোলা দরজা দিয়ে আসছে আলো। ছোটমার কথায় বাজছে সেই আলোর বেণু।
"এটি সহজিয়া ভাব, কালীকীর্তনে সে ভাবের আমদানি হবে আরও পরে," ছোটমা হাসছেন। "ধর্ম, সংস্কৃতি যখন সাধারণ্যে স্থান করে নিতে চায়, তখন তাকে সুরের আশ্রয় নিতে হয়। সুরের অসীম ক্ষমতা, কানের ভিতর দিয়ে সে সহজেই 'মরমে পশিয়া' যেতে পারে, আকুল করতে পারে মন প্রাণ। সেই বোধ বা চেতনা থেকেই কালীকীর্তনের জন্ম।"
"আচ্ছা ছোটমা, কীর্তন কেন? শ্যামাসংগীত বললেই তো হয়?"
"কীর্তন সংস্কৃত কথা, তার অর্থ ঈশ্বরের ভজন। তাই ওই নাম। পরে আমরা তাকে আদর করে সংগীতের একটি ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলাম। নাম দিলাম, শ্যামাসংগীত। আজকের আকাশবাণী, দূরদর্শন শ্যামাসংগীত প্রচার করে। রেকর্ড বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও শ্যামাসংগীত খুবই জনপ্রিয়।"
"সে তো বুঝলাম, কিন্তু শুরুটা হয়েছিল কীভাবে?" বাবলু কৌতূহলী।
"মধ্যযুগে মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে আসেন দুই ভক্ত কবি, রামপ্রসাদ সেন আর কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রামপ্রসাদের জন্ম। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য আসেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে। দৈবমাহাত্ম্য ছেড়ে দেবীকে ঘরের মেয়ে ভাবতে শেখালেন তাঁরাই। কখনো মা-ছেলের মান-অভিমান, কখনো বা কন্যারূপে দেবীকে দর্শন, সহজিয়া ভাবের বন্যা বয়ে গেল গানে গানে। এমন কী আপনভোলা রামপ্রসাদের হাতে হাতে বেড়া বেঁধে দিয়ে গেল শ্যামাঙ্গী এক কন্যা। দেবতার এই আত্মীকরণ বাঙালির বড় পছন্দের জিনিস। দূরের নক্ষত্র নয়, দেবতাকে মাটির ধুলো মাখিয়ে তবেই তার শান্তি।"
"যেমন বাঙালির মা দুর্গা পুজোর পাঁচদিন চার ছেলেমেয়ে আর শিবঠাকুরকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন?"
"একদম ঠিক। এখানেও আমরা দেবী দুর্গাকে ঘরের মেয়ের আদরে বরণ করি, বিদায়বেলায় প্রতিমার মুখে সন্দেশ-পান দিয়ে কানে কানে বলে দিই আসছে বছরের আবার আসার কথা। সেই একই কথা দেবী কালীকে নিয়েও খাটে। দেবীই রামপ্রসাদের একান্ত আশ্রয়। সংসার আর জীবনের যত দুঃখকষ্ট, আর যন্ত্রণা, সব উজাড় করে দেন সেই কালী মায়ের কাছে।"
ছোটমা গুন গুন করে উঠলেন।
"অপার সংসার, নাহি পারাপার,
মাগো আমার –
ভরসা শ্রীপদ, সঙ্গের সম্পদ
বিপদে তারিণী, করো গো নিস্তার।"
মুগ্ধ হয়ে শুনছে কিশোর বাবলু।
ছোটমা বলে চলেছেন, "আবার সেই চাওয়া-পাওয়ার হিসেব না মিললে রাগ করেছেন, গালি দিতেও ছাড়েননি নিজের একান্ত আপনজনটিকে।
মা হ’য়ে মা জন্মে জন্মে
কত দুঃখ আমায় দিলে,
প্রসাদ বলে এবার ম’লে
ডাকবো সর্বনাশী ব’লে।"
"কী কাণ্ড! এই সর্বনাশী কথাটা আমি অনেক গানেই শুনেছি মনে হচ্ছে। এ তো রীতিমত রাগ দেখানো!"
"শুধু কি তাই? আরেকটি গানে আরো এক কাঠি ওপরে উঠে সোজা বললেন, 'এবার মা তোমাকেই খাব, তোমার ডাকিনী-যোগিনী সমেত! এত জ্বালিয়েছ আমায়, আর ছাড়ব না। মা-খেকো ছেলেই হব না হয়!'"
এবার কালী তোমায় খাব
খাব-খাব গো দীন দয়াময়ী,
তারা গন্ডযোগে জন্ম আমার।
গন্ডযোগে জনমিলে
সে হয় যে মা-খেকো ছেলে,
এবার তুমি খাও. কি আমি খাই
মা, দুটোর একটা ক’রে যাব।
ডাকিনী-যোগিনী দুটোয়
তরকারি বানায়ে খাব,
তোমার মুন্ডমালা কেড়ে নিয়ে
অম্বলে সম্বরা দিব।"
বাবলু এবার হাসি চাপতে পারে না, "ডাকিনী-যোগিনীর তরকারি? আর মুণ্ডমালার অম্বল? তা আবার কেমন করে হবে?"
"কেমন করে? সেটাই তো বুঝিয়ে দিলেন গানের শেষে এসে,
খাব-খাব বলি মাগো
উদরস্থ না করিব,
এই হৃদি-পদ্মে বসাইয়ে
মনোমানসে পূজিব।
কালীর বেটা শ্রীরামপ্রসাদ
ভালমতে তাই জানাব,
তাতে মন্ত্রের সাধন শরীর পতন
যা হবার তাই ঘটাব।
এ যেন নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেওয়া, পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ, একান্ত আপন করে নেওয়া। হৃদমাঝারে অনুভব না করলে কি এমন করে বলা যায়?"
"আচ্ছা ছোটমা, গানের মধ্যেই রামপ্রসাদ নিজের নাম বলে গেছেন, তাই না?"
"ঠিক। বেশিরভাগ রামপ্রসাদী গানেই নিজের নামটি বলে গেছেন রামপ্রসাদ। কমলাকান্তও তাই। গানেই বলে গেছেন নিজের নাম। একই সহজিয়া ধারার গান বাঁধিয়ে। কত না মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়া, রাগ-দুঃখ ফুটে ওঠে গানে গানে। আর গালি দেওয়া? গালি দিতে তিনিও কম যান না।
অশান্ত কমলাকান্ত দিয়ে বলে গালাগালি -
এবার সর্বনাশী, ধরে অসি, ধর্মাধর্ম দুটো খেলি?
শুনেছিস তো গানটা?"
"শুনিনি আবার? পান্নালালের গলায় প্রায়ই তো বাজে এ গান। কিন্তু ছোটমা, কমলাকান্তের একটি গান মনে আসছে, এ গান আমি শুধু বাড়ির রেকর্ডেই শুনেছি। আর কোথাও পাইনি।
আপনাতে মন আপনি থাকো
তুমি যেও না কো কারো ঘরে,
যা চাইবি তা বসে পাবি
শুধু খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে।
রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে?"
ছোটমার চোখে ঘনিয়ে আসে কী এক মায়া, "সে গানে আসছি আমি। কিন্তু তার আগে একটা ব্যাপার খেয়াল কর। এতক্ষন আমরা যে সব গানগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম, প্রায় সবই হল বাউল বা কীর্তনাঙ্গের গান। তার মানে কোন রাগ?"
"খাম্বাজ।" কিশোরটি ঝটপট উত্তর দেয়। রাগরাগিণীর ব্যাপারে মাথা তার সাফ।
ছোটমা খুশি হন। "বেশির ভাগ সহজিয়া শ্যামাসংগীত গান এই খাম্বাজ রাগে বাঁধা। খুব বেশি হল তো ভৈরবী। এ সবই বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তনের প্রভাব। রামপ্রসাদের গানে তো সুরের চলনও প্রায়ই এক ধরণের, বলতে পারিস তাঁর সিগনেচার টিউন, যার জন্যে রামপ্রসাদী গান শুনলে মোটামুটি চেনা যায়। কিন্তু কমলাকান্ত তাঁর গানে মাঝে মাঝেই বেশ ঝাঁকিয়ে দিয়ে যান। খাম্বাজ-ভৈরবীর বাইরেও অন্য রাগরাগিণী তাদের বিশুদ্ধ রূপ নিয়ে গানে হাজির হয়। যেমন ধর, তুই যে গানটার কথা এইমাত্র বললি, কী সুগভীর অন্তর্মুখী উপলব্ধির কথা বলা আছে এ গানে,
কী দেখ কমলাকান্ত
মিছে বাজী এ সংসারে,
সেই বাজীকরে চিনলে না রে
সে যে তোমার ঘটে বিরাজ করে।"
গুন গুন করে গেয়েই ছোটমার প্রশ্ন, "কী রাগ?"
বাবলু কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল এ গান শুনতে শুনতে। বহুবার শোনা গান, তবুও উদাস করে দেয়। আস্তে উত্তর দেয়, "শঙ্করা।"
দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে, এমনই এ গানের মায়া।
"এ ছাড়াও আসে দেশ, মালকোষ। এ সব রাগ শ্যামাসংগীতে অন্য মাত্রা এনে দেয়।" ছোটমাই নীরবতা ভাঙেন। "নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের নাম বেশি কেউ শোনেনি। এবার তাঁর গানের কথা তোকে শোনাই একটু।"
"বল, বল ছোটমা!" বাবলু উৎসাহে কাছ ঘেঁষে আসে।
"নীলবরণী নবীনা রমণী, নাগিনীজড়িত জটাবিভূষিণী
নীলনলিনী যিনি ত্রিনয়নী, নিরখিলাম নিশানাথ নিভাননী।"
ছোটমা গাইছেন।
"এ তো দেশ রাগ!" বাবলু অবাক।
"সে তো বটেই। বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় অঙ্গের গান, দেশ রাগে বাঁধা। কথাগুলো একবার খেয়াল কর।
নির্মল নিশা করকপালিনী, নিরুপম ভালে পঞ্চরেখাশ্রেণী
নিকরচারু করসুশোভিনী, লোলরসনা করালবদনী।"
"দাঁড়াও, দাঁড়াও, এ কথাগুলোর কোনো একটা বৈশিষ্ট্য আছে যা আমি বুঝতে পেরেও যেন পারছি না!" বাবলু প্রাণপণে অধরাকে ধরতে চাইছে।
ছোটমা মুচকি হাসেন, "বাকীটুকু শোন তাহলে, দেখ কী মনে হয়,
নিতম্বে বেষ্টিত শার্দূল ছাল, নীল পদ্মকরে করে করোয়াল,
নৃমুণ্ডখর্পর অপর দ্বিকর, লম্বোদরী-লম্বোদর প্রসবিনী।
নিপতিত পতি শবরূপে পায়ে, নিগমেরই হার নিগূঢ় না পায়,
নিস্তার পাইতে শিবের উপায়ে, নিত্যসিদ্ধা তারা নগেন্দ্রনন্দিনী।
কী বুঝছিস? তত্ত্বকথা তো?"
"তত্ত্বকথা তো বটেই," বাবলু ঘাড় নাড়ে, তবে গানের প্রতিটি পংক্তি দন্ত্য ন দিয়ে শুরু হচ্ছে। তাই না ছোটমা?"
"এইবার ঠিক ধরেছিস।" ছোটমা ভারী খুশি, " এমন পংক্তি নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের গানের বৈশিষ্ট্য। সেইসঙ্গে বিশুদ্ধ রাগে সুর। বাড়ি গিয়ে গানটা তুলে নিস নিজের গলায়।" ছোটমা এবার উঠে পড়েন। বাড়ি যেতে হবে।
"তা তো বটেই। কিন্তু তোমার শ্যামাসংগীতের ঝাঁপি কি এখানেই শেষ?" বাবলু জিজ্ঞেস করে। এত তাড়াতাড়ি ছোটমাকে ছাড়তে তার মন চায় না।
"মোটেই না," ছোটমা মুচকি হাসেন, "এই তো সবে শুরু। আরও কত পদকর্তা আছেন। সবার নাম তো জানাও যায় না। তাছাড়াও আছেন নজরুল ইসলাম। একাই তিনশো।"
"বিদ্রোহী কবি? নজরুলএর শ্যামাসংগীত আমি শুনেছি।"
"কিন্তু কজন জানে তাঁর সাধনার কথা? ভিন্ন ধর্মের মিলন ঘটিয়েছিলেন নিজের মধ্যে। তাঁকে ছাড়া কি শ্যামাসংগীত সম্পূর্ণ হয়? বাড়ি ফিরে না হয় বাকি সবার কথা বলব।"
আশ্বাস পেয়ে বাবলু উঠে পড়ে। আনন্দে ভাসে মন। চুপিচুপি গায়,
হৃদকমলে ধ্যান-কালে আনন্দ-সাগরে ভাসি,
ওরে কালীর পদ-কোকনদ, সে যে তীর্থ রাশি-রাশি।
মনের কথাটি কেমন করে যেন আজ রামপ্রসাদ ঠিক বুঝে নিয়েছেন।