এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী। বড় গল্প।

    লেখক শংকর হালদার লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ আগস্ট ২০২৩ | ৩২২ বার পঠিত
  • গল্প নম্বর :- ৩
    বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী।
    গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।

    ◆ " আদিবাসী বিদ্রোহী নারী" নামে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গমে বিপর্যয় ( দ্বিতীয় গল্প সংকলন।) প্রথম প্রকাশ :- ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। কলকাতা বইমেলা ও দত্তপুলিয়া (নদীয়া জেলা) বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত।

    ◆ বিষয় ও শ্রেণী :- সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস গবেষণা মূলক ও উন্নয়ন মূলক প্রবন্ধ যুক্ত গল্প।
    শিক্ষা ব্যবস্থার গাফিলতির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এক কিশোর প্রতিবাদী কন্ঠের কাহিনী।

    ◆ ৩ আগস্ট ২০২৩ সংশোধনের মাধ্যমে "আদিবাসী বিদ্রোহী নারী" নাম পরিবর্তন করে "বিদ্রোহী আদিবাসী কিশোরী" রাখা হয়েছে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ আদিবাসী কুইরি সম্প্রদায়ের মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম স্থান অধিকারী কিশোরী লাজবতী কুইরি (কাল্পনিক নাম)। তৎকালীন সময়ের রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শিক্ষা, বাসস্থান, কর্মস্থান, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও কুইরি সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রতিবাদ করেছিল। রাজনৈতিক নেতাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

    ◆ জঙ্গলের বাসিন্দাদের কথা কোন রাজ্য
    সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই বুঝতে চায় না। ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই করতে গেলে সন্ত্রাসবাদী, আতঙ্কবাদী ও মাওবাদী নামে দেশের সরকার আখ্যায়িত করে, শাসনের নামে চরম নির্যাতন আর অত্যাচার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর নেমে আসে।

    ◆ এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের দিকে কোন সরকারের নজর নেই। এই জঙ্গলমহলে বিভিন্ন সময়ে সরকারের সাথে জঙ্গল বাসীদের বিভিন্ন আন্দোলন হিংস্র ঘটনা ঘটেছে। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তবুও তাদের কন্ঠরোধ বা আন্দোলন ঝিমিয়ে যায়নি।

    ◆ সরকার মাওবাদী নামে চিহ্নিত করে কত মানুষের না জীবন নিয়েছে। জঙ্গলমহলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী কেন প্রতিবাদী হয়ে উঠে! মাওবাদী দলে নাম লেখায় তা কিন্তু একবার কোন সরকার খতিয়ে দেখেন না।

    ◆ লাজবতী শিশু কাল থেকে কিশোরী কালের সময়ে লেখাপড়া শিখতে গিয়ে জাত পাতের লড়াইয়ে উচ্চবর্ণের কাছ থেকে বারবার লাঞ্ছিত বঞ্চিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে সমাজের উন্নয়নের কাজে ব্রতী হন।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    স্বাধীনতা আন্দোলনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকা।

    ◆ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বৃহৎ জেলা মেদিনীপুর ছিল। পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যার ভিত্তিতে বর্তমান রাজ্যের শাসক দল জেলাটিকে ভেঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম নামে তিনটি জেলায় ভাগ করে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বেশকিছু অঞ্চল বর্তমানে সরকারের ঘোষিত ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত লাভ করেছে।

    ◆ বিশেষ করে জঙ্গলমহল এলাকায় বিভিন্ন ধরণের জাতি-উপজাতি বাসবাস করে। তারা নানা ধরণের রীতি-নিয়ম, প্রথা ও ব্রততে বিশ্বাসী। ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে শাল মহুল, আম, জাম, শিমূল ইত্যাদি গাছের সবুজ জঙ্গল রয়েছে।

    ◆ জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আদিবাসীদের ছোট ছোট গ্রাম রয়েছে। এই সমস্ত গ্রামে সাঁওতাল, শবর, লোধা, মুণ্ডা ইত্যাদি জনজাতি আদিম যুগ থেকে একটা সময় পর্যন্ত জীবনধারণের জন্য সম্পূর্ণভাবে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল।

    ◆ জঙ্গলের ফল-মুল,শাক-পাতা খেয়ে, পশুপাখি শিকার করে, জঙ্গলের কাঠ ও বনজ উপকরণ দিয়ে ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানান জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে কিন্তু তাদের দিব্যি জীবন জীবিকা নির্বাহ করে।

    ◆ সারাদিন খাটুনির পর সন্ধ্যাবেলা মহুল ও সিমুলের তলায় বসে হাঁড়িয়া খেত আর মাতাল হয়ে মেয়ে-মরদ একে অপরের কোমর জড়িয়ে নাচ আর গান গাইতে থাকে।

    ◆ সেই প্রাণ খোলা আনন্দের মুহূর্ত গুলো চোখে না দেখলে কথাকথিত আধুনিক সভ্য সমাজের মানুষেরা অনুভব করতে পারবে না। সেই সব আনন্দের দিনগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে।

    ◆ অখন্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের
    ইতিহাসের পাতায় সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল অতিপরিচিত ঘটনা। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে একজোট হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, পুরুলিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ গুলো।

    ◆ সিধু, কানু, চান্দ ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হয় বটে কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে গেল। অধিকার সচেতনতার লড়াইয়ের জন্ম নেয়। পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর এক বিদ্রোহ শুরু হয়।

    ◆ ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রথম বিদ্রোহ আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী শুরু করেন। পরবর্তীতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নেতার আবির্ভাব ঘটেছে।

    ◆ অখন্ড ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত ভারত বর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষে সেই আদিবাসী ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কতটুকু রাষ্ট্রীয় ভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। তাদের কি কোন উন্নয়ন হয়েছে?
    ভারত সরকারের উদ্যোগে তাদের খাদ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে কি?

    ◆ পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, উত্তর
    ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড অব্দি বিস্তৃত অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন।

    ◆ আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগেই তারা ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া যায়। সেই অস্ট্রিক গোষ্ঠীরই উত্তরাধিকারী বর্তমানের সাঁওতাল উপজাতি। সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ।। ঝিয়ের কাজের প্রতিবাদ ।।

    ◆ পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠী এলাকার জামবনির গ্রামের কুঁইরি পাড়ার শিবে কুঁইরির মেয়ে লাজবতী কুঁইরি, সকালবেলা উঠানে বসে শীতের ঝলমলে মিষ্টি মিষ্টি রৌদ্রের তাপে পিঠ দিয়ে দুলে দুলে ক্লাস সেভেনের পাঠ্য বই থেকে সামন্ত রাজার ইতিহাস পড়ে মুখস্ত করতে বাস্ত।

    ◆ কিশোরী লাজবতী কিছু সময় পড়াশোনা করার পর ভাবে মনে মনে :- 'মা, বাবুপাড়ার দে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। কাজের বিনিময়ে ফেলে দেওয়া বাসি পান্তা খাদ্য ও মাসের শেষে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়। যে টাকা দেয় তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ভাত খাওয়া হয় না।

    ◆ ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মায়ের শরীর টা একদম ভেঙে গিয়েছে। মায়ের শরীরে মাঝে মধ্যেই জ্বর আসে। আর জ্বর আসলে মা তালপাতার ঘরের বারান্দায় খেজুরের পাটিতে একা একা চুপচাপ শুয়ে থাকে। অভাবের সংসারে টাকার জন্য মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে না। এই এলাকার মধ্যে বহু গ্রাম থাকা সত্ত্বেও কোন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই।

    ◆ আছে শুধু, রাজনীতির বড় বড় বক্তৃতা আর প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ভোট আদায় করা। ভোট চলে গেলে আমাদের মত হতদরিদ্র মানুষের কথা কোন রাজনৈতিক নেতাদের মনে থাকেনা।

    ◆ বাবা বলেছেন; স্বাধীনতার বহু বছর পরে রাজ্যের জনগণ পুরনো শাসক কে বাদ দিয়ে অনেক আশা ভরসা নিয়ে নতুন সরকার গঠন করে। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এলাকায় কোন উন্নয়ন হয়নি।

    ◆ বইকে পড়ি শিক্ষা নাকি জাতির মেরুদন্ড কিন্তু বাস্তবে আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অনেক দূরে বাবুদের ছেলে মেয়ের স্কুলে আমাদের যেতে হয়। আমরা নাকি অস্পর্শ জাতি ছুঁয়ে দিলে স্নান করতে হয়। তাই স্কুলের সহপাঠী গণ আমাদের স্পর্শ বাঁচিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সব সময় চলে।

    ◆ আজ মায়ের শরীরে জ্বর এসেছে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই দাওয়াই শুয়ে আছে কিন্তু আজ দে বাড়ির কাজে যেতে পারেননি।

    ◆ দে বাড়ির বড় গিন্নি লোক মারফত বহুবার খবর পাঠিয়েছে। মায়ের প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, তবুও দে বাবুর গিন্নি সে কথা শুনতে চায় না। টাকা দিয়ে পোষা চাকরানী মরে যাক আর বাঁচো থাক, তা তারা দেখতে চাই না কিন্তু সবসময় তাদের কাজ করে দিতে হবে।

    ◆ লাজবতীর দিদিমা বুড়ি রৌদ্রের তাপে বসে
    ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল।

    ◆ কিশোরী লাজবতী কাছে এসে বই বন্ধ করে দিয়ে দিদিমা বুড়ি বলেন :- এখন পড়াশোনা করতে হবে না। যা বোন দে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাজ গুলো করে দিয়ে আয়।

    ◆ কিশোরী লাজবতী অনিচ্ছাসত্বে বাড়ির দিদিমা একপ্রকার জোর করেই কিন্তু মায়ের অনুপস্থিতিতে ঝিয়ের কাজের জন্য দে বাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

    ◆ কিশোরী লাজবতী দে বাড়িতে গিয়ে পুরানো ফটক ঘেরা বড় উঠান সহ উঠানোর চারিদিকে বড় বড় ঘরের এবং বড় বড় বারান্দা সব জায়গায় ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে সবেমাত্র পা বাড়িয়ে দিয়েছে।

    ◆ ঠিক সেই মুহূর্তে দে বাড়ির বড় গিন্নি বলেন :- লাজবতী কোথায় যাচ্ছি? এখনো কাজ শেষ হয়নি।

    ◆ কিশোরী লাজবতী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

    ◆ দে গিন্নি এক গাদা এঁটো বাসন নিয়ে এসে লাজবতী সামনে রেখে বলেন :- এই বাসন গুলো পরিষ্কার করার পর ভালো করে ধুয়ে মুছে রাখ।

    ◆ কিশোরী লাজবতী প্রতিবাদী কন্ঠ বলে :- আমি; আপনাদের এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না।

    ◆ দে গিন্নি রাগে উত্তেজিত হয়ে বলেন :- কি বললি তুই? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। ছোট জাত হয়ে বড় বড় কথা বলা। তোর মা, তোর দিদিমা, তোর দিদিমার মা ও তোর চৌদ্দগুষ্টি সবাই এই দে বাড়িতে বহু কাল ধরে এঁটো বাসন ধুয়ে ধুয়ে মরে গেছে। এখন তোর মা মরতে চলছে, তাদের মেয়ে হয়ে আমাদের বাড়ির এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না। আমাদের এঁটো খাবার খেয়ে তোরা বেঁচে থাকিস।

    ◆ কিশোরী লাজবতী ভাবে, এই সভ্য সমাজের ধনী মানুষেরা আমাদের মত গরিব মানুষের ছোট জাত বানিয়ে রেখেছে আর চিরকাল শোষণ, শাসন ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

    ◆ দে বাড়ির বড় গিন্নী উত্তেজিত হয়ে বলেন :- কিরে লাজবতী, কানে কথা যাচ্ছে না। দুই ক্লাস লেখাপড়া শিখে বড় অহংকারী হয়ে উঠেছে। আমাদের উপর কথা বলার এত বড় সাহস পেলি কোথায়!

    ◆ দে বাড়ির বড় গিন্নির চোখের দিকে তাকিয়ে লাজবতী বলে :- বললাম তো, আপনাদের এঁটো বাসন ধুয়ে দিতে পারবে না। আপনারা কাজের লোক দেখে নিন আমি চললাম।

    ◆ লাজবতী নিজেকে অপমানিত বোধ অনুভব করে আর নিজের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর রাগে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

    ◆ দে বাড়ির লোকজন সবাই অপমানিত বোধ করে। কিশোরী লাজবতী বাবা শিবে কুইরির কে রাস্তায় পেয়ে কিন্তু লোকজনের মধ্যে অপমান ও বিভিন্ন ভাবে ঝামেলা করতে শুরু করে। ছোট জাত পাত তুলে গালিগালাজ করতে থাকে।

    ◆ সন্ধ্যার সময় মাহাতোদের ধান কাটার পর শিবে কুইরি বাড়িতে ফিরে আসে।

    ◆ শিবের মা তার ছেলের কাছে অভিযোগ করে বলেন :- তোর মেয়ে দুই পাতা পুঁথি পড়ে বড় পন্ডিত হয়ে গেছে, ছোট মুখে বড় বড় কথা বলে। আরে আমরা হলাম ছোট জাত বাবুদের সাথে ঝামেলা অশান্তি করে আমরা কি বাঁচতে পারি?

    ◆ কিশোরী লাজবতী লেখা পড়ার বিষয় সহ প্রতিবাদ করার সাহস দেখে সত্য মিথ্যা শিবের মা তার ছেলের কাছে মহাভারতের সাতকাহন বলতে শুরু করে।

    ◆ লাজবতীর মা হাড়ির মধ্যে ধানের কুড়া দিয়ে আগুন জ্বলে মাঘ মাসের সন্ধ্যায় সময় শীতের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গা-হাত-পা সেঁক দিয়ে শরীরকে গরম রাখার চেষ্টা করছে।

    ◆ কিশোরী লাজবতী ভাবে :- বাবার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বুকে হাত দিয়ে চাপরাছে কারণ বাবুদের কাছে থেকে অপমানিত হয়ে হৃদয়ের মাঝে আগুন জ্বলে উঠেছে।

    ◆ বাবা কখনো উত্তেজিত স্বভাবের মানুষ না কিন্তু আজ ভীষণ ভাবে দুঃখ পেয়েছেন। আমি তো সত্যি কথা বলেছি কিন্তু কতদিন আর বাবুদের দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হবে। আমাদের এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ গুলো কবে বুঝবে লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা।

    ◆ শিবে কুইরি কিছু সময় ধরে অপমানের দুঃখ জ্বালা ভোলার জন্য চোখের জল ফেলতে থাকে। আরো কিছু সময় পর চোখ মুছতে মুছতে তার প্রতিবাদী মেয়ের কাছে এসে বসে।

    ◆ লাজবতী বাবা তার মেয়েকে কাছে নিয়ে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে উচ্চ কন্ঠে বলেন :- লাজবতী তুই যা করেছিস ভীষণ ভাবে ভালো করেছিস। আমি চাই; আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠুক। আর কতকাল এই বাবুদের শাসন শোষণ নির্যাতন সহ্য করবো।

    ◆ তোর মা, তোর মায়ের বংশপরম্পরায় সবাই বাবুদের বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে আসছে। বাবুদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছে কিন্তু তাতে হয়েছে কি? তাতে হয়েছে কি ?

    ◆ বাবুদের কাছে আমরা ছোট জাত কিন্তু তাই বলে আমাদের কি কোন মান সম্মান থাকতে নেই?

    ◆ কিশোরী লাজবতী বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- ঠিকই তো, আমাদের কি কোন মান সম্মান নেই। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নারীদের বাবুরা কোনো মূল্যই দিতে চাই না। অকারণে নারীদের উপর শাসনের নাম করে শোষণ চালিয়ে যায়। দেখে মনে হয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মহিলারা বাবুদের কেনা সারা জীবনের ক্রীতদাসী। বাবুদের ইচ্ছা মত চলতে হবে নিজস্ব স্বাধীনতা বলে কিছুই থাকবে না।

    ◆ বাবা শিবে কুইঁরি ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়ে লাজবতীর হাত ধরে উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে বলেন :- মা লাজবতী, মনে রাখিস তুই কিন্তু পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করার জন্য জন্ম হয়নি। যত বড় লাট সাহেব হোক না কেন; নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কারো কাছে মাথা নত করবে না।

    ◆ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তোকে লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে , তোর থেকে সবাই শিখতে পারবে। না হলে আমাদের মতো দিন দরিদ্র মানুষের ঘরে আছে কি ?

    ◆ এই যে আমার জাত ভাইয়েরা শুনো, আজ একটা পুচকে মেয়ে বাবুদের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করেছে কিন্তু তোমরা যা কোনদিন করতে পারোনি কিন্তু আর ঘুমিয়ে থেকো না প্রতিবাদী হয়ে ওঠো।

    ◆ লাজবতী রাতে ঘরের শত ছিদ্র দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবে :- মেয়েদের কি সমাজের বুকে কোন স্বাধীনতা নেই , না আছে অক্ষর জ্ঞান না আছে মান সম্মান।

    ◆ ছোট থেকে শুনে আসছি মা, কাকিমা, দিদিমা ও বয়স্কদের মুখে মেয়ে মানেই মাটি। দুই দিন পর পরের ঘরে গিয়ে কিন্তু রান্নাঘরে জায়গা হবে, তা লেখাপড়া শিখে কি লাভ হবে?

    ◆ একগাদা সন্তান লালন-পালন করতে করতে আর মাঠে-ঘাটে কাজ করতে করতেই দিন চলে যাবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈদিক নিয়ম অনুসারে স্ত্রী তার স্বামীকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকে কাজ করে সংসার চালাবো।

    ◆ আমাদের জনগোষ্ঠীর সব দায়-দায়িত্ব নাকি মহিলাদের উপর, এটাও একটা চরম অন্যায় কাজ করে চলেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা কিন্তু নারীকে ভোগের সামগ্রী বানিয়ে রেখেছে।

    ◆ এই সংসার চালাতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম সহ বহু নারীদের কে বাবুদের সাথে কত রকম ছলচাতুরি করতে হয়। এমনকি নিজের মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে পর পুরুষের সাথে টাকার জন্য থাকতে হয়।

    ◆ আর বেশিরভাগ পুরুষগুলো সারাদিন মদ মাতাল হয়ে কাটিয়ে দেবে। স্বামীদের কে আবার চুল্লু কেনার পয়সা দিতে হবে কিন্তু উক্ত নারী টাকা কোথা থেকে আনবে সে চিন্তা একবার করে না।

    ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সভ্য সমাজের বাবুরা তাদের উপর ক্ষমতায়ন দেখায়। পুরুষরা এক বোতল বিদেশি মদ হোক আর দেশী লোকাল চুল্লু পেলে কিন্তু মহা সন্তুষ্ট। অন্যায় কাজ হলেও কিন্তু বাবুদের সমর্থন যোগাবে।

    ◆ গাঁয়ের কয়েকজন ভালো মনের বাবুরা বলে, দ্যাখ লাজবতী, মন খারাপ করলেই কিন্তু তুমি হেরে যাবে আর বহু দূর পর্যন্ত পিছিয়ে পড়তে হবে। লোকে যে যা বলে বলুক না কিন্তু এক কান দিয়ে শুনবে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেবে। তোমার পড়াশোনা চালিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য পথে এগিয়ে চলে।

    ◆ কয়েক বছর পর লাজবতীর বাবা এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘ সময় ধরে অসুস্থতার জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে কিন্তু একদিন শরীরের মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়ে।

    ◆ মা ও মেয়ে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তবুও লাজবতী বহু কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন মজুরের কাজ কর্ম করে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে করতে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আসে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ।। শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।।

    ◆ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় পাশের গ্রামে বসবাসকারী জামবনি স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয় লাজবতীর মাটির বাড়িতে এসে লাজবতী লাজবতী লাজবতী লাজবতী ডাকাডাকি করতে শুরু করেন।

    ◆ অনেক ডাকাডাকি করার পর লাজবতীর মা দরজা খুলে মাস্টারমশাই সহ পাড়া প্রতিবেশী লোকজন দেখে হতভম্ব ও আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে :- বাবুরা, আমরা কি কোন অন্যায় করে ফেলেছি! আর মাস্টারমশাই আপনি।

    ◆ মাস্টার মশাই আনন্দিত মনে মাথা নিচু করে কুঁড়ে ঘরে ঢুকে বলেন :- 'মা লাজবতী, তুই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফলাফলে সর্ব প্রথম স্থান অধিকার লাভ করে কিন্তু আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছিস।
    হেড মাষ্টারের কথা শুনে লাজবতী জরাজীর্ণ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।

    ◆ লাজবতী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে :- 'মাস্টারমশাই, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আমার মত অভিভাবকহীন আদিবাসী কালো মেয়ে শুধুমাত্র স্কুলের ক্লাসের মাস্টারের কাছে পড়াশোনা করে প্রথম হতে পারে না। মাস্টার মশাই হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।

    ◆ মাস্টার মশাই লাজবতী মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন :- 'মা, সত্যি তুমি প্রথম স্থান অধিকার করেছো। এই সংবাদ দেওয়ার জন্য ভোরবেলা এসেছি। না হলে আবার কাজে চলে যাও। মা আমি আসছি বলে, ঘরের বাইরে এসে চলতে শুরু করেন।

    ◆ পরীক্ষা পাসের খবর শুনে আনন্দের অশ্রুধারা ঝরতে থাকে মা ও মেয়ের। সকাল বেলায় চাঁদের হাট বসেছে ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরের উঠানের মাঝে।

    ◆ লাজবতী তার অসুস্থ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে :- আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতে ভীষণ খুশি হতো কারণ বাবার উদ্যোগের কারণে লেখাপড়া শিখতে পেরেছি। বলে দুই হাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে স্বর্গীয় বাবার উদ্দেশ্যে কয়েক বার প্রণাম করে।

    ◆ দিনের আলো উদিত হওয়ার পর দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে লাজবতীর মাটির কুড়ে ঘরের উঠানোর মাঝে গ্রামের প্রতিবেশী সহ, অঞ্চল প্রধান, উপ প্রধান, মেম্বার ও রাজনৈতিক দলের নেতারা হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দলে দলে আসতে শুরু করে।

    ◆ লাজবতীর মা এত লোকের আনাগোনা খাবারের প্যাকেট দেখে ভাবে মনে মনে :- বহুদিন যে অনাহারে থেকেছি কিন্তু তখন কেউ তো খোঁজ করেনি। হয়তো রাজনৈতিক কোনো ফায়দা লোটার জন্য নেতারা বাড়ির উঠানে এসেছে। মেয়ের পড়াশোনার জন্য একটা বই খাতা কেউ দিয়েছে।

    ◆ মাধ্যমিকের বই কেনার জন্য কত নেতার পিছনে পিছনে ঘুরতে হয়েছে। তবুও একটা বই কেউ কিনে দেয়নি। তাদের নোংরা প্রস্তাব মেনে নিলে কিন্তু অনেক কিছু পাওয়া যেতে। এই সব স্বার্থবাদী নেতাদের মুখে থু থু থু থু থু থু থু থু।

    ◆ স্কুলের প্রধান মাস্টারের সহযোগিতায় কিছু পুরনো বইয়ের সংগ্রহ করে লাজবতী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে। হে ঈশ্বর তুমি লাজবতী কে রক্ষা করো।

    ◆ প্রথম স্থান অধিকারী লাজবতীর ছবি তোলার জন্য টিভি চ্যানেলের ও দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকগণ ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

    ◆ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন শাসকদলের এক রাজনৈতিক নেতা বলেন :- তোমাদের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়েরা যদি উঠে আসে, তবে ভারতবর্ষ উঠে আসবে।

    ◆ লাজবতী ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলে :- নেতা মশাই; কথাটা ভীষণ সত্যি বলেছেন কিন্তু বাস্তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেয়েদের উঠে আসার রাস্তা যে এখনো আপনারা তৈরি করে দেননি।

    ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক ভাবে নিচু জাত বানিয়ে রেখেছে।

    ◆ নিচু জাত বলে আমাদেরকে সবসময় অবহেলিত করে নিচের দিকে ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু কেন?
    ◆ আমাদের জনগোষ্ঠী কি ভারতবর্ষের নাগরিক নয়?
    ◆ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবো না।

    ◆ খাড়া পাহাড়ে ওঠা সহজ নয়, উঠতে হলে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয় আর শরীর ও মনের জোর আর বিশ্বাস চাই।

    ◆ একটি দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক বলেন :- আপনার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

    ◆ লাজবতী ভাবে সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ের ঘটনা ছাড়া আমার আর কিছু মনে আসছে না। দে বাড়ির ঘটনা উল্লেখ করে বলতে শুরু করে। ঘটনা শেষ হওয়ার পরে চারিদিকে হাততালি পড়তে থাকে।

    ◆ টিভি সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে বলে :- তুমি যে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বপ্রথম হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তোমার পড়াশোনার জন্য উদ্যোক্তা সবচাইতে বেশি কে ?

    ◆ লাজবতী বলে :- আমার বাবা আমার পড়াশোনা করার জ্ঞানের আলোর বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা কে কিন্তু বাবুদের কাছে বহু অপমানজনক কথা বার্তা শুনতে হয়েছে।

    ◆ প্রথম যেদিন দে বাবুদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজের এঁটো বাসন ধোয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম।

    ◆ সেই দিন আমার বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিল :- লাজবতী; তুই ঠিক করেছিস আর কতকাল বাবুদের এঁটে বাসন ধুয়ে বেড়াবে আমাদের জাতির মানুষেরা, তোকে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে হবে।

    ◆ আজ আমাদের কুড়ে ঘরে অপ্রত্যাশিত সূর্যের আলো দেখে কিন্তু বাবা বেঁচে থাকলে ভীষণ খুশি হতেন।

    ◆ যখন আমি প্রথম লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছোট জাত বলে সমাজের উচ্চ জাত নামধারী বাবুরা আমাকে সহযোগিতার বদলে করেছিল অবহেলা ও অপমানজনক কথা বার্তা। সেই কথাগুলো আমি আজও ভুলতে পারি।

    ◆ আজ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছি বলে ছোট জাতের তালপাতার কুঁড়েঘরে লোকে-লোকারণ্য হয়েছে কিন্তু কেন ?
    আমাকে দেখিয়ে রাজ্যের মান বাড়ানো আর উন্নয়নের নামে নেতাদের বাড়বাড়ন্ত।

    ◆ আমাদের সুখ দুঃখের খবর কয়জন রাখে। আজ বড় বড় ক্যামেরা নিয়ে বলছেন, অনেক বড় বড় কথা, দুদিন পরে হারিয়ে যাবে আমাদের কুঁইরি সমাজের মানুষেরা সব কথা। স্মৃতির পাতায় শুধু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে কুঁইরি পাড়ার মানুষগুলো।

    ◆ লাজবতী ভাবছে :- আমাদের তালপাতা দিয়ে ঘেরা কুড়ে ঘরে কত মানুষ আসছে। মন্ত্রী আসবে বলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আবার অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।

    ◆ কয়েক দিন পর শীতের দুপুরে রৌদ্রের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের পাহারায় লাল মাটির ধুলা উড়িয়ে লাজবতীর মাটির কুড়ে ঘরের সামনে মন্ত্রীর গাড়ি বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে আসে। শিক্ষামন্ত্রী সহ আরো রাজনৈতিক নেতাগণ গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।

    ◆ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তার দামী গাড়ি থেকে নেমে বলেন :- লাজবতী কুঁইরি কোথায় ?

    ◆ লাজবতী তার অসুস্থ মায়ের হাত ধরে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে আর হেড মাষ্টারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

    ◆ হেডমাস্টার মশাই বলেন :- প্রণাম কর লাজবতী প্রণাম কর।

    ◆ লাজবতীর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে মন্ত্রীমহোদয় বলেন :- তুমি, দিন মজুরের কাজ কর্ম করে সংসার চালিয়ে বহু কষ্টে মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। শুনি ভীষণভাবে আনন্দিত হলাম তাই তোমাকে দেখতে চলে এলাম। তোমাদের সত্যিই ভীষণ দারিদ্র্য অবস্থা কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা আমাদের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অঞ্চল প্রধান কোথায়।

    ◆ অঞ্চল প্রধান তাড়াহুড়ো করে মঞ্চের উপরে উঠে আসে।

    ◆ লাজবতী দিকে তাকিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন :- তুমি; এখনো ঘর পাওনি বলে পাশে থাকা অঞ্চল প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার অঞ্চলের হত দারিদ্র্য মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে। তা না করে আপনি ভীষণভাবে সর্বহারা মানুষের যুক্তফ্রন্ট পার্টির সুনাম নষ্ট করেছেন। লাজবতী যদি ঘর না পাই তবে পাবে কে?

    ◆ তারপর লাজবতীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমাদের মত মেয়েরা যাতে উঠে আসে, তার জন্যই তো আমাদের পার্টি ও তোমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য সরকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

    ◆ একজন জেলা পর্যায়ে আদিবাসী নেতা মন্ত্রীর কানে কানে কিছু বলে আর মন্ত্রী চুপচাপ হয়ে যায়।

    ◆ কিছু সময় পর মন্ত্রী মহোদয় দশ হাজার টাকার চেক লাজবতীর হাতে দিয়ে বলেন :- লাজবতী, তোমাকে আমরা আরও ফুলের মালা দিয়ে বড় মঞ্চ তৈরি করে সংবর্ধনা জানাবো। আরো অনেক টাকা তুলে দেবো। এই টিভির লোক গুলো ক্যামেরা এদিকে নিয়ে এসে ভিডিও করুন।

    ◆ মন্ত্রী চেক প্রদান করছেন উন্নয়নের জন্য চারিদিক থেকে ছোট-বড় নানা ধরনের ক্যামেরা ঝলসে ওঠে আলোয়।

    ◆ লাজবতী ভাবে :- বাপের সেই গাম্ভীর্য মুখ খানা অন্তর থেকে বাবা বলেন:- না, না লাজবতী টাকা নিবি না।

    ◆ লাজবতী চিৎকার করে উঠে বলে :- না, না এই টাকা আমি নিতে পারবো না আর আপনারা আমাকে যে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেবেন, তাও আমার লাগবে না।

    ◆ হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো লাজবতীর মুখে কথা শুনে মন্ত্রী ঢোক গিলতে শুরু করে এবং একদম নিস্তব্ধ পরিবেশ হয়ে যায়।

    ◆ লাজবতী ভাবে মনে :- মা, যে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন, সেই দে বাড়ির গিন্নির বড় ছেলে এখন পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বড় নেতা। এঁটো বাসন ধুতে পারবো না বলে প্রতিবাদ করেছিলাম কিন্তু বাবা কে করেছিল মানুষের মাঝে অপমান সেই দিনের কথা গুলো এখনো ভুলিতে পারি নাই।

    ◆ দে বাড়ির বড় গিন্নির বড় ছেলে স্থায়ী এলাকার বড় নেতা ভিড় ঠেলে লাজবতীর কাছে এসে বলে :- কেন রে কি হয়েছে! লাজবতী টাকা নিবি না? তুই তো একদিন আমাদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতিস?
    বল তোর আর কি কি লাগবে ? ভালোভাবে খুলে বল সব দেবে আমাদের সর্বহারা পার্টি।

    ◆ লাজবতী চিৎকার করে বলে :- এই রাজ্যের মধ্যে আমার মতো হাজার হাজার কুঁইরি মেয়ে লাজবতী আছে। আমি শিবে কুইরির মেয়ে অজপাড়াগাঁয়ের মধ্যে বসবাস করি।
    এই পাড়ার কঁইরি ছেলে মেয়েরা যতদিন অন্ধকারে পড়ে থাকবে, যতদিন লেখাপড়ার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়-ততদিন কোন বাবুর ও মন্ত্রীর দয়া আমার লাগবে না। শুনেছেন আপনারা আমার কোন দয়া লাগবে না।

    ◆ মন্ত্রী বলে :- কেন, মা তুমি রাগ করছো ?

    ◆ লাজবতী বলে :- আমার বাবা বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরে গিয়েছে। আমার মায়ের মতো শত শত মা এই গ্রামে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কিন্তু নিম্নতম প্রাথমিকভাবে তাদের কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এই গ্রামে কোন স্কুল নেই অন্য কোন গ্রামে গিয়ে বাবুদের হাতে পায়ে ধরে তাদের ইচ্ছা মত পড়াশোনা করতে হয়।

    ◆ কিন্তু কেন আমাদের জনগোষ্ঠীকে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন!
    ◆ সরকারের স্কুল আমাদের গ্রামে কি প্রয়োজন নেই।
    ◆ সর্বহারা মানুষের জন্য নাকি আপনাদের দল কিন্তু ক্ষমতায়নের পর সর্বহারা মানুষের জন্য কি করেছেন?
    ◆ রাজ্যের অন্যান্য জেলার ছেলেমেয়েরা শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছু পেয়ে থাকে কিন্তু আমাদের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল গুলোতে পাই না কেন?
    ◆ আর লোক দেখানো চেক দিয়ে আমি কি করব?
    ◆ আপনারা ভালই জানেন আদিবাসী মানুষের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই আর চেক ভাঙ্গাতে পারবে না। এটাও কি আপনাদের রাজনীতির খেলা?

    ◆ যদিও অন্যের একাউন্টে জমা দেওয়া হয়, তাহলে হনুমানের মত রুটি ভাগ করতে করতে আমার ভাগে আর কিছু থাকবে না।

    ◆ আপনারা রাজ্য পার্টির বড় নেতা ও মন্ত্রী। কেমন রাজ্য পরিচালনা করেন ?

    ◆ লাজবতী কে থামানোর জন্য এক নেতা অনুরোধ করে।

    ◆ মাহাত বাবুর দিকে তাকিয়ে লাজবতী বলে :- আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এই জেলার বড় নেতা মাহাত বাবু কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর জন্য আপনি কি করেছেন?

    ◆ মাওবাদীদের দমন আইনের আওতায় পড়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য শাসক দলে যোগদান করেন। তারপর আদি জনগোষ্ঠীর কথা বাদ দিয়ে নিজের আখের গোছানোর ব্যবস্থা করে চলেছেন।

    ◆ আমি মাথা গোঁজার ঘর পায় না আর আপনি নিজে তো বড় বড় বাড়ি তৈরি করে জমি জমা ব্যবসা-বাণিজ্য আরো বড় করে তুলেছেন।

    ◆ আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বার্থনেশী মানুষগুলো আমাদের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    ◆ তারপর মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে লাজবতী বলে, এইতো আপনার সর্বহারা পার্টির হালচাল।

    ◆ গরিব মানুষকে শোষণ না করলে কিন্তু কেউ কোনদিন বড়লোক বা ধনী ব্যক্তি হতে পারে না।

    ◆ খাতা কলমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে না। তাহলে উন্নয়নের টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়?

    ◆ আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছি বলেই, ভোট পাওয়ার আশায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের নাম করে আমাদের কে সান্তনা দিতে এসেছেন।

    ◆ এতদিন কোথায় ছিলেন? যখন বই খাতার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছিলাম না, বিদ্যালয়ে গিয়ে বার বার অপমানিত হতে হয়েছে।

    ◆ হাই স্কুলের হেডমাস্টার মহাশয় কে আমার শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই কারণ তার সহযোগিতায় আমি মাধ্যমিক পাস করতে পেরেছি।

    ◆ দে বাড়ির বড় গিন্নির বড় ছেলে এলাকার বড় নেতা হয়ে, জনসমুদ্রের মাঝে শিবে কুইরির মেয়ে লাজবতী কে ঝিয়ের কাজের অপবাদ দিয়ে কিন্তু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অপমান করলো কেন?

    ◆ আমাদের কুঁইরি সমাজের মানুষেরা চিরকাল হতদরিদ্র আর অশিক্ষিত হয়ে থাকবে কি?

    ◆ আপনারা শিক্ষিত সমাজের মানুষ হয়ে আমাদের উন্নয়নের জন্য কি করেছেন?

    ◆ না করেছেন একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, না করেছেন গ্রামের কোন উন্নয়ন, না কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

    ◆ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের টাকা গুলো আত্মসাৎ করেছেন।

    ◆ আমাদের মত হতদরিদ্র ব্যক্তি হয়ে আজ পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতা, গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার ও এলাকার নেতা হলে লাখপতি আর কোটিপতি হয়ে যায় কি করে?

    ◆ আমাদের এলাকার অঞ্চল প্রধান হওয়ার পর তার বাড়ি দোতলা আর আমার বাড়ি তালপাতার কুঁড়েঘর তা চোখে দেখতে পায় না।

    ◆ প্রতিবাদ করতে গেলে তার কন্ঠ রোধ করে তার উপর মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জেল আর নির্যাতন। এই তো হলো রাজনৈতিক খেলা।

    ◆ যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গৌরব করছেন কিন্তু এখনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজের ছেলেমেয়েদের স্কুলে গেলে কোন মূল্যায়ন করা হয় না।

    ◆ শিশু কালে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছি, স্কুলের বারান্দায় বসে বসে আমাদের ছোঁয়া নাকি স্নান করতে হয়।

    ◆ যদি কিছু করার সৎ ইচ্ছা থাকে তাহলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজের উন্নয়নের জন্য কিছু করুন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন আর বাসস্থান দিতে হবে না।

    ◆ লাজবতী হাত জোড় করে বলে, মন্ত্রী মহোদয় আমার জন্য আপনার কিছুই করতে হবে না। আমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হলে আরো লড়াই চালিয়ে যাবো।

    ◆ নেতা ও মন্ত্রীদের মুখে আর কোনো কথা নেই। মন্ত্রীমহোদয় গভীর চিন্তায় মুখ কালো করে ভাবতে থাকে। বাস্তবে উন্নয়ন না করে উন্নয়নের কথা বলে বেশিদিন রাজনীতি চলে না। এর মধ্যে যে আগুনের লেলিহান শিখা জেগে উঠেছে তা ধপ করে নেভানো যাবে না।

    ◆ একটা কিছু অবশ্যই করে দেখাতে হবে। লেখাপড়া শিখে মানুষ গুলো প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। এখন থেকে নতুন ভাবে রাজনীতি শুরু করতে হবে।

    ◆ লাজবতী মাথা ঝাড়া দিয়ে দ্রুত পায়ে মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসে আর মায়ের হাত ধরে ভাঙ্গা কুড়ে ঘরের দিকে চলতে থাকে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ।। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ।।

    ◆ লাজবতীর কলেজ চলাকালীন সময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে বিদ্যালয়ের বয়স্ক ইতিহাস শিক্ষক অশোক মহাশয় লাজবতী কে কাছে ডেকে নিয়ে "আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস" মূলক প্রবন্ধের বই হাতে দিয়ে বলেন :- এই বইটি মন দিয়ে পড়বে আরো বই সংগ্রহ করে দেবো। তোমাকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে হবে। পড়াশোনা করার মাধ্যমে তোমার সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে।

    ◆ লাজবতী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা ও কিছু বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্যে গবেষণা শুরু করে।

    ◆ প্রাচীনকাল থেকে সর্বপ্রথম এই
    ভারতবর্ষের ভূখণ্ডে যে জনগোষ্ঠী বসবাস করত, তাদেরই “আদিবাসী” জনগোষ্ঠী বলা হয়ে থাকে। আদিবাসী শব্দ কথাটিরই অর্থ হল আদি বাসিন্দা বা সর্বপ্রথম বাসিন্দা।

    ◆ বর্তমানে প্রায় সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী হয়ত Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত হননি, তাঁরা অন্তর্ভুক্তর জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

    ◆ আদিবাসী জনগণ কে প্রাথমিক দিকের
    প্রথম জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ ও উপজাতি প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।

    ◆ যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তারাই আদিবাসী। নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি।

    ◆ পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের ৪০টির বেশি দেশে বসবাসরত প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ কোটি।

    ◆ নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ায় যুগে যুগে এদের অনেকে প্রান্তিকায়িত, শোষিত, বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত হয়েছে এবং যখন এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে তারা কথা বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা দমন নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে।

    ◆ এক সময়ে উত্তর ভারত থেকে প্রশান্ত
    মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড অব্দি বিস্তৃত ছিল অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ। নাক চওড়া ও চেপ্টা, গায়ের রং কালো এবং মাথার চুল ঢেউ খেলানো। আনুমানিক ত্রিশ হাজার বছর আগেই তারা ভারত থেকে অস্ট্রোলিয়া যায়। সেই অস্ট্রিক গোষ্ঠীরই উত্তরাধিকারী বর্তমানের সাঁওতাল। খুব সম্ভবত সাঁওত বা সামন্তভূমিতে বাস করার কারণে সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়ে পড়েছে।

    ◆ যুগের ব্যবধানে ভারতের ভূমিতে এসেছে আর্য, গ্রীক, আরব এবং মোঙ্গলদের মতো অজস্র জাতি। সেই অর্থে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন দেশের বহিরাগত। এদের কেউ কেউ নিজেদের কে মহাভারতে বর্ণিত বীর একলব্যের বংশধর মনে করেন। তবে তাদের উৎস এবং আদি নিবাসভূমি সম্পর্কে বলতে বহুল প্রচলিত এক লোককথাকে ‍গুরুত্ব দেয়া হয়।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ।। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্মের ইতিহাস।।

    ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে। "সাঁওতাল পুরাণ" নামক গ্রন্থে হাঁস ও হাঁসিল গল্প থেকে জন্মের ইতিহাস জানা যায়।

    ◆ সেই মুহূর্তে পৃথিবী নামক গ্রহের জন্ম হয়নি কিন্তু শুধু জল আর জল। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে কাহিনী।

    ◆ একদিন চন্দ্রের কন্যা স্নান করতে এসে শরীরের ময়লা থেকে সৃষ্টি করলেন হাঁস এবং হাঁসিল নামে দুটি পাখি। বহু বছর জলের উপর ভেসে থাকার পর একদিন তাদের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের (ঠাকুর জিউ) নিকট খাবারের জন্য প্রার্থনা জানাই। তাদের প্রার্থনা শুনে ঈশ্বর অর্থাৎ ঠাকুর জিউ পৃথিবী সৃষ্টির মনস্থ করলেন। ভাবলেন সৃষ্টির জন্য মাটির দরকার কিন্তু মাটি রয়েছে সমুদ্রের তলদেশে।

    ◆ জলচর প্রাণী বোয়াল কে ডাকা হল। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নির্দেশ দিলেন, সমুদ্রের তলা থেকে মাটি নিয়ে আসার কিন্তু প্রথমে বোয়াল ও তারপর কাকড়া মাটি আনতে ব্যর্থ হলে।

    ◆ কেঁচো নামক এক প্রাণী এগিয়ে এলো। কচ্ছপ কে জলের উপর ভাসতে বলে কেঁচো নিজে লেজ রাখল তার পিঠে। তারপর কেঁচো মাটি খেয়ে তা লেজ দিয়ে বের করে কচ্ছপের পিঠে রাখতে শুরু করে। এই ভাবে দীর্ঘ হাজার হাজার বছর ধরে চেষ্টার ফলে পৃথিবীর জন্ম নিল।

    ◆ সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর অর্থাৎ ঠাকুর জিউ নরম মাটিকে শুকনো করার জন্য পৃথিবীতে ঘাস শাল ও মহুয়া সহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ রোপন শুরু করলেন।

    ◆ আরো কিছুদিন পর মেয়ে পাখিটা দুটি ডিম দিল এবং নয় মাস দশ দিন পর ডিম পরিপুষ্ট হয়ে উঠে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ডিম ফেটে যায়। জন্ম হয় একজন পুরুষ পিলচু হাড়াম ও একজন নারী পিলচু বুড়ি।

    ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ি পৃথিবীর প্রথম নর নারী। হিহিড়ি-পিহিড়ি নামক স্থানে তারা বসবাস করলে লাগলো।

    ◆ ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাদের দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয় ও মিলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় সাতটি পুত্র ও আটটি কন্যা।

    ◆ ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) এবার পিলচু হাড়ামকে পুত্রদের নিয়ে সিংবীরে ও পিলচু বুড়িকে কন্যাদের নিয়ে মানবিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। ঈশ্বরের (ঠাকুর জিউ) আদেশ পালিত হলো দ্রুত গতিতে।

    ◆ দীর্ঘ কয়েক বছর পর শিকার করতে করতে ভুলক্রমে সাত পুত্র এক বিলের ধারে চলে আসে। সেখানে শাক তুলছে আট কন্যা। পরস্পরকে দেখে আকর্ষিত হলো। ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণ গড়ালো দৈহিক মিলনের পর্যায়ে। ছোট কন্যাকে বাদ রেখে দেয়। ভাইদের মধ্যে যে বড় সে বড় বোনকে এইভাবে সাত জন পুরুষ সাত জন নারীকে গ্রহণ করে।

    ◆ সেই সাত পুত্র থেকে জন্ম নিলো সাতটি বংশ- হাঁসদা, মূর্মূ, কিস্কু, হেমব্রোম, মারাণ্ডি, সোরেন এবং টুডু। তখন থেকেই মূলত গোত্রপ্রথা এবং বিয়ে প্রথার শুরু হয়।

    ◆ তারপর তারা খোজা-কামান দেশে গিয়ে বসবাস করতে লাগলো। নৈতিক অবক্ষয়, অন্যায় ও অত্যাচারে লিপ্ত হবার কারণে ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) তাদের উপর রুষ্ট হয়ে পড়ে।

    ◆ সাতদিন সাতরাত টানা অগ্নি বৃষ্টির মাধ্যমে পিলচু হাড়াম ও পিলচু বুড়ির বংশধরদের ধ্বংস করে। হারাতা পর্বতে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গেলো পিলচু হাড়াম এবং পিলচু বুড়ি। ধ্বংসলীলার শেষে প্রথমে সাসাংবেদা এবং পরে চায়চাম্পাতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং ঈশ্বর (ঠাকুরজিউ) আবার সন্তানাদি দান করলেন।

    ◆ বর্তমান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর
    সামাজিক অবস্থান। সমাজ ও বিচারের কাঠামো। বহু যুগ যুগ ধরে হিন্দু এবং মুসলিমদের সাথে বসবাস করার পরেও সাঁওতালরা তাদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য হারায়নি। বস্তুত রাষ্ট্রীয় বিধানাবলির চেয়ে সামাজিক প্রথার প্রতি তাদের আনুগত্য অধিক। তার অন্যতম প্রমাণ বিচারব্যবস্থা।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ।। সাঁওতাল গ্রাম পঞ্চায়েতের নিয়ম।।

    ◆ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজস্ব ভাবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু আছে। সাঁওতাল গ্রামের বিশেষ পাঁচজনকে নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয়। গ্রাম পঞ্চায়েতের পদ গুলো হলো, মাঝি হাড়াম বা গ্রামপ্রধান, পরাণিক, জগমাঝি, গোডেৎ এবং নায়েকে। আবার কয়েকটি গ্রামের প্রধানদের নিয়ে গঠিত হয় পরগণা পঞ্চায়েত। এর প্রধানকে বলা হয় পারগাণা। এর থেকেও বৃহত্তর ব্যবস্থা দেশ পঞ্চায়েত। সাঁওতাল সমাজের দেশ বলতে নির্দিষ্ট এলাকাকে বোঝানো হয়।

    ◆ সাধারণত দেশপ্রধানের অধীনে পাঁচ থেকে ছয় জন পারগণা ও মাঝি হাড়াম থাকতে পারে। এই তিন স্তরের বিচারব্যবস্থার বাইরে ল’বীর বা সুপ্রিম কোর্ট আছে। জটিল বিষয়াদি নিয়ে বছরে মাত্র একবার এই আদলত বসে।

    ◆ সাঁওতালদের একটি বৈঠক। মাঝি হাড়াম বলতে গ্রামপ্রধানকেই বোঝানো হয়। শুধু বিচারিকভাবে না, সার্বিকভাবে গ্রামের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তার সহায়ক হিসেবে বাকি পদগুলো সৃষ্ট।

    ◆ পরাণিক পালন করে সহকারি গ্রাম প্রধানের দায়িত্ব। মাঝি হাড়াম অসুস্থ কিংবা অনুপস্থিত থাকলে তার দায়িত্ব বর্তায় পরাণিকের উপর। জগমাঝি পালন করে উৎসব তদারকির ভার। সেই সাথে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা তার মাধ্যমেই নিজেদের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে। সে হিসেবে তিনি যুব প্রতিনিধি। গোডেৎ এর কার্যাবলী অনেকটা চৌকিদারের অনুরূপ। আর নায়েকে বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজা উপলক্ষে বলি দেওয়ার মতো বিষয়ের দায়িত্ব পালন করে।

    ◆ স্থানীয় সমস্যাগুলো মীমাংসা করা হয় গ্রাম পঞ্চায়েতে। গ্রাম পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো পরগণা পঞ্চায়েতে উত্থাপিত হয়। দেশ পঞ্চায়েতে উঠে পরগণা পঞ্চায়েতে অমীমাংসিত সমস্যা। সবার শেষে স্থিত ল’বীরের মুঠোতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ গোত্র বিন্যাস।◆ ◆

    বাংলার আবহাওয়াই গোত্রব্যবস্থার অনুকূল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রে বিভক্ত হিন্দু সমাজের দেখাদেখি এখানকার মুসলমান সমাজও বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল সৈয়দ, শেখ, পাঠান ও দেশি মুসলিম হিসেবে। তবে তাদের কারোরই প্রভাব সাঁওতাল সমাজে পড়েনি।

    ◆ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মধ্যে বসবাসকারী সাঁওতাল সমাজ মূলত ১২টি ভাগে বিভক্ত। তারা হলো- কিস্কু, হাঁসদা, মূর্মূ, হেমব্রম, মারণ্ডি, সোরেন, টুডু, বাস্কি, গুয়াসোরেন, বেসরা, পাউরিয়া এবং চোঁড়ে।

    ◆ পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০ আদিবাসী গোষ্ঠী আছে। ভারতে প্রায় ৭০০ এরও অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। পশ্চিমবাংলায় মোট ৪০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে Scheduled Tribe বা তপশীলি উপজাতি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ দৈনন্দিন জীবনাচার।◆ ◆

    সাঁওতালদের খাদ্যতালিকা বাঙালি হিন্দু কিংবা মুসলমানের খাদ্যতালিকার মতোই। ভাত, মাছ, মাংস নিরামিষ কিংবা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক পিঠা তাদের খাবার হিসেবে বিদ্যমান।

    ◆ নেশা জাতীয় খাদ্যের মধ্যে হাড়িয়া বা ভাত পচানো মদ প্রধান। এছাড়া ভাঙ, তাড়ি, হুকা এবং গাঁজা আছে। অনেক মেয়ে হাড়িয়া ও ধূমপানে অভ্যস্ত থাকলেও সব সাঁওতাল ধূমপান করে না। অতি ‍উৎসাহী অনেকেই তাদের খাদ্যাভ্যাসে কাঠবিড়ালী, গুইসাপ এবং কাঁকড়ার নাম উল্লেখ করেন।

    ◆ গরীব পুরুষদের প্রধান পরিধেয় নেংটি। পোশাকটি একসময় বাংলার অধিকাংশ মানুষই পরিধান করতো বলে এখনো পরিচিত। তবে স্বচ্ছলদের মধ্যে সাধারণ পোশাক হিসাবে ধুতি এবং পাগড়ি বেশ জনপ্রিয়।

    ◆ আধুনিক শিক্ষিতরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের অনুরূপ প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি ও পায়জামা প্রভৃতি পরিধান করে। মেয়েদের পোশাক মোটা শাড়ি বা ফতা কাপড়। তবে স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাঙালি মেয়েদের মতোই শাড়ি, ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরে।

    ◆ ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সাঁওতাল নারী ও পুরুষ। সাঁওতাল রমণীগণ সৌন্দর্য সচেতন। স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন না থাকলেও গলায় হাঁসুলি, মালা ও তাবিজের ব্যবহার দেখা যায়।

    ◆ এছাড়া কানে দুল, নাকে নথ ও মাকড়ী, সিঁথিতে সিঁথিপাটি, হাতে বালা, চুড়ি এবং বটফল, বাহুতে বাজু, কোমরে বিছা, হাতের আঙুলে অঙ্গুরী, পায়ের আঙুলে বটরী প্রভৃতি অলঙ্কার বেশ জনপ্রিয়। কখনো খোঁপায় ফুল গুঁজে, কখনো কাঁটা ও রঙিন ফিতা দিয়ে চুল বাঁধা হয়। দরিদ্র মেয়েরা বিশেষ প্রকার মাটি ব্যবহার করে শরীর মাজতে, যা নাড়কা হাসা নামে পরিচিত।

    ◆ ক্ষুদ্রাকার ঘরগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন। নিম্নাংশ রঙিন করা ছাড়াও দেয়ালে আঁকা হয় নানা রঙের ছবি। বাসায় আসবাবপত্রের আধিক্য নেই। কাঠ, বাঁশ ও পাট ব্যবহারের প্রাচুর্য দেখা যায়। তীর ধনুক ও টোটা প্রায় সব সাঁওতাল বাড়িতেই আছে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ উৎসব-অনুষ্ঠান সাঁওতাল সমাজ উৎসব প্রধান। ◆

    সাধারণত দুই ধরনের উৎসব দেখা যায়। জন্ম-বিবাহ ও মৃত্যুকেন্দ্রিক উৎসব এবং পার্বণিক উৎসব। সব অনুষ্ঠান ঝাঁকঝমকপূর্ণ না হলেও বিয়ে ও পার্বণিক অনুষ্ঠানগুলো ঘটা করে পালিত হয়।

    ◆ বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মতো সাঁওতাল শিশু জন্মের পাঁচ কিংবা পনেরো দিনে অনুষ্ঠিত হয় অন্নপ্রাশন। এছাড়া নামকরণ, কানে ছিদ্র করা এবং সিকা দেওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় উৎসব। সিকার বদলে মেয়েরা ব্যবহার করে ঈশ্বরের চিহ্ন।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ সাওতাল সমাজের বিয়ের নিয়ম। ◆ ◆

    সাঁওতাল সমাজে চার ধরনের বিয়ের ব্যবস্তা প্রচলিত আছে। অভিভাবকের পছন্দ মাফিক বিয়ে হলে তাকে বলা হয় ডাঙ্গুয়া বাপ্লা বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে। আগে থেকে বিদ্যমান প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে সেই বিয়েকে বলা হয় আঙ্গির বা প্রেমঘটিত বিয়ে।

    ◆ এছাড়া আর দুই প্রকারের বিয়ে হলো অ-র বা বলপূর্বক বিয়ে এবং ইতুত বা কৌশলে বিয়ে। অ-র বিয়েতে কোন তরুণ তার পছন্দের তরুণীকে জোর করে সিঁদুর পরিয়ে দেয়।

    ◆ পরবর্তীতে বৈঠক ডেকে তরুণীর মতামত নেওয়া হয়। তরুণী হ্যাঁ বললে কিছু করার থাকে না কিন্তু না বললে তরুণকে দণ্ডিত করা হয়।

    ◆ ইতুত বিয়েটাও প্রায় কাছাকাছি। শুধু এক্ষেত্রে তরুণ সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে সিঁদুর পাতা গ্রামপ্রধানের কাছে জমা দেয়। গ্রামপ্রধান যুবতীর মত জানতে চান। হ্যাঁ হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলে ধরা হয়।

    ◆ সাঁওতাল সমাজে পণপ্রথা প্রচলিত আছে। তবে তা খুবই নগণ্য। সর্বনিম্ন ১২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা। বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে তিনটা কাপড় প্রদান করে। কনের দিদিমা কে দেয়া শাড়িকে বলা হয় বোঙ্গা শাড়ি। বাকি দুটি পায় কনের পিসিমা এবং মা।

    ◆ বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। বিধবাকে সেই সমাজে বলা হয় ‘রাণ্ডি’। অন্যদিকে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রাপ্তা মেয়েদের বলা হয় "ছাডউই"।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ সাঁওতাল সমাজের অনুষ্ঠানাদি। ◆ ◆

    মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য পালিত হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। সাঁওতালর মৃতকে কবর দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।

    ◆ ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ কথাটা সাঁওতাল সমাজের জন্য আরো বেশি করে সত্য। বাংলা ফাল্গুন মাসে উদযাপিত হয় নববর্ষ। চৈত্রমাসে বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখে হোম, জ্যৈষ্ঠ মাসে এরোয়া, আষাঢ়ে হাড়িয়া, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিনে দিবি, কার্তিকে নওয়াই এবং পৌষ মাসে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। ধর্ম-কর্ম, উৎসব-অনুষ্ঠান সবকিছু কে ঘিরে থাকে নৃত্য আর গান।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ ধর্ম-কর্ম।◆ ◆

    সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণ লিপি নেই; ধর্ম আছে, কিন্তু লিখিত কোন ধর্মগ্রন্থ নেই। মানুষের মুখে মুখে শ্রুতি হিসাবে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে।

    ◆ ধর্মের আদি দেবতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। সিং বোঙ্গা হলো সূর্যদেবতা। সূর্যের এমন প্রকাশ অনেক ধর্মেই দেখা যায়। চান্দো শব্দের অর্থও সূর্য। অন্যদিকে মারাংবুরু আদিতে একটি পাহাড়ের নাম ছিল। ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় মহাজাগ্রত দেবতায়। বস্তুতপক্ষে সিং বোঙ্গা, চান্দো এবং মারাংবুরুর সাথে ঈশ্বরের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।

    ◆ শ্রেষ্ঠদেবতা অর্থে ঠাকুরজিউ ব্যবহৃত হয়। খুব সম্ভবত তা পরবর্তীকালে সংযোজিত। অনুরূপ কথা ধর্মদেবতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

    ◆ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষের বিশ্বাস মতে, আদি দেবতা নিরাকার। স্বর্গ-নরক কিংবা জন্মান্তরবাদের তেমন কোন ধারণা তাদের মধ্যে নেই। ধর্ম-কর্ম আবর্তিত হয় পার্থিব জীবনের মঙ্গল অমঙ্গলকে কেন্দ্র করে। বোঙ্গা মানে নৈসর্গিক আত্মা। তাদের মতে, আত্মা কখনো মরে না; সর্বদা পৃথিবীতেই বিচরণ করে।

    ◆ বোঙ্গারাই সুখ-দুঃখের নিয়ন্তা। সাঁওতাল ধর্মীয় জীবনের অধিকাংশ স্থান জুড়ে বোঙ্গাদের অবস্থান। এমনকি প্রত্যেক বাড়ির জন্য গৃহদেবতা হিসেবে আবে বোঙ্গা থাকে। আদিতে মূর্তিপূজা না থাকলেও ইদানিং দূর্গা ও শ্যামা পূজার মতো দাঁসাই উৎসব এবং মাই বোঙ্গার পূজা চালু হয়েছে।

    ◆ লোক-সংস্কৃতি সাঁওতাল সমাজ একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। জীবনের নানান সত্যকে বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য গড়ে উঠে লোকজ গল্প ও কাহিনী এবং শ্লোক। যেমন-

    ◆ দারে সাকাম সাগে নেনা
    ঞুরুঃলাগিৎ চান্দো পালোঃ লাগিৎ
    নিংমাঞ জানা মাকান নোয়া ধারতিরে
    বাংদঞ টুণ্ডোং চান্দো বাং দঞ বাং আ।।

    ◆ ভাবার্থঃ গাছের পাতা ঝরে যাবার জন্য আসে। আর পৃথিবী থেকে সরে যাবার জন্য আমি জন্মগ্রহণ করলাম।

    ◆ এরকম অজস্র গল্প রয়েছে। আবার যাপিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ভেতর জন্ম নিয়েছে নানান বিশ্বাস ও সংস্কার। অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় ফসল লাগালে অমঙ্গল হয়, চুল ছেড়ে গোশালায় গেলে গৃহপালিত পশুর অকল্যাণ ঘটে, রাতে এঁটো থালা বাইরে ফেললে দারিদ্রতা আসে- প্রভৃতি কালের ব্যবধানে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে।

    ◆ এছাড়া সুলক্ষণা ও কুলক্ষণা নারীর বৈশিষ্ট্য, যাত্রা শুভ কিংবা অশুভ হবার কারণ, বৈবাহিক সম্পর্কের ঠিক-ভুলের প্রতীক প্রভৃতি তাদের বিশ্বাস ও সংস্কারে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে লোক-সংস্কৃতির অফুরন্ত উপাদানে সমৃদ্ধ সাঁওতাল সমাজ।

    ◆ হাজার হাজার বছর ধরে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির লালন করছে কিন্তু হাজার বছর ধরে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সাথে বসবাস করেও সাঁওতাল সমাজ তাদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হতে দেয়নি। ক্ষুন্ন হতে দেয়নি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা।

    ◆ প্রতিদিনের প্রকৃতি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধের আদর্শকেও কালিমালিপ্ত হতে দেয়নি। আদিবাসী সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য এখানেই।

    ◆ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করছিল। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের দামিনিকোতে বসবাস নির্দিষ্ট করে। স্থানটির পরবর্তী নাম হয় সাঁওতাল পরগণা।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ।◆ ◆

    ভারতীয় ইতিহাসের সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে ১৮৫৫-৫৬ সালে। ১৯৪৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে তেভাগা আন্দোলনে শহিদ ৩৫ জনের অনেকেই সাঁওতাল কৃষক ছিলেন। তারা ১৯৫০ সালে নাচোলে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।

    ◆ ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন। ইংরেজ শাসন, জমিদার এবং নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হঠাৎ বীরভূমের মাটিতে আগুন জ্বলে উঠে। নেহায়েত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আধুনিক বন্দুক কামানের মুখোমুখি হয়েও ব্রিটিশ মসনদ কাঁপিয়ে দিয়ে ছিল। সিধু, কানু, চান্দ ও ভৈরবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বছরের মাথায় বিদ্রোহ স্তিমিত হলো বটে। কিন্তু গোটা ভারতের মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে গেলো। জন্ম নিলো অধিকার সচেতনতা।

    ◆ তার দলিল ঠিক পরের বছর থেকেই এই মাটিতে একের পর এক বিদ্রোহ। বিপ্লব ছোঁয়াচে রোগের মতো কী না! ইতিহাসের পাতায় ঘটনাটি সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল নামে স্বীকৃত। আর এর মধ্যে দিয়ে আলোচনায় আসে একটা আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সাঁওতাল।

    ◆ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সাঁওতাল যুবকদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল।

    ◆ বিদ্রোহের পর ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পরাজয়ের ফলে আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে তারা। ছড়িয়ে পড়ে বাংলা, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায়। দীর্ঘদিন বন জঙ্গলে কেটেছে।

    ◆ জমি হারানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভারতের অন্তত ১৭টি রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি বনবাসী উপজাতি ও অন্যান্য জনজাতি পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন।

    ◆ ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কিছু অরণ্যপ্রেমী সংগঠনের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ৷

    ◆ এদের উচ্ছেদ করার পেছনে আপাত কারণ হলো, খনি ও কলকারখানার জন্য আরো জমি চাই৷ জীববৈচিত্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্পোদ্যোগীদের হাতে জমি তুলে দেওয়া চাই৷ ঝাড়খন্ডে কয়েক হাজার বনভূমি এলাকা আদানি কোম্পানির লোকজন দখল করে নিয়েছে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ।◆ ◆

    ◆ ভারতে প্রায় চার কোটি হেক্টর বনভূমিতে বসবাস করে প্রায় ১০ কোটির বেশি আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতি৷ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ কোটি।

    ◆ এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার ইনুইট বা এস্কিমোস, উত্তর ইউরোপের সামি, নিউজিল্যান্ডের মাওরি অন্যতম। মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ আদিবাসী বলিভিয়ায় আছে। পেরু ও গুয়াতেমালায় অর্ধেক লোকই আদিবাসী। চীন, মায়ানমারেও বহু আদিবাসী রয়েছে।

    ◆ ভারতে প্রায় ১০.৪ কোটি আদিবাসী জনগণ বসবাস করেন যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৬ %। পশ্চিমবাংলায় প্রায় ৬০ লক্ষ আদিবাসীর বাস যা পশ্চিমবাংলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ %। মূলধারার জনগোষ্ঠীর থেকে আদিবাসীদের পৃথক জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস আছে।

    ◆ পশ্চিমবাংলায় মোট ৪০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘Schedule Tribe (ST) বা তফশিলি উপজাতি’ হিসেবে সরকারী সুযোগ সুবিধা প্রদান করার জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ ◆ সংযুক্ত রাষ্ট্র সংঘের (United Nations Organization – UNO) ◆ ◆

    আলোচনায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৩ সালকে “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী বর্ষ“ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত “আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠী দশক“ ঘোষণা করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের উদ্বেগের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া।

    ◆ এছাড়া ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্ট কে “বিশ্ব আদিবাসী দিবস“ ঘোষণা করা হয়। সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘ (United Nations Organization – UNO) ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়।

    ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ।। কর্মজীবন ও বিবাহ ।।

    ◆ লাজবতীর মা ঘুম থেকে উঠে তার মেয়ে কে বলেন:- ভোর হয়ে গেছে বই রেখে একটু ঘুমিয়ে নে। বলে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো গোছগাছ করে হারিকেনের আলো নিভিয়ে দেয়।

    ◆ কয়েক এক সপ্তাহ পর কলেজ জীবনের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু বিকাল চারটার সময় একটা কাগজ হাতে করে লাজবতী বাড়িতে সাইকেল নিয়ে উপস্থিত হয়।

    ◆ লাজবতী সাইকেলের আওয়াজ শুনে দুই রুম বিশিষ্ট পাকা ঘর থেকে বেরিয়ে বলে :- আরে সত্যানন্দ তুমি তা কি মনে করে! ঘরের মধ্যে এসো বসো।

    ◆ দুজনেই ঘরের বারান্দায় আসে তারপর লাজবতী উপস্থিত পাড়ার ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে :- তোমরা আজ বাড়ি চলে যাও, কাল থেকে আবার পড়াবো।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার জন্য একটা সুখবর আছে কিন্তু তুমি কলেজে যাচ্ছ না কেন!

    ◆ লাজবতী এক গাল হেসে বলে :- কিছু সমস্যা আছে তাই। তোমার মতো আর আদরের ঘরের দুলালী নয়। পড়াশোনার পাশাপাশি আবার পেট ভরানোর জন্য কাজ কর্ম করতে হয়।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- তুমি বিএ পাস করেছো বলে কাগজ হাতে ধরিয়ে দেয়।

    ◆ লাজবতী ফলাফলের কাগজ হাতে নিয়ে মা মা বলে ডাকতে থাকে।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার কথা বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছি।

    ◆ লাজবতী বলে :- উত্তর দিলেন নিশ্চয়ই, ওই কালো আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- না, বাবা মা বিয়েতে রাজি আছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে আসবে।

    ◆ লাজবতী বলে :- আমার কপালে এত সুখ সইবে তো।

    ◆ সত্যানন্দ হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে মিষ্টির প্যাকেট বের করে বলে :- শাশুড়ি কে দেখতে এলাম, তাই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এলাম।

    ◆ লাজবতী হাসতে হাসতে বলে :- শাশুড়ির মেয়েকে তো নয়। তাহলে যাই শাশুড়ির জামাইয়ের জন্য কিছু জল খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসি। তোমার শাশুড়ি মা কিছু জিনিসপত্র আনার জন্য দোকানে গিয়েছে।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- এখনো কি তোমরা দিনমজুরির কাজ করো?

    ◆ লাজবতী বলে :- তিনটে প্রাইভেট পরিয়ে আমাদের চলবে কিভাবে! মাঝে মধ্যে মায়ের সাথে যেতে হয়। বিকালে একটি গ্রুপে পাড়ার ছেলে মেয়েদের বিনামূল্যে পড়ানো হয়। যাতে শিক্ষার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার মায়ের দায়িত্ব আমি নিলাম আর তোমাদের দিনমজুরির কাজে যেতে হবে না। আমি তো পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোটখাটো ব্যবসা করছি।

    ◆ লাজবতী বলে :- দেখো তোমার শাশুড়ি কি বলে?

    ◆ সত্যানন্দ মুড়ি চিবাতে চিবাতে বলে :- তুমি তো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহী নারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছো কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করে উঠবে না তো।

    ◆ লাজবতী হাসতে হাসতে বলে :- সংসার জীবনে তুমি যদি অন্যায় কাজ কর, তাহলে তো আমাকে বিদ্রোহী বউ করতেই হবে। না হলে বিদ্রোহী নারীর সম্মান থাকবে।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- তোমার সংগঠনের কাজকর্ম কেমন চলছে।

    ◆ লাজবতী বলে :- কয়েকটি এনজিও র মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা করছি।

    ◆ সত্যানন্দ বলে :- প্রয়োজন হলে বলে যদি সহযোগিতা করতে পারি।

    ◆ কয়েক মাসের মধ্যে লাজবতী মা মারা যায়। তারপর লাজবতী মায়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আবার দাম্পত্য জীবনের সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সংসারের মাঝে থেকেই শশুর শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করতে থাকে।

    --------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    ◆ রচনাকাল :- ৬ মার্চ ২০২২ সালে।
    শ্রী শ্রী মা সেবাশ্রম,খাটুয়া,দোলন ঘাটা,মাঝদিয়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।

    ◆ সংশোধন :- ৩ আগস্ট ২০২৩ সালে।
    আশ্রম খাটুরা-দোলন ঘাটা, মাঝদিয়া, নদীয়া।

    ।। অবলম্বনে ও তথ্য সূত্রে ।।

    ◆ (০১) দেবব্রত সিংহ রচিত কবিতা 'তেজ'। মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।
    ◆ (০২) বাংলাদেশের সাঁওতাল: সমাজ ও সংস্কৃতি, মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, নভেম্বর ১৯৯১
    ◆ (০৩) বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতি, ড. মাযহারুল ইসলাম তরু, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা- ৩১-৪২ এবং ১০৭-১১৭
    ◆ (০৪) বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, খুরশীদ আলম সাগর, শোভা প্রকাশ, ঢাকা
    ◆ (০৫) আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি: সাঁওতাল

    ----------------------------------------------------------~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন