১
উৎসব হয় কোথায়?
মণ্ডপে রাস্তায় বাড়িতে মসজিদে গির্জায় কোন বাড়িতে।
উৎসব আসে কোথায়?
উৎসব আসে মনে।
মন না জাগলে মন না মাতলে উৎসবের কোনো মূল্য নেই।
প্রকৃতি সুন্দর।
ততক্ষণই, যখন আপনার চোখ ও চোখের ভিতরে থাকা মন প্রস্তুত তাকে দেখতে।
কাশফুল আগেও ফুটতো। দুর্গাপূজার আগে।
কিন্তু দুর্গাপূজার সঙ্গে কাশফুল জড়িয়ে গেছে লেখায় বলায়।
ফলে আপনার ভাবনায় এবং মনে।
শরতের নরম রোদ এসে বলে উৎসব আসছে।
কিন্তু যার ঘরে কাজ নেই, খাবার নেই, পরনের পোশাক নেই!
তার কাছেও কি কাশফুল রোদ এক রকমের?
নাকি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বাবা মায়ের কাছে দুশ্চিন্তার।
এই উৎসবেও তো অনেকের নতুন পোশাক হয় নি।
মুসলমান নয়, হিন্দুদেরও।
হয়তো ছেলেমেয়েদের দিয়েছেন, বা দিতে পারেননি, দিলেও বাবা মায়ের হয় নি।
আমাদের প্রজন্মের বাবা মায়েরাও সব উৎসবে নতুন পোশাক পরতেন না।
২
আমাদের ছোটবেলায়, সত্তর দশকে আশপাশের কোনো গ্রামেই দুর্গা পূজা হতো না।
হতো বাজারে গঞ্জে। তাও ৩০০ গ্রামের মধ্যে সাকুল্যে ৫-৭ টি বড় বাজার। সেখানে হতো।
সেহারাবাজারেই হতো দুটো। একটা ওঁ গোষ্ঠী বলে ক্লাবের আরেকটা মিল মালিকদের উদ্যোগে লায়কাবাজার/ নায়কাবাজারে। এটা সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরে। কেউ গ্রাম থেকে পূজা দেখতে যেত বলে শুনিনি। তিন কিলোমিটার দূরে পলাশন। সেখানে একটা। সেখানেও কেউ বাইরে থেকে যেতো না।
আসলে আলোর কায়দা, মেলা কিছুই ছিল না।
কালীপুজো হতো দুয়েক জায়গায় ধুম করে। তবে তখনো কালী মূলত ডাকাতদের লুকিয়ে মাঠে পূজা করার ব্যাপার। ব্যতিক্রম ছিল। আমাদের সেহারা স্কুলের প্রবাদপ্রতিম প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কালীসাধক। কিন্তু সেতো নিত্যপূজা। আলাদা ঘটা নেই।
৩
আমাদের এলাকায় ৩০০ গ্রামেই উৎসব আসতো অগ্রহায়ণ পৌষ মাঘে। ধান কাটার সময় হলে বা পরে।
পকেটে পয়সা থাকলে তবে তো উৎসব। সেই উৎসব আবার দুর্গা বা কালীকেন্দ্রিক নয়। মা শীতলা বা ওলাইচণ্ডীর পূজা।
যা হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলিত উৎসব। পূজা করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু তাকে ঘিরে মেলা, যাত্রা, আত্মীয় কুটুম আনাগোনা সব বাড়িতেই।
আমার অভিজ্ঞতা বলছে, ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পর দুর্গাপূজা এবং বিপরীতে মসজিদের রমরমা।
এর পিছনে একাধিক কারণ।
একটা প্রধান কারণ, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত কংগ্রেসের নেতারা হিন্দু হলে দুর্গাপূজা এবং মুসলমান হলে তাবলিগ জামাতের মাতলেন। বা মসজিদ গড়তে শুরু করে মাতব্বর হলেন।
পার্টির বদলে ধর্ম আরেক ক্ষমতার উৎস।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার নামে ডিগ্রিপ্রাপ্ত লোক বাড়ল। তাঁরা অকুলীন শীতলা / বাসন্তী/ ওলাইচণ্ডী/ বনবিবির বদলে দুর্গাপূজায় উৎসাহী হলেন।
দুর্গাপূজা হলো এলিট পূজা।
আরেকটি জিনিস খেয়াল করেছি, ওলাইচণ্ডী পূজায় হিন্দু মুসলমান সবাই মায়ের কাছে যেতে পারতেন। দুর্গাপূজার ক্ষেত্রে তা হলো না।
দূর থেকে দর্শন। প্রথমে তফশিলিদেরও এই অধিকার দেওয়া হয়নি। পরে এই নিয়ে কথা চালাচালি হলো। কংগ্রেস সমর্থক একজন তফশিলি সম্প্রদায়ের হায়ার সেকেন্ডারি পাস যুবক সম্পাদক হয়ে মুসলমানদের বিষয়ে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। আর ১৯৮৯ এ ইট পূজার পর মসজিদের রোয়াকে যে হিন্দু মুসলমান সবার আড্ডা হতো, তা বন্ধ হয়ে গেল। মাটির রোয়াকটা রইল না। ঘেরা বারান্দায় রূপান্তরিত হলো।
১৯৮৯ এর আগে শীত গ্রীষ্মে শিবমন্দির ও শিবমন্দির এলাকা ছিল আড্ডা স্থল। বর্ষায় মসজিদের রোয়াক। ১৯৮৯-এর রামমন্দির বাবরি মসজিদ বিতর্ক, ইট পূজা এই আড্ডা ভাঙল। চলে গেল আড্ডা মূলত দোকানে। দোকানে আগেও ছিল। এবার আরো বাড়ল।
যদিও আমাদের এলাকায় হিন্দু মুসলমান ঐক্য এখনো দেখার মতো। ইদানীং তো বিজয়ার পর একসঙ্গে খাওয়াও শুরু হয়েছে।
৪
আমাদের এলাকায় বিশেষ করে আমাদের গ্রামে ওলাইচণ্ডী পূজায় হিন্দু মুসলমানের যৌথ উদ্যোগ দেখার মতো। পূজা উপলক্ষে আগে একদিনের মেলা হতো দুদিন থেকে সাতদিন যাত্রা। একরাতে দুটো যাত্রা পালাও হতো। আমি নিজেও একবার এক রাতে দ্বিতীয় পালায় উৎপল দত্তের 'সাদা পোশাক' নাটকে ছাত্রনেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছি। বাবা নির্দেশক।
দুর্গাপূজার জন্য আলাদা মন্দির হয়েছে এখন। বাঁধানো। বারোয়ারি তলায় ওলাইচণ্ডী পাশে শিবমন্দির। পুরানো মাটির শিবমন্দির ভাঙা পড়েছে। যাত্রার জায়গার প্রয়োজনে। জায়গাটা হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে চাঁদা দিয়ে কিনেছিলেন। এখন সরকার স্থায়ী যাত্রামঞ্চ করে দিয়েছেন। তাতে গ্রামের অপেশাদার দলের চেয়ে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে পার্ট বলা অভিনেতা অভিনেত্রীদের দাপট।
৫
আমাদের ছোটবেলায় মদনদা আসতেন ঠাকুর গড়তে। দুগ্গা নয়, মা ওলাইচণ্ডীর। পৌষমাসের এক তারিখ থেকে মাটি পচানো শুরু। খড় পাট জল দিয়ে মাটি পচানো। শীতকাল। বেশ ঠান্ডা। কিন্তু আমাদের কচি কচি মন তখন উত্তেজিত । উষ্ণ আবেশময়। আমরা মনের সুখে কাদা ছানি। তারপর একটু একটু করে মূর্তির আদল দান।
দু' একজন ছড়া কাটতেন,
ওপরে লেপন চোপন
ভেতরে খড়ের বোঝন
তবে বুঝবে হিন্দুদের মূর্তি পূজন।
সেসব কে গায়ে মাখে?
উল্টো ছড়াও ছিল:
পুরুষ মানুষের ভালোবাসা
মুসলমানের মুরগি পোষা।
সে সব বলার লোক তখন কম।
শোনার লোক আরো অল্প। এখনকার মতো অসভ্য সাম্প্রদায়িকতা তখন দেখিনি। ভাবিনি।
অতএব আমাদের সবার তখন, মার্বেল গুলি ডাংয়ের চেয়ে বেশি ঝোঁক, মদনদা কবে রঙ লাগাবে? স্বার্থও আছে। ওই কাদামাটি নিয়ে কেউ ময়ূর গড়ার চেষ্টা করেছে, কেউ ইঁদুর, কেউ গরু। গরুই বেশি। কারণ গড়া সোজা।
মদনদা তাঁর অযোগ্য শিষ্যদের নিরাশ করতেন না। রঙ দিতেন। মাঝেমধ্যে একটু আধটু তাঁর হস্তক্ষেপে নিজেদের গড়া যেমন তেমন মূর্তিকে যে কী মনে হতো না, কী বলব!
ছোটখাট ভাস্কর দেবীপ্রসাদ তখন আমরা।
('যুগান্তর' তখন ওঁর লেখা বের হতো রোববারে।)
মায়ের চক্ষুদান ছিল এক বিরাট ঘটনা।
মাসিমা কাকিমা সবাই স্নান সেরে খোলা চুলে লাল পাড় সাদাশাড়িতে ভক্তিমতী হয়ে আসতেন।
আমরা নন্দীভৃঙ্গীরা তো বলাই বাহুল্য ।
আমাদের আবাসিক এলাকায় মূর্তি কেনা হতো। বছর চারেক আগে আমি প্রস্তাব দিই, পূজা কমিটির বৈঠকে: মূর্তি এখানেই গড়া হোক।
ছেলেমেয়েরা দেখবে। হাত লাগাবে।
কিন্তু তেমন উৎসাহ দেখি না।
আর আমি?
আমার মনের বয়স তো বাড়ল না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আজো দেখি।
আজকাল রঙ লাগাতে ভয় পাই, wrong বলে যদি বিবেচিত হয়!