যখনই প্রাচীন কোন কবর থেকে সমাধিস্থ কোন মৃতদেহের উৎখনন করা হয়, সেসময় প্রত্নতাত্ত্বিকদের একদম প্রাথমিকতম কাজগুলির মধ্যে একটি হলো দেহের পেলভিস, মাথার খুলি ইত্যাদির হাড়ের আকৃতি, দেহের পাশে প্রাপ্ত ব্যবহার্য বস্তুর অবশেষ, মৃতের পরিহিত অলঙ্কার, সমাধিতে উপস্থিত কোন লিখিত উপাদান ইত্যাদির বিজ্ঞানভিত্তিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে দেহটি পুরুষ না নারী, তা নির্ধারণ করা।
কিন্তু আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগেও কি পৌরুষ আর নারীত্ব আজকের মতো একইরকম বিপ্রতীপ মাপকাঠিতে নির্ধারিত হতো, নাকি এই দুই সমান্তরাল রেখা মিলেমিশে সেসময় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মানবের অন্যতর কোন পরিচয়? গত দশকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলেন নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটানভিল কলেজের অধ্যাপিকা তথা শিল্প ঐতিহাসিক মেগান সিফারেলি। প্রাপ্ত যে কোন প্রাচীন দেহাবশেষকে নারী ও পুরুষ নামক দুটি লিঙ্গে দেগে দেওয়ার বাঁধা গতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন এক উত্তরের আশায় গবেষণার জন্য ইরানের মরু-মালভূমির গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নকেন্দ্র তথা লৌহ-ব্রোঞ্জযুগের বাণিজ্যনগরী টেপ হাসানলুর প্রাচীন সমাধিগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি এবং খুঁজে বেরও করেছিলেন মানব যৌনতার তৃতীয় স্বরের বেশ কিছু অসামান্য নিদর্শন।
২০১৪'র নভেম্বরে মেগান আমেরিকান স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের এক সেমিনারে তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল ঐতিহাসিকদের সামনে উপস্থিত করেন। দেখা যায়, বিষয়টির বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানের শুরুতেই মেগান হাসানলু'র ৫১টি সমাধিতে প্রাপ্ত নরকঙ্কাল ও ব্যবহার্য দ্রব্যগুলিকে নিচের তিনটি পর্যায়সারনীতে ভাগ করেছেন..
* প্রথম বিভাগের সমাধিগুলিতে প্রাপ্ত কঙ্কালের পেলভিসের আকার তো বটেই, অনেক সংখ্যক সূঁচ, কাপড় আঁটকানোর পিন আর গয়নার উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে, সেগুলি ছিল মহিলাদের সমাধি।
* দ্বিতীয় বিভাগে ছিল পুরুষদের সমাধি, যা প্রাপ্ত কঙ্কালের পুরুষালি পেলভিস ও পাশে থাকা হাতিয়ারগুলির দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছিল।
* শেষ বিভাগে ছিল সেই ১১টি মিশ্র সমাধি, যেখানে নারী-পুরুষের কঙ্কালের পাশে একই সঙ্গে পুরুষালি আর মেয়েলি স্টিরিওটাইপ দিব্যি সহাবস্থান করছিল। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবে ৫টি পুরুষ ও ৩টি নারীদেহ হলেও, পূর্ণবয়স্ক না হওয়ার কারণে পেলভিসের হাড় ও মাথার খুলি থেকে বাকি ৩টি কঙ্কালের লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি,তবে সেই ৩ক্ষেত্রেও পুরুষালি ও মেয়েলি দ্রব্য একইসঙ্গে রাখা ছিল।
এই তৃতীয় বর্গের সমাধিগুলি তাদের সংখ্যার আধিক্য আর স্পষ্ট বৈশিষ্ট্যের ভিতে সোচ্চারে প্রাচীন হাসানলুর সমাজে তৃতীয় স্বরের জোরালো উপস্থিতিকে নির্দেশ করছিল। মেগান ছবিসহ এরপর দেখান, কোন 'পুরুষ' সমাধিতে তীরের ফলার পাশে রাখা সূঁচ বা ব্রোচের মতো 'মেয়েলি' সামগ্রী, আরেকটিতে ধাতব ব্লেডের পাশে পেয়ালার মতো বাসন বা সূঁচ-ব্রোচের উপস্থিতি ওই ব্যক্তির যুগপৎ পুরুষালি পেশা আর মেয়েলি পোশাক পরার বাস্তবকে তুলে ধরছে পরিষ্কারভাবে। তিনি বললেন, সমস্ত প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ মেনে যত্নে দাফন করা তৃতীয় গোত্রের এই সমাধিগুলি স্পষ্টতঃ প্রমাণ করছে যে, হাসানলুর সংস্কৃতিতে সম্মান ও স্বাভাবিকতা, এই দুইয়ের সঙ্গেই তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রান্তিক যৌনতার অস্তিত্ব স্বীকৃত ছিল।
কিন্তু পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, সমাধিতে পড়ে পাওয়া কিছু ব্যবহার্য জিনিসের ভিত্তিতে কিভাবে মেগান হাসানলুতে তৃতীয় স্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে এত নিশ্চিত হচ্ছেন? মনে হতেই পারে, হয়ত দাফনের সময় শবদেহের পাশে তাঁর প্রিয়জনেরা নিজেদের ব্যবহার্য জিনিস সযতনে রেখে দিয়েছিলেন অথবা এ-ও মনে হতে পারে, সমাহিত ব্যক্তিটি তাঁর জীবদ্দশায় কোন বিশেষ সামাজিক বা ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য বিপরীত লিঙ্গের পোশাক বা জিনিস ব্যবহার করতেন বলেই সেগুলি রাখা হয়েছিল। কিন্তু
মেগান সম্পূর্ণ নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সফলভাবে বারবার এই সন্দেহগুলি নিরসন করেছেন। যুক্তি হিসেবে তিনি তথ্যপ্রমাণ সহ বলেছেন,
প্রথমত, পুরুষ বা নারী অর্থাৎ নির্দিষ্ট লিঙ্গের কবরগুলি যেমন বসতির একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যুথবদ্ধভাবে নির্মিত হয়েছিল, তেমনি তৃতীয় লিঙ্গের কবরগুলিও ছিল একসঙ্গে অবস্থিত এবং বাকি কবরগুলির মতো একইরকম দেখতে।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু প্রাপ্ত প্রতি তৃতীয় গোত্রীয় কবরই বাকি সমাধিগুলির মতো সমকালীন সমস্ত ধর্মীয় রীতি অনুসারে নিখুঁতভাবে নির্মিত ছিল এবং সেখানে শবদেহগুলি পুরোমাত্রায় আনুষ্ঠানিকভাবে সমাহিত হয়েছিল, ফলে এই কবরগুলিতেই কেবল দুঃখী মহিলারা তাঁদের ব্যবহার্য সূঁচ, গয়না বা পেয়ালা ফেলে দিয়ে যাবেন, তা ভাবা বাতুলতা।
তৃতীয়ত, সমাহিতের 'সামাজিক অবস্থান এবং লিঙ্গ পরিচয়কে পরলোকেও অপরিবর্তিত অবস্থায় প্রবাহিত করার ধর্মীয় দায়িত্ব' বর্তাতো পুরোহিত আর পরিবারের লোকের ওপরেই। ফলে তাঁরা গয়না বা হাতিয়ার রেখে এজন্মের লিঙ্গপরিচয়কে পরজন্মের জীবনে 'গুলিয়ে দেওয়ার ভুল' কখনোই করবেননা।
যেহেতু হাসানলু'র সেকালের নাগরিকরা একটিও লিখিত উপাদান ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাননি, তাই সমাহিত তৃতীয় গোত্রের ব্যক্তিদের নামধাম-পেশা, তাঁদের যৌন প্ৰবণতার পরিচয়, হাসানলু'র সমাজ ও সংস্কৃতিতে তাঁদের অবস্থান বা গুরুত্ব, কোন কিছুই সন্দেহাতীত আমাদের পক্ষে অন্তত বর্তমান সময়ে জানা সম্ভব নয়। লিখিত উপাদানের অভাব মেগান সিফারেলির অনুসন্ধান ও তার ফলাফলকে নিশ্চিতভাবে কিছুটা কঠিনও করে তুলেছে। তবে তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর বক্তব্যকে দ্বিতীয়বারের জন্য যুক্তির ভিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসানলু'র ধ্বংসাবশেষের বুক থেকে অনেক বছর আগে খুঁজে পাওয়া একটি সোনার পাত্রের সাহায্য নিয়ে।
এই স্বর্ণপাত্রটির গায়ে খোদিত ছিল সমকালীন জনজীবনের নানা ভাস্কর্য। যার মধ্যে একটি দৃশ্যে নারীদের পোশাক পরিহিত অথচ শ্মশ্রু-গুম্ফ মণ্ডিত এক পুরুষকে এমন ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখা যায়, যা সেযুগে প্রচলিত আইকনোগ্রাফি অনুযায়ী কেবল মহিলাদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। মেগানের মতে এই ভাস্কর্যটি নিঃসন্দেহে একজন প্রান্তিক যৌনপরিচয় সম্পন্ন ব্যক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে পুরুষ সমাধির আধিক্য হোক বা ব্যবহার্য পাত্রে ভিন্ন যৌনতার পুরুষ চেহারা খোদাই, অবশ্যই সেযুগেও, এযুগের মতোই নিজস্ব যৌনঅভিমুখ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় পুরুষের অধিকতর স্বাধীনতাকে তুলে ধরছে।
শুরু থেকেই প্রতিবেশী আসিরিয় এবং উরারতু সাম্রাজ্যের জোড়া আক্রমনের শিকার ছিল সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র হাসানলু। তবে ৮০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে উরারতু রাজ্যের দ্বারা ব্যাপক আক্রমণ, লুন্ঠন, গণহত্যা আর অগ্নিসংযোগের ফলে শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। টেপ হাসানলু'র পতন পর্বের একটি অভিনব আবিষ্কার নিঃসন্দেহে হাসানলু'র অলিঙ্গনরত প্রেমিক যুগলের কঙ্কাল, যাঁদের নিয়ে আজ পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে চলেছে নানা মতভেদ আর বিতর্ক। তবে সেই বিষয়টি বা শহরের পথে ছড়িয়ে থাকা বাকি স্তূপাকার আহত ও পলায়নোদ্যত মৃতদেহগুলি নিয়ে মেগান চর্চা করেননি। তিনি মূলত খৃষ্ট পূর্ব ১৩০০ থেকে ১০৫০ অব্দ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্মিত সমাধি ও শিল্পদ্রব্যগুলিকেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। সমাধিতে প্রাপ্ত ব্যবহার্য দ্রব্য আর পাত্রের গায়ে খোদিত নানা ভাস্কর্যকে সময় সারণীতে ভাগ করে মেগান দেখিয়েছেন, উরারতু আর আসিরিয়ার আক্রমণের শুরুর দিকে হাসানলুতে লিঙ্গ ও যৌনতার প্রশ্নে তেমন কোন রক্ষণশীলতা ছিলনা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বহিরাক্রমণ যত তীব্রতর হয় এবং নগরের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন যত জটিল হয়ে ওঠে, ততোই হাসানলুর ভাস্কর্য থেকে তার জেন্ডার-ফ্লুইড বৈশিষ্ট্য মুছে গিয়ে স্পষ্টতর হতে থাকে পুরুষালি সৈন্যের অবয়ব আর সমাধিতে সূঁচ আর ব্রোচের বদলে বাড়তে থাকে হাতিয়ারের সমাহার।
শেষ দশক থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও শিল্প-ঐতিহাসিকরা সারা বিশ্ব জুড়ে যেহেতু প্রাচীন সভ্যতাসমূহের যৌনতার ক্ষেত্রে গবেষণা চালাচ্ছেন, সেই সূত্র ধরেই মেগান বলেন, সময় নিশ্চিত ভাবে হাসানলু সভ্যতায় বিরাজিত প্রান্তিক যৌনতা সম্পর্কে আরো অনেক নতুন তথ্য সামনে নিয়ে আসবে। তামাম পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির দিকে তাকালে দেখা যায়, নারী আর পুরুষ, এই দুটিমাত্র লিঙ্গবোধ ও যৌনপরিচয়ের কঠোর শেকলে সেযুগের মানুষ নিজেদের অস্তিত্বকে বেঁধে ফেলেননি। প্রাচীন গ্রিস, রোম, মিশর বা ভারতেই কেবল নয়, পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা "অসভ্য-অনুন্নত" বলে একদা দেগে দেওয়া 'নেটিভ ইন্ডিয়ান', ইন্দোনেশিয়ার 'বুগিস' জনজাতির মধ্যেও ৫টি পর্যন্ত লিঙ্গ পরিচয়ের মান্যতা ছিল।
এই বিশ্বপ্রকৃতি তো সহজাতভাবেই বহুমাত্রিক, মানব প্রকৃতির বহুমাত্রিকতাও সেই বৃহত্তর বোধেরই এক নগন্য অংশমাত্র। দুটি বা তিনটি লিঙ্গপরিচয়ের খোপে মানুষের যৌনতাবোধকে চেপে গুটিয়ে রাখা নিঃসন্দেহে আগ্রাসী আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের এক কৌশলমাত্র। সভ্যতা যত উন্নতির দিকে এগিয়েছে, এই আগ্রাসনের তীব্রতাও তত বেড়েছে আর ঠিক ততটাই ব্যস্তানুপাতিক হারে কমেছে ভিন্ন যৌনতার প্রতি মানবমনের সংবেদনশীলতা ও সহিষ্ণুতা। যৌন সংখ্যালঘুদের ওপর আজও পৃথিবী জুড়ে নানা অজুহাতে ঘটে চলা বহুতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাই মেগান সিফারেলির কথা ধার করে বলতেই হয়, লৌহ যুগের সেইসব মানুষ, যাঁরা লিখতেও জানতেন না, তাঁরা যদি ভিন্ন যৌনতাকে স্বাভাবিকভাবে আপন করে নিতে পারেন, তবে ২১শতকের আত্মঘোষিত 'উন্নত' মানবজাতি কেন সেটুকু করতে পারেনা?
উৎস সূত্রঃ
১)https://www.asor.org/anetoday/2015/02/gender-and-jewelry-at-hasanlu/
২)https://www.haaretz.com/archaeology/2018-12-30/ty-article-magazine/.premium/ancient-civilization-in-iran-recognized-transgender-people-study-suggests/0000017f-e0fc-d7b2-a77f-e3ffb5fb0000
৩)https://www.iflscience.com/ancient-persians-recognized-at-least-three-genders-51206