আমি মাতাল নই, চাতাল নই, কিঞ্চিৎ গেঁজেল; তবে ভাঙ খেতে বড় ভালবাসি। ছোটবেলায় মিশনে পড়ার সময় মহারাজ একটা গান শিখিয়েছিলেন-‘ভাঙ খেয়ে বিভোর ভোলানাথ ভুতগণ সঙ্গে নাচিছে’।
ব্যস্ তখন থেকেই আমি মহাদেবের ভক্ত। বিন্দাস দেবতা। কুছ পরোয়া নেই। বাবা ভোলানাথ ভক্তের থেকে খুব বেশি কিছু চান না। ঢুলু ঢুলু চোখে সব দেখেন। পাশে দুটো ষাঁড় বসে জাবর কাটে। কাউকে গুঁতোয় না। বছরে একবার বাবাধামে গিয়ে মাথায় দুধ ঢেলে দাও, দুটো বেলপাতা দাও; তাহলেই খুশি। ওনার পুজো সবচেয়ে সোজা।
সহজে রাগেন না। তাবলে ভেব না ওনাকে এলেবেলে ভেবে তাচ্ছিল্য করবে। উনি অপমান সহ্য করেন না। যদি একবার খেপচুরিয়াস হয়ে যান তাহলে চিত্তির! দক্ষযজ্ঞ মনে আছে তো?
তবে একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা নন। মাঝে মাঝে ঘরে ফিরতে দেরি হয়, ঘরের রাস্তা ভুলে যান। সে তো আমিও ভুলে যাই। আজ থেকে নয়, সেই কৈশোর থেকে। চাল কিনে আনতে গিয়ে ঠেকে বসে ভুলে গেলাম। যখন মনে পড়ল তখন সুজ্জি ডোবে ডোবে।
আসলে আমরা দুজনই , মানে আমার আরাধ্য শিব এবং ভক্ত আমি, ঠিক সংসারের জন্যে ফিট নই। তবে তফাৎ আছে। ওঁর সংসার টিকে আছে, আমারটা নেই। ওনার স্ত্রী হিমালয়- দুহিতা উমা ভোলেনাথ স্বামীকে নিয়ে বেশ চালিয়ে যাচ্ছেন, ঝালে-ঝোলে-অম্বলে।
মা মেনকা এইসব বলে খুঁচিয়ে দেন “ কেমন করে হরের ঘরে ছিলি উমা বল মা তাই। কত লোকে কত বলে শুনে প্রাণে মরে যাই”।
--ওসব অন্তরটিপুনি দিও না তো! তোমরাই তো দেখে শুনে এমন জামাই এনেছিলে, বলেছিলে ছাব্বিশ গুণ মিলেছে—একেবারে রাজযোটক। এখন এসব বললে হবে? ভোলেনাথ আমার চারটে ছেলেমেয়ের বাপ।
--ওরে আমি যে তোর মা। বাকি চারটে গুণ যে দেখিনি। দেখ দিকি, এখন একেবারে ফুটে বেরোচ্ছে।
‘মার প্রাণে কি ধৈর্য ধরে জামাই নাকি ভিক্ষা করে, এবার নিতে এলে পরে বলব উমা ঘরে নাই’।
--খবদ্দার এসব বলবে না!
উমার চোখ পাকানো দেখে মেনকা কেমন যেন ভেবলে গেলেন। হয়ত যৌবনে শকুন্তলাকে জন্ম দেওয়ার বেত্তান্ত মনে পড়ে গেল। সেই মেয়েটার এমন চোপা ছিল না। তাই তো শেষে রাজরাণী হল।
মাকে ভোলাতে উমা এবার কপালে টিপ এলোচুলে একেবারে হিন্দি ফিল্মের জয়াপ্রদা হয়ে গেয়ে উঠলেন –ভালা হো, বুরা হো, জ্যায়সা ভি হো; মেরা পতি মেরা দেবতা হো”।
‘ ভাল-মন্দ যেমনই হোন, উনি আমার স্বামী,
অবহেলা করলে পরে হব নরকগামী’।
তা বেশ কথা। তবে কিনা ওসব দেবতাদের ব্যাপার, একবার সরি বললে দেবীরা গলে যান, সাত খুন মাফ! কিন্তু আমি মর্ত্যের মানুষ। আমার স্ত্রী আমার মধ্যে কোন গুণই দেখেন না।
উনি ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্রী , কাব্য বোঝেন না। ফলে আক্ষরিক অর্থে আউড়ে যান “অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ, কোন গুণ নাহি তার কপালে আগুন”।
কথাটা খানিক সত্যি। আমাদের মধ্যে বয়েসের তফাৎ আছে বৈকি , আর বিয়ের সময় আমার মাথাভর্তি ভ্রমরকালো চুল ছিল। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই পেটের গণ্ডগোল আর বারবার বদলি হয়ে জল বদলে যাওয়ায় চুল ঝরতে শুরু করল।
এসব মিলে যা হল—উনি আমার শাউড়ির কথায় নেচে আমাকে উকিলের নোটিস ধরিয়ে দিলেন। আমি আদালতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করলাম যে অধিকাংশ অভিযোগ মিথ্যে নয়। আমি ভাল স্বামী, ভাল বাবা কোনটাই নই। আমার সংসার করার কোন যোগ্যতাই নেই, ওই ব্যাংকের চাকরিটুকু ছাড়া।
কিন্তু একেবারে দায়িত্বজ্ঞানহীন নই। মাসের খরচা , বৌ-বাচ্চার জামাকাপড়-- সব আমিই যোগাই। আর মাতলামি, বৌয়ের গায়ে হাত তোলা বা এদিক ওদিক যাওয়ার চরিত্রদোষ—কোনটাই টেকে না।
জজ সাহিবা সব শুনে রায় লিখলেন। আপাততঃ আমাদের আলাদা থাকতে হবে। দুটো হেঁসেলের খরচা আমিই দেব। কিন্তু দুটো বাচ্চা মায়ের কাছেই থাকবে।
উনি খুব বোঝালেন যে আমাদের হিন্দু বিয়ে হল প্রজাপতির নির্বন্ধ। ফিরিঙ্গি সভ্যতার মত চাইলেই দুম করে ভাঙা যায় না।
বরং আমরা ক’দিন আলাদা থেকে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখি- যদি ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায়!
আমার পার্বতী এবার লক্ষ্মীসরস্বতীর নড়া ধরে নিজের হিমালয়ে নিয়ে গেলেন। সরস্বতী বড্ড কাঁদছিল। লক্ষ্মী কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। আমি হাত ঝেড়ে আমার কৈলাসের গুহায় ফিরে এলাম। ভাঙ ও গাঁজার মাত্রা একটু বেড়ে গেল, এই আর কি!
অ্যাই, আইনের ভপকি দেবেন না। আমেরিকায় ২১টি দেশে মারিজুয়ানা, মানে গাঁজার মাসতুতো বোন, এ’বছর লিগ্যাল হয়েছে । আর কে না জানে ‘হোয়াট আম্রিকা থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া উইল থিঙ্ক টুমরো’।
না, ইয়ার্কি মারছি না।
আমার বিলাসপুর শহরের বিজেপি এম এল এ শ্রীমান কৃষ্ণমূর্তি বান্ধী মহোদয় বলেছেন মদের বদলে গাঁজা এবং ভাঙ প্রমোট করা উচিত। তাহলে দেশে অপরাধ কমে যাবে। মদের নেশায় গুরুলঘু জ্ঞান থাকে না। রেপ, মার্ডার , দাঙ্গা সব ঘটে। কিন্তু গাঁজা বা ভাঙ সেবনের পর কেউ খুন বা বলাৎকার করে? তাহলে হিমালয়ের সাধুরা ওসব প্রসাদ করেন কী করে?
কিন্তু কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী বাঘেলজী শুনলে তো! হাঁকিয়ে দিয়ে বললেন—যান, যান; ওসব দিল্লিতে গিয়ে বলুন। নারকোটিক অ্যাক্ট সংশোধন করান গে’।
এম এল এ বান্ধীজি পেশায় ডাক্তার। অতএব, আমি ওনার কথাই মেনে চলব।
এভাবেই চলছিলাম। গাঁজা ভাঙ সব সরকারি লাইসেন্স প্রাপ্ত দোকান থেকে কিনছিলাম। দিনের বেলায় ব্যাংকের চাকরি মন দিয়ে করছিলাম, তবে রাতের বেলায় সব হরিপদ কেরাণীই আকবর বাদশা হয়ে যায়।
এবার আমার একমেটে জীবনেও সেদিন অঘটন ঘটে গেল। সবটা খুলে বললে আপনারাও মানবেন—অঘটন আজও ঘটে। হ্যাঁ, বাবা ভোলেনাথের কৃপায় সবই মুমকিন, সব সম্ভব।
দিনটা ছিল মঙ্গলবার, মহাশিবরাত্রির ছুটি। দিনের বেলা উপোস করে বিকেলে শিবের মাথায় দুধ ঢেলে অরপা নদীতে চান করে মনটা বেশ উড়ি উড়ি হয়ে গেছল। রাত্তিরে ভাঙের মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেল। তারপর আমি না, বললে বিশ্বাস করবেন না, ত্রিকালজ্ঞ হয়ে গেলাম।
মানে ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান দেখতে পেলাম। খালি আমার না, সবার। গোটা দেশের। সেই গল্পটাই আজ খেপে খেপে বলি। তিনটে খেপে; ওই ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান আর কি! আরে ভুত-টুত দেখাব না। বলছি ভুতকালের কথা, যাকে বলে অতীত।
এবার চুপটি করে শুনুন। মাঝখানে এটা- কেন- হল, ওটা- কেন- হল গোছের প্রশ্ন করবেন না। কোন প্রেস কনফারেন্স করছি না, স্রেফ গপ্পো শোনাচ্ছি। কাজেই আমার গরুর পাল কখনও সখনও মাঠে চরে বেড়ানো ছেড়ে গাছে চড়বে।
ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল।
আমার ব্যাংক ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটা পথে কুড়ি মিনিট। রোজ খেয়েদেয়ে এভাবেই যাই। স্কুটার বিক্রি করে দিয়েছি। ভাবি কী হবে স্কুটার রেখে? পেছনে কেউ বসার নেই যখন।
ধরুন কোমর জড়িয়ে একটু ঝুঁকে। মানে ওই একটুকু ছোঁয়া লাগে আর কি! ওসব এখন ভুলে যেতে চাই।
আজ সেভাবেই যাচ্ছিলাম। সিভিল লাইন্সের সরকারি বাংলো, গার্লস ডিগ্রি কলেজ, লেডিজ হোস্টেল, সিভিল লাইন্স থানা—সব পেরিয়ে লিংক রোড। একটা ছোটখাট মলের মত, উলটো দিকে সিনেমা হল। দুটো বাড়ি পেরিয়ে গেলেই আমার ব্যাংকের হেড অফিস, এখানে এসেছি তিন বছর হল।
ঢোকার মুখে থমকে গেলাম। অফিসের মোরম বিছানো কোর্ট ইয়ার্ডে জেনারেল ম্যানেজারের গাড়ি দাঁড়িয়ে। কিন্তু –কিন্তু গাড়িটা তো দেখছি বোলেরো। গতকালও ওটা ছিল মারুতি জিপসী। তাহলে এটা কি অন্য কোন অফিসের গাড়ি? অন্য কেউ দেখা করতে এসেছে কোন কাজে?
মরেছে! কোন কমপ্লেনের ব্যাপার নয় তো! আমার বসের একটু বাই আছে, এদিক সেদিক দেখে টুক করে--। লোকটা লোভী, কিন্তু বেজায় ভীতু।
ও হল লোন ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার, আমি তার সুযোগ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিন্তু ঝামেলায় পড়লে আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে ওর এতটুকু বাধবে না। আমার আগে যে ছিল সে এর পাল্লায় পড়ে দুটো ইনক্রিমেন্ট খুইয়ে এখন কোন দূরের ব্র্যাঞ্চে বসে মদ খাচ্ছে আর তুলসিমালা জপছে।
ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে উঁকি মারি—নাঃ , সামনে তো আমাদের ব্যাংকের নাম গোটা গোটা করে লেখা। তাহলে এটা নতুন গাড়ি ! বেশ বেশ, আমাদের বেহ্মজ্ঞানী মত জি এম স্যার নতুন গাড়ি কিনেছেন? মহাশিবরাত্রির পবিত্র দিনে?
ভেতরে ঢুকে ভুরু কুঁচকে গেল। রিসেপশন কাম ডেসপ্যাচ ডেস্কে একটি নতুন মেয়ে বসে আছে, বিবাহিত এবং তেঁতুল, মানে দক্ষিণী। নইলে ভর দুপুরে মার্চের গরমে কেউ খোঁপায় গোড়ে মালা লাগায়!
এও কি গাড়ির মতই মহাশিবরাত্রির নতুন আমদানি ? কে জানে, কিন্তু হাসে না কেন! কোন অফিস ম্যানার্স নেই, ঠিকমত গ্রুমিং হয়নি। সে যাকগে, ওর ব্যাপার ও বুঝবে। মেয়েটা চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছে। চেহারায় স্পষ্ট কোশ্চেন মার্ক।
আমি ওর কনফিউশন আরও বাড়িয়ে ওকে একটা স্মাইল ছুঁড়ে দিয়ে হল পেরিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াই।
--স্যার, স্যার, জরা শুনিয়ে তো।
মেয়েটা উঠে ডেস্কের থেকে বাইরে চলে এসেছে।
--ইয়েস?
--আপ কহাঁ জা রহে ? কোথায় যাচ্ছেন?
--যাচ্ছি নিজের জায়গায়। লোন অ্যান্ড অ্যাডভান্স ডিপার্টমেন্টে।
--ওয়েল, হু ডু ইয়ু সাপোজ টু মিট স্যার?
মেয়েটা তো আচ্ছা হাঁদা। কিছুই জানে না! এবার আমার রাগ হয়ে যায়।
কেটে কেটে বলি—আমি এখানকার অফিসার, সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট গ্রেড ২।
--ওকে, ইয়ু আর মিঃ খুবচন্দানী, ইজন’ট ইট স্যার?
--নট অ্যাট অল। আয়্যাম রায়চৌধুরী। মে আই গো নাউ, ইয়োর হাইনেস?
মেয়েটা কায়দা করে ঠিক আমার রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ওর ঠোঁটের উপর ঘামের ফোঁটা।
--প্লীজ স্যার, রাগ করবেন না। কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। ওই ডিপার্টমেন্টে কোন মিঃ দেবাংগন নেই তো।
আরেঃ , এই বেটি তেঁতুল বলে কি? ঠিক আছে, আমার কার্ড বের করে দেখাচ্ছি। কিন্তু ওয়ালেট হাতড়ে আমি অবাক, কোন কার্ড নেই । কবে ফুরিয়ে গেল? স্টেশনারি বিভাগকে ফের বলতে হবে।
আচ্ছা, আমার ক্লার্ক মিস বিশ্বাসকে ডেকে আন। ইন্টারকমেই ডাকো। ও আসলে তবে একদম দুধ কা দুধ, পানী কী পানী হয়ে যাবে।
--সরি স্যার, লোন ডিপার্টমেন্ট কেন, গোটা অফিসে কোন মিস বিশ্বাস বলে কেউ নেই। আপনি বোধহয় মিস স্যানিয়েলের কথা বলছেন, কিন্তু তিনি তো ডেটা অ্যানালিটিক্সে বসেন।
এ কি গেরো! কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম!
--শুনুন, আপনি লোন ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জকে বলুন ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট মিঃ রায়চৌধুরী লবিতে অপেক্ষা করছে, মানে ও আধঘন্টা ধরে চেষ্টা করছে, কিন্তু ঢুকতে পারছে না।
মেয়েটি এবার ভয় পায়। বলে -স্যার, আপনি নিজেই আপনার বসকে মোবাইলে ফোন করে প্রবলেমটা বলুন না।
ও ইয়েস, ইফ ইট শ্যুড বি লাইক দ্যাট। এক্ষুণি কল করছি, তারপর দেখ তেঁতুল তোমার কি হয়!
কিন্তু –কিন্তু পকেট হাতড়ে মোবাইলটা পাচ্ছি না যে! নিঘঘাৎ বাড়িতে ফেলে এসেছি, গাঁজা-টাজা ছাড়তে হবে, বড্ড ডোবায়। এক্কেবারে হাতে হ্যারিকেন কেস।
এবার মেয়েটার পালা। চোখ সরু করে বলে আইডি কার্ড, মোবাইল সব বাড়িতে ফেলে এসেছেন! আর ইয়ু শিওর?
আমি ব্যাকফুটে, ইশারায় ইন্টারকম দেখাই, মুখে অনুনয়ের ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলি।
মেয়েটা আমাকে পালটা ইশারায় একটু দূরের সোফা দেখিয়ে দেয়। কাউকে এক গ্লাস জল দিয়ে যেতে বলে। তারপর একটা বোতাম টিপে কাকে যেন বলে—একটু আসুন স্যর। সাম মিঃ রায়চৌধুরী ওয়েট করছেন। না, কোন আইডি কার্ড আনেন নি, মোবাইলও নয়।
জল আসে, আমি চোঁ চোঁ করে গেলাস খালি করে এদিক ওদিক তাকাই। কিছু কিছু জিনিস বদলে গেছে। ইন্টেরিয়র ডেকরের কথা বলছি। কিন্তু গত শুক্কুরবারে অফিস থেকে বেরোনোর সময় এসব কেন চোখে পড়েনি?
--এই যে স্যার! ইনিই মিঃ রায়চৌধুরী।
আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন একজন স্যুটেড বুটেড মহাশয়। থুতনিতে ছাগল দাড়ি। এ ব্যাটা কোত্থেকে? আমাদের অফিসে তো কেউ ছাগলদাড়ি রাখে না!
লোকটা আমাকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে গ্ল্যাড টু মিট ইয়ু, আমি পরমার, অফিস ম্যানেজার। বলুন , হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
কিন্তু আমাদের অফিস ম্যানেজার তো কেশরবানী, ওর কি ট্রান্সফার হয়ে গেছে? কবে হল?
--সরি, গত দু’বছর ধরে আমিই এখানকার অফিস ম্যানেজার। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ি।
--এসব কি আগড়ম বাগড়ম বকছেন! আমার কেন ভুল হবে? আমি লাস্ট ওয়ার্কিং ডে, মানে গত শুক্রবারেও এই বিল্ডিং, মানে এই অফিসে এসে আমার ডিউটি করে গেছি। তখনও অফিস ম্যানেজার ছিলেন কেশরবানী, আমার ক্লার্ক ছিল মিস বিশ্বাস আর রিসেপশনে মিস গ্রোভার-- হাসিমুখে বসে থাকত।
ভুল আপনাদের হচ্ছে। আমি লোন ডিপার্টমেন্টের সেকন্ড অফিসার, রায়চৌধুরী। আমাকে আমার ডেস্কে যেতে দিন, ঢের হয়েছে।
--নো, এই অফিসে কোন মিঃ রায়চৌধুরী নেই। চাইলে কম্পিউটার স্ক্রীনে আমাদের স্টাফ লিস্ট দেখাতে পারি। আপনি বোধহয় ভুল অফিসে এসেছেন। এরকম হয় মিঃ রায়চৌধুরী। মানুষজন ট্রেনে ভুল কোচে উঠে বার্থ নাম্বার নিয়ে ঝগড়া করে। ধরুন, পাশাপাশি দুটো কোচ। দুটোতেই বার্থ নাম্বার ৩৭ , লোয়ার বার্থ। এখন আপনি যদি ভুল করে পাশের কোচে—
--স্টপ ইট! আমাকে এভাবে হিউমিলিয়েট করতে পারেন না। আপনারা কারা? আমি চিনি না। আমি এখানে নেই মানে কি আমার সাস্পেনশন বা টার্মিনেশন হয়েছে? উইদাউট এনি শোকজ বা প্রিলিমিনারি এনকোয়ারি?
আমি বোধহয় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। হলে লোক জমা হচ্ছে, দু’জন সিকিউরিটি এগিয়ে এসেছে।
--প্লীজ কাম ডাউন। উই ক্যান সর্ট ইট আউট ইন এ সিভিলাইজড ম্যানার। কুল ডাউন। কফি আসছে।
আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত, সোফায় বসে হাঁফাতে থাকি। আমায় ঘিরে ধরে ছোট একটি ভিড়।
একটা ভারি আওয়াজ বলে—শুনুন মিঃ রায়চৌধুরী। ট্রেনে বার্থ নিয়ে ডিস্পিউট হলে আমরা কী করি? পরস্পরের টিকিট বা রিজার্ভেশন স্লিপ চেক করি। এখানেও আমরা তাই করব। ঠিক আছে? আচ্ছা, প্রথমে কিছু সিম্পল কোশ্চেন দিয়ে শুরু করছি।
ব্যাটাচ্ছেলের ভাবভঙ্গী দেখ, যেন কুইজ মাস্টার।
--আচ্ছা, এই ব্যাংকের নাম কী? হোয়াটস দ্য নেম অফ দ্য ব্যাংক ইউ হ্যাভ বীন সার্ভিং সিন্স--
দুস্ শালা! এটা কোন প্রশ্ন হল?
-- দ্য নেম ইজ – দ্য নেম ইজ---ছত্তিশগড় রাজ্য গ্রামীণ ব্যাংক। সংক্ষেপে সি আর জি বি। এর রিজার্ভ ব্যাংক লাইসেন্স নাম্বার অ্যান্ড ডেট—
--এক মিনিট মিঃ রায়চৌধুরী। কাম হিয়ার মিসেস সুব্রাহ্মনিয়ন। হোয়াটস দ্য নেম অফ দিস ব্যাংক? আই মীন দ্য ব্যাংক ইউ আর সারভিং সিন্স দ্য লাস্ট ইয়ার?
সেই ডাম্ব তেঁতুল মহিলা গলা তুলে প্রায় আমাকে ভেঙিয়ে বলে—দ্য নেম ইজ –দ্য নেম ইজ—ছত্তিশগড় ইন্ট্রিগেটেড রুর্যাল ব্যাংক, সি আই আর বি ইন শর্ট!
হাততালি! হাততালি! চারদিকের ভিড় তালি বাজাচ্ছে, যেন ক্রিকেট মাঠে বল বাউন্ডারি পেরোচ্ছে বা সোজা উইকেটে লেগেছে।
এরা ভেবেছেটা কী!
আমি ফের দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচাই—ইট কান্ট বি! আর ইউ জোকিং? লুক অ্যাট ইওর সাইনবোর্ড অ্যান্ড পোস্টার্স, ইয়োর ব্রোশার্স অ্যান্ড বুকলেটস্।
হা-হা-হা-হা। সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। আমি বিমুঢ়, এর ওর মুখের দিকে তাকাই।
ছাগলদাড়ি আমার হাতে একটা লোনের ব্রোশার ধরিয়ে দেয়। বলে আপনি নিজেই দেখে নিন মিঃ রায়চৌধুরী। আমি ওর হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে পাগলের মত চোখ বোলাই—ব্যাংকের নাম, লোগো এবং কর্পোরেট অফিসের ঠিকানা, ইনকর্পোরেটেড ইন দ্য ইয়ার—
একী! এসব হচ্ছেটা কী?
এবার তেঁতুল মেয়েটি ওর ডেস্কের পেছনের দেয়ালে টাঙানো বিরাট সাইনবোর্ডের দিকে ইশারা করে।
সর্বত্র অক্ষরগুলো আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে, না পড়ে উপায় নেইঃ
ছত্তিশগড় ইন্ট্রিগেটেড রুর্যাল ব্যাংক
সি আই আর বি
(এ প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ অফ মনসুখানি হাউস)
আমার মাথা ঘুরছে, ধপ করে সোফায় বসে পড়েছি। ভাঙা গলায় বলি—আমি কিস্যু বুঝতে পারছি না। কেউ কি একটু হেল্প করবেন? আমি কি সত্যিই ভুল অফিসে এসেছি বা ভুল ঠিকানায়? এটা কি ভারত সরকারের একটি পাবলিল সেক্টর ব্যাংক নয়?
চারদিকের হইচই থেমে গিয়ে একেবারে সন্নাটা। ছাগলদাড়ি বলে—আপনার প্রশ্নের উত্তর একাধারে হ্যাঁ এবং না।
এ আবার কি হেঁয়ালি ?
--বুঝিয়ে বলছি। এই বিল্ডিং একসময় পুরনো গ্রামীণ ব্যাংকের হেড অফিস ছিল বটে, যেখানে আপনি কখনও চাকরি করতেন। সেটা ছিল পাবলিক সেক্টর ব্যাংক, কিন্তু এখন আর নয়। কারণ, হাউস অফ মনসুখানি এটা অধিগ্রহণ করেছে তিন বছর আগে।
--ভুল। গত সপ্তাহেও এটা পাবলিক সেক্টর ব্যাংক ছিল। আমি শুক্রবারে ফেস্টিভ্যাল অ্যাডভান্স নিয়েছিলাম। আর আপনারা শোনাচ্ছেন তিন বছর আগের অধিগ্রহণের গল্প। মানছি, তিন বছর আগে কোন এক বিজনেস হাউস থেকে অধিগ্রহণের প্রস্তাব এসেছিল। সরকারও রাজি। কিন্তু আমাদের সংযুক্ত ইউনিয়ন আন্দোলন করে সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল। যা খুশি বললেই হল?
সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। বুঝলাম, ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছি। মামার বাড়ির আবদার! একটা পাবলিক সেক্টর ব্যাংক, প্রফিটে চলছে—তাকে কোন ব্যাটা মনসুখানির ইচ্ছে হল তো টপ করে গুলাবজামুনের মত গিলে নিল, এমন হয় নাকি? এখনও আকাশে চন্দ্র-সূয্যি উঠছে।
কিন্তু ছাগলদাড়ি বোধহয় সহজে হাল ছাড়বে না। বড্ড নাছোড়বান্দা ঘ্যানঘ্যানে পার্টি। গত সপ্তাহে একটা এরকম পার্টি এসেছিল বটে!
নতুন স্টার্ট আপ, আট মাস হয়েছে। এখনও অপারেটিং প্রফিট হয়নি, ব্রেক ইভেন দূর কী বাত! বলে দশ লাখ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন দাও। বসের মন দোদুল্যমান। কারণ পার্টি পলিটিক্যাল রেকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। দেখলাম, সমূহ বিপদ।
বললাম,-- ল্যান্ড বা বিল্ডিং কিছু আছে, ক্লিয়ার টাইটেল? মর্টগেজ রাখতে হবে। আর টার্ন ওভার এবং স্টক স্টেটমেন্ট কই?
বলে সব জমা করেছি।
বললাম শুধু কাগজে হবে না, আমি ইন্সপেকশনে যাব। স্টক দেখে ভ্যালুয়েশন করব। জমির সার্চ রিপোর্ট করাতে হবে, বারো বছরের। আর করবে আমাদের ব্যাংকের প্যানেলের উকিল।
ব্যস, ওর হয়ে গেল! শেষে বলে- আচ্ছা, অন্ততঃ পাঁচ লাখ দিন। ঠিক আছে, মর্টগেজ দিতে পারব না; দু’লাখ দিন, আরে কিছু তো দিন।
বস আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম—নাথিং ডুইং। ফিল্ডে গিয়ে দেখতে হবে এর মধ্যে অন্য কোন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে চেপে বসে আছে কিনা।
তখন ব্যাটা উঠে বিড়বিড় করে আমার মা-মাসি করতে করতে বেরিয়ে গেল।
আজ এদেরও ওই হাল করে ছাড়ব, পরে যত ইচ্ছে গাল দিক গে’।
কিন্তু নাছোড়বান্দা ছাগলদাড়ি আমার সামনে ঝুঁকে পড়েছে। ওর চোখে তীব্র দৃষ্টি ।
--বলুন তো মিঃ রায়চৌধুরী, আজ কত তারিখ এবং কোন সাল?
--এবং কী বার? মঙ্গল নাকি শনি?
এটা ওই রিসেপশনিস্ট মিসেস সুব্রাহ্মনিয়ম। এর বড় বাড় বেড়েছে তো!
--এক এক করকে। আজ মঙ্গলবার । গতকাল সোমবার মহাশিবরাত্রিতে ব্যাংক বন্ধ ছিল। তারিখ ২৭ শে মার্চ, ২০১৯।
এবার সব চুপ; দিয়েছি ব্যাটাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে। হুঁ হুঁ বাবা!
কিন্তু ভিড় আমার চারপাশে আরও ঘন হয়ে এল। একটা উচ্চিংড়ে ছোঁড়া আমার মুখের সামনে আঙুল নেড়ে বলতে লাগল—বলুন তো আংকল, ক’টা আঙুল? ঝট সে বোলিয়ে!
আমি ওকে উপেক্ষা করে ছাগলদাড়ির দিকে তাকাই—কী হল?
ও বিষণ্ণ মুখে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।
--সরি, রায়চৌধুরীজী, আপনার শেষ উত্তরটা, মানে মঙ্গলবার ঠিক, কিন্তু সালের ও মাসের হিসেব ভুল। এটা ২০২৩। আমরা আপনার ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছি ২০১৯ সালে, ঠিক চারবছর আগে।
আর গত কাল ব্যাংক বন্ধ ছিল মহাশিবরাত্রির জন্যে নয়, ভাইদুজের হিসেবে। শনিবার ছিল বড়ী দিওয়ালী, আপনাদের কালীপুজো। আর আজকের দিন এবং তারিখও ভুল বলেছেন—মার্চ নয়, ২৮শে অক্টোবর।
আমার মাথার ভেতরটা খালি হয়ে গেছে। অতিকষ্টে বলি, পুরনো স্টাফ কেউ থাকলে তাকে ডাকতে। তাদের মুখ থেকে সত্যি সত্যি কী হয়েছে শুনতে চাই।
--সরি রায়চৌধুরীজী। কেউ নেই। অধিগ্রহণের শর্ত অনুযায়ী পুরনো সবাইকে কমপেন্সেশন প্যাকেজ দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনিও পেয়ে থাকবেন—২০১৯ সালে অধিগ্রহণের সময়।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। জ্ঞান হারানোর সময় কানে এল কেউ বলছে –অ্যাই ডক্টর শ্রীবাস্তবকে কল দে, এর পালস্ চেক কর।
চোখ মেললাম রিসেপশনের সোফাতেই। উঠে বসতে যেতেই সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল, শুয়ে থাকুন, আরেকটু শুয়ে থাকুন। একজন বুড়োমত ডাক্তার আমার প্রেসার মাপতে লাগলেন। ওনার ইশারায় সেই রিসেপশনিস্ট মহিলাটি এসে ছোট গেলাসে গ্লুকোজ ওয়াটার আর দুটো ক্যাপসুল গিলিয়ে দিল।
ডাক্তার বলল—আরও আধঘন্টা এখানেই শুয়ে থাকুন। তারপর ভালো লাগলে বাড়ি যাবেন।
আমি মাথা নাড়ি। বলি—ঠিক আছি, একবারে বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ব।
ছাগলদাড়ি অফিসার ওদের অফিসের সেই বোলেরো দিয়ে আমাকে ঘরে পৌঁছে দেবার অর্ডার দেয়। আমি ওদের থ্যাংকস্ বলে হাত নেড়ে লক্ষ্মীছেলের মত গাড়িতে উঠে পড়ি। ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণের তামাশায় আজকের কাজকম্মের বারোটা বেজে গেছে।
আজ নিজের নিজের ডেস্কে ফিরেও সবাই এই নিয়ে গুলতানি করবে। পাক্কা করবে। আসলে ব্যাংকের কাজটাই এত একঘেয়ে যে সবাই কোন না কোন ডাইভার্সন পেলে বর্তে যায়।
মনে পড়ল, একবার জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে জৈনমুনিদের পারায়ণ চলছিল। অফিসের উলটো ফুটে এক ধর্মশালায়। সাতসক্কালে দিগম্বর মুনিরা চান করে ঠান্ডায় হি হি করতে করতে নগ্নপদে দৌড়ে ধর্মশালায় যাচ্ছে, পেছন পেছন দৌড়ুচ্ছে ভক্তকুল, অনেকেই দীক্ষিত। তাদের মধ্যে আবার কিছু মহিলাও আছেন।
আমাদের তখন মুম্বাই থেকে কোন বড়সায়েবের আগমন উপলক্ষে সাজো সাজো রব। সবাই সক্কালে হাজির। কোন আমোদগেঁড়ে বলল—দেখে যা, শিগগির। ব্যস, আমরা দোতলার সবাই করিডোরে হাজির সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে। মায় ক্লার্ক মিস বিশ্বাস পর্য্যন্ত।
হাঁটাপথের দূরত্ব কুড়ি মিনিট, গাড়িতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগল না। কিন্তু আমি ঘরের দরজায় না নেমে পেছনের গলির মুখে নেমে গেলাম। ওই লম্বা লিকপিকে গলি দিয়ে শর্টকাট করলে শেষে একটা পার্ক, তার সামনেই আমার কলিগ ব্রজকিশোরের বাড়ি।
ওর সংগে কথা বলে বুঝতে চাই হয়েছেটা কী? নইলে পাগল হয়ে যাব।
যে ভাড়াবাড়িটার দোতলায় আমি থাকি তার সামনের মোড়ের নাম ‘দুর্ঘটনা চৌক’। কর্পোরেশনের খাতায় নাম ইন্দু চৌক, কিন্তু বিলাসপুর শহরের ম্যাংগো পাবলিক এটাকে জানে দুর্ঘটনা চৌক বলে। সেবার লাইনে কোন ফল্ট হওয়ায় আমার ঘরে কয়েকঘন্টা ধরে বিজলি হাওয়া। ফোন করে বিজলি বিভাগকে বললাম লাইনম্যান পাঠাতে। তো মই ঘাড়ে দুটো লোক এসে কাজ করে যাওয়ার সময় বলল-- এটাকে বলে দুর্ঘটনা চৌক, কারণ এই মোড়ে মাসে মিনিমাম একটা অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া বাঁধা।
মোড়টা এমন, যে কোন না কোন গাড়ি টার্ন নিতে গিয়ে রাস্তা ছেড়ে চারপাশের কোন বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা মারে। স্পীড কম থাকে বলে রক্ষা, কারও প্রাণ যায়নি, কিন্তু কেউ কেউ হাসপাতালে গেছে।এই তো, দু’মাস আগেই, এম পি ট্রান্সপোর্টের বাস টার্ন নিতে গিয়ে গার্লস কলেজের প্রিন্সিপালের সরকারী আবাসনের পাঁচিল ভেঙে বাগানে ঢুকে গোলাপ চারা পিষে ফেলল।
কাজের কথায় আসি। আমি ওই দুর্ঘটনা চৌকে নেমে আমাদের বাড়ির পেছনের সর্পিল গলিতে ঢুকে পড়ে সাবধানে খোলা নর্দমার উপচে পড়া নোংরা জল বাঁচিয়ে বকের মত পা ফেলে ফেলে এগোতে থাকলাম।এটা দলিতদের মহল্লা। এরা চামড়ার কাজ করে। তবলা, ঢোল, মাদল এই সব বানায়।
এখন ভর দুপুরে কারও আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশ ঘরের দরজা বন্ধ। সাবধানে এগোচ্ছি। দুপাশের নোনাধরা স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালে কোথাও কোথাও দু’একটা আরশোলা বা তিলচট্টা একেবারে সেঁটে রয়েছে।
কিন্তু পনের মিনিট হয়ে গেছে গলির ল্যাজামুড়ো বুঝতে পারছি না। কখন শেষ হবে?
আরে একী! একটা ঠেলাগাড়ি কেউ দাঁড় করিয়ে ভেগে গেছে। নিশ্চয় ঠেলাওয়ালা আশে পাশের কোন ঘরে থাকে। হয়ত এক খেপ মেরে দুপুরে বোরেবাসি বা পান্তাভাত খেতে বসেছে। কিন্তু এত সরু গলি যে ঠেলাগাড়ি না সরালে আমি এগুতে পারব না। কী যে করি!
তবে এতদূর এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না।
বাঁদিকের ঘরের বন্ধ দরজায় ঠক ঠক করে কোন লাভ হল না। কেউ দরজা খুলল না। সব যেন ঘোড়া বেচে নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে, যত্তসব!
এবার ডানদিকের ঘরে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক লুঙ্গি পরা বুড়ো, তার উদোম গায়ে গামছা জড়ানো। কোন কথা না বলে যেভাবে তাকাল তার মানে –আপকা লফড়া ক্যা হ্যায়? ঝামেলিটা কী বলে ফেল।
--ব্রজকিশোরের বাড়ি যাব, কিন্তু এই ঠেলাগাড়িটা না সরালে যাব কী করে?
বুড়ো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বোঝায় যে তার ও কী করবে? নিজের ম্যাও নিজে সামলাও।
--কোন শর্টকাট নেই? অন্য কোন রাস্তা?
বুড়ো কিছু ভাবে। তারপর বলে –আছে, ভেতরে একটা কোচিং চলছে এখানকার বাচ্চাদের জন্যে। তার মধ্য দিয়ে গলে যাওয়া যায়, একেবারে ব্রজকিশোরের পাড়ায়।
আমি ওর পেছন পেছন ঢুকে পড়ি আর ও ভেতর থেকে শেকল তুলে দেয়।
বাইরের কড়া রোদ্দূর থেকে ভেতরে এসে এই চারদিক-বন্ধ ঘরে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। গাঢ় অন্ধকার।
ও হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতে থাকে। একটা করিডর। তারপরে একটা কামরার দরজা খুলে ভেতরে ঠেলে দেয়। বলে- বেঞ্চিতে ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়। ক্লাস শেষ হলে এর পেছন দিয়ে স্যার নিজে তোমাকে ব্রজকিশোরের বাড়ি নিয়ে যাবেন।
এই ঘরটায় অন্ধকার আরও গাঢ়। কারণ সামনের সাদা দেওয়ালে তীব্র আলোর ফোকাস পড়েছে, তাতে নানান রকম চিহ্ন এবং সংখ্যা ফুটে উঠেছে, কিছু গ্রাফ। আরেকটু নীচু আওয়াজে কেউ কিছু বলে চলেছেন, বোধহয় ইংরেজিতে। কিন্তু আমার কানে ওনার উচ্চারণ, গলার স্বরের ওঠানামা কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না।
মনে হল, একটা ক্লাস চলছে, সম্ভবত অংকের ক্লাস, হায়ার লেভেলের। কারণ সাইনগুলো আমার অপরিচিত। আর আলোটা আসছে একটি ও এইচ পি, অর্থাৎ ওভারহেড প্রোজেক্টর থেকে—যেমনটি আমাদের ব্যাংকের সেমিনার বা ট্রেনিং ক্লাসে হয়।
চোখ সয়ে গেলে টের পেলাম ঘরের ভেতরে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মত কিছু, বোধহয় ছাত্রের দল। হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালের পাশে একটা বেঞ্চির কোণে বসে দেয়ালে হেলান দিতেই চোখ লেগে গেল। ব্যাংকের অফিসে জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তার বোধহয় কোন সিডেটিভ দিয়েছিলেন।
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানিনা। জেগে উঠলাম একটা ঠেলা খেয়ে। ধড়মড়িয়ে উঠে চোখ কচলে দেখি ক্লাস ফাঁকা, কিন্তু আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে একজন প্রৌঢ়, চাঁচাছোলা মুখ, একহারা চেহারা। মাথায় টাক হলেও কানের পাশে কিছু কাঁচাপাকা চুল। তাঁর চেহারায় বিরক্তির চিহ্ন।
--ক্লাসের মাঝখানে ঘুমুচ্ছিলে কেন?
কী উত্তর দেব?
মাল্টিপল চয়েস।
ঘুম পেয়েছিল তাই ঘুমুচ্ছিলাম। লেকচারটা বড্ড একঘেয়ে, ঘ্যানঘেনে—তাই ঘুমুচ্ছিলাম। অংক আমার বিষয় নয়, তাই ঘুমুচ্ছিলাম। আসল কথাটা যদি খুলে বলতে হয়—ডাক্তার ইত্যাদি তাহলে মুশকিল।
বোবার শত্রু নেই, কথাটা ভুল। উনি আরও চটে গেলেন।
আরেঃ, এই কথাটা আমায় দু’দশক আগে ভিলাইয়ের কলেজের ক্লাসরুমে সিদ্দিকি স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন না? চুপ করে থাকায় আরও বলেছিলেন—চারপাশে এত গার্লস, তবু ঘুম পেল? তুমি কেমন পুরুষ?
--এখানে কেন এসেছ? পড়তে না ঘুমুতে?
--আমি পড়তে আসি নি। ব্রজকিশোরের বাড়ি যাব বলায় এখানে ঢুকিয়ে দিল।
--আমিই ব্রজকিশোর। বল, কী চাও?
আমি অবাক হয়ে ভদ্রলোককে দেখতে থাকি। নাঃ এ কোন মতেই আমার এক্স-কলিগ ব্রজকিশোর নয়। পাঁচবছর হল ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। অন্য জেলায় ট্রান্সফার হয়ে গেছল। তার মধ্যে চুল পেকে টাক পড়ে এই অবস্থা? আবার একটা নেয়াপাতি ভুঁড়ি!
--আপনাকে নয়, আমি আমার ব্যাংকের কলিগ ব্রজকিশোরের বাড়ি যাব ভেবেছিলাম।
--এখানে আর কোন ব্রজকিশোর নেই। আগেও ছিল না, পরেও হবে না। আমিই একমাত্র ব্রজকিশোর, আদি এবং অকৃত্রিম।
এবার কেমন ভয় ভয় করছে। আচ্ছা লোকের পাল্লায় পড়া গেছে! সারাদিন কি এমন ভুলভুলাইয়ার চক্করে ঘুরে ঘুরে কাটবে? কোত্থাও না, সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমুব, ঘাট হয়েছে, আর এসবের মানে বোঝার চেষ্টা করি!
--ঠিক আছে, তাহলে আমি যাই। এতক্ষণে হয়ত ঠেলাগাড়িটা সরে গিয়ে গলিতে লোক চলাচল শুরু হয়েছে।
একটা নিঃশব্দ হাসি সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।
--যাই বললেই যাওয়া যায় নাকি? এতটুকু ভদ্রতা বোধ নেই? আমি খর্চাপাতি করে এই কোচিং খুলেছি কি না পড়ে চলে যাবার জন্যে? তোমার চোদ্দপুরুষের—
নাঃ, লোকটা গালাগালটা মুখে না এনে নিজেকে সামলে নিয়ে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বিড়বিড় করতে লাগল।
আমার মাথায় একটা প্ল্যান এল। ফীস জিগ্যেস করি? তারপর বলব—আজ নয়, টাকাপয়সা জোগাড় করে কাল থেকে পড়তে আসব। লোকটা হয় পাগল, নয় শয়তান। কেটে পড়াই মঙ্গল।
--আমার এখানে পড়তে কোন পয়সা লাগে না।
লোকটা কি অন্তর্যামী?
--শোন, তোমার মত ছাত্রদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। সবক’টা এক একটি শ্যামাদাস, খালি ক্লাস কেটে সিনেমা দেখার ধান্ধা। তোমার কপাল ভাল, ইদানীং আমার রাগ অনেক কমেছে আর মুখে আগল লেগেছে।
পাগলটাকে পটাতে হবে। তারপর পালাবার সুযোগ পাওয়া যাবে।
--আচ্ছা, আপনি বুঝি আগে খুব রাগী ছিলেন? কতদিন আগে স্যার?
--একটা গল্প শোন। আগে আমি বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার একটা মৌজায় সাড়ে সাত আনার জমিদার ছিলাম। তখন দেশে স্বদেশী আন্দোলনের ধূম। স্বয়ং গান্ধীজি এসেছেন আন্দোলনের এবং সবরমতী আশ্রমের জন্যে চাঁদা তুলতে। আমার এলাকায় চাঁদা তোলার ভার আমি নিয়েছি।
তা গাঁয়ের সব মাথাদের নিয়ে ছোটখাটো সভা ডাকলাম। যতগুলো পাড়া আছে তাদের মোড়ল, মন্দিরের পুজারী, আরও দু’দশটা গ্রামের জমিদার সবাই মিলে সভা জমজমাট।
আমাকে বলা হল একটা লেকচার দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে। সেই হল সাড়ে সর্বনাশ। আমার তখন মুখে লাগাম ছিল না। ঢুকত জর্দা দেওয়া পান আর বেরোত গালাগালি, পিক ফেলার মত ।
বললাম, কাল গান্ধীজি আসছেন চাঁদা নিতে। তোমরা যে যা পার দাও, একদম দিল খোলকে। টাকা আনা যে যেমন পার। তোমাদের এক এক আনা মিলে গান্ধীজির একশ’ টাকা হবে। সেই টাকার জোরে গান্ধীজি একটা মস্ত বড় ডান্ডা কিনে ব্রিটিশের পেছনে ঢুকিয়ে দেবেন। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বাপ রে মা রে ডাক ছেড়ে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফিরে যাবে।
ওমা, আমার লেকচার শেষ হতে সবাই দেখি গুটি গুটি উঠে হাঁটা দিয়েছে। কেউ একটি পয়সা উপুড়হস্ত করেনি। আমার হল রাগ।
বললাম- ওরে হারামখোরের দল, ওরে নিমকহারাম! ওরে মা-মেগো বোন-মেগোরা! একটা ফুটো কড়িও ট্যাঁকে নেই? এইভাবে পালিয়ে যাচ্ছিস তো গান্ধীজি কি কাল এখানে নিজের অ্যায়সি কী ত্যায়সি করাতে আসবেন?
কোন লাভ হল না।
পরের দিন গান্ধীজি যখন এলেন তখন আমার না আছে একটা লোক, না বটুয়ায় একটা ফুটো পয়সা।
--গান্ধীজি কী বললেন?
--উনি স্নিগ্ধ হেসে আমার মাথায় হাত রেখে একটা বাংলা দোঁহা বললেন, মহাভারত থেকে।
“ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ, ক্রোধে কুলক্ষয়,
ক্রোধে সর্বনাশ হয়, ক্রোধে অপচয়”।
--ব্যস? আর কিছু নয়?
--হ্যাঁ, বললেন- ব্রজকিশোরজী, আপনি বাণী কে নিয়ন্ত্রণ করুন। অপশব্দ ইতর শব্দ ইত্যাদি ক্রোধের প্রকাশ মাত্র এবং পরিণামে হিংসার জন্ম দেয়। হিংসা রক্তবীজের মত , হিংসা আত্মঘাতী।
এছাড়া আপনি মিথিলা অঞ্চলের লোক। এখান থেকেই কবি বিদ্যাপতি এবং রাজা শিবসিংহ ব্রজভাষায় কত মধুর পদ রচনা করেছেন। নিরর্থক গালি দিয়ে আপনার ভাষাকে কলুষিত করবেন না।
--তারপর?
--তারপর আর কি, ছিলাম মিথিলার রাজা জনকের এলাকার একটা মৌজায় সাড়ে সাত আনার জমিদার। হয়ে গেলাম ছত্তিশগড়ের এক কানাগলির ভেতর কোচিং মাস্টার ব্রজবাবু। আমি ফীস নিই না। কিন্তু কেউ খুশি হয়ে কলাটা মূলোটা দিলে গ্রহণ করি। পাপী পেট কা সওয়াল হ্যায়।
--সবাই নিশ্চয়ই খুব দেয়?
--নাঃ , কেউ কেউ দেয়। বেশির ভাগ কিছু দেয় না। আমার কোন আফশোস নেই। যো দে উসকা ভালা, যো না দে, উসকা ভী ভালা। দিক না দিক, সবাইকে ভাল করে পড়াই।
--কী পড়ান? গান্ধীজির স্বদেশী এবং গ্রামসমাজের ইকনমিক্স?
--আরে না না। আমি তো অংক পড়াই। ওই সব আইআইটি এবং জয়েন্ট ক্লিয়ার করার ম্যাথস্ নয়। ওরকম কোচিং বিলাসপুর শহরে গণ্ডায় গণ্ডায় আছে।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। একটু হায়ার ম্যাথস পড়াই, ধর টাইম মেশিন বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রবলেমস্।
ঠিক আছে, তুমি অংক শিখতে চাও না? কোই বাত নহীঁ। তোমার সমস্যাটা কী, মানে কী জানতে চাও আমায় একটু বলে দেখ। যদি আমি কোন হেল্প করতে পারি।
আমার মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে। আমার দরকার টাইম মেশিন, তিন বছর আগে কী হয়েছিল? আমার পাবলিক সেক্টর ব্যাংক কী করে ভোগে গেল আর কোন মনসুখানি মন চাহা দামে কিনেও নিল? আমরা তখন কী করলাম !
পারবে, বিলাসপুরে কেউ যদি পারে তো এই পাগলা মেহের আলি ব্রজকিশোরই পারবে। আমার মাথায়ও একটা পাগলামি চাড়া দেয়। আমি দু’কথায় বলি যে ২০১৯ সালে কী হয়েছিল সেটা বুঝতে চাই। আপনি বোঝাতে পারবেন ?
--কেন নয়? শুধু বোঝাতে কেন, দেখাতেও পারব। এই যেমন আমাকে দেখছ, তেমনই দেখতে পাবে।
ও বাবা ! এ যে দেখছি রামকেষ্ট ঠাকুর। নরেনকে মুখের উপর বললেন হ্যাঁ, উনি ঈশ্বরকে দেখেছেন। নরেন্দ্রকেও দেখাতে পারেন!
--আচ্ছা! কী ভাবে দেখাবেন?
--শোন, ব্রহ্মাণ্ডের গতির ইউনিট হল আলোক বর্ষ, লাইট ইয়ার।
এক আলোক বর্ষ মানে এক বছরে আলোক রশ্মি প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলো মিটার গতিবেগে যতদূর যায়, অর্থাৎ প্রায় ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব।
--উঃ , এ যেন “বলছিলাম কি বস্তুপিন্ড সুক্ষ্ম হতে স্থুলেতে,
অর্থাৎ কিনা লাগলো ঠ্যালা পঞ্চভূতের মূলেতে”।
--মানে? এসব কি আগড়ম বাগড়ম বকছ?
--স্যার, আপনি তো আমায় শ্যামাদাস ঠাউরেছেন। বলছিলাম কি একটু সহজ করে বলুন না! মানে কীভাবে তিন বছর আগের ঘটনা চর্মচক্ষে দেখতে পাব।
হুম, অধ্যাপক ব্রজকিশোর একটু টাক চুলকে নিলেন।
--শোন, কোন জিনিস আমরা কখন দেখতে পাই? যখন সেই জিনিস থেকে আলো এসে সোজাসুজি আমাদের চোখের রেটিনায় আঘাত করে। সেখান থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইম্পালস্ গিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে কম্পন তোলে। ব্রেন সেটা রীড করে আগের মেমোরি ডেটার প্যাটার্ণের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। আর আমরা তখন জিনিসটিকে দেখতে পাই। তেমনি সূর্যের থেকে কোন রশ্মি রওনা দিয়ে পৃথ্বীতে আমাদের চোখে পৌঁছাতে সময় নেয় ৮.৩ মিনিট। তখন আমরা সূর্যকে দেখতে পাই।
কিন্তু সূর্য তো পৃথিবী থেকে মাত্র ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে। আর ওখান থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় নেয় ৮.৩ মিনিট। অর্থাৎ তুমি এখন পৃথিবীতে যে আলো দেখছ সেটা সূর্যের থেকে ৮.৩ মিনিট আগে রওনা হয়েছে। তাহলে তুমি যদি সূর্যের কাছে গিয়ে পৃথ্বীর দিকে তাকাও—
--এক মিনিট স্যার, তার আগেই আমি পুড়ে শেষ হয়ে যাব। মহাভারতে আছে না? আর সেই আইকেরুসের গল্প—যে মোমের পাখনা মেলে সূর্যের দিকে উড়ে যাচ্ছিল।
--ধ্যাৎ, হাইপোথেটিক্যালি দাঁড়াতে বলছি।
--না স্যার, আমার অমন কোন ক্যালি নেই। অন্য ভাবে বোঝান।
--ঠিক আছে। এই মিল্কিওয়ে নীহারিকা মণ্ডলীর মাঝে আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশি নক্ষত্রের নাম Proxima Centauri, ওখান থেকে আলো আসতে লাগে ৪.২ বছর।
উলটো ভাবে বললে তুমি যদি এখন ওই প্রক্সিমাতে গিয়ে দাঁড়াও তাহলে ৪.২ বছর আগের পৃথিবীকে দেখতে পাবে। সেই সময়ের ব্যাংক, তার বিবর্তন সব মহাকাশের অদৃশ্য ভিডিওতে ধরা আছে।
--স্যার, ওসব তো থিওরিতে চলে। বাস্তবে কি আপনি আমাকে ওসব দেখাতে পারেন?
--কেন, প্ল্যানেটোরিয়ামে গেছ? ওখানে গিয়ে মহাকাশ যাত্রা করেছ?
--স্যার, ওটা তো কম বয়সে গেছলাম, সার্কাস দেখার মত। কাজেই—
--পাশের কামরায় চল। তিন বা চার বছর সময়ের মাপদণ্ডে বড্ড ছোট, অনেক মাইক্রো ইউনিট। আমি তোমাকে ১০০ বছর আগে থেকে দেখাব। ওঘরে থ্রিডি প্রোজেক্টর রয়েছে।
আমি সম্মোহিতের মত আধপাগল ব্রজকিশোর স্যারের পেছন পেছন অন্য একটি কামরায় ঢুকি।
দেয়াল জুড়ে বিশাল এক স্ক্রীন। টেবিলে টেলিস্কোপ গোছের দু’তিনটে যন্ত্র। নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলে পরে স্যার আমাকে একটা থ্রি ডি চশমা দিয়ে বললেন ভাল করে পরে নিতে।
এক গেলাস জল খেয়ে তৈরি হলাম টাইম মেশিনে যাত্রা করতে।
খানিকক্ষণ খুটখাট করার পর আলো নিভে গেল। সাউণ্ড সিস্টেমে শোনা গেল অন্য এক অচেনা কণ্ঠস্বর। আর পর্দা জুড়ে ফুটে উঠল কিছু সাদা কালো ছবি। ছবিগুলো দেখলে ভারত সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের ছোটবেলার তথ্যচিত্রের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেসব অবশ্য এই শতাব্দী ছোঁয়ার অনেক আগেই চুকে বুকে গেছে।
আমি বুঁদ হয়ে দেখতে থাকি। পর্দায় একটা টাইটেল ফুটে উঠল—বৃটিশ ভারত।
পর্দায় রঙিন ছবি--আমজাদ খান, থুড়ি ওয়াজিদ আলি শাহ, জেনারেল আউট্রামের সামনে নিজের তাজ নামিয়ে রাখছেন। লক্ষ্ণৌ ছেড়ে কোলকাতার উদ্দেশে রওনা দেবার সময় আমজাদ চোখ বন্ধ করে গাইছেন—জব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী!
আরে এটা তো আমার দেখা সিনেমা—সত্যজিতের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’।
সিপয় মিউটিনি। ঘোড়সোয়ার বাহিনী, বৃটিশ ও বিদ্রোহী সেনা। অস্ত্র ঝঞ্ঝনা , ঘোড়ার হ্রেষা, আহতদের চিৎকার। শশি কাপুর গোপনে আশ্রয় দিয়েছেন একটি ইংরেজ পরিবারকে, ইস্মত চুঘতাই ও নাফিসা আলিকে। আর কিশোরী নাফিসাকে কল্পনা করে নিজের বেগম শাবানাকে প্রায় রেপ করে ফেলছেন।
ধ্যাৎ, এটা তো শ্যাম বেনেগালের ‘জুনুন’।
পর্দায় সাদা কালো ডকুমেন্টারি শুরু হল।
তবে এই লোকটা কে? মাথায় একটা কালো টুপি, পরণে ধুতি, হাঁটু অব্দি মোজা আর জুতো। আরে , এই গরমে একটা গলাবন্ধ কোট কেন? ওর চোখ দুটো ভাঁটার মতন জ্বলছে।
--সব ভুল, বুঝলে খোকন। তোমাদের মিথ্যে গেলানো হচ্ছে। এটা আদৌ শুধু সিপাহীদের বিদ্রোহ ছিল না। এস্টেট বা রাজ্য হারানো জমিদারদের গদি ফিরে পাওয়ার লড়াই ছিল না। এ ছিল কৃষকদের লড়াই, হিন্দু মুসলমান, ছোট বড় জাত সবার লড়াই। এ ছিল আমাদের পুণ্যভূমি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই লড়াইয়ে ভারতমাতার বীর সপুতেরা সবাই নিজেদের মধ্যে জাতি-ধর্ম-ভাষার প্রভেদ ভুলে একসাথে লড়েছিল। এক নতুন ভারত জন্ম নিচ্ছিল যার প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লির তখতে বসতেন শেষ মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর।
আপনি কে?
--আমি ব্যারিস্টার বিনায়ক দামোদর সাভারকর, অভিনব ভারত এবং হিন্দু মহাসভার নেতা।
-আপনিও চাইতেন বাহাদুর শাহ জাফরকে ?
--তখন লড়াকু বিদ্রোহীরা চেয়েছিল। আমিও চাইতাম ১৯০৯ সালে।
আর এখন?
সাভারকর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন।
পাগল মেহের আলি তার ঘোলাটে চোখে চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে-- হঠো! তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়!
পর্দা সাদা হয়ে গেল।
ফিল্ম ডিভিশন আন্দামানের জারোয়াদের উপর একটা তথ্যচিত্র দেখাচ্ছে। কিন্তু জারোয়াদের জাম্প কাট করে পর্দায় ভেসে উঠল সেলুলার জেল আর তার সাতটা উইং।
উঠোনে রান্না করছেন হেমচন্দ্র দাস। যোগান দিচ্ছেন উপেন্দ্র ও বারীন্দ্র। ভাত ডাল নেমে গেছে। তবে জেলের বাইরের গ্রাম থেকে কেউ একটা মোচা দিয়ে গেছে। আজ মোচার ঘন্ট রান্না হবে। হৈ চৈ পড়ে গেছে।
একটু আগে রান্নার পদ্ধতি নিয়ে তর্কাতর্কি হয়ে গেছে।
বারীন্দ্র—আমার দিদিমা হাটখোলার দত্ত বাড়ির মেয়ে এবং পাকা রাঁধুনি, সুতরাং আমার মতই ঠিক।
হেমদাদা—আমি ফ্রান্সে গিয়ে ফরাসী রান্না শিখে এসেছি। সুতরাং আমার পদ্ধতিই ঠিক।
স্বদেশী কাজে বিদেশি ডিপ্লোমার বেশি সম্মান। এবং মেদিনীপুরের ড্রইং টিচার হেমচন্দ্র ঘরবাড়ি বেচে ফ্রান্সে গিয়ে বোম বানানোর ফর্মূলা এবং পদ্ধতি সব শিখে এসেছেন। তারপরে মানিকতলা এলাকার মুরারিপুকুরে অরবিন্দ ঘোষের বাগান বাড়িতে বোম বানানো ও ট্রেনিং দেওয়ার কাজ চালিয়ে গেছেন।
এবার উপেন্দ্রের ক্লোজ আপ।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—এঁকে চেন? মানে হেমদাদাকে?
আমাদের দেশের সমস্ত বিপ্লবীদলের বোমা বাঁধার দ্রোণাচার্য উনিই। মজঃফরপুরের ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবের জুড়িগাড়িতে যে বোমা ছুঁড়ে ছিলেন সেটার যোগানদারও ইনি। তাতে সাহেবের স্ত্রী ও কন্যা মারা গেলেন বটে, তবে তার পাপের বোঝা হেমদার কাঁধে কেন চাপবে? আর ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত আড়াই ’দশক পরে পার্লিয়ামেন্ট ভবনে বোমা ছুঁড়ে যে তুলকালাম বাঁধালেন সেটাও ওনার সাপ্লাই।
কিন্তু ওই দেখ! হেমদাদা কড়াইয়ে তেল গরম করে পেঁয়াজের ফোড়ন দিয়ে তাতে মোচা ছেড়ে দিলেন!
গেল, গেল-- সব গেল!
খেতে খেতে সবাই হাসছে। মোচার ঘণ্ট কুচকুচে কালো। তাতে পেঁয়াজের গন্ধ। আহা! এটা বুঝি ফরাসী কুইজিন!
ফের তর্কাতর্কি।
বারীন্দ্র সাভারকরের উপর খাপ্পা। সাভারকর নাকি বলছেন --ভারত স্বাধীন হলে মারাঠি পেশোয়াদের রাজত্বই উচিত হবে। বাঙালীরা বড্ড প্রাদেশিক। বঙ্কিম বন্দে মাতরমে ‘সপ্তকোটি কণ্ঠ’ বলেছেন, তেত্রিশ কোটি বলেন নি তো! আবার দ্বিজেন্দ্রলাল গান লিখেছেন—বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার আমার দেশ। ধুস্ ।
উপেন্দ্র ফোড়ন কাটল।
শুনেছ হেমদাদা, সাভারকর নাকি লিখেছে যে ও তোমাকে ‘অভিনব ভারত’ দলের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিল। কবে দিল? তুমি তো যুগান্তর দলের প্রভাবে প্যারিসে গিয়ে এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট হয়ে ফরাসী পুলিশের হুড়ো খেয়ে মাত্তর কয়েক মাসের জন্যে লণ্ডন গেছলে।
তারপর তো সোজা কোলকাতায় আমাদের মুরারিপুকুরের বাড়িতে।
হেমচন্দ্র মিটিমিটি হাসছেন, বললেন বাজে কথা ছেড়ে খেতে শুরু কর। বল মোচার ঘণ্ট কেমন হয়েছে? ভালো রেঁধেছি না?
নাকতলার খেলার মাঠে চায়ের দোকানে বীরেশকাকু নিজের ছেলে ছ্যাং’কে তাড়া করেছেন। এঁচোড়ে পাকা ছেলেটা সবার সামনে ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে—বাবা, আইজ ক্লাসে স্যার জিগাইছিল তিলকের পুরা নাম কি? কইতে পারি নাই। কী গঙ্গাধর তিলক যেন? তুমি তো জান।
--বাঞ্চোইত, জাননা কী গঙ্গাধর? বাল!
এই বলে বীরেশকাকু দোকানের ঝাঁপের লাঠি খুলে ছেলেকে তাড়া করলেন।
পর্দায় দেখা যাচ্ছে বিশাল জনসমুদ্র। কংগ্রেসের কনফারেন্স, মঞ্চে উঠছেন গান্ধীজি, নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, বল্লভভাই প্যাটেল, সি আর দাশ, ভুলাভাই দেশাই। একজন খেঁকুরে চেহারার স্যুটটাই পরা লম্বামত লোক চুরুটে টান দিতে দিতে প্যান্ডেলের নীচে ঢুকল। তারপর আধপোড়া চুরুটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে গটগটিয়ে সোজা স্টেজে উঠে গেল।
ওর গর্তে বসা উজ্বল চোখদুটো অনেকটা সাভারকরের মত।
ওর বক্তৃতার পালা এলে মাইকে স্পষ্ট গলায় বলল –না, না। মুসলমানের জন্য আলাদা দেশ? হাস্যকর প্রস্তাব। যার একটু বুদ্ধিশুদ্ধি আছে সে এই প্রস্তাবে রাজি হতে পারে না। আমাদের ইংরেজের হাত থেকে মুক্তি চাই। নতুন ভারত হবে আধুনিক রাষ্ট্র , কোন থিওক্র্যাটিক স্টেট নয়। আমরা মুসলিম লিগের সঙ্গে একমত নই। দেশকে ভাগ করা চলবে না।
তালিয়াঁ ! তালিয়াঁ!
কিন্তু লোকটা স্টেজ থেকে নামার আগে গান্ধীজির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল—হ্যাল্লো মিঃ গান্ধী! হাউ ডু ইউ ডু?
গান্ধীজি স্মিত হেসে বললেন—ফাইন!
তারপর হিন্দিতে বললেন –আপনি কেমন আছেন মিঃ জিন্না? শুনেছিলাম ইদানীং আপনার শরীরটা নাকি ভালো যাচ্ছে না?
কিন্তু লোকটা নেমে দু’পা এগোতেই কিছু ভলান্টিয়ার ওর কলার চেপে ধরল। কেউ টেনে ধরল ওর টাই। মহাত্মাকে মিঃ গান্ধী বলা? ধম্মে সইবে?
সুভাষ বোস নেমে এসে দুই ধমকে সেবাদলের উচ্চিংড়ে স্বেচ্ছাসেবকগুলোকে সরালেন। জিন্নাকে অনেকবার সরি বললেন। জবাবে জিন্না শুধু হাসলেন। কিন্তু ওঁর চোখদুটো জ্বলছে।
আবার সাদা কালো ছবি।
জেলের মধ্যে ভগত সিং হাসছেন।
নেহেরু গরাদের ফাঁক দিয়ে বলছেন – শোন, ফাঁসির সাজা মকুব করার জন্যে মার্সি পিটিশন লিখবে? তোমার উপর অ্যাসেম্বলিতে বোম মারা ছাড়াও আরেকটা সিরিয়াস চার্জ আছে, ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার স্যাণ্ডার্সকে গুলি করে হত্যা। কাজেই তোমার ছাড়া পাওয়া মুশকিল। কিন্তু যদি প্রাণটা বাঁচে তবে—
ভগত সিং আরও জোরে হেসে উঠলেন।
--পিটিশন তো আমি পাঞ্জাবের গভর্নরকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
--কী লিখেছ? সাজা মকুব হলে হিংসার পথ ছেড়ে দেবে?
--চার্জশীট হিসেবে আমরা তো যুদ্ধবন্দী, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি নাকি! তাহলে আমাদের ফাঁসি হয় কী করে? আবেদন করেছি যাতে আমাদের তিনজনকে, মানে আমাকে, রাজগুরু ও সুখদেবকে, ফাঁসি না দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়। ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
শূন্য পর্দা। সাউন্ড ট্র্যাকে বাজতে থাকে রাগ দরবারী কানাড়ায় ‘সর ফরোসি কী তমন্না আজ হমারে দিল মেঁ হ্যায়। দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মেঁ হ্যায়!
আঘাত হানবে গর্দানে আজ তরবারি খরশান,
দেখব আজকে ঘাতকের বাহু নেবে আর কত প্রাণ।
রাত্তির পৌনে এগারটা। চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে ইউরোপিয়ান ক্লাব। আঙিনার সামনে ফেন্সিং এর গায়ে একটা সাইনবোর্ড-“ ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান্স আর নট অ্যালাউড ইনসাইড”।
দশজন সন্তর্পণে এসে দাঁড়িয়েছে ওই সাইনবোর্ডের সামনে। সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের নেতা একজন শিখ তরুণ। সে ইশারা করায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল ওই সাইনবোর্ডে। তারপর শুরু হল গুলি চালানো। লক্ষ্য ক্লাবের ভেতরে খানাপিনায় মত্ত ইউরোপিয়ান নরনারী।
আর্তনাদ, আতংক। ক্লাবের ভেতরের আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুলি লেগেছে বেশ কয়েকজনের। কিন্তু ভেতরে ছিল সশস্ত্র পুলিশ। তারা বিল্ডিং এর আড়াল থেকে পজিশন নিয়ে গুলি চালাতে লাগল।
বিদ্রোহীদের নেতা বললেন—এবার রিট্রিট। আমাদের উদ্দেশ্য সফল। আরও বড় কাজ বাকি। সবাই সরে যেতে লাগল। কিন্তু নেতার গায়ে বিঁধেছে একটা গুলি। রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে অজস্রধারে। নেতা মাথার পাগড়ি খুলে ফেললেন। শিখের ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে এল এক তরুণী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। পাগড়ির কাপড় দিয়ে গুলি বেঁধা জায়গাটা চাপা দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা তেমন সফল হল না। শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। পা চলছে না।
এদিকে সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলেছে জায়গাটা। এগিয়ে আসছে গুলি চালাতে চালাতে। প্রীতিলতার গুলি ফুরিয়ে গেছে। বুঝতে পারছেন যে পালানো অসম্ভব।
কিন্তু মাস্টারদা’র স্নেহধন্য রাণী কিছুতেই ধরা দেবেন না, মেনে চলবেন সূর্য সেনের অন্তিম নির্দেশ। কোমরের বটুয়ার থেকে হাতড়ে বের করলেন পটাসিয়াম সায়নাইডের ক্যাপসুল।
কে সি দে খোলা গলায় গাইছেন –মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান।
পর্দায় দুটো মুখের ক্লোজ আপ। দু’জনের চোখে চশমা। দু’জনের মুখে বিষণ্নতার ছায়া। একসময় দু’জনেই জেলে ছিলেন। একজন আন্দামানের সেলুলার জেলে, অন্যজন ব্রহ্মদেশের মান্দালয় জেলে।
--মিঃ সাভারকর, অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
আগে মিঃ জিন্নার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বলেছিলাম –এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দারুণ সুযোগ এসেছে ইংরেজকে আঘাত হানার। আসুন সবাই মিলে সমর্থন করি মহাত্মাজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের। গোটা দেশ জেগে উঠেছে।
উনি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন ওনার লক্ষ্য ইংরেজদের প্রেশার দিয়ে মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা দেশ আদায় করা। প্লীজ, আপনি আমাদের নিরাশ করবেন না।
--সরি মিঃ বাসু । দেখলেন তো জিন্নার চাল।
আমি চাইছি ইংরেজদের প্রেশার দিয়ে এই সুযোগে বৃটিশ ফৌজে ৭৫% হিন্দু যুবকদের ভর্তি করাতে। ওরা আধুনিক অস্ত্র চালানো শিখে তৈরি হবে আগামী মহাসমরের জন্যে।
--সে কী! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো চলছে। আবার কোন মহাসমর?
--কেন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগামী মহাসমর। ওরাই আসল বিদেশী । ওরাই আক্রমণকারী। ওরা আমাদের কেউ হতে পারে না। ওদের পুণ্যভুমি সৌদি আরবে।
--আপনি মস্ত বড় ভুল করছেন মিঃ সাভারকর, ঠিক মিঃ জিন্নার মত। আগামী দিনে ব্রিটিশ এম্পায়ারের চিহ্ন থাকবে না। ইতিহাসে তাঁরাই স্মরণীয় হবেন যাঁরা আজ ইংরেজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ না করে লড়াই করবেন।
--আমি ভুল করি না মিঃ বাসু। আমি ইতিহাস লিখি। আগামী দিনে ভারতবাসী এই যুগকে ‘সাভারকর যুগ’ বলে মনে রাখবে।
মেহের আলি বলে—হঠো! তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়!
সাউন্ড ট্র্যাকে ড্রাম বাজছে। মার্চপাস্টের পদধ্বনি।
কোলকাতার রাস্তায় পথে ঘাটে পড়ে থাকে কঙ্কালসার মানুষ, মৃত বা অর্ধমৃত।
সাউন্ড ট্র্যাকে বাজেঃ
“দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে, জাগিয়া উঠিল হা হা রবে”।
আমি কবিতাটা জানি। কোন চিন্তা নেই। একটু পরে সুপ্রিয়া ঢুকে নাচবে আর শোনা যাবেঃ
ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়া, তব আজ্ঞা লইল বহিয়া— নগরীর অন্ন বিলাবার, আমি আজি লইলাম ভার।
যাঃ , বাকি লাইনগুলো শোনা যাচ্ছে না। কোন সুপ্রিয়া এল না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। সাদাকালো ছবির মধ্যে, জয়নাল আবেদীনের ড্রইঙয়ের মধ্যে সুপ্রিয়াকে আঁতিপাতি করে খুঁজি।
পেয়েছি; সুপ্রিয়া ফুটপাথে শুয়ে আছে। ওর ছোট্ট শিশু প্রাণহীন মায়ের বুকে মুখ ঘসছে।
আকাশ জুড়ে কালো মেঘ। উড়ে যাচ্ছে বকের পাঁতি। বোলপুরের কোপাই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কালো আলখাল্লা পরা এক বাউল উদভ্রান্ত, বিধ্বস্ত। হাওয়ায় উড়ছে তাঁর সাদা চুল, সাদা দাড়ি।
আকাশের দিকে দূ’ হাত তুলে তীক্ষ্ণ চড়া আওয়াজে আর্তনাদ করে উঠলেনঃ
“মহাকাল সিংহাসনে সমাসীন বিচারক
শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে”।
হঠাৎ হু হু করে ধেয়ে এল ঝোড়ো হাওয়া। কড় কড় শব্দে বাজ পড়ল। বিদ্যুতের চেরা জিভ চেটে দিল কালো আকাশকে। বাউল ফিরে চললেন। বিড় বিড় করে কী বলছেন বোঝা মুশকিল। হাওয়ার ঝাপটা সামলাতে থেমে গেলেন। ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। এগিয়ে এলেন দু’পা।
তারপর কেটে কেটে বললেনঃ
“ নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”।
মেরিনা পার্ক, পোর্ট ব্লেয়ার। একপাশে কিছু বাংকার। তার থেকে বেরিয়ে রয়েছে অ্যান্টি -এয়ার ক্রাফট গানের নল। আজাদ হিন্দ ফৌজের মার্চ পাস্ট। একটি মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে সর্বাধিনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসু সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখছেন, অভিবাদন নিচ্ছেন।
সামনে দিয়ে এগিয়ে চলেছে মেয়েদের রাণী লক্ষ্মীবাঈ রেজিমেন্ট। তারপর গান্ধী ব্রিগ্রেড, সুভাষ ব্রিগ্রেড—একের পর এক।
মার্চ পাস্টের তালে তালে গানটা স্পষ্ট হয়ে উঠলঃ
‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা, খুশিসে গীত গায়ে যা।
ইয়ে জিন্দগী হ্যায় কৌম কী, তু কৌম পে লুটায়ে যা’।
কোলকাতার রাস্তায় এক মোটাসোটা বাবরি চুলের মানুষ হাঁটছেন আর গুনগুন করছেন। আধময়লা পাঞ্জাবি আর ধুতি, কাঁধের চাদর রাস্তায় লুটোচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বললেন—দে গরুর গা ধুইয়ে!
হেসে উঠছে তাঁর পদ্মপলাশ লোচন। কিন্তু হাসি বন্ধ হয়ে গেল। উনি চমকে পেছন ফিরলেন।
লাঠিসোঁটা খোলা তলোয়ার নিয়ে ভীড় তাড়া করছে একটি পরিবারকে। প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে ছেলেবুড়ো এবং একটি মেয়ে। না ওরা বাঁচতে পারেনি। গলির বিপরীত দিক থেকে আসছে আরেকটি উন্মাদ ভীড়।
ব্যারিটোন গলায় উনি গেয়ে উঠলেন –খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, অর্জুন ছোঁড়ে বাণ।
গানটা যেন কান্নার মত শোনাল।
নোয়াখালি জেলার গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে, মানুষ মরছে। সংখ্যালঘুদের মেয়েরা ধর্ষিতা হচ্ছে। সেই আগুন আর রক্তের মাঝখানে হেঁটে চলেছেন এক অর্ধনগ্ন ফকির। বলছেন—যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে!
মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দাঁড়াচ্ছেন মানহারা মানবীদের দ্বারে, বলছেন ক্ষমা কর। আমরা এখনও পশুত্ব ছেড়ে পুরোপুরি মানুষ হতে পারি নি। ভাবছেন, দেশভাগ ঠেকাতে গিয়ে এত মৃত্যু এত ঘৃণা কি যুক্তিযুক্ত? তবে কি দেশভাগ মেনে নিলেই মঙ্গল? থামবে হত্যালীলা, শ্মশানশৃগালের নারকীয় উল্লাস?
মেহের আলি বলে—হঠো! তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়!
পর্দাজুড়ে একটা ক্লোজ আপ। সবুজরঙা কাপড়ে রূপোলী চাঁদ তারা।
গান্ধীজিকে মিঃ গান্ধী সম্বোধন করা সেই বিলেতফেরত ব্যারিস্টার মঞ্চ থেকে জনতার অভিবাদন গ্রহণ করছেন। বলছেন এই পাক, এই পুণ্য ভূমিতে সব ধর্মের লোক মিলে মিশে শান্তিতে থাকতে পারবে।
কিন্তু জনতার মধ্যে শোনা যাচ্ছে—“ হাস হাসকে লিয়া হ্যায় পাকিস্তান,
লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্তান” ।
একজন কবি লাহোরের জেলে বসে আওড়াচ্ছে –ইয়ে দাগ দাগ উজালা ইয়ে গম সজীদা সহর-- এই ময়লা আকাশ, এই দমবন্ধ করা ভোর –এই স্বাধীনতার স্বপ্ন তো আমরা দেখি নি।
এদিকে ঢাকায় জনতা গাইছে –কায়েদ এ আজম, কায়েদ এ আজম, তুমিই মোদের প্রাণ,
তোমায় নিয়ে গড়ব মোরা সোনার পাকিস্তান।
অন্ধকারে শুনতে পেলাম ব্রজকিশোরের গলাঃ লোকটা জানত না যে ওর আয়ু মাত্র আর ছ’মাস। বুকে বাসা বেঁধেছে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগ।
ইউনিয়ন জ্যাক নামছে, তেরঙ্গা পতাকা উঠছে। জনৈক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ ইংরেজিতে দেশবাসীকে বলছেন এক স্বপ্নের কথা –প্রত্যেক চোখ থেকে জল মোছানোর স্বপ্ন। বিড়বিড় করছেন –অ্যান্ড মাইলস্ টু গো বিফোর আই স্লীপ।
আমরা দু’জন ব্রজকিশোরের হাতের চিনি ছাড়া লাল চা খেলাম। মানে, ব্রজকিশোর খেল, আমি কোঁৎ করে কোন রকমে গিলে ফেললাম।
ফের কামরার আলো নিভে গেল।
কোলকাতার রাস্তায় মিছিল চলছে, শ্লোগান উঠছে—ইয়ে আজাদী ঝুঠা হ্যায়, দেশ কী জনতা ভুখা হ্যায়।
মিছিল বৌবাজারের মুখে পৌঁছুতেই বিশাল পুলিশ বাহিনী রাস্তায় ব্যারিকেড করে পথ আটকে দাঁড়াল। থমকে গেল হাওয়া। এগিয়ে এল মেয়েরা , ওঁরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাবেন।
আচমকা গুলি চলতে শুরু করল। পিচগলা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেন ওঁরা চারজন—অমিয়া, প্রতিভা, গীতা ও লতিকা।
শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব।
‘রোদন ভরা এ বসন্ত’। শাল-মহুয়া-পলাশের বনে শন শন হাওয়া বইছে।
মেয়েরা পড়েছে বাসন্তী রঙে ছোপানো শাড়ি, ছেলেদের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, হলুদ কোমরবন্ধ।
মেহের আলি বলে—হঠো! তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়!
গণনাট্য সংঘের নৃত্যনাট্য ‘অহল্যা’ অভিনীত হচ্ছে। মঞ্চে একটা নীল আলো। নদীর খাঁড়ি দিয়ে নৌকো বেয়ে আসছে মেয়ে পুরুষ। সুন্দরবনের গরাণ আর সুঁদরী গাছের জঙ্গল সাফ করে এরা আবাদ করবে নোনা মাটি, চন্দনপিঁড়ি গ্রাম। লক্ষ্মীপুজোয় ব্যস্ত মেয়েরা। পুরুষেরা দূরের গ্রামে। চুপিসাড়ে ঢুকছে জোতদার, ঢুকছে পুলিশ।
হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াল মেয়েরা। কিন্তু অসম যুদ্ধ। ফল যেন আগে থেকেই জানা। সবার আগে লুটিয়ে পড়ল অহল্যা, পেটে অজন্মা শিশু।
সাউন্ড ট্র্যাকে সলিল চৌধুরির গলায় ‘অহল্যা মা তোমার সন্তান জনম নিল না, ঘরে ঘরে সেই সন্তানের প্রসব যন্ত্রণা’।
দেশভাগের দাঙ্গা থামছে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বজন হারানোর যন্ত্রণার ভয়াবহ স্মৃতি বুকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসছে শিখ, পাঞ্জাবী, আর্যসমাজী হিন্দু এবং সিন্ধি সম্প্রদায়। গান্ধীজি অসহায়। প্রার্থনা সভায় সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলছেন। কিন্তু ভিটেমাটি চাটি হওয়া জনতার প্রাণে সেই কথা আশাভরসা যোগাচ্ছে না।
একটি প্রার্থনা সভায় গান্ধীজির কয়েক গজের মধ্যে একটি বোমা পড়ল, ফাটল না। গান্ধীজি চোখ বুঁজে প্রার্থনা করছিলেন, টের পেলেন না। এবার একটি যুবক এগিয়ে এসে গান্ধীজিকে প্রণাম করল। তারপর একটি ব্রাউনিং রিভলবার থেকে গুলি চালাল। তিনটে ৯ এমএম বুলেট গান্ধীজির শরীরে, উনি লুটিয়ে পড়লেন।
পর্দায় আবার এসে দাঁড়ালেন সেই ব্যারিস্টার। চোখে চশমা, মাথায় কালো টুপি, পরনে ধুতি ও সাদা ফতুয়া। নির্বিকার মুখে বললেন—খুব খারাপ হয়েছে। গান্ধীজির হত্যা, আমাদের ক্ষতি।
কিন্তু উনি চলে যাবার আগে ওনার পথ আটকালো ব্রজকিশোর।
-- এক মিনিট মিঃ সাভারকর! গান্ধীজিকে মেরে কি ওঁর বিচারধারাকে খতম করা যাবে?
--আমি মেরেছি? যারা মেরেছিল তাদের আইন সাজা দিয়েছে। আদালতের বিচারে আমি নির্দোষ। আমার পথ ছাড়, আমি অসুস্থ। একটু বিশ্রাম নেব।
--আপনি ব্যারিস্টার। আইনের ফাঁক ফোকর ভালই জানেন। লণ্ডনে কার্জন-উইলি হত্যা হোক কি দিল্লিতে গান্ধী হত্যা, আপনি ধরাছোঁয়ার বাইরে । কিন্তু হোম মিনিস্টার বল্লভভাই প্যাটেল বলছেন – এই হত্যার নৈতিক দায় আপনারই। গডসে আপনার হাতে গড়া পুতুল।
--শোন, আমি ভারত সরকারকে লিখে দিয়েছি যে আমি আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকব না। আমাকে ছেড়ে দেওয়া হোক। ওরা ছেড়ে দিয়েছে। আর বিরক্ত কর না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
--যাবার আগে জেনে নিন, আপনি ব্যর্থ। গান্ধীহত্যার পর এই যুগ ইতিহাসে গান্ধীযুগ বলেই লোকে মনে রাখবে।
-- অর্বাচীন, ইতিহাসের লেখন পড়তে শেখ নি? আর কয়েক দশক, ব্যস। আমি থাকবো না। কিন্তু এই শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু হবে ‘সাভারকর যুগ’। আমার পোতা চারাগাছ একদিন মহীরুহ হবে।
সাউন্ড ট্র্যাকে শোনা যায়” ধাও ধাও সবে সমরক্ষেত্রে, গাহ উচ্চে রণজয় গাথা,
রক্ষা করিতে পীড়িত ধর্মে শোন ওই ডাকে ভারতমাতা।
কে বল করিবে প্রাণের মায়া, যখন বিপন্না জননী জায়া,
সাজ সাজ সকলে রণসাজে, শুন ঘন ঘন রণভেরী বাজে”।
বিশাল মিছিল যাচ্ছে, হাতে লাঠি, ত্রিশূল, তলোয়ার। শ্লোগান উঠছে –‘অযোধ্যা মেঁ জিত হমারী হ্যায়, অব কাশী মথুরা কী বারী হ্যায়’।
সাভারকর গুণ গুণ করছেন—আর্যসনাতন বঙ্গভূমিতে রাখিব না আর যবন চিহ্ন।
--কী হল মাস্টার? এখনও সন্দেহ আছে? আমরা নতুন ইতিহাস লিখছি, বিজয়ীর ইতিহাস। হিন্দু কখনও হারে নি।
দেখ, আদালত কী বলছে? বাবরের সেনাপতি মীর বাকীর তৈরি মসজিদ ধূলোয় মিশে গেছে। আদালত বলছে –এটা অপরাধ, এর কঠিন শাস্তি হবে। কিন্তু কে ভেঙেছে? কোন প্রমাণ নেই।
শোন, সম্রাট অশোক আর মহাত্মা গান্ধী –এই দুটো লোক অহিংসা অহিংসা করে আমাদের সর্বনাশ করেছে। একুশে শতাব্দীর ভারত হবে বীর্যবান। আমার কথা শোন মাস্টার, আমি সাভারকর বলছি—এক ধর্মরাজ্যপাশে খণ্ডছিন্নবিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি’।
একজন সাদা দাড়ি বৃদ্ধ বাউল কাঁপা কাঁপা গলায় গাইছেনঃ
একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে
রাজার দোহাই দিয়ে।
এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,
মন্দির দ্বারে এসেছে ভক্ত সাজি—
ঘাতক সৈন্যে ডাকি
‘মারো মারো’ ওঠে হাঁকি।
সাভারকর চলে যাচ্ছিলেন। ব্রজকিশোর পেছন থেকে ডাকলেন।
--একটা কথা বলে যান, তাঁতিয়া! আপনার পোঁতা চারাগাছ না কী যেন বললেন? একটু খোলসা করে বলুন না!
--মন দিয়ে শোন। শিবাজি মহারাজও একটা ভুল করেছিলেন। পরাজিত মুসলমান সুলতানের বিবি আর বাচ্চাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। ওদের মেরে ফেলা উচিত ছিল। সাপকে আমরা কী করি? ওরা জিতলে আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করে। আমরাই ছেড়ে দেব কেন?
মেহের আলি বলে—হঠো! তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়!
সাদা পর্দা, কামরায় আলো জ্বলে ওঠে।
মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু আমার ব্যাংক! তার কী হল?
ব্রজকিশোর ধমকে ওঠে। বলে ও’সব হবে খন। খালি নিজের ধান্ধা! এই করেই দেশটা গোল্লায় গেল। আগে বল- গত শতাব্দীর শেষ দেখেছ। এর পর আগামী দিনের ছবি দেখার সাহস আছে? নইলে কাটো। আমার সময় নষ্ট কোর না।
আমি মাথা হেলিয়ে সায় দিই। ও কড়া করে এক গেলাস আদা দেওয়া লাল চা গেলায়। তারপর বলে –আগে হয়েছে ভিডিও সেশন। এবার অডিও, আমরা পাঁচটা অডিও ক্লিপ শুনব। তোমাকে এর থেকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে চিনতে হবে। তাহলে বর্তমানকে বোঝা এবং কোর্স কারেকশনের চেষ্টা করা সহজ হবে।
আমরা নিজের নিজের চেয়ারে বসে পড়ি। আলো নিভে যায়। পর্দায় একটা নীলাভ আলো, যেন ভোর হবার একটু বাকি। সাউন্ড ট্র্যাকে ব্রজকিশোরের গলাঃ
জোম্বি দ্বীপের কথকতা
(১)
সত্যিটা কী? চারদিকে যা দেখছি, যা শুনছি? কিন্তু চোখ তো মরুভূমিতে জল টলটল সরোবর দেখে, কান যে কখনও কখনও স্বপনপারের ডাক শোনে যা অন্য কেউ শুনতে পায় না। তবে কি বোধবুদ্ধি বা অনুভব? জেগে স্বপ্ন দেখছি, নাকি স্বপ্নে জেগে আছি? দুটোর মধ্যে তফাৎ কী?
আছে, তফাৎ আছে। স্বপ্নে গেলাস গেলাস এক কুঁজো জল খাও ঢক ঢক করে খাও বা যেমনই ইচ্ছে, তেষ্টা মেটে না। তাহলে আমার যে সারাজীবন তেষ্টা মেটেনি, তবে আমি কি স্বপ্ন দেখছি? স্বপনে রয়েছি গো সখি, আমারে জাগায়ো না।
স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা কি এতই অস্পষ্ট?
তা কেন হবে? দুটোর তফাৎ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। যেমন, স্বপ্নে বীর্যপতন হলেও সন্তানের জন্ম হয় না।
বাজে যুক্তি।
বাস্তবেও অনেকসময় বীর্যপতন হয়, সন্তান জন্মায় না।
তেভাগার সময়ের কাকদ্বীপ। চন্দনপিঁড়ি গাঁয়ের চাষিবৌ অহল্যা, ভরা পোয়াতি। পুলিশ ও গুন্ডার সমবেত আক্রমণের মুখে পিছু হটেনি। ‘অহল্যা মা তোমার সন্তান জনম নিল না’।
ও তো মরে গিয়ে শহীদ হল, কিন্তু আমরা? আমি কি বেঁচে আছি? কী করে বুঝব? কাত্যায়ন, তুমি নাড়ি দেখতে জান? দেখ তো, আমি বেঁচে আছি কিনা!
ফ্লোরিডা টুডে, ২২ মে, ২০১৮
“দক্ষিণ ফ্লোরিডার লেক ওয়ার্থ এবং টার্মিনাস এলাকার অধিবাসীদের সতর্ক করা হচ্ছে যে জোম্বি ক্রিয়াকলাপ ও আক্রমণের ফলে ৭৩৮০ ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। কখন স্বাভাবিক হবে বলা মুশকিল”।
শুনছ তো, জোম্বিরা আছে। শুধু নেটফ্লিক্সে ‘ওয়াকিং ডেড’ সিরিজে নয়। বাস্তবে আছে। ওরা ছিল , আছে এবং থাকবে। ওরা রক্তবীজের ঝাড়। ওদের দাঁতে নখে ভাইরাস। ভবিষ্যতে ওদের উপনিবেশের নাম হবে জোম্বি দ্বীপ। আন্দামান নিকোবর এলাকায় কয়েকশ’ নামহীন ছোট ছোটদ্বীপের মধ্যেই গড়ে উঠছে এই উপনিবেশ, কাজ চলছে।
ব্রজকিশোরের স্বর থেমে যায়, আমি উদগ্রীব হয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকাই।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল মধু। না, কোন ব্যথা তো নেই, শুধু একটা বোদা ভাব। একটু একটু করে চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হচ্ছে। চোখে পড়ছে ছোট ঘর, হাল্কা নরমসরম আলো,অফ হোয়াইট সিলিং, পীচ সবুজ দেয়াল, হালকা নীল পরদা। ও শুয়ে আছে একটি খাটে, লোহার খাট, ধপধপে সাদা চাদর- যেমনটি একটা হাসপাতালে থাকে। তাহলে কি ও কোন হাসপাতালে আছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
মাথার কাছে কোন ছোট র্যাক বা টেবিল নেই যাতে ওষুধের শিশি, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন লেখা কোন চার্ট এসব থাকে। নাঃ, বিছানার কাছে কোন পাইপ, হুক থেকে ঝোলান স্যালাইন বা গ্লুকোজের বোতল – ওসব কিস্যু নেই। তাহলে ? তাহলে ও এল কোথায়? আরে, হাসপাতাল হলে অন্ততঃ একজন নার্স বা নিদেনপক্ষে একজন ওয়ার্ডবয় তো দেখা যাবে।
ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল আরও সারি সারি গোটা দশেক খাট। কিন্তু সব খালি। একটাও রুগি নেই। তাহলে কি এটা হাসপাতাল নয়? তবে? মধুর মাথা ঝিমঝিম করে।
ও এখানে কতক্ষণ আছে? মানে কতদিন হল? আর এল কী করে? কে আনল? আজ কী তারিখ? কিছু বোঝার উপায় নেই; না আছে কোন খবরের কাগজ, না কোন লোক, কাকে জিগ্যেস করবে? দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারও নেই। এটা কেমনধারা হাসপাতাল?
মধু আগে কখনও হাসপাতালে যায় নি। তবে এত বড়টি হয়েছে, শুনে শুনে খানিকটে আবছামত ধারণা হয়েছে। বাবা যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, অনেকদিন ছিল, তখন ও অনেক ছোট। তাই ওকে যেতে দেওয়া হয় নি। খালি একটা কাঁচে ঢাকা গাড়ি করে বাবাকে যখন বাড়ি নিয়ে এসেছিল সেটা ওর মনে আছে। মা খুব একটা কাঁদেনি। থম মেরে বসেছিল। সবাই ফিসফিস করছিল কী করে কাঁদানো যায়!
ও বুঝতে পারছিল না মাকে কেন কাঁদতে হবে? বাবার ঘুম ভেঙে যাবে না? শেষে বড়পিসি এসে মায়ের হাত জোর করে টেনে ধরে হাতের শাঁখা-চুড়ি খুলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে আছড়ে আছড়ে ভাঙল। তখন মা ডুকরে উঠল। কিন্তু যখন পাড়ার সবাই মিলে বাবাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল তখন মা মুখের চেহারা শক্ত করে বলল—মধুরে ছাইড়্যা দ্যান। অ ছুটু, অরে শ্মশানে যাইতে অইব না।
মা? মা এখন কোথায়? মাকে কেন দেখা যাচ্ছে না? একটা অজানা শিরশিরানি ভয় আস্তে আস্তে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। কিছু মনে পড়ছে না। ওর কী হয়েছিল? মাথা ঝাঁকিয়ে ও আবার ভাবার চেষ্টা করে।
হ্যাঁ, এবার একটু একটু মনে পড়ছে। কিছু টুকরো টুকরো ছাড়া ছাড়া ছবির মত।
ওর পুরনো বাইকটা নিয়ে রোজকার মত কাজে বেরিয়েছিল। ডেলিভারি ব্যাগটা পিঠে স্ট্র্যাপ দিয়ে আঁটা। ঘেমো গরমওলা এক বিচ্ছিরি দিন। ওর জামা ঘামে ভিজে পিঠে সেঁটে গেছে। হ্যাঁ, ওর গাড়ির স্পীড অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই ছিল, তার যথেষ্ট কারণ।
কিন্ত একী? একদল স্কুল ফেরত কলকল করা কচিকাঁচার দল একেবারে সোজা রাস্তার মাঝখান দিয়ে পার হচ্ছে। ও ব্রেক চেপে গিয়ার বদলে সামলে নিল। আবার গতি বাড়াল, কিন্তু ওদের এই মফঃস্বলী শহরে রাস্তাগুলো তেমন সুবিধের নয়। মাত্র বর্ষা বিদায় নিয়েছে। খানাখন্দগুলোর মেরামতি এখনও শুরু হয় নি।
ও স্টেশন পাড়ার মার্কেট কমপ্লেক্স পেরিয়ে গিয়ে বাঁদিকে বাইক ঘুরিয়েছে কি সামনে এক বয়স্ক মহিলা, হাতে বাজারের ভরা থলি। কোত্থেকে যে উদয় হলেন, একেবারে ওর মার্ডগার্ডের সামনে। ও প্রাণপণে স্টিয়ারিং ঘোরায়। একটা চিৎকার! পিঠের দিকে একটা তীব্র যন্ত্রণা! ব্যস, সব অন্ধকার।
আরও কিছু টুকরো টুকরো ছবি।
হ্যাঁ, এবার ভালই মনে পড়ছে। মনে পড়েছে ও কে, কী করে সব।
ও হল মধুসুদন দেবাঙ্গন—একটা রোগাপটকা বছর কুড়ির ছেলে; ছত্তিশগড়ের হাওড়া-মুম্বাই লাইনের চাঁপা জংশনের কাছে ক্রিশ্চান পাড়ার দিকে একটি অ্যাসবেস্টসের ছাদওলা এককামরার কোয়ার্টারে বিধবা মায়ের সঙ্গে থাকে।
পাড়াটাতে একটা প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ; সেখান থেকে মাঝে মধ্যে আটা,পুরনো গরম কাপড়, জ্যাকেট এসব পেয়েছে। কয়েকবার ফাদারের উপরোধে সানডে বাইবেল ক্লাসে গিয়েছে।কিন্তু নিয়ম করে প্রতি রবিবার চার্চে যাওয়ার বান্দা ও নয়। ফলে ক্রীশ্চান হতে হতে হয় নি। কিন্তু ফাদার আশা ছাড়েননি। তাই ওর মা চার্চের কুষ্ঠ হাসপাতালে আয়ার কাজ পেয়ে গেল। ও পেল বছরে একজোড়া জুতো ও শীতের জামাকাপড়।
এরপরে একদিন এলেন ওর স্কুলের অংকের স্যার – রামচন্দ্র দুবেজী।
বললেন—কী ব্যাপার মধু? কীসব শুনছি? তুমি নাকি মধুসূদন দেবাঙ্গন থেকে মধু ড্যানিয়েল হয়েছ?
ও লজ্জা পায়, চোখ নামায়। খেয়াল করেছে যে স্যারের কথায় হাসির আভাস, কিন্তু চোখ হাসছে না। ও জানিয়ে দেয় যে কথাটা সত্যি নয়, ও ড্যানিয়েল হয়নি।
--কেন হওনি? তোমাদের ওরা দানছত্রের গমের বস্তা আর সায়েবদের ফেলে দেয়া ইউ এস এ ছাপমারা পুরনো জ্যাকেট দেয়নি? তাহলে?
--স্যার, আসলে ওদের গানটান, গিটার, অর্গান ভালই লাগত। কিন্তু ওখানে বড্ড কথায় কথায় পাপ। আমরা পাপী, পাপে জন্মেছি, আমাদের পরিত্রাতা যীশু মসীহ –এইসব। আমার মা-বাবাকে পাপী ভাবতে ভাল লাগেনি স্যার, তাই একদিন চলে এলাম।
দুবে স্যারের চোখ জ্বলে ওঠে।
--ঠিক করেছ, ম্লেচ্ছদের কথায় আর ভিক্ষের চালডাল পেয়ে নিজের বাপ-পিতামোর ধর্ম বিসর্জন দাওনি।তুমি হলে বীরের জাত, বীরের পরিবার।
--মানে? আমার বাবা তো চাঁপা রেলস্টেশনের হামাল, মানে কুলি ছিল। কোন যুদ্ধটুদ্ধ করেনি তো!
--আলবাৎ করেছেন। তোমার পিতামহ প্রপিতামহ সবাই। শোন, ভাল করে ইতিহাস পড়। আগে কয়েক’শ বছরের যবনদের শাসন, তারপর দু’শ বছরের ম্লেচ্ছ। কত অত্যাচার! কত লোক ভয়ে নিজের ধর্ম বদলে ফেলল। কিন্তু তোমাদের বংশ ঝড়ের মধ্যে প্রদীপের শিখা নিভতে দেয়নি।
তুমি কাল থেকে রোজ সকালে হাতমুখ ধুয়ে শুদ্ধ হয়ে আমাদের মাঠে এস। ডিসিপ্লিন শিখবে, চরিত্র নির্মাণ হবে। এখন তোমার গড়ে ওঠার সময়। চতুরাশ্রমের প্রথম হল ব্রহ্মচর্য। গার্হস্থ্য জীবনের আগে সমস্ত মেয়েদের ভগিনী ভাবতে হয়। এই ম্লেচ্ছপাড়ায় ইন্দ্রিয়সংযম বড় কঠিন। বেশি বলার দরকার কি, তুমি নিয়মিত আসা শুরু কর।
মধু যেতে লাগল। প্রথম প্রথম ভয় ভয় করছিল, পরে ভাল লাগছিল। খালি ড্রিল, আর কসরত নয়, অনেক নতুন নতুন খেলা শিখছিল। যেমন কবাড্ডি বা খো-খো খেলায় ওরা ‘আউট’ বা ‘ইন’ বলে না, বলে ‘বিষ’ আর ‘অমৃত’। বিষে তুমি আউট, আর অমৃতের ছোঁয়ায় তুমি বেঁচে ওঠ।
আর শিখল রাষ্ট্র একজন দেবতা। নমো রাষ্ট্রদেবায়!
রাষ্ট্রের হিত সর্বোপরি, ব্যক্তির স্বার্থ সবসময় রাষ্ট্রহিতের জন্যে বলি দিতে হবে। আরও বুঝল যে সদাবৎসল মাতৃভূমির রক্ষায় সর্বস্বপণ করতে হবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আংশিকভাবে। ম্লেচ্ছ ও যবনের মিলিত চক্রান্তে, দুদিকের দুটো যবনভূমি মিলে, আজ তিনটুকরো। আগের অখন্ড ভারতে ফিরতে হবে।
একবার চাঁপা থেকে বিলাসপুরের শিবিরে ওরা সবাই গেল। এর আগে ও যতবার লোক্যাল ট্রেনে বিলাসপুর গিয়েছে, কখনও টিকিট কাটেনি। চেকারদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলাটায় কী মজা!
কিন্তু রামচন্দ্রস্যার সতর্ক করে দিলেন। রাষ্ট্রের ক্ষতি করা চলবে না। সবাইকে টিকিট কাটতে হবে। তবে মধু ও আরও কয়েকজনের টিকিট উনিই কিনে দিলেন।
কিছুদিনের মধ্যে মধুর আত্মদর্শন হল। বুঝতে পারল যে ও হল আসলে উড়নচন্ডে; কোন ডিসিপ্লিন মেনে চলা ওর ধাতে নেই। এছাড়া এখানেও ওর মনে হানা দিল এক পাপবোধ। একদিন ওর ল্যাঙ্গোটিয়া ইয়ার স্ট্যানলির বোনকে কোয়ার্টারের পেছনে কুয়োর পাড়ে চুমো খেয়ে ছিল।
ভেবেটেবে নয়, কেমন করে যেন ঘটে গেল। জেনির চেহারায় গোলাপি আভা ফুটে উঠেছিল। সেই মেয়েটাকে এখন ‘ভগিনী’ ভাবতে হবে? আরও পাপ আছে। মাঝে মাঝে ওরা স্ট্যানলির বাবার সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে একটা দুটো সরিয়ে রেলপুলের পাশে গিয়ে ফোঁকে।
তাহলে কি চরিত্র বিগড়ে যাচ্ছে? চুরি এবং নেশা করা! কিন্তু মধু দুম করে মিথ্যে বলতে পারেনা। দুবে স্যারকে যে ও শ্রদ্ধা করে!
এই গোঁজামিল সামলাতে না পেরে ও আখড়ায় যাওয়া ছেড়ে দিল। তারপর গ্রহের ফেরে স্ট্যানলির বাবা রায়পুর লাইনের গতোরা স্টেশনে বদলি হয়ে গেলেন। জেনি স্ট্যানলি দ্রুত ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ হয়ে গেল।
ইস, এটাই যদি এক বছর আগে হত। তাহলে হয়ত মধুকে আখড়া ছাড়তে হত না।
যাইহোক, ও এখন এক স্মল-টাউন বয় যে নিজের চাকরিটাকে—যাতে মাত্র দু’মাস আগে জয়েন করেছে—প্রাণপণে বাঁচাতে চাইছে। চাকরিটা ঠিক বলার মত নয়, বিশেষ করে মাইনেপত্তর। দেখতে গেলে ওর যা ডিউটি সেটা কুড়ি বছরের জোয়ান ছেলের খুব একটা ভাল লাগার কথা নয়। কাজটা হল পাঁচ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে ডাক বা কিছু কনসাইনমেন্টের প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া। অর্থাৎ ফিলোমেল ক্যুরিয়ের সার্ভিস।
কী আশ্চর্য! এই একঘেয়ে কাজটাও ওর ভাল লেগে গেছে। কেন? ও নিজেও ঠিক জানেনা।
কিন্তু মালিক, ঝিটুমল সিন্ধি, একটুও খুশি নয়। এই ক্যুরিয়ার সার্ভিসটা চাঁপা শহরে বছর খানিক আগে শুরু হয়েছে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে --এইসব কেরেস্তান ছোকরাদের নেওয়াই ভুল। এরা সব আলসে আর আড্ডাবাজ।
একেই ব্যবসার হাল খাস্তা, তায় এইসব ডেলিভারি বয় হল বোঝার উপর শাকের আঁটি। আরও তিনজন কর্মচারি আছে বটে, কিন্তু মালিকের হিসেবে মধু হল সবচেয়ে ওঁচা।ও গোড়ার দিকে কয়েকবার বলেছে যে ও কেরেস্তান নয়।কিন্তু মালিকের চোখে অবিশ্বাস, তাই আজকাল আর কিছু বলে না।
--তোর মত গবেটকে কেন যে মরতে কাজে লাগালাম! দু’মাসেই এতগুলো কমপ্লেন? চারটে ভুল ঠিকানায় ডেলিভারি তো তিনটের অ্যাকনলেজমেন্ট হারিয়ে ফেলা? আর দু’বার বাড়তি চার্জ ঠোকা!
-- বস, ওটা আমার দোষ ছিল না। সেন্ডার আপিস থেকেই প্যাকেটের গায়ে ভুল লেবেল লাগানো ছিল, তো আমি কী করব?
--- আচ্ছা, তুমি সাধুপুরুষ? ঠিকানায় একটু এদিক ওদিক, কিন্তু টেলিফোন নম্বর ? সেটা দিয়েও তো ভেরিফাই করা যেত, তা তুমি করবে না। তোমার সম্মানে লাগে! আর অ্যাকনলেজমেন্ট হারিয়ে ফেলা? ওটা নিয়ে কী বলবে শুনি? আসলে তুমি হচ্ছ কুঁড়ের হদ্দ।
এবার আমাকে রেহাই দাও। ফিরে যাও তোমাদের ওই চায়ের দোকানের ঠেকে; গিয়ে রাজা-উজির মারতে থাক। এর বেশি তোমার এলেম নেই। তোমার মত ছেলেদের ভরসায় থাকলে আমার ব্যবসা লাটে উঠল বলে। পাক্কা উঠবে, আজ নয় কাল।
--বস, এটা একটু বেশি হয়ে গেল। আমি কি কিছুই করি নি? ছ’জন নতুন ক্লায়েন্ট এ্নেছি, মাত্র দু’মাসে—ভেবে দেখুন।
--মাত্তর ছ’জন, তার এত চোপা! আরে ওদের মধ্যে দু’জন তো এমনিতেই এসে যেত। কারণ, ওদের আগের বাঁধা ক্যুরিয়ার কোম্পানি এ শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। তাছাড়া ওদের চার্জও একটু হাই ছিল। এতে তোর কিসের কেরামতি?
--না বস, আরও অনেক সার্ভিস দেনেওলা আছে। ওরা এসেছে আমার জন্যে। ওদের হেড বেয়ারারা আমার চায়ের দোকানের বন্ধু।
--বাতেলাবাজি ছাড়, ঢের হয়েছে। এবার যেদিন কোন কমপ্লেন আসবে সেদিনই তোর হিসেব করে দেব। এই তোর লাস্ট লাইফ লাইন, বুঝলি?
মধু আর কথা বাড়ায় নি। একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে না খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। মা খাবার নিয়ে সাধলে কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিল—শরীর ভাল নেই।
সেদিন রাত্তিরে ঘুম হয় নি। চাকরি গেলে খাবে কী? বাড়িভাড়া আর ইলেক্ট্রিসিটি বিল কী করে চোকাবে? মার পেনশানের ক’টা টাকায় তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
ও ক্রিকেট ভাল খেলত; ছোটবেলা থেকেই। রেলের মাঠে প্র্যাকটিস করত, ক্লাব কোচিংয়েও নিয়মিত যেত। সবাই ধরে নিয়েছিল যে স্পোর্টস কোটায় রেলের চাকরি ওর কপালে নাচছে। কিন্তু সেটা যে তুর্কি নাচ হবে তা বুঝতে দুটো বছর লেগে গেল।
অনেক সুকতলা খসিয়ে দেখল সবসময় আড়াল থেকে একজন নেপো এসে দই খেয়ে যায়। তবে ওর কপালের পুরোটাই তেঁতুলগোলা নয়। ওর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ফোন করে দেওয়ায় দু’মাস আগে এই চাকরিটা পেয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই ব্যাটা যাই যাই করছে।
সে যাই হোক, ওর কষ্টের আসল কারণ একটু আলাদা। এটা ওর কাছে আচমকা ধরা পড়ল আর ও অবাক হয়ে গেল। বুঝতে পারল যে এই কাজটাকে ও খুব ভালবাসে; রোজ অপেক্ষা করে থাকে কখন তৈরি হয়ে ব্যাগ পিঠে বাইকে চড়ে বসবে। রোজ কড়া নাড়বে কোন নতুন দরজায়।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে কোন নতুন মুখঃ ঝোড়ো কাকের মত চেহারার কোন বিরক্তবাবু, দয়ালু মুখের বয়স্ক মাসিমা, রাগী তরুণ বা নিষ্পাপ মুখশ্রীর কিশোরী—অজস্র মুখের মিছিল। ঘর থেকে বেরনোর সময় ও কল্পনা করে আজ প্রথম বাড়িতে দরজাটা কে খুলবে। অধিকাংশ দিন পায় একেবারে কেজো ঠান্ডা ব্যবহার।
কিন্তু কেউ কেউ, হাজারে একজন, হেসে কথা বলে, একগ্লাস জল দেয়; আর সেই প্রসন্ন মুখ আদমের না হয়ে ঈভের স্বগোত্রের হলে? গোটা দিনটার মানে বদলে যায়। মালিকের খোঁচা দিয়ে কথা বলা গায়ে লাগে না।
এখন এই হাড়কেপ্পন ভোঁদাগোছের বস ওকে দরজা দেখিয়ে দেবে বলে প্রায় স্থির করে ফেলেছে। একের পর এক বিষাক্ত লেগ কাটার। অপেক্ষা করছে কখন বল ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ বা কিপারের হাতে যায়। ঘোর অন্যায়! মাতা মেরি নিশ্চয় দেখছেন। তবে ওকেও এখন থেকে খুব সাবধানে ব্যাট করতে হবে। আর কোন কমপ্লেন হলে চলবে না। চৌকস হতে হবে।
দিনটা ভালই শুরু হয়েছিল। প্রথম ঘন্টাতেই দুটো ডেলিভারি, বেশ সাবধানে । আর দু’জায়গাতেই হাসিমুখে ‘থ্যাংক ইউ’ পেল। আর কী আশ্চর্য, ধন্যবাদদাতাদের একজন স্কুলের মেয়ে, অবাঙালী। ওর বার্থডে ড্রেস –বিদেশি ব্র্যান্ডের- -অ্যামাজনের সৌজন্যে মধু গিয়ে ডেলিভারি দিল। মেয়েটি চিনেমাটির প্লেটে করে দুটো লাড্ডু ও একগ্লাস জল দিয়ে বলল—লীজিয়ে ভাইয়া! বার্থ ডে কী মিঠাই।
মধুর খুব লজ্জা করছিল। তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে গিয়ে বিষম খেয়েটেয়ে একসা।
তখন থেকেই ওর মনটা একদম হলিউড-জলিগুড হয়ে গেছল।
এতক্ষণে সব স্পষ্ট মনে পড়ছে। ওই ফিল-গুড মন নিয়ে অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়িয়ে শার্প টার্ন নেওয়ার সময় কোথথেকে যে ওই থলিহাতে মাসিমা একেবারে ফ্রন্ট হুইলের সামনে এসে পড়লেন! ও ঠিকই কাটিয়ে ছিল, কিন্তু হলিউড-জলিগুড মন খেয়াল করেনি যে একটা মালভরতি ট্রাক বিপজ্জনক ভাবে ওকে ওভারটেক করছে।
ও এবার পুরোপুরি জেগে উঠেছে। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে, অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসছে, কোনটার উত্তর ওর জানা নেই।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে? কে নিয়ে এসেছে? মা কোথায়? ওর কী হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট? এটা কীরকম হাসপাতাল? এখানকার খরচা কে মেটাবে?
মাথার ভেতরে জমে থাকা ঘন কুয়াশা আস্তে আস্তে পাতলা হচ্ছে; কিন্তু বড্ড ধীর লয়ে। ও খাট ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করল, পারল না। হতাশ হয়ে দেখল ওর হাত-পা কেমন যেন বিছানার সঙ্গে সেঁটে আছে। এবার ও সত্যি সত্যি ভয় পেল। এর মানে কী?
মরিয়া হয়ে চিৎকার ! মানে চিৎকারের চেষ্টা আর কি। কিছু একটা হল। ওর অস্পষ্ট চাপা শব্দের অভিঘাতে ওই শান্ত নিঃশব্দ শূন্যতার মাঝে কোন ঢেউ ঊঠল। কোথাও একটা দরজা খুলল।
এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস। তারপর একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর ওকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাইল যে ওকে এখন এই অবস্থায় থাকতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ওর ভালোর জন্যেই এটা করা হয়েছে।
কিন্তু এই কথা শুনে ওর মন শান্ত হল না। ও এই অর্থহীন দুনিয়ার মানে বুঝতে চায়। তাই প্রশ্ন করতেই হবে।
-এ জায়গাটার নাম কী?
উত্তর এল প্রায় প্রতিধ্বনির মত।
-কোন নাম নেই।
-উফ্! আজকে কত তারিখ? কী বার? এখন সকাল না বিকেল?
- এখানে এইসব প্রশ্ন অর্থহীন।
-কী যা তা! আরে ক’টা বাজে তো বলবে?
-বললাম তো, এখানে সময় অনন্ত।
-জীশাস, আর ইয়ু ম্যাড? দেয়ালঘড়ি্র কাঁটা দুটো দেখে বল ক’টা বাজে ।
-এখানে দেয়ালে কোন ঘড়ি থাকে না, নিজেই দেখে নাও।
ও চমকে ঘাড় ঘোরায়। হা হা করছে নিঃস্ব দেওয়াল। কোন ঘড়ির চিহ্ন মাত্র নেই।
মধু নিজের চেতনাকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
-লাস্ট কোশ্চেন। আমাকে এখানে কে নিয়ে এল?
-তোমারই অতীতের কর্মফল।
আবার কুয়াশার মেঘ । ধোঁয়া ধোঁয়া। এক ঘন অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে ও শুনতে পেল একসঙ্গে অনেকগুলো দেয়ালঘড়ির বেজে ওঠার মিঠে শব্দ। বারোটা বাজছে।
এখনও ভোর হয়নি বোধহয়। কিন্তু আমার বড্ড শীত করছে। পা দিয়ে লেপ বা কম্বল টানতে গিয়ে দেখছি পা অবশ, নড়ছে না। ঝিঁঝিঁ ধরেছে। সেটা হতেই পারে। ছোটবেলা থেকেই আমার এই রোগটা রয়েছে — অবশ্য যদি এটাকে কোন রোগ বলা যায়।
জটাটবী/গলজ্বল/ প্রবাহপাবিত/স্থলে,
গলেব/লম্ব্যলম্বিতাং/ ভুজঙ্গতুঙ্গ/মালিকাম।
ডুমড্ডুম/ডুমড্ডুম/নিনাদবড্ড/মর্বয়ং,
চকারচণ্ড/তান্ডবং/ তনোতুনঃ/শিবঃ শিবম।
কোত্থেকে একটা গান ভেসে আসছে না? খুব দূরে নয়, আবার খুব কাছেও নয়। একটা কথারও মানে বুঝতে পারছি না। কিন্তু বিট ভাল লাগছে। বেশ একটা মার্চিং সং গোছের ভাব।
ওই ডুমড্ডুম ডুমড্ডুম! কেমন চেনা চেনা—বুঝেছি , বীট ড্রাম বাজছে। আরে, একসময় তো আমিও বাজিয়েছি। না, ভুল বললাম। আমি কেটল ড্রাম বাজাতাম। বীট ড্রামটা বাজাতো সুধীরদা, বেশ লম্বা চওড়া, ক্লাস এইটে একটু গোঁফের রেখা। আসলে দু’বার ফেল করে আমাদের ক্লাসে রয়ে গেছল।
মনে পড়ছে - ছোটবেলায় মিশনের স্কুলে পড়েছি। হোস্টেলে ছিলাম। সেখানে মেজ মহারাজের হাতে তৈরি ব্যান্ডপার্টি। শহরের মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় পুলিশ ব্যান্ডের পর আমাদের ব্যান্ড। কত পুরনো কথা সব মনে পড়ছে। এমনকি লীড ড্রামের সঙ্গে আমাদের শুরু করার ১৬ বিটের স্ট্রোকগুলো।
ঠরাররা ঠরাররা ট্রাম--
ঠরাররা ঠরাররা ট্রাম--
রামপাম রামপাম রামপামা রামপাম,
রামপাম রামপাম রামপামা রামপাম,
রামপামা রামপামা রামপামা রামপাম,
ঠরাররা ঠরাররা রামট্রামট্রাম--।
গান চলছে, গানের কথাগুলো একটু একটু বুঝতে পারছি, সংস্কৃত বটেক।
জটাকটাহ/সভ্রম/ভ্রমান্নালম্প/নির্ঝরা,
বিলোলবীচি/বল্লরা/ বিরাজমান/মূর্ধনি।
ধগদ্ধগ/দ্ধগজ্বল/ ললাটপট্ট/পাবকে,
কিশোরচন্দ্র/শেখরে/ রতিঃপ্রতি/ক্ষণং মমঃ।
ওরে বাবা! কীসব সমাসবদ্ধ শব্দের মিছিল, দাঁতকপাটি লেগে যাবে। এবার মুখড়ায় ফিরছে। শেষ দুটো লাইন!
“ডুমড্ডুম/ডুমড্ডুম/নিনাদবড্ড/মর্বয়ং,
চকারচণ্ড/তান্ডবং/ তনোতুনঃ/শিবঃ শিবম”।
মার দিয়া কেল্লা! এটা কোন শিবের স্তোত্র। কিন্তু আগে কখনও শুনিনি।
বম ভোলে! খা চাঁদিকে গোলে! ব্যোম ভোলা! ব্যোম ভোলা! খাও বাছা রূপোর গোলা।
আমরা মিশনে শিখেছিলামঃ
‘জয় শিবশংকর, হর ত্রিপুরারি,
পাশীপশুপতি পিণাকধারী’।
বা, ‘নাচে পাগলা ভোলা বাজে বম বম বম’। কিন্তু এটা নতুন রকম, কীরকম একটা ফার্স্ট বিটের নাচের ভাব। সে যাকগে, এটা কী হচ্ছে? কোথায় হচ্ছে?ধেত্তেরি!
কবীরা খড়া বাজার মেঁ, চাহে সবকো খের,
ন কাহুকে দোস্তি, ন কাহুকে বৈর।।
ভরা বাজারে দাঁড়িয়ে কবীর, চায় সে সবার ভাল,
কেউ নয় তার শত্রুমিত্র, তাতে কিবা এসে গেল!।
ধুর শালা, নাড়িকাটার দিন থেকে আমরা শত্রুমিত্র চিনতে পারি। কড়া চাউনির বড়পিসি আমার মিত্র। ফ্রকপরা ছোটপিসি আমার শত্রু। খালি ঘরে আমায় একা পেলে পাছায় খুব জোরে চিমটি কাটত।টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে বেড়াত, দু’চারটে পাত্তি পেলে একটা ঝেড়ে দিত। আমাকে আঙুল উঁচিয়ে শাসাতো, যদি মুখ খুলি তো বিপদ।
তবে কেউই আগাপাশতলা ভাল বা খারাপ নয়।
বড়পিসি আমার গাল টিপে ধরে মুখের ভেতর আঙুল পুরে ভাঁড়ার থেকে চুরি করে চুষতে থাকা গুড়ের ডেলা বের করে নর্দমায় ফেলে দিত। নইলে দাঁতে পোকা হবে, পেটে ক্রিমি কিলবিল করবে।
হলে আমার হবে, তোমার কি!
বড় হয়ে চাকরি করে মাইনের টাকা দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি গুড় কিনব, দেখব কে আমাকে ঠেকায়!
তেমনই আমার শত্তুর ছোটপিসি শিখিয়েছিল দুটো গুরুমন্তর।
এক, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ হল চুকলি করা, বিশেষ করে বন্ধুদের ব্যাপারে।
দুই, ‘মুখ দোষে মার গলে’। যখন তখন পট পট করে মুখ খুলতে নেই।
মুখ খোলার বিপদ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বড় হতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
বাইরে বোধহয় একটু ফর্সা হয়েছে। তাহলে তো এবার উঠতে হয়। সেই ছোটবেলার শিক্ষে। বাঙলা প্রাইমারে ‘ঐক্য বাক্য মাণিক্য’র পাতায় ছিলঃ
‘আলস্য ত্যাজিয়া বাল্যে বিদ্যাভ্যাস কর,
সত্যমতি ত্যাগবীর নিত্যনায়ে চড়’।
কী খারাপ পদ্য! এটা বলে ক্লাসে কানে মোচড় খেয়েছিলাম। হ্যাঁ, কর্পোরেশনের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারমশাইয়েরা বড্ড মারতেন।
কী ডেঁপো ছেলে! গাল টিপলে দুধ বেরোয় সে কিনা ছাপা বইয়ের ভুল ধরছে! ওটা তোমাদের পড়ানো হচ্ছে ‘য-ফলা’ শেখানোর জন্য, ছড়া মুখস্থ করতে নয়, বুঝেছ মাণিকচন্দ্র?
--আমার নাম মাণিক দাস।
এবার মাথায় পড়ল দুটো গাঁট্টা।
সেই যে ‘মুখ দোষে মার গলে’। ভুলে গেছলাম- যখন তখন পট পট করে মুখ খুলতে নেই। আচ্ছা, আজকাল কোন মাস্টারমশাই গাঁট্টা মারে না?
নাঃ। কাউকে কিস্যু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কিন্তু পা নড়ে না কেন? পাশ ফিরতে পারছি না কেন? এখনও ঝিঁঝিঁ ছাড়েনি? কী কান্ড!
আচ্ছা, এই ঘর এই বিছানা অমন অচেনা লাগছে কেন?কাল রাত্তিরে কোথায় ছিলাম? কার ঘরে?
ছোটবেলায় ধলা ঠাকুমা এই সময় ঘরে ঢুকত। আমাদের দু’জন ঠাকুমা ছিল-দুই বোন। একজন ফর্সা আর অন্যজন কালো। তাই ধলা ও কালা ঠাকুমা।
ধলা ছিল আমার মিত্র, কালা শত্রু নাহলেও নিউট্রাল। মা পেটালে কখনও ছাড়াতে আসত না। পানের ডাবা থেকে পান বের করে নির্বিকার মুখে চুণ খয়ের লাগিয়ে গালে পুরত। তখন থেকে আমি নিউট্রাল লোকেদের দু’চক্ষে দেখতে পারি না।
ধলা ঠাকুমা ঝাঁপিয়ে পড়ত। বৌমা, পোলাডারে কি মাইরা ফ্যালাইতে চাও?
- সেকি, আমি তো হাতপাখার ডাঁটি দিয়ে মাত্র এক ঘা দিয়েছি । শয়তান ছেলে আপনার পেছনে লুকুচ্ছে। আপনার লাই পেয়ে মাথায় উঠেছে। আজ আমি ওর হাড়মাস—
ততক্ষণে ঠাকুমা মায়ের হাত থেকে হাতপাখাটা কেড়ে নিয়েছেন।
ধলা ঠিক টের পেতেন আমি জেগে না ঘুমিয়ে। মটকা মেরে পড়ে থাকলেও লেপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পায়ের তলায় কাতুকুতু দিতেন।
‘উঠরে ভাই, মাণিকসোনা, হাত মুখ ধুইয়া পড়তে বস।
‘সকালে শয়ন করি সকালে উঠিবে,
সুস্থ সুখী ধনী জ্ঞানী তবে তো হইবে’।
--পড়তে ভাল লাগে না ঠাকুমা।
--ভাল তো অনেক কিছুই লাগে না। ওষুধ খাইতে কি ভাল লাগে দাদুভাই? খাইতে হয়। তেমনই পড়াটড়া তিতা ওষুধের মত সোনামুখ কইর্যা সাইর্যা ফেল।
তারপর ধলা সুর করে বলেনঃ
লেখাপড়া করে যে?
আমি উত্তর দিইঃ
গাড়ি চাপা পড়ে সে।
দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠি। কাতুকুতু বেড়ে যায়। এবং আমার ঝিঁঝিঁ ছেড়ে দেয়। এবার আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। এটা আমাদের রোজকার খেলা।
কলতলায় গিয়ে পেট হালকা করে কালীদন্তমাঞ্জনের গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে শুনতে পাইঃ
“নামটি আমার গদাধর, সবাই ডাকে গদা,
সারাদিনটি খেলে বেড়াই গায়ে ধুলোকাদা।
দাদা বলে গাধা তুই, লিখবি পড়বি নে’?
অমনি আমি কেঁদে দিলাম – ভ্যাঁ এঁ এঁ।
দিদি বলে - ষাট ষাট, গদু ভাল ছেলে,
সোনামানিক এস খানিক হাডুডুডু খেলে”।
বাসন মাজতে মাজতে মা গজগজ করে — বুড়িকে সাতসকালে ছড়ায় পেয়েছে।
ঝিঁঝিঁ শুধু পায়ে নয় হাতেও ধরেছে। কাউকে ডাকবো? কী জন্যে? ঝিঁঝিঁ ছাড়িয়ে দেবার জন্যে? লজ্জার কথা। কিন্তু ঘরে কেউ তো আসুক। গোটা কয়েক খালি বিছানা - একটাও লোক নেই। এ কেমন সৃষ্টিছাড়া জায়গা?
সেই গানটা আবার ফিরে আসছে, এবার কোরাসে। ওরা আসছে, এদিকেই এগিয়ে আসছে। কথাগুলো এখন অনেক স্পষ্ট। আমি বিট বুঝতে পারছি। মানেটাও শিখে নেব, কার থেকে? কেন, ওই যে লীড গাইছে - ওর থেকে।
“জটাকটা/হসভ্রম, ভ্রমান্নালম্প/নির্ঝরা,
বিলোলবীচি/বল্লরা, বিরাজমান/মূর্ধনি।
ধগদ্ধগ/দ্ধগজ্বল/ ললাটপট্ট/পাবকে,
কিশোরচন্দ্র/শেখরে/ রতিঃপ্রতি/ক্ষণং মমঃ।
ধেত্তেরি! ওরা ভেতরে এল না। এগিয়ে গেল, মার্চপাস্টের ছন্দে। ওরা কারা? এ আমি কোথায় এসেছি!
পেডিয়ান চাই! পেডিয়ান!
এটা কী বললাম? পেডিয়ান! এসব তো সেই ছোটবেলার কথা। ভুলে গেছলাম। এই শব্দটা কোন অভিধানে নেই। এই শব্দ আমার তৈরি করা। আজ নয়, সেই মিশনের হোস্টেলের দিনে।
আমি তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন। অনেক সময় হাত-পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে। গরীবদের জন্যে বরাদ্দ ফ্রি কোটায় ভর্তি হয়েছিলাম। বাবা সাইকেল রিকশা চালাত, মা বাড়ি বাড়ি বাসন মাজত। ওদের মধ্যে খুব ঝগড়া হত। এমনই এক রাত্তিরে বাবা এককাঁড়ি মদ গিলে মার সঙ্গে বিচ্ছিরি ঝগড়া করল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর ফিরে আসে নি। ততদিনে কালা-ধলা দুই ঠাকুমা উপরে চলে গেছেন।
মা কিছুদিন গুম মেরে রইল। তারপর বাবার দোস্ত সনৎকাকুর সঙ্গে থাকতে লাগল।
কাকু বেশ মজার লোক ছিল। আমার সঙ্গে লুডো ও নানান খেলা খেলত। তার মধ্যে একটায় আমার ব্যথা লাগত। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিত কাছাকাছি মা আছে কিনা। তারপর বলত — মানিক, বিন্দাবন দেখবি?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলে আমার দুদিকের জুলফির দুপাশে হাত দিয়ে চেপে শূন্যে তুলে ধরত। একদিন বলে দিলাম – বিন্দাবন দেখব না।
কাকু মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের গাড়ি চালায়। ওনাকে ধরে আমাকে মিশনের স্কুলে ফ্রি কোটায় ভর্তি করে দিল। ফর্ম ভরার সময় একটু ঝামেলা হয়েছিল। বাবার নামের জায়গাটা মা খালি রেখেছিল। মহারাজ সেদিকে পেন্সিল লাগালে মা ঘোমটার ভেতর থেকে বলল—নিরুদ্দেশ।
সনতকাকু বলল - আমার নাম লিখে নিন, আমি ওর কাকা।
মহারাজ মার দিকে তাকালেন। মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখে আঁচল চাপা দিল। মহারাজ মাথা নাড়লেন।
-- মা, ঈশ্বর তোমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ, জন্মদাতা পিতার বিকল্প হয় না।
তারপর উনি আমার দিকে ফিরলেন — খোকা, তোমার বাবার নাম কী?
-- শ্রীযুক্ত নিবারণ চন্দ্র দাস।
আমি ঘাবড়াইনি। ধলা ঠাকুমা শিখিয়ে দিয়েছিল যে!
মহারাজের মুখে একগাল হাসি। দেখলে তো মা!
উনি নিজেই নামটা ভরে দিলেন, আমি ভর্তি হয়ে গেলাম।
প্রথম প্রথম কান্না পেত। মনে পড়ত ধলা কালা দুই ঠাকুমার কথা। পাড়ার বন্ধুদের কথা। আমার মা পারুলবালার কথা।
একবার হোস্টেলে একটা ছেলের সাদা শার্ট চুরি গেল। সে এসে আমাকে বলল—মাণিক, জামাটা ভালয় ভালয় ফেরত দিয়ে দে। আমার নতুন জামা। কাউকে কিছু বলব না।
আমি অবাক, আমি তো নিইনি। কী করে ফেরত দেব।
ও বলল—বাইরে শুকোতে দিয়েছিলাম। ওয়ার্ডেন অচ্যুতদা দেখেছে, একটা কালো ছেলে তুলে নিয়ে গেছে।
আমি বললাম—কালো ছেলে কি আর নেই? তোমার গায়ের রঙও তো কালো।
ব্যস, সেই যে- মুখ দোষে মার গলে।আমি নতুন ছেলে, আমি ফ্রি কোটায় জায়গা পেয়েছি। ওরা তিনজন এল, আমার হাত মুচড়ে দিল। টিনের বাক্সে তালা ছিল না।হাণ্ডুল পান্ডুল করে দেখে কিছু না পেয়ে দুটো লাথি কষিয়ে ব্যাজার মুখে চলে গেল।
রাত্তিরে হাতের ব্যথায় ঘুম না এলে মাকে মনে পড়ল। পারুলবালা থাকলে ঠিক চূণহলদি- পেঁয়াজবাটা গরম করে হাতে লাগিয়ে দিত। সব ব্যথা টেনে নিত।
নিজের মনে মায়ের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। নিজের ভাষায়। এ ভাষা শুধু আমাদের দুজনের, অন্যেরা শুনলেও বুঝবে না। মা ঠিক উত্তর দিত।
আমি - মাম্মা, হাম্বুল তাম্বুল? কেমন আছ মা, তোমাদের কেমন চলছে?
মা - নিরেনবুল, চিঞ্চিতাং। যেমন চলার, চিন্তা করিস না।
আমি - কঙ্কড় ধঙ্ক্র, মুই মুই? কতদিন হল তোমায় দেখিনা, কবে আসবে মা?
মা - আলম্বন, নিলম্বন। একটু সময় লাগবে, একটু অপেক্ষা কর।
এইভাবে আমার আর মার মধ্যে একটু একটু করে নিয়মিত গল্পগাছা হত। আর আমি পেলাম একটি নিজস্ব ভাষা। এর অভিধান, ব্যাকরণ, সন্ধি-সমাস, ণত্ব-ষত্ব বিধি- সব, সব আমার হাতে তৈরি।
ছ’মাস পরে একদিন আমার রুম পার্টনার মলয় এটা খেয়াল করল। ধীরে ধীরে সুব্রত, গৌতম, পঙ্কজ, সবাই জেনে গেল আমি একা একা খালি ঘরে নিজের সাঙ্কেতিক ভাষায় কারও সঙ্গে কথা বলি। ওরা প্রথমে ভয় পেল, তারপর মজা। ওদেরও শিখিয়ে দিলাম।
বছর ঘুরতে হোস্টেলে প্রায় সবাই জেনে গেল আমরা একটা কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলি।
শুরুতে কেউ পাত্তা দেয়নি।
কিন্তু একদিন ভলিবলের মাঠে সিনিয়রদের সঙ্গে পঙ্গা। আমরা তিনজন --বল পাস করা, নেটের সামনে তুলে দেয়া, লাফিয়ে চাপ মারা বা নেটের সামনে দুজনে একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে ব্লক করা – সব নিজস্ব কোডে বিনিময় করে খেলতে লাগলাম।
মলয় চেঁচাচ্ছে — হাডুম্ব! হাডুম্ব!
আমরা দু’জন সমস্বরে উত্তর দিলাম - হম্ব, হম্ব।
নেটের সামনে উঁচুতে বল, মলয় লাফিয়ে উঠে বল না ছুঁয়ে সরে গেল। ওর আড়াল সরতেই আমি সপাটে স্ম্যাশ করলাম। সিনিয়র বিজনদা অদ্ভুত শব্দ শুনে বল থেকে চোখ সরাল। ফলে যা তা ব্যাপার।
একটু পরে সুব্রত টাচলাইনের এপাশ থেকে বডি ফেলে একটা বল তুলে দিল। কিন্তু লাইনম্যান গোষ্ঠদা সেটাকে ‘আউট’ বলায় আমাদের গোটা টিম হতভম্ব।
আমি গর্জন করলাম — পেডিয়ান চাই, পেডিয়ান! প্রতিশোধ চাই।
মজা পেয়ে গোটা মাঠ বুঝে না বুঝে সমস্বরে গর্জন করল — পেডিয়ান চাই!
সিনিয়র টিম এই প্রথম জুনিয়রদের কাছে হেরে গেল। ওদের মুখ থমথমে।
সন্ধ্যেয় প্রার্থনার পরে আমার মহারাজের ঘরে ডাক পড়ল। আমি নাকি মাঠে বড়দের অশ্লীল গালাগাল দিয়েছি। উনি জানতে চাইলেন আমি ঠিক কী শব্দ বলেছি। আমি বললাম এবং বেত খেলাম।
পরের দিন জলখাবারের সময় থেকে এই নিয়ে হাসাহাসি চলল। টিউটোরিয়াল ক্লাসে মাস্টারমশাই সমীরদা আবার জানতে চাইলেন আমরা নিজেদের মধ্যে ঠিক কী ভাষায় কথা বলি। দিনদুই পরে উনি আমাকে একটি বই উপহার দিলেন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পসল্প’। তাতে দেখি বাগবুলবুলি ভাষা, ক্রেকংটাকৃষ্ট, তাঝঝিম মাঝঝিম।
তারপর সন্ধ্যেবেলা আমি মলয়ের পিঠে একটা কিল বসিয়ে বললাম — রবি ঠাকুর বলেছেন পিঠে কিল পড়লে সেটা যে কিল তা বুঝতে পন্ডিত ডাকতে হয় না।
কয়েকবার বেত খাওয়ার পর আমাদের মধ্যে সান্ধ্যভাষা নিয়ে উৎসাহ উপে গেল। অনেক বছর কেটে গেল। শুধু উত্তেজিত হলে বা দুঃখ পেলে আমার মুখ দিয়ে কিছু শব্দ বেরিয়ে যেত। তবে এর জন্যে এমন মূল্য চোকাতে হবে ভাবি নি।
ফুলশয্যার রাতে মশারির ভেতরে সোনালির মুখ একেবারে ‘কেয়ূরকঙ্কণে কুঙ্কুমচন্দনে’!
আমি জানতাম জানলার আড়ালে কারা আড়ি পেতেছে। ভাবলাম স্থুলতার হাত থেকে সোনালিকে বাঁচাতে হবে। অন্ততঃ আজ রাত্তিরে। ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম — হামতিমানু কাষ্ঠাগোকুল।
ও চমকে উঠে একটু সরে গিয়ে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখতে লাগল। আমি ওর দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বলে উঠলাম — ইস্টিমানু কাষ্ঠাগোকুল।
ওর দুচোখে ভয়ের সমুদ্র।
আমি এবার ‘আড্ডাপাডা, বাড্ডাপাডা’ বলে লাইট নিভিয়ে ওর দিকে পেছন ফিরে শুলাম। ও ছিটকে মশারি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওদিকে সোফার ওপরে শুয়ে পড়ল।
সোনালি পরের দিন সকাল থেকে আমার সঙ্গে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিল এবং দ্বিরাগমনে বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরে এল না। একমাস পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হুমকি ভরা এক চিঠি এল।
সেদিন রাত্তিরে ঘুম এল না, বিছানায় শুয়ে ভেড়া গুণছি, এ’পাশ ও’পাশ করছি।
-- মাম্মা, গ-গ-গ-গ-গ! থ্যাতা ব্যাতা। বড্ড কষ্ট পেয়েছি মাগো, বড় কষ্ট।
-- নি-নি-নি-নি! ফুর ফুর ফুর! মন খারাপ করিস নে। সেরে গেলে ভাল হয়ে যাবি।
সে তো অনেক পরের কথা। এখন ‘প্রশ্ন করি নিজের কাছে কে আমি, কোথায় ছিলাম, কোথায় যাবো এই আমি’?
ঘুম আসছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা।আধো জেগে আধো তন্দ্রার মধ্যে আবার শুনতে পেলামঃ
“ডুমড্ডুম/ডুমড্ডুম/নিনাদবড্ডমর্বয়ং,
চকারচণ্ড/তান্ডবং/ তনোতুনঃ/শিবঃ শিবম”।
এবার একটা সিনেমা দেখছি। একটা মিছিল। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম। একটা মসজিদ। তার মিনার থেকে মাইকে কিছু ঘোষণা হচ্ছে। মিছিলে কিছু ইঁট পড়ল। মিছিল ধাক্কাধাক্কি করে পিছিয়ে এল। এবার মিছিলের পেছনের সারির ভ্যান রিকশার মাইক থেকে কিছু বলা হল। মিছিলের কিছু লোক উলটো দিকে মসজিদের দেয়ালে সেঁটে গেল।
ইঁট পড়া বন্ধ হয়েছে। মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিছিলের শেষ দিকের কিছু লোক উল্টোমুখো হয়ে মসজিদের কোলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করতে লাগল।আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। দোকানপাটের ঝাঁপ পড়ে গেছে।
পুলিশ অনেক দূরে ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে। একটা টিয়ারগ্যাসের শেল ফাটল, খুব কাছে। ধোঁয়া, চোখে জ্বালা। আমি অন্ধের মত মসজিদে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলাম। চোখে জল দিতে হবে। ওদের আঙিনায় অনেক কল থাকে ‘ওজু’ করার জন্যে।
কখন যেন দরজা ভেঙে গেছে। আগল খুলে গেছে। অনেক লোক ভেতরে ঢুকছে। হাতাহাতি, শ্লোগান। ‘হর হর মহাদেব’ আর ‘আল্লাহু আকবর’ কখন মিলে মিশে বিকট কলরব। আমি কিছু লোকের সঙ্গে পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে পালাতে চেষ্টা করলাম। দুটো ছেলে মিনারে চড়ে লাল কাপড় টাঙিয়ে চিৎকার করল — জয় বজরঙবলী!
রাস্তা থেকে ভিড় গর্জন করল- ভারতমাতা কী জয়!
আমিও চেঁচালাম -জয়!
তারপরই মাথার পেছনে একটা কিসের বাড়ি পড়ল সেটা আর দেখতে পেলাম না।
আচ্ছা, বয়স্ক লোকগুলো কি একটু বোকা হয়? সবার কথা বলছি না, আমার বাবা মোটেই বোকা ছিলেন না।মঙ্গলা পঞ্চায়েতের কত লোকজন ওনার কাছে পরামর্শ নিতে আসে।
কিন্তু যারা একটু ফ্রাস্টু গোছের? যেমন ধরুন গ্রামীণ ব্যাংকের সকরী শাখার হেড ক্যাশিয়ার বিনোদ আংকল? আমি ওনার ব্যাংকে একটা রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলেছি। প্রতি মাসে দশ তারিখে গিয়ে একশ টাকা জমা করে আসি।
উনি আমাকে লাইনে দাঁড়াতে দেন না। পাশের চেয়ারে বসিয়ে চা খাওয়ান, বাড়ির সবার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন। অন্য একজন সব কাজ করে পাশবুকে এন্ট্রি করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। আমি নমস্তে বলে চলে আসি। উনি নাকি আমার বাবার ব্যাডমিন্টন খেলার পার্টনার।
কিন্তু ইদানীং আংকলের কথাবার্তা কেমন যেন অচেনা লাগছে। আমাকে কথায় কথায় বলেন আমি নাকি হঠাৎ বড় হয়ে যাচ্ছি। খুব সুন্দর হয়ে উঠছি! বাবার বন্ধুর মুখে এসব কথা যে আমার ভাল লাগছে না তা’ কি উনি বুঝতে পারেন না।
লোকে কিন্তু আমাকেই বোকা বলে। কারা বলে? অনেকেই, যেমন আমার মেয়েবন্ধুরা, ওদের বিশেষ চুটকুলা শুনে আমার হাসি পায় না বলে। ছেলেবন্ধুদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। ওরা অত ন্যাকা নয়।
মা বকে- তুই বড় হচ্ছিস, এখন অমন মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে পাড়ার যত বখাটে বাপে -খেদানো মায়ে- তাড়ানো ছেলেগুলোর সঙ্গে ডান্ডা-গিল্লি খেললে চলবে? আর দ্যাখ, বাইরের লোকজনের সামনে অমন হ্যা-হ্যা করে মুখ খুলে হাসতে নেই।
মুখ বন্ধ করে আবার হাসা যায় নাকি?
বোকা মেয়ে, বুঝতে পারিস না কি বলছি? তোর জন্যে আমার যে লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
মা’র ওই এক কথা। তোর জন্যে আমাদের নাক কাটা যাবে।
একদিন বললাম—মাথা আর নাক তো কাটা হয়েই গেছে। এবার গলা আর কানের কথা ভাব।
এসব বলার ফল যে ভালো হয়নি সেটা না বললেও চলে।
সেবার স্কুলের মাঠে টিফিন খাওয়ার সময় অনিতা নতুন চুটকুলা শোনাচ্ছিল।
‘ এক বোকাসোকা গাঁয়ের ছেলে সুহাগরাতে বৌকে দেখে চোখ বড় বড় করে বলল—তোমার বুকে ওদুটো কী? বৌ লজ্জা ঢাকতে বলল- ফোঁড়া বেরিয়েছে। ওর বর অবাক হয়ে বলল-ফোঁড়া তো বুকে বেরিয়েছে, ফোঁড়ার মুখ নীচে খুলল কী করে’?
ব্যস, সবাই হা-হা, হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম এতে এত হাসির কী হল? সবাই আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। আমি এত বোকা যে ওদের নাকি ‘মজা কিরকিরা’ করে দিয়েছি।
আমি বললাম- ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। ফোঁড়ার গল্পে হাসির ব্যাপারটা তো বলে দাও। ওরা বলল-এখন যা, বাড়ি গিয়ে তোর মাকে জিজ্ঞেস করিস।
রাত্তিরে হোমটাস্ক হয়ে গেলে রান্নাঘরে মাকে রুটি সেঁকতে সাহায্য করতে গেলাম। মা বেলে দিচ্ছে, আমি তাওয়ায় গরম করে তারের জালিতে দিয়ে ফুলে উঠলে থালায় নামিয়ে ঢেকে রাখছি।
মা, একটা কথা। ক্লাসে বন্ধুরা আমাকে একঘরে করে দিয়েছে। ওদের একটা হাসির গল্পে আমার হাসি পায়নি বলে। আমি নাকি খুব বোকা। তোমায় বলি?
তারপর গল্পটা মাকে শোনালাম। এবার বল এতে হাসির কী হয়েছে।
মা ব্যাজার মুখে আমাকে দেখল। তারপর রুটি বেলতে বেলতে বলল—তোর হাসতে হয় হাসিস, কাঁদতে হয় কাঁদিস, আমাকে জ্বালাস নে।এমন হদ্দ বোকা মেয়ে আমার ঘরেই –।
কিন্তু আমার জিদ চেপে গেছল, তাই আনোয়ারকে ধরলাম।
অ্যাই, এই চুটকুলায় হাসির কী আছে বল দিকি? আর যদি তুইও আমাকে ‘বেওকুফ লড়কী’ বলেছিস তো আজ তোরই একদিন কী আমারই! আমি স্কুল লেভেলে কাবাড্ডি আর ভলিবলের ক্যাপ্টেন। এক হাত যদি ধরে দিই না, গালে পাঞ্জা -ছাপে -ভোট হয়ে যাবে।
বিলাসপুর শহরের পশ্চিমে আমাদের মঙ্গলা গাঁয়ের পেছনভাগে অরপা নদীর নতুন পুল।এখান দিয়ে এখনও গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি। সূর্যডোবার একটু আগে আমরা ওখানে পুলের রেলিঙয়ে চড়ে বসলাম।
আনোয়ারের বাবা আরিফ চাচার আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে পুরনো টায়ার পাংচার সারাবার দোকান, বাস স্টপের পাশে। ওর বোন সাকিনা আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। দুই বাড়িতে আমাদের অবাধ যাতায়াত, সেই বচপন থেকেই। ঈদের দিনে ফিরনী ও সেমাইয়ের পায়েস, হোলির মিঠাই। আমরা জানি যে ওরা মুসলিম, আমরা হিন্দু। কিন্তু এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই জেনেছিলাম, যেমন আমি ও সাকিনা মেয়ে, আনোয়ার ছেলে।
একদিন কানে এল দাদিমা আমার মাতারামকে বলছেন—বহু, সুনীতা বড় হচ্ছে।কিছুদিন পরে বিয়ে দিতে হবে। এখন থেকে চোখে চোখে রাখতে হবে। ওকে আটকাও, যখন তখন ম্লেচ্ছদের বাড়ি যেতে দিও না।
মা নীচু গলায় কী যে বলল শুনতে পাইনি। তবে এরপর থেকে যেন মায়ের মুখে ‘নাক কাটা্বি, কান কাটাবি’ অভিযোগ বেশি বেশি শুনতে পাচ্ছিলাম।
আনোয়ার আমার চেয়ে তিন বছরের বড়, একই স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ে। আগে যখন আমি ও সাকিনা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম তখন ও আমাদের গার্জেনের মত আগলে রাখত। ইদানীং আগলানোর দরকার না থাকলেও কোন সমস্যা হলে আমি ওকেই সব খুলে বলি। আগে ‘ভাইয়া’ বলতাম, গতবছর থেকে বড়দের সামনে বলি, আড়ালে নাম ধরে ডাকি। আর রাখি বাঁধার প্রশ্নই ওঠেনি।
ওর ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা দেখা যাচ্ছে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিল কেমন দেখাচ্ছে? আমি বলেছিলাম—মনে হচ্ছে নাকের নীচে এঁটো ডাল শুকিয়ে আছে। খেপে গিয়ে যা তাড়া করেছিল না, আমি পালাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলাম। হাঁটুর কাছটায় ছড়ে গেছল।
আনোয়ার টেনে তুলে যেই দেখল রক্ত বেরিয়েছে অমনই ঘাবড়ে গিয়ে কাছের আরএমপি ডাক্তারখানায় নিয়ে ব্যান্ডেজ করে টিটেনাস লাগিয়ে সে এক কান্ড। তারপর থেকে মাঝে মধ্যেই আমরা দু’জন অরপা নদীর পুলের কাছে সপ্তাহে এক-আধ দিন ‘মিট’ করতাম। প্রথম প্রথম সাকিনাও সঙ্গে আসত, আজকাল আর আসে না।
সে যাই হোক, আনোয়ার নদীর পুলে চড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা সিগ্রেট ধরাল। তারপর মুরুব্বির ঢঙে বলল—কই, শুনি কিসের হাসির গল্প?
তারপর বুকে ফোঁড়া বেরোনোর চুটকুলা শুনে ওর রেলিং থেকে নদীতে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। সেকী হাসি, হেঁচকি তুলে হাসছে তো হাসছেই।
আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে জিদ করলাম—ঝেড়ে কাশো দিকি। এত হাসির কী আছে?
-সে তোকে বলতে পারব না। এসব মেয়েদের বলা যায় না।
- বলা যায় না, কিন্তু হাসা যায়? আরে এটা তো মেয়েদের আড্ডারই জোকস? তুমি তো আচ্ছা বোকা!
-- আসলে আমি ভাবতাম এসব কথা খালি ছেলেরাই বলে। মেয়েরা অনেক সভ্যভব্য হয়।
আমি একটা ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে নিই। আমরা সভ্যভব্যই, কিন্তু খুলে না বললে ইঁট মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দেব। একটা চন্ডাল রাগ আমার ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠছে।
শেষে ও গল্পটার ভেতরের ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর আমরা দুজনেই চুপ। এরকম কথাবার্তা আগে কারও সঙ্গে বলিনি। সাকিনার সঙ্গেও না।
তারপর অস্বস্তি কাটাতে আমি বললাম—জান, মেয়েরাও ছেলেদের সম্বন্ধে ওরকমই ভাবে।
-মানে?
--আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আরও একটা হাসির কথা চলে, শুনবে? ধর একজন বলল,” লড়কে লোগ আপস মেঁ ইতনী ক্যা বাত করতে হ্যায়”? অন্যজন বলবে, “ওহি, যো হমলোগ করতে হ্যায়”।
তারপর সবাই বলবে, “ছি, কিতনে বেশরম হ্যায়”। ব্যস, হাহা-হিহি শুরু।
ছেলেরা নিজেদের মধ্যে এত কী কথা বলে রে? আরে, আমরা যা বলি তাই।
ছিঃ, কী অসভ্য রে বাবা!
এভাবেই কী করে যেন আমরা কখন সচেতন হয়ে উঠলাম যে আমি এক ‘অওরত’ আর আনোয়ার হল এক হাট্টাকাট্টা ‘জোয়ান-মর্দ’। পাড়া-প্রতিবেশিদের জিভ নড়তে শুরু করল। দুইবাড়ির বাবা মায়ের টনক নড়ল। বাবা ওদের বাড়িতে ধমকাতে গেল। আরিফ চাচা বাবাকে বলল—নিজের মেয়েকে সামলান জনাব।
ও বাড়িতে আনোয়ার আর এ বাড়িতে আমি বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেলাম। দু’বাড়ির সম্পর্ক তেতো হল।
আমার ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ হল। তখন বুঝতে পারলাম আমি আর আনোয়ার দুজনে দুজনার জন্যেই জন্মেছি। আমরাই অ্যাডাম ও ঈভ। আনোয়ার আমাকে শুধরে দিল—অ্যাডাম ও ঈভ তো সায়েবদের ব্যাপার। আমরা হলাম বাবা আদম ও বিবি হবা।
গোপনে ঠিক করলাম এখানে আর না। আমরা নাগপুরে পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধব। আনোয়ার টায়ার পাংচার সারানো কোল্ড ও হট ট্রিটমেন্ট এবং খানিকটা ইঞ্জিনের কাজ জানে। কোনও গ্যারেজে ঠিক কাজ পেয়ে যাবে। ওর বয়েস আঠেরো পেরিয়ে চার মাস। আমি তো পনের পেরিয়েছি। খালি স্কুলের মার্কশীট সঙ্গে নিতে হবে। ট্রেনভাড়া ও কিছু টাকা পয়সা আনোয়ার ম্যানেজ করবে। ওর বন্ধুরা আছে।নাগপুরে ওর এক বন্ধুর মামা আছেন। প্রথমে ওখানে গিয়ে ওঠা হবে।
এখন বুঝতে পারি সত্যি কত বোকা ছিলাম। হ্যাঁ, মা যেমন বলত—হদ্দবোকা।
নাগপুরে বন্ধুর মামুজানের বাড়িতে গিয়ে পাঁচটা দিনও কাটেনি, ভোরবেলা পুলিশ এসে হাজির, সঙ্গে আরিফ চাচা ও আমার বাবা। টের পেলাম মামুজানই ফোন করে বিলাসপুর পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন। আরও জানলাম যে আমি ও আনোয়ার দুজনেই আইনের চোখে মাইনর, বিয়ে করার যোগ্য নই। আমি তো জানতাম, মেয়েরা চোদ্দ বছর হলেই বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আইন নাকি বদলে গেছে। এখন মেয়েদের আঠেরো আর ছেলেদের একুশ।
আচ্ছা, আঠেরো বছর বয়সে ভোট দিতে পারবে, দেশের হয়ে বাইরে গিয়ে খেলতে পারবে কিন্তু নিজের গাঁয়ে বিয়ে করতে পারবে না? এ কেমনধারা আইন? সত্যি, সবাই বোঝে, শুধু আমার মত বোকারাই বুঝতে পারে না।
আরিফ চাচা দেখলেন যে যা ঘটেছে তা পুলিশের চোখে গুরুতর অপরাধ। এতে আমার কিছু হবেনা, কিন্তু আনোয়ারের উপর নাবালিক অপহরণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ম পরিবর্তনের জন্যে জোর করা এবং গাঁয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে শান্তিভঙ্গের ষড়যন্ত্র—এইসব চার্জ লাগানো হয়েছে। এতে দশবছর অবধি জেল হতে পারে।
আমি বাবার কথায় চারপাঁচটা হাতে লেখা এবং টাইপ করা কাগজে সই মেরে দিয়েছি। ওসব নাকি বিনা ঝামেলায় বাড়ি ফেরার জন্যে দরকার। আনোয়ারকে দেখলাম দুজন পুলিশ শক্ত করে চেপে ধরে রয়েছে। ওর দিকে তাকালাম। ও পাথর মুখ করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে।
আরিফ চাচা বাবার পা’ জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন- বাচ্চা হ্যায়, গলতি কর ডারে। বহুত বড়ী গলতি। গুণাহ কবুল। কিন্তু এতবড় সাজা দেবেন না। আপনাদের নুন খেয়েছি, সকরি গ্রামে তিনপুরুষের বাস। সুখে দুঃখে কেটে গেছে এত বছর। কেস তুলে নিন।
আমি সাতদিনের মধ্যে পরিবার নিয়ে আপনাদের গাঁ ছেড়ে চলে যাব।‘পুরখো কে জমিন জায়দাদ ওনেপৌনে ভাও মেঁ’ বেচে দেব। পূর্বপুরুষের জমিজমা ভিটে সব জলের দরে ছেড়ে দেব। আপনিই নিয়ে নিন। উঠে যাব অন্য কোথাও।কিন্তু নালিশ তুলে নিন। আমাদের মাফ করে দেন। আল্লাহ আপনাকে অনেক বরকত দেবে। রহম করুন, একটু দয়া করুন।
একটা ঘোরের মধ্যে বাড়িতে ফিরে এলাম। কিন্তু আমাকে মূল বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হল না।গোয়ালঘরের পাশে একটা ঘরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়া হল। কানে এল আমি নাকি অপবিত্র, আমি ম্লেচ্ছ ছোকরার ঝুঠন বা এঁটো।
কিন্তু ওই ঘরে আলো নেই।মেজেতে গোবরের গন্ধ, মশা কামড়াচ্ছে। রাত্তিরে কেউ তালা খুলল। সামনে ভাতের থালা নিয়ে সুশীলা রওতাইন, পেছনে লন্ঠন হাতে মায়ের কঠিন মুখ, বয়েস বেড়ে গেছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মা লন্ঠনটা নামিয়ে চলে গেল। সুশীলা আমার কথার কোন উত্তর দিল না। খাওয়া হয়ে গেলে তালা লাগাতে লাগাতে বলল—জ্যায়সী করণী, ঐসী ভরণী। যেমন কম্ম তেমন ফল।
এভাবে দু’দিন কেটে গেল। তিনদিনের মাথায় দুপুর বেলায় বাবা-মা এল। বলল, সেই গোটা পরিবারের নাক কাটিয়ে ছাড়লি? তোকে স্কুলে পাঠানোই ভুল হয়েছে। আগেই বিয়ে দেয়া উচিত ছিল।
বিকেলে বাবা এল, সঙ্গে দেখি বাবার বন্ধু বিনোদ আংকল, সেই ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। আজকে উনি আমাকে দেখে হাসলেন না। ঘরের কোণায় একটা গরুবাঁধা দড়ি পড়েছিল। সেটা টেনে এনে ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। যাকগে, আমি বাবার কথায় কান দিলাম। বাবার গলার স্বর আজকে অনেক নরম।
-দেখ তো মুন্নি, কী কান্ড বাঁধিয়েছিস! যতই চাপাচাপি করি কথা ছড়িয়ে যায়, সার পচলে গন্ধ ছড়ায়। আমি সাত গাঁয়ের যে বড়সড় পঞ্চায়েত, তার সরপঞ্চ। পাঁচকোশের মধ্যে সবাই আমায় এক ডাকে চেনে। ন্যায়বিচার চাইতে আদালতের ঝামেলায় না জড়িয়ে আমার কাছে আসে।
শেষে কিনা আমার ঘরেই এই কান্ড! সবাই বলছে জাতধর্ম বলে কিছু রইলনা। আমায় রাজধর্ম পালন করতে হবে। সেখানে বাকি সব তুচ্ছ।
বাবা কী বলতে চাইছে? আমার কেমন ভয় ভয় করছে।
একটা খট করে শব্দ।
ভেজানো দরজা ঠেলে মা ঢুকেছে। ভেতরবাড়ি থেকে একটা কাঠের টুল তুলে এনেছে। ওটা নামিয়ে দরজায় শেকল তুলে দিল। মা তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। বাবা তাকাল বিনোদ আংকলের দিকে। আংকল দড়িটা দিয়ে একটা ফাঁস বানিয়ে টেনে দেখছে। বাবা মা’র দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
মা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি কিছু বোঝার আগেই আমার মুখ চেপে ধরে ওড়নাটা মুখে ঠুসে বেঁধে ফেলল। আমি চেঁচাতে চাইলাম, হাত-পা ছুঁড়লাম, কোন লাভ হল না।
আমাকে আংকল আর মা ঠেলে মিলে টেনে নিয়ে কড়িকাঠের নীচে দাঁড় করাল। আংকল লম্বা দড়ির আরেক মাথা ছুঁড়ে কড়িকাঠের বীমের উপর দিয়ে গলিয়ে এনেছে। তারপর গলায় ফাঁসটা পরিয়ে কষে টান। আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এবার বাবা-মা মিলে আমায় জোর করে টুলের উপর দাঁড় করিয়ে দিতেই আংকল দড়ির ওদিকের মাথাটা কামরার ভেতরের কাঠের থামের গায়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর বাবা আমার টুলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।
-আমায় মাপ করিস মুন্নি। কিন্তু আমাকে ন্যায় করতে হবে। রামজী সীতাজীকেও আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেছিলেন। আমি অসহায়।
একধাক্কায় টুল সরে গেল। আমি এখন শূন্যে, আমার গলা লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
সেই রাত্তিরেই আমাকে নদীর পাড়ে পঞ্চায়েতের শ্মশানে দাহ করা হল। আমার কোভিড হয়েছিল নাগপুরে বেড়াতে গিয়ে। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট, তিনদিনের বেশি সময় দিল না ওই মহামারী। ডাক্তারের সার্টিফিকেট তৈরি ছিল।
হাওয়ায় ভেসে ভেসে দেখছি আমার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। কোভিডের রেশ মিলিয়ে যায়নি। তবু ভিনগাঁয়ের লোকজন খেতে এসেছে। বিনোদ আংকল খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। পুরি ও পনীরের সবজি কয়েকবার করে নিলেন। শেষপাতে গাজর কা হালুয়া।
কিন্তু নিয়মমত দাহ হলে আমি আজ হাওয়ায় ভেসে নিজের শ্রাদ্ধ দেখতে পেতাম কী করে?আসলে হাসপাতাল থেকে একটি বেওয়ারিশ লাশ এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি চালান হয়ে যাই মর্গে।হিমঘরে তিনদিন।
বেশ মজা, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমার বাবার জন্যে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমাকে কত ভালবাসত তা তো জানি।
শ্রাদ্ধের পরের দিন আমি চালান হয়ে গেলাম আরেক শহরের হিমঘরে। সেখান থেকে জাহাজে চড়ে প্রায় পাঁচদিনের সফর। কাল মাঝ রাত্তিরে স্টিমার থেকে আমায় একটি দ্বীপে নামিয়ে আনা হয়েছে। শুনছি কাল অমাবস্যার রাতে এই নাম-না-জানা জায়গায় একটা বড়সড় যজ্ঞ হবে। আগুনের তাপে গলবে বরফ, পুড়ে যাবে যত পাপতাপ । ‘ম্লেচ্ছের উচ্ছিষ্ট’ অপবাদ থেকে মুক্ত হব, পবিত্র হব। অপেক্ষায় আছি।
তুমি চতুর্দশীর চাঁদ, নাকি সূর্যের দীপ্তি?
একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যা হল তা’ কেমন করে হল আজও তার কোন ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। ভেবে ভেবে কুল কিনারা পাইনে।
বাবা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল- ‘ঠিক করে বলতো কী করে এমন একটা কান্ড করে বসলি? রায়পুরের উকিল পরিবারের মূর্খ ছেলে, যে স্কুলের বেড়া ডিঙোতে পারেনি, তার বৌ হতে চাস। ওরা কি কোন জাদুটোনা করেছিল? তোকে কিছু শেকড়বাকড় বেটে খাইয়ে দিয়েছিল? কোন কবচ-তাবিজ’?
আমি মাথা নাড়ি।
‘কিন্তু লিলি মামণি, তুই তো আগে মুসলিমদের পছন্দ করতি না! বলতিস -তেলে জলে মিশ খায়না কখনও। এখন কী হল? হঠাৎ’? বাবা যেন গোলকধাঁধায় পথ খুঁজে পাচ্ছেনা।
সত্যি কথা। আমার মুসলমান মেয়েরা বন্ধু ছিল, পাড়ায় সফিয়া, স্কুলে মনিজা। কিন্তু ওদের পাড়ায় বা বাড়িতে গিয়ে আমার ভাল লাগেনি। ওরা আমাদের মত না, একেবারে অন্যরকম।
ওরা বিচ্ছিরি দাড়ি রাখে। ওরা বাইরে থেকে এসেছে, মরুভূমির দেশ থেকে। তাই অভ্যেস খারাপ। কনুই অব্দি ধোয়, একফোঁটা জল মাটিতে পড়েনা। আমরা হাত ধুই ওপর থেকে নীচে, জল পড়ে ছরছর করে। আমরা পূবদিকে মুখ করে সুর্য-নমস্কার করি। ওরা পশ্চিমে মুখ করে নামাজ পড়ে। আমাদের শূকর হল দশাবতারের এক অবতার, কিন্তু ওদের জন্যে হারাম। আমাদের গরু হল মাতা, ওরা গরুর মাংস বিরিয়ানি রেঁধে খায়, কী জঘন্য! সব কিছু উলটো-পালটা। ওরা রেগিস্তানে উটের দুধ খেত, উটের মাংস কোরবানি করে খেত। ম্যাগো!
আর ওদের মেয়েরা? আমার বন্ধু সফিয়াকেই ধর। এই ভ্যাজভ্যাজে গরমে সারাক্ষণ মাথা ঢেকে থাকে। চুলে ঘাম চিটচিট করে। বাইরে বেরোলে কালো বোরখা, তাতে দুটো ফূটো দিয়ে চোখ দেখা যায়। কেমন ভয় করে। ওদের মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়। আমাদের এক গোত্রের মধ্যেই বিয়ে হয়না। ওদের বিয়ে হল কন্ট্র্যাক্ট, তিনবার তালাক বললে ভেঙে যায়। আমাদের বিয়ে হল প্রজাপতির নির্বন্ধ, এত পলকা নয় যে কথায় কথায় ভেঙে যাবে। ওদের সবতাতে আমাদের উলটো। তেলে জলে মিশ খায় না কখনো।
বাবা চেষ্টা করে যায়--‘আরও বলতিস, আমাদের মেয়েরা মন্দিরে যায়, ওদের মেয়েরা মসজিদে যেতে পারে না। ঘরেই ধম্মকম্ম সারে। ওদের আব্বারা চার-চারটে বিয়ে করে, আমাদের একটাই আম্মা, একটাই মাতারাম।
‘কিন্তু আমি তোকে বোঝাতাম, এসব ভুলভাল সমাজবিজ্ঞান তোকে কে শেখাচ্ছে? কোন বইয়ে পেয়েছিস, কোন ইতিহাসের পাতায়? বলতাম এসব অর্ধসত্য’।
আমিই বা কম যাই কিসে! বাবারই মেয়ে। বরাবর তর্ক করে গেছি।
‘ড্যাড, যা যা বললাম তার কোনটা ভুল বল। আমি অত বোকা নই, আগে সফিয়াদের বাড়ি গিয়ে সব মিলিয়ে দেখে তবে বলছি’।
বাবা ছিল নাছোড়বান্দা।
‘সবটা শোন; আগে আমাদের বাড়িতেও, মানে পঞ্চাশ বছর আগে, সবাই ঘোমটায় মুখ ঢেকে রাখতেন। আমার মা-কাকিমারা শ্বশুর-ভাসুরের সামনে মুখ দেখাতেন না, আলাদা করে একঘরে বসে গল্প করতেন না; রেডিও শুনতেন না, একসঙ্গে খেতেন না।
আর আমাদের তেলুগু সমাজে পিসতুতো মামাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হওয়া খুব কমন ব্যাপার। আমার কলিগ মিঃ চারলু, মানে তোর শ্রীনিবাস আঙ্কল আর জ্যোতিশ্রী আন্টি, ওঁরা কিন্তু কাজিন’।
কিন্তু গরুকে মাতা?
‘ওটা অনেক পরের ব্যাপার। ঋগবেদে, মহাভারতে, উপনিষদে গরু মাতা নয়, বরং সম্পত্তির ইউনিট। যজ্ঞটজ্ঞ হলে রাজারা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের হাজার হাজার গরু দান করতেন। জনক সভায় যাজ্ঞবল্ক্য ডিবেট জিতে সোনা বাঁধানো শিংওলা হাজার গরু প্রাইজ পেলেন। নিজের মাতাকে কেউ দান করে বা বিক্রি করে? বনপর্বে ধর্মব্যাধের কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে রাজার রান্নাঘরে রোজ হাজার গরু বধ করে মাংস রান্না হত।
যুগের সঙ্গে অভ্যেস পালটে গেছে। আর খালি শুয়োর কেন , দশাবতার স্তোত্রে প্রথম অবতার হলেন মীন, মানে মাছ। ‘কেশবধৃত মীনশরীর’ মনে আছে? তাহলে তো মামণি আমাদের মাছ খাওয়া ছেড়ে দিতে হয়! আবার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবতার হল কুর্ম ও বরাহ; এবার কাছিমের মাংস, ডিমের বড়া আর সসেজ, বেকন, হ্যামবার্গার—এসব মানা করে দিই’?
আমি রেগে গিয়ে চেঁচাই—কিন্তু চারটে করে বিয়ে আর তিন তালাক?
বাবার আমার বন্ধুর মত; রেগে যায়না বরং হাসে।
‘ আরএকটু বড় হয়ে পড়ে দেখিস, ওসব ইংরেজের প্রভাবে এবং আধুনিক চিন্তার ফসল।আগেকার সময়ে হিন্দু পুরুষের একাধিক আইন্সম্মত স্ত্রী ছিল। হিন্দুধর্মে বহুবিবাহ বারণ করা হয়নি। পুরাণে দেখ, বড় বড় বীরদের বেশ ক’জন স্ত্রী। অর্জুনের দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উলুপী, চিত্রাঙ্গদা ইত্যাদি। কৃষ্ণ ও ইন্দ্রের অনেক স্ত্রী। রামচন্দ্র ব্যতিক্রম, শুধু সীতা।
বাঙালীদের কুলীন ব্রাহ্মণের একসময় এত জন স্ত্রী হত যে তারা সারা বছর পালা করে একের পর এক শ্বশুরবাড়িতে জামাই আদর পেয়ে বেশ দিন কাটাতেন। পেটের জন্যে কিস্যু করার দরকার পড়ত না। অন্যদের কথা ছাড়, আমার বাবা-কাকারা ছিলেন নয় ভাই, চার বোন। অথচ তোর বাবা-কাকারা? একটি কি দুটি’র পিতা।
আর আমাদের বাড়ির কাজের মাসি রাবেয়াকে দেখ, কোন সতীন নেই। পাড়াতেই চেনাজানার মধ্যে খুঁজে দেখ, কোন মুসলমান বাড়িতে একের বেশি দুটো বৌ’? আজকাল একটা পরিবা্র চালানরই খরচ কত বেশি।
তুমি কি বলতে চাও ওদের আর আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই?
‘কেন থাকবে না? আচারে বিচারে বিয়েসাদির নিয়মে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে অনেক ফারাক থাকে। অমন ফারাক শিখ বা ক্রীশ্চানদের সঙ্গেও আছে। ইউপি আর তামিলনাড়ুর মধ্যেও আছে। তাতে কি? ওরা কোন মঙ্গলগ্রহের জীব না যে কাছে গেলে কামড়ে দেবে। সর্দারদের মত পাগড়ি গোটা দেশে কোন হিন্দু পরে? বা দক্ষিণের ব্রাহ্মণদের মত মাথার আদ্দেকটা কামায় কে’?
সেসব অনেক আগের কথা? কত আগের? মাত্র দু’ বছর; কিন্তু মনে হয় কতযুগ আগে। এর মধ্যে কত বড় বড় ঝড় বয়ে গেছে। সব আমার জন্যে।
সব আমারই জন্যে? নাকি আফতাবের জন্যেও? অন্ততঃ খানিকটা দায় ওরও বইকি! মোদহাপাড়ার ওই বদমাসগুলোর হাত থেকে ও কেন আমাকে বাঁচাতে গেছল? হ্যাঁ, মনে পড়ছে, সেটাই তো শুরু।
কিন্তু বাবাকে এসব বোঝাতে পারিনি। কারণ কোন একটা কারণ তো নয় যে ফট করে বলে দেব? কেন পাঠানদের সবকিছু না-পসন্দ হলেও আমি সব বিরক্তি ঘেন্না ভুলে গিয়ে আফতাব নামের একটা স্টে দোকান ও এসটিডি বুথ চালানো ছেলের সঙ্গে অকুলে ভাসলাম, যে ছেলেটা কিনা মাধ্যমিকের আগে আর পড়েনি? আর সবকিছু কি আমিই ছাই বুঝেছি? এখন একটা বরফের চাঙড়ের ওপর শুয়ে সব পুরনো সিনেমার মত রিওয়াইন্ড করে স্লো-মোশনে চালিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি।
রায়পুর শহরের দুর্গা কলেজে ইংরেজিতে মাস্টার্স করব বলে ভর্তি হয়েছি। প্রাইভেট কলেজ হলে কী হবে ওদের ইংরেজি বিভাগের খুব নামডাক গোটা ছত্তিশগড়ে। ক্লাস আরম্ভ হয় সকাল সাড়ে সাতটা থেকে। আমাকে ভিলাইনগর স্টেশন থেকে লোক্যাল ট্রেন ধরতে হয় সকাল ছ’টায়। দুটো কোচ ভরে আমরা একগাদা ছেলেমেয়ে। হো-হো-হি-হি আর এর তার পেছনে লাগা-- একটি ঘন্টা কখন পেরিয়ে যায়।
তারপর স্টেশন থেকে দলবেঁধে হেঁটে কলেজ পৌঁছুতে মেরেকেটে পনের মিনিট। কিন্তু সেদিন ঘুম ভাঙতে দেরি হওয়ায় চোখের সামনে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল। বন্ধুরা জানলা দিয়ে চেঁচাল—বাসে করে চলে আয়।
বাসে করে আসতে গিয়ে একঘন্টা আরও বেশি লাগল। আমার এই প্রথমবার বাসে করে কলেজে আসা। কলেজ হল মোদহাপাড়ায়- মুসলমানদের বস্তি, একটা মসজিদের মিনার চোখে পড়ে। কিন্তু বাস স্ট্যান্ড আরেক মাথায়। এদিক দিয়ে কখনও কলেজে যাইনি। জিজ্ঞেস করে জানলাম জয়স্তম্ভ চৌক থেকে কেকে রোড ধরে সোজা পনের মিনিটি হাঁটলেই কলেজ । ঘড়ি দেখলাম, ফার্স্ট পিরিয়ড মিস হবে। তাহোক গে’। বাকিগুলো অ্যাটেন্ড করে নেব। এছাড়া রঙ্গনা স্যারের এক্সট্রা ক্লাস আছে।
আজকে উনি এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’ পড়াবেন। আমার প্রিয় নাটক। রাজার অনুগ্রহে ক্যান্টারবেরির বিশপ হওয়া বন্ধুর বশংবদ হতে অস্বীকার করা। নিজের কর্তব্যবোধে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া। দেখি, আজ উনি কোন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে চমকে দেন কিনা। রঙ্গনা স্যার চান আমরা যেন নোটস মুখস্থ না করি, নিজের মত করে ভাবতে শিখি, প্রশ্ন করি।
‘ও ম্যাডাম, ম্যাডামজী! জলদি আইয়ে। ইধার দেখিয়ে , ইধার’!
আমাকে কেউ ডাকছে? এখানে কেউ আমাকে কেন ডাকবে? সতর্ক হওয়ার চেয়ে অবাক হই বেশি। বাঁদিকে সারি সারি দোকান ঘর, সাত সকালে একটাও খোলেনি। ডানদিকে রাস্তার পাশে একটা খালি প্লট, সেখানে উবু হয়ে ক’টা লোক কিছু একটা করছে--যেন রোদ পোহাচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকেই ময়লা পাজামা পরা একটা লোক আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। একটু ভয় ভয় করছে কি? নাঃ, সকাল আটটায় রোদে ঝলমল রাজধানীর রাস্তাঘাট। একটা অচেনা লোক ডাকছে তো কী হয়েছে?
আমি থমকে দাঁড়াতে লোকটা এসে কাকুতি মিনতি করতে থাকে—চলুন না ম্যাডামজি।ওরা ক’জন মিলে আমার ভাইকে লুটে নিচ্ছে। সেরেফ হাতের সাফাই! আপনি পড়িলিখি মহিলা। আপনি ব্যাপারটা বুঝে ওদের আটকাতে পারবেন। প্লীজ, চলুন।
কৌতুহল অ্যালার্ম বেলের সংকেতকে চাপা দিল। কিছু না ভেবে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেছি ওই মাঠের কোনায় লোকগুলোর কাছে। মাটির ওপর ময়লা গামছা বিছিয়ে একটা লোক তিনটে তাস বিছিয়েছে। তারপর কীসব বলে চটপট ওই তিনটেকে ডানদিক থেকে বাঁদিক আর বাঁদিক থেকে ডানদিকের মধ্যে তিনবার শাফল করে উলটে রাখল। একজন একটা তাসে হাত রাখল, লোকটা গম্ভীর মুখে সেই তাসটা উলটে দিতেই অন্য লোকটা আনন্দের চোটে একেবারে তো-তো-তো-তো করে উঠল। আর তাসওলা ওকে ব্যাজার মুখে দশটা টাকা দিল।
আবার একজন তাসের প্যাকেট তুলে নিয়ে গামছাওলার থেকে আড়াল করে একটা তাসের কোণা একটু মুড়ে আবার ওকে ফেরত দিল। আমরা দেখলাম ইস্কাপনের গোলাম। এবার গামছাওলা ফের শাফল করে তিনটে তাস উলটো করে রাখল। তারপর প্রথম লোকটার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। ও ভাবছে কোনটাতে হাত রাখবে।
আরে কী বোকা! ও কী দেখতে পাচ্ছে না যে মাঝখানের তাসটারই কোণাটা সামান্য মোড়া, ওটাই তো ওর তাস। আমি উত্তেজনা চেপে রাখতে পারিনা। মুখ ফসকে অস্ফুট আওয়াজ আর ইশারা করে ফেলি। সংগে সংগে এতক্ষণ একটাও কথা না বলা গামছাওলা আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে—এইসা নহী ম্যাডামজি! পহলে পয়সা লাগাইয়ে, ফির বোলিয়ে।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বলি—আমি এসব খেলব না। আর আমার কাছে কোন পয়সা নেই।
তিনজন কলকলিয়ে ওঠে। ইস্কাপনের গোলাম ব্যাটাও বলে-আপ বরবাদ কর দিয়ে। ইশারা কর দিয়ে। অব ম্যায় জিৎ ভী যাউঙ্গা তো একোপয়সা নেহি মিলেগা। কারণ আপনি না খেলে বাইরে থেকে ইশারা করে আমাকে হেল্প করেছেন। এটা ফাউল।
আমাকে এখানে টেনে আনা ময়লা পাজামার গলায় অনুনয়ের সুর।
--বহেনজি, এই আমার ভাইয়া। এরা একে বেশ কয়েকবার হাতসাফাই দেখিয়ে ঠকিয়েছে।তাই আপনাকে বলেছিলাম সাহায্য করতে। এবার ভাইয়া ওদের চালাকি ধরে ফেলে জিতে যেত। কিন্তু আপনি খামোখা খেল কাচ্চি করে দিলেন। অন্ততঃ দশটা টাকা লাগান, ভাইয়া জিতলে টাকা ফেরত পাবেন।
হ্যাঁ, আমার পার্সে কলেজের ফীস পঞ্চান্ন টাকা ছিল। ফীস না হয় কালকে দেব, এখন দশটা টাকা দিয়ে এদের হাত থেকে ছাড়ান পাই আগে!
পার্স খুলে রবার ব্যান্ডে আটকানো দশটাকার ছ’টা নোট থেকে একটা বের করতে যাচ্ছি কি ওই ছোটভাই আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে গোটা বান্ডিলটা নিয়ে একটা দশটাকার নোট নিয়ে তাসগুলোর পাশে রাখে। গামছাওলা আরেকবার তাসগুলোর উপর ম্যাজিশিয়ানের কায়দায় হাত চালায়।
বড়ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করে- কোনটা? আমি ফুল কনফিডেন্সে আঙুল দেখাই কোনামোড়া তাসটার দিকে—ওটা এখন জায়গা বদলে ডানদিকে। কিন্তু আমি ড্যাম সিওর, তিনটের মধ্যে কোণার দিকে একটু মুড়ে যাওয়া তাস একটাই।
গামছাওলা তাসটা উলটে দেয়।
একী! আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। এটা তো হরতনের বিবি। কী করে হল?
লোকটা ভাবলেশহীন মুখে টাকাটা ট্যাঁকে পোরে।আবার তাস সাফল করে। বড়ভাই আবার একটা তাসের কোণা দাঁত দিয়ে কামড়ে মিলিয়ে দেয়। রুইতনের নওলা।
আমি কিছু বলার আগে ছোট ভাই আরও দশটাকা ‘ম্যাডামজিকে তরফ সে’ বলে তাতে লাগায়। আমি বাধা দেয়ার সুযোগ পাইনে। মনের মধ্যে একটু লোভও ছিল কি? যদি চান্স লেগে যায়? যদি কপালজোরে জিতে আগের টাকাগুলো ফেরত পাই।
ঝড়ের বেগে খেলা এগিয়ে চলে। প্রত্যেকবার কেউ না কেউ দাঁও লাগায় এবং সবাই হারে। গামছাওলা টাকা পয়সা গুছিয়ে মুখের ঘাম মুছে উঠে পড়ে। জটলা ভাঙে।
আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি। ছোটভাইকে বলি আমার বাকি টাকা ফেরত দাও। সে বলে-কিসের টাকা? সব তো আপনি হেরে বসে আছেন।
আমার মাথায় বাজ। কলেজের ফীস! আমি চেঁচাই—একবার খেলেছিলেম, আচ্ছা বেশি হলে দু’বার। কিন্তু বাকি চল্লিশটাকা।
বাকিরা দলবেঁধে আমাকে ঘিরে ধরে –জুয়োয় হেরে গলাবাজি? লজ্জা করে না?
--জুয়ো খেলেছি? আমি? একদম ফালতু কথা বলবে না। থানায় যাবো।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, যান যান। গিয়ে বলুন, আমি কলেজে পড়া ভদ্রঘরের মেয়ে, রাস্তার ধারে আওয়ারা ছোকরাদের সঙ্গে জুয়ো খেলে হেরেছি, দেখুন কী হয়!
আতংকে আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হয়না। কিন্তু হঠাৎ প্রাণপণে ফাটা বাঁশের আওয়াজে চিৎকার করে উঠি।
--হেল্প! প্লীজ হেল্প! মুঝে ইনলোগোঁ নে লুঠ লিয়া হ্যায়। কোই হ্যায় ? মুঝে বাঁচাইয়ে।
চারদিকে লোকজন নেই। দু’একটা সাইকেল ও মোটরবাইক নিজের খেয়ালে চলে যাচ্ছে। পান-সিগ্রেটের ঠেলাগুলোও বন্ধ।
আমি কেঁদে ফেলি। ওরা হাসে, কিন্তু একটু দূরে সরে যায়। এবার আমার গলা থেকে একটা জান্তব চিৎকার বেরিয়ে আসে। ওরা হকচকিয়ে যায়, তারপর আমাকে ভাঙায়।
একটা মোটরবাইক ইউ-টার্ন নিচ্ছে। ওদের ভুরু কুঁচকে ওঠে। বাইকটা রাস্তা ছেড়ে সোজা মাঠের মাঝখানে চলে আসে। ছেলেটি হেলমেট খুলে আমাকে জিজ্ঞেস করে- কী হয়েছে?
আমি ফোঁপাতে থাকি। বলি-এরা জোট বেঁধে আমার সব পয়সাকড়ি ঠকিয়ে নিয়েছে, ফেরত দিচ্ছে না। ওরা প্রতিবাদ করে—মেয়েটি নিজের ইচ্ছেয় এসে জুয়ো খেলছিল।
আমি বলি-আমার কলেজের ফীস!
ছেলেটা বড়ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
--তুই ইয়াসিন না? মোদহাপাড়া থানায় এর আগেও তোর নামে শিকায়ত হয়েছে কয়েকবার। একবার তো আমার আব্বাজান গিয়ে তোকে ছাড়িয়ে আনে। টাকা ফেরত দিয়ে দে!
এই কথায় যেন সাপের মাথায় জল পড়ল। ওরা নীচুগলায় বলে -আপ উকিল সাহাবকে বেটে? আফতাব ভাইয়া?
--হাঁ, ম্যায় আফতাব হুঁ। অব তো রূপিয়া লৌটা দো! নইলে আমিই থানায় গিয়ে ডায়েরি লেখাব। আব্বা আর তোকে ছাড়াতে আসবে না।
ওরা বিড়বিড় করে, মাফি চায়। তারপর ছ’টা নোট ফিরিয়ে দেয়।
আফতাব বলে-দুর্গা কলেজে পড়েন? কোন ইয়ার? আমার বোনও পড়ে। কুলসুম, বি’কম ফাইনাল। আমার পেছনে বসুন, কলেজের গেটে ছেড়ে দেব।
আচ্ছা, এই শিভ্যালরাস নাইটের নাম আফতাব? পরে জানলাম ওর একটা স্টেশনারি দোকান আছে। পাড়ার ইউনাইটেড ক্লাবের উইকেটকীপার।
তারপর ছ’টা মাস একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছল।
ধীরে ধীরে কুলসুম, আমি ও আফতাব ভাইজান একসঙ্গে কয়েকবার রাজমহল টকীজে দুপুরের শো’তে পুরনো সাদা কালো সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। রাজকাপুর-নার্গিস, দেবানন্দ-সুরাইয়া, দেবানন্দ-ওয়াহিদা। সিনেমার পরে চটপট রায়পুর স্টেশনের লোক্যাল ট্রেন ধরে সোজা ভিলাইনগর, ৪৫ মিনিট। বাবাকে বললাম—এক্সট্রা টিউটোরিয়াল ক্লাস চলছে।
কখন কুলসুম সরে গেল, শুধু আমি আর আফতাব।
একটা সময়ের পরে কলেজে কেউ কেউ দেখে ফেলল, কেউ কেউ জেনে গেল। জিভ চুলকোতে লাগল। সবচেয়ে বেশি চুলকুনি দেখলাম যার তার নাম ফরজান আহমেদ, ওদের সদর বাজারে চালের বিজনেস। শীতের সকালে একদিন অফ পিরিয়ডে কমনরুমের বাইরে রোদ্দুরে দাঁড়িয়েছিলাম, আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বলল – শোন, আজ আমার সঙ্গে প্রভাত টকিজে যাবি? ভয় পাস না। আফতাব ভাই জানতেও পারবে না।
আমি অবাক। মানে?
--আরে ও আমার বেরাদর। তুই তো হিন্দু, ওকে বিয়ে করবি না, খালি ঘোরাচ্ছিস। ভিলাইয়ে তোর বাবা কোলকাতা থেকে শাঁসালো বর ধরে আনবেন। তুইও ভাজামাছটি উলটে খেতে জানিস না মুখ করে সাত পাক ঘুরে নিবি। তা দু’দিন যদি ফুর্তিই করতে হয় তো শুধু আফতাব কেন, আমিও লাইনে আছি। একবার চান্স দিয়ে দেখ।
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছল। চড়টা বেশ জোরে মেরে ছিলাম। আর বলেছিলাম- তমিজ সে বাত করোঁ। ম্যায় কোই খিলোনা নহীঁ হুঁ।
আরও অনেক ছেলেমেয়ে কাছাকাছি রোদ্দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। সবাই জানতে চাইল কী হয়েছে।
আমি কোন উত্তর দিইনি।
কিন্তু দু’দিন পরে কুলসুম আমাকে বলল –তুই আর আমার ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করবি না, কথা বলবি না।
কালকে কিছু ছেলে এসে আমাদের বাড়িতে আমার আব্বা উকিল ইফতিকার আলি আর ভাইয়াকে শাসিয়ে গেছে—এইসব লাভ জিহাদ ধান্ধা বরদাস্ত করা হবে না। আর একবার যদি ভাইয়া তোর সাথে কথা বলে কি কোথাও যায় তাহলে--!
পরে জেনেছি ওদের কাছে চুকলি করেছে ফরজান, বলেছে ভাইয়া নাকি তোকে নিয়ে পালাবে। তোকে কলমা পড়িয়ে ইসলাম মতে শাদি করবে। যত মিথ্যে কথা! কিন্তু ওরা আমার আব্বার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছে --! আমার ভয় করছে। তুই আর –।
আমার মাথা ঘুরে গেল। না, ভয় পাইনি। হিন্দু জাগৃতি সমিতি আমার কী করবে? কিন্তু কলেজ ছুটির পর ভিলাই ফিরে দেখি সবাই খুব গম্ভীর।
কী হয়েছে?
ভেতরের ঘরে আয়। বাবা বেশ গম্ভীর।
--হ্যাঁরে , মামণি তুই নাকি মুসলমান হয়ে গেছিস?
-কে বলল?
বাবা আমার উকিল ছোটকার দিকে তাকালেন।
--কে আবার বলবে, সবাই জেনে গেছে। আজকে রায়পুরে একটা কেসে আর্গুমেন্টে গেছলাম। বার লাইব্রেরিতে সবাই বলাবলি করছিল যে রায়পুরেও লাভ জিহাদ শুরু হয়ে গেল! আমি বললাম-এসব ফালতু কথা। বিয়ে টিয়ে ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে যার সঙ্গে ইচ্ছে ঘর বাঁধবে তাতে কার কী? আইনের চোখে মাইনর বা কোন জোর জবরদস্তি বা চিটিং না হলেই হোল।
ওরা বলল আপনি কিস্যু জানেন না। কো-এড কলেজ মুসলমান পাড়ায় হয়ে ভুল হয়েছে। ওখানকার একটা ভিলাই থেকে পড়তে আসা মেয়েকে ইফতিকার উকিলের ছেলে আফতাব ফুসলিয়েছে-- নিকা করবে। মেয়েটার নাম লিলি মজুমদার।
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছল। ইফতিকার উকিল ভাল ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। ওকে গিয়ে বললাম—ভাইজান, এসব কি হচ্ছে? আমরা দু’জনেই উকিল আর আপনার ছেলে আফতাব আমাদের ঘরে সিঁধ কাটছে! আপনি কিছু জানেন না বলতে চান?
ইফতিকারের মুখ লাল হয়ে উঠল। ও কসম খেয়ে বলল যে সত্যিই কিছু জানে না। এটাও বলল যে ও বাড়ি গিয়ে নিজের ছেলেকে ভাল করে কড়কে দেবে। কিন্তু আমিও যেন ভাইঝিকে সামলে রাখি। কারণ এক হাতে তালি বাজে না।
বাবা--এবার তুই সত্যি কথা বল। মুসলমান হয়েছিস?
--না তো; এসব কী বলছ?
ঠাস করে একটা চড় পড়ল আমার গালে।
- ফের মিথ্যে কথা! ওই উকিলের ছেলের সঙ্গে পালাবার ছক কষছিস?
আমার মাথা ঘুরে গেল। এর আগে বাবা কোনদিন আমার গায়ে হাত তোলেনি।
কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম—হ্যাঁ, ছক কষছি, পালাবো। আফতাব ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। তার জন্য যদি মুসলমান হতে হয় হব।
আমার জিদের কথা বাড়ির সবাই জানে, একটা কিছু মাথায় ঢুকলে হয় ।
--এতদূর? দেখলে বড়দা, এই মেয়ে আমাদের বংশের মুখে কালি দেবে। কোন দেড়েল মুসলমান উকিল তোমার বেয়াই হবে। আমরা এখানে হিন্দু সমাজে একঘরে হয়ে যাব। আমার মেয়েদের আর বাঙালির ঘরে বিয়ে হবে না।
নাঃ, পালাই নি। মুসলমানও হইনি। সুযোগই পেলাম না। আফতাব গ্রেফতার হয়ে জেলে গেল যে!
আমার জিদ থেকে ভয় পেয়ে উকিল ছোটকা রায়পুরে এফ আই আর করায় ‘লাভ জিহাদ” ও ধর্মান্তরণের চার্জে আফতাব ও তার উকিল আব্বাকে জেলে পুরে দিল। আব্বা দু’দিন পরে জামিন পেলেন। আফতাব পেল না।
এবার আমার জিদ। বদলা নেব ছোটকার ওপর, বদলা নেব আমার ভালমানুষ বাবার উপর, আর হ্যাঁ, আমার নিজের উপরও।
আমার সবচেয়ে সুন্দর সালোয়ার কুর্তা পরলাম, কালো টিপ লাগালাম। তারপর সবাই যখন নীচের ঘরে খেতে বসেছে আমি খাটের উপর দাঁড়িয়ে ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস বানিয়ে পাখার থেকে ঝুলে পড়লাম।
কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। চোখ খুলে দেখলাম একটা বরফের চাঙড়ের উপর শুয়ে আছি, কিন্তু শীত করছে না একটুও।
পাশের ঘরে মেয়েরা প্রার্থনার মত কিছু একটা গাইছে, আরে এ ত’ বাংলা ভাষা। এবার কথাগুলো স্পষ্ট হচ্ছেঃ
“বিদুষী মৈত্রেয়ী খনা লীলাবতী, সতী সাবিত্রী সীতা অরুন্ধতী,
বহু বীরবালা বীরেন্দ্র প্রসূতি আমরা তাদেরই সন্ততি।
অনলে দহিয়া রাখে যারা মান, পতিপুত্র তরে সুখে ত্যাজে প্রাণ,
আমরা তাদেরই সন্ততি”।।
দিনটা ছিল রবিবার। আমি ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২এর কথা বলছি। আগে থেকেই টেনশন চলছিল। কথা দিয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কথা দিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, বলেছিলেন যে সিকিউরিটির কড়া বন্দোবস্ত করবেন। সুপ্রীম কোর্ট একজন অবজার্ভার পাঠিয়েধিল। কিন্তু দুপুরে যখন একদল লোক হাতুড়ি শাবল গাঁইতি নিয়ে গম্বুজের উপর চড়ে ভাঙতে শুরু করল তখন তিনি দুপুরবেলা গভর্নমেন্ট গেস্ট হাউসে ঘুমুচ্ছিলেন।
আমার বয়েস তখন মাত্র সাত ’বছর। এসব কিছুই জানতাম না, বড় হয়ে ভাইয়ার থেকে শুনেছি।
বেলা বোধহয় তিনটে। আমি পাশের বাড়ির মনীষার সঙ্গে ওদের ঘরে বসে পুতুলের চুল খুলে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে ফের বিনুনি করে দিতে ব্যস্ত।
ওর দাদা সুজিত তখন ক্লাস এইটে পড়ে। এক বন্ধু এসে ডাক দেওয়ায় বেরিয়ে যাবার মুখে মাসিমাকে বলল—মা, একটু আসছি। দরজাটা লাগিয়ে দাও।
আধঘন্টাও হয়নি, সুজিতদা ফিরে এল। ওর সঙ্গে পাড়ারই আরও কয়েকটা ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এসে ঘরে ঢুকল। ওদের মুখ উত্তেজনায় লাল।
--বাবা, শীগগির টিভি খোল। বাবরি মসজিদ ভেঙে গেছে।
মেশোমশায় ছুটির দিনে মাংসভাত খেয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। কাঁচা ঘুম ভেঙে বিরক্ত মুখে জানতে চাইলেন কী হয়েছে? কার কী ভেঙেছে?
--আরে বাবরি মসজিদ ভেঙে গেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে টিভি খুলে দেখ।
এসব বলে ও নিজেই টিভি অন করল।
না, দূরদর্শন তখনও দেখাচ্ছে যে কড়া পুলিশ প্রহরা। বাবরি মসজিদ অক্ষত, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন সুপ্রীম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী কাজ হবে।
তবে ক্যামেরা প্যান করে দেখাল কাছেই একটা মঞ্চ। তাতে বড় বড় সব নেতারা একের পর এক বলছেন মোঘল সাম্রাজ্যের অত্যাচারের শেষ চিহ্নটিকে মুছে ফেলার ঐতিহাসিক ক্ষণ আগত, মাভৈঃ।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোন মসজিদ, কেন কেউ ভাঙবে, ঝগড়াটা কিসের?
এদিকে মেশোমশায় আর সুজিতদার মধ্যে লেগে গেছে। খামোখা হুজুগ! কেন ঘুম ভাঙানো হল? ওসব ফালতু উত্তেজনা ছড়ানো, --এসবের কোন মানে নেই।
কিন্তু সুজিতদার সঙ্গের ছেলেটি টেবিলের উপর থেকে ট্রানজিস্টর তুলে নিয়ে বিবিসি অন করেছে। ইংরেজিতে কীসব ক্যাও ম্যাও হচ্ছে। মেসোমশায়ের চোখ বড় বড়। এমন সময় মোড়ের ছোট্ট শিবমন্দিরের দিক থেকে চড়চড় পটপট পটকা ফাটার আওয়াজ। যেন দীপাবলীর রাতে ধানীপটকার হাজার লড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
শিবমন্দিরের দিক থেকে একটা গর্জন ক্রমশঃ এদিকে এগিয়ে আসছে—হর হর মহাদেব! জয় বজরঙ্গবলী কী—
সুজিতদা ও তার সঙ্গী কোরাসে চেঁচিয়ে উঠল—জয়!
আমি চমকে উঠলাম।
মেসোমশায় আমার দিকে দেখলেন। তারপর ধমকে উঠলেন—বেরো! সবক’টা বেরো! যা, রাস্তায় গিয়ে চিৎকার কর।
মাসীমা এসে দাঁড়িয়েছেন। মেসোমশায় বললেন—নগমাকে ভেতরে নিয়ে যাও। আর দরজাটা বন্ধ করে দাও।
কিন্তু দরজা বন্ধ করার আগে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে সালেহা দিদি এসে বলল—নগমাকে ওর আব্বাজান ডাকছে।
আমি ওর হাত ধরে ঘরে ফিরে চললাম। সালেহা দিদির হাত কাঁপছে। আমি অবাক হয়ে মুখ তুলতেই দেখি ও ওড়নার পল্লু দিয়ে চোখের জল মুছছে। কী হয়েছে দিদি? ও মাথা নাড়ল, কিছু না।
মোড়ের মাথায় অনেক লোকের ভীড়। আবির উড়ছে, লালা আর সবুজ আবির। এ ওর মুখে মিঠাই গুঁজে দিচ্ছে—লাড্ডু ও গুজিয়া।
বাড়িতে ঢুকতেই মা আমাকে প্রায় ছোঁ মেরে ভেতরে নিয়ে গেল। ঘরের ভেতরে মেয়েদের ভীড়, সবাই কাঁদছে। সেই দেখে আমারও কান্না পেয়ে গেল।
সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে রান্না হয়নি। একসময় দাদি এসে আমার মুখে কিছু গুঁজে দিল।
আমি উঁকি মেরে দেখলাম বাইরের ঘরে অনেকগুলো লোক। কিছু অল্পবয়েসি এপাড়ার মুখচেনা। ওরা বাবাকে বলছে— মৌলবী সাহেব, এবার আমরা কী করব? চুপ করে আছেন কেন? কিছু বলুন।
বাবা বললেন—আমরা দোয়া দুরুস্ত পড়ে আল্লাতালাহ্ কে ডাকব।
“আমি তোমাদের খুবই নিকটে, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো’ (সুরা ২ অল বাকারাঃ ১৮৬, সুরা ১১ হুদঃ ৬১) ।
কিন্তু সাবধান!
“আমরা যেন আল্লাতালাকে পেতে কিংবা তাঁর নিকট কিছু প্রার্থনা করার সময় মূর্খতা ধর্মান্ধতার ঈমানহারা চোরা গলিপথে না যাই’ (সুরা ২, অল বাকারাঃ ১০৭, ২৫৭)।
মাসখানেক আমাকে মনীষাদের বাড়ি খেলতে যেতে দেওয়া হল না।
তারপর ধীরে ধীরে সব আগের মত হয়ে গেল। ঠিক আগের মত হল কি? তখন অতশত বুঝিনি।
আমি ওর সঙ্গে হোলির দিন রঙ খেলে ভুত হয়ে বাড়ি ফিরতাম। ওরা আসত রমজান মাসের শেষে রোজা ভাঙার পরের ঈদের দিনে ফিরনি, সেমাই খেতে। অর্থাৎ ঈদ-উল-ফিতর বা উপোস ভাঙার আনন্দ। এখানে ওরা মানে মনীষা ও সুজিতদা।
আবার ঈদুজ্জোহা বা ত্যাগের উৎসবে বিরিয়ানি খেতে। ওদের মুখে একটা হল সেমাই ঈদ, অন্যটি বকরা ঈদ। আমি হাসতাম।
সালটা বোধহয় ২০০২। শীত যাই যাই করছে। সন্ধ্যেয় এতোল বেতোল হাওয়া। আমি তখন আর বাচ্চা নই, অষ্টাদশী। সামনে উচ্চ মাধ্যমিক। মন দিয়ে পড়ছি। সন্ধ্যের দিকে সুজিতদা এল। বিলাসপুরের কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে নাগপুরে যাচ্ছে এম বি এ করতে।
বাইরের ঘরে বাবা-মা’র সঙ্গে গল্প করছে। আমার কান খাড়া, ওর গলার আওয়াজ, ওর হাসি। আমার থ্রি ডি জিওমেট্রির অংক ভুল হয়ে যাচ্ছে।
--কী রে, তোর ম্যাথস কেমন চলছে? এটাতেই স্কোর করতে হবে, বুঝেছিস ? তিনদিন আছি, কোন প্রবলেম হলে বলবি, দেখিয়ে দেব।
--ইস্ তোমাকে আর দেখাতে হবে না। চশমা চোখে শেয়াল পণ্ডিত! আমি ব্যানার্জি স্যারের কোচিং যাই।
--আমি না হয় চশমা নিয়ে শেয়াল পণ্ডিত হয়েছি, আর তুই নিজে? বলব?
আগে ছিলি রোগাপটকা ২ ডি, এবার হয়েছিস থ্রি -ডি জিওমেট্রি। স্ফিয়ার, ইলিপ্সয়েড –এই আর কি!
আমি রাগে চেয়ারে বসেই হাত চালাই। কিন্তু সুজিতদা কায়দা করে ধরে ফেলে। তারপর গালে একটা ঠোনা মেরে চলে যেতে যেতে বলে- কাল বিকেল পাঁচটায়, অরপা নদীর তিন নম্বর পুল।
কিন্তু পরের দিন আর ঘর থেকে বেরোতে পারি নি।
সকালের খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইন। গুজরাতের গোধরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা সাবরমতী এক্সপ্রেসের একটি কোচে কারা যেন পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। পুড়ে মরেছে ষাটের উপর হিন্দু করসেবক। বাতাসে পোড়া গন্ধ যেন এখান থেকে টের পাচ্ছি। চার দিকে আওয়াজ শুনছি –বদলা চাই।
বদলার আগুনে পুড়ছে মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আগুনে আহুতি দেওয়া হচ্ছে মেয়ে শিশু। একজন বয়স্ক লোক বলছেন—রাজধর্ম পালন করতে হবে। কেউ শুনছে না।
আবার আমাদের বাড়িতে ভীড়। মৌলবী সাহেব, এবার কী করব?
বাবা বলতে চাইলেন দোয়া -দুরুস্ত প্রার্থনার কথা। মুখ দিয়ে শব্দ বেরোল না। নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন—আমি জানি না। আল্লাহ্ রসুল, আমায় পথ দেখাও।
একজন গম্ভীর গলায় বলল, “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয়” ( সুরাঃ অল বাকারা, আয়াত ১৯৩)।
সবাই অবাক। আমি দেখছি -- আমার দাদা জামিল ভাই। ওর উপর কোন কিছুর ভর হয়েছে। একনাগাড়ে বলে চলল—ইসলাম শান্তির বাণী। কোন নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষকে মারা নিষিদ্ধ। কিন্তু জিহাদ মানে ন্যায়যুদ্ধ। রসুল আল্লাহ্ ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ করেছেন। মুসলমানদের নারী-শিশু ও ধনসম্পদ রক্ষার জন্য প্রতিরোধ বা যুদ্ধ জায়েজ।
একসপ্তাহের মধ্যে বাবার জায়গায় বড়ে ভাইয়া নতুন মৌলবী নিযুক্ত হলেন। বাবা ঘরে বসে তসবী জপতেন আর বিড়বিড় করতেন।
সালটা ২০০৯।
আমি এখন একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার, সকালের শিফটে। ছাব্বিশ বছরের ধিঙ্গি মেয়ে। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে শাদীর জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি বলছি আগে বড়ে ভাইয়ার হোক। আমি গার্লস কলেজে দুপুরের শিফটে বি এড কোর্সে ভর্তি হয়েছি।
কিন্তু বিকেলে সুজিতদার সঙ্গে দেখা করি। ওর চাকরি চলে গেছে। তাই কিছুদিনের জন্যে বিলাসপুরে ফিরে এসেছে। এম বি এ করেছিল, আজ নয় কাল কিছু পেয়ে যাবে। তবে এভাবে একবছর হয়ে গেল।
বাজার নাকি খুব খারাপ, রিসেশন না কী যেন! বাজার একটু চড়লেই ও ভাল চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার বগলে পুরে কাট মারবে অনেক দূরে।
আজকাল আমাদের দেখা করা বেশ নিয়মিত হয়ে গেছে। ও একটা মোটরবাইকে চড়ে আসে। আমি পেছনে বসি আর আমরা চলে যাই শহরের বাইরে সকরি গাঁয়ের কাছে, অরপা নদীর পাড়ে।
ফিরতে দেরি হয়, তবে সন্ধ্যের অন্ধকারের আগেই ফিরি।
আব্বা জিজ্ঞেস করায় বললাম –লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করি। আমাদের কলেজের লাইব্রেরি বেশ বড়, ইউজিসি গ্রান্ট পাওয়া। আব্বা আমাকে খুব বিশ্বাস করত।খুব খারাপ লেগেছিল আব্বাকে মিথ্যেটা বলতে।
একটা সময়ে বুঝতে পারলাম সুজিতদাকে নইলে আমার চলবে না। ওকে আমার চাই। কথাটা খুলে বললাম ওকে। ও গম্ভীর হয়ে গেল।
একটু পরে বলল যে এটা অসম্ভব। ওর ধর্ম নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই, কিন্তু একমাত্র ছেলেবৌ মুসলমান ঘরের হবে, গোস্ত খাবে—সেটা আমার পুজো-আচ্চা করা বাবা মানতে পারবেন না।
তোমার বড়ে ভাইয়া যদি হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে তাহলে কী হবে ভেবেছ? ছেলেবৌ কাফির হবে এটা তোমার মৌলবী আব্বা মানতে পারবেন কি?
সত্যি কথা। আমাদের সমাজে খুব নিন্দে হবে, বদনাম হবে। এমনকি আমার আব্বার মসজিদে ধর্মগুরুর পদ খোয়ানো, অঞ্জুমান পাঠশালার কমিটি ও মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া -সবই হতে পারে।
-- হতে পারে, ওরা যদি এই শহর ছেড়ে চলে যায়। মানে ওরা দু’জন, ভাইয়া আর ভাবী। তবে এত চিন্তা কর না। ভাইয়া এখন বদলে গেছে। এখন ও পুরো দস্তুর মৌলবী।
--আচ্ছা! আগে তো গার্লস কলেজের কাছে বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করত!
--ধ্যাৎ, বাজে কথা বলবে না। ভাইয়া কোন দিন কোন হিন্দু মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় নি।
এটা শোনঃ “ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যে দৃষ্টি নত করা আবশ্যক,। অর্থাৎ বেগানা মেয়েদের প্রতি ইচ্ছাকৃত দৃষ্টিপাত পুরুষদের জন্যে হারাম”।(আহসানুল ফতোয়া ৫, পৃঃ ১৯৯)।
সুজিত মিটিমিটি হাসে। বলে আরো একটা রাস্তা আছে।
--সেটা কী?
-কেন, তোমার হিন্দু ঘর থেকে আসা বৌদি যদি ধর্ম পালটে মুসলমান হয়ে যায়। তোমার বাবা মৌলবী সাহেবই যদি ওকে কলমা পড়িয়ে দেন?
আমার খুব রাগ হয়।
আমার বাবার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? আর বিয়ে করতে হলে ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে কেন?
ওসব আমি মানি না। আমি তোমাদের ঘরে বৌ হয়ে গেলে কি হিন্দু হয়ে পুজো আচ্চা করব? কখখনও নয়। আমি যা বিশ্বাস করি তাই থাকব। তোমার আস্থা হিন্দুধর্মে, তুমি হিন্দু থাকবে।
--আচ্ছা, আমি যদি মুসলমান হয়ে যাই?
--কেন, আমাকে বিয়ে করতে? যেমন কিছু ফিল্মি দুনিয়ার লোক করে? কোন দরকার নেই ঢং করার। আমরা সেলিব্রিটি নই। নেহাত সাধারণ মানুষ, আমাদের ওসব মানায় না।
--না ধর, যদি নিজের মন থেকে?
--ধেৎ, কোন হিন্দু মতলব ছাড়া মন থেকে মুসলমান হয়? শুনি নি তো!
--দুটো হাতে গরম উদাহরণ দিচ্ছি। হিন্দু বাবামা’র সন্তান এ এস দিলীপকুমার ২৩ বয়েসে স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়ে নাম নিলেন আল্লারাখা রেহমান। যাঁকে আজ আমরা মিউজিক কম্পোজার এ আর রেহমান নামে চিনি।
--আরেকজন?
--কেরলের নামজাদা কবি কমলা দাস। যাঁর ইংরেজি কবিতা আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠ্য ছিল।
--সে কী? উনি মুসলমান হয়েছেন?
--উনি ৬৫ বছর বয়েসে মুসলমান হয়ে কমলা সুরাইয়া হলেন। প্রথম জীবনে মেয়েদের যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে খোলাখুলি লিখে নাম -বদনাম দুটোই হয়েছিল। শেষে বুড়ো বয়েসে হিজাব পরলেন, ভাবা যায় ?
--আর গুলজার? উনিও নাকি আগে হিন্দু ছিলেন? নাম ছিল সপূরণ সিং, পরে গুলজার হয়েছেন?
--বাজে কথা। উনি আগেও পঞ্জাবী হিন্দু ছিলেন, এখনও তাই। গুলজার ওনার কবিতা লেখার পেননেম। ওসব ছাড়; কাজের কথা বল। ধর যদি আমি নিজের থেকে কলমা পড়ে মুসলমান হই, তাহলে তোমার মৌলবী আব্বা মেনে নেবেন?
আমার হাসি পায়। কলমা পড়া কী জান? শুনবে?
ওর চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। বলে নিশ্চয়ই, ও সব কিছু যাচাই করে নিতে চায়। যদি ভাল লাগে তবে ভেবে দেখতে পারে।
শোন তাহলে।
আমি বোঝাতে থাকি। কলমা হল মানুষের ইসলাম ধর্মমতে আস্থার প্রকাশ। ছ’টা কলমা আছে।এক এক করে বলছি।
প্রথম, কলমা অল তৈয়ব, পবিত্রতার শপথঃ আল্লাহ্ একমাত্র ঈশ্বর, অন্য কেউ নয়। হজরত মহম্মদ হলেন নবী বা ঈশ্বরের দূত।
দ্বিতীয়, কলমা আশ শহাদা,সত্যের বা বিশ্বাসের শপথঃ আমি শপথ নিয়ে বলছি--আমি জানি যে এক আল্লাহ্ বিনা অন্য কোন ঈশ্বর নেই। তাঁর কোন অংশীদার নেই, আর হজরত মহম্মদ হলেন আল্লার সেবক এবং দূত।
তৃতীয়, কলমা অল- তমজিদ, গৌরব গাথাঃ আল্লা মহান, ধন্য হোক তাঁর নাম, আল্লা বিনা পূজনীয় কেউ নেই, আল্লার চেয়ে বড় কেউ নেই। আল্লার মধ্যে সমস্ত শক্তি সমাহিত। এমন কোন শক্তি, কোন ক্ষমতা নেই যা তাঁর মধ্যে নেই।
চতুর্থ, কলমা অল-তওয়াহিদ, আল্লার একত্ব ঘোষণাঃ আল্লা এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোন অংশীদার নেই। তিনি সার্বভৌম, তিনি ধন্য। তিনি জীবনদাতা এবং মৃত্যুও তাঁরই দান। তিনি প্রাণময় এবং অবিনশ্বর। বিশ্বের যা কিছু ভাল, সব তাঁরই দান। সবকিছু তাঁর অধীন, ধন্য হোক তাঁর নাম।
পাঁচ, কলমা ইস্তিগিফার, অনুতাপ মন্ত্রঃ জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যত পাপ করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি আমার প্রভু সেই আল্লার কাছে। আমাদের কোন পাপ তোমার অগোচর নয়। তুমি শরণাগতের সমস্ত ত্রুটি মার্জনা কর, সমস্ত পাপ ক্ষমা কর। তুমি সর্বশক্তিমান, তুমি মহান।
ছয়, কলমা রদ্দ অল কুফ্রঃ অবিশ্বাস ত্যাগের শপথঃ হে আল্লা, আমি তোমার শরণ নিলাম। তোমাকে আর কোন দেবতার সঙ্গে ভাগাভাগি করব না- এ আমি জানি। যা জানিনা তার জন্যে আমাকে ক্ষমা কর। আমি এর জন্যে অনুতপ্ত, এবং আমি তোমায় অবিশ্বাস করা পরিত্যাগ করেছি।
আমি পরিত্যাগ করছি তোমার অস্তিত্বে সন্দেহ করাকে, বহুদেববাদকে; ছেড়ে দিচ্ছি যত মিথ্যাচার, চুকলি করা, পথভ্রষ্ট হওয়া, বদনাম করা, অনৈতিক আচরণ, এবং সমস্ত পাপাচরণ।
আল্লাহ্ বিনা কোন দেবতা নেই, এবং মহম্মদ তাঁর দূত।
কলমা শোনার পরে ওকে বেশ চিন্তিত দেখাল।
--কী বুঝলে? মুসলমান হবে? কলমা পড়া তোমার কেমন লাগল?
--উমম্ হতেও পারি। খুব খারাপ লাগেনি। বেশ সোজা সাপটা বিশ্বাসের কথা। কোথাও যেন আমাদের বৈদান্তিক একেশ্বরবাদের সঙ্গে মিল আছে।
--এই যে বড় বড় কথা বলছ, এর মানে হল তোমার খুব একটা ভাল লাগেনি। থাক, আমার মন রাখার জন্যে জোর করে মুসলমান হতে হবে না। আব্বু হয়ত খুশি হবে। ভাববে আরও একজন পথভ্রষ্ট মানুষ সুপথে ফিরে এল। বড়ে ভাইয়া এখন পাক্কা মৌলবী, সে ও খুশি হতে পারে। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগবে।
--কেন খারাপ লাগবে?
আমি একটু ইতস্ততঃ করি। নীচের দৃশ্য দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করি। পুলের নীচে অরপা নদীতে জল কম, গোড়ালির বেশি ভিজবে না।
ভিজে বালি।
এ জায়গাটা নির্জন। বেশ খানিকটা দূরে লোকে সাইকেল দুহাতে তুলে পার হচ্ছে। একপাশে কাদা আর কচুরিপানার মধ্যে একটা মোষ গা ডুবিয়ে রয়েছে। একটা বকের মত লম্বা ঠোঁট পাখি মোষের পিঠে চড়ে ওর কান পরিষ্কার করছে।
সেদিনকার মত ঠেকিয়ে দিলাম।
কিন্তু সুজিতদা বড় নাছোড়বান্দা। দু’দিন পরে আবার জিদ করতে লাগল। জানতে চায় ও মুসলমান হয়ে গেলে আমার কেন খারাপ লাগবে?
--কী হল, বল?
আমি আকাশের দিকে তাকাই। সূর্য প্রায় অস্ত গেছে। আকাশে অলক মেঘের সারি, তাতে গোলাপি রশ্মির খেলা। দ্রুত অন্ধকার নামছে।
ও আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়। আমি অপ্রস্তুত হয়ে হড়বড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলি।
--আমরা সুন্নী মুসলিম, তোমায় কলমা পড়া ছাড়াও আর একটা কাজ করতে হবে। সুন্নত করতে হবে। সুন্নত মানে—
--আমার মানে জানা আছে, ও তোমায় ভাবতে হবে না। ধরে নাও আমার সুন্নত হয়েই আছে।
--সেকী, কবে? ধেৎ , এসব নিয়ে ফাজলামি করতে নেই। সুন্নত অল্প বয়সে করাতে হয়। ব্যথা কম হয়, রক্তপাতও কম। এখন এই বয়সে--, না থাক্ ।
--আরে, আমার ও জায়গাটা ওরকমই। মানে ক্যাপ খুললে পার্কার কলম যেমন দেখতে হয়।
সব রক্ত এখন আমার মুখে জড়ো হয়েছে, আয়নায় না দেখেই টের পাচ্ছি।
ও হেসে ওঠে। কী হল? লজ্জা করছে? তাহলে তোমাকে চুমো খাব কী করে?
--আমাদের ধর্মে বিয়ের আগে এসব করা বারণ। করলে গোনাহ্ হয়।
--পাপ হয়? যাকে ভালবাসি তাকে চুমো খাওয়া পাপ? কে বলেছে? কোন শাস্তরে?
-- “প্রকাশ্য হোক কি গোপন, অশ্লীলতার থেকে দূরে থাকবে (সুরাঃ আল -আন -আম, ১৫১)।
--আচ্ছা, তুমি তো অনেক কিছু জান দেখছি! আর কী কী জান?
-- ‘যে নারী পাঁচ ওয়ক্ত নামাজ পড়ে, রমজান মাসে রোজা রাখে, নিজের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে ও স্বীয় স্বামীর প্রতি অনুগত থাকে, সে নিজের পছন্দমত জন্নতের যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে’।(আহমদঃ ১৫৭৩)।
--সাবাশ! দেখ, তুমি দিনে পাঁচবার নামাজ পড়, রোজা রাখ –তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু “স্বামীর প্রতি অনুগত”? উঁহু, তার কোন লক্ষণ দেখছি না তো!
--এ আবার কি হেঁয়ালি? আমার বিয়ে হল কবে? কে আমার স্বামী?
--যেদিন আমরা বিয়ের কথা ভেবেছি সেদিনই। আরে মিঞা বিবি রাজি, তো ক্যা করেগা কাজী! আমিই তোমার স্বামী, বলছি চুমো খেতে তো তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ, আমার অবাধ্য হচ্ছ। তাহলে জন্নতের দরজা তোমার জন্যে খুলবে কী করে?
আমার মাথা ঘুরছিল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। সেই সুযোগে ও আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁট চেপে ধরল। ওর ঠোঁটে ওর জিভে সিগারেটের স্বাদ আর ধীরে ধীরে ওর জিভ আমার মুখে সেঁধিয়ে গেলে টের পেলাম চৈত্রমাসের দুপুরের গরম হাওয়ার হলকা এবং মহুয়া ফুলের গন্ধ।
কিন্তু ভেতর থেকে কে যেন বলছে--“প্রকাশ্য হোক কি গোপন, অশ্লীলতার থেকে দূরে থাকবে” (সুরাঃ আল -আন -আম, ১৫১)।
আমি আপত্তি করি, বলি আমার জন্যে তুমি বাপ-মাকে ছেড়ে যাবে? একটাই তো ছেলে ওঁদের? না, আমি পাপের ভাগী হব না।
ও বেশ চিন্তিত।
--ভেবে দেখলাম, আমাদের বিয়ে হওয়া এমনিতে সম্ভব নয়। তোমার আব্বা কখনও কোন বেকার ছেলেকে জামাই করবেন না। একটাই রাস্তা, যদি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি?
--বদনাম হবে। দুই বাড়ির সবাই আমাদের একঘরে করে দেবে।
--ঠিক আছে, না হয় তাই হবে। তাতে কী? তোমার শাস্ত্রে এভাবে বিয়ে করা নিয়েও নিষেধ আছে নাকি?
--“যাকে খারাপ ব্যবহারের জন্যে সবাই পরিত্যাগ করেছে , কয়ামতের দিন আল্লার চোখে সেই সবচেয়ে ঘৃণিত হবে”।(আবু দাউদ ৪৭১৬; হজরত আয়েশা)
--উফ, যদি আমরা সিভিল ম্যারেজ করি? তোমার আমার ধর্ম আলাদা, পরিবার গোঁড়া। আর আমরা কেউ কারও ধর্ম ছাড়ব না।
-- প্রশ্নই ওঠে না, কেন ছাড়ব?
--তাহলে তো আমাদের সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট ছাড়া গতি নেই। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে একমাসের নোটিস দিতে হবে। তারপর বিয়ে। হাওয়া গরম হবে। কিছুদিন অন্য শহরে গিয়ে থাকব। সবার মাথা ঠান্ডা হলে বিলাসপুরে ফিরে আসব। কী হল? বিশ্বাস হচ্ছে না?
--বিয়ে করে না হয় পালিয়ে গেলাম। তারপর? খাওয়াবে কী?
-- আল্লাহ বলেনঃ চরিত্র রক্ষার জন্য যারা বিয়ে করবে তারা যদি অভাবি হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন। (সুরা নুর : ৩২)। আর কিছু?
আমি অবাক। এসব আয়াত কবে শিখল? ওর কি মাথাটাথা গেছে?
--আরে, গত দু’রাত্তিরেএকটু কোরান পড়লাম। তোমাকে বিয়ে করব তো তোমার সংস্কার তোমার ভাবনা –এগুলো একটু বুঝতে হবে না? এবার বল, যাবে আমার সঙ্গে?
--কীরকম অস্বস্তি লাগছে। আমরা ভুল করছি না তো? আমি কখনও কোর্ট ম্যারেজের কথা ভাবি নি।
--বুঝতে পারছি। তোমার বইয়ে সিভিল ম্যারেজ নিয়ে কোন কথা নেই। আরে আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে কোথায় সিভিল ম্যারেজ? তাও আবার আরবের মরুভূমিতে? শাস্ত্রের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা সম্ভব নয়।
--এসব বল না। আমি যতদূর সম্ভব মেনে চলি। তোমার আমার বিয়ে হওয়া অসম্ভব। যা আল্লাহ্ দিয়েছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তাই আর কখনও আমাকে ছোঁবে না।
দেখ, হাদীস কী বলছেনঃ রসুল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর, এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক ও আল্লাহকে ভয় পেও।(সুরাঃ আল হস্রঃ৭)।
--তুমি ভুল বলছ। সমস্ত প্রাচীন নির্দেশ তুমিও মেনে চল না। তাহলে ভাতখণ্ডে স্কুলে গিয়ে দু’বছর ধরে গান শিখতে না।
কারণ, “যারা গান-বাজনার সাথে যুক্ত আল্লাহ তাদের মাটিতে ধ্বসিয়ে দেবেন এবং বানর ও শূকরে পরিণত করবেন”।
(ইবন-এ-মাজাহ ৪০২০; ইবন-এ-হিব্বান ৬৭৫৮; ত্বা বারানীঃ৩৩৪২)।
আমার বুক ঢিপ ঢিপ করে।ও এসব কবে শিখল? এসব কী হচ্ছে? খোদাতালার কী যে মর্জি!
--আচ্ছা, এক কাজ কর। আমার সঙ্গে এইখানে অরপা নদীর জলে হাতমুখ ধুয়ে নাও, তারপর বালির উপরে আমার পাশে হাঁটুগেড়ে বস। পশ্চিম দিকে অস্তগামী সূর্যের দিকে মুখ কর। জোড়া হাত তোল, হাতের তালু আকাশের দিকে। আর আমার সঙ্গে বলঃ
“ হে আসমান-জমিনের সৃষ্টিকর্তা, দুনিয়া ও আখিরাত- দুই জাহানেই তুমি আমার অভিভাবক।আমাকে ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করো, এবং আমাকে সৎকাজ করা লোকজনের মধ্যে ধরে নাও”।(সুরা ইউসুফঃ আয়াত ১০১)।
আমরা উঠে পড়ি। দেরি হয়ে গেছে।
একটা আয়াত মনে পড়লঃ “তুমি পানির মত হতে চেষ্টা কর যে কিনা নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেয়, তবে পাথরের মত হয়ো না যে কেবল অন্যের জন্যে বাধা তৈরি করে”।
হ্যাঁ, আমি নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিচ্ছি।
আল্লাহ রসুল বলেনঃ সন্তানের জন্যে শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোন পিতা করতে পারেনা।
আমার আব্বা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আজ আমি ওনাকে ছেড়ে যেতে রাজি হলাম। ঠিক করছি? সন্দেহ যায় না যে! মনকে আরও শক্ত করতে হবে।
পরশুদিন বিকেলে কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা মহানগর এক্সপ্রেস ধরে আমরা পুণে চলে যাব। সেখান থেকে কিছুদিন নাসিকে সুজিতদার বন্ধুর বাড়িতে। একটা ছোটখাটো কাজের জোগাড় হয়েছে নাকি!
আমরা নদীর পাড় থেকে উঠে বাইকে বসি। আজ দেরি হয়ে গেছে।
বাইক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজোড়া বাইক আমাদের পাশাপাশি চলতে লাগল।
বিরক্ত হয়ে সুজিতদা স্পীড কমালো। ওরা আমাদের ওভারটেক করার আগে কেউ একটা ছড়া কাটলঃ
“একদিন আমি হব লাশ, কেউ বা ঝাড়ে কাটবে বাঁশ,
কেউ তো দেবে কবর; শেসে কেউ নেবে না খবর”।
আমি কেঁপে উঠলাম। সন্ধ্যের সময় কবরের কথা কেন? এই ছড়াটার মানে কী? ছেলেগুলো কারা?
--ছাড় তো! হোস্টেলের বখা ছেলে। সন্ধ্যের সময় মেয়ে দেখলেই আওয়াজ দেয়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা বলেছি মনে আছে তো? আমরা তোমার আব্বাকে লেখা চিঠিটা মধ্যপ্রদেশের বর্ডার পেরিয়ে গোন্ডিয়া রেলস্টেশনে পোস্ট করব। তোমার স্কুল কলেজের সমস্ত সার্টিফিকেট অবশ্য নেবে, আর একজোড়া কাপড়। বাকি আমরা পরে কিনে নেব।
না; ওই চিঠি আর পোস্ট করা হয় নি। আমি কি জানতাম বড়ে ভাইয়া অনেকদিন ধরে আমাকে নজরে রেখেছিল। আমাদের টিকিট বিলাসপুর থেকে কাটা হলেও আমরা বাইকে করে দুটো স্টেশন এগিয়ে গিয়ে ট্রেন ধরব ভেবেছিলাম। তার আগেই বিলহা স্টেশনের কাছে ওরা আমাদের ধরে ফেলল।
সেই ছেলেগুলো। তবে এবার চারটে বাইক, ওরা আটজন।
মুখ বেঁধে পিছমোড়া করে খালের ধারে নিয়ে গেল। ওখানে দুটো কবর আগে থেকে খোঁড়া ছিল।
সেই দুটো গর্তের সামনে বড়ে ভাইয়া দাঁড়িয়ে। একবারও আমার চোখের দিকে তাকান নি। খুব শান্ত ছিলেন। শুধু শেষ সময়ের আগে দোয়া করলেনঃ
হে আল্লাহ্ রসুল! হে পরবরদিগার-এ -আলম! মেয়েটি ভুল পথে গেছে। কিন্তু কেয়ামতের দিন ও কবর থেকে উঠে যেন তোমার করুণা পায়। ওকে মাফ করে দিও খোদাতাল্লা! ও বড় দুঃখী।
কিন্তু মাফ কোর না, এই মুনাফির, এই কাফিরকে। এ শয়তান, এ আমার বোনকে পাপের পথে নিয়ে গেছে। ওর ঈমান নেই। ও যেন দোজখের আগুনে অনন্তকাল পুড়তে থাকে।
গরমে ঘেমে চোখ কচলে উঠে বসলাম। খালি ক্লাস রুমে অনেকগুলো লাইট জ্বলে উঠেছে। কোন ব্রজকিশোরের দেখা নেই। সেই বুড়োটা এসে পাখা বন্ধ করে দিয়েছে,তাই ঘাম হচ্ছে।
--ভর সন্ধ্যেতে এমন করে ঘুমোতে নেই। শয়তান এসে ভর করে। আপনাকে দু’বার ডেকে গেছি। একেবারে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
শরীর খারাপ নাকি? চলুন, আমাকে দরজা বন্ধ করে তালা লাগাতে হবে।
--কিন্তু ব্রজকিশোরের বাড়ি?
--দেখিয়ে দিচ্ছি। পেছনের দরজা দিয়ে বেরোলে একটি পতলী গলি। সেটা পেরোলেই একটা মুদি দোকানের পাশ দিয়ে গিয়ে এগিয়ে গেলে সোজা আপনার বন্ধুর বাড়ির গেট। এবার গা তুলুন।
নাঃ এখনও অন্ধকার হয় নি। ব্যাটা আমাকে ভাগাবার জন্যে ‘ভর সন্ধ্যে’ এসব পট্টি দিচ্ছিল। একটা ঘরের পাশের খালি প্লটে ছোটবাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে, রান আউটের অ্যাপিল করে বেদম চেঁচাচ্ছে।
ব্রজকিশোরের বাড়ির সামনে এসে ভাল করে নেমপ্লেট দেখি।
হ্যাঁ, ব্রজকিশোর নিগম, ভূতপূর্ব ব্যাংক অফিসার। কোন সন্দেহ নেই।
বাড়িটা ছোট হলেও মন্দ বানায় নি। সামনে একটু লন, তাতে একটা দোলনা। শ্রীমান ব্রজকিশোর তাতে বসে চা খাচ্ছেন এবং মোবাইলে কিছু করছেন।
আমি গেট খুলে ভেতরে এগিয়ে যাই। হাসিমুখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। ওর চেহারা খুব একটা বদলায় নি, মাথাভর্তি চুল, কিন্তু তাতে বেশ পাক ধরেছে। আর গালের চামড়া যেন একটু শিথিল। ও হঠাৎ কোন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তোলে, তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
--পহচান রহাঁ হ্যায় কি নহীঁ?
ও উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।
--কবে এলি বিলাসপুরে?
আমি কিছুই বলি না, শুধু হাসতে থাকি।
--এখন কোথা থেকে আসছিস?
--আরে, আমি তো আগের বাড়িতেই আছি, তোর কাছেই দুর্ঘটনা চৌকে। এখন আসছি কোন এক ব্রজকিশোরের কোচিং থেকে, ওকে চিনিস?
এবার ব্রজকিশোর নিগমের চোখ ছোট হয়, কোচিং?
যেন কেউ এমন একটা লোন প্রপোজাল নিয়ে এসেছে যা ব্যাংকের কোন স্কীমে নেই।
--শোন, দেবাংশু। এপাড়ায় কোন কোচিং সেন্টার নেই। ওসব বহুদিন উঠে গেছে। আজকাল সব অনলাইনে হয়।
--সে কী? কবের কথা বলছিস? আমি তো এতক্ষণ এক পাগলা স্যারের পাল্লায় পড়ে অনেক কিছু দেখলাম, বেশির ভাগই মাথার উপর দিয়ে গেল। আর তুই বলছিস—
--শোন, একটা পাগলামত লোক এসে কোচিং খুলে বাচ্চাদের উলটো সিধে পড়াতো, ভবিষ্যতের ভারতকে বদলে দেবার কথা বলত, তার কথা বলছিস? লোকটা সুবিধের ছিল না।
ওকে একসময় ইন্টেলিজেন্স থেকে এসে তুলে নিয়ে যায়। কোচিং যায় বন্ধ হয়ে। ব্যাটা সম্ভবতঃ কোন টেররিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
--ছিল? পাস্ট টেন্স? কবে নিয়ে গেল?
--দশ বছর আগে, ২০১৯ সালে। যখন আমাদের ব্যাংক মনসুখানি হাউস নিয়ে নিল, সেই বছরেই।
--আরে এখন তো ২০২৩, তাহলে দশ নয়, চার বছর আগে।
ব্রজকিশোর গম্ভীর হয়ে যায়, খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে—তোর কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে, এটা ২০২৯।
আজ সকাল থেকে আমার সঙ্গে এসব কী হচ্ছে, একের পর এক!
না, নিজের কন্ট্রোল হারালে চলবে না। কোথাও একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমি ঠিক করি ওর হিসেবেই খেলব।
--সরি, আমারই ভুল। এটা ২০২৯ সালই বটে। আসলে দু’দুবার কোভিড হয়ে রায়পুরের হাসপাতালে ছিলাম। অনেক কিছু ভুলে গেছি। ডাক্তার বলছে টেম্পোরারি মেমোরি লস। আস্তে আস্তে ঠিক হবে।
ইন ফ্যাক্ট, এই জন্যেই তোর কাছে এসেছি। একটু হেল্প চাই।
ওর মুখের চেহারা কঠিন হয়।
--দেখ, বেশি পারব না। দশ হাজার দিতে পারি, এক বছর পরে ফেরত দিস। বুঝতেই পারছিস, চাকরি চলে গেল। যা পেয়েছি, অনেক হিসেব করে চালাই। ভাগ্যিস বাড়িটা আগেই লোন নিয়ে করেছিলাম।
--আরে না না, টাকাপয়সা চাই না। ওই ব্যাংকের ব্যাপারটাই মনে করতে পারছি না। তুই বল। দশ বছর আগে যখন মনসুখানি হাউস আমাদের ব্যাংককে পকেটে পুরল তখন আমরা কী করলাম? আমাদের ইউনিয়ন কী করল?
--ভুলে গেছিস? তিন মাস হরতাল চলেছিল। আমরা ওদের প্যাকেজ রিফিউজ করে অনশনে বসেছিলাম। কিন্তু ওরা প্যাকেজ বাড়িয়ে গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেক প্রপোজ করল। আমাদের বৃদ্ধ নেতারা একে একে মেনে নিলেন।
তারপর আমরা সবাই প্যাকেজ নিয়ে ঘরে বসে গেলাম। তুই আমি সবাই।
--হুমম্, তোকে আর একটা কাজ করতে হবে। আমার বৌ দুই মেয়েকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি চলে গেছে, অনেকদিন। ডিভোর্স চাইছে। বহুদিন ধরে কেস চলছে, এর কোন মানে নেই।
তুই আমার এমিসারি হয়ে গিয়ে বল, আমি রাজি। সহজে ডিভোর্স পেয়ে যাবে। বুঝেছি মন সায় না দিলে কাউকে ধরে রাখার চেষ্টা করা পণ্ডশ্রম। ও যা চাইছে তাই হবে।
কিন্তু ব্রজকিশোর কোন উৎসাহ দেখায় না।
--কী? তুই যাবি তো? দেখ, ওই পাগলা কোচিং মাস্টার মন্দ বলে নি। ভবিষ্যত বদলে দিতে হলে আগে বর্তমান থেকে শুরু করতে হবে। তাই নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে চাই।
ব্রজকিশোর আমাকে জলের গেলাস এগিয়ে দেয়। বাড়ির ভেতর থেকে কাজের মেয়ে এসে সামনের বেতের কফি টেবিলে দু’কাপ চা রেখে চলে যায়।
ব্রজকিশোর আমার দিকে ইশারা করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। ও কিছু একটা ভাবছে; বলি বলি করেও কিছু ওর গলায় আটকে যাচ্ছে। তারপর যেন কোন একটা ডিসিশনে পৌঁছেচে এমন ভাব করে বলে—না, আমি যেতে পারি না, সম্ভব নয়।
আমার মুখে চায়ের স্বাদ তেতো হয়ে যায়। আমি উঠে দাঁড়াই।
ঠিক আছে, ও নাই যাক, আরও অনেক বন্ধু আছে। ওদের ঠিকানা মনে পড়ছে না। এর থেকে নিয়ে নেব। সেটাই ঢের বন্ধুকৃত্য হবে।
ও উঠে আমার কাঁধে হাত রাখে। নরম গলায় বলে—হ্যাঁরে দেবু, তোর কি কিছুই মনে পড়ছে না? আমি ধরিয়ে দিচ্ছি। একটা বিচ্ছিরি দুর্ঘটনায় তোর মস্তিষ্কে চোট লাগে, ব্লাড ক্লট হয়। তুই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকিস।
তখন তোকে দুটো বছর রায়পুর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ডঃ পি এন শুক্লার মানসিক চিকিৎসালয়ে থাকতে হয়।
--এসব কী বলছিস?
--ঠিকই বলছি, সেটা ২০২১। সেই সময় তোর বৌ আদালতে ডঃ শুক্লার সার্টিফিকেট পেশ করে ডিভোর্স পেয়ে যায়। এখন তাদের নতুন সংসার। তোর মেয়েরা তোকে ভুলে গেছে। খামোকা ওসব ভেবে লাভ নেই।
--আমি বাকিটাও জানতে চাই। কী সেই দুর্ঘটনা? আমার চিকিৎসা কে করেছিলেন?
--তুই সবটা না শুনে মানবি না?
--কী করে মেনে নেব? আজই দিনের শুরুতে আমাদের ব্যাংকে গেছলাম, পুরনো হেড অফিসে। সেখানে গিয়ে দেখি ওটার নাম পালটে গেছে; ওটা এখন প্রাইভেট ব্যাংক।
--হ্যাঁ, সেই দশ বছর আগে, বললাম তো!
--কেন মিথ্যে কথা বলছিস? ওই ব্যাংকের অফিসার পরমার তো বলে দিল চার বছর আগে, এখন তো ২০২৩ সাল। অফিসভর্তি লোকের সামনে বলল। আর তুই এখন আমাকে একা পেয়ে বোকা বানাচ্ছিস, কেন?
হোয়াট ইজ ইয়োর গেম, টেল মি!
--কী নাম বললি, পরমার? আচ্ছা, আমি এক্ষুণি ওই ব্যাঙ্কে ফোন লাগিয়ে পরমারের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। দেখে নিই কে ভুল, ঠিক আছে? তুই এখানে বসে চা শেষ কর। আমি ল্যান্ডফোনে কথা বলে দেখছি।
ব্রজকিশোর ভেতরে চলে গেল।
আমি চায়ে চুমুক দিই। আর চারদিকে চোখ বোলাই। ছোট্ট লন, কিন্তু যত্ন করে ছাঁটা ঘাস। একদিকে অল্প একটু সিজনাল ফুলের বেড। তাতে কিছু চন্দ্রমল্লিকা, কিন্তু শুকিয়ে গেছে। মার্চ মাসের শেষ যে, এগুলো এবার তুলে ফেলে দিতে হবে।
অথচ, ব্যাংকে তো বলেছিল এটা অক্টোবর। তাহলে নতুন করে চন্দ্রমল্লিকা , ডালিয়া , গাঁদা সব লাগাতে হবে। আর আসন্ন শীতের ফুলগুলো—ফ্লক্স, ডায়ান্থাস, কারনেশন, হলিহক, সুইট পী , আরও কী কী যেন।
কিন্তু ব্রজকিশোর এখনও আসছে না কেন? ফোন এনগেজড? নাকি ও ওয়াশ রুমে গেছে?
আমার বৌ এসব ভাল জানত। ওর বাগানের শখ ছিল। ধেত্তেরি আধঘন্টা হয়ে গেল। আর কাজ নেই, পরমারের সঙ্গে কথা বলে। বড্ড ক্ষিদে পাচ্ছে।
এবার সত্যিই সন্ধ্যে হয়ে এল। অন্ধকার নামছে। আর দু’মিনিট দেখব। তারমধ্যে ও এলে ভাল, নইলে আমি চুপচাপ চলে যাব। আমার রাগ হচ্ছে।
এক মিনিট, দেড় মিনিট।
একটা গাড়ির আওয়াজ, কারা যেন গেট খুলে ঢুকছে।
চারজন এসেছে, হয়ত ব্রজকিশোরের বন্ধু বা আত্মীয়। আমি উঠে দাঁড়াই, ওরা বসুক।
ওরা হাঁ হাঁ করে বাধা দেয়। না না, আপনি উঠবেন না।
তারপর দু’জন এগিয়ে এসে শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে।
ইয়েস মিঃ রায়চৌধুরি, প্লীজ কাম উইথ আস্ !
লেখকের ফুটনোটঃ
খবর পেয়ে গিয়েছিলাম পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।
রায়পুর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে এক মানসিক চিকিৎসালয়। ডাক্তার শুক্লা আমেরিকা থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। খুব নামডাক। এই শহরের ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়কর দেন।
হাইওয়ে থেকে দশ কিলোমিটার ভেতরে পাঁচ একর জমি নিয়ে বিশাল বিল্ডিং, দুর্গের মত উঁচু লোহার গেটে পেল্লায় তিনটে তালা, ভেতর থেকে লাগানো। আমরা বেল টেপায় দরজার গায়ে একটা স্লিট সরে গিয়ে দুটো চোখ আমাদের দেখতে লাগল। ডাক্তার শুক্লার স্লিপ দেখালে একটু সময় নিয়ে ঘড়াং ঘড়াং করে মেন গেট খুলল।
ভেতরে এগিয়ে যাচ্ছি, একজন লোক একটা কলা চুসতে চুসতে আমার রাস্তা আটকিয়ে বলল—শোন, ফালতু ঘোরাফেরা করে জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট কর না। যাও, কিছু কাজকম্ম কর, দু’পয়সা ঘরে আনো। ‘আরে ধান্ধে কা কুছ বাত করো, কুছ পয়সা জোড়ো’।
কিন্তু এখানে আমাদের বন্ধু দেবু কই? ওয়ার্ডেন আঙুল তুলে দেখালো একটু দূরে আমগাছটার নীচে একটা জটলা।
ফাগুন মাসের রোদ। একটা সুতো বের করা কোট গায়ে দিয়ে দেবু গাইতে গাইতে চলেছে আর ওর পেছনে মিছিলের মত চলছে আরও কিছু রোগী। ও হাত তুলে শ্লোগান দেওয়ার মতন ভঙ্গীতে চেঁচিয়ে গাইছেঃ
ইয়ে জো মুহব্বত হ্যায়, ইয়ে উনকা হ্যায় কাম
মহবুব কা জো, বস লেতে হুয়ে নাম,
রহনে দো ছোড়ো ভী, জানে দো ইয়ার
হম না করেংগে প্যার।
আমি কাছে গিয়ে ডাকি—হ্যালো রায়চৌধুরি!
ও নিজের খেয়ালে গান গেয়ে চলে, শুনতে পায়নি। আমি ওর পিঠে টোকা দিয়ে ডাকি—দেবু, কেমন আছিস?
ও ঘুরে দাঁড়ায়, আমাকে দেখে। ওর হাসিটা একটু একটু করে গোটা মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
তারপর আমার দিকে হাত এগিয়ে দেয়ঃ
“কাত্যায়ন, তুমি নাড়ি দেখতে জান? দেখ তো, আমি বেঁচে আছি কিনা”।