বাংলা ভাষায় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস লেখার কাজ চলছে অন্তত ২০০ বছর সময়কাল ধরে। প্রায় ৩০০ বছর আগেকার কবিরাজী পাতড়া নামে এক প্রাচীন বাংলা পুঁথির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে ((সুশীল কুমার দে, হিস্টরি অফ বেঙ্গলি লিটারেচার ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিঃ ১৮০০-১৮২৫)। সে গ্রন্থে ক্ষুধামান্দ্যর প্রতিকার নিয়ে টোটকা চিকিৎসার আলোচনা আছে – “বাই অম্বলের প্রতিকার। ... আম্বল হইতে যে ২ বলবান হয় তাহা ঘুচে। ইহার নাম শুঁটিখণ্ড।” বাংলায় লেখা হলেও এটা নিতান্তই ঘরোয়া টোটকা চিকিৎসা সংক্রান্ত, মূল চিকিৎসার ধরনের মাঝে পড়েনা। ১৮১৯ সালে বাংলায় শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হল উইলিয়াম কেরির বড় পুত্র ফেলিক্স কেরির লেখা বিদ্যাহারাবলী (সুশীল কুমার দে, হিস্টরি অফ বেঙ্গলি লিটারেচার ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি, পৃঃ ২৫১) – বাংলায় প্রথম অ্যানাটমি চর্চার বই। বলার কথা যে এ ধরনের প্রয়াস শুরু হয় বাংলা তথা ভারতে ইংরেজ শাসন পাকাপোক্ত হয়ে বসার পরে। প্রসঙ্গত, শেল্ডন পোলোকের অধিনায়কত্বে Sanskrit Knowledge-Systems Project-এর সুবিশাল গবেষণার সুবাদে আমরা জেনেছি যে ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ২০০-২৫০ বছরের সময়কাল জুড়ে আয়ুর্বেদচর্চায় কিছু নতুন ধারা বিকশিত হয়। এসময় সংস্কৃতের পরিবর্তে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এবং দরবারি পাঠের ধরনকে ছাপিয়ে বেশিরভাগ মানুষের বোধগম্য হবার উপযোগী এক ধরনের নতুন আয়ুর্বেদচর্চা শুরু হয়। যদিও এখানে উল্লেখ করা দরকার, প্রাক-উপনিবেশিক কিংবা “on the eve of colonialism” কালে এ রচনাসমূহ মূলগতভাবে শাস্ত্রীয় বা স্কল্যাস্টিক ক্ল্যাসিকাল আয়ুর্বেদের কাঠামোর অনুসরণে কিংবা কাঠামোর মধ্যে অবস্থিত থেকেই রচিত হয়েছে। বাংলায় লেখা একটি স্বল্প-পরিচিত গ্রন্থে আয়ুর্বেদের বিভিন্ন পুঁথি ও পুস্তকের ভালো বিবরণ পাওয়া যায় (গুরুপদ হালদার, বৈদ্যক-বৃত্তান্ত, কলিকাতা, ১৯৫৪)। এছাড়া সুখ্যাত ‘আধুনিক’ কবিরাজ গণনাথ সেনের লেখা আয়ুর্বেদ পরিচয়-এ (বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৩৫০ বঙ্গাব্দ) আয়ুর্বেদের সংক্ষিপ্ত, আঁটোসাঁটো এবং আধুনিক সময়ের উপযোগী ভয়ে ওঠার ইতিহাস পাওয়া যায়, গণনাথের পুস্তকের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আয়ুর্বেদের সাথে আধুনিক চিকিৎসার মূলগত পার্থক্য, সংঘাত এবং সহযোগিতা ও আত্মীকরণের বৃত্তান্ত যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে আলোচিত হয়েছে। তাঁর একটি মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ – “এমন কি পরবর্তী যুগের বাগভটাচার্যের গ্রন্থেও রোগবিজ্ঞানের উপায়রূপে নাড়ী পরীক্ষার কথা উল্লিখিত হয় নাই। বস্তুত, পরবর্তী যুগে শারীরচর্চা বিলুপ্ত হইলে এবং “অঙ্গুষ্ঠমূলগত জীব সাক্ষিণী ধমনীর” সহিত হৃদযন্ত্রের সম্বন্ধ পর্যন্ত কবিরাজ মহাশয়গণ ভুলিয়া গেলে এই নাড়ীবিজ্ঞানের সৃষ্টি হইয়াছে।” (পৃঃ ১৯) পরবর্তীতে আয়ুর্বেদের আধুনিক হয়ে ওঠা নিয়ে মন্তব্য করছেন – “ইহার পর আয়ুর্বেদের পুনরভ্যুদয়ের কাল ইংরেজি ১৮৩০ সাল হইতে আরম্ভ হয় .... মধুসূদন গুপ্ত ১৮৩৫ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজে নিজ হস্তে শবব্যবচ্ছেদ করিতে গিয়াছিলেন। আয়ুর্বেদের পুনরভ্যুদয়ের প্রথম মন্ত্র তিনিই উচ্চারণ করেন।” (পৃঃ ৩১)
লক্ষ্যণীয়, ১৯শ শতকের মধ্য ভাগ থেকেই (বিশেষ করে ১৮৩৫-এ মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সময়ে) আয়ুর্বেদ চর্চার ওপরে একদিকে ছিল মডার্ন মেডিসিনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও চাপ, অন্যদিকে আয়ুর্বেদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানতত্ত্ব ছেড়ে আধুনিক হবার জন্য শবব্যবচ্ছেদের মতো বিষয়কে নিয়মিতভাবে আয়ুর্বেদের কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার ঐকান্তিক প্রয়াস। এ দুয়ের টানাপড়েন নিয়ে আয়ুর্বেদের পরবর্তী “নির্মাণ”, যাকে মান্য গবেষকেরা বলেছেন “নব্য আয়ুর্বেদ”। বর্তমান সময়ে আয়ুর্বেদের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলে মান্য মিউলেনবেল্ড (কিছুদিন হল প্রয়াত হয়েছেন) তাঁর magnum opus পাঁচ খণ্ডের History of Indian Medical Literature (HIML)-এ বলছেন – “the renaissance of Āyurveda since the middle of the nineteenth century led to the construction of a unitary model of Indian medicine, weaned from inconsistencies and untenable concepts … The ancient terms for physiological and pathological processes, nosological entities etc., were diligently re-interpreted to bring them into line with terms derived from Western medicine.” (HIML, IA, পৃঃ ২। নজরটান আমার)
আমরা এবার একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। বেদের সাথে আয়ুর্বেদের সংযোগ আছে, আবার নেইও। কিভাবে? চরক-সংহিতা-র সূত্রস্থানম্-এ বলা হচ্ছে – “বেদকে আপ্তাগম বলে। বেদ ব্যতীত অপরাপর যে সমস্ত শাস্ত্র বেদের অবিরোধী; পরীক্ষকগণ কর্তৃক প্রণীত এবং সমস্ত মানুষের হিতকামনায় ঋষিগণ কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছে, তাদেরকেও আপ্তাগম বলে।” অনুমাণ করা যায় চার্বাক দর্শনের প্রবক্তাদের একটা ছাপ ও প্রভাব আয়ুর্বেদের ওপরে সেসময়ে ছিলো। চার্বাকপন্থীরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করতেন না। এজন্য সূত্রস্থানম্-এর আরেক স্থানে বলা হয়েছে – “বুদ্ধিমান ব্যক্তি নাস্তিক্য বুদ্ধি ও সংশয়ভাব পরিত্যাগ করবেন। কেননা এ সংসারে প্রত্যক্ষের ভাগ অল্প; এবং অপ্রত্যক্ষ বিষয় শাস্ত্র, অনুমান ও যুক্তি দ্বারা উপলব্ধ হয়ে থাকে।”
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সায়ান্স অ্যান্ড সোসাইটি ইন এনশেন্ট ইন্ডিয়া-তে এ ঘটনার একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে যারা চিকিৎসাবৃত্তির সাথে ছিলেন তাদের বিশেষ অবস্থানগত, নৈতিক এবং পেশাগত কারণে রোগীর দেহের রক্ত, পূরীষ বা অন্য কোন বর্জ্য পদার্থ সম্বন্ধে কিংবা রোগীর সামাজিক অবস্থান বা বর্ণ/জাত নিয়ে বাছ-বিচার করা চলতো না কারণ রোগীর আরোগ্যই ছিল প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজের প্রবল চাপে পেশাগতভাবে টিকে থাকতে গেলে আয়ুর্বেদ চর্চাকারীদের একটা সমঝোতায় আসতে হয়েছে। এবং এরকম আপোষের কারণেই সম্ভবত নাস্তিক্যবাদ কিংবা অন্য কোন বেদ-বিরোধী অবস্থানকে নাকচ করা হয়েছে। অর্থাৎ, আয়ুর্বেদের সেক্যুলার চরিত্রের ওপরে আরেকটি স্তর যুক্ত হল – গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের স্তর। এখানেই আয়ুর্বেদের প্রধান সংকট এবং পরবর্তীতে শরীরের কাটাছেঁড়া ক্রমাগত আয়ুর্বেদের মূল চরিত্র ও কাঠামো থেকে দূরে আরও দূরে সরে গেছে। অবশেষে মুছে গেছে। সামাজিকভাবে কিছু নীচুতলার মানুষের বা গোষ্ঠীর মাঝে বংশ পরম্পরাগত craft হিসেবে রয়ে গেছে। অধুনাকালে আরেক আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ কেনেথ জিস্ক তাঁর Asceticism and Healing in Ancient India গ্রন্থে মনে করিয়ে দেন যে শবব্যবচ্ছেদ কোন সময়েই গৃহীত পদ্ধতি ছিলনা কারণ শবব্যবচ্ছেদ করতে গেলে চিকিৎসক এবং ছাত্রদের অতি অপবিত্র এবং নোংরা বস্তুর সংস্পর্শে আসতে হবে যা ব্রাহ্মণ্যবাদ অনুমোদিত নয়। ফলে, তাঁর ধারণা, ব্রাহ্মণ্যবাদের পরিবেশে আয়ুর্বেদের জ্ঞানের এবং কৃৎ-কৌশলের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। তিনি বৌদ্ধদের সার্বিক চিকিৎসার জ্ঞান ও ধরণের থেকে আহরণের কথা বলেছেন। জিস্কের প্রায় দু’দশক আগে দেবীপ্রসাদও সমধর্মী মতামত ও প্রমাণ রেখেছিলেন। জিস্কের মতে “traditional brâhminic sources recount the origin of Indian medicine through a lineage of divine, semidivine, and venerable transmitters.” ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে একটি মুক্তমনা (heterodox) জ্ঞানের জগৎ প্রবল গোঁড়া (orthodox) সংস্কার ও শাস্ত্রের চাপে ঈপ্সিত চলনপথ থেকে কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত স্কল্যাস্টিক চিকিৎসার একটি জ্ঞানভান্ডারে পর্যবসিত হল। জিস্কের ধারণায় – “এটা যৌক্তিকভাবে ধরে নেওয়া যায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে (৪র্থ থেকে ৭ম শতাব্দী) আয়ুর্বেদের ব্রাহ্মণীকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এই সময়কালেই ঝক, সাম, যজুর –এর সাথে অথর্ববেদ-কে প্রথম পবিত্র বেদ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এই সময়কালেই প্রাধান্যকারী পুরাণগুলো রচিত হয়।” (“Mythology and brahminization of Indian medicine: transforming heterodoxy into orthodoxy”,
এস এন দাসগুপ্ত তাঁর ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস নিয়ে ৫ খণ্ডে লেখা অতি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক A History of Indian Philosophy-র ২য় খণ্ডে বলছেন যে ভারতে যতগুলো বিজ্ঞানের শাখা বিকশিত হয়েছিল তার মধ্যে মেডিসিনই প্রধান এবং “was directly and intimately connected with the Sāṃkhya and Vaiseshika physics and was probably the origin of the logical speculations subsequently codified in the Nyaya-sytras.” (২য় খণ্ড, পৃঃ ২৭৩) এই তিনটি দর্শনের কোনটিই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিনিধিত্বকারী দর্শনের সমার্থক ছিলনা।” তিনি আরও বলছেন – “logical portions of the Caraka-samhita were collected by Caraka from non-medical literature and grafted into his work.” এ পুস্তকেই দাসগুপ্ত বলেছেন – “A comparison of Vāgbhata I shows that the study of anatomy had almost ceased to exist in the latter’s time.” (পৃঃ ৪৩৩) এ ধারণা মিউলেনবেল্ড এং জিস্কের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যদিও দাসগুপ্তের পুস্তক প্রায় ১০০ বছর আগে প্রকাশিত। অ্যানাটমির জ্ঞানের স্বল্পতা এবং অসম্পূর্ণতার একটি বড়ো নমুনা হচ্ছে সুশ্রুত মানুষের শরীরের ফুসফুসের আকারের ওপরে নির্ভর করে বাঁদিকের ফুসুফুসকে ক্লোম, এবং ডানদিকেরটিকে পুপফুস বলেছেন। (দাসগুপ্ত, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৮৮) মিউলেনবন্ডের হিসেব অনুযায়ী সুশ্রুত-সংহিতা ৩০০-৫০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে দৃঢ়বল-র হাতে সংকলিত হয়। এবং বাগভট্টের সময়কাল ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ডোমিনিক য়ুজাস্তিক তাঁর The Roots of Ayurveda গ্রন্থে এমনটাই বলেছেন। অর্থাৎ, ৩০০ বছরের মধ্যে শল্য চিকিৎসার ধারা আয়ুর্বেদের মূল ধারা থেকে হারিয়ে যায়। এ জ্ঞান কালের স্রোতে এবং ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমে জমা হয়ে থাকে নাপিত, কুমোর বা কামার সহ অন্য বর্গের মানুষের মাঝে। ফ্রান্সিস জিমারম্যান তাঁর “Terminological Problems in the Process of Editing and Traslating Sanskrit Medical Texts” প্রবন্ধে বলছেন যে শুধু এটুকু আমাদের মাথায় রাখলে চলবেনা যে সুশ্রুত-সংহিতা এবং চরক-সংহিতা-র দৃঢ়বদ্ধ টেক্সট হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ১০ থেকে ১৫ শতাব্দী লেগেছে এবং মধ্যযুগের বিভিন্ন ভাষ্য এতে যুক্ত হয়েছে, এর সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে এত দীর্ঘ সময়কালে সমষ্টিগত চিন্তার জগতে প্রচুর ভাঙ্গাচোরা এবং পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি দেখিয়েছেন – “এধরনের পরিবর্তনের আরও মূলগত একটি উদাহরণ হচ্ছে পঞ্চকর্ম – পাঁচটি চিকিৎসা – এই শব্দটি। “পাঁচটি চিকিৎসা”-কে আর কোষ্ঠ বা দেহ পরিষ্কার করার জাতিবাচক বা জেনেরিক নাম হিসেবে দেখা যায়না। পঞ্চকর্ম আদিতে সম্ভবত শোধন বা পরিশুদ্ধ করার চিকিৎসার সাথে সমার্থক ছিল, কারণ দুটি ক্যাটেগরিতেই অন্তর্ভুক্ত ছিল বমনোদ্রেককারক, রেচক, শক্তিশালী এনেমা, এবং errhines বা নাক দিয়ে প্রবেশ করানো ওষুধ যা শ্লেষ্মা তৈরি করে। পঞ্চম প্রক্রিয়া ছিল রক্তমোক্ষণ (bloodletting)। যেহেতু সময়ের সাথে রক্তমোক্ষণ অপ্রচলিত এবং অব্যবহৃত হয়ে যায় ফলে একে বাদ দিয়ে নিয়ে আসা হয় তেলের এনেমা। এই টেকনিক্যাল পরিবর্তনগুলো এবং শব্দার্থের পরিবর্তন চিকিৎসার দর্শনের ক্ষেত্রে আরও মূলগত পরিবর্তন ঘটালো – অপারেশনের চিকিৎসা হয়ে গেলো অধিকতর মৃদু পদ্ধতি।” শল্য চিকিৎসার মৌলিক সমাধি সম্পূর্ণ হল। কিছু বিশেষ শল্য চিকিৎসা বেঁচে রইলো নীচু জাতের মাঝে পারিবারিক, পরম্পরাগত বৃত্তি হিসেবে। এরকম একটা উদাহরণ কাটা নাক জোড়া লাগানোর কাহিনী।
এখানে আমরা এক আমেরিকান মিশনারি ডাক্তার ব্যাচেলার-এর ১৮৫৬ সালের একটি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করতে পারি – “কামার তার চিমটে দিয়ে ডেন্টিস্ট হিসেবে কাজ করে, এবং নাপিত তার ক্ষুর দিয়ে সার্জেন হিসেবে কাজ করে। কারণ এরাই হচ্ছে কেবলমাত্র সেসব লোক যারা শল্য চিকিৎসার কাজের সাথে যুক্ত।” (O. R. Bacheler, Hinduism and Christianity in Orissa: Containing a Brief Description of the Country, Religion, Manners and Customs, of the Hindus, and an Account of the Operations of the American Freewill Baptist Mission in Northern Orissa, 1856, পৃঃ ১৭৪)
১৭৯২ সালে টিপু সুলতানের বাহিনীর একজন যাকে ঐতিহাসিকভাবে কাওয়াসজি বলে জানা যায় সুলতানের বাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তার নাক কাটা যায়। পুণের এক গ্রামের কুমোর পরিবারের হাতে তার নাক আবার জোড়া লাগে। সে চিত্র ইংল্যান্ডের প্রথম সারির জনপ্রিয় পত্রিকা জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন-এ ছাপা হয়েছিল ১৭৯৪ সালে। নীচে দেওয়া হয়েছে সে চিত্র।
সুশ্রুত-সংহিতা-র শারীরস্থানম-এর ৫ম অধ্যায়ে মাত্র ৫টি শ্লোকে (৪৬-৫০) শবব্যবচ্ছেদের উপযুক্ত দেহ কিভাবে তৈরি করতে হবে তার মোটামুটি বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সমগ্র সুশ্রুত-সংহিতা-র আর কোথাও এনিয়ে একটি শব্দও নেই। এ অংশটুকুকে কি কোনভাবে প্রক্ষিপ্ত বলা যাবে? আমাদের কাছে নির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই। রাশিয়ার দু’জন সংস্কৃতজ্ঞ স্কলার সুশ্রুতে ব্যবহৃত শল্য শবদটি নিয়ে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন (ফিসার এবং ফিসেরোভা, “Dissection in Ancient India. In History and Culture of Ancient India” (For the XXVI International Congress of Orientalists), ed. W. Ruben, V. Struve and G. Bongard-Levin, Moscow, 1963, pp. 306-328) প্রকৃত অর্থে, শল্য বলতে বোঝায় কোন তীক্ষ্ণ পদার্থ যা শরীরে বেদনা সৃষ্টি করে। (মনিয়ের-উইলিমাসের অভিধান দ্রষ্টব্য) ফিসার এবং ফিসেরোভা বলছেন – “তাহলে, যে ব্যক্তি শল্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে ভালোভাবে মৃতদেহটি প্রস্তুত করতে হবে এবং সঠিক পদ্ধতিতে এর পর্যবেক্ষণ করতে হবে।” সহজ কথায় সুশ্রুতের যে শ্লোকের ব্যাখ্যা অ্যানাটমি এবং সার্জারি-কেন্দ্রিক হয়ে এসেছে সে ধারণাটিকে এঁরা প্রশ্নের মুখে ফেললেন। এবং এদের প্রশ্ন সমগ্র আলোচনাটিতে ছুরির কোন ব্যবহার বা উল্লেখ নেই কেন? তাঁদের পর্যবেক্ষণে – “পৃথিবীতে এখনো অবধি জানা দ্বিতীয় কোন উদাহরণ নেই যেখানে ছুরির ব্যবহার ছাড়া শব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে।” সুশ্রুতে যে পদ্ধতিতে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের উপযুক্ত করে তোলা হবে তাকে বলা হয়েছে “অবঘর্ষণ” পদ্ধতি। বলার কথা, এভাবে জলের মধ্যে মৃতদেহ রেখে বিশেষ ধরনের ঘাস দিয়ে ঘষে ঘষে স্তরের পরে স্তরকে উন্মুক্ত করার পদ্ধতি সেসময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চালু ছিলো। তাহলে দেহের উপরে বিভিন্ন শল্য চিকিৎসা করার জন্য দেহের উপরিতলের ধারণা আয়ুর্বেদের চর্চাকারীরা অর্জন করলেন কিভাবে? সম্ভাব্য উৎস হতে পারে – (১) যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত বা আহত সৈনিকদের দেহের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, (২) ঘোড়া বা সমধর্মী পশুদের দেহের অভ্যন্তরভাগগের মনোযোগী পর্যবেক্ষণ, এবং (৩) যেহেতু সেসময়ে মৃত শিশুদের পোড়ানোর বদলে কবর দেবার ব্যবস্থা চালু ছিল সেজন্য এদের গলিত দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব ছিলো। শিশুদের ক্ষেত্রে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি এবং হাড়কে আলাদা করা যায়না। এ কারণে সম্ভবত অস্থির সংখ্যার ক্ষেত্রে কার্টিলেজকেও ধরে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে চরক, সুশ্রুত এবং বাগভটে উল্লেখিত অস্থির সংখ্যা আধুনিক মেডিসিনের সাথে একেবারেই মেলেনা। প্রসঙ্গত, আয়ুর্বেদে দেহের অভ্যন্তরের, বিশেষ করে মস্তিষ্ক এবং হার্ট, কোন বিবরণ পাওয়া যায়না। দেহের ধারণা একান্তই দৃঢ়ভাবে দ্বি-মাত্রিক। নেপাল থেকে সংগৃহীত ১৮০০ (?) সালে আঁকা নীচের চিত্রটি এটা বুঝতে সাহায্য করবে।
নীচের চিত্রটি কাওয়াসজির নাক জুড়ে দেবার চিত্র – এক ব্রিটিশ সার্জেনের আঁকা। (The Gentleman's Magazine LXIV, pt. 2, no. 4 (October, 1794) 891-92, 1 plate (at p. 883).)
(কাওয়াসজির জোড়া লাগা নাক rhinoplasty-র পরে)
প্রথম বেদ রচিত হবার পরে প্রায় ১০০০ বছর ধরে বেদের চর্চা ও বিস্তার যতো পুর্ব দিকে বিস্তৃত হয়েছে, অর্থাৎ বঙ্গদেশে, তত আয়ুর্বেদের চরিত্র এবং উপাদান পরিবর্তিত হয়েছে। এসময় দিয়ে অথর্ববেদ রচিত হয়েছে। পরবর্তীতে উন্মেষ হয়েছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের – প্রকৃত অর্থ আয়ুস্+বেদ, দীর্ঘজীবিতার জ্ঞান। আয়ুর্বেদকে কখনো পঞ্চম বেদও বলা হয়েছে। কিন্তু সঠিক অর্থে ভাবলে আয়ুর্বেদ প্রকৃত অর্থে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে তুলনীয় নয়। এখানে চিকিৎসার কথা আছে। সমানভাবে দর্শনের কথা আছে। কিভাবে একজন গার্হস্থ্য, এমনকি যৌন জীবন, যাপন করবে তার নির্দেশনা রয়েছে। রয়েছে খাদ্যবিধির উল্লেখ, চোখে পড়ার মতো রয়েছে সামাজিক অনুশাসনের প্রসঙ্গ। কিন্তু আয়ুর্বেদের মূল কাঠামোতে নির্ভুলভাবে রয়েছে “unwaveringly male gaze.”
চরক-সংহিতা-র প্রথম অধ্যায় অর্থাৎ সূত্রস্থানম্-এ বলা হয়েছে –
“শরীরেন্দ্রিয়সত্ত্বাত্মসংযোগো ধারি জীবিতম। / নিত্যগশ্চানুবন্ধশ্চ পর্যায়ৈরায়ুচ্যতে।।”
এর বাংলা অর্থ করলে হবে – শরীর, ইন্দ্রিয়, মন ও আত্মা এদের সংযুক্ত অবস্থার নাম আয়ু। ধারি, জীবিত, নিত্যগ ও অনুবন্ধ – এই কয়েকটি শব্দ আয়ুর পর্যায়বাচক। এর ঠিক আগেই বলা হয়েছে – হিতাহিতং সুখং দুঃখমায়ুস্তস্য হিতাহিতম্। / মানঞ্চতচ্চ যত্রোক্তামায়ুর্বেদঃ স উচ্যতে।। বাংলা অর্থ হয় – আয়ু চার প্রকার। হিতায়ুঃ, অহিতায়ুঃ, সুখায়ুঃ, এবং দুঃখায়ুঃ। এখানে আমরা দেখছি এক binary বা দ্বিত্বতা – হিতায়ুঃ/অহিতায়ুঃ, সুখায়ুঃ/দুঃখায়ুঃ। একেবারে প্রথম অধ্যায়ে এ ধারণার মধ্য দিয়ে একটি নীতিবোধের প্রসঙ্গ গভীরভাবে লীন হয়ে থাকলো আয়ুর্বেদ চর্চা এবং পাঠের মধ্যে। অনেক পরে কালজয়ী বাংলা উপন্যাস আরোগ্য-নিকেতন-এ জীবন মশাইয়ের মধ্যে এরকম অন্তর্লীন নৈতিকতা খুঁজে পাবো, যা তাঁর জীবনের চালিকা শক্তি। চালিকা শক্তি আয়ুর্বেদেরও। এ নৈতিকতা আধুনিক মেডিসিনের কাঠামোর মধ্যে অনুপস্থিত।
আমরা এটুকু আলোচনা থেকে বুঝতে পারি মডার্ন মেডিসিনে যেরকম প্রতিটি টেকনিক্যাল শব্দের অর্থ নির্ভুল, লক্ষ্যভেদী এবং একটি মাত্র অর্থ নিরূপণ করে, আয়ুর্বেদে শব্দ বা শব্দার্থ অনেক তরল এবং প্রেক্ষিত-নির্ভর। একই শব্দ বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে যা সপ্তদশ শতব্দী থেকে ক্রমবিকশিত আধুনিক মেডিসিনে সেরকম fluidity এবং context-specfic হবার সুযোগ নেই। মেডিসিনের অন্তর্বস্তুর এই পরিবর্তনের মধ্য মেডিসিন আধুনিক এবং লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠেছে। এর সাথে শবব্যবচ্ছেদের আবশ্যিক শিক্ষা মেডিসিনকে organ-localization of disease বুঝতে শিখিয়েছে। ফলে আধুনিক মেডিসিনের মৌলিক চলন ডায়াগ্নোসিস-কেন্দ্রিক, রোগকে খুঁজে নির্দিষ্ট চেহারায় চিহ্নিত করা। বিপরীতে, আয়ুর্বেদে মূলগতভাবে এই বৈশিষ্ট্য না থাকার জন্য রোগের বিচার সবসময়েই prognosis-centered। তাহলে আধুনিকতার ক্ষমতা ও জোর দৃঢ়বদ্ধ হল রোগ-নির্ণয়কে কেন্দ্র করে, অন্যদিকে “অনাধুনিক” আয়ুর্বেদের অভিমুখ থাকলো রোগের পূর্বলক্ষ্মণ নির্ণয় করার দিকে। এই পার্থক্যের প্রধান ভিত্তি হল শবব্যবচ্ছেদের বস্তুনির্ভর অব্জেক্টিভ জ্ঞান বনাম শবব্যবচ্ছেদহীন empirical এবং স্কল্যাস্টিক জ্ঞান। মিউলেনবেল্ড prognosis-এর চরিত্র ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – “শুরুতেই এটা জোর দেওয়া কার্যকরী হবে যে ভারতীয় মেডিসিনে একটি রোগের গতিধারা হল বিকাশের একটি বিরামহীন প্রক্রিয়া। একটি রোগ হল এমন কিছু যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। প্রাথমিক লক্ষ্মণ বা পূর্বরূপ বিকশিত হয় পূর্ণাঙ্গ লক্ষ্মণসমূহে বা রূপ-এ। আনুষঙ্গিক প্রকোপ বা উপদ্রব হল একটি মৌলিক রোগগ্রস্ত প্রক্রিয়ার ফলাফল। এই প্রক্রিয়ার শেষে হয় সুস্থ হয়ে ওঠে কিংবা মৃত্যুকালীন চিহ্ন বা অরিষ্ট ফুটে ওঠে ... বহুক্ষেত্রেই এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে কাব্য ছন্দে রাখা হয়, গদ্যে বিবরণের চাইতে পদ্য স্মরণে রাখা সহজ।” (The Madhavanidana, p. 612)
লক্ষ্যণীয় হল যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেল অথর্বেদ থেকে আয়ুর্বেদে উত্তরণ কালে। আগে যেখানে রোগের উৎপত্তি ধরা হত দেহের বাইরে দেহাতিরিক্ত পরিসরে সেটা রূপান্তরিত হল “ত্রি-দোষ” তত্ত্বে, অর্থাৎ, রোগের উৎপত্তি দেহের আভ্যন্তরীন পরিসরে যদিও দেহাতিরিক্ত একটি উপাদান রইলো “আগন্তুজ” রোগের মধ্যে। “দৈব ব্যাপাশ্রয় ভেষজ” রূপান্তরিত হল “যুক্তি ব্যাপাশ্রয় ভেষজ”-এ। এটা এক মৌলিক রূপান্তর – টমাস কুনের আধুনিক ব্যাখ্যায় বলা যায় “প্যারাডাইম শিফট”। এখানে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভূমিকা প্রধান হল, সেসময়ের প্রভাবশালী কয়েকটি বস্তুবাদী দর্শনের আত্মীকরণ হল। কিন্তু, সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও যুক্তিকে অতিক্রম করে রয়ে গেলো আপ্তোপদেশের বিশেষ গুরুত্ব। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। চরক-সংহিতা-র সূত্রস্থানম্-এর পঞ্চবিংশ অধ্যায়ে কাঙ্কায়ন ও ভরদ্বাজের মধ্যে পুরুষের সৃষ্টি ও তার রোগসমূহের প্রতিকার নিয়ে যখন বিসম্বাদ তৈরি হয়েছে সেসময় ভগবান পুনর্বসু বললেন – “তথর্ষীণাং বিবদতামুবাচেদং পুনর্বসুঃ / মৈবং বোচত তত্ত্বং হি দুষ্প্রাপং পক্ষসংশ্রয়াৎ।।” (আপনারা এরকম বাগ্-বিতণ্ডা করবেন না। কেননা এক পক্ষ নিশ্চয় করে তর্কবিতর্ক করলে যথার্থতত্ত্বে উপনীত হওয়া দুষ্কর।) এরপরে পুনর্বসু বলেছিলেন, আপনারা এই বাদসঙ্ঘট্ট পরিত্যাগ করে অধ্যাত্মবিষয়ের চিন্তা করুন। তমোরাশি দূরীভুত না হলে কখনই জ্ঞেয় বিষয়ের জ্ঞানলাভ করা যায় না। লক্ষ্যণীয় যে এক বিশেষ পটভূমিতে শব্দ এবং ব্যক্তির ভূমিকা কিভাবে কর্তৃত্বকারী এবং normative হয়ে ওঠে।
কিন্তু মিউলেনবেল্ডের গভীর পর্বেক্ষণে আয়ুর্বেদে দর্শনের উপস্থিতি নিয়ে একটি ভিন্ন চেহারাও ধরা পড়ে। তাঁর “The many faces of Ayurveda” প্রবন্ধে বলছেন – “চরক- এবং সুশ্রুত-সংহিতায় এমন সুপ্রচুর পরিচ্ছেদ আছে যা থেকে বোঝা যায় মেডিক্যাল নীতিমালার সাথে দার্শনিক ধারণা ঠিক মতো খাপ খাচ্ছেনা। চরক-সংহিতা পরিষ্কারভাবে দেখায় যে বিভিন্ন দর্শনের প্রতি সমন্বয়ধর্মী (eclectic) দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে যা সেসময়ের চিকিৎসকদের একান্ত বৈশিষ্ট্য ছিল। সুশ্রুতের সংহিতা এমনকি খোলাখুলিভাবে এই সমন্বয়ধর্মী এবং সহনশীল বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর স্বপক্ষে স্পষ্ট সওয়াল করে।”
এর আগে আয়ুর্বেদে শব্দের তারল্য এবং বহু-অর্থবাদী যে চরিত্রের কথা হচ্ছিল তার একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা পাওয়া যায় চরক-সংহিতা-র নিদান-স্থানম্-এর শুরুতেই – ব্যাধি, আময়, গদ, আতঙ্ক, যক্ষ্মা, জ্বর, বিকার ও রোগ, এই সমস্ত শব্দ একার্থে ব্যবহৃত হয়। নিদান, পূর্বরূপ, লিঙ্গ, উপশয় ও সম্প্রাপ্তি, এই সকল দ্বারা ব্যাধির উপলব্ধি হয়ে থাকে। এর পরে বলা হল – মনুষ্যগণের আটটি কারণ থেকে জ্বর উৎপন্ন হয়ে থাকে। যেমন, বায়ু, পিত্ত, কফ, বাতপিত্ত, বাতশ্লেষ্মা, ও আগন্তু কারণ। আগন্তু ছাড়া বাকি সব কারণই দেহের অভ্যন্তরে নিহিত। এখানেই আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী অবস্থান এবং আধিভৌতিক পরিসরের বাইরে রোগের অবস্থান নির্ণিত হল, যেমনটা আগে বলেছি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে চরক-সংহিতা-র শারীরস্থানম্-এর প্রথম অধ্যায়ে – যে জল দিয়ে আগে শস্য নষ্ট হয়েছিল, সে জল আবার আসতে পারে এ ভাবনা থেকে যেমন সেতু নির্মাণ করা হয়, তেমনি ভবিষ্যদ্ ব্যাধির পূর্বরূপ দেখে যে প্রতিকার করা হয় সেই প্রতিক্রিয়া অনাগত ব্যাধির নিবারণ করে থাকে। অর্থাৎ এটাই ভবিষ্যদ্ ব্যাধির চিকিৎসা।” বিমান-স্থানম্-এর সপ্তম অধ্যায়ের শুরুতে বলা হচ্ছে – যেহেতু আংশিক জ্ঞান দিয়ে সমস্ত জ্ঞেয় বিষয়ে জ্ঞান জন্মাতে পারে না, রোগজ্ঞানে বিমূঢ় বৈদ্যকে চিকিৎসাবিষয়ক যুক্তিজ্ঞানেও বিমূঢ় হতে হয়।
বঙ্গদেশের বিশিষ্ট অবস্থান এক বিশেষ চারিত্র্য অর্জন করেছিল আয়ুর্বেদে। এখানে আয়ুর্বেদের চর্চা আয়ুর্বেদের কাঠামোর মধ্যে ভৌগলিক অবস্থানগত পার্থক্যরেখা নিয়ে এলো। এ বিষয়ে ফ্রান্সিস জিমারম্যান তাঁর The Jungle and the Aroma of Meats গ্রন্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আমরা শুধু এটুকু বুঝবো যে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রুক্ষ, শুকনো অঞ্চলকে “জাঙ্গল” (আমাদের চালু ধারণার জঙ্গল নয়) বলা হত। এর বিপরীতে বঙ্গদেশকে বলা হত “আনূপ” বা রসস্থ। মনিয়ের-উইলিমাস-এর মান্য সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে আনূপ-এর অর্থ করা হয়েছে “belonging to a watery place; wet, watery, marshy”। এবং জাঙ্গল-এর অর্থ করা হয়েছে –“arid, sparingly grown with trees and plants (though not unfertile)। এখন আমরা নিশ্চয়ই দিল্লী হরিয়ানা পাঞ্জাবের ভূগোলের সাথে বঙ্গদেশের অথর্ববেদগত পার্থক্য বুঝতে পারবো। কিন্তু আয়ুর্বেদের “জাঙ্গল” কিভাবে উপনিবেশকালে অর্থগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের এখনকার চেনা ও বোঝা জঙ্গল হয়ে গেলো সে বিবর্তন এবার আমরা বুঝতে চাইবো।
জিমারম্যান যাত্রাপথটি এভাবে বিবৃত করেছেন –
“সংস্কৃতঃ
শুষ্ক ভূমি (এই ব্যঞ্জনা হিন্দিতে হারিয়ে গেছে)
অনুধ্যষিত, অকর্ষিত অঞ্চল (হিন্দিতে এই ব্যঞ্জনা রক্ষিত হয়েছে)
ক্ল্যাসিকাল হিন্দি
বন্য অঞ্চল (>অপরিমার্জিত)
অরণ্য
লম্বা ঘাস (>আগাছা)
ছবির মতো নিসর্গচিত্র
ইংরেজি
উর্বর, প্রাচুর্যময়
অস্বাস্থ্যকর, ম্যালেরিয়াবাহী অঞ্চল (> jungle fever, 1808)
সহজেই নজরে পড়বে যে প্রথম তৃতীয় ক্ষেত্রের মধ্যে অর্থের পার্থক্য। প্রথমটিতে অর্থ আসে শুষ্ক, স্বাস্থ্যকর এবং উর্বর ভূখণ্ড। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে হয়ে গেলো অস্বাস্থ্যকর, অগম্য অঞ্চল। এবং শব্দের সাথে রাষ্ট্র ক্ষমতা বা ক্ষমতার সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত। এজন্য, ব্রিটিশ-উত্তর ভারতে উপনিবেশিক ক্ষমতার হাতে প্রতিসৃত হয়ে নতুন অর্থের জন্ম হল। এবং ইউরোপীয় গবাক্ষ দিয়ে দেখতে প্রশিক্ষিত আমরা এটাকেই অর্থ বলে জানলাম। একইভাবে নব্য-আয়ুর্বেদ-এর প্রবক্তাদের হাতে পড়ে আয়ুর্বেদের শব্দভাণ্ডারের অর্থ বদলে গেছে, যদিও প্রকাশিত হয়েছে সংস্কৃতের চেহারা নিয়েই। শব্দার্থ অনেক circumscribed হল এবং, সর্বোপরি, তরলতা ও প্রেক্ষিত-নির্ভর বহু অর্থের যে সম্ভাবনা ছিলো তা বিলীন হয়ে গেলো। এরকমটা মডার্ন মেডিসিনের জগতেও ঘটেছে। আদিতে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ আধুনিক সময়ে এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দী পরবর্তী সময়ে যখন শবব্যবচ্ছেদ আবশ্যিক হয়েছে এবং হিপোক্রেটিস, অ্যারিস্টোটল এবং গ্যালেন-এর হিউমারের ধারণা মেডিসিনের জগৎ থেকে অপসৃত হবার পরে (যদিও উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অতিক্রম করেও হিউমার তত্ত্বের প্রভাব এখানে সেখানে রয়ে গেছিলো)।
আর্থার ম্যাকডোনেল এবং আর্থার কীথ-এর রচিত/সম্পাদিত Vedic Index of Names and Subjects-এর প্রথম খণ্ড থেকে জানা যাচ্ছে যে ধমনী শব্দের উৎপত্তি সম্ভবত তিনটি উৎস থেকে – ঋগবেদ, নিরুক্ত এবং অথর্ববেদ। বলা হয়েছে, অথর্ববেদে “it denotes perhaps ‘artery’ or ‘vein or more generally ‘intestinal channel,’ being coupled in some passages with Hira”। (১৯১২, পৃঃ ৩৯০) এটুকু থেকে প্রতীয়মান হয় যে ইউরোপীয় মেডিসিনের মেডিক্যাল টার্মসের মতো অতিমাত্রায় সুসংবদ্ধ ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী কোন অর্থ আয়ুর্বেদের পরিভাষায় পাওয়া যাবেনা। সুশ্রুত-সংহিতায় ধমনী এবং nerves একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার শারীরস্থানম্-এর সপ্তম অধ্যায়ে শিরা এবং vessels সমার্থক, পরবর্তীতে শিরার ইংরেজিও হয়েছে nerves. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন পিটার ব্রেটন ১৮২৫ সালে জানাচ্ছেন – “they [i.e., the “Asiatics”] have no distinct words for nerve and therefore call it Nus, Asub, Shirra, etc. in common with Ligaments and Tendons…they know not the distinction between an Artery and a Vein and consequently the appellation of Rug and Shirra are indiscriminately applied to both. The Hindee word Rug and Shirra according to the Soosrut, a Sanskrit work on Anatomy and Pathology, means blood vessels or tubular vessels of any kind.” (A Vocabulary of the Names of the Various Parts of the Human Body and of Medical and Technical Terms in English, Arabic, Persian, Hindee and Sanscrit, for the Use of the Members of the Medical Department in India, ১৮২৫, পৃঃ ১)
যাহোক, “আনূপ” অঞ্চলই হোক বা “জাঙ্গল” অঞ্চল হোক, জিমারম্যান যৌক্তিকভাবে দেখিয়েছেন, “ভৌগলিক বিভিন্নতার যে বাস্তব প্রেক্ষিত আয়ুর্বেদে বিদ্যমান ছিল সেখানে ecology (বাস্তব্যবিদ্যা) একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। উদ্ভিদকুল এবং প্রাণীকুলসহ (flora and fauna) রোগীর পরিবেশ সম্পর্কে চিকিৎসকের জ্ঞান তাঁকে রোগের সম্মুখগতি অনুমান করতে (prognosis) এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম করতো .... a biogeography absorbed into therapeutics ... a discourse on the world (natural history) is contained within a discourse on ma (medicine)।” (The Jungle and the Aroma of Meats, পৃঃ ২০)
এই অসামান্য পর্যবেক্ষণের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে উদ্ভিদকুলের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ধানের বিবরণ। চরক-সংহিতা-র সূত্রস্থানম্-এর ২৭ নম্বর অধ্যায়ে রয়েছে বিভিন্ন ধানের নাম – শূকধান্য, শমীধান্য, রক্তপালি, মহাশালি, কলম, শকুন, চূর্ণক, দীর্ঘশুক, গৌর, পাণ্ডু, অঙ্গুল, সুগন্ধিক, লোহবালা, শালিক, প্রমোদক, পতঙ্গ ও তপনীয় ধান্য এবং বিভিন্ন ধরনের শালিধান্য। এছাড়া রয়েছে রক্তপালি, মহাশালি, কলম, শকুন, চূর্ণক, দীর্ঘশুক, গৌর, পাণ্ডু, অঙ্গুল, সুগন্ধিক, লোহবালা, শালিক, প্রমোদক, পতঙ্গ ও তপনীয় ধান। আবার চরকের বিচারে সমস্ত ধানে মাঝে রক্তশালি সর্বশ্রেষ্ঠ। শালিধান তিন ধরনের – রক্তশালি, মহাশালি এবং কল্ম। এরপরেও আছে যবক, হায়ন, পাংশু, বাপ্য এবং নৈষধক প্রভৃতি ধান। রয়েছে ষষ্টিক, বরক, উদ্দালক, চীন, শারদ, উজ্জ্বল, দর্দ্দুর, গন্ধল, কুরুবিন্দ, ব্রীহি, কোরদূয়, শ্যামাক, হস্তিশ্যামাক, নীবার, তোয়পর্ণী, গবেধুক, প্রশাতিকা, জলশ্যামাক, লোহিতানু, প্রিয়ঙ্গু, মুকুন্দ, ঝিন্টি, গর্মুটি, চরুকা, বরক, শিবির, উৎকট এবং জুর্ণা। এগুলো আনূপ অঞ্চলের খাদ্য। জাঙ্গল অঞ্চলের খাদ্যের মধ্যে পড়ে – যব, গোধূম (নান্দীমুখী এবং মধুলী), মাষকলাই ইত্যাদি।
এরপরে “অথ মাংসবর্গ” শিরোনামে বিভিন্ন প্রাণীর মাংস যা বিভিন্ন ধরনের রোগীর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রয়োজন পড়ে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখনকার সময়েও তালিকা দেখলে আয়ুর্বেদাচার্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদের গণ্ডীর বাইরে অবস্থান এবং “সেক্যুলার” দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় – যদিও অনেক মৌলিক চিন্তাতেই আপোষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এঁরা। যাহোক, কোন কোন প্রাণীর মাংস রোগীর পথ্য হিসেবে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিবেচিত হবে তার তালিকাটি এরকম – শৃমর, চমর, খড়গ, মহিষ, গবর, হস্তী, নঙ্কু এবং শূকর প্রভৃতিকে আনূপ পশু বলে। রুরু প্রভৃতি মৃগরাও আনূপ শব্দের বাচ্য। এই তালিকায় রয়েছে গো, গর্দভ, অশ্বতর, উষ্ট্র, ঘোটক, চিতাবাঘ, সিংহ, ভল্লুক, পেঁচা, ধুমীক অর্থাৎ ফিঙ্গা পাখী, কচ্ছপ, কর্কটক, মৎস্য, শিশুমার, তিমিঙ্গিস, শুক্তি ইত্যাদি। জাঙ্গল পশুদের নাম – পৃষৎ, শরভ, রাম, শ্বদংষ্টা, মৃগমাতৃকা, শশ, উরণ, কুরঙ্গ, গোকর্ণ, কোট্টকারক, চারুষ্ক, হরিণ, এণ, শম্বর, কালপুচ্ছক, ঋষ্য এবং ভরপোত। এর সাথে যুক্ত হবে ছাগ ও মেষ মাংস। ময়ূরের মাংস, কুক্কুট মাংস, গোসাপের মাংস, শজারুর মাংস, শশক মাংস, গোমাংস, বরাহ ও শূকরের মাংস, মহিষের মাংস। সবশেষে বলা হচ্ছে – “শরীরপোষকের মধ্যে মাংসাপেক্ষা অন্য কোন খাদ্য শ্রেষ্ঠ নহে।”
বর্তমান ভারতবর্ষে এরকম “বিপজ্জনক” খাদ্যবিধিকে অনুমোদন দেওয়া প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে – যেখানে একইসাথে গরু, মহিষ, শূকর, ময়ূর, শজারু, ভল্লুকের মাংস ভক্ষণের বিধান দেওয়া আছে রোগীর এবং রোগের প্রয়োজন অনুযায়ী। একে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে, নির্বিষ, নিরামিশ এবং নিরীহ করে কেবলমাত্র ফার্মাকোলজির অংশটুকুকে গ্রহণ করে AYUSH-এর মধ্যে নিয়ে এসে একটি একমাত্রিক আয়ুর্বেদ তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যেকার বহুস্তরীয়, বহুত্ববাদী, বহু-অর্থবাহী চরিত্র বিলীন হয়ে বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির চিকিৎসা জগতের বাহক আয়ুর্বেদ (মিউলেনবেল্ড, জিমারম্যান এবং অন্যান্য স্কলাররা এমনটাই মনে করেন) পর্যবসিত হয়ে যাবে রাষ্ট্র অনুমোদিত নির্জীব, নিষ্প্রাণ একমাত্রিক একটি চিকিৎসাবিধিতে।
পেছনে ফিরে তাকালে আমরা বুঝতে পারবো এরকম একমাত্রিক এবং “নিরীহ” হয়ে ওঠার সূচনা হয়েছিল “নব্য-আয়ুর্বেদ”-এর প্রবক্তাদের হাত ধরে। ১২৯২ বঙ্গাব্দে চিকিৎসা সম্মিলনী পত্রিকার একটি সংখ্যায় শীতলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় “আয়ুর্বেদ বৈজ্ঞানিক না অবৈজ্ঞানিক” শিরোনামে প্রবন্ধে লিখছেন – “বর্তমান সময়ে ইংরেজ শিষ্যগণ উচ্চপদারূঢ়, অন্তত তাহাদের সংখ্যাই অধিক। তাঁহাদের যে শাস্ত্রের উপর আস্থা দাঁড়াইবে, সাধারণে তাহাই মান্য করিয়া চলিবে।” আরেকটি পত্রিকা অণুবীক্ষণ-এ (১২৮২ বঙ্গাব্দ) “দেশীয় ঔষধ ও তাহার শিক্ষক” প্রবন্ধে লেখা হচ্ছে – “ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্র এদেশে আসাতে এদেশীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের হতাদর হইয়াছে। রাজা উৎসাহ না দিলে কোন শাস্ত্র ব্যবহৃত হইতে বা কোন শ্রেণীস্থ পণ্ডিত উন্নতি লাভ করিতে পারে না। সত্যের গুরুতর বল সন্দেহ নাই কিন্তু আদৃত ব্যক্তি সাধারণের মনে সহজে স্থান পায় না।” এবার উপায়? নব্য-আয়ুর্বেদের প্রবক্তাদের কাছে সহজ এবং পরীক্ষিত ও প্রমাণিত পথ ছিলো ইউরোপীয় অ্যানাটমির জ্ঞানকে আয়ুর্বেদে আত্মীকরণ করে নেওয়া এমন ব্যাখ্যা দিয়ে যেন এটাই আয়ুর্বেদে হবার কথা ছিল এবং আয়ুর্বেদে সব উপাদানই ছিল। আমাদের কাজ হল শুধু সাজিয়ে গুছিয়ে আয়ুর্বেদের নতুন টেক্সটে বসিয়ে দেওয়া প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা সমেত। স্বাস্থ্য পত্রিকার (১৮৯৯ সাল) একটি সংখ্যায় “প্রাচীন হিন্দুর চিকিৎসা জ্ঞান” প্রবন্ধে স্পষ্ট ভাষায় লেখা হয়েছে – “শবব্যবচ্ছেদের শিক্ষা ব্যতিরেকে যে অস্ত্র চিকিৎসায় পারদর্শিতা লাভ হয় না এ কথা বলাই বাহুল্য।” এমনকি “বিবাহ বিচার”-এর মতো প্রবন্ধে (চিকিৎসা সম্মিলনী, ১৮৮৮ সাল) অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার বিবাহের বিচারে আধুনিক অ্যানাটমির জ্ঞানকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো হল – “আমাদের পাঁজরের অস্থিসকল ২৫ হইতে ৩০ বৎসরের মধ্যে সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। .... পাছার অস্থি দুইখানি ২৫ বৎসরে পূর্ণ হয়। ঊরুদেশের অস্থিখানি পরিপক্ক হইতে বিশ বৎসর আবশ্যক।”
এরই চূড়ান্ত রূপ এলো বাংলায় গণনাথ সেন, মাদ্রাজে গোপালাচারলু, কেরালায় ভেরিয়ার প্রভৃতিদের হাত ধরে।
(বাঁদিকের ছবিটি ১৯০২ সালে আয়ুর্বেদের এক পুস্তকে ব্যবহৃত। ডানদিকেরটি বিখ্যাত গ্রে’জ অ্যানাটমি-র ১৮৯৫ সালের সংস্করণ থেকে)
(একই পুস্তক থেকে গৃহীত এই দুটি ছবি। বলার অপেক্ষা রাখেনা সেসময়ের প্রচলিত ইংরেজি অ্যানাটমির টেক্সট বই থেকে তুলে নেওয়া। এবং মস্তিষ্ক এবং হৃদযন্ত্র এ দুটি অঙ্গ নিয়ে কোন ধারণা আয়ুর্বেদে নেই, ডায়াগ্রামের প্রশ্নই ওঠেনা কারণ এদশে ছবি আঁকার চল প্রায় ছিলনা বললেই চলে, বিশেষ করে আনূপ এবং জাঙ্গল অঞ্চলে। মুঘল মিনিয়েচার আর্ট অনেক পরের সংযোজন। দেহের অভ্যন্তর সম্পর্কে কোন ধারণা আয়ুর্বেদে নেই। কারণ শবব্যবচ্ছেদ না হবার কারণে দেহের অভ্যন্তর প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলো। এজন্য আয়ুর্বেদকে “আধুনিক” করতে গিয়ে কুম্ভীলকবৃত্তির আশ্রয় নিতে হয়েছে।)
এবার গণনাথ সেনের শারীর-পরিচয় (পূর্বার্দ্ধ) গ্রন্থ থেকে কয়েকটি চিত্র এখানে রাখছি। আমরা দেখবো আধুনিক অ্যানাটমি বইয়ের থেকে টুকে নিয়ে/তুলে নিয়ে তাঁর বইয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রতিটি চিত্রে যুক্ত করা হয়েছে সংস্কৃত (বা বাংলা) নাম। দক্ষিণ ভারতে একই ভাবে আধুনিক ইলাস্ট্রেশনে আঞ্চলিক শব্দ বসিয়ে অ্যানাটমির “বিশ্বাসযোগ্যতা” বাড়ানো হয়েছে। নীচে গণনাথ সেনের পুস্তকে ব্যবহৃত চিত্র।
(এই চিত্রে সমস্ত লিগামেন্ট, ক্যাপসুল, সাইনোভিয়াল স্পেস, এমনকি বোন ম্যারো পর্যন্ত নিখুঁতভাবে দেখানো হয়েছে। স্বয়ং সুশ্রুতও কোনদিন এভাবে দেখানো যেতে পারে সুদূর কল্পনাতেও ভাবেননি।)
নীচের চিত্রটিতে মাথার খুলির স্যাজিটাল সেকশন অবধি দেখানো হয়েছে।
চিত্রের, অন্তর্বস্তুর এবং আয়ুর্বেদের চিত্রকল্পের এরকম রূপান্তর নিয়ে জিমারম্যানের পর্যবেক্ষণ – “Through a kind of retrospective rationalization, the image of channels in a rice paddy is replaced by a modern image, one familiar to any twentieth-century high-school student; namely the anatomical diagram”। গণনাথ সেন তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে আয়ুর্বেদের অবক্ষয় এবং পুনর্জাগরণ নিয়ে বলেছিলেন যে বৌদ্ধ এবং যবন মুসলমানদের হাতে পড়ে “শবব্যবচ্ছেদ একেবারে বিলুপ্ত হয় এবং আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসক শারীরতত্ত্বে নিতান্ত অনভিজ্ঞ হইয়া পড়েন। এইরূপে শারীর জ্ঞান বর্জিত চিকিৎসকের সংখ্যার আধিক্য বশতঃ আয়ুর্বেদের যথেষ্ট অবনতি ঘটে।” এখানেই ঈশ্বর-প্রেরিত উদ্ধারকারী হিসেবে ইংরেজের আবির্ভাব। গণনাথের ভাষায় – “নষ্টপ্রায় ভারতীয় বিদ্যার এবং বিপ্লবপীড়িত প্রজার উদ্ধারের জন্যই যেন বিধাতা কৃপা করিয়া উদার-হৃদয় ইংরাজ জাতিকে এদেশে প্রেরণ করিয়াছেন ... বহুদিনের পর ভারতবর্ষের নানা স্থানে আয়ুর্বেদের একটা নতুন জাগরণ দেখা যাইতেছে।” (শারীর-পরিচয় (পূর্বার্দ্ধ), ১৯২৪, পৃঃ ১৬) প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গণনাথ সেন আয়ুর্বেদের মহামহোপাধ্যায় হবার পরেও মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনো করেছিলেন। ফলে শবব্যবচ্ছেদের কাজে নিজে নিযুক্ত ছিলেন, শবব্যবচ্ছেদের জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। সম্যকভাবে বুঝেছিলেন মেডিসিনে শবব্যবচ্ছেদের গুরুত্ব।
সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে যা হল, এতদিন আয়ুর্বেদে প্রধানত যে চর্চা চলছিল তা হল টেক্সটে যা আছে তাকে সুপ্রমাণিত করা। সেটা মূলগতভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়ে হল শবব্যবচ্ছেদ এবং রোগীর বেডসাইড ক্লিনিক্যাল অবস্থা যে শেখায় তা নতুন জ্ঞানের জন্ম দেবে। Text-as-authority রূপান্তরিত হল পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানে। মৃতদেহ শিক্ষিত করে তুললো জীবিত দেহ সম্পর্কে, জ্ঞানবানও করে তুললো। ভারতীয় টেক্সটের সুপ্রাচীন কর্তৃত্ব, জীবন্ত এম্পিরিক্যাল ও এক্সপেরিয়েনশিয়াল জ্ঞান চিরকালের জন্য আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার জগতে হারিয়ে গেলো। আধুনিক মেডিসিনের সমকক্ষ হতে গিয়ে আয়ুর্বেদ এর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে প্রকারান্তরে এবং প্রয়োগভেদে আধুনিক ভিন্নতর প্রসারিত রূপ হয়ে উঠলো। বর্তমানে AYUSH-এর ক্ষমতাবৃদ্ধির মাঝে এটা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। আয়ুর্বেদ নামটি রয়েছে প্রবলভাবে, কেবল “তোতাকাহিনী”-র মতো আয়ুর্বেদের অন্তরাত্মা নেই। কিন্তু ভিন্ন ঢং-এ এবং চেহারায় AYUSH-এর নির্ধারিত আয়ুর্বেদ text-as-authority হিসবে ঐতিহাসিক চরিত্র অর্জন করছে।
সমৃদ্ধ হলাম খুব সহজ ভাষায় তথ্যসমৃদ্ধ লেখা । এই ধরনের লেখা সবার কাছে পৌঁছানো উচিত
খুবই ভালো লাগলো, সুন্দর লেখা
খুব ভাল লাগল মন ভরে গেল .
খুব ভাল লেখা ,মন ভরে গেল
খুব ভাল লেখা ,মন ভরে গেল
সমৃদ্ধ করল।
অসাধারণ লেখা l তোমার প্রচুর পরিশ্রমের ফসল আমি তোমার লেখা থেকে আত্মস্থ করতে চেষ্টা করলাম l আমি অনেক বন্ধুকে এটা পাঠালাম l তারা পাঠানোর জন্যে আমাকে ধন্যবাদ দিলো l গর্বিত আমার বন্ধুর জন্য l
অসামান্য, এটা নিয়ে আরো বড়ো করে লেখ, দাদা।
ডা: জয়ন্ত ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ টি সুখিলিত ও প্রচুর তথ্য সমৃদ্ধ। আশা করি এভাবে তিনি আমাদের আরো বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হবার অবকাশ দেবেন।
ভালো লাগলো পড়ে। তাহলে কি
ব্রাহ্মণ্যবাদই পিছিয়ে পরার অন্যতম কারণ?
Excellent sir
সমৃদ্ধ হলাম
খুব ভালো
ডাক্তার জয়ন্ত ভট্টাচার্য --ভাইজীবনের আয়ূর্বেদ ও সালয়া চিকিৎসা সম্পর্কিত লেখাটি বার বার পরেছি i
অসাধারণ এই লেখনী ও তার বক্ত্যব্য
. .
Etato agei porechhi, lekhata pore ayurbeder itihas jana abang bojha galo .
Amrato asab khubi Kam jani. Tor lekha ato sahoj r sabolil je bujhteo sadharon manuser subidha hay.
অভাবনীয় ভালো একটি প্রবন্ধ! ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক ঐতিহ্যের সন্ধান। অনেক ধন্যবাদ।
অসাধারণ লেখা। গবেষণালব্ধ এরকম একটি লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।
লেখাটা দারুণ । সমৃদ্ধ হলাম ।