২০০৫ সালের ২৪-৩০ জুলাই। আমি তখন বেইজিং-এ গিয়েছি “ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ হিস্টরি অফ সায়ান্স”-এর ২২তম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে একজন প্রতিনিধি হিসেবে প্রান্তিক রায়গঞ্জ থেকে। কোন সন্দেহ নেই, এক সময়ের অনেক স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের সাথে জড়িয়ে থাকা চিনে যাব এরকম ভাবনা বিলক্ষণ কিছু শিহরণ তৈরি করেছিল।
পৃথিবীর প্রায় ১০০ দেশের বিজ্ঞানী, গবেষক, বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক, এমনকি নোবেলজয়ীও এসেছেন এই কংগ্রেসে যোগ দিতে। এখানে তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রের গবেষণাকর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন, করবেন মত বিনিময় এবং বিতর্ক। ভারত থেকেও হাতে গোণা কয়েকজন গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
ফ্রান্সের সোরবোন ইউনিভার্সিটির এক বিজ্ঞান-গবেষক অধ্যাপক (এখন নাম মনে করতে পারছিনা) তাঁর আকর্ষণীয় আলোচনায় ফোর্থ ডাইমেনসন তথা চতুর্থ মাত্রার ওপরে একটি ফিল্ম দেখিয়ে আলোচনা করলেন। কিন্তু মুশকিল হল, খুব সহজ করে ফোর্থ ডাইমেনসন নিয়ে আলোচনা করার পরেও বিষয়টিকে আমি মাথায় নিয়ে রাখতে পারলাম না। তৃতীয় মাত্রা অব্দি ভেবে কাজ করা আমি যে কি করে আরেকটি মাত্রাকে হৃদয়ঙ্গম করব তার কোন হদিশ করতে পারলাম না। সুখের কথা, আমি হেন আকাট ছাড়াও বিদেশের আরও কিছু শিক্ষককে পেয়েছেছিলাম যাঁদের দশা আমারই মতো – ডাঙ্গায় তোলা কাতল মাছ তুল্য। এসব জেনে আমি কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত বোধ করেছিলাম – এই আর কি!
যাহোক, ফিল্ম দেখানোর পরে সে গবেষক একটি চাঞ্চল্যকর গবেষণাপত্র পাঠ করলেন। গবেষণাপত্রে তিনি কঠোর এবং প্রামাণ্য যুক্তিক্রম দিয়ে দেখালেন ফরাসী বিজ্ঞানী পঁয়কারে (Poincare) আইনস্টাইনের কিছু আগে বা সমসাময়িক কালে “আপেক্ষকিতার বিশেষ তত্ত্ব”-র (স্পেশাল থিওরি অফ রেলাটিভিটি) মূল আংকিক বনিয়াদ আবিষ্কার করেন। সে উপস্থাপনায় অধ্যাপকের আক্ষেপ ছিল যে পঁয়কারের ‘বৈষয়িক’ বুদ্ধি কম থাকার জন্য আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়েছেন পরে (প্রসঙ্গত আইনস্টাইন একটি পেটেন্ট অফিসেই চাকরি করতেন)। এজন্য পৃথিবী আবিষ্কর্তা হিসেবে আইনস্টাইনের নাম জেনেছে, পঁয়কারে থেকে গেছেন অবহেলিত প্রান্তিক চরিত্র হিসেবে। এ বিশেষ গবেষণাকে আমাদের অভ্রান্ত বলে মান্যতা দেবার কোন কারণ নেই। গবেষণার মাঝে ফরাসী জাত্যাভিমান প্রকট, এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই – যেমনটা নিউটন এবং লিবনিজের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কিন্তু সে কংগ্রেস থেকে এ কথা আরেকবার বিলক্ষণ বুঝেছিলাম যে পঁয়কারে উপযুক্ত স্বীকৃতি পান বা না পান অন্ততঃ যে ৫ জন বিজ্ঞানীকে আইনস্টাইন তুল্য মেধা ও গবেষণা শক্তির অধিকারী বলে গণ্য করা হয় তাঁরা হলেন – পঁয়কারে, বোর, শ্রয়েডিংগার, হাইজেনবার্গ এবং ফার্মি। এদের পরবর্তী তুল্য মেধার অধিকারী ফাইনম্যান, অটো হান প্রমুখরা।
আমি বিজ্ঞানের ইতিহাস লিখতে কিংবা বিজ্ঞানীদের গবেষণাকর্মের তুলনামূলক আলোচনা করতেও বসিনি। আমার আলোচনার বিষয় একেবারে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ। কিন্তু ভাবলে শিহরিত হতে হয়, এই পৃথিবীতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ৩০-৪০ বছরে এক সঙ্গে এতজন অনৈসর্গিক মেধাসম্পন্ন বিজ্ঞানী দুনিয়ার যাবতীয় অদলবদল সৃষ্টিকারী গবেষণাগুলো তাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে করেছেন। শুধু করেন নি, সর্বোচ্চ স্তরের গবেষণাতে মগ্ন থেকেছেন। এরকম এক পরিবেশে যেখানে প্রায় সমধর্মী বিষয়ের ওপরে এরকম স্তরের মেধারা কাজ করছেন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সেখানে বিজ্ঞানের জগত বদলে দেওয়া আবিষ্কারগুলো তো হবেই।
ভাবার মতো বিষয় হল, এ সব আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই কাজ করে ইংরেজিতে যাকে বলে serendipity – আকস্মিকভাবে কোন ভালো আবিষ্কারের সন্ধান পেয়ে যাওয়া। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কোন চিন্তা বা সমাধান একটি মেধাবী সৃষ্টিশীল মননে ধরা দেয়। পঁয়কারে বিষয়টিকে দেখেছেন এভাবে – “They are those which reveal to us unsuspected kinship between other facts, long known, but wrongly believed to be strangers to one another. Among chosen combinations the most fertile will often be those formed of elements drawn from domains which are far apart. Not that I mean as sufficing for invention the bringing together of objects as disparate as possible; most combinations so formed would be entirely sterile. But certain among them, very rare, are the most fruitful of all.” (Henri Poincare, “Mathematical creation”, Resonance February 2000, 85-94. Reprinted from Science et méthode, 1908)
Serendipity কথাটি এসেছে সেরেন্ডিপ থেকে। পারস্য দেশের এক লোককথা ছিল যার ইংরেজি অনুবাদ হয়েছিল The Princes of Serendip শিরোনামে। New Shorter Oxford Dictionary জানাচ্ছে – আজকের শ্রী লংকাকে একসময়ে সেরেন্ডিপ বলা হত। ১৭৫৪ সালে ইংরেজ লেখক তথা চিন্তাবিদ হোরেস ওয়ালপোল তাঁর বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে serendipity শব্দটি ব্যবহার করেন। তারপর থেকে বৈজ্ঞানিক, স্রষ্টা ও শিল্পী মহলে এটা চালু শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। New Shorter Oxford Dictionary থেকে জানা যাচ্ছে serendipitous শব্দের প্রধান অর্থ – “Of people: having a supposed talent for making happy and unexpected discoveries by accident”। Serendipity বা serendipitous জাতীয় বৈশিষ্ট্য থেকে বহু যুগান্তকারী আবিষ্কার বিজ্ঞানের এবং চিকিৎসার জগতে হয়েছে। কিন্তু এর উপযুক্ত নিউরোলজি-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা এখনও অধরা।
আমি বেইজিং কংগ্রেসের আঙ্গিনায় ফিরি। বেইজিং কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিলেন ১৯৫৭ সালে ফিজিক্সে নোবেলজয়ী চেন নিং ইয়াং (আধুনিক উচ্চারণে ইয়াং ঝেন্নিন)-এর ভাষণ। তখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ। ১৯৫৬ সালের কথা যখন তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কণা পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর সহ-গবেষক সুং-দাও লি। নোবেল কমিটি তাঁদের বক্তব্যে জানালো যে এঁদেরকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে “for their penetrating investigation of the so-called parity laws which has led to discoveries regarding the elementary particles”। যখন এঁরা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তখন কণা পদার্থবিদ্যা এর শৈশবাবস্থায় রয়েছে বলা যায়।
এ সময়ে এঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল – প্রকৃতিতে যে সমস্ত symmetry-কে আমরা এতদিন স্বাভাবিক বলে ধরে এগিয়েছি তার মাঝে একটা ফাঁক আছে, এটা তাঁরা বারংবার অনুমান করছিলেন। কিন্তু ফাঁকটা ঠিক কোথায় ধরে উঠতে পারছিলেন না। যে রেস্তোরাঁতে এরা প্রতিদিন দুপুরে খেতে যেতেন সে রেস্তোরাঁয় একদিন খাবার সময়ে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ইয়াং-এর মাথায় সমাধানটি ধরা দেয়। যেন serendipity-র জীবন্ত উদাহরণ।
সুং-দাও লি-ও একই সমাধানের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ১৯৫৭ সালে যৌথভাবে নোবেল প্রাপ্তি। সম্ভবত আজ অবধি যত নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে এ পুরষ্কারটি তার মধ্যে দ্রুততম – ১৯৫৬ সালে তত্ত্বায়ন এবং ১৯৫৭ সালে নোবেল জয়। নোবেল কমিটির সাইটেশনে আরও বলা হয়েছিল – “Chen Ning Yang and Tsung-Dao Lee formulated in 1956 a theory that the left-right symmetry law is violated in weak interactions. Measurement of the decay of electrons from a cobalt isotope confirmed the symmetry violation.”
এঁদের পুরষ্কার পাবার পরে ঐ রেস্তোরাঁ আরও এক ধাপ এগিয়ে একটি জানালার পাশে (যেখানে চেন নিং ইয়াং বসতেন) বড়ো করে নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছিল – “Eat here, get Nobel Prize”। মোদ্দা কথা হল, আমাদের চোখের সামনে দীর্ঘদিন ধরে আপাত-সম্পর্কহীন যে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে সেগুলোর অনেক কিছুর মাঝেই বিভিন্ন ধরনের যোগসূত্র আছে। গভীরভাবে অনুসন্ধিৎসু মননে ও চিন্তায় সে সম্পর্ক ধরা দেয়। আমরা মানব মস্তিষ্কের খুব সামান্য অংশই জানি। মগজের ক্রিয়া-কলাপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিষ্কার বা ব্যাখ্যাত নয়। প্রতি মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন একে জানার এবং সম্যকভাবে বোঝার।
একটি বিষয় স্নায়ু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বোঝা গেছে – যাঁরা ভাবুক, অনেক বেশী গভীরতায় চিন্তা করতে পারেন, নতুন উদ্ভাবনী শক্তি আছে তাঁদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে নিউরোন ও গ্লায়াল কোষের সজ্জা এবং অনুপাত আমাদের মতো গড়পড়তা মানুষের থেকে ভিন্ন। গ্লায়াল কোশের সংখ্যা তুলনায় আনুপাতিকভাবে স্বল্প হলেও বেশী। এখানে হয়তো সেরেন্ডিপিটির সাথে মস্তিষ্কের যোগাযোগের একটা সম্ভাবনা সূত্র থাকতে পারে। আধুনিক গবেষণাও সেদিকে ইঙ্গিত করে। ২০২১ সালে Behavioral Neuroscience জার্নালে গৃহীত (৪ আগস্ট, ২০২১) একটি প্রি-প্রিন্ট পেপারে বলা হয়েছে – “Serendipity favors the prepared mind, but how does the brain make that lucky find? Analyzing the cerebral mechanisms behind an exceptional (albeit trivial) discovery, the author suggests that a combination of ‘concept cells’ and the Global Neuronal Workspace Hypothesis could explain how we make great discoveries.” (Daniel Kondziella, “Serendipity and the Brain, or How We Make Great Discoveries”)
সেরেন্ডিপিটির দুনিয়ায় আরেকটি উদাহরণ – বিংশ শতাব্দীর নামী শিল্পী চাক ক্লোজে (Chuck Klose) বিমূর্ত শিল্প সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে দুটো ছবি এঁকে ফেললেন। আঁকার পরে আবিষ্কার করলেন – দর্শক এবং তিনি, উভয়েই – ছবিটিকে স্বাভাবিক দূরত্ব থেকে দেখলে একটি বিমূর্ত শিল্পের নিদর্শন হিসেবে মনে করবে, যেখানে ক্যানভাসের ওপরে বেশ কিছু চকলেট পড়ে আছে মনে হয়। একটু দূরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবয়ব।
জীব বিজ্ঞানের একটু উঁচু ক্লাসের ছাত্র বা বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষই হয়তো জার্মান নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী পল আর্লিখের (Paul Ehrlich) নাম জানবে। ইনি একজন বিশেষ প্রতিভাধর বিজ্ঞানী। কাজ করেছেন মারণান্তক রোগ সিফিলিস নিয়ে, এর প্রথম ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। কাজ করেছেন ইমিউনোলজি এবং হেমাটোলজি নিয়ে, এমনকি ক্যান্সার নিয়েও। ১৯০৮ সালে নোবেল প্রাইজ পান ইমিনোলজিতে। “ম্যাজিক বুলেট” তথা অ্যান্টিবায়োটিকের ধারণা প্রথম আসে আর্লিখের মাথায়, যে সময়ে তিনি সিফিলিসের ওষুধ salvarsan নিয়ে কাজ করছিলেন। সে সময়ে আরেকটি বিষয়ও তাঁর মনে হচ্ছিল – তিনি যেসব রাসায়নিক গঠন নিয়ে কাজ করছেন বা ভাবছেন সেগুলো চোখ বন্ধ করলে স্বপ্নে দেখতে পান যেন। ১৮৭৭ সালে তাঁর বন্ধু C. A. Herter-কে এক চিঠিতে লেখেন – “I also, in fact, believe that my real natural endowment lies in the domain of Chemistry; and mine is indeed, as you know, a kind of visual, three-dimensional Chemistry. The benzene-rings and structural formulae really disport themselves in space before my mind’s eye, and I believe that it is just this faculty which has been of supreme value to me in my later studies. I might say, indeed, that my chemical imagination was very strongly developed, and that with the help of this natural gift I have been able to anticipate many things, which were recognized only much later by the followers of pure Chemistry.” (The Collected Papers of Paul Ehrlich. in Four Volumes Including a Complete Bibliography, F. Himmelweit (Eds.) ১৯৫৬, পৃঃ ৯)
একে সেরেন্ডিপিটি ছাড়া আর কিছু বলা যাবে? একজন বিপুল প্রতিভাধর মানুষ যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবেন বলে গভীরভাবে ভাবছেন সেগুলোর রাসায়নিক চরিত্র যেন মনের অভ্যন্তরে মনশ্চক্ষে আগেই দেখতে পাচ্ছেন!
এক্স রশ্মির (এক্স-রে) আবিষ্কারক রন্টগানের (Wilhelm Conrad Röntgen) নাম তো সবার জানা। রন্টগান কাজ করেছেন ক্যাথোড রশ্মি এবং এর বিচ্ছুরণ নিয়ে। কাজ করতে গিয়ে তাঁর চোখে কিছু কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ছিল যা ক্যাথোড রশ্মির স্বাভাবিক আচরণের সাথে মেলে না। অথচ কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এরকম এক সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রী কোন কারণে তাঁকে কফি দেবার জন্য ঢোকেন এবং তাঁর হাত ঐ রশ্মির সামনে চলে আসে। পরে রন্টগান যখন ফটো ফিল্মগুলো ধুচ্ছেন তখন অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন তাঁর স্ত্রীর হাতের ছবি উঠেছে। আলোক রশ্মির এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। সেরেন্ডিপিটি এক অসাধ্যকে সাধ্য করে তুললো মানব জীবনে। নতুন দিশা খুলে গেল রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে।
(বাঁ দিকে, রন্টগানের স্ত্রী Anna Bertha Ludwig-এর চিত্র। ডান দিকে, অ্যানাটমিস্ট Albert von Kölliker-এর উন্নত চিত্র। ঋণঃ উইকিপিডিয়া)
সুকুমার রায়ের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন সবার মনে আছে নিশ্চয়ই – “খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হাতি লোফেন যখন তখন”। তা না হয় হল। কিন্তু হাঙ্গেরির নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট জেন্ট-গিয়োর্গি (Albert Szent-Györgyi) বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এরকম হাতি লোফালুফির কাজ করেছেন। ১৯২৭ সালে এক সেরেন্ডিপিয় (serendipitous) মুহূর্তে আচমকা আবিষ্কার করলেন হেক্সুরোনিক অ্যাসিড (hexuronic acid)। এই হেক্সুরোনিক অ্যাসিড আদতে ভিটামিন সি বা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। এঈ আবিষ্কারের পরে বিপাক ক্রিয়ার ক্রেবস চক্র (Kreb’s cycle) এবং মাংসপেশি নিয়ে কাজ শুরু করলেন। ১৯৩৭ সালে নোবেল পুরষ্কার পেলেন। নোবেল সাইটেশনে উল্লেখ করা হল – “for his discoveries in connection with the biological combustion processes, with special reference to vitamin C and the catalysis of fumaric acid”। আবিষ্কার সম্পর্কে তাঁর নিজের উপলব্ধি ছিল – আবিষ্কার এমন একটা ব্যাপার যেখানে কোন একটি বিষয় সবাই মিলে দেখছে এবং ভেবে চলেছে, কিন্তু আবিষ্কারক ছাড়া অন্য কেউ সেটা ভেবে উঠতে পারেনি।
ওয়ার্ল্ড জার্নাল অফ ক্লিনিকাল অঙ্কোলজি-র মতো সুবিদিত জার্নালে (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর প্রায় ৫) ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় “Serendipity in anticancer drug discovery” শিরোনামে। এ গবেষণা পত্রে দেখানো হয় অ্যান্টি-ক্যান্সার ড্রাগের ২৪%-এর ওপরে আবিষ্কৃত হয়েছে পরীক্ষাগারের কঠোর নিয়মে নয়, বিভিন্ন serendipitous মুহূর্তে – “in total, 24.1% (347/1437) of marketed drugs can be directly traced to serendipitous events confirming the importance of this elusive phenomenon. In the case of anticancer drugs, 35.2% (31/88) can be attributed to a serendipitous event, which is somewhat larger than for all drugs. The therapeutic field that has benefited the most from serendipity are central nervous system active drugs reflecting the difficulty in designing compounds to pass the blood-brain-barrier and the lack of laboratory-based assays for many of the diseases of the mind.” (World J Clin Oncol 2012 January 10; 3(1): 1-6)
এত সবের মাঝেও সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর পেনিসিলিন আবিষ্কার। বেশ ক’বছর ধরে তিনি গবেষণা করছিলেন, এমন কোন ছত্রাক পাওয়া যায় কি না যা যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় তাকে প্রতিহত করতে পারে। ১৯২৮ সালের গ্রীষ্মকালে – তারিখটা ২ সেপ্টেম্বর – ফ্লেমিং পারিবারিক ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসে যে পেট্রি ডিশগুলো ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো পরিষ্কার করতে গেলেন। তাঁর মুখ থেকে নিজের অজান্তে সহকর্মীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এল সে বিখ্যাত উক্তি – It is funny!
ফ্লেমিং অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, একটি পেট্রি ডিশে পেনিসিলিয়াম স্পোরের আশেপাশে কোন ব্যাক্টেরিয়া (staphylococcus) নেই। তিনি অনবধানতা বশত দুটি “ভুল” করেছিলেন – (১) ছুটিতে যাবার আগে পেট্রি ডিশগুলো পরিষ্কার করে রেখে যান নি, এবং (২) ল্যাবরেটরির জানলা খুলে রেখে গিয়েছিলেন। পেট্রি ডিশগুলো পরিষ্কার না করার জন্য দীর্ঘসময় ধরে অল্প অল্প করে পেনিসিলিন তৈরি হয়েছে যা ব্যাক্টেরিয়ার ওপরে কাজ করেছে। এবং, দ্বিতীয়ত, জানলা খোলা থাকার জন্য বাতাসের সে সময়ের গতিবেগের ওপরে নির্ভর করে নীচের তলায় যারা যারা পেনিসিলিয়াম নিয়েই গবেষণা করছিল তাদের কোন একটি স্পোর খোলা জানলা দিয়ে এসে ফ্লেমিং-এর পেট্রি ডিশের ওপরে পড়ে ও আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকে।
এরকম কোন ঘটনা ফ্লেমিং-এর সুদূরতম চিন্তাতেও ছিল না, ছিল বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা। সেরেন্ডিপিটি সম্ভব করে তুললো চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার।
আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ-এর বিজ্ঞানী Edward D. Korn জার্নাল অফ বায়োলজিকাল কেমিস্ট্রি-তে জার্নালের শতবর্ষ পূর্তিতে আমন্ত্রিত প্রবন্ধ লেখেন “The Discovery of Unconventional Myosins: Serendipity or Luck?” (Volume 279, ISSUE 10, P8517-8525, March 2004)। কর্ন অপ্রচলিত (unconventional) মায়োসিনের (মাংস পেশির প্রোটিন) ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ (দ্রষ্টব্যঃ “The Unconventional Myosins and Edward D. Korn”, Journal of Biological Chemistry July 2006, E22-E24)। যাহোক, আমন্ত্রিত প্রবন্ধটিতে কর্ন বলেন – “Perhaps it was serendipity that led me from lipoprotein metabolism to endocytosis to actin to myosin, but it was luck that actin and myosin were being studied in the same laboratory by Wayne Kielley (whom I had known at Penn where he was a postdoctoral fellow of Otto Meyerhof), Bob Adelstein, and Evan Eisenberg, each of whom freely offered the guidance I needed.” (পৃঃ ৮৫২৩)
পৃথিবীর নামী অ্যাবডোমিনাল রেডিওলজিস্ট মর্টন মেয়ার্স ২০০৭ সালে একটি সাড়া জাগানো বই লিখে ফেললেন – Happy Accidents: Serendipity in Modern Medical Breakthroughs। এ বইয়ে তিনি আক্ষেপ করেছেন, এখন যেভাবে গবেষণা হয় বড়ো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অর্থানুকূল্যে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী সেখানে ছোট আবিষ্কার বা প্রচুর মুনাফা দিতে পারবে না এরকম আবিষ্কারের আদৌ কোন গুরুত্ব নেই। একটি অনুশাসিত, কঠোরভাবে নিগড়বদ্ধ মুনাফা উৎপাদনকারী গবেষণায় সেরেন্ডিপিটির জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। কল্পনা কমে যাচ্ছে – জায়গা নিচ্ছে predictable results-এর গবেষণা।
কোরিয়ান জার্নাল অফ রেডিওলজি-তে (জুলাই-আগস্ট, ২০০৭, পৃঃ ২৬৩) মেয়ার্সের বইয়ের একটি রিভিউ প্রকাশিত হয় “Happy Accidents: Serendipity in Modern Medical Breakthroughs” শিরোনামে। এই রিভিউয়ে বলা হয় – “Dr. Meyers asserts that fostering serendipity is important.He is saying that money does not foster new ideas, at least ideas that drive science; it only fosters applications of old ideas, most often enabling improvements but not discoveries. Only ideas and creative thought can provide an answer, and the ideas and creative thought are things that our existing system sadly lacks and fails to nurture. Serendipitous discoverers insist on trying to see beyond their own and others' expectations and resist any pressure that would close off investigation. They break through, sidestep, or ignore any obstacle or objection to their chosen course.“ এরপরে আরও বলা হয় – “Dr. Meyers concludes that discoveries are surprises. You cannot plan surprise, but you can certainly create an environment in which they are apt to happen and are likely to be recognized and pursued when they do. Fostering openness to serendipity has the potential to accelerate medical discovery as never before.”
সৃজনশীল মানব সভ্যতার জন্য এবং আজকের পৃথিবীতে বহু ক্ষেত্রে পণ্য দুনিয়া-নিয়ন্ত্রিত গবেষণার বিকল্প কিংবা প্রতিস্পর্ধী হিসেবে এ কথাগুলো আমাদের নতুন করে গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি।