আমরা আমাদের চারপাশে সাধারণত দুই শ্রেণীর মানুষ দেখতে পাই, এক যাঁরা বড়োলোক আর দুই যাঁরা ছোট লোক। পৃথিবীর ইতিহাস, যাবতীয় যুদ্ধ, রক্তক্ষয় তা সবই এই বড়ো আর ছোটদের দ্বন্দ্বপ্রসূত। যেমন ঝিলাম নদীর ধারে প্রবল পরাক্রমশালী রাজা আলেকজান্ডারের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত দূর্বল রাজা পুরুর যুদ্ধ, যেমন সাম্রাজ্য বিস্তারকামী সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে ছোট ছোট হিন্দু রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রতিরোধ, যেমন অত্যাচারী জমিদারদের বিপক্ষে সাধারণ ভূমিহীন কৃষক, বা কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনকে নস্যাৎ করে ব্যক্তি মানুষের বা ব্যক্তিত্বের উত্থান। আমার বিশ্বাস, ইতিহাস ও সমাজ বিকাশের এই রীতিনীতি ঐতিহ্য মেনেই একেবারে হাল আধুনিকে ইনফোটেক ও বিজ্ঞাপন শাসিত সমাজ ব্যবস্থায়, প্রবল দোর্দন্ড মিডিয়া প্রতাপের বিপরীতে একটি কি দুটি ছোট পত্রিকা আর তাকে ঘিরে মুষ্টিমেয় কিছু প্রকৃত ছোটলোক, ছোট মানুষ বেঁচে আছেন।
একজন বড়লোকের সঙ্গে ছোটলোকের পার্থক্য তাঁদের চিন্তায় এবং কৃতকর্মে। একজন বড়লোকের হতাশাবোধ থাকেনা। একজন বড়লোক প্রবল আত্মসম্মান বোধহীন, বাজার সফল, এমন কি প্রেমেও। তিনি জীবনে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন। তিনি জানেন থিসিস আর এন্টি থিসিস নিয়েই হলো সিন্থেসিস। অন্যদিকে একজন ছোটলোকের জীবন হতাশাক্রান্ত। তিনি হয়তো 'হ্যাঁ ' বলে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পরক্ষনেই 'কিন্তু' বলে একটা বিকল্প সম্ভবনাও জুড়ে দিয়েছেন। এইভাবে তাঁর জীবন হ্যাঁ .... কিন্তু ... হ্যাঁ ..... কিন্তু বিশাল শৃঙ্খল। বড়লোক যদি বলেন তোমার শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই, তো ছোটলোক দেখেন শৃঙ্খল তাঁর পথে তেঁতো ওষুধের অপরিহার্যতা নিয়ে উপস্থিত।
কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ট মাধ্যম হ'ল শিল্প। যে গুহামানব সর্বপ্রথম গুহাগাত্রে একটি ছুটন্ত হরিণ এঁকেছিল, সে হয়তো খোঁড়া ছিল। এই ছিল তার প্রতিবাদ, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সে হয়তো ঐ ছুটন্ত নিরুপায় হরিণের মধ্যে নিজেকেই দেখতে চেয়েছিল। আমি কে ? আমি কেন পারি ? অথবা পারিনা ? যেদিকে স্রোত আমি তার উল্টোদিকে কেন ? কেন আমার নন্দন একাডেমি ফেসবুক চত্বর আর ভালো লাগছে না ? কেন আমার জনতা কেবিন, স্বপনদার চায়ের দোকান এতো ভালো লাগছে বা আজ সন্ধেবেলা নন্দন বুকস্টলের ষষ্টিদার বিরক্ত মুখই বা এতো ভালো লাগলো কেন ? সবাই যে গান ভালো বলছে আর আরও সবাই যে গানে মাথা দোলাচ্ছে, সেই গানে আমি কেন সপ্রতিভ হয়ে উঠতে পারছিনা। তবে কি আমি ভুল ? না কি আমিই শেষ পর্যন্ত ঠিক ! এইসব আত্মচিন্তা শিল্পে একজন প্রকৃত ছোটলোকের জন্ম দেয়। তখন সেই শিল্পী শিল্পে আর নিজেকে দেখান না, তিনি নিজে যা করেন, যা ভাবেন তাই দেখানোর চেষ্টা করেন। বিনয় মজুমদার তাই তাঁর কবিতাকে দিনলিপি বলেন। এইসব প্রকৃত তরুণ ছোটলোকদের হাতেই একজন প্রকৃত ছোটলোক পুনরাবিষ্কৃত হন। সেই কারণেই আমরা দেখি যুগান্তর চক্রবর্তীর ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত বই ১৯৯৮ এ পুনর্মুদ্রিত হয়। অন্যদিকে অপ্রকৃত ছোটোলোকরা ছোটলোকদের মতো দেখতে হলেও ভেতরে ভেতরে এনারা নির্বোধ উচ্চাকাঙ্খী। বিভিন্ন কায়দায় আত্মপ্রকাশ নয়, আত্মপ্রচারই তাঁদের তাঁদের উদ্দেশ্য। তাই তাঁরা আরো মূর্খদের সঙ্গ চান। তাঁরা পুরুলিয়াতে একটি কবি সম্মেলন করেই আবার বাঁকুড়ার দিকে চলে যান সেখানকার কবিদের সংঘটিত করবার জন্য বা তাঁরা হুগলীর একজন তরুণ কবির লেখা ছাপেন যাতে তাঁদের কবিতার ব্র্যান্ড নেম ( যা কিনা অ -কবিতা, না -কবিতা, স্মার্ট কবিতা) জয়যাত্রা অক্ষুন্ন থাকে। আর মুখে বলেন এই হ'লো আমাদের সমান্তরাল শিল্প চর্চা, আপনারা বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দিন।
বড়ো পত্রিকার বড়ো মানুষেরা, যাঁরা অনেক রখম রিসোর্স নিয়ে ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা ইচ্ছে করলেই ভারতীয় সংবিধান থেকে বাংলার বেশ্যাবৃত্তি পর্যন্ত অনর্গল বলতে ও লিখতে জানা লোকদের দিয়ে লিখিয়েও নিতে পারেন। আর কে না জানে, যে পণ্য -সর্বস্ব বাজার ব্যবস্থায় সবই বিক্রয়যোগ্য পণ্য মাত্র, এমন কি লেখাও, কেন না 'সকলেই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক'।
সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আর একটি কথা না বললেই নয়। সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য যেন তেন প্রকারেন ব্যাপক পাঠক গোষ্ঠীকে কে মুঠোর মধ্যে নেওয়া। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করে বিজ্ঞাপন। লেখক এখানে নির্লজ্জ পাপেট মাত্র। কতখানি নির্লজ্জ ও নির্বোধ হলে একজন তৃতীয় শ্রেণীর ঔপন্যাসিক বা একজন কবি তার বই প্রচার অভিযানে একজন সেলিব্রিটিকে ডাকেন। আর এলেবেলে পাঠক সেই বিজ্ঞাপন দেখে তার বই কিনে আনেন …. যে সমস্ত পাঠক সেলিব্রিটিদের কাছে নিজের মাথাটাকেও বাঁধা রেখেছেন , তাঁদের শিল্প সচেতন করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং একজন ছোট লেখককে এঁদের অবজ্ঞা করাই সমুচিত হবে।
ডেভিড মার্কসনের A Novel Against Novel পড়েছিলাম, উনি Antinovel প্রসঙ্গে বলেছিলেন – The antinovel is a niche genre which positions itself radically and emphatically against what might be called the conventional novel. কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠিত শক্তির পথেই হাঁটছে, সেই লিনিয়ার প্লট, সেই কজ -এফেক্ট রিলেসন, সেই এক ভেরিসিমিলিচিউড, যেন একতা কাপুরের সোপ সিরিয়াল চলেছে।
পাঠক, মনে রাখবেন আমি কিন্তু বড়ো পত্রিকায় লেখার পক্ষে বিপক্ষে সওয়াল করছিনা। যে সব গুরুত্বপূর্ণ বই প্রতিষ্ঠানের আলো পাইনি, সেই বই যদি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হতো তবে তা খারাপ হয়ে যেত না। অন্য দিকে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত (যদিও খুব কম, বাংলা ভাষায় তো বটেই) বইমাত্রই পড়া যায় না এমনটিও নয়। প্রতিষ্ঠানে সমস্ত লেখকদের লেখার গণতন্ত্র ফিরে আসুক এমন অদ্ভত দাবিও আমি করছিনা। আমি বলছি একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা যা একটি ছোট পত্রিকার লেখকরাই ঠিক করবেন। খারাপ লাগে, যখন রানাঘাটের একটি পত্রিকা, বীরভূমের একটি পত্রিকা কলকাতার চেনা লেখকগোষ্ঠী নিয়েই আত্মপ্রকাশ করে।
প্রকৃত ছোট পত্রিকা আদপে একটি দর্শন। যে কোনও দর্শন সময়কে পুনর্নির্মাণ করে। তাই একজন ছোট পত্রিকার লেখককে ঘটা করে বড়ো পত্রিকার লেখকদেরকে অস্বীকার করতে হয়না। তিনি নিরপেক্ষ এবং উদাসীন। এই উদাসীনতা নিয়ে একজন ছোট লেখক জন্মান না, এই উদাসীনতা তিনি অর্জন করেন, জীবনকে আরও বেশি পাওয়ার লোভে, আরও বেশি আত্ম-আবিষ্কারে নেশায়।
নতুন সাহিত্য, একটি নতুন দর্শন। যে কোনও দর্শনই নেতির ওপরে পালিত নয়। যে দর্শন নেতির ওপর পালিত হয়, সেই দর্শনের চর্চা করে লাভ কি ? একজন ছোট লেখক এই বিষয়টা বোঝেন, এবং বোঝেন বলেই লিখতে না পারলে, লেখা থামিয়ে অন্য ব্যবসায় যান, একজন বড়ো লেখক থামতে জানেন না, যতদিন তিনি বাঁচবেন, তিনি লিখবেন এবং লেখা ছাড়া অন্য কোনও ব্যবসায় তিনি যাবেন না।
শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় নিষ্পাপ শিশুর মুখে বলিয়েছিলেন "রাজা তোর কাপড় কোথায় ?" কবিতাটি বাংলা কবিতার স্কুল ফাইনাল পাস পাঠক -আবৃত্তিকারের মুখে মুখে ঘোরে, এবং এই লেখাটির পরে, একটি প্রভাবশালী বড়ো পত্রিকা দপ্তরে কাজের সুবাদে নীরেন্দ্রনাথের পদোন্নতি হয়, মাইনে বাড়ে। কবিতায় শোষিত মানুষের কথা বলতে এসে শেষ পর্যন্ত তিনি সেই বড়ো পত্রিকারই বিশিষ্ট একজন হয়ে যান। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তা মানতে পারেননি। তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন - নীরেন তোমার ল্যাংটো রাজা। কবিতাটি এইরকম ছিল --
নীরেন! তোমার ন্যাংটো রাজা
পোশাক ছেড়ে পোশাক পড়েছে!
নাকি, তোমার রাজাই বদলেছে?
সেই শিশুটি কোথায় গেল
যেই শিশুটি সেদিন ছিল?
নীরেন, তুমি বলতে পারো,
কোথায় গেল সে?
নাকি, তুমি বলবে না আর ;
তোমার যে আজ মাইনে বেড়েছে!
হেইও হো! হেইও হো!
পোষাক ছাড়া নীরেন, তুমি,
তুমিও ন্যাংটো |
কিন্তু ঘরে তেমন একটি
আয়না রাখে কে?
এই রাজা না, ঐ রাজা না |
তুমিও না ; আমিও না |
হেইও হো! হেইও হো!
পোষাক ছাড়া নীরেন, আমরা,
সবাই যে ন্যাংটো |
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই
রাজার রাজত্বে!
কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর ;
তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে!
পরিশেষে কবি সমর সেনের কথা বলবো -- কবি সমর সেনের বিয়ের কথা হচ্ছে। সমর সেনের হবু শ্বশুরমহাশয় চান, যে সমর সেন বিদেশ যাক, যা কিছু খরচাপাতি তিনিই দেবেন। কিন্তু কবি রাজী হননি, বলেছিলেন পুরুষাঙ্গ বাঁধা রেখে আমি বিদেশ যেতে পারবো না।
১ সমর সেনের গল্পটা বোধহয় একটু অন্যরকম। দাদু দীনেশচন্দ্র সেন নাতিকে কথা দিয়েছিলেন ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলে অক্সফোর্ডে পাঠাবেন। সমর সেন রেজাল্ট বেরোলে খুশি হয়ে দাদুকে ধরলেন--এবার?
দাদু মাথা চুলকে বললেন-- আদ্দেক খরচ আমি দিচ্ছি ,বাকি আদ্দেক বিয়ের সময় হবু শ্বশুরের থেকে নিস। সমর বলেছিলেন-- না দাদু পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলেত যাব না।
২ সমর সেনের দ্বিতীয় গল্পঃ
ওঁর নকাকা বিমর্শ। অনেকগুলো সন্তানের বাবা । কাল আরেকটি হয়েছে। সমর জিজ্ঞেস করেন-- এত সন্তান হয় কেন?
--ভগবানের হাত।
--ভগবানের হাত এত ছোট!
(বাবুবৃত্তান্ত)
"কতখানি নির্লজ্জ ও নির্বোধ হলে একজন তৃতীয় শ্রেণীর ঔপন্যাসিক বা একজন কবি তার বই প্রচার অভিযানে একজন সেলিব্রিটিকে ডাকেন। আর এলেবেলে পাঠক সেই বিজ্ঞাপন দেখে তার বই কিনে আনেন"
এই য়্যাতো য়্যাতো জাজমেন্টের কি হল? সিনিমা মানেই সত্যজিত রায় আর বই মানেই কমলকুমার? গান মানেই মার্গ সঙ্গীত আর ছবি মানেই গনেশ পাইন ?
ডাইভার্সিটির কি হবে?
আমার খুব ভাল লেগেছে। খুব সুন্দর করে সহজ ভাবে মাথায় গিয়ে আঘাত করে। অনেকেই কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলেন, কিন্তু কবিতার পাঁক পলিটিক্স নিয়ে চন্দ্রিল ছাড়া কাউকে লিখতে দেখিনি। লেখকের আরো গদ্য পড়তে চাই
বেশ কিছু বানান ভুল দেখছি- ঠিক করে দেওয়ার অনুরোধ জানাই।
একই সঙ্গে বড় না বড়ো, ছোট না ছোটো কোনটি ব্যবহার হবে সেটি ঠিক করে নেওয়া ভালো। সবরকম বানানই মিলেমিশে রয়েছে।
লোকজনের হেভি জ্বলুনি। করোনা বাজারে সবাই ফাস্ট্রেটেড। বেছে বেছে খুঁত খুঁজে বার করে। তারপর জ্ঞান দিয়ে, রুডনেস দেখিয়ে চলে যায়। নাই ভাল লাগতে পারে আপনাদের কিন্তু এই বাজারে একটু পজেটিভিটিটাও দেখানো যেতে পারে। ভাল পয়েন্টগুলোও বলুন না দুটো। পারলে নিজেও ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করুন।
ভালো শুনতে চাইছেন? তা বল্লেই হয়!
এই ধরুন শিল্প সাহিত্য নন্দনতত্ত্বের কোরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা হয়েছে! বাজার ও বাজার্বিরোধিতার ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এ সব তো প্রশং্সনীয় বটেই।
একটা ব্যাপার বুজুন - লোকে উট্কো ভুল দেখছে মানে অনেক কিছু নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে, তাই ভুল্গুলো সামলাতে বলছে!
এই য্যামন এক্ষুনি মনে হল - সমর সেনের থেকে বেটার উদাহরণ দেওয়া যেত! কেন? জিগোবেন না কিন্তু!
ঠোঁটকাটা কি আমার মন্তব্যে অসন্তুষ্ট? এত রাগারাগির কী হ'ল?
সম্পাদিত বিভাগে বানান ভুল কাঙ্খিত নয়, তাই শুধরে দিতে বলা। লেখার ভাল মন্দ কিছুই বলা হয় নি।
রূঢ়ভাষ বা জ্ঞানদান মনে হলে , আমি অপারগ।
ধন্যবাদ... কত্ত জানেন ভাই। আপনার ইন্টারনেট ট্রোলিং এ মুগ্ধ হলাম। ঋদ্ধ হলাম। আপনাকে লিখতে বলেছিলাম ভাগ্যিস!
*(i এর জন্যে নয়)
কে কাকে ট্রোল করলো?