আমার ছেলেমেয়ে দুটোর বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। ১০ বিষয়ের পরীক্ষা। জেএসসি পরীক্ষার আগের দিন তাদের হাতে যে রুটিন ধরিয়ে দেওয়া হলো তাতে মোটামুটি দু একদিন যাও বা গ্যাপ ছিলো পরীক্ষার মাঝে, ১০ তারিখের মধ্যে সকল পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশে সংশোধিত রুটিনে একদিনে দুই বিষয়ে পরীক্ষা, এমনকি শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে ১০ তারিখের ভেতর শেষ করার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়েছে।
বাচ্চাদুটো রাত জেগে পড়ে আর কতোক্ষন পরপর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে,মা পরীক্ষা দেবোনা।
ভয়ে সকালে পরীক্ষা দিতে যাবার আগে কিছু খেতে পারে না, উৎকণ্ঠায় সারারাত কাটায় অর্ধঘুমে। বাচ্চাদুটোর চেহারার দিকে তাকানো যায় না। কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। আমার ক্ষমতাও নেই সেই সাহসও নেই, ওদের বলি পরীক্ষা দিতে হবেনা।সত্যি আমি যদি পারতাম,নির্ঘুম অসহায় বাচ্চাদুটোকে বলতে, যাও পরীক্ষা দিতে হবে না। আমি নজরুলকে জানি, আমি রবীন্দ্রনাথকে জানি। স্কুল কলেজ পাশ দিয়ে তারা হননি। লালন স্কুল পাশ দেন নি।
কিন্তু পারি না। আমিও সিস্টেমের দাস।
না আমার বাচ্চাদের মোটেও প্রথম হবার চাপ নেই। কিন্তু সিস্টেমটাই এমন পরীক্ষা পাশের তাড়া গিলে খেয়েছে এদের শৈশব, এদের আনন্দ।
সবাই নড়েচড়ে বসেছেন দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুন্নেছা স্কলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায়। শাস্তি চাইছেন প্রিন্সিপালের। কিন্তু আমি অভিজ্ঞতা থেকে জানি এদেশের সব কয়টি স্কুল কমবেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কন্সট্রেশন ক্যাম্প। এলাকার ভিত্তিতে অধিক নামী স্কুলগুলো বেশিমাত্রায় আর কমনামী স্কুলগুলো কমমাত্রায়। এদেশের একটা স্কুলও শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। এদেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী আনন্দ নিয়ে প্রবেশ করে না।
এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষকরা সবাই একেকজন সর্বেসর্বা।অথবা একটি সিণ্ডিকেট। এঁদের কোন ভুল হয় না। এঁদের ভুল ধরতে নেই।এঁরা যা করেন সব ঠিক। কোন অভিভাবক বা শিক্ষার্থী যদি প্রতিবাদ করেন তবে সেই শিক্ষার্থী পরিণত হবে টার্গেটে। কারণে অকারণে বিনাকারণে হেনস্থার স্বীকার হবে যখন তখন। আর শিক্ষার্থীর যদি কোন দোষ থাকেতো উপায়ই নেই! তার মূল্যবান জীবন শেষ করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা্নই যথেষ্ট।
এদেশে প্রশ্নপত্র ফাস ডালভাতের মতো,প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং ব্যবসা ওপেন সিক্রেট। দুদিন পরপর সিলেবাস বদলে ছাত্রদের গিনিপিগ বানানো হাতের তুড়ি মারার মতো। কিন্তু যখনই কোন বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে আসে তখনই সবচে আগে খড়্গটিও নামে শিক্ষার্থীর উপর।
পরীক্ষা নামক ফাঁসির রজ্জুর সম্মুখে নার্ভাস শিক্ষার্থীটিকে পুনঃপুনঃ চেক করার নামে ভয়াবহ মানসিক চাপ,পরীক্ষার হলে খাতা আটকে রাখা ইত্যাদি কতোরকম ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যে একজন শিক্ষার্থীকে এই পরীক্ষা নামক ফাঁসির রজ্জু থেকে বেঁচে ফিরতে হয় তা বলা বাহুল্য মাত্র! যেন দেশের এই বেহাল শিক্ষা ব্যবস্থার সব দায় শোধ করতে হবে নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের।
যতক্ষণ একটি ব্যবস্থা পরীক্ষাকেই ধরবে মেধা যাচাইয়ের মাপকাঠি,যতক্ষণ একটি ব্যবস্থা পরীক্ষাকেই নির্ধারিত করবে তার যোগ্যতা যাচাইয়ের দাঁড়িপাল্লা, ততক্ষণ গাইড ব্যবসা, প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবসা, কোচিং ব্যবসা কিছুই বন্ধ করা সম্ভব নয়।সম্ভব নয় "শিক্ষক" নামধারী কিছু চাকরিজীবীদের ষণ্ডামি। সম্ভব নয় বন্ধ করা ছাত্রের পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাবার প্রতিযোগিতায় যে কোন উপায় অবলম্বনের প্রবণতাও।এবং ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রবণতা অপরাধও নয়।
একজন শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, কাছ থেকে দেখেছি কিছু শিক্ষক নামধারীদের অবিমৃষ্যকারিতা।
একজন অভিভাবক হিসাবে দায়িত্বও আমার। আমার বাঁহাতি ছেলে বাঁহাতে পরীক্ষার হলে এক্সট্রা পেপার নিয়েছিলো বলে হলেই শিক্ষকের থাপ্পড় খেয়েছিলো। ১০৩ ডিগ্রি জ্বর গায়ে পরীক্ষার হলে কান্নাকাটি করেছিলো বলে শিক্ষক তাকে বলেছে,এসব ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া উচিত। অভিজ্ঞতার ঝুড়ি দু'দিক থেকেই সমৃদ্ধ আমার।
শিক্ষার্থীকে অপমান করে যেন এক পাশবিক আনন্দ পান কিছু 'শিক্ষক' নামের বেতনভোগী। যেন শিক্ষকতার সব সাফল্য অর্জিত হয় শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিতে পারলেই।হয়তো শাস্তি হবে এই প্রিন্সিপালের।অসহায় অপমানিত অরিত্রী ফ্যানে ঝুললো বলে তার মৃত্যু খবর হলো, হিসাবে এলো। কিন্তু প্রতিদিন সারাদেশে সহস্র শিক্ষার্থীর আত্মিক মৃত্যু হচ্ছে এজাতীয় নির্যাতনে।
ভিকারুন্নেছার ঘটনায় যদি আপাত ভাবে বন্ধ হয় শিক্ষার্থী নির্যাতন, এই মুহূর্তে এটাই হবে সর্বোচ্চ অর্জন। নিষ্পাপ অরিত্রীর আত্মদানে পবিত্র হোক আমাদের শিক্ষায়তনগুলো।আর একজন অরিত্রীও অকালে ঝরে না পড়ুক। নইলে একজন প্রিন্সিপালের শাস্তিপ্রাপ্তিতে কী আসবে যাবে?
এর উল্টোপিঠটাও দেখতে হবে আমাদের।
আমার কাব্যপদ্য প্রতিদিন রাতে জিজ্ঞেস করবে, মা সকালে তোমার কলেজ আছে? আমার উত্তরও প্রতিদিন এক,হ্যাঁ আছে। দুজনের একসাথে মন খারাপ। আমি সকালে ওঠে কলেজ চলে যাই।ওরা একা একা খেয়ে পরীক্ষায় যায়,স্কুলে যায়। ক্লাসের সময়টা কাটিয়ে দিলেও পরীক্ষার সময়টাতে অনেক মন খারাপ করে।
অন্য অভিভাবকরা সন্তানদের সাথে করে নিয়ে যায়,ঘণ্টা পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে বসে থাকে,টিচার ঢুকলে সন্তানের কপোলে শেষ চুমুটা দিয়ে ক্লাস দিয়ে বের হয়।আর কর্মজীবী মা হওয়ার কারণে আমি ওদের স্কুলে পৌছে দিতেও যেতে পারি না।
আমার ছেলেটা একটু সরলসিদা টাইপ,কোনকিছু নিজের মতো বুঝে না। যা কিছু অসংগতি মনে আসে কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে বলে দেয়।একদিন আমাকে বলেছে, মা শুনো আমারও অন্যদের মতো আদর পেতে ইচ্ছে করে। সবার মা টিফিন পিরিয়ডে ওদের টিফিন খাইয়ে দেয়,পানি খাইয়ে মুখ মুছে দেয়।আমি তখন ওকে কর্মজীবী মা আর হাউস-ওয়াইফ মায়েদের একটা পার্থক্য বুঝিয়েছি। ও বুঝেছে। ওর মনোবেদনাটাও আমি টের পেয়েছি।কিন্তু মোটেই নিজে অপরাধবোধে ভুগিনি।
মেয়ে আবার নিজে নিজে অনেক কিছু বুঝে নেয়। এবার বললো, মা অন্তত একদিন আমাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে চলো, নইলে সবাই ভাবে তুমি অসচেতন মা, আমার পড়ালেখার দিকে তোমার নজর নেই।এই অভিযোগেও মোটেও বাড়াবাড়ি নেই।ওরা চারপাশে যা দেখে তা থেকেই তো তৈরি হবে মনোজাগতিক প্রত্যাশা। কিন্তু আমি এ নিয়েও অপরাধবোধে ভুগিনা।
আমার বাচ্চারা যখন কেজি নার্সারিতে পড়ে,ক্লাসে ফার্স্ট সেকেণ্ড হয়না, মা পরীক্ষার সময় উৎকণ্ঠা নিয়ে স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে থাকি না তখন থেকেই বাকি অভিভাবককুল সহ শিক্ষকদের আমার প্রতি অভিযোগের অন্ত নেই।আমি এসব পাত্তা না দিয়েই চলি।
তবে সন্তানদের যখন বুঝাতে হয় তখন ওদের বুঝাই, সময়ের চাকা পেছনের দিকে ঘুরবে না সোনারা। আজ তোমার মা যতোটা সময় ঘরের বাইরে থাকে তোমাদের সময়ে তা বাড়বে ছাড়া কমবে না।তোমাদের কষ্ট এখন আশেপাশে অন্য হাউস ওয়াইফ মায়েদের সন্তানদের সময় দিতে দেখো বলে, তোমাদের সন্তানরা সে কষ্ট পাবে না কারণ তখন সব মায়েরাই এমন ব্যস্ত থাকবে।
ভিকারুন্নেছা নুনের ঘটনায় শাস্তি হয়েছে শিক্ষকের। এবার আসুন অভিভাবক হিসাবে নিজের চেহারাটা দেখি।
আমরা তো সেই অভিভাবক যারা প্রত্যেকেই চাই,সন্তান ক্লাসে ফার্স্ট হোক!আমরা তো সেই অভিভাবক যারা সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তি করার জন্য ডোনেশনের নামে ঘুষ দেই!আমরা তো সেই অভিভাবক যারা ফাস হওয়া প্রশ্নপত্র সন্তানের হাতে তুলে দেই! আমরা তো সেই অভিভাবক কোচিং প্রাইভেট টিউটরের চাপে যারা সন্তানের আনন্দময় সময়কে হত্যা করি! আমরা তো সেই অভিভাবক কাঙ্ক্ষিত নাম্বার না পেলে যারা সন্তানকে মানসিক ও শারীরিকভাবে শাস্তি দেই! আমরা তো সেই অভিভাবক,সমাজে নিজের সম্মান বাড়ানোর জন্য যারা প্রতিনিয়ত সন্তানকে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেই!
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরে দোষ চাপালেও কিছুটা চলে।সাবধান আপনার নিষ্পাপ পবিত্র সন্তান কিংবা শিক্ষার্থীর উপর দোষ চাপাবেন না।
যে শিক্ষার্থী ক্লাসে নকল করছে, তাঁকে আপনি-আমি বার্তা দিচ্ছি যেনতেন ভাবে পরীক্ষায় ভালো করলেই জীবনে সাফল্য আসবে। যে ছেলে অসদুপায় অবলম্বন করে শিক্ষককে চোখ রাঙাচ্ছে সে আপনার আমার মতো কারো সন্তান, যে আপনি আমি তাঁকে লোভী করে তুলেছি। সৎ শিক্ষা দিতে পারিনি।তাঁকে সর্বদা বলেছি "ফার্স্ট" হতে হবে। কখনো "ভালো মানুষ" হতে বলি নি।ফল যা হবার হচ্ছে, আমরা বছর বছর গণ্ডা গণ্ডা “দক্ষ” পেশাজীবী পাচ্ছি,মানুষ পাচ্ছি না। আর তার প্রভাব ক্রমান্বয়ে টের পাচ্ছে পুরো সমাজ।
আমরা প্রত্যেকে সমাজে আমাদের নিজেদের তথাকথিত সম্মান আর প্রতিষ্ঠার কথাই ভাবছি শুধু। যে শিক্ষার্থী কোন অসদুপায় অবলম্বনের কারণে বহিষ্ৃত হল, তাঁর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়ে দিতে দ্বিধা করছি না। আমরা মোটেই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সমস্যার গোড়ার দিকে নজর দিচ্ছি না।
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো, যে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ,যার ভবিষ্যৎ তৈরি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেতে যায় যে ঘুণেধরা ব্যবস্থা আসুন সেই ব্যবস্থাকে ঘৃণা করি,বদলাতে চেষ্টা করি।আর এই দায়িত্ব আমার এবং আপনার।আমাদের সন্তানদের নয়।