এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  রাজনীতি

  • চুকনগর গণহত্যা: এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা 

    দীপ
    আলোচনা | রাজনীতি | ২০ মে ২০২৫ | ৪৯৪ বার পঠিত
  • চুকনগর গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করলেন সাখ‌ওয়াত হোসেন। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এই ইতিহাস সবার জানা প্রয়োজন। সেজন্যই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। আগ্রহী হলে পড়তে পারেন।
    -------------------------------------------------------------------
     
    গুগল আপনাকে সব খুঁজে এনে দেবে। আপনি গুগল সার্চবক্সে যেয়ে 'চুকনগর' লিখুন, চুকনগর এনে দেবে না। আপনাকে এনে দেবে লাশের সারি। আপনি চুকনগর নামের অর্থ খুঁজুন, পাবেন না। চুকনগরের সৌন্দর্য খুঁজুন, পাবেন না। পাবেন শুধু একটা রক্তাক্ত ইতিহাস। আজ মে মাসের বিশ তারিখ। আজ সকাল এগারটা থেকে চুকনগরে আরম্ভ হবে ব্রাশফায়ার, টানা চার ঘণ্টা পর বিকাল তিনটায় থামবে ব্রাশফায়ার কারণ ততক্ষণে ফুরিয়ে যাবে বুলেট। আপনি একবার চোখ বুজে নিজেকে নিয়ে যান উনিশশো একাত্তর সালে। আপনি চোখ খুলে আর নিজেকে পাবেন না।
    খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার একটা গ্রামের নাম চুকনগর। সকাল এগারটা থেকে বিকেল তিনটা। এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্য। চার মাইল। চার ঘণ্টা। আনুমানিক বারো হাজার মানুষ। বলা হয়, পৃথিবীর যেকোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সংঘটিত সর্ববৃহৎ একক গণহত্যার নাম, চুকনগর গণহত্যা। চার ঘণ্টা ব্যাপী চলা এই ব্রাশফায়ারের নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়াত। বিকেল তিনটার দিকে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর সামনে পা বাড়াতে পারেনি সে আর। মাটি ভিজে গিয়েছিল, পায়ের তলায় ছিল অগুনতি লাশ। লাশ সরানোর নির্দেশ দিয়ে চলে যায় হায়াত।
     
    চুকনগর গ্রামের আনসার আলী সরদার জানিয়েছিলেন, তারা সারাদিন ধরে বিয়াল্লিশজন মিলে একুশটি বাঁশে করে লাশ ঠেলে নদীতে ফেলেছিলেন। প্রতিবার দুইশো করে লাশ। একুশ তারিখ থেকে চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত বিয়াল্লিশজন মিলে চার হাজার লাশ গুনে হাল ছেড়ে দেন। আটলিয়া ইউনিয়নের পাতাখোলার বিল থেকে চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতীপাড়া, ভদ্রা নদী ও সাতক্ষীরা রোড থেকে ঘ্যাংরাইল নদী পর্যন্ত লাল হয়ে ছিল রক্তে।
     
    বিশ তারিখের পর ভদ্রা নদীর জল ছুঁয়েনি মানুষ। দু’মাস অবধি ঐ নদীর মাছ খায়নি। লাশ পঁচা গন্ধ এতবেশী ছিল, ছয় মাস অবধি চুকনগর বাজারে যায়নি কেউ। কোথাও কোথাও লাশ আটকে নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একুশ তারিখ সকালবেলা বাবা চিকন আলী মোড়লের সন্ধানে বের হয়েছিলেন পুত্র এরশাদ আলী মোড়ল। তিনি দেখেছিলেন ভয়ংকর এক দৃশ্য। পাতখোলা বিলের সামনে লাশের স্তুপ থেকে মৃত এক নারীর স্তন চুষে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে এক ক্ষুধার্ত শিশু। এরশাদ আলী মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে আসেন। শিশুটির নাম রাখেন 'সুন্দরী'। মৃত মায়ের কপালে সিঁদুর ও হাতের শাখা দেখেই বুঝেছিলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী তারা। সুন্দরীকে একটা সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারেই বড়ো করেন তিনি। একটা সাক্ষাৎকারে সুন্দরী বলেছিলেন, আমি তো জানি না আমার পৈতৃক বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে এসেছিলেন আমার বাবা মা। চুকনগরের এই জায়গায় আসলে শুধু বুকটা হু হু করে উঠে আমার।
     
    চুকনগর গণহত্যার বহু বহু বৎসর পরের একটা গল্প শোনাই। জায়গাটা হচ্ছে, নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন। ওখানে বাংলাদেশীরা একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এক ভদ্রলোক মামা ও মামী সহ ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন। যে ট্যাক্সি করে তারা যাচ্ছেন, ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভার একজন পাকিস্তানি যুবক। প্যাসেঞ্জার বাংলাদেশী শুনে যুবক উচ্ছ্বসিত। জানালো- ‘আমরা সবাই ভাই ভাই, মাঝখানে ইন্ডিয়া এসে গোলমাল বাঁধালো।’
     
    যা অনুমেয় ছিল; যুবক একাত্তর জানে নাই। তাদের পড়ানো হয়েছে ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তি বাহিনী মিলে ষড়যন্ত্র করে গণ্ডগোল লাগিয়েছে ভাই ভাইয়ের মধ্যে। এটা তাদের পাঠ্য পুস্তকের পাঠ্য। ফলে ওরা জানে- অত মানুষ হত্যা, অত ধর্ষণ, অত জ্বালাও পোড়াও, সব প্রোপাগান্ডা। ওরা বিশ্বাস করে- মুক্তিবাহিনী মূলত হিন্দু আর ইন্ডিয়ানদেরই একটা গ্রুপ যারা শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করতো ও লুটপাট করতো। ভদ্রলোকের মামা রাগে কাঁপতে কাঁপতে যুবককে তখন একটা লম্বা বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমি বক্তব্যটা হুবহু তুলে দিচ্ছি।
     
    ‘আমি নিজে মুক্তিবাহিনীর লোক। আমি হিন্দুও না, ইন্ডিয়া থেকেও আসি নাই। অতএব তোমার শিক্ষায় ভুল আছে। একাত্তর সালে আমি তোমাদের আর্মির অত্যাচার দেখেছি। কিভাবে তারা নিরীহ মানুষ খুন করেছে আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিজ হাতে গুলি করে তোমাদের আর্মিকে থামিয়েছি কয়েক জায়গায়। এই যে পিছনের সিটে বসা আমার ভাগ্নেটাকে দেখছো, ওর জন্ম ঐ যুদ্ধের সময়। ওর মা আমার ছোট বোন। সে আট মাসের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় প্রায় আশি মাইল রাস্তা হেঁটে শহর থেকে গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিল তোমাদের আর্মির হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমি কোনো লোকমুখে শোনা গল্প বলছি না। আরও কিছু শুনতে চাও? তুমি যদি মুক্তিবাহিনী সম্বন্ধে আরেকটা বাজে কথা বলো, এখনই তোমার ট্যাক্সি থেকে আমরা নেমে যাবো।’
     
    বাকি রাস্তা পাকিস্তানি যুবক আর একটাও কথা বলে নাই। বরং যখন ভদ্রলোক ট্যাক্সি থেকে নেমেছিলেন, যুবক নিজেও নেমেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার মা কি জীবিত আছেন? ভদ্রলোক মাথা ওপর-নিচ করেছিলেন। যুবক বলেছিল, তোমার মাকে বোলো, একজন পাকিস্তানী তাঁর কাছে মাফ চেয়েছে।
     
    পাকিস্তান পৃথিবীর কুৎসিৎতম রাষ্ট্র। ঘৃণ্য রাষ্ট্র। খবিশ রাষ্ট্র। এই বর্বর রাষ্ট্র তার নব্য প্রজন্মদের তাদের করা বর্বরতার ইতিহাস জানায়নি একফোঁটা। এই শুয়োরের বিষ্ঠামাখা রাষ্ট্র জানায়নি, চুকনগরের ফসলি জমিতে এখনও হাড়গোড় পাওয়া যায় মানুষের। কখনো সখনো পাওয়া যায় নারীর পরিহিত অলঙ্কার। জানায়নি সহস্র নারীর যোনিতে বেয়নেট ঢুকিয়ে পেটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলার গল্প। কিশোরগঞ্জের বরইতলার রেললাইনে অসংখ্য মানুষকে বসিয়ে এক এক করে ওদের মাথা ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ শাবল দিয়ে চূর্ণ করে দিয়েছিল ওরা একদিন।
     
    একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের ধরণ ও প্রক্রিয়া সম্বন্ধে গবেষণায় যা পাওয়া গেছে তার থেকে অল্প একটু বলি:
     
    ▪️ ১. সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখামাত্র গুলি করা।
    ▪️ ২. শক্ত সমর্থ তরুণদের রাস্তা অথবা বাড়িঘর থেকে বন্দী করে অজ্ঞাত স্থানে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শারীরিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন শেষে হাত বেঁধে কখনও একজন কখনও অনেকজনকে একসাথে গুলি করে মেরে গর্ত অথবা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া।
    ▪️ ৩. লোকসংখ্যা বেশী থাকলে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা।
    ▪️ ৪. আপনজন সামনে থাকলে তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ব্যক্তিকে জবাই করা, দেহ টুকরো টুকরো করা।
    ▪️ ৫. ভীতি ছড়ানোর জন্য সবার সামনেই অসহায় মানুষদের অঙ্গচ্ছেদ করা।
    ▪️ ৬. চোখ উপড়ে ফেলা।
    ▪️ ৭. নগ্ন করে উল্টো করে বেঁধে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলা।
    ▪️ ৮. ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে করে মাথা চূর্ণ করে দেওয়া।
    ▪️ ৯. বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে মুখ বেঁধে অনর্গল পিটিয়ে হত্যা করা অথবা মুখ বন্ধ বস্তাসহ নদীতে ফেলে দেওয়া।
    ▪️ ১০. দড়ি দিয়ে ব্যক্তিকে বেঁধে অনবরত লাথি ঘুষি অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে করে মেরে ফেলা।
    ▪️ ১১. বাঁশ ও রোলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চেপে ধরে থেঁতলে দেওয়া।
    ▪️ ১২. বেয়নেট দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করা, নাড়িভুড়ি বের করা, বুক চিরে হৃদপিণ্ড উপড়ে নেওয়া।
    ▪️ ১৩. দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা।
    ▪️ ১৪. পানি, অগ্নিকুণ্ড অথবা বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা।
    ▪️ ১৫. মৃতপ্রায় মানুষ পানি খেতে চাইলে মুখে প্রস্রাব করা, মলমূত্রের ওপর মানুষটার মাথা চেপে ধরা।
    ▪️ ১৬. সিগারেটের আগুনে শরীরের সংবেদনশীল জায়গায় ছ্যাকা দেওয়া।
    ▪️ ১৭. মলদ্বার ও আশপাশের স্থানে বরফ অথবা উত্তপ্ত লোহা ঢুকিয়ে দেওয়া।
    ▪️ ১৮. চোখের সামনে লাইট জ্বালিয়ে আলো দিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া।
    ▪️ ১৯. গায়ে ও মলদ্বারে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া।
    ▪️ ২০. আঙুলে সুঁচ ফোটানো।
    ▪️ ২১. নখ উপড়ে ফেলা।
    ▪️ ২২. শরীরের চামড়া ছিলে লবণ ও মরিচ লাগিয়ে দেওয়া।
    ▪️ ২৩. পুরুষের অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ থেঁতলে দেওয়া।
    ▪️ ২৪. মেয়েদের যৌনাঙ্গে লাঠি, রাইফেলের নল, ধারালো বোতল জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া।
    ▪️ ২৫. ‘বাঁশ ঢলা’ দেওয়া।
    ▪️ ২৬. বরফের চাঙরের ওপর শুইয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা।
    ▪️ ২৭. বুলেট বাঁচাতে দা দিয়ে জবাই করা।
    ▪️ ২৮. তরুণীদের বাড়ি থেকে ধরে এনে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা, স্তন কেটে নেওয়া, অমানুষিক শক্তি ব্যবহার করে চুল টেনে চামড়া সহ উপড়ে ফেলা।
     
    সর্বপ্রথম আশির দশকের গোড়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধফেরত মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দিয়েছিল। ভয়ানক যুদ্ধের সবটুকুন ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী যারা, যুদ্ধ শেষে বাকি জীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল তাদের ঐ স্মৃতি, ঐ মৃত্যু, ঐ ট্রমা।
     
    আমার মাঝেমধ্যে খুব জানতে ইচ্ছে করে, একাত্তরের যুদ্ধ ফেরত ঐ শুয়োরের জাতগুলো ঘুমোতে পেরেছিল কোনোদিন তারপর? ওদের কারোর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হয়নি? ওরা কী করে ঘুমিয়েছিল? ওরা সুখী হয়েছিল? ওদের বিবাহ হয়েছিল হয়তো। পুত্র সন্তান হয়েছিল, কন্যা সন্তানও হয়েছিল। ওরা নিশ্চয় ঐ কন্যার কপালে চুমু খেয়েছিল। চুলে হাত বুলিয়েছিল। ফোলা গাল দু’টো টিপে কোলে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল সপ্তাহে একবার। স্ত্রী সহ। কন্যা আবদার করেছিল হয়তোবা ঘাড়ে চড়ার। তারা নিশ্চয় ঘাড়েও চড়িয়েছিল তাকে। ঐ সন্তান থেকেছে পরম আদরে, বেঁচে আছে দুধে ভাতে।
     
    কখনই ওই সন্তানের জানা হবে না, চার ঘণ্টায় বারো হাজার, প্রতি ঘণ্টায় তিন হাজার, প্রতি মিনিটে পঞ্চাশ এবং প্রতি সেকেন্ডে একজন করে মানুষ হত্যা করলে মাত্র দশটা সেকেন্ড বাকি থাকে ঘড়িতে, যে দশটা সেকেন্ড চুকনগরে মারার মতোন আর দশটা মানুষ খুঁজে পায়নি তার রক্তপিপাসু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সেবক। এক ভদ্রা নদীর রক্তের অংক কষতে এই জনম কাটবে তাদের। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটা শ্মশানের বাকি হাড়গোড় গুনার সময় কই আর।
    .
    সূত্রঃ
    ১. ‘২০ মে ১৯৭১: চুকনগর গণহত্যা’ – আহমাদ ইশতিয়াক (দ্য ডেইলি স্টার, ২০.০৫.২০২১)
    ২. ‘চুকনগর বধ্যভূমি’ – (ডুমুরিয়া, খুলনা, গর্ভমেন্ট বিডি সাইট)
    ৩. আবদুল্লাহ ইবনে মাহমুদ
    ৪. ‘চুকনগর গণহত্যা’ – মুনতাসীর মামুন
    ৫. ‘৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ’ – ডা. এম এ হাসান (সংগ্রামের নোটবুক)
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • PRABIRJIT SARKAR | ২১ মে ২০২৫ ০৬:৫৭744878
  •  হিন্দু গণ হত্যা ভূমি সংস্কারের অঙ্গ। বিপ্লবীদের এই নিয়ে চিত্ত বিকার নেই। তাদের চিন্তা গাজা গুজরাট নিয়ে।
  • দীপ | 2401:4900:3f9b:9f29:90a3:1cfe:d2c4:***:*** | ২১ মে ২০২৫ ১০:৩২744886
  • Imam Hussain লিখেছিলেন, 
     
    ছোটো বেলায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড়োদের কাছে সবচেরে বেশি যে কথাটি শুনেছি— পাকিস্তানিরা কালেমা জিজ্ঞেস করত, বলতে পারলে ছেড়ে দিত, না পারলে মেরে ফেলত। স্বাক্ষর, নিরক্ষর, মোল্লা পুরোহিত সবার কাছেই এই কাহিনি শুনেছি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো মুসলমান যখন এই ঘটনা বলত, একধরনের উল্লাস, একটা মৌন আত্মতৃপ্তি তার চেহারায় প্রকাশ পেত। আর হিন্দু যখন বলত, একটা অদৃশ্য ভয়ের ছাপ তার চেহারায় উদ্ভাসিত ভেলার মতো ধরা দিত। 
     
    আমি একা একা যখন এই ঘটনা নিয়ে ভাবতাম, মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তাম, আমি তো কালেমা জানি। যদি আর কোনোদিন পাকিস্তানি মিলিটারি আসে, আমি কালেমা বলে বেঁচে যাব। ইয়ে। একটা অদ্ভুত খুশিতে চিকচিক করত আমার চোখ। গর্ব হতো আমি মুসলিম বলে।
     
    আস্তে আস্তে বড়ো হতে লাগলাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করতে লাগলাম। খুঁজে খুঁজে সেই টপিকগুলোই পড়তাম, যেখানে হিন্দুদের কালেমা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, যেখানে লুঙ্গি খুলে পেনিসের সার্কামসেশন চেক করা হচ্ছে। ভাগ্য ভালো আমারও সার্কামসেশন করা হয়েছে, তাছাড়া কালেমাও জানি। কাজেই বইয়ে এই কাহিনিটুকু পড়ে একটা অদ্ভুত সুখ পেতাম। একটা ভরসা, একটা আশা জাগানিয়া কল্পনা মনে এসে যেত। কারণ, একটা দুঃসময়ে, নিকটেই আমার মৃত্যু, আমি শুধু কালেমা ও খৎনাকৃত লিঙ্গ থাকায় বেঁচে গিয়েছি। এইযে তীব্র ভয়ের পর একটা স্বস্তি, এই স্বস্তি অনুভব করতেই ঝলমল করে উঠত আমার বদন। আর ধর্মের প্রতি ভক্তি আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠত। 
     
    যখন আরও বড়ো হলাম, অর্থাৎ ক্লাস নাইন টেনে উঠে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও জানার সুযোগ পেলাম। তড়িতে আমার মনে সেই কালেমার কনসেপ্ট, লুঙ্গি খোলে লিঙ্গ বিচারের দৃশ্য চলে আসত। তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতো। একটা চাপা অভিমান মাথায় ঝেঁকে বসত, চোখের চাহনিতে থরথর করত প্রশ্ন— শুধুমাত্র কালেমা না জানার কারণে মেরে ফেলা, শুধুমাত্র লিঙ্গের চামড়া না কাটার কারণে মানুষ মেরে ফেলা, এ কেমন বিচার? টু বি অনেস্ট, পাকিস্তানের প্রতি আমারও গভীর ভক্তি ছিল। একটা ফ্যান্টাসি কাজ করত, পাকিস্তান বাংলাদেশ ভাই ভাই; আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা, আমি মুসলিম, একারণে আমাকে মারবে না, এই ভাবনাটা আমার মনে পাকিস্তানি মুসলিমদের প্রতি একটা শ্রদ্ধার বন্ধন তৈরি করেছিল। অথচ সেই বন্ধন ছিড়ে গেল, যখনই মনে প্রশ্ন আসল, কেবল কালেমা না জানার কারণে, কেবল হিন্দু হওয়ার কারণে কাউকে মেরে ফেলাটা কতখানি সঠিক? আমার অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল অয়ন, একসাথে আমরা স্কুলে যেতাম, একসাথে আসতাম। অয়নের আম্মু আমাকে ভীষণ আদর করতেন, স্কুলে যাওয়ার সময় আমার হাতে খাবার ধরিয়ে দিতেন। আমি জানি অয়ন কালেমা জানে না, এবং এও জানি অয়নের খৎনা হয় নি। আমরা বিকেলে ফুটবল খেলে তারপর ল্যাংটা হয়ে গোসল করতাম পুকুরে। আমি দেখতাম, আমার সব হিন্দু বন্ধুগুলোর খৎনা করা নেই। আমি যখন ভাবতাম, আমার এই বন্ধুগুলোকে পাকিস্তানি সেনারা হিন্দু বলে গুলি করবে, কালেমা জানে না, খৎনা নেই, তাই মেরে ফেলবে। ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত, মস্তিষ্কে জ্যাম লেগে যেত। এ কোনোভাবেই মানা সম্ভব নয়, কেবল হিন্দু বলে আমার বন্ধুদের কেউ মেরে ফেলছে, সে মুসলমান হলেও আমার কেউ নয়, মুসলমান হলেও তার প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধা নেই। 
     
    আজ ২০ মে, ঐতিহাসিক হিন্দুহত্যা দিবস। এইদিনে পাকিস্তানি শূয়রের বাচ্ছারা বারো হাজার হিন্দুকে লাইন ধরে দাড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে, যতক্ষণ গুলি না ফুরায় ততক্ষণ মেরেছে। গুলি ফুরালে জবাই করেছে, বস্তাবন্দি করে জিন্দা অবস্থায় নদীতে ফেলেছে, অণ্ডকোষ থেঁতলে দিয়েছে পুরুষের, যোনিতে ভাঙা কাঁচ, বন্ধুকের নল, বাঁশ ঢুকিয়ে পেট অবধি ধাক্কা দিয়ে মেরেছে নারীদের। উফ, বর্ণনা করতে গেলে বুক কেঁপে কেঁপে উঠে, চোখ বেয়ে জল গড়ায়। সেদিনের সেই হত্যাকাণ্ড এতই ভয়ংকর ছিল যে, হত্যাকারীরা হাঁটার জন্য এক ইঞ্চি শুকনো মাটি অবধি পায় নি। সর্বত্রই রক্ত আর রক্ত। আমার ভাইয়ের রক্ত, আমার মায়ের রক্ত, আমার বোনের রক্ত; রক্তে মিশে চুকনগরের মাটি হয়েছে চাপচাপ কাদামাটি। মাটির সোদা গন্ধের জায়গায় রক্তের তীব্র গন্ধে বাতাস বিহবল হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, চুকনগরের আশেপাশে যে মানুষগুলো বেঁচেছিল, তারা কয়েকাস লাশের গন্ধে ঘর থেকে বের হতে পারে নি, পারে নি নদীর পানি দিয়ে কুলি করতে। যে লাশগুলো নদীতে ফেলা হয়েছিল, সেগুলোর তীব্র গন্ধে নদীর পানি পিনে লায়েক আর থাকে নি। 
     
    অথচ আজ ওরা বিশ্বাস করতে চায় না, হিন্দুহলোকাস্ট হয়েছে বলে। খুলনা, চুকনগরে যত হিন্দু ছিল, বাংলাদেশে তত হিন্দু আর কোথাও একসাথে ছিল না। পাকিস্তানি মিলিটারি খুঁজে খুঁজে হিন্দুদের বসবাসের এলাকা বের করে আজকের এই দিনে উনিশশো একাত্তরে লাশের মিছিল আয়োজন করেছিল। একথা আজ ওরা চেপে যেতে চায়। ওরা হিন্দুদের টার্গেট করে হত্যার কথা স্বীকার করতে চায় না! যেন এটা স্বীকার না করলে পাকিস্তানি শূয়রের বাচ্ছাদের সব অপরাধ মিটে যায়। ওরা কীভাবে পারে ত্রিশলাখকে তিন লাখ বানাতে, কী লাভ হয় তাতে! পাকিস্তানি মুসলিম ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যায়, ত্রিশ লাখ শুনলেই? 
     
    আপনি একবার কল্পনা করুণ, আপনার হিন্দু বন্ধুটি, অথবা অফিসের কলিগ, কিংবা পাড়ার বিন্দে কাকুটি, যার সাথে আপনার ভীষণ ভালো সম্পর্ক রয়েছে, শুধুমাত্র হিন্দু বলে তাকে কেউ মেরে ফেলেছে। আপনি পারবেন, সে খুনির নামে স্লোগান দিতে? আপনার বুকে বাঁধবে না? বিবেক আপনাকে তাড়া করবে না? নিশ্চয় করবে। আপনি ওই খুনির নামই উচ্চারণ করতে ঘৃণা করবেন, তাকে পেলে পায়ের তলায় পিষে ফেলতে চাইবেন। অথচ সেই আপনি কিনা, এদেশের লাখ লাখ হিন্দুদের ধরে হত্যা, ধর্ষণকারীর স্লোগান গর্বভরে উচ্চারণ করেন, আপনি বিবেচনাহীন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেন, কেবল ভারতের বিরোধিতা করার জন্য। আপনার কি লজ্জা লাগে না? ছাড়ুন হিন্দুর কথা। ও তো মালাউন। আপনার মুসলমান ভাই, বন্ধু, কিংবা বান্ধবীর কথা ধরুন, ধরুন পাশের বাড়ির রহিমা চাচির কথা। যে আপনাকে দেখলেই একগাল হেসে দেয়, ডাক দিয়ে বলে, বাবা বোস, পানি খা, বিস্কুট খা। সেই চাচির ধর্ষণকারী কিংবা হত্যাকারী, সেই বান্ধবী, সে বন্ধুর হত্যাকারীকে আপনি পিষে ফেলতে চাইবেন। অথচ আপনি আওয়ামীলীগের বিরোধীতা করার জন্য, ভারতের বিরোধিতা করার জন্য, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেন। যেই স্লোগান দিয়ে রক্তের তালাব বানিয়েছিল ওরা বাংলাদেশকে৷ আপনি কীভাবে পারেন, সেই স্লোগান গর্বভরে উচ্চারণ করতে? আপনার লজ্জা লাগে না? 
     
    আজকের এইদিনে যে বারো হাজার ভাই, বোন, পিতা-মাতা, নবজাতক, কিংবা জন্মই হয়নি, এবং যে গর্ভবর্তী বোনেরা রক্তের নির্দেশিকায় আমাদের পাইয়ে দিয়েছ আহা মরি বাংলাদেশ। তোমাদের আত্মত্যাগে আমাদের কোটি কোটি প্রণাম; তোমাদের রক্তের ঋণ আমরা কোনোদিন ভুলব না। কোনো দিন না।।
  • PRABIRJIT SARKAR | ২১ মে ২০২৫ ১৬:১৮744888
  • ১৯৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের হাতে বন্দি হওয়া পঞ্চাশ জনের বেশি ভারতীয় সৈন্য কোন দিন মুক্তি পায় নি। পাকিস্তান স্বীকার করেনি এদের কথা। তাই ইন্দিরা গান্ধী ওদের প্রায় লাখ খানেক সৈন্য মুক্তি দিল। কিন্তু এদের মুক্তি হয়নি। ওদের আত্মীয় পরিজন মাথা কুটে মরেও কিছু করতে পারেনি। শোনা যায় জুলফিকার আলী ভুট্টো জেলের মধ্যে বন্দি থাকার সময় এদের মরণ চিৎকারে ঘুমোতে পারতেন না।
    এই পাকিস্তানিরা এতই পাষন্ড।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন