রোজার শুরু মানেই স্মৃতির বই মেলে ধরে পড়তে শুরু করা। এ যেন নিজেকে আবিষ্কার করা আর শৈশব আর কৈশরে বিপণি বিতানগুলোতে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো এক কন্যার হাসি কান্না।
মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে জন্ম হয়েছিল বলেই অনেককেই কৌতুক করে বলতে শুনেছি সোনার চামচ মুখে নিয়ে নাকি জন্মেছি। বাবা ছিলেন অনেক পরিশ্রমী একজন মানুষ। চাকরির পাশাপাশি ব্যাবসা আর পৈতৃক সম্পত্তিও ছিল অনেক। সচ্ছলতার কারণেই হয়তো আমাদের ইদানন্দ ছিল একটু বেশি। কারণ তখনও মনে হত বাজারে টাকায় সুখ কেনা যায়।
আম্মা রোজার প্রথমদিন থেকেই কেনাকাটা শুরু করে দিতেন। আমাদের সকলের জন্য, বাসার কাজের লোকদের জন্য ,তাদের পরিবারের জন্য, জাকাতের কাপড়, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আম্মার প্রতিদিনের কেনাকাটার সঙ্গী ছিলাম আমি। আম্মা কখনও কোনো জিনিস পছন্দ হলেও এক দোকান থেকে কিনতেন না। তিনি ঘুরে ঘুরে দরদাম করে জিনিসপত্র কিনতে পছন্দ করতেন। চরম ক্লান্তিতে আমার পা লেগে আসত। আম্মা বলতেন, “আর একটু, আর একটু”। ধৈর্য কাহাকে বলে হয়তো তখন থেকেই শিখতে শুরু করেছিলাম। আম্মা সবসময় আব্বার দেওয়া বাজেটের নিচে সবাইকে জামা কিনে দিতেন। এবং বেঁচে যাওয়া টাকা আব্বুকে দিয়ে দিতেন।
এইরকম কোনো এক ইদে আম্মা আর আমি গেছি জামা কিনতে। আমার যে জামা পছন্দ হয় আম্মার সেটা পছন্দ হয় না। আম্মা বলে, “রংটা একদম তোমাকে মানাবে না, তুমি কালো তো তাই”। আমার আকাশে গহীন কালো অন্ধকার নেমে আসল এবং চোখও ঝাপসা, বারবার হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়েও আবার সোজা। যেন পড়ে গেলেই হেরে যাওয়া। দোকানদারের সামনে কেন এইভাবে আম্মা আমাকে কালো বলল? আসলে তো দাম বেশি তাই কেনেননি। জুতা কিনতে যেয়েও একই কাণ্ড, “হিল জুতা দেখাবেন না, আমার মেয়ে অনেক লম্বা, হিল জুতায় আরো লম্বা আর বিশ্রী লাগে দেখতে”। আবার চোখ ঝাপসা। যাহ্ আর কিছু নিজে থেকে পছন্দই করব না আজ। হাল ছেড়ে দিয়ে এক দোকানের সামনে বসে পড়লাম। আম্মা বলল, “চলো, আর বেশি ঘুরব না”।
এরপর আবার এ দোকান সে দোকান। একটা লাল জামা খুব পছন্দ হল, কিন্তু সেটাও কিনে দিল না। হালকা সাদা বা আকাশি রংয়ের একটা জামা কিনে দিল (সাদা বা আকাশি রংয়ের জামা ছাড়া আম্মা অন্য কোনো রংয়ের জামা খুব একটা কোনোদিন কিনে দিয়েছে বলে মনে পড়ে না)। তারপর খুব মন খারাপের জন্য একটা আইসক্রিম। খেতে খেতে বাড়ি ফেরা। আব্বু বাসায় আসার পর নালিশ, “এবার ইদের দিন নতুন জামাই পরব না”। আব্বু আম্মাকে কিছু বলতেই আম্মার কথা, “কত মানুষ নতুন জামাই পায় না, তোমরা যে এই পেয়েছ তাই শোকর করো”। মনে মনে প্রতিজ্ঞাত, যেদিন নিজেই আয় করব সেদিন বাজারের সবচেয়ে দামিটাই কিনব।
কিন্তু সত্যিই যেদিন নিজে আয় করেছি সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পেরেছি কি? আম্মা আমাদের অভাবী না হয়েও অভাবটা বুঝতে শিখিয়েছে। অপচয় না করতে শিখিয়েছে। অন্যের কথা ভাবতে শিখিয়েছে। আমাদের জন্য এতকিছু কিনলেও আম্মা আব্বুকে নিজেদের জন্য দামি কিছু কিনতে দেখিনি কখনই। বাবা মা আমাদের বুঝতে শিখিয়েছে অপচয় মানে অন্যেকে তার পাওনা থেকে বঞ্চিত করা। তাইতো ইদ আসলে এখনো নিজের থেকে অন্যের খুশিটাকেই বড় করে দেখতে পারি। কিন্তু কোনো ইদেই আমার নিজ হাতে বানানো আব্বুর প্রিয় গাজরের হালুয়া আর খেতে পারি না।